ফেরারি প্রেম পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
295

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৩৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

নীহারিকা পুরোপুরি হতাশ হয়ে সবিতার বাড়ি থেকে বিদায় নিলো। এই মাঝরাতে হঠাৎ সবিতার বাড়িতে আসার কারণটা সবিতা তেমন তলিয়ে দেখলনা! এই বিষয়ে তার কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিলনা!

নিরাশ ভাব নিয়ে নীহারিকা মাথা নুইয়ে রূপলের মুখোমুখি দাড়ালো৷ নীহারিকার সন্দেহ যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে তা নীহারিকার চুপসে যাওয়া মুখশ্রী দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে রূপল! তুখোর রগচটা ভাব নিয়ে রূপল নীহারিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই বুঝি এক্ষুণি নীহারিকার গালে কয়েক দফা চড় পরবে তার! রূপলের রাগের কারণ এবং সেই রাগের গভীরতা বুঝতে পেরে নীহারিকা মাথা উঠিয়ে ভীতু দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো! শুকনো গলায় বলল,

“বাবাড়ি চলুন।”

তৎক্ষনাৎ রাগে ফোঁস করে উঠল রূপল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে নীহারিকার দিকে ঝুঁকে এলো। ঝাঁজালো গলায় বলল,

“গো এলোন! ইস্টুপিট গার্ল!”

এই বলে রূপল তড়তড়িয়ে বাইকে ওঠে বসল। মুহূর্তেই অস্থির হয়ে উঠল নীহারিকা। অপমান গাঁয়ে লাগালোনা। বাইকের পেছনের গদিতে হাত রেখে সে রূপলের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ছটফটে গলায় বলল,

“সরি মিস্টার রূপল৷ এবারের মত আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ। পরের বার থেকে আর এমন ভুল হবেনা। আই সোয়ার।”

“আই ডোন্ট বিলিভ ইউ ওকে? যা ইচ্ছা তা করুন আপনি। তবে কোনোকিছুর মধ্যে আমাকে আর জড়াবেন না! আপনি আপনার পথে থাকুন, আর আমি আমার পথে।”

“আমি কিন্তু আপনাকে ফোর্স করিনি আমার সাথে এখানে আসার জন্য। একা একাই বের হচ্ছিলাম আমি। পরে যদি আপনি নিজে থেকে এসেই আমার সাথে জড়িয়ে পরেন সেখানে আমার কী দোষ বলুন?”

রূপল এখনও বুঝতে পারছেনা আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সে কেন নীহারিকার এক কথায় রাতে বিরাতে এভাবে ছুটে আসতে বাধ্য হলো! সেতো দিব্যি আরামের ঘুম ঘুমুচ্ছিল! এত আরামের ঘুম হারাম করে সে কেন এভাবে ছুটে এলো তাই যেন তার বোধগম্য হচ্ছিলনা। বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল রূপল। ইতস্তত দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। গলা ঝাকিয়ে বলল,

“ওঠে পড়ুন। এমনিতেই অনেকটা লেইট হয়ে গেছে।”

মিচকি হেসে বাইকের পেছনের গদিতে ওঠে বসল নীহারিকা। শোঁ শোঁ বেগে বাইক ছেড়ে দিলো রূপল। দুজনই নিশ্চুপ রইল। কারো মধ্যে কোনো কথা হলোনা। রাতের শীতল বাতাসটা দেহ-মন ছুঁয়ে দিচ্ছিল দুজনের। মনে জমে থাকা রুক্ষতা কেটে গেল নিমিষেই। দুজনকেই এখন স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। রাগের ছিঁটেফোঁটা নেই কারোর মধ্যে। প্রকৃতি কারো অবসাদ জিইয়ে রাখতে দেয়না!

কিছুক্ষণের মধ্যেই নীহারিকাদের বাড়ির সামনে নীহারিকাকে নামিয়ে দিয়ে রূপল কোনোরূপ কথা বার্তা ছাড়াই বাইক ঘুরিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। নীহারিকা অনেক চেয়েও রূপলের সাথে একটিবার কথা বলার সুযোগ পেলনা। ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছে তার মধ্যে। শুধুমাত্র সন্দেহের বশে ঘুমন্ত একটি মানুষকে রাতে বিরাতে ডেকে এনে সে অযথা হয়রানি করল।

গভীর আফসোস নিয়ে নীহারিকা বাড়ির ড্রইংরুমে প্রবেশ করতেই হঠাৎ চারিদিক থেকে ড্রয়িংরুমের লাইটগুলো জ্বলে উঠল! থতমত খেয়ে নীহারিকা সামনে তাকাতেই দেখতে পেল স্বয়ং পিয়াসা তার মুখোমুখি দাড়িয়ে! শুধু তাই নয় নিহাল এবং তার মা-বাবাও তার সামনে দাড়িয়ে। সবার চোখেমুখে প্রখর রাগী ভাব। ভয়ে শিউরে উঠল নীহারিকা। অমনি নীহারিকার বাবা তেড়ে এসে নীহারিকার মুখোমুখি দাড়ালেন। তটস্থ গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,

“এতরাতে কোথায় গিয়েছিলি তুই?”

শুকনো ঢোঁক গিলল নীহারিকা। কথা জড়িয়ে আসতে লাগল তার। “দশদিন চোরের, একদিন গেরস্তের!” এই বাংলা প্রবাদটি মনে পড়ে গেল তার! মিথ্যের আশ্রয় নিলো সে। আমতা আমতা গলায় বলল,

“ঘুম আসছিলনা বাবা। তাই একটু বাইরে গিয়েছিলাম হাঁটতে।”

তৎক্ষণাৎ নীহারিকার মুখের কথা টেনে নিলো পিয়াসা! খরখরে গলায় সে তার শ্বশুড়কে লক্ষ্য করে বলল,

“নীহারিকা মিথ্যা বলছে বাবা! আমি স্বচক্ষে দেখেছি নীহারিকা কারো সাথে বাইকে করে কোথাও একটা ঘুরতে যাচ্ছে! তবে পেছন থেকে বাইকে থাকা লোকটিকে আমি দেখিনি। তখন অলরেডি বাইকটা স্টার্ট করে দিয়েছিল তাই।”

নীহারিকা প্রথম থেকেই আন্দাজ করেছিল পিয়াসা-ই তার বিরুদ্ধে তার মা-বাবা এবং তার ভাইয়ের কাছে নালিশ করেছে! ঐ সময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে রান্নাঘরের দিকে যে ছায়াটি সে দেখেছিল সেটি তার মায়ের ছায়া নয় বরং তার ভাবি পিয়াসার ছায়া ছিল। এই বিষয়ে তার আর কোনো সন্দেহ রইল না। পিয়াসার কথা শেষ হতে না হতেই নীহারিকার বাবা ঠাস করে নীহারিকার গালে ঠাটিয়ে এক চড় বসিয়ে দিলেন! গালে হাত দিয়ে নীহারিকা তাজ্জব দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। নীহারিকার দিকে এক দফা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি জায়গা থেকে প্রস্থান নিতে নিতে বললেন,

“তোর থেকে এটা এক্সপেক্ট করিনি নীহা। তুই আমার অহংকার ভেঙে দিয়েছিস!”

মনে মনে বেজায় খুশি পিয়াসা! মুখ টিপে হাসতে লাগল সে! আপন মনে বিড়বিড় করে বলল,

“একদম ঠিক হয়েছে। আমাকে জ্ঞান দেওয়া তাইনা? ছোটোরা বেশী পাকামো করলে এমনই হবে!”

গভীর অনুতাপ নিয়ে নীহারিকার বাবা জায়গা থেকে প্রস্থান নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিসেস মারজিনা বেগম এবং নিহাল তেড়ে এলো নীহারিকার দিকে। ছিঃ চিৎকার করে মারজিনা বেগম নীহারিকাকে বললেন,

“মান সম্মান আর রাখলিনা তুই। বেশী স্বাধীনতা দিয়েছি বলে এভাবে তার অপব্যবহার করলি?”

প্রত্যত্তুরে নীহারিকাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিহাল তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কার সাথে তুই এতরাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলি বল? ছেলেটা কে ছিল?”

রাগে রি রি করে উঠল নীহারিকা! গালে হাত রেখে সে টলটলিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। চোয়াল উঁচিয়ে বলল,

“মিস্টার রূপলকেই জিজ্ঞেস করো ছেলেটি কে ছিল!”

এ কথা বলেই হনহনিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো নীহারিকা। হতভম্ব হয়ে সবাই নীহারিকার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। বিচলিত হয়ে পিয়াসা তৎক্ষনাৎ রূপলের নাম্বারে কল করল। বাড়ির কাছাকাছি পৌছে গেছে রূপল। পিয়াসার নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখে সে বাইকটি এক সাইডে থামিয়ে কলটি তুলল। শান্ত স্বরে রূপল হ্যালো বলতেই পিয়াসা প্রশ্ন ছুড়ল,

“কোথায় তুমি ভাইয়া?”

“এইতো একটু বাহিরে আছি। বাড়ির কাছাকাছিই আছি। কেন?”

“নীহারিকা কী এতক্ষণ তোমার সাথেই ছিল?”

আগপাছ না ভেবেই রূপল সোজাসাপটা গলায় বলে ফেলল,

“হ্যাঁ! কেন?”

মাথায় আগুন জ্বলে উঠল পিয়াসার! রাগান্বিত হয়ে সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“এসবের মানে কী ভাইয়া? এতরাতে নীহারিকা তোমার সাথে কী করছিল? কোথায় গিয়েছিল তোমরা? চলছেটা কী তোমাদের মধ্যে?”

“আশ্চর্য তো! এই সামান্য বিষয়টাকে নিয়ে তুই এত হাইপার হচ্ছিস কেন? তাছাড়া তুই যা সন্দেহ করছিস সেই রকম কোনো সম্পর্ক নেই আমাদের মধ্যে। নীহারিকা একটি প্রয়োজনেই বলেছিলেন বের হতে। আদার’স আর কিছু নয়।”

“এতরাতে রাতে তার কী এমন প্রয়োজন পরল ভাইয়া? যে তোমাকে সাথে করে তার বের হতে হলো? তোমাদের সম্পর্কটা আমার মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছেনা।”

পিয়াসার মনগড়া কথায় রাগে তেতে উঠল রূপল। তর্জন গর্জন করে সে পিয়াসাকে শাসিয়ে বলল,

“না বুঝে ফালতু কথা বলবিনা পিয়াসা। আমার থেকে দূরে আছিস বলে বেঁচে গেছিস। এই মুহূর্তে যদি তুই আমার সামনে থাকতিস ঠাটিয়ে দুটো চড় খেতিস! ফোন রাখ ইডিয়ট।”

পিয়াসাকে ঝারি মেরে কলটি কেটে দিলো রূপল! রাগে গজগজ করে পিয়াসা জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। রূপলের হুমকি ধমকি সহ্য হলোনা তার! বাড়াবাড়ি মনে হলো। নিহাল এবং মারিজনা বেগম নির্বাক হয়ে জায়গায় দাড়িয়ে রইলেন। কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে এর কিছুই বুঝতে পারছেনা তারা! সম্পূর্ণ ঘটনা জানার জন্য নিহালও কৌতূহল নিয়ে পিয়াসার পিছু পিছু তাদের বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল। দাড়িয়ে রইলেন শুধু মারজিনা বেগম।

ফোনটি প্যান্টের পকেটে গুজে রূপল কয়েকদফা রুদ্ধশ্বাস ফেলল। ঘামে ভেজা কপালে লেপ্টে থাকা অগোছালো চুলগুলো টেনে ধরল সে। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে চিন্তিত গলায় বলল,

“ডেম ইট। এবার থেকে আমাকে যতটা সম্ভব নীহারিকার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। সবাই অযথা সন্দেহ করছে আমাদের সস্পর্কটা নিয়ে। যা কখনও হবার নয় তা নিয়ে কেউ সন্দেহ করুক আই কান্ট একসেপ্ট ইট।”

নিহাল অনেক চেষ্টা করেও পিয়াসার মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারল না। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে পিয়াসা জিম খিঁচে বিছানার এক কোণায় শুয়ে আছে! নিহাল তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেই তাকে ঝারি মেরে উঁড়িয়ে দিচ্ছে! কোনো মতে রাতটা পাড় হোক। সকালেই সে তার বাপের বাড়িতে যাবে! রূপল এবং নীহারিকার অবাধে মেলামেশা নিয়ে তার মায়ের কানে বিষ ঢেলে আসবে!

ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নীহারিকা এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পরল৷ সে জানে তার সাথে ইদানিং যেসব আজব ঘটনা ঘটছে তা যদি সে গলা কেটেও সবাইকে বলে তবুও কেউ তা বিশ্বাস করবেনা! বরং সবাই তাকে ভুল বুঝবে৷ প্রমাণ চাইবে। কিন্তু সেই প্রমাণ তো তার পক্ষে এখনও জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য তাকে আরও অপেক্ষা করতে হবে।

___________________________________

পরদিন সকালে পিয়াসা তার বাড়িতে গেল। রূপল এবং নীহারিকার সম্পর্ক নিয়ে তার মায়ের কান ভাঙিয়ে আসল! বলল রূপলকে চোখে চোখে রাখতে। নীহারিকার ধারে কাছেও যেন রূপল ঘেঁষতে না পারে। সব শুনে নাজনীন বেগম রাগে ফুলে ফেঁপে উঠলেন! পিয়াসার কথা যদি সত্যি হয় তবে কিছুতেই তিনি রূপল এবং নীহারিকার সম্পর্ক মেনে নিতে পারবেন না! নীহারিকার মত কালো এবং বেঁটে মেয়ে কোনোভাবেই রূপলের মত সুদর্শন ছেলের জন্য যোগ্য নয়! ছেলেকে নিয়ে বেশ অহংকারে গাঁ ভাসাচ্ছেন তিনি! পা যেন মাটিতেই পরছিল না।

মাঝখানে কেটে গেল প্রায় মাস খানেক! সেদিনের পর থেকে রূপল এবং নীহারিকার মাঝে কোনো যোগাযোগ হয়নি। দুজন দুজনের পথে আলাদা চলছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সেদিনের পর থেকে নীহারিকার নাম্বারে সেই অচেনা নাম্বারগুলো থেকে ফোন কল আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল! এর উপযুক্ত কারণ নীহারিকা খুঁজে পাচ্ছিলনা। তাকে ভয় দেখানো সেই মহিলা এবং পুরুষটিকে একটি বারের জন্যে হলেও নীহারিকা দেখতে চায়। এই অচেনা আগন্তুকগুলোর জন্যই নীহারিকার পরিবার নীহারিকাকে আগের মত বিশ্বাস এবং ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছে। তার বাবার সাথে তার দূরত্ব তৈরী হয়েছে! রূপল এবং তার স্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়ে আঙুল উঠেছে।

এরমধ্যেই রূপল ব্যস্ত হয়ে গেছে তার চাকুরীর প্রিপ্রারেশন নিয়ে! মাস্টার্স পাশের সার্টিফিকেট নিয়ে এভাবে বেকার অবস্থায় ঘরে বসে থাকার কোনো মানে হয়না। একই সাথে সুহাসিনীকে ভুলে থাকার প্রয়াসে সে নিজেকে পড়াশোনা এবং বিভিন্ন কাজে কর্মে ব্যস্ত রাখতে চাচ্ছে। জীবনের ঘটে যাওয়া কালো অধ্যায়টিকে সে চিরতরে মুছে ফেলতে চাইছে!

প্রায় দুইদিন আগে নীহারিকার ইনকোর্স এক্সাম শেষ হলো। মাসের শুরুতেই সে একটি টিউশন নিয়েছে! ক্লাস সেভেনে পড়ে মেয়েটি। টুকটাক হাত খরচের জন্য টিউশনিটি নেওয়া তার। প্রতিদিন হাত পেতে তার বাবা এবং ভাইয়ের কাছে টাকা চাইতে বড্ড অস্বস্তি হয় তার৷ এরচেয়ে ভালো বরং নিজের মেধা এবং সময় কাজে লাগিয়ে হাত খরচের টাকাটা নিজেই উপার্জন করা। প্রতিদিনের মত আজও নীহারিকা সন্ধ্যা সাতটায় বের হয়ে গেল টিউশনির উদ্দেশ্যে।

রাত দশটা নাগাদ সে টিউশনি থেকে বের হয়ে এলো! ছাত্রীর বাড়িতে আজ ডিনারের দাওয়াত ছিল তার। বাড়ির সবাইকে আগে থেকেই বলে এসেছে সে। নিহাল রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে নীহারিকাকে ড্রপ করে আনবে এই কথা ছিল। তবে এরমধ্যেই নিহাল অফিসের কাজে বেশ ব্যস্ত হয়ে গেল। জরুরী মিটিং পড়ে গেল তার। তাই সে নীহারিকাকে বলল একটু অপেক্ষা করতে।

তবুও নীহারিকার যেন তড় সইছিল না। তাই সে একাই ছুটল বাড়ির উদ্দেশ্যে। দু-একটা খালি রিকশা যদিও সে দাঁড় করিয়েছিল তবে অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ায় সে না করে দিলো। ফুটপাত ধরে সে একাই হাঁটতে লাগল। রাস্তার পাশে থাকা বড়ো একটি বটগাছের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেই নীহারিকার গাঁ টা হঠাৎ ছমছম করে উঠল! অজানা কারণে গাঁ টা শিউরে উঠল তার। আশপাশটা ভীষণ নিরিবিলি। ল্যাম্পপোস্টের আলো পৌঁছাচ্ছিলনা সেখানে। মৃদু অন্ধকারে ঢাকা পরিবেশ।

নীহারিকার আশঙ্কাই সত্যি হলো! পেছন থেকে কেউ তাকে মুখ চেপে ধরল! পুরুষালী শক্ত হাত৷ নীহারিকা কিছুতেই সেই শক্ত হাতের বাঁধন খুলতে পারছিলনা। অন্তরআত্তা কেঁপে উঠল তার। ভয়ে হাঁসফাঁস করতে লাগল সে। মুখ চেপে ধরে রাখার দরুন সে চিৎকার করতে পারছিলনা। নীহারিকাকে টেনে হেছড়ে আগন্তুকটি রাস্তায় দাড় করিয়ে রাখা তার গাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেতেই নীহারিকা তার উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগালো! পা দ্বারা নীহারিকা সুযোগ বুঝে লোকটির মেইন পয়েন্টে জোরে একটি লাথ দিলো! সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি আহ্ করে চিৎকার করে উঠল। হাতের বাঁধনও খুলে গেল তার। ছাড়া পেয়ে নীহারিকা তাৎক্ষণিক পিছু ঘুরে তাকালো।

মৃদু অন্ধকারেও শাফকাতকে চিনতে বেশী বেগ পেতে হলোনা নীহারিকার! বিধ্বংসী রূপ নিয়ে সে শাফকাতের গলার টুটি চেপে ধরল। শক্ত গলায় বলল,

“কু’ত্তা’র বাচ্চা! তুই?”

ইতোমধ্যে রূপলও ঘটনাস্থলে চলে এলো! হন্ন হয়ে সে শাফকাত এবং নীহারিকার দিকে ছুটে এলো। অনেকক্ষণ যাবত নীহারিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল সে। শাফকাত এবং নীহারিকাকে ঐ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখে বুঝতে বেশী বেগ পেতে হলোনা কী হচ্ছে এখানে। কারো সাথে কোনো টু শব্দ না করেই রূপল শাফকাতকে এলোপাতাড়ি কি’ল-ঘু’ষি দিতে লাগল! তাজ্জব হয়ে গেল নীহারিকা! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে রূপলের দিকে তাকালো। বলল,

“আপনি এখানে?”

“জিজু বলল আপনাকে রিসিভ করতে।”

#চলবে…?

[রি-চেইক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৩৮
#নিশাত_জাহান_নিশি

“জিজু বলল আপনাকে পিক করতে।”

রূপলের উত্তম-মধ্যম মারের চোটে শাফকাত ব্যথায় আর্তনাদ করতে লাগল! ডানপিটে রূপলকে কোনোভাবে থামাতে না পেরে শাফকাত করুন গলায় রূপলকে অনুরোধ করে বলল,

“ভাই ভাই প্লিজ ছেড়ে দিন। এবারের মত আমাকে মাফ করে দিন।”

আক্রমনাত্নক রূপল যেন কিছুতেই শাফকাতের অনুনয়ে বিনয়ে ক্ষান্ত হচ্ছিলনা। বরং শাফকাতকে পুরোপুরি আ’হ’ত করাটা তার এই মুহূর্তে লক্ষ্য হয়ে দাড়িয়েছিল! বর্বর রূপ নিয়ে রূপল তর্জন গর্জন করে বলল,

“শাট আপ। জাস্ট শাট আপ। আগের বারও ছাড় দিয়েছিলাম তোকে। তবে এবার আর নয়। বার বার এভাবে ছাড় দিতে থাকলে তো তুই পেয়ে বসবি। পরের বার আরও বেশী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবি। সাহস বেড়ে যাচ্ছে তোর দিন দিন। বেশী উড়ে গেলে সেই পাখা কীভাবে ছাটাই করতে হয় রূপলের বেশ ভালোভাবেই জানা আছে।”

এলোপাথাড়ি কি’ল ঘু’ষি’তে শাফকাতের নাক-মুখ থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পরছিল। নির্জীব হয়ে আসছিল তার দেহ। মাটিতে লুটিয়ে পরার মত অবস্থা। এই পর্যায়ে এসে নীহারিকা বেশ ভয় পেয়ে গেল! রূপলকে থামানোর চেষ্টা করল সে। শরীরের সমস্ত শক্তি কাজে লাগিয়ে সে রূপলকে পেছন থেকে টেনে আনার অভিপ্রায়ে লিপ্ত হলো। ভীরু গলায় বলল,

“প্লিজ মিস্টার রূপল ছাড়ুন তাকে। সামান্য মশা মেরে নিজের হাত নোংরা করে কোনো লাভ আছে বলুন?”

পিছু ফিরে রূপল রাগী দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। উত্তেজিত গলায় বলল,

“তার সাহসটা একবার চিন্তা করে দেখুন। আপনি আমার রিলেটিভ জানা সত্ত্বেও তার সাহসে কীভাবে কুলালো দ্বিতীয় বার আপনার ক্ষতি করার?”

“শান্ত হোন প্লিজ। নেক্সট টাইম আর এমন ভুল করবেনা সে। যদি লাজ লজ্জার বালাই থাকে তো। ভয়ভীতি তার মধ্যে কাজ করে তো।”

রূপলের শক্তির সাথে পেরে উঠছিলনা নীহারিকা। তবুও নীহারিকা চেষ্টা করল রূপলকে টেনে হেছড়ে বাইকের দিকে নিয়ে যাওয়ার। ছাড়া পেয়ে শাফকাত যেন বাঘের মত গর্জন করে উঠল! নাক-মুখ থেকে গড়িয়ে পরা রক্তগুলো সে মুছে নিলো। নীহারিকাকে উদ্দেশ্য করে বিদ্রুপের স্বরে বলল,

“দেখব তোকে কোন শালা বিয়ে করে! কালো হয়েও দেমাগ কমেনা! তোর সাত কপালের ভাগ্য যে আমার মত একটা স্মার্ট ছেলে তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিল! আজীবন তোকে কুমারী হয়ে থাকতে হবে। পাড়ায় থেকে বুড়ি হবি তুই!”

আর এক সেকেন্ডও জায়গায় দাড়ালোনা শাফকাত। গাড়িতে ওঠে জায়গা পরিত্যাগ করল। চোখ দুটো ছলছল হয়ে উঠল নীহারিকার! শুধু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা। শাসিয়ে উঠল রূপল। শাফকাতের যাওয়ার পথে তাকিয়ে যতটুকুনি সম্ভব চিৎকার করে বলল,

“ইউ ব্লা’ডি, বি’চ। নেক্সট টাইম হাতের কাছে পেয়ে নিই তোকে। এবার তোকে আমি মা’র্ডা’র করেই ছাড়ব!”

কান্না বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারলনা নীহারিকা। হেচকি ওঠে গেল তার! আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে রূপল পাশ ফিরে নীহারিকার দিকে তাকালো। নীহারিকার কান্নার ঢল দেখে রূপল উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল! ফিচেল স্বরে বলল,

“হেই নীহারিকা? আপনি কাঁদছেন কেন? একটা ফা’ল’তু ছেলের কথা শুনে আপনি কাঁদছেন?”

মাথা নুইয়ে নিলো নীহারিকা। ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল,

“ছেলেটা ফা’ল’তু হলেও সে যা বলেছে মোটেও মন্দ কিছু বলেনি! আমিও বিশ্বাস করি আমার লাইফে কখনও এমন কেউ আসবেনা যে আমার সকল দুর্বলতাগুলো মেনে নিয়ে আমাকে গ্রহণ করবে!”

“আমি সবসময় ভাবতাম আপনি মেয়েটা খুব লজিক্যাল! কিন্তু এই সময়টাতে এসে মনে হচ্ছে আপনি পুরো বাচ্চা স্বভাবের একটি মেয়ে! জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিনটিই কিন্তু বিধাতার লিখন। ইভেন আল্লাহ্ জোড়া ছাড়া পৃথিবীতে কাউকে পাঠাননি! শুধু ধৈর্য্য নিয়ে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হয়। যে যাই বলুক কারো কথা গাঁয়ে মাখালে চলবে না। আশা করছি বিষয়টা আপনাকে বুঝাতে পেরেছি?”

রূপলের কথায় যদিও নীহারিকা স্বস্তি খুঁজে পেল তবে এই মুহূর্তে নিজের আবেগকে সংযত করতে পারছিলনা সে। প্রতিনিয়ত সমাজের করা কটাক্ষ তার শ্বাস রুদ্ধ করে দিচ্ছিল। এই সময় শান্তনার বাণীও নিছক অবান্তর মনে হচ্ছিল। কান্নারত অবস্থাতেই নীহারিকা ভরাট গলায় রূপলকে বলল,

“আমি বাড়ি যাব।”

“হ্যাঁ। বাড়িতো যাবই। তবে আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো? এত ভালো করে বুঝানোর পরেও আপনি কাঁদছেন কেন? আমার কথায় ট্রাস্ট হচ্ছেনা আপনার?”

চোখ ভর্তি জল নিয়ে নীহারিকা নিশ্চল দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো। হীনমন্যতায় ভুগে জনাজীর্ণ গলায় বলল,

“শুধু যে আজই আমার গাঁয়ের রঙ নিয়ে আমাকে বিদ্রুপের মুখে পরতে হয়েছে তা কিন্তু নয় মিস্টার রূপল। বরং প্রতিদিন, প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে সমাজের কাছে, প্রতিবেশীদের কাছে, আত্নীয়-স্বজনদের কাছে খোঁটা শুনতে হয়েছে ইভেন এবং হচ্ছেও! কতদিন আর নিজের পেশেন্স ধরে রাখব বলুন? আমিও তো মানুষ। আমারও কষ্ট হয়। কান্না পায়। আমিও ভেঙে পড়ি।”

নীহারিকার কষ্ট, যন্ত্রণা, মন খারাপকে প্রশ্রয় দিতে চাইলনা রূপল। বরং হেসে উড়িয়ে দিলো বিষয়টা। এই প্রথম নীহারিকার দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো রূপল! কোনোরূপ রাগ, বিদ্বেষ, ঘৃণা ছাড়াই! উচ্ছ্বল এক দৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে তাকালে অনায়াসে দুঃখ ভুলে থাকা যায়! শিথীল গলায় রূপল নীহারিকাকে বুঝিয়ে বলল,

“সমাজ বলুন প্রতিবেশী বলুন কিংবা আত্নীয় স্বজন বলুন তারা কী আপনাকে খাইয়ে পরিয়ে রাখে যে তাদের কথায় আপনি কষ্ট পাবেন? ভেঙে পরবেন? বরং তখন আপনার কষ্ট পাওয়া উচিৎ যখন দেখবেন আপনার পরিবারের কোনো সদস্য আপনার দুর্বলতা নিয়ে কটাক্ষ করছে! যে পরিবারে আপনি থেকে, খেয়ে, মানুষ হচ্ছেন সেই পরিবারের মানুষদের যেহেতু আপনার গাঁয়ের রঙ নিয়ে অথবা আপনার অন্যান্য দুর্বলতাগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই সেখানে সমাজের দু’একটা কথায় আপনি এত ভেঙে পরছেন কেন নীহারিকা? হোয়াই?”

রূপলের শীতল দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো নীহারিকা। সাহস হলোনা সেই আবেদনময় দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখার! বেদনাবিধুর গলায় পুনরায় বলল,

“প্লিজ আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রূপল নীহারিকার উদ্দেশ্যে বলল,

“ওকে। বাট একটা শর্ত আছে!”

“কী শর্ত?”

“আমাকে প্রমিস করতে হবে যে, বাসায় গিয়ে কোনো রকম কান্নাকাটি করা যাবেনা! যদি আপনি আমার এই শর্তে রাজি হোন তো, তবেই আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব।”

অমনি ছ্যাত করে উঠল নীহারিকা! রূপলকের বাইক থেকে নেমে পড়ল সে! রাগ দেখিয়ে দাঁত গিজগিজিয়ে বলল,

“আমি পায়ে হেঁটেই বাড়ি যেতে পারব!”

গাঁ ছাড়া ভাব নিলো রূপল। ঘামে ভেজা শার্টের কলারটা পেছনের দিকে এলিয়ে দিলো। বাইকের স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“ওকে। বাট দেখবেন মাঝরাস্তায় যেন আবার শাফকাত এসে আপনাকে নিয়ে টানা হেছড়া না করে! পুরুষ মানুষ তো। আমি চিনি তারা কেমন হয়!”

ভয় পেয়ে গেল নীহারিকা! তড়িঘড়ি করে সে রূপলের বাইকের পেছনে ওঠে বসল। অস্থির হয়ে চিন্তিত গলায় বলল,

“বাইকটা ছাড়ুন।”

“কেন? একা যাবেন না? অমনি সাহস সব ফোঁস হয়ে গেল?”

সাহসী ভাব নিলো নীহারিকা! গাঁ ঝারা দিয়ে বসল সে। অবিচল গলায় বলল,

“ভীতু নাকী আমি? যে সাহস সব ফোঁস হয়ে গেল? নেহাত ভাইয়া আপনাকে পাঠিয়েছে আমাকে পিক করার জন্য। তাই ভাইয়ার সিদ্ধান্তকে সম্মান করার জন্যই আমি বাধ্য হয়ে আপনার বাইকে উঠতে রাজি হলাম।”

নাক ঘঁষে রূপল বলল,

“কথায় কেউ হারাতে পারবেনা! যাই হোক, আমার দায়িত্ব আমি পালন করে আসি।”

বাইক স্টার্ট করে দিলো রূপল। কিছুদূর যেতেই মেইন রাস্তার পাশে একটি ফুচকার স্টল দেখা গেল। হুট করেই রূপল স্টলটির সামনে বাইকটি থামিয়ে দিলো। ততক্ষণে জিভে জল চলে এলো নীহারিকার! রূপলের জায়গায় নিহাল থাকলে নীহারিকা সেই অনেকক্ষণ আগেই বাইক থেকে চ্যাচাতো তাকে ফুচকা খাওয়ানোর জন্য! তবে মুখে কিছু বলার আগেই যে রূপলকে জায়গামত বাইক থামিয়ে দিবে বুঝতে পারেনি নীহারিকা৷ এতে বরং ভীষণ অবাক-ই হলো নীহারিকা! হতভম্ব দৃষ্টিতে সে ঘাড় বাঁকিয়ে রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল! পিছু ঘুরে তাকালো রূপল। নীহারিকাকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রূপল ভ্রু যুগল কুঁচকালো! প্রশ্ন ছুড়ল,

“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

অবিলম্বেই ঘাড় সোজা করে নিলো নীহারিকা! থতমত গলায় বলল,

“না মানে। হঠাৎ এখানে বাইকটা থামালেন তাই কিউরিসিটি হচ্ছিল।”

“ফুচকা খাবেন?”

এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি শুরু হলো! লোভ নিয়ে নীহারিকা খাব বলার ক্ষণেই ভেবে বসল অন্যকিছু! শুকনো গলায় সে রূপলকে শুধাল,

“বিল দিবে কে?”

“কে আবার? আপনি!”

“আমি? কিন্তু আমার কাছে তো কোনো টাকা নেই!”

“তাহলে এখানে বাইকটা থামাতে বললেন কেন?”

“কী? আমি কখন বললাম আপনাকে বাইক থামাতে?”

“ওহ্৷ বলেন নি?”

“না তো!”

“কিন্তু আমিতো ফিল করছিলাম কেউ মনে মনে বলছিল ইশ বাইকটা যদি এখানে কেউ থামাত!”

বোকা বনে গেল নীহারিকা। নির্বোধ ভঙ্গিতে সে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,

“কী আশ্চর্য! লোকটা কী আমার মনের কথা পড়তে পেরেছিল? সত্যিই তো আমি মনে মনে ভাবছিলাম বাইকটা যদি এখানে দাড় করাত। তাহলে তো ফুচকা খেতে পারতাম!”

গলা ঝাকালো নীহারিকা। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,

“দেখি বাড়ি চলুন।”

“কেন? ফুচকা খাবেন না?”

“বললাম তো টাকা নেই।”

“তাহলে ধার নিন!”

“আপনি ধার দিবেন?”

“পরে সুদসহ দিবেন। আমি মাইন্ড করবনা!”

এই বলেই ব্যগ্র হাসল রূপল! নীহারিকাকে রাগাতে তার বেশ ভালোই লাগছিল। ভেতরে ভেতরে নীহারিকা রাগে ফুসছিল! এই চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকার জন্য লোকটা কী-না তার কাছে ধারের সাথে সুদও চাইল? এত ছ্যাচড়া কেন এই লোক? ফুচকা খাওয়ার লোভের কাছে যেন রূপলের ছ্যাচড়ামিও হার মানল নীহারিকার কাছে! নিরুপায় গলায় সে বলল,

“আচ্ছা সুদও দিব। বিলটা এখন দিয়ে দিবেন প্লিজ।”

এই বলেই নীহারিকা বাইক থেকে নেমে গেল। নীহারিকার উচ্ছ্বলতা দেখে রূপল ফিচেল হাসল! প্রাণোচ্ছ্বল নীহারিকার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

“একটুকুতেই কত খুশি মেয়েটা! অথচ এতক্ষণ কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিচ্ছিল! এখন তাকে দেখে কেউ বলবে? যে সে একটু আগেও নিজেকে অপমানিত, ঘৃণিত মনে করছিল?”

এক প্লেটের জায়গায় নীহারিকা দুই প্লেট ফুচকা খেল! পাশের টং দোকানে দাড়িয়ে রূপল সিগারেট ধরালো। নীহারিকার দুই প্লেট ফুচকা শেষ হতে হতে রূপলও নিমিষেই এক প্যাকেট সিগারেট টেনে শেষ করে ফেলল! ইদানিং অতিরিক্ত ধূমপান করছে রূপল। চেয়েও তা কমাতে পারছেনা। হয়ত রক্তের সাথে মিশে গেছে! ধার দেওয়ার বিষয়টা নেহাতই রূপলের মশকরা ছিল! নীহারিকাকে রাগানোর পন্থা। এতে নীহারিকার তো শুধু রাগই হলোনা বরং রূপলের সম্পর্কে তার খারাপ ধারণারও সৃষ্টি হলো! এতে অবশ্য রূপলের কিছু আসে যায়না। কারণ সে জানে ধীরে ধীরে নীহারিকার ভুল ভেঙে যাবে!

রাত এগারোটা নাগাদ রূপল নীহারিকাকে তার বাড়ি পৌঁছে দিলো। পিয়াসা এবং মারজিনা বেগমের অনুরোধে রূপল রাতের খাবারটা তাদের বাড়িতে খেতে বাধ্য হলো। রূপল চলে যাওয়ার পর পিয়াসা কোমর বেঁধে ঝগড়া লেগে গেল নিহালের সাথে! চোয়াল উঁচিয়ে সে নিহালের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“এই? কোন সাহসে আপনি আমার ভাইয়াকে অর্ডার করেন আপনার বোনকে পিক করতে? যেখানে আমি এবং আমার মা পছন্দ করিনা ভাইয়া এবং নীহারিকার সম্পর্কটাকে?”

সারাদিনের ব্যস্ততা এবং ক্লান্তির পর নিহাল মাত্র বিছানায় পিঠ লাগিয়েছিল। এরই মধ্যে পিয়াসার অবান্তর কথাবার্তা৷ সব মিলিয়ে নিহাল খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বলল,

“সময় গময় বুঝোনা তুমি? কখন কাকে কী বলতে হয় জানো না? তোমাদের প্রবলেম কী রূপল এবং নীহারিকার সম্পর্ক নিয়ে? তারা তো প্রেম করছেনা যে এতে তোমাদের কোনো প্রবলেস হচ্ছে? ফ্রেন্ড হিসেবে তারা একসাথে চলাফেরা করতেই পারে!”

অমনি অট্ট হাসিতে ফেটে পরল পিয়াসা! ঠাট্টার স্বরে বলল,

“প্রেম? তাও আবার আপনার বোন কালীটার সাথে আমার সুদর্শন ভাই রূপলের? হাউ ফানি নিহাল! তা এই জীবনে সম্ভব নয়!”

নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলনা নিহাল! তেড়ে এসে প্রথম বারের মত সে পিয়াসার গালে ঠাস করে একটি চ’ড় বসিয়ে দিলো! দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“নেক্সট টাইম আমার বোন সম্পর্কে আর একটা বাজে কথা শুনব তো তোমাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হব আমি! মাইন্ড ইট!”

ট্রে তে করে নীহারিকা গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে এসেছিল নিহাল এবং পিয়াসার জন্য! দরজায় দাড়িয়ে সে এতক্ষণ সব শুনছিল। পিয়াসার কথায় ভীষণ কষ্ট পেল নীহারিকা। দরজার সামনে ট্রে টি রেখে নীহারিকা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে তার রুমে চলে গেল!

#চলবে…?

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৩৯
#নিশাত_জাহান_নিশি

ট্রে তে করে নীহারিকা গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে এসেছিল নিহাল এবং পিয়াসার জন্য! দরজায় দাড়িয়ে সে এতক্ষণ সব শুনছিল। পিয়াসার কথায় ভীষণ কষ্ট পেল নীহারিকা। দরজার সামনে ট্রে টি রেখে নীহারিকা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে তার রুমে চলে গেল!

চ’ড় খেয়ে পিয়াসা হতভম্ব হয়ে নিহালের দিকে তাকিয়ে রইল! চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেল। শ্বাস প্রশ্বাসও তার থমকে এলো! আদোতেই সে বিশ্বাস করতে পারছেনা নিহাল তার গাঁয়ে হাত উঠিয়েছে। শুধু তাই নয় তাকে সরাসরি ডিভোর্সের কথাও জানিয়ে দিয়েছে! রাতারাতি জীবনের এতবড়ো অলক্ষুণে সিদ্ধান্তটি নেওয়া কীভাবে সম্ভব? এদিকে তুখোর রাগের বশবর্তী হয়ে নিহাল পিয়াসার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। পিছু ফিরে পুনরায় বিছানায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল,

“প্রশ্রয় দিচ্ছি বলে দিন দিন সাহস বেড়ে যাচ্ছে তার। আমার বোনকে নিয়ে কটুক্তি করা। মাথায় তোলার পর কীভাবে আ’ছা’ড় দিয়ে মাথা থেকে নামাতে হয় তা আমার বেশ ভালোভাবেই জানা আছে!”

উগ্র মেজাজ নিয়ে নিহাল বিছানায় কাত হয়ে শুলো। অমনি পিয়াসা হাত-পা ছুঁড়ে বাজখাঁই গলায় মৃদু চিৎকার করে বলল,

“কী বললেন আপনি? সত্যি বলার অপরাধে আপনি আমাকে ডিভোর্স দিবেন?”

শোয়া থেকে তড়তড়িয়ে ওঠে বসল নিহাল। পিয়াসাকে এই মুহূর্তে খু’ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছিল তার! একদমই সহ্য হচ্ছিলনা তাকে। ঝাঁজাল গলায় সে পিয়াসাকে শাসিয়ে বলল,

“এই কীসের সত্যি হ্যাঁ? কীসের সত্যি? আমার বোনকে ছোটো করে কথা বলা তোর কোন সত্যির আওয়াত পড়ে? বুঝা আমাকে?”

“কী বললেন? আপনি আমাকে তুই তুকারিও করছেন?”

“যেখানে আমাদের সম্পর্কটা ডিভোর্সের দিকে চলে যাচ্ছে, সেখানে তুই শব্দটা কী খুব বেশি বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে তোর কাছে? ভাগ্য ভালো আমি তোকে এখনও তালাক দিইনি!”

মরা কান্না জুড়ে দিলো পিয়াসা! মাথায় হাত দিয়ে সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। হায় হুতাশ করে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল,

“এ কার কাছে আমাকে বিয়ে দিলো আমার মা-বাবা? বোনের পক্ষ নিয়ে যে কী-না তার স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করছে? তার গাঁয়ে হাত তুলছে, তাকে তুই-তুকারি ও করছে, এমনকি তাকে তালাক দিতেও একবার ভাবছেনা! আমি এক্ষুণি আমার বাপের বাড়িতে চলে যাব! থাকবনা আর এই বাড়িতে।”

“যা! এক্ষুণি বের হবি তুই আমার বাড়ি থেকে! অনেক সহ্য করেছি তোকে আর নয়। বিয়ের দিন যা কেলেঙ্কারি করেছিলি তুই। নেহাত আমি ভালো বংশের ছেলে বলে তোকে আজও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি! কিন্তু তোর কপালে তো সুখ সইছেনা। আট পাঁচটা নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়েদের মত স্বামীর মন থেকে ওঠে শ্বশুড় বাড়ির লেটা চুকিয়ে বাপের বাড়িতে আজীবনের জন্য বোঝা হয়ে পরে থাকবি এটাই তোর জন্য ভালো!”

নিহালের সহাভূতি পেতে গিয়ে নিজের অবস্থানটা আরও নড়বড়ে করে ফেলল পিয়াসা! খামোশ খেয়ে গেল সে। আতঙ্কিত দু-চোখে রাগে ক্ষিপ্র নিহালের দিকে তাকিয়ে রইল। বিয়ের পর এই প্রথম নিহালকে এত রাগতে দেখল সে! এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা নিহাল রেগে গেলে এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। যার মধ্যে বিন্দুমাত্র দয়া মায়া কাজ করেনা! সম্পর্কের প্রতি টানও থাকেনা। পিয়াসার ভীতু অবস্থা এবং নীরবতা দেখে নিহাল শেষবারের মত পিয়াসার দিকে আঙুল তুলে বলল,

“এখনও সময় আছে ভালো হয়ে যা তুই। স্বামী এবং তার পরিবারকে মূল্যায়ন করতে শিখ। তাদের আপন করতে শিখ। তুই আমার বোনের পেছনে যতটা লেগে থাকিস তার এক অংশও যদি আমার বোন তোর পেছনে লাগত তাহলে না হয় তার বিরুদ্ধে করা তোর অভিযোগগুলো মানা যেত। যেখানে আমার বোন তোর প্রতি এতটা সদয় সেখানে তুই তার প্রতি কেন এতটা নির্দয়? আবারও সতর্ক করছি তোকে ভালো হয়ে যা তুই। আজকের জন্য তেকে ছাড় দিলেও পরেরবার কিন্তু আমি তোকে ছাড় দিবনা। মাইন্ড ইট।”

উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল নিহাল। চোখ বুজে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করল। মনে অশান্তি নিয়ে কীভাবে শান্তিতে ঘুমুতে হয় তা জানা নেই তার। নিহালের প্রতি ভয় বাড়তে লাগল পিয়াসার! কান্না থামিয়ে সে বসা থেকে ওঠে দাড়ালো। একপ্রকার তব্দা লেগে গেল সে! রুমের সমস্ত আলো বন্ধ করে সে চুপিসারে সোফায় চুপটি করে শুয়ে পড়ল! বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

“শুধু বাপের বাড়ির মানুষগুলো ঠিক নেই বলে আজ আমি তার সব অ’প’মান সহ্য করে নিলাম! আমার বাপ আর ভাই যদি ঠিক থাকত তাহলে এতক্ষণে তার মুখের উপর থু থু ছিটিয়ে কখন এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতাম! এই সংসারে আর ভালো লাগছেনা আমার! বাকিটা জীবনও হয়ত এভাবেই আমাকে মারধর খেয়ে কাটিয়ে দিতে হবে।”

নাকে কান্না জুড়ে দিলো পিয়াসা। চোখ খুলে নিহাল রুমের সব আলো বন্ধ দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠল। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল তার। ঝট করে সে শোয়া থেকে ওঠে বিচলিত হয়ে অন্ধকারে পিয়াসাকে খুঁজতে লাগল। ভাবল সত্যি সত্যি বুঝি পিয়াসা বাপের বাড়ি চলে গেল! সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিহাল সোফার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই দেখল সোফার উপর পিয়াসা নড়াচড়া করছে। স্বস্তির শ্বাস ফেলল নিহাল। ঝট করে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ জোড়া বুজে বিক্ষিপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,

“আর কিছুতেই তাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা। টাইটে রাখতে হবে। বুঝাতে হবে সে যা করছে ভুল করছে। আর আমিও তার প্রতি এতটা দুর্বল নই যে তাকে সবসময় মাথায় তুলে রাখব। আদরের সময় যেমন আদর করব তেমনি শাসনের সময় শাসন।”

____________________________________

রাতের আঁধার পেরিয়ে চারিদিকে ভোরের আলো ফুটতেই মারজিনা বেগম ঘুম থেকে জাগলেন। ফজরের নামাজ কায়েম করে তিনি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়তেই লক্ষ্য করলেন নিহালের রুমের দরোজার সামনে দুধের গ্লাস সমেত ট্রে টি এখনও পরে আছে! বিষয়টিতে বেশ অবাক হলেন তিনি। নিহালের রুমের দিকে অগ্রসর হয়ে তিনি গভীর চিন্তিত গলায় বললেন,

“কী ব্যাপার? দুধসহ ট্রে টি এখানে কী করছে? কাল রাতে তো আমি নীহারিকাকে ট্রে টি দিয়ে বলেছিলাম পিয়াসা আর নিহালকে দুধটা দিয়ে আসতে। তার মানে কী নীহারিকা দুধটা তাদের না দিয়ে দরোজার সামনেই রেখে চলে গেছে? সামান্য এই কাজটাও মেয়েটাকে দিয়ে হলোনা?”

নীহারিকার উপর রেগে গেলেন মারজিনা বেগম। ট্রে টি হাতে নিয়ে তিনি ছুটে গেলেন নীহারিকার রুমে। অর্ধখোলা দরোজাটি খুলে তিনি রুমের ভেতর প্রবেশ করে রুমের আলো জ্বালিয়ে দিলেন। অমনি অবাক হয়ে তিনি চোখ ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ রুমটিকে দেখতে লাগলেন। এই কী অবস্থা রুমের? জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! আলমারির কাপড়চোপড় সব বিছানার উপর অগোছালো হয়ে পরে আছে। ফুলের টব দুটি ভাঙা! মনে হচ্ছে ভাঙচূড় হয়েছে রুমে। বিছানার এক পাশে নীহারিকা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। শুয়ে আছে বললে ভুল হবে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।

দুধের ট্রে টি টেবিলের উপর রেখে মারজিনা বেগম রেগেমেগে তেড়ে গেলেন নীহারিকার কাছে। ঘুমন্ত নীহারিকাকে দু-হাত দ্বারা ঠেলে তিনি ধমকের স্বরে বললেন,

“এই নীহারিকা ওঠ। ঘরের কী অবস্থা করে রেখেছিস তুই?”

এভাবে দুই-তিনবার নীহারিকাকে ঠেলতেই ঘুম ভাঙল নীহারিকার। চোখ বুজেই সে বিরক্তি প্রকাশ করল। সারারাত অঝরে কান্নার দরুন চোখ টেনে মেলতে পারছিলনা সে। চোখ দুটি ফুলে ফেঁপে একাকার। মাথাটাও চরম ব্যথা করছে। কপাল ঘঁষতে ঘঁষতে সে বিব্রতকর গলায় তার মাকে বলল,

“উফস মা কী হচ্ছে? ঘুমাতে দাও।”

“কেন? সারারাত কী করেছিস তুই? চোর পাহারা দিয়েছিস যে সকাল হওয়ার পরেও বলছিস ঘুমুতে দাও। রুমের এ কী দশা করে রেখেছিস তুই?”

বিরক্তি নিয়ে নীহারিকা কাঁথা টেনে আরও আরাম করে শুলো! তার মায়ের রাগ এবং কথাকে অগ্রাহ্য করে সে কাঁথার নিচে মুখ লুকিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,

“তুমি এখন যাও তো মা। আমি যেমন আমার রুম অপরিষ্কার করেছি। সময় হলে আমিই আমার রুম গুছিয়ে নিব। তাছাড়া আজ আমার কলেজ আছে। একটু পরে এমনিতেও ওঠে যেতে হবে। যে দু-এক ঘণ্টা আছে একটু ঘুমুতে দাও।”

নীহারিকার কথায় আরও চটে গেলেন মারজিনা বেগম। তবে এই মুহূর্তে তা নীহারিকার সামনে প্রকাশ করলেন না। এবং নীহারিকাকে বিরক্তও করলেন না। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে তিনি নীহারিকার রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। যেতে যেতে রগচটা গলায় বললেন,

“ঘুম থেকে ওঠ একবার। তোর তেল আমি বের করব। মায়ের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করা তো দূরে থাক সাথে কোনো কাজ দিলে তাও করবিনা আবার সব উল্টেপাল্টেও রাখবি। দায়িত্ব বলতে কিছু নেই। ছেলের বউটাও হয়েছে এক। সকাল হয়ে গেছে এখনও পরে পরে ঘুমুচ্ছে। জানে তার স্বামী সকাল আটটা বাজেই অফিসে রওনা হবে। এরপরেও এই ব্যাপারে তার দায়িত্বহীনতা। জ্বালা শুধু আমার। কারণ আমিতো মা। পেটে ধরেছি তাকে। তাই আমাকেই সবদিক খেয়াল রাখতে হবে।”

কিছুক্ষণ পকপক করে মারজিনা বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন। সকালের নাশতা তৈরি করতে। ঘড়ির এলার্ম অনুযায়ী নিহাল কারেক্ট সাতটা পনেরোতে ঘুম থেকে উঠল। চোখ কচলে সোফার দিকে তাকাতেই দেখল পিয়াসা একটুখানি সোফার উপর দলা মোচড়া হয়ে এখনও বেঘোরে ঘুমুচ্ছে! হামি তুলে নিহাল বিছানা ছেড়ে ওঠে দাড়ালো। রাগী ভাব নিয়ে সোফার কাছে এগিয়ে গিয়ে পিয়াসার নাম ধরে ডাকল। বলল,

“এই পিয়াসা উঠো। আমার অফিসের সময় হয়ে গেল অথচ এখনও তুমি নাক টেনে ঘুমুচ্ছ? দায়িত্ব বলতে কিছু নেই? যাও রান্নাঘরে যাও। মা কে হাতে হাতে সাহায্য করো।”

নিহালের কথা অগ্রাহ্য করে পিয়াসা তবুও নাক টেনে ঘুমুচ্ছিল! দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে সজাগ! চোখ দুটি পিটপিট করছে। ঘুমোনোর বাহানা ধরে নিহালের সমস্ত কথা শুনছে। পিয়াসার চালাকী বুঝতে পেরে নিহাল টেনে ধরে পিয়াসাকে শোয়া থেকে দাঁড় করিয়ে দিলো! গরম দৃষ্টিতে পিয়াসার দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“সব শুনেও তুমি নাটক করছ আমার সাথে তাইনা? যাও ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে যাও। মাকে হেল্প করো। আর কাল থেকে তুমি ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠবে। নামাজ পড়বে দেন রান্নাঘরে যাবে সকালের নাশতা বানাবে। বুঝতে পেরেছ আমি কী বলেছি?”

ভেতরে ভেতরে রাগে ফোঁসছিল পিয়াসা! তবে চ’ড় থা’প্প’র খাওয়ার ভয়ে সে সিটিয়ে গেল! বাধ্য হয়ে নিহালের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে বলল,

“হুম। বুঝতে পেরেছি।”

নিহালের সব রাগারাগি হজম করে পিয়াসা ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে চলে গেল তার শ্বাশুড়ি মাকে সাহায্য করতে। পিয়াসাকে হঠাৎ এই সময়ে রান্নাঘরে দেখে বেশ অবাক হলেন মারজিনা বেগম। পিয়াসার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কী বউমা? আজ হঠাৎ এত সকালে তুমি রান্নাঘরে? শরীর টরীর খারাপ হলো না-কী তোমার?”

তেজ দেখিয়ে পিয়াসা চায়ের পাতিল চুলোয় বসালো। তটস্থ গলায় প্রত্যত্তুরে বলল,

“কেন? অসুস্থতা ছাড়া কী আমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারিনা? শুধু কী আপনি একাই এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেন মা? আর বাকীরা পারেনা?”

সকাল সকাল পিয়াসার সাথে তর্কে জড়াতে চাইলেন না মারজিনা বেগম! চুপ করে সব সহ্য করে গেলেন। আর ভেতরে ভেতরে তীব্র আফসোস নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন।

____________________________________

ক্লাসে বসে ঘুমে ঝিমাচ্ছিল নীহারিকা! রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার দরুন তার অবস্থা এখন ঘুম কাতুরে। কোনোমতে আর একটি ক্লাস শেষ করতে পারলেই সে বাড়ি পৌঁছে লম্বা একটি ঘুম দিবে সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বেঞ্চে মাথা রাখা অবস্থায় নীহারিকার বান্ধবী হঠাৎ নীহারিকাকে ঠেলে তার কানে বিড়বিড় করে বলল,

“তোর বেয়াই দেখছি ক্যাম্পাসে একটি মেয়ের সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে! মেয়েটি কে রে নীহারিকা? তোর বেয়াইয়ের গার্লফ্রেন্ড নাকী?”

অমনি নীহারিকার চোখ থেকে ঘুম শুড়শুড় করে বিদায় নিলো! বেঞ্চ থেকে মাথা উঠিয়ে সে তার বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে বলল,

“কই তিনি? কোথায় দেখছিস তাকে?”

বটতলার দিকে আঙুল তুলে নীহারিকার বান্ধবী রূপলকে দেখিয়ে দিলো। সেদিকে নীহারিকা তাকিয়ে দেখল সত্যিই রূপল একটি মেয়ের সাথে দাড়িয়ে বেশ হেসে হেসেই কথা বলছে! বিষয়টায় বেশ রাগ হলো নীহারিকার। সঙ্গে সঙ্গেই সে ম্যামের অনুমতি নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল! ছুটে গেল রূপলের কাছে। দুজনের মাঝখানে দাড়িয়ে সে কঠিন গলায় রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“এই? আপনি এখানে কী করছেন? মেয়েটি কে?”

নীহারিকার উপস্থিতিতে রূপল বিব্রতবোধ করল! সাথে মেয়েটিও! বিরক্ত হয়ে মেয়েটি রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ইনি কে ভাইয়া? কথার মাঝখানে এসে আমাদের বিরক্ত করছে! আপনার দিকে প্রশ্নও তুলছে।”

নীহারিকার উপর যদিও রূপল ক্ষিপ্ত তবুও সে স্বাভাবিক গলায় মেয়েটিকে বুঝিয়ে বলল,

“বেয়াইন হয়। আচ্ছা তুমি এখন যাও তৃষা। আমি ঐ ব্যাপারে পরে তোমার সাথে কথা বলব।”

নীহারিকার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটি। জবাবে রূপলকে বলল,

“ওকে ভাইয়া। বায়।”

রূপলের থেকে বিদায় নিয়ে মেয়েটি চলে গেল। ভ্রু উঁচিয়ে রূপল এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী দরকার ছিল ক্লাস মিস করে এখানে ছুটে আসার? ক্লাস শেষ হলেও তো আসা যেত তাইনা?”

“আপনি জানতেন আমি ক্লাস করছিলাম?”

“এখান থেকে দাড়িয়ে আপনাদের ক্লাসটা সরাসরি দেখা যায়। ঐ হিসেবে আপনাদের ক্লাসের দিকে দু-একবার চোখ পরেছিল। তখনই খেয়াল করেছি আপনি ক্লাস করছেন।”

“ঠিক আছে। কিন্তু আমিতো তৃতীয় সারির একদম লাস্ট বেঞ্চে বসেছিলাম। এত সহজে তো আমাকে দেখার কথা নয়।”

“আপনাকে দেখাটা আমার কাছে কঠিন কিছু নয়! যাই হোক, ক্লাসে বসে বসে ঘুমুচ্ছিলেন কেন? রাতে কী চোর পাহারা দিয়েছিলেন?”

#চলবে…?