আঙুলে আঙুল পর্ব-২৯+৩০

0
201

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (২৯)

মাইমূন বলল,
” হিংসে আমারও হচ্ছে। আমার হবু শালীকে বিয়ে করে সংসার সাজিয়ে ফেলছেন অথচ আমি এখনও তার বড় বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারিনি। ”

সে কথাটা ফিসফিসে বলেনি। স্বাভাবিক স্বরে প্রকাশিত জবাবটি অরুণিমার কানে গিয়ে টোকা দিল। মুহূর্তে একাগ্রতা অভাব চোখদুটি দুটো যুবকের মধ্যে স্থির হলো। না চাইতেও বুঝে গেল, দুজনের মধ্যে তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। সে লজ্জা পেল। আড়ষ্টভাব আরও দৃঢ় হলো। অপছন্দণীয় প্রসঙ্গটা বদলে ফেলায় তৎপর হলো। জিজ্ঞেস করল,
” শূভ্রা কোথায়? কেমন আছে? ”

প্রশ্নটা সামনে বসে থাকা স্বর্ণলতার উদ্দেশ্যে করলেও উত্তর এলো সঞ্জয়ানের দিক থেকে। বলল,
” বোনের খোঁজ পরে নিও, আগে আমার খোঁজ নেও। ”

অরুণিমা আবারও অপ্রতিভ হলো। সঞ্জয়ানের আচরণে বিস্মিত না হয়ে পারছে না। এতটা সংকোচশূন্য ব্যবহার এর আগে পায়নি। কাজের সুবাদে দুজনের মধ্যে অনেক কথা হয়েছে, চলাফেরা হয়েছে। সেই সময় ‘ বিয়ে ভাঙা ‘ এর মতো ঘটনা ঘটেনি তবুও সঞ্জয়ানের কথা-বার্তায় ভদ্রতা ছিল, মাপ ছিল। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুই বলেনি। একটা অদৃশ্য সীমা তৈরি হয়ে গেছিল দুজনের মধ্যে। যেটি আজ খুঁজে পাচ্ছে না। মানুষটা কি তাহলে বদলে গেল? নাকি এমনই ছিল সবসময়। শুধু তার সামনে ভদ্রতার একটা পর্দা টেনে দিয়েছিল?

” আমার সাথে এসো। শূভ্রা ভেতরে আছে। ”

অরুণিমা উঠবে কি উঠবে না বুঝতে পারছে না। দ্বিধা ও সংশয়ে জড়িয়ে পড়ছে। সঞ্জয়ানের ব্যবহার যদি মাইমূনও খেয়াল করে থাকে? কীভাবে নিচ্ছে? সেও জানে, এই মানুষটায় তাকে বিয়ে করার জন্য বরবেশে হাজির হয়েছিল। অরুণিমা বলল,
” আমি গিয়ে দেখা করে আসলে কি ভালো দেখাবে? তারচেয়ে ভালো হয়, ও কে এখানে আসতে বলুন। সবার সাথে দেখা হবে। ”
” তাকে এখানে আনা যাবে না। তোমাকে একা আসতে হবে না। মাইমূন সাহেবকেও নিয়ে আসো। আমার কোনো সমস্যা নেই। ”

এবার যেন চিন্তায় পড়ে গেল সে। শূভ্রাকে এখানে আনা যাবে না! সঞ্জয়ান এমন বলছে কেন? তাহলে কি ওদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়েছে? অরুণিমার মনে পড়ে গেল, শূভ্রা এই বিয়ে করতে চায়নি। তবুও করতে হয়েছে। এই নিয়ে নতুন কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে কি? শূভ্রাকে সে চেনে। ছোটবেলা থেকে তার কাছেই বড় হওয়া। রাগ যেমন জেদও তেমন। আগে-পিছে না ভেবেই যা খুশি তাই করে বসে।

” অনেকদিন আগে বলেছিলাম না, শূভ্রা যে তোমার বোন আমার বিশ্বাস হয় না? সেই অবিশ্বাসটা আমার এখনও রয়েছে। চুল পরিমাণও কমেনি। ”

অরুণিমা ডান পাশে তাকাল। এখানে মাইমূন ছিল, এখন নেই। একটু পিছিয়ে আসছে। তার জায়গায় সঞ্জয়ান। সে পেছনে মাইমূনের দিকে এক ঝলক চেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে বলল,
” আবার কিছু করেছে? ”
” অনেক কিছু করছে। মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এইটুকু শরীর! মনে হয়, রক্তের পরিবর্তে সৃষ্টিকর্তা জেদ ঢেলে দিয়েছে। ”

সঞ্জয়ান এক এক করে সব ঘটনা খুলে বলছে। অরুণিমা নীরবে শুনছে আর সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মাঝেমধ্যে মাইমূনকেও দেখছে। তার সামনে এসব বলা কি ঠিক হচ্ছে? অরুণিমার ইচ্ছে হলো, তাকে থামিয়ে দেয়। সুযোগই পেল না। তার এই সংকোচশূণ্য অবিরত নালিশ শুনতে শুনতে ধারণা করল, সে তাকে অন্য কিছু নয় বন্ধুর মতো দেখছে। আর বন্ধুত্বে কোনো মাপকাঠি থাকে না। সীমা থাকে না। এখন এই ধারণা সঠিক হলে বেঁচে যায়। নাহলে বোনের সামনে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। এই বাড়িতে আর কখনও আসতে পারবে না। তারা রুমের কাছে পৌঁছে গেল। অরুণিমা দেখল, দরজা বাইরে থেকে আটকানো। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইলে, সঞ্জয়ান বলল,
” আমি চেয়েছিলাম, গ্রামে যাওয়ার পূর্বে শূভ্রাকে বাবার বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে আনতে। কিন্তু ও যে রকম আচরণ করছে, আমার মনে হয় না ঐ বাড়ি নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে। হয়তো একবার যেতে পারলে নিজ থেকে আসতে চাইবে না। জোর করে আনতে চাইলে অনেক বড় ঝামেলা তৈরি হবে। এই মুহূর্তে আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছি না। আমার বাবা, ছেলের বউকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছেন। তার ইচ্ছেটা পূরণ করি, তারপর এই বিষয়ে দুই পরিবার একসাথে বসে আলোচনা করব। ততদিন অবধি শূভ্রা যেন শান্তশিষ্ট, ভদ্র মেয়ে হয়ে থাকে। তুমি একটু বুঝিয়ে বলো। ”

তার এই আকুল আবেদনটা অরুণিমা ঘাড় কাত করে গ্রহণ করল। সঞ্জয়ান দরজা খুলে দিতে শূভ্রা দৌড়ে এলো। কান্না জুড়ে দিল আপুকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমি বাড়ি যাব। আপু, আমাকে নিয়ে যাও। এই বুড়া ব্যাডার সাথে আর এক মুহূর্তও থাকব না। ”

শূভ্রা আরও অনেককিছু বলল। সঞ্জয়ানকে বকাবকিও করল। নালিশ দিল। এক মুহূর্তের জন্য অরুণিমার মনে হলো, শূভ্রা এখানে ভালো নেই। তাকে নিয়ে চলে যাবে। পর মুহূর্তে বাবার কথা মনে পড়ল, তিনি খুব রেগে যাবেন। সম্পর্ক ছিন্ন হলেও বাড়ি আলাদা হয়নি। এই কাজের জন্য সেটাও হতে পারে। তাই নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে ফেলল। সান্ত্বনা দিল, এই ভেবে যে, সঞ্জয়ান মানুষ হিসেবে ভালো। আর যাই করুক, সেধে শূভ্রাকে কষ্ট দিবে না। সে যদি চায়, তাহলে সঞ্জয়ানের সাথে সুখে-শান্তিতে সংসার করতে পারবে। অরুণিমা বোনকে নিয়ে বিছানায় বসল। নিজের মতো করে বুঝ দেওয়া শুরু করতে সে আৎকা জিজ্ঞেস করল,
” তুমি আমাকে নিয়ে যাবে নাকি বলো। ”

অরুণিমা সরাসরি না বলতে পারছিল না। তাই অন্যভাবে বুঝাতে চাইলে শূভ্রা চেপে ধরল। চড়া স্বরে পুনরায় প্রশ্ন করল,
” আপু, নিয়ে যাবে নাকি বলো। ”
” না। ”
” তাহলে এখানে এসেছ কেন? যাও আমার রুম থেকে। ”

অরুণিমাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে রুম থেকে বের করে দিল। সঞ্জয়ান ও মাইমূন বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। ধাক্কার বেগ সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিল, মাইমূন ধরে ফেলল। সঞ্জয়ান ধরতে এসেও হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল,
” বিশ্বাস হলো? ”

অরুণিমা উত্তর দিল না। নীরবে চলে যেতে চাইল। সঞ্জয়ানের মা রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। তারা খায় না। আরেক দিন আসবে বলে বেরিয়ে পড়ে। সঞ্জয়ান তাদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। মাইমূন খালি রিকশার তালাশ করায় ব্যস্ত হতে অরুণিমা বলল,
” শূভ্রা যেমনই হোক না কেন, আপনার স্ত্রী। এভাবে সবার কাছে তাকে নিয়ে নালিশ করবেন না। সম্মান আপনারও নষ্ট হবে। ”

সঞ্জয়ান আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল,
” সবার কাছে করিনি তো, তোমার কাছে করেছি। ”

কিছু দূরে মাইমূন দাঁড়িয়ে ছিল। অরুণিমা তার দিকে তাকাল। সঞ্জয়ান খেয়াল করে বলল,
” মাইমূন সাহেবকে তো আমি তোমার মানুষ হিসেবে ধরেছি। তুমি যা, সেও তা। নাকি তুমি তাকে আলাদা হিসেবে গণ্য করছ? ”

প্রশ্নটা অরুণিমার হৃদয়ের আলোড়ন তৈরি করল। সত্যিই তো! সে কি মাইমূনকে পর হিসেবে দেখল?

____________
বাসায় ফিরে অরুণিমা ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে উঠে দেখে, তার ফোনে ছয়টা মিসড কল। সবগুলো মাইমূনের নাম্বার থেকে এসেছে। সে তখনই ফিরতি কল দিল। রিসিভ হলো সঙ্গে সঙ্গে। প্রশ্ন এলো,
” ঘুমিয়ে পড়েছিলে? ”
” হ্যাঁ। কেন? দরকার ছিল? ”
” রাতে ছাদে আসার কথা ছিল, ভুলে গেছ? তোমার জন্য আমি আঁজল ভরে বকুল ফুল কুঁড়িয়ে এনেছিলাম। ”

অরুণিমা জিভ কামড়াল। মাথায় চাটি মারল। শোয়া থেকে উঠে বসল,
” সত্যি ভুলে গেছিলাম। আমি খুব দুঃখিত! ”

ওপাশ থেকে মাইমূনের গলা ভেসে আসল না৷ সে ভাবল, কল কেটে দিয়েছে। মোবাইল কান থেকে সরিয়ে দেখল, কাটেনি। তাই পুনরায় সুধাল,
” কিছু বলছ না যে? ”
” কী বলব? ”
” তুমি এখন কোথায়? ”
” ছাদে। ”
” সারারাত ছাদেই ছিলে? ”
” হ্যাঁ। ”

অরুণিমা বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,
” ওখানে থাকো। আমি এখনই আসছি। ”
” না আসবে না। ”

সে রুম থেকে বেরিয়ে পড়েছিল প্রায়। মাঝপথে থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” উত্তরটা তুমি নিজেই বের করো। ”

কলটা কেটে গেলেও অরুণিমা জায়গা থেকে নড়ল না। অনেকটা সময় স্থবির হয়ে উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করল। পেয়েও গেল, বুঝতে পারল, মাইমূনের প্রতি সে একটু বেশি উদাসীন। এই উদাসীন্যতার ফলে তাদের মধ্যকার যে হালকা একটা টান সৃষ্টি হয়েছিল সেটিও হারিয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারণ কী? প্রশ্নটা উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার মুখটা আলোর মতো প্রতিফলিত হলো। উপলব্ধি করল, সবসময় বাবার ছায়ায় বড় হওয়া মেয়েটা আচমকা দূরে ছিটকে পড়াকে সে মানতে পারছে না। প্রকাশে না করলেও অবচেতনে এই শোকে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সবসময়। যে বাবা, তার প্রতিটা কথা, কাজকে মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, গুরুত্ব দিতেন, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন সেই বাবা তার সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ পছন্দকেই মেনে নেয়নি। প্রত্যাখ্যান করেছে। তার এই প্রত্যাখ্যানটাই হৃদয়ে জোঁকের মতো এমনভাবে বসেছে যে, তার সকল অনুভূতি শুষে নিচ্ছে। মনটাকে মৃত করে দিচ্ছে। এই মনটাকে বাঁচাতে পারবে একমাত্র অসীউল্লাহ। আর সেটা মেয়ের পছন্দকে গ্রহণ করে। অরুণিমা আর সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। তার এখনই বাবার সাথে কথা বলা জরুরি। সে তৎক্ষনাৎ বাবার রুমের দিকে ছুটল।

চলবে

আঙুলে আঙুল
পব (৩০)

বাবার রুমের দরজা ভেজানো আছে। অরুণিমা সরাসরি ভেতরে ঢুকতে সাহস পেল না। কড়া নেড়ে অনুমতি চাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তখনই বাবার গলা শুনতে পেল। মা রুমে নেই, রান্নাঘরে। একা একা কথা বলার মতো ব্যামো তার নেই। তবে কি ফোনে কথা বলছেন? অরুণিমা কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করার মনস্থির করল। চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বাবার কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিল। কয়েকটা জবাবে বুঝে গেল, ফোনের ওপাশটায় শূভ্রা আছে। এত সকালে মেয়েটা কখনও উঠে না। আজ ওঠল যে! শ্বশুরবাড়িতে গেলে মেয়েদের অনেক অভ্যাস পরিবর্তন করতে হয়। বিশেষ করে বদঅভ্যেস! অরুণিমা মনে মনে খুশি হলো। মেয়েটা তাহলে শ্বশুরবাড়িটাতে মেনে চলার চেষ্টা করছে। তার এই খুশি বেশিক্ষণ টিকল না। বাবা যখন ভার ও উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘ আসছি, মা। আমি এখনই আসছি। আর কাঁদিস না। ‘

অসীউল্লাহ কাজের জন্য তৈরি হয়েছিলেন। নাস্তাটা আর করবেন না বোধ হয়। ভীষণ ব্যস্ত চালে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। বড় মেয়েকে নজরে পড়লেও পাত্তা দিলেন না। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে হাঁ’ক ছাড়লেন,
” দরজাটা আটকে দেও, আমি বের হচ্ছি। ”

নাজিয়া বেগম রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। নাস্তার কথা মনে করিয়ে দিতে চাইলেন। সুযোগ পেলেন না। তার পূর্বে অরুণিমা বলল,
” শূভ্রাকে আনতে যাচ্ছ, বাবা? যেও না। এই মুহূর্তে ও কে এই বাড়িতে আনা ঠিক হবে না। ”

অসীউল্লাহ এক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিলেন। বড় মেয়ের দিকে এক পলক চেয়ে যখন জুতো পড়ায় মনোযেগী হলেন তখন অরুণিমা তার কাছে এগিয়ে গেল। বলল,
” তোমরা হয়তো জানো না, শূভ্রা এই বিয়েটা করতে চায়নি। তোমার ভ’য়ে তবুও করেছে। এখন মানিয়ে নিতে পারছে না। শ্বশুর-শাশুড়ি তো দূর সঞ্জয়ান স্যারের সাথে দুর্ব্যবহার করছে। তার ধারণা, শূভ্রা এই বাড়ি আসলে আর যেতে চাইবে না। যদি তোমারও মেয়েকে একেবারে রেখে দেওয়ার ইচ্ছে থাকে তবে যাও। নিয়ে আসো। ”

এতটুকু বলে বাবার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। একটা মনখারাপের ছায়া পড়ল মুখটায়। মাইমূনের কথা তোলার সুযোগ পায়নি। শূভ্রার ব্যাপারে সাবধানীটাও হয়তো মূল্য পাবে না! সে নিজের রুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছে সহসা শুনতে পেল,
” এসব মিথ্যা কথা কে শিখিয়েছে তোকে? শূভ্রা বিয়ে মেনে নিয়েছে। সংসারও করছে। নিয়ে আসার অনুমতি সঞ্জয়ানই দিয়েছে। ”

অরুণিমা চকিতে পেছন ঘুরল। জিজ্ঞেস করল,
” এ কথা সঞ্জয়ান স্যার বলেছেন? ”
” না। সে বাসায় নেই। জরুরি কাজে রাজশাহী গিয়েছে। দুইদিন থাকবে ওখানে। তাই বলে গেছে, শূভ্রা এই কয়দিন বাবার বাড়ি বেরিয়ে আসুক। তারপর গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাবে। ”
” এগুলো তো শূভ্রা বানিয়েও বলতে পারে। সঞ্জয়ান স্যার কি এতটাই দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ যে, তোমাকে এই ব্যাপারে কিছু না বলে চলে যাবে? ”
” কাজটা হঠাৎ পড়েছে। তাই তাড়াহুড়ো ছিল। ফোনটাও নিয়ে যায়নি। শূভ্রার কাছে রেখে গেছে। সেটা দিয়েই কল দিয়েছে। ”

ফোন রেখে যাওয়ার কথাটা শুনে অরুণিমার মনের সন্দেহ আরও তীব্র হলো। প্রকাশ করার সুযোগ নেই। অসীউল্লাহ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেছেন। প্রায় অর্ধেক পেরুতে আচমকা প্রাদুর্ভাব ঘটল সঞ্জয়ানের। শ্বশুরকে সালাম প্রদর্শন করে সুধাল,
” কোথাও যাচ্ছেন? ”

অসীউল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারলেন না। প্রথম দিকে নিজের ভ্রম বলে বোধ হলো। এই সময়ে যার বগুড়া থাকার কথা সে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে। তার মনের অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত সঞ্জয়ান। পুনরায় বলল,
” চাচা, কোথাও যাচ্ছেন? ”
” হ্যাঁ, আপনার বাসায়। শূভ্রাকে আনতে বলেছিলেন যে, তাই যাচ্ছিলাম। ”
” আমি শূভ্রাকে আনতে বলেছি? কখন? ”

অসীউল্লাহ পাহাড় থেকে পতিত হলেন বুঝি! ঘাড় ফিরে তাকালেন, বড় মেয়ের দিকে। তার কথাই ঠিক। সঞ্জয়ান এসব ব্যাপারে জানে না। শূভ্রা মিথ্যা বলেছে। মেয়ের জামাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” স্যার, ভেতরে আসেন। বসে কথা বলি। ”

সঞ্জয়ান আপত্তি করল না। শ্বশুরের পেছন পেছন বাসার ভেতর ঢুকল। টুলে বসে নাস্তা খেতে খেতে পুরো ঘটনা শুনল। অত:পর নিরুদ্বেগে বলল,
” আমি ভেবেছিলাম, ফোনটা হারিয়ে ফেলেছি। এখন বুঝতে পারলাম, ফোনটা চুরি হয়েছে। ”

চোরের নামটা উল্লেখ করল না। গতকাল অরুণিমাকে যেভাবে সমস্যা ও সমাধানের কথা বুঝিয়েছিল তেমন করে অসীউল্লাহকেও বুঝাল। তিনি দুশ্চিন্তায় জড়ানোর পূর্বেই বলল,
” চিন্তা করবেন না। যে সিদ্ধান্ত নিই না কেন, সকলের মতামতের ভিত্তিতেই নেওয়া হবে। আশা করছি, শূভ্রার ভবিষ্যৎে খারাপ প্রভাব করবে না। এই নিশ্চয়তা আমি দেব। ”

অসীউল্লাহ হাসার চেষ্টা করলেও সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। মুখটা গম্ভীর করে জামাইয়ের সাথে বসে নাস্তা সমাপ্তি করছেন। অরুণিমা একটু দূরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিল ও দেখছিল। সহসা সঞ্জয়ানের চোখে চোখ পড়তে সরে যেতে চাইল। তখনই সে বলল,
” দাঁড়াও। ”

সে দাঁড়িয়ে পড়ল। জিজ্ঞাস্য চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকলে সঞ্জয়ান অরুণিমার বাবার দিকে ঘুরে বলল,
” আপনার সাথে একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলতে আসছি। কিছুক্ষণ পরে সপরিবারে গ্রামের পথে রওনা হব। কবে ফিরব নিশ্চিত নই। তাই কথাগুলো এখনই বলার প্রয়োজন বোধ করছি। আপনি অনুমতি দিলে শুরু করতে পারি। ”
” কী কথা? ”
” আমি শুনলাম, অরুণিমা আর মাইমূনের সম্পর্কটা এখনও মেনে নেননি? ”

অসীউল্লাহর আগ্রহভাব মুছে গেল। মুখের ভাব যেমন গম্ভীর করলেন, তেমন বিরক্তও হলেন। চুপচাপ থাকলে সঞ্জয়ান পুনরায় বলল,
” কারণটা কি জানতে পারি? ”

এই পর্যায়ে মুখ খুললেন,
” জেনে-শুনে অমন গু’ন্ডাকে মেয়ের জামাই বানাই কী করে? গরীব হলেও সম্মান আছে কিছুটা। মানুষ কী বলবে? ”
” মাইমূন সাহেব গু’ন্ডা নন। আপনি হয়তো জেনে খুশি হবেন, তিনি দিদারুল করিমের একমাত্র পুত্র। ”

অসীউল্লাহর চোখে-মুখে এক ঝলক বিস্ময়ের দ্যুতি দেখা দিল। সবিস্ময়ে সুধালেন,
” কোন দিদারুল করিম? ”
” সম্ভবত আপনি এই নামে একজনকেই চিনেন। আর সেটা এই বাড়ির মালিক। ”

এই তথ্যটি তার অজানাই ছিল। শুনেছিলেন, বাড়িওয়ালার ছেলেটি খুব ক্ষমতাবান, কিন্তু সেই ক্ষমতা যে, গু’ন্ডা রূপে পেয়েছে ভাবতে পারেনি। তার ধারণা ছিল, সে প্রশাসনিক বিভাগের কোনো উচ্চকর্মস্থ ব্যক্তি হবে। তার বিস্ময় হতাশায় রূপ নিল। ব্যঙ্গ করে বললেন,
” বাপের টাকার জোরেই এই অধপতন! ”

সঞ্জয়ান বুঝানোর প্রচেষ্টায় বলল,
” আপনি ‘ মিয়া ভাই ‘ উপাধিতে তাকে যেভাবে দেখেছেন, শুনেছেন প্রকৃতিপক্ষে সে তেমন নয়। ভালো ও মেধাবী ছেলে, খারাপ সঙ্গে পড়ে লেখাপড়া সম্পন্ন করতে পারেনি। মেয়েলি ব্যাপারে খারাপ রেকর্ড নেই। রাজনীতি জড়িয়ে পড়ায় একটু বেপরোয়া ও উগ্র হয়ে পড়েছে। অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি এখনও। বিয়ে করে সংসারী হলে হয়তো পুরোটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। সব থেকে বড় কথা, মাইমূন আপনার মেয়েকে পাগলের মতো ভালোবাসে। ”

অসীউল্লাহ মেয়ের দিকে এক ঝলক চেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলেন। রু’ষ্ট স্বরে বললেন,
” আপনি যত সহজে সমাধান ভেবে ফেলেছেন ততটাও সহজ নয়, স্যার। এইসব ভালোবাসা-টালোবাসা কিছু নয়। সব মোহ, আকর্ষণ। অরুণিমার রূপের মায়ায় পড়ছে ও। যেটা আপনি বুঝতে পারছেন না। আমার মেয়েও না। তাছাড়া এতকিছু হওয়ার পরও এই ছেলে সামান্যতম ভদ্রতা শেখেনি। আমাকে ধ’ম’কা’চ্ছে, শা’সা’চ্ছে। যদি অরুণিমাকে সত্যি ভালোবাসত, তাহলে তার বাবাকে সম্মানের চোখে দেখত। ”
” উনি আপনাকে ধ’ম’কে’ছে? ”
” হ্যাঁ, গতকালই আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল কলেজে। ”

কথাটা শোনামাত্র অরুণিমার মনে পড়ল, কাল মাইমূন সত্যি কলেজে গিয়েছিল। একাডেমিক ভবন থেকে বেরুতেও দেখেছিল। এর অর্থ দাঁড়ায় মাইমূন তার সাথে নয়, তার বাবার সাথে দেখা করতে এসেছিল। আলোচনার মাঝেই সে ছুটে চলে গেল রুমে। মাইমূনের নাম্বারে কল করে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
” কাল তুমি বাবার সাথে দেখা করেছ? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” ক্ষমা চাইতে। ”
” ধম’কে-ধাম’কে ক্ষমা হাসিল করতে চেয়েছিলে? ”
” একদমই না। হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়েছি। তবুও পাইনি। ”

মাইমূনের কথার সাথে বাবার কথা মিলছে না। সে ক’ড়া গলায় প্রশ্ন করল,
” সত্যি ধ’ম’কাওনি? ”
” ধ’মকা’তে যাব কেন? আমি তো জানি, তিনি এমনি রে’গে আছেন। আমি কি এতটাই বোকা যে, ধ’ম’কে আরও রাগিয়ে দিব? ”

অরুণিমা ভীষণ ফ্যাসাদে পড়ে গেল। কার কথা বিশ্বাস করবে সে?

____________
বাবা-মা তৈরি হয়ে বসার রুমটায় বসে আছে মুখ গোমরা করে। শূভ্রাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সঞ্জয়ান গাড়িতে তেল ভরতে গিয়েছিল। এসে বাবা-মায়ের মুখ দেখে জানতে চাইল, কী হয়েছে। উত্তরে জানাল, শূভ্রা তৈরি হয়নি। দরজা আটকে ভেতরে বসে আছে। কড়া নাড়লে চেঁচিয়ে বলছে, সে কোথাও যাবে না। সঞ্জয়ান অযথা দরজা ধাক্কানোর ঝামেলায় পড়ল না। ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে দরজার তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। শূভ্রা যেমন অবস্থায় ছিল তেমন অবস্থায় কাঁধে চড়িয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
” এবার বুঝলে তো, এই মেয়েকে আমি কেন এত অপছন্দ করি? শুধু আমি কেন, আমার তো মনে হয়, এই পৃথিবীতে এমন একটি মানুষও খুঁজে পাবে না, যার শূভ্রাকে পছন্দ। ”

কথাটা বলা শেষ করতে শূভ্রা উত্তর করল,
” পুরো পৃথিবীতে খুঁজতে হবে না। শুধু আপনার কলেজে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন, এই শূভ্রা শুধু একজন না অনেক ছেলেরই পছন্দ। তাদের ভাগ্য খারাপ, আমি শুধু একজনকেই মন দিয়েছি। ভালোবেসেছি। তার নাম রোমান। ”

সঞ্জয়ান অবাক চোখে চেয়ে রইল এই অবাধ্য, সগর্বিত ও উদ্ধতস্বভাবের মেয়েটির দিকে।

চলবে