আঙুলে আঙুল পর্ব-০১

0
750

#আঙুলে_আঙুল
#রোকসানা_রাহমান
#পর্ব (১)

বিয়ের আংটি পরার বদলে ছিনিয়ে নিল অরুণিমা। মুঠোর মধ্যে লুকিয়ে সোফা ফেলে মেঝেতে বসে পড়ল চোখের পলকে। টলমল চোখে এক ঝলক তাকাল আগত বরপক্ষের দিকে। প্রত্যেকটি মুখের ভাব বিস্মিত ও বিস্ফারিত। চোখগুলোতে একই প্রশ্নের ধারা। তাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাবার দিকে মুখ করে বসল সে। অশ্রুসিক্ত লোচনে কাতর স্বরে বলল,
” এই বিয়েতে আমার মত নেই। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। দয়া করে আপনারা চলে যান। ”

অরুণিমার বাবা অসীউল্লাহ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন পূর্বেই। এবার হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবার অবস্থা হলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রী নাজিয়া বেগমের কাঁধ ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন তখনই অরুণিমা দ্বিতীয়বারের মতো বলল,
” আমাকে মাফ করে দাও, বাবা। তোমাকে অনেক বার মানানোর চেষ্টা করেছি। তুমি মানোনি, তাই আমাকে এই উদ্যোগটা নিতে হলো। ”

মুহূর্তেই ছোট্ট বসার রুমটায় গোলমাল বেঁধে গেল। তাদের থামানোর জন্য নাজিয়া বেগম উচ্চস্বরে জানালেন,
” ও কাউকে ভালোবাসে না। মিথ্যা বলছে। আপনারা শান্ত হোন। বসুন। ”

কেউ শান্ত হলো না। উল্টো অস্থির হলো, রাগ বাড়ল, কথা বাড়ল। কেউ কেউ তো এগিয়ে এলেন অসিউল্লাহ ও নাজিয়া বেগমের দিকে। শাসানি বাক্য ছুঁড়তে লাগলেন একের পর এক। ঝড়ের মতো বদলে দেওয়া পরিস্থিতির চাপটা সামলাতে অনেকটা সময় খরচ করে ফেলেছেন অসিউল্লাহ। স্ত্রীর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে টের পেলেন তার সারা শরীর কাঁপছে। নাজিয়া বেগম মেয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে ধমকে ওঠলেন,
” চুপ করে আছিস কেন? বলে দে, তুই মিথ্যা বলছিস। কাউকে ভালোবাসিস না। ”

সেই ধমকে অরুণিমার শরীরটা একবারের জন্য কাঁপল শুধু। মনের চাওয়া বদলাল না। নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে বলল,
” সত্যি বলছি, মা। আমি মাইমূনকে ভালোবাসি। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি! ভাঙার সাহস নেই। ”

নাজিয়া বেগমের চোখদুটিতে দাবানল ছুটে বেড়াচ্ছে! অদম্য রাগসহিত মেয়ের দিকে অগ্রসর হতে চেয়েও থমকে গেলেন। আংটি পরানোর দায়িত্বে থাকা যুবকটি অরুণিমার কাছে চলে গেছে তার আগেই। জিজ্ঞেস করল,
” তোমার মত না থাকলে বিবাহকার্য এতদূর এগুল কী করে? ”

অরুণিমা চোখ তুলে তাকানোর প্রয়োজন মনে করল না। কণ্ঠটা তার সুপরিচিত। বরবেশে থাকা মানুষটিও তার নিকট শ্রদ্ধালু, সম্মানিত। সে আনত নয়নে করুণ স্বরে জবাব দিল,
” আমি জানতাম না, আজ আমার বিয়ে। বলা হয়েছিল, পাত্রপক্ষ আসবে। দেখে চলে যাবে। ”
” যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে থাক, তাহলে পাত্রের সামনে বসাও অন্যায়। ”
” আমি নিরুপায় ছিলাম। কেউ শুনছিল না। ”
” আমাকে বলতে পারতে। ”

এই পর্যায়ে অরুণিমা চোখ তুলে তাকাল। অবিরত অশ্রু ক্ষরণে তার চোখদুটি রক্তজবার মতো লাল হয়ে গেছে। নাকের পাতা ও ঠোঁটজোড়া ক্রমশ কাঁপছে। সে চোখের পাতা এক করে ফেলল। অপরাধির মতো বলল,
” যদি একবারের জন্যও শুনতাম পাত্রের নাম সঞ্জয়ান সাখাওয়াত তাহলে…”

সে কথাটা থামিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। চোখের কার্নিশ বেয়ে আরও একটা নোনা জলরাশির ধারা ঝরে পড়তে সঞ্জয়ান সুধাল,
” তাহলে কী করতে অরুণিমা? ”

সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর না করলেও বেশিক্ষণ নীরবও থাকল না। মাথাটা পূর্বের মতো ভূমির দিকে হেলিয়ে বলল,
” সাহায্য চাইতাম। ”

সঞ্জয়ান আটকে রাখা শ্বাসটা ছাড়ল ধীরে ধীরে। চোখেমুখের ভাব ও রঙ বদলানোর সময় পেল না। অসীউল্লাহ ছুটে এসেছেন তার নিকটে। ডান ও বাম উভয় হাত এক করে টেনে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বললেন,
” সব আমার দোষ। ইচ্ছে হয় মাফ করুন নাহয় শাস্তি দিন। ”

তার এই অপরাধ স্বীকার, নত করা মাথা, শাস্তি চাওয়া কিছুই মেনে নিতে পারছে না অরুণিমা। ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাবাকে টেনে সরিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যত হতে তিনি বিরূপ ধারণ করলেন ও আকস্মিক চড় মেরে বসলেন মেয়ের গালে। চিৎকার করে আদেশ করলেন,
” ভেতরে যা। ”

অরুণিমা আদেশ পেয়েও ভেতরে গেল না। তার এই অবাধ্যতায় অসীউল্লাহর গলার স্বর আগের চেয়েও উচ্চ ও তীব্র হলো। স্ত্রীর দিকে চেয়ে ধমকে ওঠলেন,
” আমি ভেতরে যেতে বলেছি। ”

নাজিয়া বেগম আর এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। অরুণিমার হাত ধরে জোর করে রুমের ভেতরে চলে এলেন। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে বকাবকি শুরু করলেন। তার এই অবিরাম বকাবকি অরুণিমা একটুও গায়ে মাখল না। দরদভরা গলায় বলল,
” মা, শান্ত হও। বসে জিরিয়ে নাও। নাহয় প্রেশারটা বেড়ে যাবে তো! ”

তিনি শান্ত হওয়ার বদলে অগ্নিশিখার মতো জ্বলে ওঠলেন। তেজি স্বরে বললেন,
” তুই তো এটাই চাস। প্রেশার বাড়িয়ে বাপ-মাকে হত্যা করবি। সেজন্যই এত সব করলি। বুদ্ধিটা কার ছিল? তোর নাকি তোর ঐ মাস্তানটার? ”
” ঠিক করে কথা বলো। মাইমূন মাস্তান না। শিক্ষিত ছেলে। ভদ্র ঘরের সন্তান। ”

মা-মেয়ের এই কথা কাটাকাটি চলছিল বেশ। সহসা ভারী কিছু পড়ার শব্দ হলো। দুজনেই চমকে ওঠল! নিজস্ব যুক্তিতে সাজানো বাক্যগুলো ভুলে একে-অপরের দিকে চেয়ে ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে। বসার রুমে সঞ্জয়ানরা নেই। তাদের বদলে চার-পাঁচটা অল্প বয়সের ছেলেপিলে। ষাড়ের মতো ক্ষিপ্ত ও উন্মত্ত ছেলেগুলো ছড়িয়ে আছে পুরো বসার রুমটায়। ভাঙচুর করছে স্বল্পোন্নত ও অল্প দামী আসবাবপত্রগুলো। সবচেয়ে বেটে ও শুকনো ছেলেটাই বোধ হয় টিভিটা আছাড় মেরেছে। যার শব্দে নাজিয়া বেগম ও অরুণিমা ছুটে এসেছিল। এসব কিছুকে এড়িয়ে অরুণিমার দৃষ্টি গিয়ে আটকাল দরজার কাছে আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ ও দীর্ঘাকৃতি পুরুষটির দিকে। সবিস্ময়ে উচ্চারণ করল,
” মাইমূন! ”

তার অনুচ্চস্বরটা চাপা পড়ে গেল নাজিয়া বেগমের চিৎকার-চেঁচামেচিতে। সবগুলো ছেলেকে সমানে ধমকে যাচ্ছেন। কিন্তু কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। যে যার মতো ভাঙচুর করে চলেছে। যেন এটাই তাদের একমাত্র কাজ। এজন্যই তারা ধরার কোলে জন্মেছে! অরুণিমা আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। অসহ্য হয়ে পড়েছে সবটা। দৌড়ে গেল মাইমূনের কাছে। মিনতি করে বলল,
” কী করছ এসব? সবাইকে থামতে বলো। ”

মাইমূন তেমন কিছুই বলল না। তৃপ্ত ভরে একগাল হাসল। এক হাতে প্রেমিকার কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিল। অন্য হাতে পকেট থেকে সাদা রঙের রুমালটা বের করে সিক্ত চোখ ও গাল মুছে দিতে দিতে বলল,
” ভালোবাসা, খুব কষ্ট হয়েছে? একটা কাজে আটকে গেছিলাম তাই আসতে দেরি হলো। তুমি রাগ করোনি তো? ”

তার এই আবেগ মাখা যত্ন বুলিতে অরুণিমা গলতে পারল না। বিধ্বস্তপ্রায় রুমটার দিকে চেয়ে আগের মিনতিটা করতে চাইল, পারল না। মাইমূন রুমালসহ হাত দিয়ে তার মুখটা চেপে ধরে বলল,
” ওরা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। এইটুকু শাস্তি তো পাওনা। ”

অরুণিমা প্রেমিকের হাত মুখ ও কোমর থেকে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
” ওরা আমার বাবা-মা। এই রুমটা আমার। জিনিসপত্রগুলোও। তুমি এভাবে নষ্ট করতে পার না। ”

মাইমূন মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলেও কোমর থেকে সরাল না। বাঁধন আগের চেয়েও শক্ত করল। আরেকটু চাপিয়ে নিল নিজের দিকে। তারপর সামনের দিকে চেয়ে বলল,
” ভয় কী! আমি নতুন কিনে দিব। সব তোমার পছন্দের হবে। এর থেকেও দামী ও উন্নত। ”

অরুণিমা চোখ রঙিয়ে তাকাল। মাইমূন খানিক ভয় পেল। মনখারাপ করে কিছু একটা বলতে চাইল, তখনই অসীউল্লাহ তিরস্কারপূর্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
” এই তোমার ভালোবাসা! ভবিষ্যৎ! এরজন্যই বাবার সম্মানের মাথাটা কাটলে আজ! এই দিনটা দেখার জন্যই বেঁচে ছিলাম। তাই না রে, মা? ”

তারপরেই স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” কে যেন বলেছিল, আমার ঘরে জান্নাতের ফুল জন্মেছে? তাকে ডাকো। বলে দিই, জান্নাতের ফুল না জাহান্নামের আগুন জন্মেছে। যার তাপে আমার বিশ্বাস, ভরসা, স্বপ্ন, গর্ব সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ”

চলবে