ফেরারি প্রেম পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0
311

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৪৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

এক পর্যায়ে নীহারিকা ঘুম ভেঙে উঠল। চোখ খুলে নীহারিকা সামনে তাকাতেই নিহাল এবং মারজিনা বেগম ভয়ে পেয়ে গেলেন। কারণ, চোখ দুটি তার অসম্ভব লাল হয়ে আছে! যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে চোখ থেকে। নেশাখোরদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছেনা তাকে!

অর্ধখোলা চোখে নীহারিকা বারংবার নিহাল ও মারজিনা বেগমের দিকে তাকাচ্ছে। তবে পূর্ণদৃষ্টি মেলে সে পরিষ্কারভাবে কারো দিকে তাকাতে পারছেনা। ধোঁয়াশা ডুবে যাচ্ছে। বেসামাল ঘুমই যেন সরছেনা তার দু’চোখ থেকে। ভীষণ অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে তার। মাথাটাও প্রচণ্ড ভার হয়ে আছে। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার দরুন কেমন বমি বমিও পাচ্ছে। সে তার ভেতরের অস্বস্তিটা কাউকে খুলে বলতে পারছেনা। দিশাহীনভাবে কেবল চোখের পাতা খুলছে ও বন্ধ করছে! ভীরু চাহনি তার। নীহারিকার এই বেহাল দশা দেখে মারজিনা বেগম এবার প্রচণ্ড ভীতু হয়ে উঠলেন। নীহারিকার পাশে বসে তিনি নীহারিকার মাথায় হাত বুলালেন। চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কী হয়েছে মা? তোকে এমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে কেন? শরীর টরীর খারাপ করল না তো?”

মায়ের হাতের আদুরে ছোঁয়া পেয়ে নীহারিকা এবার শান্তিতে চোখ জোড়া বুজে নিলো! ঘুম জড়ানো চোখে সে অস্ফুটে গলায় তার মাকে বলল,

“আমাকে আরও একটু ঘুমাতে দাও মা। খুব ঘুম পাচ্ছে আমার। প্লিজ বিরক্ত করো না আমায়।”

“কেন? রাতে ঘুমুসনি? এই সময় তো তোকে কখনও ঘুমাতে দেখিনি।”

মুহূর্তের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল নীহারিকা। সেকেণ্ড ও যেন ব্যয় হলোনা। নিহাল নিশ্চুপ হয়ে এতক্ষণ যাবত নীহারিকার হাবভাব পর্যবেক্ষণ করছিল! নীহারিকার আচরণ কিছুই সুবিধার মনে হলোনা তার! ভেতরে ভেতরে দুঃশ্চিন্তা চেপে রেখে সে স্বাভাবিক গলায় তার মাকে বলল,

“থাক মা ওঠে এসো। তাকে আর বিরক্ত করোনা। তুমি বরং পিয়াসাকে দিয়ে রাতের খাবারটা তার রুমে পাঠিয়ে দাও। ক্ষুদা লাগলে পরে খেয়ে নিবে।”

এই বলে নিহাল হনহনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। নীহারিকার গাঁয়ে সযত্নে কাঁথা টেনে দিলেন মারজিনা বেগম। আরও একদফা নীহারিকার দিকে তাকিয়ে তিনি রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় রুমের দরজাটা টেনে দিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর পিয়াসা এসে নীহারিকার রুমে খাবারটা রেখে গেল। যাওয়ার সময় সূক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলো ঘুমন্ত নীহারিকার দিকে ফিরে তাকালো পিয়াসা৷ দু-কদম এগিয়ে এসে নীহারিকার দিকে ঝুঁকল সে। দু-হাত নাড়িয়ে পরীক্ষা করল নীহারিকা জেগে আছে কী-না। কৌতূহলী হয়ে পিয়াসা এবার নীহারিকার হাত ধরে টান দিলো! তবুও জেগে উঠল না নীহারিকা! বিষয়টায় ভীষণ অবাক হলো পিয়াসা। কোমরে হাত গুজে সে হতভম্ব গলায় বলল,

“এই মেয়ে কী নেশা ভান করে না-কী? মরার মত এভাবে ঘুমুচ্ছে কেন? তাকে কেউ টেনে নিয়ে গেলে ও তো সে টের পাবেনা।”

এতটুকু বলেই পিয়াসা পা টিপে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। বেডের কার্ণিশে হেলান দিয়ে বসে আছে নিহাল। মাথায় হাত তার। কোনোকিছু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সে। যা তার মুখভঙ্গি দেখে ভালোই বুঝা যাচ্ছে। অমনি পিয়াসা দরজা ঠেলে রুমে ঢুকল। পিয়াসা খরখরে গলায় নিহালের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“আগামী সপ্তাহে আমাদের রিসিপশন। অথচ এই বিষয় নিয়ে এখনও কোনো আলোচনা হলোনা। এরেঞ্জমেন্ট করবেন কখন? সময় তো বেশি নেই।”

স্থির গলায় নিহাল প্রত্যত্তুরে পিয়াসাকে বলল,

“কাল কথা হবে এই বিষয় নিয়ে। দেখলে না নীহারিকা ঘুমুচ্ছে?”

“ঘুমুচ্ছে তো কী হয়েছে? বাড়িতে কী আর কোনো মুরুব্বি নেই? এখানে নীহারিকাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে?”

“কারণ নীহারিকাও এই বাড়ির একজন সদস্য। শুধু সদস্যই নয়, একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আমরা তাকে ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নিইনা!”

“ওহ্ আচ্ছা। তাহলে এই ব্যাপার? তো বলি যখন তার বিয়ে হয়ে যাবে তখন কী তাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে ডেকে আনবেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য?”

“হ্যাঁ আনব! প্রয়োজনে তাকে ডেকেই আনবে। এই বিষয়ে নিয়ে আর কোনো কথা না বললে আমি খুশি হব। রাত হয়েছে অনেক। ঘুমিয়ে পড়ো।”

রাগে ফোঁস ফোঁস করে পিয়াসা ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। নীহারিকার প্রতি দিন কী দিন তার ক্ষোভ বাড়ছে। তার চেয়ে নীহারিকাকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এটাই হলো তার সবচেয়ে অপছন্দের কারণ! কিছুক্ষণের মধ্যে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো পিয়াসা। মুখ মুছতে মুছতে সে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা নিহালকে বলল,

“আচ্ছা শুনুন। রিসিপশনের বিষয়টা কিন্তু ফোনে আমার বাবা-মা কে বললে হবেনা। তাদের বাসায় গিয়ে তাদের দাওয়াত করে আসতে হবে। বিষয়টা মাথায় রাখবেন।”

“এই বিষয় নিয়ে আমাকে কোনো জ্ঞান দিতে হবেনা তোমার। কাল সন্ধ্যার দিকে আমরা ঐ বাড়িতে যাব। সরাসরি তাদের সাথে কথা বলে আসব।”

খুশিতে গদগদ হয়ে পিয়াসা পাশ ফিরে নিহালের পাশে শুয়ে পরল। চোখ বুজতেই সে ঘুমিয়ে পরল। কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিহাল একবার আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে পিয়াসার দিকে তাকালো।মুহূর্তেই পিয়াসার থেকে চোখ সরিয়ে নিহাল কপালটা ঘঁষতে লাগল। দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় সে মিনমিনিয়ে বলল,

“নীহারিকার ব্যাপারটা বুঝলাম না! তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার কিছু সুবিধার মনে হলোনা। ঘুম থেকে তো এমন হওয়ার কথা নয়! তবে কী আমি কাজের স্ট্রেস থেকে বেশি বেশি চিন্তা করছি? যার ফলে সবকিছুই আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে?”

নিজেকে কিছুটা রিল্যাক্স করে নিহাল উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পরল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত বারোটা বাজছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তার চোখেও ঘুম নেমে এলো।

_____________________________________

রাত জেগে রূপল বাড়ির ছাদে দাড়িয়ে স্মোকিং করছে! ছাদের রেলিং ঘেঁষে তীব্র অস্থিরতা নিয়ে সে কেবল নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছে! রাগের চোটে এ কী করে ফেলল সে? সরাসরি চুমু খেয়ে দিলো নীহারিকার গালে? ভীষণ অনুতাপবোধ কাজ করছে তার মধ্যে। পরবর্তীতে নীহারিকার মুখোমুখি সে দাঁড়াবে কী করে তা নিয়েও কঠিন প্রশ্ন ঘুরছে তার মাথায়। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজেই অনুশোচিত হয়ে যাবে তা ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি রূপল! নিশ্চয়ই তার প্রতি নীহারিকার মনে এখন খারাপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে! এসব ভাবতেই যেন রূপলের মাথাটা ফট করে ধরে গেল। হাতে থাকা সিগারেটটি সে ছুড়ে ফেলে দিলো। মৃদু চিৎকার করে বলল,

“শিট। আমি তাকে দুটো হুমকি ধমকি না দিয়ে কিস করতে গেলাম কেন? কোন লজিকে আমি তাকে কিস করলাম? নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে এখন! নেক্সট টাইম আমি তার মুখোমুখি দাড়াব কীভাবে? আর সে ই বা আমাকে কীভাবে নিবে? ধ্যাত। নিজের গালে এখন নিজেরই চড় মারতে ইচ্ছে করছে!”

সামনের চুলগুলো টেনে ধরে রূপল বিধ্বস্ত অবস্থায় ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারী করল। অতঃপর কিছু একটা ভেবে সে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটি বের করে নীহারিকার নাম্বারে ডায়াল করল। অমনি ঐ পাশ থেকে নীহারিকা সঙ্গে সঙ্গেই কলটি তুলল! রূপলকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে নীহারিকা ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে আলুথালু গলায় বলল,

“আমি আর পারছিনা রূপল! মনে হচ্ছে কেউ আমার গলা চে’পে ধরছে। আমাকে মে’রে ফেলার চেষ্টা করছে। প্লিজ হেল্প মি রূপল প্লিজ!”

হতবিহ্বল হয়ে রূপল ধীর হয়ে দাড়িয়ে রইল। মাথা কাজ করছিলনা তার। নীহারিকা এসব কী বলছে? কেন বলছে? কী হলো তার? কণ্ঠস্বর শুনে তো মনে হচ্ছেনা সে মজা করছে। তবে কী তার সাথে সাংঘাতিক কিছু ঘটছে? অস্থির হয়ে রূপল প্রশ্ন ছুড়ল,

“হোয়াট? কোথায় আপনি?”

“বাবাবাসায়! লোকটা আমাকে রুম থেকে বের হতে দিচ্ছেনা রূপল। কেউ আমার চিৎকারও শুনতে পারছেনা। প্লিজ আপনি আসুন। মা-বাবা ভাইয়া-ভাবিকে বলুন আমাকে বাঁচাতে! আমার খুব ভয় করছে।”

নীহারিকার আতঙ্কিত কথাবার্তা শুনে রূপল মরিয়া হয়ে উঠল। আর একদণ্ড ছাদে না দাড়িয়ে থেকে সে দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। ফোনে থাকা ঘাবড়ানো নীহারিকাকে শান্ত স্বরে বলল,

“এই নীহু। আপনি প্লিজ শান্ত হোন। আমি আসছি। কিছু হবেনা আপনার।”

বলেই রূপল কলটি কেটে দিলো। ঝড়ের বেগে বাসা থেকে বের হয়ে সে তার বাইক নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। নিহালের নাম্বারে লাগাতার কল করতে লাগল সে। তবে ঐ পাশ থেকে কেউ কলটি তুললনা। বিরক্ত হয়ে রূপল বাইকটি ফুল স্পিডে ছেড়ে বলল,

“ডেম ইট। জিজু কলটা কেন তুলছেনা?”

পিয়াসার নাম্বারে কল দেওয়ার পরেও ঐ একই অবস্থা হলো! কলটি বেজে যাওয়ার পরেও ঐ পাশ থেকে কেউ কলটি তুললনা। ঐ বাড়ির আর কারো নাম্বার রূপলের কাছে না থাকায় রূপল আর কাউকে কল করতে পারল না। এভাবে কাজ হবেনা তাই রূপল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইকের স্পিড যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দিলো।

গভীর রাত তখন। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা থাকায় রূপল অনায়াসেই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা এড়িয়ে বাইকটা টান দিয়ে কোনো রকমে নীহারিকাদের বাড়ির সামনে এসে পৌছালো। বাড়ির মেইন গেইট যদিও ভেতর থেকে তালা বদ্ধ ছিল তবে এই মুহূর্তে রূপল গেইট টপকে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল! হাতের কিছু কিছু জায়গায় গেইটের ধারালো অংশ লেগে হাত কেটে গেছিল তার! টপটপ করে র’ক্ত ঝরছিল হাতের পিনকি বেয়ে! সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই রূপলের। নীহারিকার অসহায়ত্বে ভরা সেই আকুতি মাখা কণ্ঠ রূপলের কর্ণকুহরে বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। নিজেকে সামলাতে পারছিলনা সে! নীহারিকাকে রক্ষা করাই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাড়ালো! রূপল আদোতেই এখন নিজের মধ্যে নেই। কোন সে টানে সে এত মরিয়া হয়ে উঠল তা এখন তার ভাবনার অতীত।

বাড়ির সদর দরজাও ভেতর থেকে লক করা ছিল। অস্থির হয়ে রূপল সদর দরজায় ক্রমাগত টোকা মারতে লাগল। পিয়াসার নাম ধরে ডাকতে লাগল। এতেও কাজ হলোনা বলে রূপল শরীরের সমস্ত শক্তি কাজে লাগিয়ে বাড়ির সদর দরজায় জোরে এক লাথ মারল! রূপলের বিধ্বংসী চিৎকার এবং দরজায় লাথ পাওয়ার শব্দ পেয়ে নিহাল ঘুম ভেঙে তাড়াহুড়ো করে উপরের তলা থেকে দৌড়ে নিচ তলায় নেমে এলো! বাড়ির সবাইও এতক্ষণে নিচে চলে এলো। ক্ষিপ্ত হয়ে নিহাল সদর দরজাটি খুলতেই বিপর্যস্ত অবস্থায় রূপলকে দেখতে পেল। অমনি নিহাল তাজ্জব হয়ে রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী ব্যাপার রূপল? তুমি এতরাতে?”

রসকষহীন গলায় রূপল তার জিজুকে বলল,

“কী খেয়ে ঘুমান আপনারা হ্যাঁ? কখন থেকে কল করছিলাম আপনাদের? দরজা ধাক্কাচ্ছিলাম শুনেন নি?”

প্রত্যত্তুরে নিহালকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না রূপল। দৌড়ে সে বাড়ির দু-তলায় ওঠে গেল। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে রূপলের কাজকর্ম দেখছিল। নিহালও এবার অস্থির হয়ে রূপলের পিছু পিছু নীহারিকার রুম অবধি চলে গেল।

ড্রিম লাইট জ্বলছে রুমে। পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে কাপড়চোপড় এদিক ওদিক ছিটিয়ে আছে। বিছানার এক পাশে বসে নীহারিকা হাঁটুর উপর মাথা ঠেকিয়ে ভয়ে কাঁপছে! আর আবোলতাবোল কী যেন বিড়বিড় করে বলছে। পুরো রুম জুড়ে ভয়ঙ্কর একটি পরিবেশ বিস্তরণ করছে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রূপল এবং নিহাল ধীর পায়ে হেঁটে নীহারিকার কাছে এগিয়ে গেল। অমনি নীহারিকা মাথা তুলে তার আগুন ঝরা দৃষ্টিতে রূপল এবং নিহালের দিকে তাকালো। চোখেমুখে তার ঘোর আতঙ্ক কাজ করছে! চোখ থেকে টলটলিয়ে জল পরছে। ঘেমে নেয়ে একাকার। শ্বাস প্রশ্বাস খুব দ্রুত বেগে ওঠা নামা করছে। হুট করে সে সামনে থাকা রূপলের হাতটি টেনে ধরল! বিচলিত গলায় বলল,

“প্লিজ হেল্প মিস্টার রূপল। লোকটা আমাকে মে’রে ফেলবে।”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাড়িয়ে রইল নিহাল। নিস্তব্ধ, নির্বিকার। নীহারিকার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না সে। নীহারিকার এই করুন অবস্থা দেখে রূপল কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল। নরম হয়ে এলো সে। এই অবস্থায় নীহারিকাকে কোনো প্রশ্নে জড়াতে চাইলনা রূপল। বরং নীহারিকার সব কাল্পনিক চিন্তাধারা বিশ্বাস করে নিলো। বিচার বুদ্ধি বিবেচনা ভুলে সে ঝট করে নীহারিকার হাতটা আঁকড়ে ধরল! শিথিল দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। নীহারিকার ভরসা অর্জন করে সে বিনা দ্বিধায় নীহারিকার গালে হাত রাখল! অমনি নীহারিকার চোখ থেকে দু-ফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পরল রূপলের হাতে। নীহারিকাকে শান্ত করার জন্য রূপল এবার নীহারিকার মাথায় আলতো হাত বুলালো। শান্ত স্বরে বলল,

“বি কুল নীহু। আমি থাকতে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। প্লিজ ট্রাস্ট মি।”

#চলবে….?

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৪৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

“বি কুল নীহু। আমি থাকতে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। প্লিজ ট্রাস্ট মি।”

রূপলের বিশ্বস্ত ও শিথিল দু-চোখের দিকে তাকিয়ে নীহারিকা হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে রূপলের বুকে এসে লুটিয়ে পরল! এই মুহূর্তে পিয়াসা, মারজিনা বেগম ও আফজাল হকও ছুটে এলেন নীহারিকার রুমে। রূপলের বুকে শায়িত অবস্থায় নীহারিকাকে দেখা মাত্রই ফট করে পিয়াসার মাথাটা গরম হয়ে গেল! আগ্রাসী দৃৃষ্টিতে সে পেছন থেকে রূপলের দিকে তাকালো। পরিস্থিতি খারাপের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ভেবে নিহাল ঝট করে রূপলের বুক থেকে নীহারিকাকে টেনে এনে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো! পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল! নিহাল যে বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিবে। পিয়াসা ঠিক এই জিনিসটাকেই অস্বাভাবিক ভাবে নিবে তা নতুন করে জানার কিছু নয়। হাঁটু মুড়ে নিহাল ফ্লোরে বসল। উদ্বিগ্ন হয়ে সে জ্ঞানশূণ্য নীহারিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“কী থেকে কী হয়ে গেল বোন? আমার মাথায় তো কিছুই কাজ করছেনা।”

নীহারিকার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে মারজিনা বেগম এবার কান্না জুড়ে দিলেন। ছুটে এসে তিনি নীহারিকার পাশে বসলেন। আফজাল হকের দিকে তাকিয়ে তিনি আহাজারি গলায় বললেন,

“কী হলো মেয়েটার? প্লিজ তুমি এক্ষণি ডক্টর ডেকে আনো। সন্ধ্যার পর থেকেই আমার মেয়েটা কেমন করছে।”

আফজাল হক এবার মরিয়া হয়ে উঠলেন কল করে ডক্টরকে বাড়িতে ডেকে আনতে। তখনি রূপল আফজাল হককে থামিয়ে দিলো! নম্র এবং সুস্থির গলায় আফজাল হককে বুঝিয়ে বলল,

“আঙ্কেল প্লিজ এখন কোনো ডক্টর ডাকার প্রয়োজন নেই। কাল না হয় জিজু একবার সময় করে নীহারিকাকে নিয়ে মেডিকেলে যাবে। আমার মনে হচ্ছে না বাড়ির ডক্টর এই মুহূর্তে নীহারিকার কোনো ভালো চিকিৎসা করতে পারবে বলে।”

নিহালও তখন রূপলের কথায় একমত পোষণ করল। চিন্তিত গলায় সে তার বাবাকে বলল,

“হ্যাঁ বাবা। রূপল ভুল কিছু বলেনি। আমার মনে হচ্ছেনা এই বিষয়টা খুব নরমাল। সিরিয়াস কিছু মনে হচ্ছে! সন্ধ্যার পর থেকেই আমি নীহারিকার হাবভাব নোটিশ করছিলাম। কাল অফিস মিস করে হলেও আমি বোনকে নিয়ে মেডিকেলে যাব। প্রয়োজনে রূপলও আমাদের সাথে যাবে। কী রূপল? কাল সময় দিতে পারবে তো আমাকে?”

“অভেয়সলি জিজু। হোয়াই নট? হসপিটালে পৌঁছে একটা কল করবেন জাস্ট। আমি হাজির হয়ে যাব।”

রূপলের ভালো মানুষি পিয়াসার একদমই পছন্দ হচ্ছেনা! রাগে রি রি করছে সে। আর সুযোগ খুঁজছে কখন সে রূপলকে একান্তে পাবে! অজ্ঞান হয়ে থাকা নীহারিকার দিকে একবার ধীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রূপল জায়গা থেকে ওঠে গেল। এবং জোরপূর্বক হেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আচ্ছা আমি এখন আসছি তাহলে। নীহারিকাকে এই মুহূর্তে ডাকার কোনো প্রয়োজন নেই। তাকে বরং ঘুমুতে দিন। আর অবশ্যই তার যত্ন নিবেন।”

ভরাট গলায় তখনি মারজিনা বেগম রূপলকে কৃতজ্ঞতার স্বরে ডেকে বললেন,

“রূপল বাবা। তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দিব আমার জানা নেই। তুমি না থাকলে হয়ত আমরা জানতেও পারতাম না যে আমার মেয়েটা একা রুমে থেকে এতটা কষ্ট পাচ্ছে।”

“এখানে তো আপনাদের কোনো দোষ নেই আন্টি। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আমরা রাতটাই তো সময় পাই একটু ঘুমানোর জন্য। এই সময়ে গভীর ঘুমে থাকাটাই স্বাভাবিক। বাই দ্যা ওয়ে আন্টি। আমি আসছি।”

প্রস্থান নিলো রূপল। নিহাল পুনরায় রূপলকে পিছু ডেকে বলল,

“হাত থেকে র’ক্ত পরছে রূপল। কা’টা জায়গা গুলোতে ঔষধ লাগিয়ে নিও। আর তোমাকে যে আমি তুমি তুমি করে ডাকি তুমি মাইন্ড করো না তো?”

“আরে না জিজু। বয়সে আমি আপনার ছোটো। নাম ধরে তুমি তুমি করে ডাকতেই পারেন। ইট’স কুল।”

“ওকে। আর যা বললাম হাতে ঔষধ লাগিয়ে নিও।”

মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে রূপল রুম থেকে বের হয়ে গেল। অমনি আগে থেকেই দরজার বাইরে দাড়িয়ে থাকা পিয়াসা রূপলের মুখোমুখি দাড়ালো! বুকের উপর দু-হাত গুজে রূপলকে শাসিয়ে বলল,

“এসব কী ভাইয়া? তুমি এত রাতে এই বাড়িতে কী করছ? আর কেনই বা এলে এই বাড়িতে? নিশ্চয়ই নীহারিকা তোমাকে কল করে এনেছে?”

পিয়াসার গাঁ জ্বলা কথাতেও শান্ত রইল রূপল! বরং ধীর স্থির গলায় সে পিয়াসাকে বুঝিয়ে বলল,

“নীহারিকা নয় বরং আমিই নীহারিকাকে কল করেছিলাম! সেই হিসেবেই জানতে পারা সে ঠিক নেই।”

“কেন কেন? তুমি এত রাতে তুমি নীহারিকাকে কেন কল করতে গেলে?”

“বয়সে তুই আমার ছোটো পিয়াসা। তাই তুই যখন তখন আমার উপর হুটহাট প্রশ্ন তুলতে পারিসনা! যা এখন রুমে যা। ননদের সেবা কর।”

“তুমি কী ভেবেছ ভাইয়া? আমি কিছু বুঝিনা? কেন তুমি নীহারিকার পেছনে এত ঘুরঘুর করছ আমি সব বুঝি!”

“ওকে কী বুঝিস বল? আমিও জানতে চাই কেন আমি তার পেছনে এত ঘুরঘুর করছি!”

“তুমি ঐ মেয়েটার প্রেমে পরে গেছ ভাইয়া! যা তোমার চোখমুখ দেখলেই স্পষ্ট বুঝা যায়! কেন বুঝতে পারো না তুমি ভাইয়া? সে তোমার যোগ্য নয়!”

“ওহ্ রিয়েলি? আমি সত্যিই তার প্রেমে পরে গেছি? তুই না বললে তো বুঝতেই পারতাম না!”

ব্যঙ্গ করে রূপল পিয়াসাকে কথাগুলো বলল। অতঃপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে পিয়াসার দিকে তাকালো। শার্টের হাতা ভাজ করে চোয়াল উঁচিয়ে বলল,

“যতসব ফালতু কথা তোর। যা সামনে থেকে সর। ননদের সেবা কর। সংসারে মন দে।”

হনহনিয়ে রূপল পিয়াসার সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। বেকুব হয়ে পিয়াসা রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। মুখটা হা করে সে নির্বোধ গলায় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল,

“ভাইয়া কী সত্যিই নীহারিকার প্রেমে পরেনি? তবে কী আমিই একটু বেশী বেশী ভাবছি?”

কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপল বাড়ি ফিরে গেলো। বাইকের চাবিটা টেবিলের উপর রেখে সে রুমের এসিটা ছেড়ে দিলো। ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর থেকে শার্টটা খুলে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে দিলো। ডান হাত থেকে গড়িয়ে পরা রক্তগুলো সে বাঁ হাত দ্বারা মুছে নিলো। অস্থির হয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। চোখ বুজে সে কিছু অমিমাংসিত গভীর ভাবনায় ডুব দিলো। একটু আগের দেখা নীহারিকার সাথে সে অতীতের দেখা নীহারিকার যোগ বিয়োগ করতে লাগল। নীহারিকাকে মোটেও তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছেনা। খুবই চুপচাপভাবে কিছু একটা ঘটছে নীহারিকার সাথে। যা কেউ টেরই পাচ্ছেনা।

একে একে আগের কথাগুলো মনে পরতে লাগল রূপলের। সেই স্কুটি থেকে শুরু থেকে ফেইক কল এমনকি আজকের ঘটনাটিও! সব কিছু একসাথে মিলাতে গিয়ে রূপল মহা বিভ্রাটে তলিয়ে গেল। এই সময়টাতে এসে নীহারিকার একটা কথাও তার অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছেনা। তবে নীহারিকার মধ্যে কোনো একটা রহস্য লুকিয়ে আছে! যা ভেদ করতে হলে রূপলকে সরাসরি নীহারিকার মুখোমুখি হতে হবে। হুমকি ধমকি দিয়ে হোক বা বুঝিয়ে শুনিয়ে হোক নীহারিকার কাছ থেকে সত্যিটা জানতে হবে। আর এসব ভাবতে ভাবতেই রূপল সোফার উপর ঘুমিয়ে পরল।

সেই ঘুম ভাঙল তার পরের দিন সকাল ঠিক দশটায়। তাও আবার নিহালের অনেকগুলো কল পেয়ে। ফ্রেশ হয়ে রূপল গাঁয়ে কোনো রকমে একটা শার্ট জড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। সকালের নাশতা করার সময়টাও পেলনা সে। বাইক নিয়ে ছুটল হসপিটালের দিকে।

সময়মতই রূপল হসপিটালে এসে পৌঁছালো। ডক্টরের চেম্বারের সামনে এসে রূপল দেখল ব্লাড টেস্টের জন্য নীহারিকাকে ল্যাবে নেওয়া হচ্ছে। রূপল আসার উপস্থিতি টের পেয়ে নীহারিকা হুট করে পিছু ফিরে তাকালো! যেন তার আগে থেকেই জানা ছিল রূপল আসবে! ঢুলুঢুলু চোখে সে একবার রূপলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করল। তবে চোখ দুটো তার মিইয়ে আসছিল। রূপলকে বেশ অস্থির দেখা যাচ্ছে। রূপলের সেই অস্থিরতা নীহারিকার চোখ এড়ালো না। অমনি ডক্টররা নীহারিকাকে ল্যাবে ঢুকিয়ে নিলো। ল্যাবের বাইরে দাড়িয়ে আছে নিহাল। রূপলকে দেখে সে স্বস্তি পেল। দু-কদম এগিয়ে এসে রূপল ব্যস্ত গলায় নিহালের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কোথায় নিয়ে গেল উনাকে?”

“ব্লাড টেস্টের জন্য।”

“ওহ্। তাহলে আমরা ওয়েট করি।”

“হুম।”

দু-এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট বের হলো। সেই রিপোর্ট নিয়ে ডক্টরের চেম্বারে রূপল এবং নিহাল ঢুকল। নীহারিকাকে তারা বাইরে রেখে এলো। ডক্টরের সামনে চেয়ার টেনে বসল দুজন। রিপোর্টটা হাতে নিয়ে ডক্টর সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিপোর্টটি কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। রিপোর্ট থেকে চোখ সরিয়ে তিনি গম্ভীর দৃষ্টিতে নিহাল এবং রূপলের দিকে তাকালেন। ভাবুক গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,

“রোগী কী ড্রাগস নেয়?”

অমনি হতবাক হয়ে রূপল এবং নিহাল ডক্টরের দিকে তাকালো। অস্থির হয়ে নিহাল ডক্টরকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“মানে? রক্তে কী ড্রাগস পাওয়া গেছে?”

“হুম। তাও আবার খুব হাই পাওয়ারের ড্রাগস। যা মুহূর্তেই একজন মানুষকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য করে ফেলে। তার মস্তিষ্ককে অটোমেটিকলি কাবু করে ফেলে। তখন কাল্পনিক চিন্তাধারা তার মাথায় ঘুরতে থাকে। দিন কী দিন তাকে ড্রাগস এডিক্টেড করে ফেলে। তখন রোগী নিজেকে মানসিক টর্চার করতে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার তা শারীরিক টর্চারেও পরিণত হয়।”

“কিন্তু আমার বোন তো ড্রাগস নেয়না ডক্টর। আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।”

অমনি রূপল ইশারায় নিহালকে থামিয়ে দিলো! তাকে চুপ থাকতে বলল। গলা ঝাকিয়ে রূপল শান্ত গলায় ডক্টরকে বলল,

“আচ্ছা ডক্টর। এখন এর থেকে বের হয়ে আসার উপায় কী?”

“ড্রাগস নেওয়া বর্জন করতে হবে। যদিও এই প্রথম বার ড্রাগস নিয়েছে সে! খেয়াল রাখবেন যেন পরবর্তীতে সে আবার ড্রাগস না নেয়। এছাড়াও আমরা একটা ইনজেকশন পুশ করে দিব তাকে। যেন ড্রাগসের প্রভাব তার শরীরে না টিকে।”

“ওকে ডক্টর। আপনি আপনার চিকিৎসা চালিয়ে যান। আমরাও রোগীকে শোধরানোর চেষ্টা করব!”

এই বলে নিহালকে নিয়ে রূপল ডক্টরের চেম্বার থেকে বের হয়ে গেল। নিহাল তো রেগেমেগে ফায়ার! রূঢ় গলায় সে রূপলের দিকে প্রশ্ন তুলে বলল,

“ডক্টরকে তুমি এসব কী বললে রূপল? আমার বোন ড্রাগস নেয়? আর ইউ মেড?”

নিহালের রাগ হওয়ার যুক্তিসম্মত কারণ রূপল বুঝতে পারল। তাই সে নিহালকে শান্ত করার চেষ্টা করল। স্থির গলায় নিহালকে বুঝিয়ে বলল,

“দেখুন জিজু। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য অনেক সময় অনেককিছু ছাড় দিতে হয়। কিছু কিছু জায়গায় মিথ্যেও বলতে হয়। কিছু গোপন সত্যি লুকিয়ে রাখতে হয়। অনেক কিছু আবার সঠিক সময়ের হাতে ছেড়েও দিতে হয়। আমি জানি আপনার বোন ড্রাগস নেয়না। তবে কেউ হয়ত তার অজান্তে তাকে ড্রাগস দিয়েছে! তাই এই বিষয়টা আমাদের আগে ক্লিয়ার করতে হবে। এর জন্য আমাদেরকে নীহারিকার মুখোমুখি হতে হবে। এই কয়েকদিনে সে কোথায় গিয়েছে, কার সাথে মিশেছে, কী খেয়েছে সব পার্ট বাই পার্ট আমাদের জানতে হবে। ডক্টরের কাছে তো এতকিছু খুলে বলা যাবেনা। তাই আমি বলেছিলাম আপনাকে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে।”

রূপলের উপস্থিত বুদ্ধি মন্দ মনে হলোনা নিহালের কাছে। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে পরিস্থিতি কন্ট্রোল করার গুন অবশ্যই আছে রূপলের মধ্যে! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিহাল। রূপলের কথা মেনে নিলো সে। এর মধ্যেই নীহারিকাকে কেবিনে নিয়ে ডক্টর একটি ইনজেকশন পুশ করে দিলো! ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা হসপিটাল থেকে বের হয়ে গেল। অফিস থেকে দু-ঘণ্টার জন্য ছুটি নিয়েছিল নিহাল। অফিসের কাজের চাপ ইদানিং বেড়েই চলছে। তাই সে চেয়েও গোটা দিনের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিতে পারছেনা। সেজন্য নিহাল রূপলের কাছে নীহারিকার দায়িত্ব দিয়ে তার অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

___________________________________

দুপুর বারোটা তখন। নদীতে পা ঝুলিয়ে বসে পানি নিয়ে খেলছে নীহারিকা! ঠোঁটের কোণে তার প্রাণোচ্ছ্বল হাসি। বেশ চনমনে দেখাচ্ছে তাকে। নেশাগ্রস্ত ভাবটা প্রায় দূরে হয়ে গেছে। আকাশ তখন মোটামুটি মেঘলা। মনে হচ্ছে খুব জোরে বৃষ্টি নামবে। দমকা হাওয়া উড়িয়ে দিচ্ছে নীহারিকার ওড়নার আঁচল। সেই আঁচল উড়ে এসে রূপলের চোখেমুখে পরছে! উদাসীন হয়ে রূপল পলকহীন দৃষ্টিতে নীহারিকার উচ্ছ্বলতা দেখছে! নীহারিকাকে দেখতে এখন খুব শান্ত, স্থির এবং চিন্তামুক্ত মনে হচ্ছে। এতদিন পর রূপল খেয়াল করল হাসলে নীহারিকার বাঁ গালে টোল পরে! এতে যেন তার হাসির সৌন্দর্য দ্বিগুন বেড়ে যায়! চোখ দুটোও খারাপ না নীহারিকার। বড়ো বড়ো টানা চোখ। চোখের পাপড়িও ঘন কালো। আলাদাভাবে কাজল না পরলেও চলে! মুখটা তার লম্বাকৃতির হলেও গাল দুটো ফোলকো লুচির মত। যে কারো টেনে দিতে ইচ্ছে করবে।

পানি নিয়ে খেলার সময় এক ছটা জল এসে রূপলের চোখের পাপড়িতে পরল। অমনি রূপল তার ধ্যান ভেঙে নড়েচড়ে স্বাভাবিক হলো। আবার ও সে নীহারিকার দিকে মনোযোগ দিলো। মন মেজাজ বেশ ভালো দেখাচ্ছে নীহারিকার। এখন অনায়াসেই তার ভেতর থেকে কথা বের করা যাবে। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে রূপল গলা ঝাকিয়ে নীহারিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। অমনি নীহারিকা হেসে হেসে রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“নদীটা খুব সুন্দর তাইনা?”

“হুম। ঠিক আপনার মত!”

বেকুব হয়ে নীহারিকা রূপলের দিকে তাকালো! রূপলের মাথা টাথা খারাপ হয়ে না-কী তার বুঝার চেষ্টা করল। নীহারিকাকে আরও একদফা অবাক করে দিয়ে রূপল দুটো সিঁড়ি টপকে এসে নীহারিকা যে সিঁড়িটিতে বসেছে সেই সিঁড়িটিতে বসল। স্থির দৃষ্টিতে সে নীহারিকার দিকে তাকালো। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

“বাই দ্যা ওয়ে নীহারিকা। গতকাল আপনি টিউশন থেকে কোথায় গিয়েছিলেন?”

কোষভর্তি পানি নিয়ে নীহারিকা অবুঝ দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো। নির্বোধ গলায় শুধালো,

“কোথায় যাব আবার?”

“এইতো কোনো ফ্রেন্ডের বাড়িতে বা কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন?”

“না তো। আমিতো কাল টিউশনিও করাই নি। সোজা বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”

“ডু ইউ নো নীহারিকা? আপনার ব্লাডে ড্রাগস পাওয়া গেছে?”

অমনি অস্থির হয়ে উঠল নীহারিকা! শুকনো মুখে সে রূপলের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ রূপলের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কাঠ কাঠ গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,

“হোয়াট? আমার রক্তে ড্রাগস পাওয়া গেছে?”

“হুম। কেউ হয়ত আপনাকে খাবারের সাথে অথবা অন্য কোনোভাবে ড্রাগস দিয়েছে। মনে করার চেষ্টা করুন তো কাল রাতে আপনি কী কী করেছিলেন কিংবা আপনার সাথে কাল কী কী ঘটেছিল।”

কাল রাতের সমস্ত ঘটনা নীহারিকা বেশ মনোযোগ দিয়ে ভাবতে লাগল। কিছুদূর ভাবার পর সে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল। বিস্ফোরিত গলায় বলে উঠল,

“যেই লোকটার সাথে কাল ধাক্কা খেয়েছিলাম সেই লোকটা নয় তো?”

মরিয়া হয়ে উঠল রূপল। নীহারিকার দিকে ঝুঁকে এলো সে। অধীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কোন লোকটা? কার সাথে আপনি ধাক্কা খেয়েছিলেন বলুন?”

“কাল যখন আমি রাস্তায় আনমনা হয়ে হাঁটছিলাম ঠিক তখনি মনে হয়েছিল আমি কারো সাথে ধাক্কা খেয়েছি! শিট আমি তখন লোকটার দিকে ফিরে তাকালাম না কেন?”

সন্দেহের দৃষ্টিতে রূপল নীহারিকার দিকে তাকালো। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো তার।তৎপর গলায় নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“আপনি কী আমাদের থেকে কোনোকিছু আড়াল করছেন নীহারিকা? আপনি এভাবে চুপচাপ থাকলে কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হবেনা। নির্ভয়ে আপনি আমাকে সব খুলে বলতে পারেন। আপনি তো ব্রেইভ গার্ল তাইনা? কীসের এত ভয় আপনার?”

রূপলের দু-চোখে নীহারিকা ভরসা খুঁজে পেল। স্নিগ্ধ চোখ জোড়া তার ক্রমশ ভরাট হয়ে এলো। রূপলের আশ্বস্ত দুচোখের দিকে তাকিয়ে সে অভয় পেয়ে বলল,

“আমার মনে হচ্ছে ঐ লোকটা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে রূপল! সেদিন আমার স্কুটির নিচে যে লোকটি চাপা পরেছিল সেই লোকটি! আমার আরও মনে হচ্ছে এর পেছনে কোনো না কোনো ভাবে সবিতা আপুও জড়িত আছে! আপনি কী এই রহস্য উদঘাটনে আমাকে সাহায্য করবেন রূপল?”

“হোয়াই নট? আপনি যেমন আমার দুঃসময়ে পাশে ছিলেন, আমি কেন আপনার দুঃসময়ে পাশে থাকব না? থ্যাংকসটা আমি এই সময়ের জন্য হয়ত তুলে রেখেছিলাম! ইকুয়েল ইকুয়েল করব বলে।”

#চলবে…?

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৪৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“হোয়াই নট? আপনি যেমন আমার দুঃসময়ে পাশে ছিলেন, আমি কেন আপনার দুঃসময়ে পাশে থাকব না? থ্যাংকসটা আমি এই সময়ের জন্য হয়ত তুলে রেখেছিলাম! ইকুয়েল ইকুয়েল করব বলে।”

রূপলের নিবিড় দু’চোখে তাকিয়ে নীহারিকা স্বস্তির আভাস খুঁজে পেল। তবে এরমধ্যে নীহারিকা বেশ ভালোভাবেই খেয়াল করল, রূপলের দৃষ্টি যেন আজ কিছুতেই সরছে না তার থেকে! বরং তাকে চাওয়ার গভীরতা যেন ক্রমশ বেড়েই চলছে! এর কারণ খুঁজে পাচ্ছেনা নীহারিকা। তাই ব্যাপারটায় ভীষণ অবাক সে। বিস্ময় কাটাতে রূপলকে এই সম্বন্ধে প্রশ্ন না করলেই নয়। যেই ভাবা সেই কাজ। গলা ঝাকিয়ে নীহারিকা রূপলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। আগ্রহী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“হেই রূপল? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কী হয়েছে আপনার?”

নীহারিকার ঘোরে ডুবে থেকেই রূপল হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলল,

“হয়ত প্রেম রোগে ধরেছে আমায়!”

তাজ্জব হয়ে গেল নীহারিকা। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হলো রূপলের দৃষ্টি এখনও তার দিকেই সীমাবদ্ধ! আচমকা শুকনো ঢোক গিলে সে নির্বোধ গলায় শুধালো,

“সিরিয়াসলি? কার প্রেমে পরেছেন আপনি?”

“আপনার প্রেমে তো ভুলেও নয়! সো ডোন্ট ওরি! এখানে প্রেমে পরার মত আরও সুন্দর সুন্দর জিনিস আছে!”

বেশ ভাব নিয়ে কথাগুলো বলল রূপল! বসা থেকে সোজা দাড়িয়ে গেল। অবিলম্বে নীহারিকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে শার্টের কলারটা ঠিক করতে করতে এদিক ওদিক তাকালো। যেন নীহারিকাকে চিনেই না এমন একটা ভাব নিলো! ঠোঁটে হাসির লেশমাত্র ও নেই তার। গম্ভীর ভাব ফুটে উঠেছে মুখের সর্বত্র। রূপলের এই আকাশচুম্বী ভাব দেখে রাগে গাঁ রি রি করে উঠল নীহারিকার। সেও বসা থেকে দাড়িয়ে গেল। রূপলের মুখের কাছে আঙুল তুলে সে দাঁতে দাঁত চেপে রূপলকে শাসিয়ে বলল,

“যদিও আমার প্রেমে পরেন না? আমি কিন্তু আপনাকে পাত্তা দিবনা! পরিবারের ঠিক করা ছেলেকেই বিয়ে করব।”

সঙ্গে সঙ্গেই নীহারিকার আঙুলটা মুচড়ে ধরল রূপল! ভাবশূণ্য দৃষ্টিতে সে নীহারিকার দিকে তাকালো। দাঁত গিজগিজিয়ে বলল,

“যদিও আমি আপনার প্রেমে পরি। তাহলে আপনি কেন আমাকে বিয়ে করবেন না? লেট মি আনসার?”

আঙুল মুচড়ে ধরে রাখায় ব্যথায় নীহারিকা ছটফট করতে লাগল। তবে মুখে তা প্রকাশ করলনা। এই তুচ্ছ ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা সে রাখে তা বুঝাতে চাইল রূপলকে। অসহ্যকর দৃষ্টিতে নীহারিকা এবার রূপলের দিকে তাকালো। রাগী গলায় বলল,

“কারণ অতিরিক্ত সুদর্শন ছেলেদের চরিত্রের ঠিক থাকেনা! ক্যারেক্টারলেস হয়। আমি যেমন কালো তেমনি কালো ছেলেকেই বিয়ে করব! কেউ কাউকে ঠকানের সম্ভাবনা থাকবেনা।”

“এসব ভুয়া লজিক আপনাকে কে শেখায়? গাঁয়ের রঙে মানুষের চরিত্র বুঝা যায়? কোন জ্যোতিষির কাছ থেকে এই অবাস্তব কথা শুনেছেন?”

“যা আমার নিজের জীবনের সাথে ঘটে গেছে তা আমি অন্যের কাছ থেকে শিখব যাব কেন? শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, বরং আমার পরিচিত অনেক কাছের মানুষদের সাথে এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে। সুন্দর পুরুষদের নারীদের প্রতি লোভ থাকে বেশী! তারা মেয়েদের মন নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। আমি আমার জীবন থেকে যতটুকুনি উপলব্ধি করতে পারলাম আপনাকেও ঠিক ততটুকুনিই বললাম।”

নীহারিকার আঙুলটা ছেড়ে রূপল নিজের রাগকে সংযত করার চেষ্টা করল। ঠাণ্ডা মাথায় সে নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ওকে ফাইন। আগে আপনি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো। হাতের পাঁচটা আঙুল-ই কী সমান?”

ব্যথা নিয়ে আঙুলটা ঘঁষতে ঘঁষতে নীহারিকা ঠোঁট উল্টে রূপলকে বলল,

“না। বাট পৃথিবীর সব সুদর্শন ছেলেরা খারাপ হয়! তার মধ্যে আপনিও একজন!”

“ওহ্ রিয়েলি? আমিও আপনার চোখে খারাপ? তা কী খারাপ কাজ করেছি আমি আপনার সাথে? কাম অন টেল মি?”

“সেদিন রাতের কথা মনে নেই? আপনি আমার গালে চুমু খেয়েছিলেন!”

রাগী ভাবমূর্তি পাল্টে ব্যগ্র হাসল রূপল। আপত্তি কর ভঙ্গিতে নীহারিকার দিকে এক কদম এগিয়ে এলো। ডানপিটে গলায় বলল,

“হ্যাঁ তো? গালেই তো চুমু খেয়েছি। ঠোঁটে তো খাইনি! তবে নেক্সট টাইম ঠোঁটে খাব! আমি তো এমনিও খারাপ অমনিও খারাপ! সো খারাপ কাজ করেই না হয় খারাপ হলাম।”

অমনি নীহারিকার ঠোঁটে হাত চলে গেল। বড়ো বড়ো চোখে সে রূপলের দিকে তাকালো! রূপলের ব্যবহার আচরণে সে হতবাক না হয়ে পারলনা। দিন দিন এ কী অবনতি হচ্ছে রূপলের? এজন্যই বুঝি পুরুষ লোকের সঙ্গ এত খারাপ? বেলেহাজ কথাবার্তা বলতেও তাদের মুখে আটকায় না? নীহারিকার ভয়ার্ত এবং চুপসে যাওয়া মুখখানি দেখে ভেতরে ভেতরে রূপলের বেশ পাশবিক আনন্দ হচ্ছিল! তবে উপরে সে বেশ গাঁ ছাড়া ভাব নিলো। প্যান্টের পকেটে হাত গুজে ভাবে ডুবানো গলায় বলল,

“নেক্সট টাইম আমাকে খারাপ বলার আগে দুইবার ভাববেন ওকে? যখনি আমি নোটিশ করব আপনি আমাকে খারাপ ভাবতে শুরু করেছেন তখনি কিন্তু আমি আপনার ঠোঁটে….

কথার মাঝখানে রূপলকে থামিয়ে দিলো নীহারিকা! রূপলের ঠোঁট কাটা কথা তার একদমই সহ্য হচ্ছিলনা! গাঁয়ে কাটা দিচ্ছিল। অদ্ভুত সুন্দর এক অনুভূতি হচ্ছিল! যে অনুভূতি তার হৃদয়কে অস্থির করে তুলছিল। বেশীক্ষণ এই অস্থিরতা তার মধ্যে কাজ করতে থাকলে জ্ঞান হারাতে বেশী সময় লাগবে না তার। তাই নীহারিকা রূপলকে উপেক্ষা করৱ। নদীর ঘাট পাড় হয়ে সে সামনের দিকে হাঁটা ধরল। রূপলও নীহারিকার পিছু নিলো। প্রসঙ্গ পাল্টাতে নীহারিকা অস্থির হয়ে উঠল। পিছু ঘুরে তৎপর দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো। নিশ্বাস হীন গলায় বলল,

“আমাদের এখন রহস্য উদঘাটন করতে হবে মিস্টার রূপল! সবিতা আপুর বাসায় যেতে হবে। প্লিজ হারি আপ।”

“ওহ্ নো! আবার মিস্টার রূপল কেন? রূপলই তো ঠিক ছিল!”

ভ্রু যুগল কুচকে এলো নীহারিকার। কপালেও কয়েক দফা ভাজ পরল। সন্দেহের দৃষ্টিতে সে পিছু ফিরে রূপলের দিকে তাকালো। কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“এই? আপনি কী আমার সাথে লাইন মারার চেষ্টা করছেন?”

গাঁ ছাড়া ভাব নিলো রূপল। পুনরায় প্যান্টের পকেটে হাত গুজল। জবাবে নীহারিকাকে রাগানোর জন্য বলল,

“লাইন তো আপনি আমাকে মারার চেষ্টা করছেন! আমার মনকে বার বার….

এরমধ্যেই ভীড়ের মাঝখানে কেউ এসে নীহারিকার গাঁয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে সোজা হেঁটে চলে গেল পার্কের গেইটের দিকে। পুরুষালি শরীরের ধাক্কা। বেশ শক্তপোক্ত এই ধাক্কা। ব্যথায় উহ্ করে উঠল নীহারিকা। কথা বলা থামিয়ে দিলো রূপল। ভ্রু যুগল কুঁচকে সে লোকটির যাওয়ার পথে তাকালো। শূণ্য গলায় নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ব্যথা পেয়েছেন?”

“সামান্য।”

ফট করে রূপলের মাথায় কিছু একটা কাজ করল। অস্থির হয়ে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গেই লোকটির পিছু নিলো সে! অবাক হয়ে নীহারিকা দৌঁড়োতে থাকা রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। এক পর্যায়ে সেও রূপলের পিছনে দৌড়াতে লাগল। উৎকণ্ঠিত গলায় রূপলকে শুধালো,

“হেই রূপল? কী হয়েছে? আপনি হঠাৎ দৌড়চ্ছেন কেন?”

দৌড়ানো অবস্থাতেই রূপল পিছু ফিরে রাগী গলায় নীহারিকাকে বলল,

“হাউ স্ট্রেঞ্জ নীহারিকা। লোকটা আপনার গাঁয়ে আস্ত একটা সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে দিল আর আপনি টের ও পেলেন না? অ্যানি হাউ আপনি তাড়াতাড়ি মেডিকেলে যান। ডক্টরকে বলুন কিছু একটা করতে। ড্রাগসের প্রভাব যেন আপনার শরীরে ছড়িয়ে পরতে না পারে তার আগে।”

দৌড়ে কিছুদূর যেতেই রূপল কালো হুডি পরা লোকটিকে পার্কের গেইটের বাইরে দেখতে পেল! প্যান্টের পকেটে হাত গুজে লোকটি বেশ নিশ্চিত রূপে দাড়িয়ে আছে। সাধারণ মানুষদের সাথে বেশ স্বাভাবিকভাবেই মিশে গেছে লোকটি। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সবেচেয় সরল, সোজা খুবই নির্বোধ লোক একমাত্র তিনি! লোকটির পাশে শান্ত এবং স্থিরভাবে দাড়ালো রূপল। তব্ধ শ্বাস ফেলে সে পাশ ফিরে ধীর গলায় লোকটিকে বলল,

“হায় ইয়াং ম্যান!”

সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি পাশ ফিরে রূপলের দিকে তাকালো। নীহারিকা এতক্ষণ রূপলের পাশেই দাড়িয়ে ছিল। হুডির ভেতর থেকে লোকটি চোখ তুলে রূপলের দিকে তাকাতেই নীহারিকার চোখের সামনে লোকটির চেহারা ভেসে উঠল! সঙ্গে সঙ্গেই নীহারিকা অস্থির হয়ে উঠল। জায়গা থেকে প্রস্থান নিয়ে সে রাস্তায় গাড়ির সন্ধান করতে লাগল। ব্যস্ত গলায় রূপলকে বলল,

“এই লোকটিই সেই লোক রূপল! প্লিজ তাকে ক্যাচ করুন। আমি হসপিটালে যাচ্ছি।”

উত্তেজিত হয়ে যেইনা লোকটি ছুটে পালাতে যাবে অমনি রূপল পেছন থেকে লোকটির হুডির মাথা টেনে ধরল! বল না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি দাড়িয়ে গেল। টানতে টানতে রূপল লোকটিকে নিয়ে একটি জনমানবহীন নিরিবিলি জায়গায় দাড়ালো। আক্রোশ ভরা দৃষ্টিতে লোকটি রূপলের দিকে ফিরে তাকিয়ে রইল। যেন এক্ষণি রূপলকে আস্ত চিবিয়ে খাবে!অমনি রূপল অট্ট হেসে দিলো! মুহূর্তেই সেই হাসি তার ভয়ঙ্কর রূপ নিলো! হাসির মধ্যেই সে হিংস্রতা ফুটিয়ে তুলে লোকটিকে বলল,

“খুবই সস্তা প্ল্যানিং তোর! একই প্ল্যান বার বার কাজে লাগানোটা কখনও মাস্টারমাইন্ডের কাজ হতে পারেনা! তুই হয়ত ভুলে গেছিস নীহু খুবই ধূর্ত মেয়ে! সে ধরে ফেলেছে তোর চালাকী। তা না বুঝেই তুই দ্বিতীয়বার একই প্ল্যান কাজে লাগালি। আর ধরাও পরে গেলি। সো স্যাড অফ ইউ ইয়ার।”

বলেই রূপল লোকটির নাক বরাবর জোরে এক ঘু’ষি মারল! সঙ্গে সঙ্গেই লোকটির নাক থেকে গড়গড়িয়ে র’ক্ত ঝরতে লাগল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এত অসহনীয় ব্যথা পাওয়ার পরেও লোকটি মুখ থেকে কোনো আর্তনাদ প্রকাশ করলনা! শুধু তাই নয় তার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হচ্ছেনা। রূপলকে শাসাচ্ছে না, হুমকি-ধমকি দিচ্ছেনা। এমনকি নিজের পক্ষে সাফাইও দিচ্ছেনা! ব্যাপারটায় ভীষণ অবাক হলো রূপল। হুডির কলার চেপে ধরে সে লোকটিকে এনে তার মুখোমুখি দাঁড় করালো। চোয়াল উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী হলো? তুই চুপ করে আছিস কেন? নিজের পক্ষে কিছু বলবি না? আমাকে হুমকি দিবি না?”

লোকটি তবুও চুপ রইল! কেবল রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকল। মুখ থেকে বের হয়ে আসা রক্ত গুলো সে থু থুর মাধ্যমে ফেলতে লাগল। ভ্রু উঁচিয়ে রূপল এবার থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“এই তুই কী বোবা?”

অমনি লোকটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো! হতবিহ্বল হয়ে রূপল লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। প্রশ্ন ছুড়ল,

“সবিতাকে তুই চিনিস?”

লোকটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো! পুনরায় উদ্যমী গলায় রূপল প্রশ্ন ছুড়ল,

“সবিতা এখন কোথায় আছে তুই জানিস?”

লোকটি আবারও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো! উত্তেজিত হয়ে উঠল রূপল। লোকটির কলার ধরে টানতে টানতে সে লোকটিকে নিয়ে রাস্তায় চলে এলো। ঝাঁজালো গলায় লোকটিকে লক্ষ্য করে বলল,

“তুই এক্ষণি আমাকে সবিতার কাছে নিয়ে যাবি! সকাল থেকেই তাকে আমি ফোনে পাচ্ছিনা। মনে হয়না সে বাড়িতেও আছে বলে। ইদানিং তাকে বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়না। হৃদিকেও কাল রাতে সবিতা আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে। আমি আমার ভাইজির ব্যাপারে কোনো কম্প্রোইজ করব না!”

#চলবে..?