#বিবর্ণ_বসন্ত
১১তম_পর্ব
~মিহি
-‘পড়াশোনা অফ করে তুমি কী করতে চাইছো? সমস্যাটা বলো আমাকে। তোমার কী মনে হচ্ছে আমি তোমার পড়াশোনার খরচ চালাতে অযোগ্য?’
-‘সোহরাব তুমি ভল বুঝছো আমাকে।’
-‘ঠিক বোঝার সুযোগটা কোথায় দিচ্ছো তুমি?
সোহরাব অনামিকার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অনামিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজ শুক্রবার। সোহরাবের পরোটা না খাওয়ার কাহিনী অবশ্য এখন অনামিকা জানে তবে এখন রাগ করে সোহরাব যে পরোটা খেতেই যাবে তাও বুঝলো অনামিকা। রান্না শেষ করে অনামিকা গেল সাজিয়ার সাথে কথা বলতে। সোহরাবের তখনো কোনো পাত্তা নাই। সেই যে বেরিয়েছে, এখনো বাড়িতে আসেনি।
-‘মা আসবো?’
-‘অনুমতি নেওয়া লাগবে না আয়।’
-‘মা কিছু কথা ছিল।’
-‘বল।’
-‘আমি পড়াশোনা বন্ধ করতে চাচ্ছি এইচএসসির পর।’
-‘তা কেন? তোর মাকে আমি বলেছি তোর পড়াশোনা আমি বন্ধ হতে দিব না অথচ তুই কিনা এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস! কারণ কী?’
-‘মা আসলে…’
-‘বল কী চলছে মনে।’
-‘মা, কাল গার্লস গ্রুপে এক আপুর পোস্ট দেখলাম। উনি পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে ওনার স্বামীর উনার উপর আগ্রহ কমে যায়। আপুও পড়াশোনার কারণে সংসারে মন দিতে পারেন না। ফলে রোজ তাদের ঝগড়া হয়। শেষমেশ দুজন ডিভোর্স নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঐ পোস্টে সবাই বলেছে আপুর আগে সংসার নিয়ে ভাবা উচিত ছিল, সংসারকে পায়ে ঠেলে পড়াশোনার কথা ভাবা উচিত হয়নি।’
অনামিকার বোকা বোকা কথায় সাজিয়া ঠোঁট টিপে হাসলেন। অনামিকার মনেও তবে সোহরাবকে হারানোর ভয় জেগেছে।
-‘অনামিকা তুমি কি সোহরাবকে অবিশ্বাস করো? সে তোমায় ছেড়ে অন্য কারো কাছে যাবে?’
-‘না মা কিন্তু …’
-‘পড়াশোনা মানুষ শুধু জ্ঞানার্জনের জন্যই করে না বা শুধুই টাকার জন্য করেনা। হুট করে সোহরাবের চাকরি চলে গেলে সংসারের দায়িত্ব তোমার কাঁধেও আসতে পারে। তাছাড়া তুমি লেখাপড়া নিয়ে উদাসীনতা দেখালে তোমার মায়ের কাছে আমি কী জবাব দিব?’
অনামিকার মন কোনোক্রমেই শান্ত হলো না। সে কেবল মাথা নাড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। অনামিকা বের হতেই খাটের তলা থেকে সোহরাবও বেরিয়ে এলো।
-‘দেখেছো মা! তোমার ছেলের বৌ তোমার ছেলেকে দুই শতাংশ বিশ্বাসও করেনা। কিসের না কিসের ফেসবুক গ্রুপ, সেই জের ধরে এখন উনি পড়াশোনা করবেন না। শোনো মা, ও যদি পড়াশোনা না করে একটা গোরু কিনবো। তারপর তোমার বৌমা বসে থেকে ঐ গরুর ঘাস কাটুক। ধ্যাত!’
রাগে গজগজ করতে করতে সোহরাব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সাজিয়া দুজনের কাণ্ডকারখানার দেখে কেবল হাসলেন। অবশেষে দুজন দুজনের মায়ার বাঁধনে পড়েছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন তিনি।
সুমির মেজাজ ইদানিং খিটখিটে হয়ে গেছে। যখন তখন তন্বীর সাথে দুর্ব্যবহার করে সে। তন্বী অবশ্য কিছু মনে করে না তবুও সুমির কথায় মাঝে মাঝে একটু হলেও ব্যথিত অনুভব করে। আজ সুমির মন ভালো। সোহরাব বলেছিল ওদের দুইজনের মধ্যে কেউ একজন যদি এবারেদ পরীক্ষায় টপ তিনের মধ্যে থাকে তবে সোহরাব ওদের দুজনের জন্য একটা ল্যাপটপ কিনে দিবে। সোহরাব কথাটা সুমির জন্য বলেছিল কিন্তু সুমির রেজাল্ট মোটেও ভালো হয়নি। টেনেটুনে পাশ করেছে সে কিন্তু তন্বী টপ তিনের মধ্যে আছে। সে সূত্রেই ল্যাপটপটা পাচ্ছে তারা। তন্বীর এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। ল্যাপটপ তার খুব একটা লাগে না। কোনো তথ্য দরকার হলে অনামিকার ফোনটাই বরাদ্দ তার জন্য। তাছাড়া আরেকজনের বাড়িতে থেকে পড়ে এখন আবার ল্যাপটপ চাওয়া বিলাসিতা। তবে সুমির ল্যাপটপের প্রতি আগ্রহ দেখে তন্বীর ভালো লাগছে যে তন্বী সুমির জন্য কিছু হলেও করতে পেরেছে।
সোহরাবের এমনিতেই মেজাজ ঠিক ছিল না এর মধ্যে সুমি ল্যাপটপের বায়না ধরলো। স্বভাবতই কিছুটা বিরক্ত হয়ে সোহরাব মানা করে দিল। সোহরাবের এ নিষেধে সুমির মন আরো খারাপ হয়ে গেল। রাগ উঠলো তার। চেঁচাতে শুরু করলো।
‘দিবেই না যখন তখন বলছিলা কেন? যে জিনিসের সামর্থ নাই, সে স্বপ্ন দেখানোর কী ছিল?’ সুমির কথা শুনে সোহরাব যেন আকাশ থেকে পড়লো। ছোটবেলা থেকে সুমির কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেনি সে। অথচ সেই মেয়ে আজ এমন করে কথা বলছে। সুমির চেঁচানোটা অনামিকার কানেও গেল। সোহরাব কিছু বলার আগেই সুমি ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। সোহরাবের নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগলো। এখন এমনিতেই মাসের মাঝামাঝি। চাইলেও সে কিছু করতে পারবে না। জমানো টাকাগুলো সে সুমির ভবিষ্যতের জন্য রেখেছে। ল্যাপটপ কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিটাও মিথ্যে দেয়নি সোহরাব। সে ভেবেছিল ইদ বোনাস পেলে তখন কিনে দিবে কিন্তু সুমি যে আজই এমন জেদ করে বসবে তা তো সে কল্পনাও করেনি।
সোহরাব ঘরে ঢুকতেই অনামিকার মুখোমুখি হলো। অনামিকার উপর সে রেগে আছে তা সহজেই অনুমেয়। তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করলো অনামিকা কিন্তু সোহরাব চুপ থাকলো না।
-‘তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো?’
-‘মানে?’
-‘ওহ স্যরি! অবিশ্বাসের প্রশ্ন তো সেখানে উঠে যেখানে বিশ্বাস থাকে। তুমি তো আমাকে বিশ্বাসই করো না, অবিশ্বাস তো দূরের বিষয়।’
-‘সোহরাব, আপনি ভুল বুঝছেন।’
-‘সবটা তো নিজের কানেই শুনে এলাম। তুমি ভাবলে কী করে তুমি পড়াশোনায় মন দিলে তার প্রভাবে আমাদের সংসার নষ্ট হবে? বিয়ের পর মেয়েরা পড়াশোনা করে না? তাদের সবার ডিভোর্স হয়?’
-‘আপনি লুকিয়ে আমার কথা শুনেছেন?’
-‘তুমি কথা লুকালে কিছু না আর আমি লুকিয়ে শুনলেই দোষ!’
অনামিকা কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। সোহরাবের অভিমানটাও তো অযৌক্তিক নয়। এ মুহূর্তে মায়ের সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে অনামিকার। আশেপাশে তাকিয়ে ফোনটা খুঁজলো সে। পরক্ষণেই মনে পড়লো ফোনটা তন্বীর কাছে রেখে এসেছে। তন্বীর কী যেন দরকার ছিল। অনামিকা কথা না বাড়িয়ে সেদিকে গেল।
সুমির মন মেজাজ একটুও ভালো নেই। অনামিকার ফোন থেকে ইমাদের একাউন্ট সার্চ দিল বেশ কয়েকবার কিন্তু পেল না। চমকে উঠলো সুমি। ইমাদ কি কোনোভাবে জানতে পেরে ব্লক করেছে? হাত পা কাঁপতে থাকলো তার।
‘সুমি!’ অনামিকার ডাকে হাত জমে গেল সুমির। সুমির মনের মধ্যে ভয় দানা বাঁধতে লাগল।
-‘ফোনের কাজ কি শেষ?’
-‘জ..জ্বী ভাবী।’
সুমি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা অনামিকার দিকে বাড়িয়ে দিল। অনামিকা সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেও কিছু বললো না। আপাতত তার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। ঘরে পা রাখতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকারে হাতড়ে সামনে এগোতেই সোহরাবের সাথে ধাক্কা খেল সে। ধাক্কাটা বেশ জোরেই খেয়েছে বিধায় দুজনেই পড়ে গেল। অন্ধকারে অনামিকা ঠিক বুঝলো না কী হলো কিন্তু সে যে মেঝেতে পড়েনি তা নিশ্চিত। খুব সম্ভবত সে সোহরাবের বুকের উপর পড়েছে। নিজেকে ছাড়িয়ে উঠতে নিতেই অনামিকা অনুভব করে সোহরাবের টি-শার্টের বোতামে তার চুল ফেঁসে গেছে। একটু টান লাগতেই চুলে অসম্ভব ব্যথা অনুভব করলো সে। হালকা আর্তনাদও করে উঠলো।
-‘কী হলো? চেঁচাচ্ছো কেন?’
-‘আপনার টি শার্টে চুল আটকেছে। ছাড়াতে সাহায্য করুন।’
-‘আমি কি বাদুড়? তোমার ধারণা আমি অন্ধকারেও দেখতে পাই? উঠো দেখি।’
-‘উঠলে চুলে টান লাগবে। দাঁড়ান ফোনের ফ্ল্যাশ অন করি।’
অনামিকা ফোনের ফ্ল্যাশ অন করতেই চোখ ধাঁধিয়ে আসলো সোহরাবের। একটু পর সেই আলোতে তাকাতেই দেখতে পেল অনামিকা ঠিক তার থেকে দু’ইঞ্চির দূরত্বে। পুরুষ জাতি কি বরাবরই তার স্ত্রীর নিকট গেলে এতটা দুর্বল হয়ে যায়? সোহরাবের এ মুহূর্তে নিজেকে প্রচণ্ড দুর্বল মনে হচ্ছে। অনামিকার এতটা সন্নিকটে এসে তার হৃদস্পন্দন ক্রমাগত বাড়ছে। অনামিকা কি এই কাছে আসাটাকে প্রত্যাশা করছে? সোহরাব আরেকটু কাছে গেলে কি অনামিকার খুব রাগ হবে?
চলবে…