বিবর্ণ বসন্ত পর্ব-০৭

0
239

#বিবর্ণ_বসন্ত
৭ম_পর্ব
~মিহি

সোহরাবের গালে সজোরে থাপ্পড় লাগিয়ে দিল অনামিকা। অগ্নিদৃষ্টি মেলে সোহরাব কেবল দেখলো।

-‘আমার উপর মিথ্যে অপবাদ দিয়েছেন আপনি। সত্যি না জেনে আমাকে কতটা আঘাত করেছেন সবাই দেখেছে। দিনশেষে যখন সব মিথ্যে প্রমাণ হলো একবার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। আমাকে কী ভেবেছেন? পাথর আমি? ব্যক্তিগত বিষয় ঘরে মেটাতে হয় এটুকু বুঝ তো আমারই আছে অথচ আপনার নাই। আপনার বিরুদ্ধে তো প্রমাণও দিলাম। এখন আমারো কি উচিত না থাপ্পড়সহ সব আঘাত ফিরিয়ে দেওয়া? আপনার চুলগুলো ধরার মতো হলেও হয়তো আপনার করা কাজটা রিপিট করতাম না। আপনি পশু হতে পারেন, আমি তো নই।’

-‘অনামিকা!’

-‘গলা নামিয়ে কথা বলুন সোহরাব! আমি আপনার বউ, আপনার কেনা ক্রীতদাসী নই। আমাকে আমার প্রাপ্য অধিকার আর সম্মান থেকে বঞ্চিত করার অধিকার আপনাকে দেওয়া হয়নি। আর এ থাপ্পড়টা স্ত্রী কর্তৃক একজন অযোগ্য স্বামীর প্রাপ্য ছিল।’

অনামিকা আর কিছু বললো না। এতক্ষণ চোখ শুষ্ক থাকলেও এবার তার চোখে জল এবং গলায় ক্ষীণ কান্নারত আমেজ স্পষ্ট বোঝা গেল। আফসোস হচ্ছে অনামিকার। মাকে ছেড়ে এসেছিল সে একটা নতুন সংসার সাজানোর আশায় অথচ যার সাথে পথচলার কথা সে মানুষটাই ভুল। ভুল সহচরী নিয়ে কতদূরই বা যাওয়া যায়? জীবনটা বৃথা মনে হচ্ছে অনামিকার। ঘরে ঢুকে বাথরুমে ঢুকলো সে। দরজা বন্ধ করে ট্যাপ ছেড়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলো। সমস্ত বিষাদ যেন জল হয়ে গাল বেয়ে গড়াচ্ছে।

_____________________

সোহরাব ঘরে যায়নি। নিচতলার কোণার ঘরে চৌকি পাতা আছে, সে ঐ ঘরে ঘুমাতে গেল। রাগে সোহরাবের চোখমুখ রক্তলাল হয়ে উঠেছে। হাঁটুর বয়সী মেয়ে কিনা তাকে চড় মারে! একদিন ভালো ব্যবহার করেছে বলে একেবারে মাথায় উঠে গেছে। বাবা ঠিকই বলতো, মেয়েমানুষ জুতোর তলায় পিষে রাখতে হয়। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ক্রমাগত হাত মুষ্টিবদ্ধ করতে লাগল সে। রাহেলা বানু সোহরাবের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

-‘সোহরাব বাবা দেখ, ঐ মেয়ে একটা ডাকিনী। তোর মাকেও ওর দিকে টেনে নিয়েছে। আজ তোর গায়ে হাত তুলেছে। দুদিন পর থেকে লাত্থি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।’

-‘ওর এত সাহস হবেনা।’

-‘যে তোকে বিয়ের চারদিন পর থাপ্পড় মারতে পারে তার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলছিস তুই? তোর মাও তো ঐ মেয়ের তালে তাল মেলাচ্ছে। তাবিজ করছে নির্ঘাত নাহলে আমার সহজ সরল ভাবী এমন করে!’

-‘ঐ অনামিকাকে আমি ছাড়বো না।’

-‘দাঁড়া সোহরাব। অনামিকা জেদী মেয়ে, গায়ের জোর ওকে দেখাতে যাস না। ওর জন্য অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।’

-‘মানে?’

-‘অনামিকা বাইরে থেকে যাই হোক, নারী তো, কোমল মন। ওকে আঘাত করতে হবে মন দিয়ে।’

-‘তোমার কথা আমি কিছুই বুঝছি না। আমি ওর সাথে সংসার করতে পারবো না।’

-‘করবি না তবে কায়দা করে বের করতে হবে ওকে। আপাতত ঘরে যা। ওর সাথে কথা বলার দরকার নেই। চুপচাপ দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমাবি।’

-‘আচ্ছা।’

সোহরাব রাহেলা বানুর কথার আগামাথা কিছু না বুঝলেও কথা মানলো। ধীর পায়ে নিজের ঘরে ঢুকলো সে। অনামিকা তখনো বাথরুম থেকে বের হয়নি। সোহরাব চুপচাপ বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো। আরো মিনিট পনেরো বাদে অনামিকা বাথরুম থেকে বের হলো। কিছুক্ষণ পরপর নাক টানছে, এতক্ষণ ধরে যে মেয়েটা কেঁদেছে তা বোঝা যাচ্ছে। এতে অবশ্য সোহরাবের কোনো মাথাব্যথা নেই। সে এই দস্যি মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করতে চায়। ব্যস! অনামিকা সোহরাবের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পড়লো। একই ছাদের নিচে একই বিছানায় দুটি মানুষ অথচ তাদের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব, এ দূরত্ব শারীরিক নয়;মানসিক।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে অনামিকা অতিদ্রুত রান্নাবান্না শেষ করলো। আজ কলেজ যেতে হবে তার। সাজিয়া শেখের অনুমতি নিতে গেল সে।

-‘মা, আমার আজ একটু কলেজে যেতে হবে। রান্নাবান্না শেষ, যাই আমি?’

-‘তোর কলেজ তো এখান থেকে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। অতদূর তুই একা কী করে যাবি?’

-‘বাসে যাব মা আর তা নাহলে রিকশা করে চলে যাব।’

-‘একা কেন যাবি? এই সোহরাব শোন তো।’

-‘মা ওনার অফিস আছে।’

-‘ওর অফিস ঐদিকেই। দাঁড়া আসুক।’

রাহেলা বানু আড়াল থেকে সব শুনলেন। সোহরাবের ঘরে গেলেন তিনি।

-‘সোহরাব শোন, ভাবী অনামিকার সাথে তোকে পাঠাবে। তুই রাজি হবি কিন্তু বাইকে যাবি না, রিকশায় যাবি। রিকশায় অনামিকার সাথে কোনো কথা বলবিনা।’

সোহরাব রোবটের মতো কেবল মাথা নাড়ায়। হাতঘড়িটা পড়ে সে মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

-‘আম্মা, ডাকছিলে?’

-‘হুম। অফিস যাওয়ার সময় অনামিকাকে কলেজে নামিয়ে দিস।’

-‘আচ্ছা।’

সোহরাবের প্রত্যুত্তরে অনামিকা বিস্ময়ের চরমে পৌঁছালো। সোহরাব এত সহজে রাজি হবে কখনো ভাবতে পারেনি সে। সাজিয়া শেখকে সালাম দিয়ে দুজন বাড়ি থেকে বেরোলো। সোহরাব বাইক রেখে রিকশা ধরতে লাগলো। অনামিকা একবার জিজ্ঞাসা করতে চাইলো বাইক রেখে সোহরাব রিকশা কেন ধরছে কিন্তু গতকাল রাতের পর থেকে অনামিকার সোহরাবের সাথে কথা বলার ইচ্ছে মরে গেছে। সোহরাব রিকশা ঠিক করলো। দুজন দূরত্ব রেখে রিকশায় বসলো।

মৃদু মধুর হাওয়া চলছে। রিকশার গতি স্বাভাবিক। অনামিকার স্কার্ফের কিনারা হঠাৎ হঠাৎ মুখে বাড়ি খাচ্ছে। সোহরাব তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। রিকশা জ্যামে আটকা পড়লো। পাশের রিকশায় চোখ পড়লো অনামিকার। স্বামী স্ত্রী বসে আছেন। স্ত্রীর হাত স্বামীর মুঠোয়, নিশ্চিন্তে স্ত্রী স্বামীর কাঁধে মাথা রেখেছেন। অনামিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহরাবের দিকে তাকালো। সোহরাবও ঐ দম্পতির দিকে তাকিয়ে আছে। অনামিকার একবার মনে হলো সোহরাবের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। সোহরাবকে থাপ্পড় মারাটা আসলেই বেয়াদবি হয়ে গেছে। সোহরাব বয়সে অনামিকার চেয়ে বেশ বড়, বয়সের হিসাবেও এটা বেয়াদবি। কিন্তু সোহরাব তো নিজের ইগোটাকেই বড় করে দেখছে। সে তো এখনো ক্ষমা চাইল না। অপরাধ তো সেও করেছে। আবারো নিজেকে শক্ত করলো অনামিকা। রিকশাওয়ালা গল্প শুরু করলেন।

-‘আপনেরা বোধহয় নয়া নয়া বিয়া করছেন। আমি যখন নয়া বিয়া করি, আমার বৌডা এত বকবক করতো যে হেতের শাশুড়ি বিরক্ত হইয়া যাইত । এখন অত কথা কয় না আর। তে আপনেরা নয়া বউ বর কথা কন না ক্যা? মান করছেন? ভাঙায়ে লন।’

অনামিকা সোহরাব পরস্পরের দিকে তাকালো। অতঃপর সোহরাব মুখ ফিরিয়ে নিলো খানিক পরেই।

-‘রিকশা কলেজ গেটে সাইড করেন মামা।’

-‘আচ্ছা মামা।’

রিকশা থামতেই অনামিকা নেমে পড়লো। রিকশাওয়ালা আবার রিকশা চালাতে শুরু করলো। অনামিকা দূরে দাঁড়িয়ে দেখলো সোহরাব এখন রিকশাওয়ালার সাথে বেশ হেসে হেসে কথা বলছে অথচ এতক্ষণ যেন তার মুখে আঠা লাগানো ছিল। বেশ রাগ হলো অনামিকার। নারীসুলভ আচরণটা দিব্যি বিদ্যমান তার মাঝে। স্বামীর স্নেহ-ভালোবাসা তো সবারই চাওয়া পাওয়া কিন্তু সোহরাবের আচরণ না শোধরানো অবধি অনামিকাও হাল ছাড়বে না।

সোহরাব অফিসে এসে বসতেই রাইসার কল আসে। সোহরাব কিছুটা বিরক্ত হলো। যত দোষ এই রাইসার। আফিফের বাচ্চা! একজনের সাথে প্রেম করে বিয়ে করলি আরেকজনরে। এদিকে ঐ মেয়ে ওর চক্করে সোহরাবের জান-জীবন শেষ করে দিচ্ছে। একরকম বিরক্ত হয়েই রাইসার কল রিসিভ করলো সোহরাব।

-‘হ্যালো সোহরাব? তুমি কি ব্যস্ত?’

-‘হুম। অফিসে আছি। বলো কী বলবে।’

-‘আসলে তোমার এনআইডি কার্ডটা আমার বাসায় ফেলে গেছো তুমি। আমি তো আজই ফিরে যাচ্ছি। কাইন্ডলি তুমি স্টেশনের কাছে ক্যাফেতে আসবে?’

-‘শীট! আচ্ছা অপেক্ষা করো। আমি এক্ষুনি আসছি।’

সোহরাবের মনে পড়লো অনামিকার কলেজটাও ঐদিকেই। আবার যদি অনামিকা রাইসা আর সোহরাবকে একসাথে দেখে? দেখুক যে! বেশি বুঝলে সোহরাবের কী! সব দোষ তো অনামিকার।

চলবে…