#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৪৬
#নিশাত_জাহান_নিশি
“তুই এক্ষণি আমাকে সবিতার কাছে নিয়ে যাবি! সকাল থেকেই তাকে আমি ফোনে পাচ্ছিনা। মনে হয়না সে বাড়িতেও আছে বলে। ইদানিং তাকে বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়না। হৃদিকেও কাল রাতে সবিতা আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে। আমি আমার ভাইজির ব্যাপারে কোনো কম্প্রোইজ করব না!”
ঐপাশ থেকে লোকটির কোনো সাড়া শব্দ পেলনা রূপল। পাবেই বা কী করে? লোকটি তো বলল সে বোবা! কথা বলতেই পারেনা। তার থেকে উত্তর কীভাবে আশা করা যায়? নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হলো রূপল। লোকটির হুডির কলার টেনে ধরে সে হাঁটা থামিয়ে জায়গায় দাড়িয়ে পরল। পিছু ফিরে আ’হ’ত এবং রাগে ক্রোধান্বিত লোকটির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে বলল,
“ধ্যাত। কাকে কী বলছি আমি? তুইতো বোবাই। আমার প্রশ্নের উত্তর দিবি কীভাবে?”
এই বলে রূপল কিছু একটা ভেবে পুনরায় লোকটির দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“সবিতা এখন কোথায় আছে সেই জায়গার নাম, ঠিকানা তুই আমাকে লিখে দিতে পারবি?”
লোকটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। পাশের টং দোকান থেকে একটি খাতা কলম নিয়ে রূপল লোকটির হাতে ধরিয়ে দিলো। দ্রুত গলায় বলল,
“নে। জায়গার নাম, ঠিকানাটা লিখে দে।”
লিখার সময় অসম্ভব হাত কাঁপছিল লোকটির। কলমটা বার বার হাত থেকে পরে যাচ্ছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে যেন সে খাতায় লতাপাতা আঁকছিল। মাথা গরম হয়ে গেল রূপলের। লোকটি যে অভিনয় করছে তা বুঝতে বেশী বেগ পেতে হলোনা তার। রাস্তা থেকে একটি অর্ধভাঙা ইট কুড়িয়ে রূপল লোকটির হাতের আঙুল বরাবর জোরে একটি ছেঁচা দিতেই লোকটি মাগো মা বলে চিৎকার করে উঠল! তাজ্জব বনে গেল রূপল। হতবাক দৃষ্টিতে সে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। অবিশ্বাস্য গলায় শুধালো,
“এই তুই এতক্ষণ নাটক করছিলি আমার সাথে?”
আর এক সেকেন্ডও দাড়ালো না লোকটি! পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজে পেল। প্রাণপণে উল্টো দিকে দৌড়োতে লাগল সে। পেছন ফিরে লোকটি শ্লেষাত্মক গলায় রূপলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পারলে আমাকে ধরে দেখা!”
নিজের জেদকে সংযত করতে পারলনা রূপল। কেউ তার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে সে ততক্ষণ অবধি শান্তি পায়না যতক্ষণ অবধি সে চ্যালেঞ্জে না জিততে পারে! আক্রমনাত্নক হয়ে রূপল লোকটির পেছনে দৌড়াতে লাগল। রুদ্রাক্ষের ন্যায় রক্তবর্ণ ধারণ করে লোকটিকে বলল,
“আমার হাত থেকে পালাতে পারিস কী-না তা আগে ভেবে দেখ।”
দুজনের মধ্যে দৌড়োদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। ঘণ্টা খানেক সময় পার করে লোকটি তার প্ল্যানিং অনুযায়ী এখান থেকে ওখানে দৌড়োদৌড়ি করে রূপলকে নিয়ে একটি ভাঙাচোরা বাড়িতে চলে এলো! বাড়িটি দেখতে যেমন স্যাঁতস্যাঁতে ছিল তেমনি অত্যন্ত নির্জন একটি জায়গায় ছিল। তাদের পাশের এলাকায় যে এমন একটি ঘন, নিরিবিলি, ভূতুড়ে জায়গা আছে তা জানা ছিলনা রূপলের। উপর থেকে এই একতলা বিশিষ্ট বাড়িটি দেখতে দুর্গন্ধযুক্ত, কুৎসিত, ভাঙাচোরা হলেও ভেতরটা মানুষের বসবাসযোগ্য। এইটুকুনি আন্দাজ করতে রূপলের খুব একটা ভাবতে হয়নি।
দৌড়াতে দৌড়াতে রূপল বাড়ির এই দিকগুলো খেয়াল করছিল। অমনি তার গাঁ টা কেমন যেন ছমছমে হয়ে উঠল! লোকটি এতক্ষণে বাড়ির পূর্ব দিকে থাকা রুমটির কাঠের দরোজাটি খুলে রুমটির ভেতর ঢুকে পরল। দৌড়ের বেগে রূপলও কিছু না ভেবেচিন্তে-ই লোকটির সাথে সাথে রুমটিতে ঢুকে গেল! রুমটিতে ঢুকা মাত্রই রূপল অবাক হয়ে গেল। দুই তিনটি রুম মিলিয়ে বোধ হয় একটি রুম তৈরী করা হয়েছে। কয়েকটি ভাঙাচোরা খাট পরে আছে রুমটিতে। দামী কোনো আসবাবপত্র না থাকলেও রুমটিতে হকিস্টিক থেকে শুরু করে ছু’রি, চা’পা’তি, লোহা কোনো কিছুরই কমতি ছিলনা! খোলা জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় রূপল এতটুকুনি বেশ ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পারল। সব মিলিয়ে খুবই লোমহর্ষক একটি পরিবেশ। রূপল বুঝতে পারছিল সে খুব বড়ো একটি ট্রেপে আটকে গেছে। এই ট্রেপ থেকে বের হয়ে যাওয়াটা এত ইজি নয়!
রুমের ভেতর ঢুকতেই রূপলের মনে হলো তার পেছন থেকে কেউ এসে রুমের দরজাটি লাগিয়ে দিলো! ঝট করে পিছু ফিরে তাকালো রূপল। সবিতাকে হঠাৎ দেখে অবাক হয়ে গেল সে! কদাচিৎ হেসে সবিতা রূপলের দিকে এগিয়ে এলো। বুকের উপর দু’হাত গুজে বেশ খামখেয়ালি স্বরে বলল,
“কী রূপল? খুব অবাক হচ্ছ আমাকে দেখে?”
ভ্রু যুগল কুঁচকালো রূপল। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো সবিতার দিকে। উত্তেজিত গলায় শুধালো,
“তুমি এখানে কী করছ? আর হৃদি কোথায়?”
হাত দুটো ঝেরে বেশ গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে সবিতা বলল,
“বিক্রি করে দিয়েছি তোমাদের হৃদিকে! তাকে আর কোথাও খুঁজে পাবেনা তোমরা!”
অমনি রূপলের মাথাটা ফট করে গরম হয়ে গেল। আগ পাছ না ভেবেই সে প্রখর হিংস্রাত্নক হয়ে সবিতার গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলো! সঙ্গে সঙ্গেই সবিতা গালে হাত দিয়ে রাগে কটমট করে খানিক চ্যাচিয়ে বলল,
“আকাশ কোথায় তুমি? শিগগির বের হয়ে এসো! রূপল আমার গাঁয়ে হাত তুলেছে!”
হুডির ভেতরে থাকা লোকটির নাম যে আকাশ তা বুঝতে বেশী সময় নিতে হলোনা রূপলকে। হাতে থাকা হকিস্টিকটি ঘুরাতে ঘুরাতে অন্ধকার থেকে বের হয়ে এলো। রূপলের দিকে এক’পা দু’পা করে হেঁটে এসে লোকটি হেয়ালী স্বরে রূপলকে শুধাল,
“কী মিস্টার পার্ফেক্ট? খুব অনুতাপ হচ্ছে তাইনা? কেন চ্যালেঞ্জটা একসেপ্ট করলেন তা নিয়ে?”
রূপল বেশ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। ভয়ভীতির বিষয়টা ঘুনাক্ষরেও বুঝালো না সে। নিজের দুর্বল জায়গা বুঝতে দিলেই তাকে এর মাসুল দিকে হবে। শার্টের কলারটা ঠিক করে রূপল পকেটে দু’হাত গুজে দাড়ালো। ভাবশূণ্য গলায় লোকটির মুখোমুখি দাড়িয়ে বলল,
“তোকে জাস্ট দশ মিনিট সময় দিলাম। এই সময়ের মধ্যে বলে দে নীহুর সাথে তোর কীসের শত্রুতা? কোন কারণে তুই নীহুর ক্ষতি করতে চাইছিস?’
অমনি পাশ থেকে সবিতা অট্ট হাসল! রূপলকে সে বিদ্রুপ করে বলল,
“কী বললে? নীহু? ইদানিং লক্ষ্য করছি ঐ ধূর্ত মেয়েটার প্রেমে তুমি বেশ ভালোই মজেছ! আমার প্রায় বোনটাকেও ভুলে গেছ।”
সূচালো দৃষ্টিতে রূপল পাশ ফিরে সবিতার দিকে তাকালো। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
“যদি সত্যিই আমি নীহুর প্রেমে মজে থাকি তো আমি বলব হ্যাঁ, বেশ করেছি আমি তার প্রেমে মজেছি! যদি তোমার কথা সত্যি হয়ে থাকে তো আমি জোর গলায় বলব তোমার বোনকে ভুলে যাওয়াটা হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো আশীর্বাদ!”
স্তব্ধ হয়ে গেল সবিতা! রূপলের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো সে। বলল,
“তুমি সত্যিই আমার বোনকে ভুলে গেছ রূপল?”
“ভুলে যাচ্ছি বলেই নীহুর প্রতি তোমার এত ক্ষোভ তাইনা? ভাবছ নীহুর চালাকির জন্যই তোমার বোন ধরা পরে গেছে? ঐ ছলনাময়ী, মিথ্যাবাদি, ফ্রড মেয়েটা তোমার বোন বলে তুমি তার হয়ে নীহুর থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছ?’
প্রত্যত্তুরে সবিতা হাউমাউ করে চিৎকার করে বলল,
“হ্যাঁ নিচ্ছি! কারণ, আমি শান্তি পাচ্ছিনা। প্রতি রাতেই যেন মনে হচ্ছে সুহাসিনী আমার কানে কানে এসে বলছে তাকে তোমার চোখে ছোটো করার শোধ নিতে! তোমার নীহুর থেকে শোধ নিতে! তাছাড়া আমি এমনি এমনি নীহারিকার পেছনে পরিনি! তোমার চোখে নীহারিকা খুব ইনোসেন্ট হলেও অতীতে সে আকাশের সাথে যে পাপ করেছে তার শাস্তি তাকে পেতেই হবে!”
অমনি মনে হলো কেউ রুমের নড়বড়ে দরজাটি খুলে রুমের ভেতর ঢুকে গেল! সবাই দৃষ্টি ফিরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখল কয়েকজন পুলিশসহ নীহারিকাকে! ভয়ে সিঁটিয়ে গেল আকাশ এবং সবিতা! দুজনই চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে পিছু হটতে লাগল। লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে পুলিশ ইন্সপেক্টর আকাশ এবং সবিতার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। দাঁত চিবিয়ে বললেন,
“বাহ্। ভালো আস্তানাই তো খুঁজে বের করেছিস তোরা! তোদের বুদ্ধিকে বাহবা না দিয়ে পারছিনা আমি।”
রূপলও তখনি পকেট থেকে ফোনটি বের করে কাট করল কলটি! ব্যগ্র হেসে সে বিধ্বস্ত আকাশ এবং সবিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন আর কলটা লাইনে রেখেই বা লাভ কী? কাট করে দিই!”
রূপলের বুদ্ধি ধরতে পেরে আকাশ এবার বেশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল! রূপলকে উদ্দেশ্য করে সে ঝাঁজালো গলায় বলল,
“তুই আমার জালে আমাকেই ফাঁসিয়েছিস তাইনা? কল লোকেশন ট্রেস করে পুলিশকে এই অবধি নিয়ে এসেছিস?’
ক্রুর হেসে রূপল বলল,
“একটু বুদ্ধি না খাটালে কী চলে বল? আমি যখন বুঝতে পারছিলাম আমি তোর ট্রেপে পা দিয়ে ফেলছি তখনি আমি নীহুকে কল করি! আর কথা না বলে কলটা এভাবেই ফেলে রাখি। আমি জানতাম নীহু খুব চতুর! আমার কলের উদ্দেশ্য সে বুঝতে পারবে। আমার ইশারা বুঝে সে কলটা হোল্ডে রেখেছিল। পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের লোকেশন ট্রেস করে এই অবধি পৌঁছেও গেল!”
এমনিতেই আকাশ নীহারিকার উপর ক্ষিপ্ত! তার উপর রূপল এবং নীহারিকার এই চালাকী। সব মিলিয়ে আকাশ ফাস্ট্রেটেড হয়ে উঠল! হাতের কাছে একটি হকিস্টিক পাওয়া মাত্রই সে ভীতু নীহারিকার দিকে হকিস্টিকটি ছুড়ে মারার চেষ্টা করল! সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ইন্সপেক্টর ক্ষিপ্র হয়ে এসে পেছন থেকে আকাশকে পেঁচিয়ে ধরলেন। দাঁত কিড়মিড়িয়ে আকাশের কানে কানে বললেন,
“বুকের পাঠা খুব বড়ো তোর তাইনা? পুলিশের সামনেও মা’রা’মারি?’
নীহারিকার উপর রাগ ঝেরে আকাশ তটস্থ গলায় পুলিশকে বলল,
“এই মেয়েটা আমার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে স্যার! আমাকে পথের ফকির বানিয়ে দিয়েছে। আপনি জানেন সে কী করেছে আমার সাথে?”
তৎক্ষনাৎ নীহারিকা জায়গা থেকে নড়েচড়ে দাড়ালো। রূপলকে উপেক্ষা করে এসে সে কাতর ভঙ্গিতে আকাশের মুখোমুখি দাড়ালো। চোখের জল ছেড়ে সে অনুতপ্ত গলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিশ্বাস করুন। সেদিন এ’ক্সি’ডেন্টটা আমার কারণে হয়নি। হয়েছে দিশার কারণে! আমি দিশাকে বলেছিলাম এত স্পিডে স্কুটি না চালাতে। কিন্তু সে আমার কথা শুনেনি। তখন অনেক রাত ছিল। রাস্তাঘাটও প্রায় শুনশান ছিল। তুলির বার্থডে সেলিব্রেট করে বাড়ি ফিরছিলাম আমরা। রাতের আঁধারে হয়ত সে রাস্তাঘাট ভালোভাবে খেয়ালও করেনি। তখনি কোথা থেকে এসে যেন আপনি স্কুটির নিচে পরে গেলেন! বিশ্বাস করুন আমি অনেক চেষ্টা করেছি আপনাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু দিশা আমাকে সেই সুযোগটা দেয়নি। জোর করে আমাকে এ’ক্সি’ডেন্ট স্পট থেকে টেনে হেছড়ে নিয়ে গেছে। সেদিনের পর থেকে আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি। বিভিন্ন হসপিটালে আপনার সন্ধান করেছি। কিন্তু আপনাকে কোনো হসপিটালে খুঁজে পাইনি।”
নীহারিকা কথা একরত্তিও বিশ্বাস করতে পারলনা আকাশ! ক্ষোভ দেখিয়ে সে বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলল,
“মিথ্যা বলছেন আপনি হ্যাঁ? মিথ্যা বলছেন? দিশা বলেছে সেদিন স্কুটি আপনি চালিয়েছেন। আর এক্সিডেন্টটা আপনার ভুলের কারণেই হয়েছিল!”
তখনি নীহারিকার পক্ষ নিয়ে আকাশের মুখোমুখি দাড়ালো রূপল। নীহারিকাকে অবাক করে দিয়ে সে সোজাসাপটা গলায় আকাশকে বলল,
“নীহু কখনও মিথ্যা বলতে পারেনা! দিশা মেয়েটা যে মিথ্যা বলছে সেই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই! আচ্ছা এসব কোনো ব্যাপার না। পুলিশের দু’একটা লা’ঠি’র বারি খেলেই দিশা ফরফরিয়ে মুখ থেকে সব সত্যি কথা বের করে দিবে! এখন বল হৃদি কোথায়? কোন গর্তে লুকিয়েছিস তাকে?”
জবাবে আকাশ কিছু বলার পূর্বেই পুলিশের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সবিতা বলল,
“হৃদি পাশের রুমেই আছে। হয়ত ঘুমুচ্ছে।”
কদাচিৎ হাসল রূপল! চোখ উঁচিয়ে সবিতার দিকে তাকালো। ঠাট্টার স্বরে বলল,
“আহা সবিতা। তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? পুলিশ দেখে সব হাওয়া কী ফোঁস হয়ে গেল? এতক্ষণ তো পাতানো প্রেমিকের পক্ষ নিয়ে খুব ঝারছিলে আমায়। শুধু তাই নয় খুব সাহসও দেখাচ্ছিলে। এখন কোথায় গেল সেই সাহস? পশ্চাৎপদ দিয়ে বের হয়ে গেল?”
#চলবে…?
#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৪৭
#নিশাত_জাহান_নিশি
“আহা সবিতা। তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? পুলিশ দেখে সব হাওয়া কী ফোঁস হয়ে গেল? এতক্ষণ তো পাতানো প্রেমিকের পক্ষ নিয়ে খুব ঝারছিলে আমায়। শুধু তাই নয় খুব সাহসও দেখাচ্ছিলে। এখন কোথায় গেল সেই সাহস? পশ্চাৎপদ দিয়ে বের হয়ে গেল?”
রূপলের অকপট কথায় যদিও ভীষণ রাগ হচ্ছিল সবিতার তবে সে এই সংকটাপন্ন মুহূর্তে নিজেকে ধীর স্থির রাকার চেষ্টা করল। ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করল। জবাবে সে মাথা নুইয়ে বেশ নমনীয় গলায় রূপলকে বলল,
“আকাশ আমার পাতানো প্রেমিক নয় রূপল। আকাশ আমার কলেজ ফ্রেন্ড! ঘটনাচক্রে একদিন তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তখন তার অসুস্থতা এবং এক্সিডেন্টের কথা জানতে চাইলে সে আমাকে নীহারিকার সম্পর্কে বিস্তারিত খুলে বলে। আকাশের কথা শুনে তখন মনে হয়েছিল সত্যিই হয়ত নীহারিকা আকাশের সাথে অন্যায় করেছে। তাই আমি আকাশের পক্ষ নিয়ে নীহারিকাকে একটা চরম শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম! কিন্তু এখন তো নীহারিকার কথা শুনে মনে হচ্ছে আকাশ এবং আমি দুজনই ভুল ছিলাম! সব দোষ আসলে নীহারিকার নয় বরং দিশার ছিল। কেন যে একতরফা সব শুনতে গেলাম! আমার উচিৎ ছিল নীহারিকার কাছ থেকেও সব জানতে চাওয়া। এখন বড্ড আফসোস হচ্ছে।”
সবিতা তার মিষ্টি মিষ্টি কথায় রূপলকে ভুলাতে পারলনা! সবিতার চালাকি ধরতে রূপলের এক সেকেন্ডও সময় লাগলনা। ভনিতা ভুলে রূপল সোজাসাপটা গলায় সবিতাকে বলল,
“এখন প্যাচে পরে আর ভালোমানুষি করতে হবেনা সবিতা! তোমার আসল রূপ আমার দেখা হয়ে গেছে। তুমি শুধু অন্যায় করোনি, ইভেন তুমি অন্যায়কে প্রশ্রয়ও দিয়েছ। যার শাস্তি তোমাকে আইন দিবে। তবে আমি ভাবতে পারিনি সবিতা, তোমরা দুই বোনই সেইম হবে। ভেবেছিলাম তুমি অন্তত ভালো হবে। কারণ, একজন মা কখনও খারাপ মানুষ হতে পারেনা। কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল সবিতা। ভালো খারাপ কখনও মাতৃত্বে প্রকাশ পায়না! তাছাড়া তুমিতো আমার হৃদির মা ও নও! মা এবং ভালো মানুষ হওয়ার মর্ম তুমি কীভাবে বুঝবে?”
সবিতাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলোনা রূপল। পুলিশের হাতে আকাশ এবং সবিতাকে তুলে দিলো। পরবর্তী মিশন তাদের দিশাকে আটক করা! দিশার মুখ থেকে স্বীকারোক্তি বের করা। হৃদিকে পাশের রুম থেকে রূপল ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে তুলে নিলো। হৃদি, রূপল এবং নীহারিকা তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। অন্যদিকে পুলিশ তাদের গাড়ি নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
নীহারিকাকে বাড়ির সামনে দাড় করিয়ে রেখে রূপল হৃদিকে নিয়ে তার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। নীহারিকাকে যদিও রূপল বলেছিল বাড়ির ভেতরে আসতে তবে নীহারিকা নাকচ করে দিলো। এই মুহূর্তে কিছুই ভালো লাগছেনা তার। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। নীহারিকার মনের কথা চিন্তা করে রূপল আর তাকে জোর করলনা। হৃদিকে রাখতে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। সবিতার সব কুকীর্তি রূপল তার মাকে সংক্ষেপে বলল। সব শুনে নাজনীন বেগম বেশ হায় হুতাশ করলেন। হৃদির জন্য কষ্ট পেলেন। ভবিষ্যতে হৃদির কী হবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ডুবে গেলেন। হৃদিকে বিছানার উপর শুইয়ে রেখে রূপল যেইনা রুম থেকে বের হতে যাবে অমনি নাজনীন বেগম উদাস গলায় রূপলকে বললেন,
“হৃদির তো এখন একজন মা প্রয়োজন রূপল! বাবা হিসেবে তুই তো আছিসই!”
নাজনীন বেগমের আবেগী কথায় রূপল পিছু ফিরল। নিশ্চল দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকালো। কয়েক সেকেণ্ড মৌন থেকে হটকারি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“স্ট্রেঞ্জ হৃদির জন্য আমি মা কোথা থেকে আনব?”
“কেন? তুই চাইলেই তো পারিস হৃদির জন্য মা আনতে!”
রূপল বেশ বুঝতে পারল তার মা কোন প্রসঙ্গে কথা বলছে! তাই সে তার মাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বরং কড়া গলায় বলল,
“আমি এখনি বিয়ে করতে চাইনা মা! সো এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”
“আর কখন বিয়ে করবি তুই? বয়স কী কম হলো তোর?”
“শুধু বয়সটাই দেখলে মা? আমার যে চাকরী বাকরী কিছু নেই তা দেখলে না? একটা বেকার ছেলের হাতে কোন পরিবার তার মেয়েকে তুলে দিবে?”
“হাসালি রূপল! তুই জানিস? আমার এই বেকার ছেলের হাতেই কত পরিবার তার মেয়েকে তুলে দেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পরে আছে? তুই শুধু মুখ খুলে একবার হ্যাঁ বল বাবা! বাকিটা আমি বুঝে নিব!”
“অবিবেচকের মত কথা বলো না তো মা। আমার কী সেল্ফ রেসপেক্ট নেই? যে নিজে কোনো আয় রোজগার না করেই একটা মেয়েকে নিজের ঘাড়ে তুলতে যাব? বাপের টাকায় নিজেও চলব, আমার বউকেও চালাব! সবসময় তোমার এসব বোকা বোকা কথা। মুডটাই নষ্ট করে দাও তুমি।”
বেশ মেজাজ দেখিয়ে রূপল বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে নাজনীন বেগম ফোঁস করে শ্বাস ফেললেন। শক্ত গলায় বললেন,
“এসব বলে তুই আমাকে থামাতে পারবিনা রূপল। আমিতো তোর জন্য মেয়ে দেখবই দেখব। তবে আগে পিয়াসার রিসিপশনটা হয়ে যাক। এরপর তোর বিয়ের জন্য আমি আট ঘাট বেঁধে নামব!”
বাইক নিয়ে রূপল বাড়ির মেইন গেইটের সামনে যেতেই দেখল নীহারিকা তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্রায় অধৈর্য্য হয়ে পরেছে! রিকশা ও ঠিক করে ফেলেছিল সে বাড়ি যাওয়ার জন্যে। তবে রূপলকে দেখে রিকশাটিকে সে চলে যেতে বলল। রূপলের বাইকের পেছনে ওঠে বসল সে। সঙ্গে সঙ্গেই বাইক ছেড়ে দিলো রূপল। নীহারিকা প্রথমে রূপলের কাঁধে হাত রাখলেও বাইকের ঝাঁকুনিতে সে হাতটা রূপলের কাঁধ থেকে নামিয়ে নিলো! ব্যাপারটায় ভীষণ অবাক হলো রূপল। কপাল ও কুঁচকে এলো তার। বিস্মিত গলায় সে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিয়েই নীহরিকাকে বলল,
“আপনার দেখি সবকিছুই উল্টা! ঝাঁকুনি খেলে মানুষ সামনের মানুষটাকে আরও শক্ত করে ধরে। যেন পড়ে না যায় তাই। আর আপনি কী-না ঝাঁকুনি খেয়ে হাতটা নামিয়ে নিলেন? পড়ে যাওয়ার ভয় নেই আপনার?”
শক্ত গলায় নীহারিকা বলল,
“না! কারণ আমার নিজের উপর কনফিডেন্স আছে। কারো উপর ডিপেন্ডেবল হতে চাইনা আমি। এতে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে!”
“আরে বাহ্! হোয়াট অ্যা লজিক। এসব ইবলিসি লজিক নিয়ে আপনি রাতে ঘুমান কীভাবে? ঘুমের মধ্যে তারা নাড়াচাড়া করে না?”
“বিদ্রুপ করলেন? আমার লজিককে ইবলিসি লজিক বললেন?”
“অভেয়েসলি এসব আপনার ইবলিসি লজিক! রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা এড়াতে অবশ্যই অন্যের উপর ডিপেন্ডেবল হতে হয়। এতে ঝুঁকি কম থাকে।”
“উঁহু! সবাই যে আমাকে বাঁচানোর জন্য দু’হাত বাড়িয়ে দিবে এমনটা কিন্তু নয়! কেউ কেউ আবার ওঁৎ পেতে থাকবে আমাকে মারার জন্য! আমাকে ধ্বংস করার জন্য। তাই যার তার উপর ডিপেন্ড করতে নেই। যদিও কথাটা আমি আপনাকে বলিনি। তবে ছোটোবেলা থেকে আমি এই লজিকেই বড়ো হয়েছি। বিপদে কারো উপর ভরসা করতে নেই! নিজের বল-ই হলো বাহুবল। কারণ, আমি মনে করি আমি নিজেকে বাঁচাতে যতটা কেয়ারফুল হব, অন্যরা ততটা কেয়ারফুল হবেনা! তাই নিজের প্রতিরক্ষা নিজেকেই করতে হবে।”
“আহা জ্ঞানের রাণী! তো বলি কী আপনার থেকে জ্ঞান অর্জন করতে কী আমার ফিস দিতে হবে?”
“ফাইজলামি করবেন না তো! এমনিতেই আছি আমি মহা টেনশনে।”
“কীসের টেনশান শুনি?”
“দিশা যদি সত্যিটা স্বীকার না করে?”
“করবেনা কেন? পুলিশের লাঠির বারি খেলে ফরফরিয়ে সব স্বীকার করবে।”
“দিশা তো এমনিতেই আমার উপর ক্ষিপ্ত! যদি কোনো ভাবে আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়?”
“যদিও আপনি কারো উপর ডিপেন্ডেড নন। তবুও বলছি এই বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দিন। টেনশন ফ্রি থাকুন। আপনি বরং এখন পিয়াসা এবং নিহাল ভাইয়ার রিসিপশন নিয়ে ভাবুন।”
“এতে আর ভাবার কী আছে? সময়মত তো রিসিপশন হবেই।”
“বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান লাগলে তো আপনাদের মেয়েদের সাজগোজ, রূপচর্চার কোনো কমতি থাকেনা। তার উপর শপিংয়েরও একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। তাই বললাম আগে থেকেই প্রিপারেশন নিতে।”
“হাহ্! আমার আবার রূপচর্চা। হাজার রূপচর্চা করলেও গাঁয়ের কালো চামড়া তো আর ফর্সা করতে পারবনা! তাই বাড়ির কোনো অনুষ্ঠান নিয়ে আমার তেমন কোনো মাতামাতি নেই।”
“তার মানে আপনি মিন করতে চাইছেন গাঁয়ের ফর্সা চামড়াই সব?”
“যার যেটার কমতি কেবল সেই তার গুরুত্ব বুঝে জানেন? বাকিরা শুধু জ্ঞান দিতে আসবে। যাই হোক, রিসিপশনে আপনার কী প্ল্যান?”
“ঐ তো আপনার মতই। কোনো প্ল্যান নেই!”
“কী রঙের পাঞ্জাবি পরবেন?”
“এখনও ডিসাইড করিনি।”
“আমি একটা রঙ সাজেস্ট করব?”
“করুন।”
“মেরুন কালার।”
“এহ্! এসব হলো মেয়েদের কালার! আমি তো কালো সাদা ছাড়া পাঞ্জাবিই পরিনা।”
“কে বলল এসব মেয়েদের কালার? আর সবসময় তো একই রঙ ভালো লাগেনা পরতে তাইনা? মাঝে মাঝে একটু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।”
“মেরুন কালার আপনার প্রিয় রঙ?”
“হুম! আমার খুব শখ জানেন? মেরুন কালার পাথরের কাজ করা গর্জিয়াস একটা লেহেঙ্গা পরব। কিন্তু…
“কিন্তু কী?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীহারিকা। বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,
“আমার গাঁয়ের রঙ তো কালো! ড্রেসের চেয়ে আমার গাঁয়ের রঙটাই বেশী চকচক করবে!”
অমনি রাস্তার পাশ ঘেঁষে বাইকটা থামিয়ে দিলো রূপল! পিছু ফিরে নীহারিকার দিকে অগ্নিঝরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! রূপলের আকস্মিক এই তেজী রূপ দেখে নীহারিকা ভয় পেতে শুরু করল! রূপলের এভাবে রেগে যাওয়ার কারণ সে বুঝল না! নীহারিকা তো রূপলকে কটাক্ষ করে কিছু বলেনি। কিয়ৎক্ষণ নীহারিকার দিকে এভাবে রক্তশূল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রূপল তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
“নিজেকে সবসময় ছোটো করে খুব মজা পান আপনি তাইনা? আপনি যেমনটা নিজেকে ভাবেন আপনি কিন্তু তেমনটাও আহামরি কালো নন। ডু ইউ নো দেট নীহু? আপনার গাঁয়ের রঙের চেয়েও আপনার চোখ, আপনার নাক, আপনার ঠোঁট, আপনার হাসি কতটা আকর্ষণীয়? যারা খাঁটি সৌন্দর্য খুঁজবে তারা কখনও আপনার গাঁয়ের রঙের দিকে নয় বরং আপনার চেহারায় যে অদ্ভুত মায়া আছে সেই মায়ার প্রেমে ডুবে যাবে!”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নীহারিকা রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। রূপল এতটা নিঁখুতভাবে তার রূপের প্রশংসা করে দিলো? তবে কী রূপল এতটা সূক্ষ্ম নজরে তার দিকে তাকায়? এই প্রথম কোনো পুরুষ তার রূপের প্রশংসা করল! কুৎসিত দেখতে মেয়েটাকে এক পলকে রূপসী বানিয়ে দিলো! খুশিতে নীহারিকার চোখের কোণে স্বচ্ছ জল টলমল করছিল। সঙ্গে সঙ্গেই রূপল নীহারিকার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো! রাগের চোটে রূপল এতদিন যাবত নীহারিকাকে নিয়ে যা ভাবত সব অভিব্যক্তি প্রকাশ করে দিলো। যা তাকে এই মুহুর্তে লজ্জায় ফেলে দিলো!
কোনো কথা না বাড়িয়ে রূপল পুনরায় বাইক স্টার্ট করে দিলো। দুজনের মধ্যেই পিনপতন নীরবতা বিরাজ করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপল নীহরিকাদের বাড়ির সামনে এসে বাইক থামালো। নিশ্চুপ হয়ে দুজনই বাইক থেকে নেমে পরল। নীহারিকার পিছু পিছু রূপল ও নীহারিকাদের বাড়িতে ঢুকে পরল। নিহালও তখন বাড়িতে উপস্থিত। রূপলকে দেখে ভীষণ খুশি হলো সে। তবে খুশি হতে পারলনা পিয়াসা! রূপলের সাথে নীহারিকাকে একদমই মানতে পারেনা সে!
নীহারিকাকে ড্রাগস দেওয়ার ঘটনাটা এবং শেষ পর্যন্ত আসল দোষীদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার সব ঘটনা রূপল ধীরে ধীরে নিহাল, মারজিনা বেগম এবং পিয়াসাকে খুলে বলল। সব শুনে সবার মধ্যে যেমন আতঙ্ক কাজ করছিল তেমনি আনন্দও হচ্ছিল। এবার অন্তত নীহারিকা আকাশের হাত থেকে মুক্তি পেল। খারাপ কিছু হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেল। যদিও পিয়াসা এই গোটা ব্যাপারটায় বেশ নাক ছিটকাচ্ছিল! নীহারিকার পাশে ঢাল হয়ে রূপলের দাড়ানোটা তার সবচেয়ে অপছন্দের এবং বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছিল!
বাড়িতে পৌঁছেই নীহারিকা তার রুমে ঢুকে গেল। কারো সাথে দেখা করতে কিংবা কথা বলতে ইচ্ছে হলোনা তার। পিয়াসা এবং নাজনীন বেগম চলে গেলেন রান্নাঘরে রূপলের জন্য নাশতা তৈরী করতে। সেই সুযোগে রূপলকে একা পেয়ে নিহাল একটা সিক্রেট রূপলের কাছে শেয়ার করল! প্রাণোচ্ছ্বল হেসে সে প্রফুল্ল গলায় রূপলকে বলল,
“একটা গুড নিউজ আছে রূপল!”
বেশ আগ্রহী গলায় রূপল বলল,
“কী গুড নিউজ জিজু?”
“নীহারিকার জন্য একটা বিয়ে এসেছে! ছেলেটা অবশ্য আমার অফিসের-ই কলিগ। খুব তাড়াহুড়ো করছে তারা। আমার রিসিপশনের পর পরই নীহারিকাকে দেখতে আসবে তারা!”
#চলবে….?
#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৪৮
#নিশাত_জাহান_নিশি
“নীহারিকার জন্য একটা বিয়ে এসেছে! ছেলেটা অবশ্য আমার অফিসের-ই কলিগ। খুব তাড়াহুড়ো করছে তারা। আমার রিসিপশনের পর পরই নীহারিকাকে দেখতে আসবে তারা!”
নিস্তব্ধ, নির্বিকার, হতভম্ব রূপল! কিছু মুহূর্তের জন্য তার নড়াচড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। নিহালের কথা তার এক কান দিয়ে প্রবেশ তো করল তবে অন্য কান দিয়ে তা বের হওয়ার বদলে বরং কর্ণকুহরে থেকেই বিকট আওয়াজে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল! যার তিক্ততা রূপল বাইরে প্রকাশ করতে না পেরে ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছিল! এই প্রথম তার উপলব্ধি হলো নীহারিকার প্রতি তার মনে আলাদা এক অনুভূতি জন্ম নিয়েছে! যা হয়ত এক এক-দুইদিনে তৈরী হয়নি। ধীরে ধীরে তৈরী হয়েছে।
রূপলের আকস্মিক স্তব্ধতা দেখে অবাক হলো নিহাল। নির্বোধ ভঙ্গিতে সে রূপলকে তার হাত দ্বারা মৃদু ধাক্কা দিলো। অমনি রূপল তার নিজের মধ্যে ফিরে এলো। জায়গা থেকে কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে বসল। নিহালের দিকে সচকিত দৃষ্টি ফেলল সে। অমনি বিস্ময়কর গলায় নিহাল প্রশ্ন ছুড়ল,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড রূপল? হঠাৎ কোন ঘোরে ডুবে গেলে তুমি? আমি এতক্ষণ ধরে যা যা বলছিলাম তার কিছুই শুনতে পাওনি তুমি?”
নিহালের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো রূপল। মাথা নুইয়ে সে নখ খুঁটতে লাগল! গলা ঝেড়ে সে গম্ভীর গলায় নিহালকে বলল,
“বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে না জিজু?”
“যেমন? কীসের তাড়াহুড়ো?”
“নীহারিকা তো সবেমাত্র অনার্সে উঠল! অন্তত অনার্সটা কমপ্লিট করুক।”
“ওহ্ আচ্ছা। পড়ালেখা নিয়ে তুমি টেনশন করছ? এটা টেনশনের কোনো ব্যাপার হলো? কজ বিয়ের পরেও নীহা পড়তে পারবে। উজ্জল তাকে পড়াবে। এই বিষয়ে কোনো এক্সট্রা টেনশন বা সন্দেহ নেই।”
“বাই অ্যানি চান্স বিয়ের পর যদি না পড়ায় জিজু! আই থিংক প্রত্যেকটা মেয়েরই সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ড হওয়ার পর বিয়ে করা উচিৎ! ইট’স ভেরি ইম্পর্টেন্ট পার্টস অফ এভরি ওমেনস। টু বি অনেস্ট জিজু এদিকে আপনাদেরও গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।”
রূপলের কথায় যদিও যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে তবুও নিহাল বিষয়টা নিয়ে প্রচণ্ড দ্বিমনায় ভুগতে লাগল। ভাবুক হয়ে সে রূপলের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে এলো। চিন্তিত গলায় শুধালো,
“তার মানে তুমি বলছ বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিতে?”
নিহালের মুখ থেকে এই কথাটি শোনার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল রূপল! ভনিতা ভুলে সে ঝট করে দ্রুত গলায় বলে দিলো,
“আই থিংক করে দেওয়া উচিৎ জিজু!”
“ধ্যাত! পাগল তুমি? আম্মায় ছেঁচবে আমাকে এই কথা শুনলে! এমনিতেই নীহার তেমন বিয়ে টিয়ে আসেনা। যদিও এই নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই তবে মা-বাবার এই নিয়ে খুব টেনশন হয়! বুঝই তো তাদের টেনশন কী নিয়ে?”
তীব্র উত্তেজনা নিয়ে রূপল বলল,
“আন্টি আঙ্কেল বুঝেনা বলে অযথা টেনশন করে জিজু। কিন্তু আপনি তো বুঝেন হোল ওয়ার্ল্ড এখন যোগ্যতার পেছনে ঘুরে। কার গাঁয়ের রঙ কী, কে দেখতে কেমন, লম্বা না খাঁটো, কার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন ট্রাস্ট মি এসবের দিকে তাকানোরও সময় নেই এখন কারো! সবাই এখন যোগ্যতাকে জাজ করে। সময় বদলেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও বলদেছে জিজু। এখন আর কেউ আগের জামানার ব্যাকডেটেড চিন্তাধারা নিয়ে বসে নেই। পড়ালেখা শেষ করে নীহু যখন তার যোগ্যতা অনুযায়ী ভালো কোনো চাকরী বাকরী করবে তখন ছেলের অভাব পড়বেনা ট্রাস্ট মি! দেখা যাবে তখন তার পেছনে ছেলেদের লাইন পরে গেছে।”
এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যেও নিহাল কেমন সন্দেহপ্রবন হয়ে উঠল! ভ্রু যুগল উঁচিয়ে সে রূপলের দিকে তাকালো। প্রশ্ন ছুড়ল,
“এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড। কী বললে তুমি? আরেকবার বলো তো? আমি যদি ভুল না শুনি নীহারিকাকে তুমি “নীহু” বললে?”
অমনি থতমত খেয়ে গেল রূপল! শার্টের কলার ঝেড়ে সে অস্থিরতা প্রকাশ করল। অবিন্যস্ত গলায় বলল,
“নীহারিকা নামটা খুব হার্ড তো! তাই শর্ট করে নিলাম! নীহু ইজ পার্ফেক্ট!”
“ওকে। বাট আমরা তো তাকে নীহা বলে ডাকি। তুমিও চাইলে তাকে নীহা ডাকতে পারবে। বাট নীহু ডাকটা অন্যরকম শুনালো তাই বললাম!”
নিহালের হুটহাট সন্দেহজনক প্রশ্নে রূপল বেশ বিরক্তবোধ করছিল! রাগে গজগজ করে সে মনে মনে অভিসন্ধি কষিয়ে বলল,
“এই বান্দায় আমারে জেরা করতে বইছে! ঘাম ছুটিয়ে দিলো জাস্ট। বিয়ে ভাঙা কী চাট্টিখানি কথা? উফ বিরক্তিকর! ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথা বলা আমার মোটেও পছন্দ নয়। এরচেয়ে ভালো বরং ডিরেক্টলি বলে দেওয়া “সময় হলে আমিই নীহুকে বিয়ে করব!” তার বোনকে দেখলে যে আমার সেনশেসন হয় এটা তো তার অন্তত বুঝা উচিৎ! ইভেন আমিতো তার বোনকে একটা স্পেশাল নামেও ডাকছি। তবুও কী বুঝতে পারছেন না তিনি আমি কী চাইছি? কেমন বেটা মানুষ রে?”
ইতোমধ্যেই পিয়াসা এবং মারজিনা বেগম নাশতার প্লেট হাতে নিয়ে ড্রইংরুমে এলো। নিহাল এবং রূপল নিজেদের অবস্থানে চুপচাপ হয়ে বসে রইল। মারজিনা বেগম হেসে হেসে রূপলের হাতে কফির মগ তুলে দিলেন। প্রফুল্ল গলায় বললেন,
“কী রূপল? বোনের রিসিপশনের পর পরই তো আরেকটা বিয়ের দাওয়াত তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে! আগে ভাগেই প্রস্তুত হয়ে থাকো।”
কফির মগটা হাতে নিয়ে রূপল সৌজন্যতার হাসি হাসতে বাধ্য হলো। বুঝেও কিছু না বুঝার ভান ধরে শুধালো,
“কার বিয়ের দাওয়াত আন্টি? বুঝলাম না ঠিক।”
তখনি মারজিনা বেগমের মুখের কথা টেনে নিলো পিয়াসা। রূপলের ঘাড় থেকে নীহারিকা বিদায় হবে সেই খুশিতে সে পৈশাচিক হাসল! আপদ দূর হবে ভেবে সে মহাখুশি। দ্রুত গলায় রূপলকে বলল,
“কার আবার? নীহারিকার! খুব শীঘ্রই তার বিয়ে।”
নির্বোধ দৃষ্টিতে রূপল পিয়াসার দিকে তাকালো। মারজিনা বেগমের সমস্ত ক্ষোভ সে পিয়াসার উপর ঝারতে উদ্যত হলো! নিমিষেই চোখ দুটো তার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল! হঠকারি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“পাত্র এখনও দেখতে এলোনা তাকে। এরমধ্যেই তোরা তাকে বিয়ে টিয়ে দিয়ে দিচ্ছিস? এত ওভার কনফিডেন্স কেন তোরা? আশ্চর্য মানুষ তো!”
রূপলের এহেন রাগের কারণ পিয়াসার বুঝতে বেশি সময় ব্যয় হলো না! তবে উপস্থিত সবার সামনে পিয়াসা কোনো বাজে ব্যবহার করতে চায়না রূপলের সাথে। তাই সে খামোশ খেয়ে গেল। তবে এই বিষয়ে একরত্তিও ছাড় পাবেনা রূপল। যেকোনো ভাবেই হোক নীহারিকার ভূত সে রূপলের মাথা থেকে নামাবেই! রূপলের কথার পরিবর্তে মারজিনা বেগম মুখটাকে কেমন কালো করে বললেন,
“বালাইষাট। এসব তুমি কী বলছ রূপল? ছেলে তো আমার নীহারিকাকে দেখেছেই। পছন্দ হয়েছে বলেই তো বিয়ের প্রস্তাবটা দিলো। দোয়া করো বাবা যেন ভালোয় ভালোয় সব মিটে যায়।”
কফির মগটা টি-টেবিলের উপর রাখল রূপল। রাগকে যথেষ্ট সংযত করার চেষ্টা করল সে। এই মুহূর্তে রেগে গেলেই পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে। মারজিনা বেগমকে ইনডিরেক্টলি সে কিছু বুঝাতে পারবেনা। তাই সে ঠাণ্ডা মাথায় মারজিনা বেগমকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,
“দেখুন আন্টি। কোনো বিষয় নিয়েই তাড়াহুড়ো করা ঠিকনা। ধীরে সুস্থে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিবেন।ইভেন বিয়ের মত ইম্পর্টেন্ট কিছু হলে তো আর কথাই নেই। প্রয়োজনে একটা বিষয় নিয়ে বিশ বার ভাববেন! কথাগুলো বলছি কারণ, নীহারিকাকে দেখানোর আগেই ছেলের সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ খবর নিন। ছেলের চরিত্র, ব্যবহার আচরণ, ছেলের হিস্ট্রি সব খতিয়ে দেখুন। আপনাদের কথানুযায়ী মনে হচ্ছে ছেলে খুব তাড়াহুড়ো করছে। যা তাকে সন্দেহ করার মেইন পয়েন্ট! বিয়ে তো করবিই ভাই। আজ না হয় কাল। সো এত তাড়াহুড়ো করার কী আছে? ধীরেসুস্থে কর। যদি তোর রেকর্ড খারাপ না হয়ে থাকে তো! আমার যা বলার বলে দিয়েছি আন্টি। বাকীটা আপনারা পরিবারের সবাই এক হয়ে সিদ্ধান্ত নিন। তাছাড়া নীহারিকার থেকও এই বিষয়ে মতামত নেওয়ার প্রয়োজন আছে। ইভেন বিয়েটা তার। হোপ সো আপনারা তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করবেন না।”
খালি মুখেই রূপল হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে মারজিনা বেগম চিন্তিত হয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি ফিরিয়ে তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে থাকা নিহালের দিকে তাকালেন। বিচলিত গলায় শুধালেন,
“রূপল এসব কী বলে গেল নিহাল? ছেলে তাড়াহুড়ো করছে মানেই কোনো ঘাপলা আছে? তুই ঠিকঠাক ভাবে ছেলের খোঁজ খবর নিয়েছিস তো?”
রূপলের কাণ্ডকীর্তি নিহালের মাথার উপর দিয়ে গেল। কিছু স্বাভাবিক মনে হলোনা তার। রূপলের চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে নিহাল নিশ্চিন্ত গলায় তার মাকে বলল,
“আমি যতটুকু খোঁজ খবর নিয়েছি মা, ছেলে দেখতে শুনতে ভালোই। কয়েক মাস হলো আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করেছে। খু্বই শান্তশিষ্ট, নম্রভদ্র, বুঝদার একটি ছেলে।”
অমনি সুযোগ পেতেই পিয়াসা মুখ খুলল। অনর্গল গলায় তার শ্বাশুড়ি মাকে বলল,
“ছেলে যেহেতু ভালোই মা। আপনারা বরং কথাবার্তা আগান! বেশি বাছতে গেলে দেখা যাবে একটা সময় পর আর বিয়েই আসবেনা। তাই সময় থাকতে থাকতে বিয়ে টিয়ে দিয়ে দেওয়া ভালো। এই কথাটা আমার মা সবসময় বলে। তাইতো অনার্সে ওঠার সাথে সাথেই মা আমাকেও বিয়ে দিয়ে দিলো!”
পিয়াসার কথায় এই প্রথম ভরসা পেলেন মারজিনা বেগম! আশ্বস্ত গলায় তিনি বললেন,
“তুমি ঠিক বলেছ মা। নিহালের বাবা আজ বাড়ি ফিরুক। বিয়েটা কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবেনা!”
___________________________________
রাত আটটা তখন। আকাশ, সবিতা এবং দিশারা একটা দফারফা করে থানার সব কাজকর্ম সেরে রূপল তার কাজিন সজল এবং শাকিলকে নিয়ে টং দোকানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাড়ে চা খাচ্ছে। তবে রূপল চা খাচ্ছে কম সিগারেটে ফুঁক দিচ্ছে বেশী! টেনশনে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে! অস্থির লাগছে খুব। রূপলের এই অস্থিরতা দেখে সজল এবং শাকিল নিশ্চুপ। দুজনই বুঝতে পারছিলনা নীহারিকার বিয়ে নিয়ে রূপলের কেন এত মাথাব্যথা? কী চলছে রূপলের মধ্যে? তবে এই নিয়ে তারা কোনো প্রশ্ন করতে চায়না রূপলকে। জেচে পরে মা’র’ধ’র খাওয়ার শখ নেই তাদের!
তবে এতকিছুর মধ্যে থেকেও রূপলের সূক্ষ্ম নজর ছিল টং দোকানের বিপরীত পাশে থাকা দু’তলা বিশিষ্ট পাকা বাড়িটির দিকে। কারো বের হওয়ার জন্য যেন সে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। তখনি তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একটি তরুন ছেলে বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এলো! রাস্তার এপাশে ওপাশে তাকিয়ে ছেলেটি রাস্তা পাড় হয়ে সোজা টং দোকানের দিকেই হেঁটে আসছিল! অমনি রূপল চা খাওয়া বন্ধ করে দিলো। সিগারেটটিও হাত থেকে ফেলে দিলো। পাশ থেকে সজল এবং শাকিল এসে রূপলের গাঁ ঘেঁষে দাড়ালো। বলল,
“ভাইয়া এই সেই উজ্জ্বল। যাকে আমরা খুঁজছি।”
মিনমিনে গলায় রূপল বলল,
“চিনেছি। সাইডে দাড়া তোরা।”
রূপলের কথামতো সজল এবং শাকিল তার পাশ থেকে সরে দাড়ালো। হেঁটে এসে উজ্জ্বল টং দোকানে দাড়ালো। রূপলের পাশে দাড়িয়ে উজ্জ্বল হাসিমুখে দোকানদারকে বলল,
“চাচা। এক কাপ চা দিয়েন তো। দুধ বেশী করে।”
দোকানদারও হেসে হেসে উজ্জ্বলকে বলল,
“দিতাছি বাবা। একটু অফেক্ষা করন লাগব।”
“ওকে চাচা। আপনি আস্তেধীরে বানান। আমি অপেক্ষা করছি।”
এই বলে উজ্জ্বল দোকানে থাকা বেঞ্চিতে বসল। পায়ের উপর পা তুলে বসে সে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে বেশ মনোযোগ দিয়ে ফোন ঘাটতে লাগল! ডোন্ট কেয়ার ভাব তার। আশেপাশে কারো দিকে তাকানোর কোনো মুড নেই। উজ্জ্বলকে কিছুতেই যেন সহ্য করতে পারছেনা রূপল! কারণ, উজ্জ্বলকে রূপল যতটা আনস্মার্ট ভেবেছিল উজ্জ্বল ততটাও আনস্মার্ট নয়! দেখতে শুনতে ভালোই। পছন্দ করার মত। এই প্রথম কোনো ছেলেকে দেখে বড্ড হিংসে হচ্ছিল তার! রূপলের রাগী রূপ দেখে সজল এবং শাকিল শুকনো ঢোঁক গিলতে লাগল। ইশারায় দুজন রূপলকে বলছিল শান্ত হতে। কে শুনে কার কথা? উজ্জ্বলের ভাব দেখে রূপলের মাথা তো আরও গরম হয়ে যাচ্ছিল! মনে হচ্ছিল এখনি মাথাটা ফাটিয়ে দিতে!
হনহনিয়ে হেঁটে রূপল দোকান থেকে বের হয়ে গেল! রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা বাইকের সাথে সে হেলান দিয়ে দাড়ালো। পকেট থেকে ফোনটি বের করে নীহারিকার নাম্বারে কল করল। সঙ্গে সঙ্গেই নীহারিকা ঐ পাশ থেকে কলটি তুলল। নম্র গলায় নীহারিকা হ্যালো বলতেই রূপল কর্কশ গলায় শুধালো,
“এই? চশমা ওয়ালা ছেলে পছন্দ আপনার?”
তাজ্জব বনে গেল নীহারিকা। এইমাত্র টিউশনিতে এলো সে। তাই উঁচু গলায় পরিষ্কারভাবে কথা বলতে পারছেনা সে। নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে সে রূপলকে বলল,
“আপনি কী পাগল হয়ে গেছেন রূপল? ফোন করে এসব জিজ্ঞেস করার বিষয় হলো? যতসব ফা’ল’তু কথা!”
“যা আস্ক করেছি তার আনসার দিন? আননেসেসারি কথা বলবেন না।”
রাগে নীহারিকা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“আমি পড়াতে এসেছি। আপনার আজাইরা বকবক শুনতে নয়। ফোনটা রাখুন।।”
“হেই স্টপ। কল কাটবেন না। একদম না। এক্ষুণি বাড়ি থেকে বের হয়ে আসুন। আমি বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছি!”
“আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন রূপল! কী হয়েছে কী আপনার বলুন তো?”
“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। কানা দেখতে ছেলে আপনার পছন্দ?”
নীহারিকা বেশ বুঝতে পেরে গেছে ঝাড়িঝুড়ি দিয়ে রূপলকে থামানো যাবেনা। পাগলকে না ঘাটিয়ে বরং তার কথামত যেকোনো একটা উত্তর দিয়ে দিলেই ভালো। প্রত্যত্তুরে নীহারিকা রাগী গলায় বলল,
“হ্যাঁ পছন্দ! এবার খুশি?”
এই বলে নীহারিকা কলটি কেটে দিলো। রাগে রূপলের মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগল! রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিলনা সে। বাইকে জোরে একটা লাথ মেরে মৃদু চিৎকার করে বলল,
“তার মানে ঐ ছেলেকে নীহু পছন্দ করবে?”
এই পরিস্থিতিতে ভেঙে পরতে চাইলনা রূপল। হনহনিয়ে হেঁটে সে আবার টং দোকানে চলে এলো! ইশারায় শাকিল ও সজলকে বলল উজ্জ্বলের পাশ থেকে সরে দাড়াতে। দুজনই উজ্জ্বলের পাশ থেকে সরে দাড়ালো। অমনি রূপল পায়ের উপর পা তুলে উজ্জ্বলের পাশে বসল!রাগী ভাব নিয়েই উজ্জ্বলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গলা ঝাকালো। বলল,
“হায়।”
ফোন থেকে মনোযোগ সরিয়ে উজ্জ্বল পাশ ফিরে রূপলের দিকে তাকালো। সৌজন্যতার খাতিরে বলতে বাধ্য হলো,
“হ্যালো।”
উজ্জ্বলের সাথে সখ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করল রূপল! জোরপূর্বক হেসে বলল,
“আ’ম রূপল। এন্ড ইউ?”
শুকনো হেসে উজ্জ্বল বলল,
“আ’ম উজ্জ্বল।”
বেশ ভাব নিয়ে উজ্জ্বল আবার তার ফোনের দিকে মনোযোগ দিলো! মাথা ঠিক নেই রূপলের। কখন সে উজ্জ্বলের মাথা ফাটিয়ে দেয় বলা যায়না! এই প্রথম কেউ রূপলের সাথে এত ভাব নিলো। যেখানে সে সবার সাথে ভাব নিতে অভ্যস্ত। তাই পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে তার কিছুটা সময় নিতে হল। বেহায়াদের মত রূপল আবারও উজ্জ্বলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“শুনলাম আপনার মা আপনার জন্য মেয়ে দেখছে?”
উজ্জ্বলের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন কারাতেও অবাক হলোনা উজ্জ্বল! বরং সে স্বাভাবিক গলায় জবাবে রূপলকে বলল,
“দেখছিল। এখন দেখা শেষ। মেয়ে পছন্দ হয়ে গেছে! মায়ের কথা আর কী বলব। চারিদিকে এত ঘটক লাগিয়ে রেখেছে!”
ঘটকের উপাধি পেয়ে রূপল রাগে কপাল ঘঁষতে লাগল! তবে শিওর হয়ে নিলো নীহারিকাকে তাদের গোষ্ঠী শুদ্ধু সবাই পছন্দ করেছে! সজল এবং শাকিলকে নিয়ে রূপল সঙ্গে সঙ্গেই টং দোকান থেকে বের হয়ে গেল! জিদ্দি হয়ে তাদের দুজনকে রূপল বাড়ি ফিরে যেতে বলল।
__________________________
বুকের উপর দু’হাত গুজে নীহারিকা রুদ্রাক্ষীর ন্যায় রাগী রূপ নিয়ে রূপলের মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে! নীহারিকার দিকে না তাকিয়ে রূপল বেশ গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে রাস্তার এদিক ওদিক তাকিয়ে সিগারেট ফুকছে! এক পর্যায়ে জেদ দমন করতে না পেরে নীহারিকা চিৎকার করে রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আমার পারমিশন ছাড়া আপনি আমার স্টুডেন্টের বাসায় ঢুকলেন কেন হ্যাঁ? কেন আপনি পড়ানো অবস্থায় আমাকে ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য করলেন? আন্টির সামনে আমাকে লজ্জা দিলেন কেন?”
তবুও শান্ত রইল রূপল! ভাবশূণ্য গলায় জবাবে বলল,
“উঁহু। এত রাগ দেখাবেন না আমার সাথে। ভেবে দেখুন আপনি কী করেছেন!”
“কী করেছি আমি?”
“বেশী এটিটিউট থাকা ছেলেরা ভালো হয়না! কানা ছেলে আপনার পছন্দ হলেও সে ছেলে আপনার ম্যান্টালিটির সাথে যাবেনা!”
#চলবে…?