বিবর্ণ বসন্ত পর্ব-১০

0
207

#বিবর্ণ_বসন্ত
১০ম_পর্ব
~মিহি

-‘ওয়ামিয়া, লিখছো না কেন?’

-‘ল…লিখছি ইমাদ ভাইয়া।’

সুমি একটু বিব্রত হলো। তার পুরো নাম সারাফ ওয়ামিয়া সুমি। ইমাদ তাকে কেন যেন ওয়ামিয়া বলেই ডাকে। ইমাদ সোহরাবের তিন ইয়ার জুনিয়র। ব্রিলিয়ান্ট হওয়ায় টিউশনির অভাব নেই তার। সোহরাবের অনুরোধেই ইমাদ সুমি ও তন্বীকে পড়াতে আসে। ইংরেজী নিয়ে সুমির কস্মিনকালেও কোনো সমস্যা ছিল না কিন্তু ইমাদকে দেখলেই সে ঘাবড়াতে থাকে। যে তন্বী কোনোদিন ঠিকমতো পড়ে না, সেও ইমাদের প্রশ্নের উত্তর পারে অথচ সুমির মুখে শব্দই আসেনা ইমাদ কিছু জিদ করলে। এ কারণে ইমাদ অবশ্য সুমির উপর কখনো বিরক্তি হয়নি। সে বরাবরই সুমিকে ভালোমতো বোঝায় কিন্তু তাতেও লাভ হয়না। সুমি কোনভাবেই তার সামনে জড়তা কাটাতে পারে না।

-‘ওয়ামিয়া, তোমার সমস্যা কী আমি আসলেই বুঝতে পারছি না। তুমি কি আমার কাছে পড়তে চাও না? সোহরাব ভাইকে বলি আমি?’

সুমি উত্তর দেয় না। সে কিভাবে বোঝাবে তার সমস্যা। তন্বীর এসবে মাথাব্যথা নেই। সে আপনমনে পড়ছে। অনামিকার পরামর্শ কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর সে। তাকে এতটা সফল হতে হবে যে নাদিমও যেন আফসোস করে সে কী হারিয়েছে এই ভেবে। তন্বীর এ পরিবর্তন সবার চোখেই পড়ে। কলেজে সবসময় রেসপন্স করে, প্রথম সারিতে বসে মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করে। অথচ সুমির যেন পড়াশোনায় ধ্যান নেই আর। ইমাদ সুমির নীরবতায় কিছুটা বিরক্ত হলেও কিছু বললো না। পরবর্তী দিনের জন্য পড়া দিয়ে প্রস্থান করলো। যাওয়ার আগে অনামিকা ইমাদের জন্য চা দিল। ইমাদ চা খেয়ে অনামিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

-‘বাহ ভাবী! এত সুন্দর চা আমি কোনোদিন খাইনি।’

-‘জেনে খুশি হলাম ভাইয়া। সুমি আর তন্বীর পড়াশোনার কী অবস্থা ভাইয়া?’

-‘আলহামদুলিল্লাহ ওরা এমনিতেই খুব ট্যালেন্টেড। ওয়ামিয়ার কিছু জড়তা আছে, ওটা কাটাতে পারলেই হয়ে যাবে। আসি ভাবী।’

অনামিকা মাথা নাড়ালো। সুমি আর জড়তা! পড়াশোনায় তো সুমির কোনো জড়তা নেই। সুমির দিকে তাকালো অনামিকা। চোখ কেমন যেন ছলছল করছে। অনামিকাকে ফাঁকি দিয়ে সে ছাদে দৌড় দিল। ইমাদ তখন মাত্র বের হয়েছে বাড়ি থেকে। যতক্ষণ ইমাদকে দেখা গেল ততক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল সে। ইমাদ দৃষ্টির অগোচর হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুমি। কী এক যন্ত্রণায় পড়েছে সে! এ যন্ত্রণা থেকে নিস্তার কোথায় গেলে পাবে? ‘সুমি..’অনামিকার ডাকে পিছনে ফিরল সুমি। অনামিকার দিকে তাকাতেই ইমাদের প্রশংসার কথা মনে পড়লো। নিজের অজান্তেই অনামিকার প্রতি তীব্র হিংসা কাজ করতে লাগলো সুমির। কেন যেন অনামিকাকে এখন সহ্য হচ্ছে না তার। ইচ্ছে করেই জবাব দিল না সে।

-‘সুমি, কী হয়েছে তোমার?’

-‘কিছুনা।’

-‘ইমাদ বলল তোমার নাকি জড়তা কাটছে না। এমন তো না তুমি।’

-‘ভাবী, আমার ক্ষুধা লেগেছে।’

-‘তুমি কথা এড়িয়ে যাচ্ছো সুমি।’

সুমি কোনো কথা না বলেই অনামিকাকে উপেক্ষা করে চলে গেল। সুমির পরিবর্তনটা অনামিকার চোখ এড়ালো না। এ পরিবর্তন যে ইমাদ আসার পর থেকেই ঘটেছে তাও লক্ষ করেছে সে। সুমিকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না, বয়সটাই এমন। অনামিকা ছোট থেকে গার্লস স্কুল আর মহিলা কলেজে না পড়লে তারও হয়তো এ বয়সে এমনটা হতো। ছোট থেকেই মা তাকে ছেলেদের সংস্পর্শ থেকে কিছুটা দূরে রেখেছেন। এর কারণ অনামিকার প্রতি অবিশ্বাস নয়, এ সমাজের পুরুষ মানুষদের কতিপয় অংশ যে কতটা জঘন্য তা সকলের বোধগম্য। ঐ কতিপয় অংশের জন্য সমগ্র পুরুষজাতিকে দোষারোপ করা আরেক বোকামি। পুরুষ যেমন ধর্ষক হয়, তেমন রক্ষকও হয়। পুরুষ মানেই খারাপ এ বদ্ধমূল ধারণা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। ভালো-খারাপ তো সবকিছুর মধ্যেই আছে। সেটাকে সমগ্র পুরুষ কিংবা নারী জাতির নামে চাপিয়ে দেওয়া ঘোর অন্যায়। কলিং বেল বাজাতে অনামিকার ঘোর কাটলো। সোহরাব এসেছে বোধহয়। দূরে আযান দিচ্ছে। অনামিকা মাথায় ওড়নাটা ঠিকমতো দিয়ে নিচে নামলো।

সোহরাব ইদানিং অনামিকার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে। আজ এনেছে তেঁতুলের আচার। সুমি আর তন্বীর জন্যও এনেছে। ওদের ভাগটা ওদের দিয়ে অনামিকার জন্য রাখা অংশটুকু অনামিকাকে দিল। তন্বী আর সুমি তখনো উঠোনের একপাশে দাঁড়িয়ে। অনামিকা আচারের ছোট বয়ামটা নিতেই তন্বী মেকি কাশি দিল। ন্যাকাসুরে গেয়ে উঠলো,’ সাজান জি ঘার আয়ে, দুলহান কিউ শারমায়ে?’ অনামিকা লজ্জা পেয়ে চলে গেলেও সোহরাব দাঁড়িয়ে রইল। তন্বীর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর সে নিজেও হেসে ফেলল। হাসলো না কেবল সুমি। সুমির মনে অন্যরকম ঝড় উঠেছে। এ ঝড়ের নাম ইমাদ। রাতের খাবার শেষ করে তন্বী পড়তে বসেছে আর সুমি বসেছে তার ডায়েরী নিয়ে। এ ডায়েরী সে কাউকে পড়তে দেয় না। ইমাদকে নিয়ে কমসে কম পৃষ্ঠা তিরিশেক লিখে ফেলেছে সে। এ ত্রিশ পৃষ্ঠা জুড়ে কোথাও নেই ভালোবাসার কথা, নেই অনুভূতির কথা। সুমির ইমাদকে একটা যন্ত্রণা মনে হয়, প্রয়োজনীয় যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণা না থাকলে বোধহয় সে বাঁচবে না। কলম হাতে নিয়ে দ্রুতগতিতে ডায়েরীতে চালালো সে।

‘আপনাকে নিয়ে আমার কোনো অনুভূতির কথা আমি কখনো লিখিনি। কিন্তু আপনার সামনে গেলে সব ভুলে যাওয়া, অকারণেই বারবার আপনার দিকে চোখ যাওয়া, আপনি অন্য কারো প্রশংসা করলে রেগে যাওয়া, এসবের কারণ কী বলতে পারেন? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? কত স্বপ্ন দেখে সবাই আমাকে নিয়ে। আমি একদিন অনেক বড় হবো, মা আর ভাইয়ার মুখ উজ্জ্বল করবো অথচ আমার স্বপ্নে ইদানিং আপনার আনাগোনা। জানেন, আমি পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছি না। আপনি একটা অসহ্য! ঘৃণা করি আমি আপনাকে। আপনি একটা যন্ত্রণা। আপনি একদম ভালো না, আপনার জন্যই আমার এই অবস্থা।’ এটুকু লিখতেই সুমি খেয়াল করে তন্বীর হাতে অনামিকার ফোন।

-‘এই তন্বী! ফোন কখন আনলি?’

-‘আরে একটা ইনফরমেশন লাগবে এই নোটের জন্য। তাই ভাবীর থেকে নিয়ে আসলাম।’

-‘আমাকে দিস তো একটু ফোনটা।’

-‘এই নে আমার কাজ হয়ে গেছে। তোর কাজ শেষ হলে ভাবীকে দিয়ে আসিস।’

সুমি মাথা নাড়ালো। সুমি ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ‘ইমাদ ওয়াহিদ’ লিখে সার্চ দিল। কয়েকটা সাজেস্টেড আইডির মধ্যে প্রথমেই দেখতে পেল কাঙ্ক্ষিত মানুষটার ছবি। সুমির মনে অন্যরকম একটা শীতল অনুভূতি বয়ে গেল। প্রোফাইলে ঢুকেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সুমির, আইডি লক করা। বিরক্ত হয়ে মনে মনে আরো কয়েকবার ইমাদকে অসহ্য বললো সুমি। প্রোফাইলের ইনফরমেশনে রিলেশনশীপ স্ট্যাটাসটা সিঙ্গেল দেখে অবশ্য মন কিছুটা শান্ত হলো। সার্চবার থেকে ইমাদের নামটা কেটে সে ফোনটা অনামিকাকে দিয়ে গেল।

_____________________

-‘অনামিকা, পরীক্ষা শেষ কবে তোমার?’

-‘আর এক সপ্তাহ। কেন বলুন তো।’

-‘বিয়ের পর এতদিন হয়ে গেছে। একবার শ্বশুরবাড়িতে ঘুরে আসা উচিত না?’

-‘আপনার যে ব্যস্ততা!’

-‘তোমার পরীক্ষা শেষ হলে যাবো। এডমিশনের প্রিপারেশন ওখানেই নিও। এখানে সারাদিন এই-সেই কাজ করো। কাজ না থাকলেও বের করে করো। এডমিশন অবধি তুমি ওখানেই থাকবে।’

সোহরাবের কথায় অনামিকার মুখ মলিন হয়ে আসলো। চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। সোহরাব বুঝে উঠতে পারলো না কী হলো। অনামিকার তো মায়ের কাছে থাকার কথা শুনে খুশি হওয়ার কথা তবে সে এমন প্রতিক্রিয়া কেন দেখালো।

-‘এই অনামিকা, কী হয়েছে? তুমি খুশি হওনি?’

-‘আমি এডমিশনের প্রিপারেশন নেবো না সোহরাব। আমার পড়াশোনা লাইফ এখানেই শেষ। উচ্চ মাধ্যমিকের পর আমি আর পড়াশোনা করতে চাইনা। এডমিশনের কথা তো মাথাতেও আনতে চাইনা।’

অনামিকার কথায় সোহরাব আকাশ থেকে পড়লো। কী যা তা বলছে এই মেয়ে! অনামিকার স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা সবকিছু কার স্বার্থে পিষে ফেলতে চাইছে সে? যে মেয়ে অধিকারের জন্য স্বামীর বিপক্ষে যায়, সে আর পড়াশোনা করবে না! সোহরাব এমন অনামিকাকে তো চায়নি। সোহরাব চায় অনামিকা আরো পড়াশোনা করুক, নিজের সব স্বপ্ন পূরণ করুক কিন্তু অনামিকা কেন চাইছে না সেটা? কী এমন কারণ আছে এটার পিছনে?

চলবে…