#বিবর্ণ_বসন্ত
১৫তম_পর্ব
~মিহি
বিষণ্ণতার কালো মেঘটা বড্ড নির্দয়। এক অনাগত প্রাণ মাসমেত পৃথিবী ছাড়লো, এ বিষণ্ণতা কী করে কাটাবে অনামিকা? তারই বাল্যসখী, কত একসাথে হেসেছে-খেলেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনামিকা। রূপার মায়ের কান্নাকাটিতে মনেই হচ্ছে না তিনি খাবারে বিষ মেশাতে পারেন। অনামিকা চলে এলো সেখান থেকে। পড়াশোনায় কিছুতেই মন বসছে না অথচ ভর্তি পরীক্ষাও দোরগোড়ায়। সোহরাবের সাথেও অনেকক্ষণ যাবত কথা হয়নি। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে অনামিকার। ফোন বের করে চেক করলো সোহরাব কল করেছে কিনা। করেনি! মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল তার। চুপচাপ বইয়ের পাতায় অনাগ্রহী দৃষ্টি ফেলে বিড়বিড় করতে লাগল।
সোহরাব গতকাল ড.আফ্রিনের সাথে দেখা করে সুমির সমস্যার কথা বলেছে। আফ্রিন আপাতত সুমিকে ইমাদের সাথে কথা বলিয়ে দিতে বলেছে। তবে ইমাদ যেন স্বাভাবিক ব্যবহার করে এটাও বলেছে। সোহরাব বুঝতে পারছে না কী করবে। ইমাদকে ডেকে যদি হিতে বিপরীত ঘটে তবে নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না সে। অনেকটা দ্বিধা দ্বন্দ্বেই ইমাদকে কল করে সবটা বললো সে।
-‘সোহরাব ভাইয়া, আমি দুঃখিত। সুমি এমন কিছু করবে জানলে আমি কখনোই এসব বলতাম না।’
-‘এসব ভেবে লাভ নেই ইমাদ। তুমি কি একটু সুমির সাথে কথা বলবে? আমার মনে হয় তুমি কথা বললেই ও বোঝার চেষ্টা করবে।’
-‘এরপর যদি ও আরো পাগলামি করে ভাইয়া?’
-‘আমি সুমিকে চিনি ইমাদ। ও একবার ঠিক হয়ে গেলে, নিজেকে শক্ত করে তুলতে পারলে তোমার প্রয়োজন ওর পড়বে না।’
-‘আচ্ছা ভাইয়া। আমি কাল হাসপাতালে দেখা করতে আসবো।’
-‘আচ্ছা ইমাদ। ধন্যবাদ।’
সাজিয়া হাসপাতালে আছেন। সোহরাব তন্বী ও রাহেলা বানুকে নিয়ে বাড়িতে এসেছে। এখন আবার হাসপাতালে যেতে হবে। রেডি হতে গেল সে।
-‘তন্বী, সত্যি করে বল তো সুমি কার সাথে কী করছে? মরতে গেল ক্যান? খারাপ কিছু করছে নাকি?’
-‘মা তুমি থামবা? সুমি তো তোমার ভাতিজি হয়, ওর সম্পর্কে যা তা বলতে তোমার মুখে আটকায় না?’
-‘তুই বেশি বুঝিস! শোন, সুমিরে এই বাহানায় একটা পোলা ধরে বিয়ে দিলে সম্পত্তির ভাগিদার কমবে।’
-‘ছিঃ মা!’
-‘আমার শ্বশুরের উইল অনুযায়ী, এ বাড়িতে কেউ ডিভোর্স নিলে বা দিলে সে সম্পত্তি পাবে না। সোহরাব আর অনামিকার সম্পর্ক তো এমনিও টিকবে না। সাজিয়ার নামে একটা জমি ছাড়া কিছুই নাই। তাইলে সব সম্পত্তি আমার অবর্তমানে তো তোরই হবে।’
-‘ছিঃ মা। আমার লজ্জা করছে তোমাকে মা বলে ডাকতে। এত নিচে কী করে নামতে পারো তুমি?’
তন্বী রাহেলা বানুর কোনো কথা না শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। নিজের মায়ের উপস্থিতিই তার কাছে বিরক্তিকর ঠেকছে। অন্যদিকে, রাহেলা মেয়ের তেজটুকু দেখলেন। অনামিকা আর সোহরাবের সম্পর্ক তো তিনি নিশ্চিত ভাঙবেন। ফোন বের করে হাসলেন তিনি। অতঃপর অনামিকার নম্বরে ডায়াল করলেন।
-‘আসসালামু আলাইকুম।’
-‘ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো অনামিকা?’
অনামিকা অবাক হলো। যে মহিলা কোনোদিন সামনাসামনি জিজ্ঞাসা করেনি সে কেমন আছে, আজ কিনা কল দিয়ে জিজ্ঞাসা করছে!
-‘কী হলো? চুপ হলে যে?’
-‘ভালো আছি ফুফু। আপনি কেমন আছেন?’
-‘এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তোমার শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখি তুমি নাই তাই ভাবলাম একটু খোঁজ নিই।’
-‘আপনি ওখানে? সবাই ভালো আছে ফুফু? সোহরাবকে ফোন দিলাম, ফোন ধরছে না। কিছু হয়েছে কী?’
-‘আসলে…’
রাহেলা বানু কিছু বলার আগেই তন্বী ফোনটা কেড়ে নিয়ে সুইচড অফ করে দেয়। রাহেলা বানু রেগে তেড়ে যান।
-‘মা, সোহরাব ভাই মানা করেছে ভাবীকে জানাতে! আর তুমি সেটাই করছিলে? কেন মা? এটাও তো তোমারই পরিবার। কিসের এত ক্ষোভ তোমার মনে? একটু তো ভালোও চাইতে পারো সবার।’
-‘তোর সাহস দেখছি আকাশে উঠেছে। তোর জন্য আজ আমার মান সম্মান সব শেষ। কোথাকার কোন ছেলের সাথে পিরিতি! তোর মতো বজ্জাতরে পেটে ধরাই আমার ভুল।’
-‘ঠিকই বলেছো। তোমার পেটে না হলে হয়তো আমি তোমার স্বভাব পেতাম না। আরেকটু ভালো হতে পারতাম।’
রাহেলা সজোরে চড় বসিয়ে দিলেন তন্বীর গালে। তন্বী ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো। লাল চোখে অশ্রু দৃশ্যমান হলো। তন্বী কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেল। রাহেলা বানুর ফোনটাও সে সাথে নিয়ে গেছে।
রাহেলা বানু হঠাৎ কল কাটায় খানিকটা অবাক হয় অনামিকা। পরমুহূর্তে কল ব্যাক করে নম্বর বন্ধ পাওয়ায় ভাবলো চার্জ শেষ বোধহয়। এরই মধ্যে সোহরাব কল দিল। অনামিকা তড়িৎ গতিতে রিসিভ করলো।
-‘একটাবার কলও দিতে পারলেন না!’
-‘কাল একটা জরুরি কাজে অফিসে গিয়েছিলাম তোমার ওখিন থেকে এসে। ফোনটা অফিসেই ফেলে এসেছিলাম। আজ এইমাত্র ফোন হাতে নিয়েই কল দিলাম।’
-‘ধূর! এত কেয়ারলেস কেনো আপনি? আমি কত চিন্তা করছিলাম। মায়ের ফোন থেকে কল দেওয়া যেত না? ‘
-‘ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দেন।’
-‘হইছে থাক! বাড়িতে সবাই কেমন আছে? ফুফু কল দিয়েছিল। কথা বলার আগেই কল কেটে গেল।’
-‘আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে। এখন একটু কাজ আছে। তুমি এদিকের চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ো।’
অনামিকা আচ্ছা বলে কল রেখে দিল। সোহরাব হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভাগ্যিস তন্বী ঠিক সময় রাহেলা ফুফুর কল করার কথাটা সোহরাবকে জানিয়েছিল নয়তো এতক্ষণে অনামিকা সন্দেহ করে ফেলতো। সোহরাব হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ বাদে ইমাদও আসলো সেখানে। ইমাদের খুব বিব্রত লাগছে। সুমির সাথে কোন মুখে কথা বলবে তাও ভেবে উঠতে পারছে না।
-‘সোহরাব ভাইয়া, আমি কী বলবো বুঝতে পারছি না।’
-‘তুমি সুমির পাশে বসো তাহলেই ওর ভালো লাগবে।’
ইমাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটা মানুষকে পুরোপুরি ক্ষতবিক্ষত করে তার পাশে বসা কি সহজ? ইমাদ তো নিজের অজান্তেই সুমিকে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলেছে। তবুও সাহস করে সুমির কেবিনে ঢুকলো সে। সুমি তখন জাগ্রত। ইমাদকে আসতে দেখে সুমির হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। অদ্ভুতভাবে মাথায় চিড় ধরার মতো একটা যন্ত্রণা শুরু হলো। এ যন্ত্রণা সুমিকে পুরোপুরি নিস্তেজ করে তোলার চেষ্টায় ব্যস্ত হলেও সুমির মন তখন ইমাদ আসার সুখানুভূতিতে মত্ত।
-‘এখন কেমন আছো সুমি?’
সুমির মনঃক্ষুণ্ন হলো। ইমাদ তো তাকে সুমি বলে ডাকেনা।
-‘ওয়ামিয়া ডাকলেন না ইমাদ ভাই?’
-‘আচ্ছা ওয়ামিয়া বলো কেমন আছো?’
সুমির বলতে ইচ্ছে করলো এতক্ষণ ভালো ছিলাম না কিন্তু এখন শান্তি পাচ্ছি। চাইলেই কি সব বলা যায়? সুমি সংক্ষেপে উত্তর দিল সে ভালো আছে। ইমাদ অপ্রাসঙ্গিক নানা কথা বলতে লাগল। সুমি ধৈর্যশীল শ্রোতার মতো কেবল শুনেই গেল। সুমির মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বুঝি সে-ই।
আকাশে হঠাৎ মেঘ জমেছে। সুমির কেবিনের জানালা দিয়ে আকাশে অনেকগুলো পাখি উড়তে দেখা যাচ্ছে। সুমি বেখেয়ালে সেদিকে তাকালো। ইমাদ সুমির দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই মেঘলা আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের আনাগোনা দেখল।
-‘আমাদের জীবনটা ঐ আকাশ আর এই পাখির মতো।’
-‘মানে?’
-‘আকাশ কখনো রৌদ্রোজ্জ্বল, কখনো মেঘলা থাকে। জীবনটাও তেমনি সুখ-দুঃখের সমাবেশ। ঐ পাখিদের দেখো, নীড়ে ফেরার তাড়া। আমরাও তো দুঃখ কাটিয়ে একটু শান্তির জন্য আশ্রয় খুঁজে বেড়াই।’
সুমির চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। ইমাদের এই সামান্য কথাটুকুই তার বড্ড ভালো লাগল। এই লোকটাকে সে সর্বদাই রগচটা দেখেছিল অথচ তার মাঝেও একটা কাব্যিক সত্তা বাস করে যে সত্তা হাসতে জানে, প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজতে জানে। ইমাদ কি সবসময় এমনই থাকবে নাকি আবারো হুট করে বদলে যাবে? মানুষ এত বদলায় কেন? এজন্যই বোধহয় মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, “মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে অকারণে বদলায়; সকালে বিকালে বদলায়।”
চলবে…