আঙুলে আঙুল পর্ব-৩১+৩২

0
186

#আঙুলে_আঙুল

পর্ব (৩১)

‘ ছায়ানীড় ‘ এর প্রবেশ দ্বারে গাড়ি পৌঁছাতে বেশ কিছু নারীর সমাগম দেখা গেল। স্বর্ণলতা গাড়ির কাচ নামিয়ে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে গেলেন, তার ছেলের বউকে দেখার জন্য কতটা উন্মুখ হয়ে আছে সকলে! সে নামার পূর্বে পেছনের সিটে তাকাল। সেখানে সঞ্জয়ান ও শূভ্রা বসে আছে। প্রথমে ছেলে ও পরে বউমার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন,
” ঘোমটা বড় করে টানো, মা। ছোট-বড় মাপবে না। সকলকেই সালাম দিবে, কেমন? ”

শূভ্রা ঘোমটা নামাবে তো দূর মুখ বাঁকিয়ে নিল অন্য দিকে। সঞ্জয়ান ব্যাপারটি লক্ষ্য করে নিজ হস্তে ঘোমটা টেনে দিল জোর করে। ঠাণ্ডা গলায় শা’সি’য়ে বলল,
” এখানে বে’য়া’দবি করলে আমি সহ্য করব না। মা যা বলবে, তা শুনবে। ”

সে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে উত্তর করল,
” শুনব না। আমি আপনাদের কেনা গোলাম নাকি! ”
সঞ্জয়ান অত্যধিক ঠাণ্ডা স্বরে প্রত্যুত্তর করল,
” কেনা গোলাম হলে এত মাপ পেতে না। পি’টি’য়ে পিঠের ছাল তু’লে ফেলতাম প্রথম বারেই। ”

গ’র’ম তেলে পানির ছিটা পড়ার মতো ছ্যাঁত করে ওঠল শূভ্রার উড়নচণ্ডী হৃদয়টা। আ’গু’ন রা’ঙা চোখে তাকাল। সেই চাহনিকে এক আনা দামও দিল না সঞ্জয়ান। গাড়ি থেকে নেমে মায়ের পাশের দরজাটা মেলে দিল। স্বর্ণলতা নামতে নামতে পেছনের গাড়ী থেকে মুনসুর সাখাওয়াতও নেমে এলেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে অভিযোগ করলেন,
” আমার পছন্দের বউমা ঘরে তুলছে বলে তোমার ছেলেকে ছাড় দিলাম। নাহলে স্বর্ণলতা আলাদা গাড়ি তো দূর, আলাদা কদম ফেলারও অনুমতি পেত না। ”

স্বর্ণলতা স্বামীর দিকে আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকালেন। সঞ্জয়ান চেয়েছিল, এক গাড়িতে পুরো পরিবার আসুক। মুনসুর সাখাওয়াত এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন শোনামত্রই। নতুন বিবাহ। এত দূরের পথ! গাড়িও দুটো। তাহলে বর-কনের সাথে শ্বশুর-শাশুড়ি কেন? সঞ্জয়ান বাবাকে বুঝাতে পারবে না। তাই মাকে বলে, শূভ্রাকে সে একা সামলাতে পারবে না। যেভাবেই হোক, বাবাকে বুঝিয়ে এই গাড়িতে নিয়ে আসুক। তিনি ছেলের অসহায়ত্ব, দুর্বলতা এক চাহনিতে বুঝে ফেলেছিলেন। তাই এক গাড়িতে উঠার জন্য স্বামীকে পীড়াপীড়ি করলে মুনসুর সাখাওয়াত বলেন, ‘ তুমি যাও। আমি অন্য গাড়িতে আসছি। দুটো গাড়ি থাকতে, এক গাড়িতে ঠেসে বসতে পারব না আমি। আমার সম্ভ্রমে খোঁচা লাগবে। ”

সঞ্জয়ান গাড়ির পাশ ঘুরে শূভ্রাকে গাড়ি থেকে নামায়। হাতে ধরে মায়ের কাছে এনে বলল,
” বাবার কথামতো বউকে এনে দিয়েছি। এবার তোমরা সামলাও। আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে! ভেতরে গেলাম। ”

সে চলে যেতে পারল না। ডান হাতটা বাবা চেপে ধরলেন। ধ’ম’কের সুরে বললেন,
” সংসার শুরু হলো না এখনই ক্লান্ত হয়ে পড়লে কীভাবে হবে? জামাই বেঁচে থাকতে বউ একা হাঁটবে কেন? দুজন একসাথে যাবি। চুপচাপ দাঁড়া এখানে। ”

উন্মুখ হয়ে থাকা সমাগম ভাঙতে শুরু করেছে। সরগরম হচ্ছে একাধিক কণ্ঠস্বরের কথপোকথনের চাপে। সেখান থেকে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন স্বর্ণলতার সামনে। ভাঙা স্বরে আহ্লাদ ঢেলে বললেন,
” নয়া বউ রে নিয়া আইছ? মুখখানা অমন ঢাইকা রাখছ ক্যান? ঘোমটা সরাও, মুখটা দেহি। ”

স্বর্ণলতা কোনো প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ পেলেন না। মুনসুর সাখাওয়াত দূর থেকে হুং’কা’র ছাড়লেন,
” আমার বাড়ির বউয়ের মুখ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখবে! তোমার এত বড় স্প’র্ধা! ”

বৃদ্ধ মহিলা ভ’য়ে ছি’ট’কে ওঠলেন। ভীতসন্ত্রস্ত পদে সরে দাঁড়ালেন এক কোণে। বৃষ্টিতে ভেজা মুরগির মতো কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে পড়লে স্বর্ণলতার মায়া হলো। নজরে পড়ে এমন রা’গ নিয়ে তাকালেন স্বামীর দিকে। কাছে চেপে এসে আস্তে কিন্তু তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
” গ্রামের হাওয়া শরীরে লাগতে গলার স্বর বদলে গেছে, তাই না? কার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় আজও শিখলেন না! ”

চাপা শাসন বুলিতে মুনসুর সাখাওয়াত থতমত খেলেন। চঞ্চলিত চোখজোড়া নিস্তব্ধ হয়ে পড়া মানুষগুলির দিকে ঘুরাতে ঘুরাতে গলার তাপ কমিয়ে ফেললেন তৎক্ষনাৎ। মাথাটা স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে সামান্য নিচু করে বললেন,
” তুমি তো আছ, আমাকে শিখিয়ে দেওয়ার জন্য। ”
” শেখাতে শেখাতে বুড়ি হয়ে গেছি আমি। ”

তিনি স্বর্ণলতার বিরক্তভরা মুখটায় চেয়ে মৃদু হেসে বললেন,
” কোথায় বুড়ি হয়েছ? আমার চোখে তুমি সেই বারো বছরের আদুরীই আছ। যার দুটো চোখ, দুটো কান, দুটো ঠোঁট, শুধু নাক একটা। ”

মুনসুর সাখাওয়াতের তুলনা শুনে তিনি অবাক হলেন। আশ্চর্যান্বিত স্বরে সুধালেন,
” বুড়ো হলে মানুষের নাক দুটো হয় নাকি চোখ, কান, ঠোঁট তিনটা হয়? ”
” কী করে জানব? আমি কি তোমার মতো এমএ পাশ শিক্ষিতা? আমি হলাম, টু’য়ে ফেল করে স্কুল ছাড়া মূর্খ মানুষ। এসব অংক কষা প্রশ্ন আমাকে করবে না, আদুরী। আমার সম্ভ্রমে লাগে! ”

কথাটা বলেই বৃদ্ধ মহিলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাতদুটো ধরে বললেন,
” চাচি, ভেতরে আসেন। আমার রুমের খাটে বসে মিষ্টি খেতে খেতে নাতবউয়ের মুখ দেখবেন। মন না ভরলে সেখানে ঘুমাবেন, সকালে উঠে আবার দেখবেন। ”

স্বর্ণলতা তার কৌশলী খোঁচাটা ধরে ফেললেন। হতাশ মনে ভাবলেন, সে এই মানুষটার শরীরটা ধুতে পারলেও মনটা আজও ধুতে পারেনি। শুধু পাহারা দিতে পারছে মাত্র। যতদিন এই পাহারা দিতে পারবেন ততদিনই মানুষটার অন্তরের ক’ঠো’রতা ব’ন্দী হয়ে থাকবে।

ছায়ানীড়ের বাইরের ভীড়টা ভেতরে ঢুকতে বিশালতায় রূপ নিল। কোনো এক রুমে বসানো সম্ভব নয় সকলকে। তাই নতুন বউকে লম্বা বারান্দার এক মাথায় বসানো হলো। বাড়ির সবচেয়ে উঁচু ও নিখুঁত ভারী নকশা করা কাঠের চেয়ারটায় তার আসন হয়েছে। বাকিদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে পাটিতে। সকলের সামনে কাচের থালায় দু’রকমের মিষ্টি ও সরবত রেখে শূভ্রার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন স্বর্ণলতা। ঘোমটা খুলতে খুলতে কানে কানে বললেন,
” সালাম দেও। ”

সে সালাম দিল না। ঘোমটার অংশ শাশুড়ির হাত থেকে টেনে নিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলল। চেয়ার ছেড়ে উঠে মানুষজনকে ডিঙিয়ে হেঁটে চলল বারান্দার অপরপাশে। দরজা খোলা আছে এমন একটা রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে চিৎকার করল,
” আমি এ বাড়ির বউ না। এরা আমাকে জোর করে তুলে এনেছে। ”

______________
” মানুষের মনের সাথে শরীরের সুগভীর একটা সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে পেটের। ”

রুহানিয়া কলেজে চাকরি পাওয়ার পর থেকে দুপুরে বাবার সাথে খাওয়া হতো অরুণিমার। এখন আর হয় না। কিন্তু অভ্যাসটাও ত্যাগ করার মতো না বলেই হয়তো সে বাবার বসার স্থানে এসেছিল। অসীউল্লাহ আপনমনে টিনের বাক্স থেকে খাবার খাচ্ছেন। অরুণিমা দূর হতে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিল সহসা আবির্ভাব ঘটে মাইমূনের। অরুণিমা চমকে যায়। জিজ্ঞেস করে,
” তুমি কখন এলে? ”

মাইমূন উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে বলল,
” এজন্যই মনখারাপ হলে পেটের ক্ষুধা মরে যায়। ঠিক যেমন তোমার মরে গেছে। অবশ্য মনের সাথে পেটের এই সুগভীর সম্পর্কটা শুধু তোমার ক্ষেত্রে না সকলের ক্ষেত্রেই হয়। ”

তার এই কথাগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দিল না। মাইমূনকে নিয়ে এই স্থান থেকে অরুণিমা সরে এলো। ভবনটির বারান্দায় নীরব জায়গায় থেমে বলল,
” আবারও আমাকে না বলে এখানে এসেছ? মানা করেছিলাম না? ”
“করেছিলে। কিন্তু মন মানছিল না। ”
” কেন? ”
” দুপুরে খেতে বসেছিলাম হঠাৎ মনে হলো, আমার ভালোবাসাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে হয়, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছে না। এরপর কি আর খাওয়া যায় বলো? না খেয়েও বসে থাকতে পারছিলাম না। তাই দৌড়ে চলে এসেছি। ”

অরুণিমা একটু নিভল। উদাস হলো। সত্যি তার খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না। বাসায় একসাথে বসে খাওয়ার নিয়ম তাদের। সে এই নিয়মের বাইরে চলে গেছে। রান্নাঘরে যেমন মায়ের পাশে থাকতে পারে না, তেমন খাওয়ার সময়ও। ব্যাপারটি এমন নয় যে, তাকে খেতে নিষেধ করেছে। কিন্তু খেতে বলেও না। তাদের সাথে বসলে থালায় ভাত বেড়ে দেয় না। প্রথম দিকে সে নিজে বেড়ে নিলেও পরবর্তীতে আগ্রহটা হারিয়ে ফেলে। মাইমূনের ধারণামতো, ক্ষুধাটায় হয়তো মরে গেছে। তাই দুইদিন ধরে রাতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে না।

” তোমার বাসার সমস্যাটা মিটেনি? রাগ চলছে এখনও? ”

অরুণিমার সম্বিৎ ফিরল। অপ্রস্তুত চেয়ে আছে। ইতস্তত করে বলল,
” কমেছে। ”
” এরপরও মনখারাপ? ”

প্রশ্নটি পড়তে ঘণ্টার শব্দ শোনা গেল। অরুণিমা তাড়াহুড়োয় বলল,
” আমার মনখারাপ নেই। তুমি এখন যাও, আমি পরে দেখা করব। ”

মাইমূনের হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। সেটা উপরে তুলে বলল,
” এগুলোর কী হবে? আমি যে ক্ষুধা জীবিত করার জন্য তোমার প্রিয় খাবার রেঁধে এনেছি। ”
” আমার প্রিয় খাবার? ”
” এই না। ভুল বলেছি, তোমার প্রিয় খাবারের নাম জানি না। তাই আমার প্রিয় খাবার এনেছি। ”
” তুমি রেঁধেছ? ”

অরুণিমার প্রশ্নটা শুনেনি এমন ভাব করে মাইমূন পুনরায় বলল,
” আমরা একে-অপরের প্রিয়-অপ্রিয়ের সম্পর্কে কবে জানব? আমার যে আর ধৈর্য্য হচ্ছে না। ভালোবাসা, কিছু একটা করো। নাহয় আমাকে কিছু করতে বলো। ”

তার কণ্ঠস্বরে একইসাথে অভিযোগ, অনুরোধ। আকুতিভরা নয়ন দুটোতে চেয়ে অরুণিমা বলল,
” আমি করব। তার আগে বলো, তুমি সত্যি বাবাকে অসম্মান করে কিছু বলোনি? ”

মাইমূন অগাধ আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রত্যুত্তর করল,
” না। নিজেকে অসম্মানিত করে তাকে সম্মানিত করেছি। শুধুমাত্র তার মেয়েকে ভালোবাসি বলেই ‘ মিয়া ভাই ‘ পদবিটা উপড়ে ফেলে মাথা নত করেছি। ”

চলবে

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৩২)

টিফিনের শেষ ঘণ্টা পড়ে যাওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসের দিকে ছুটছে। শিক্ষকগণও অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। বারান্দায় আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সকলের আসা-যাওয়ার মধ্যে পড়ে গেছে দুজন। অরুণিমা বারান্দা থেকে বেরুতে চাইল। ফাঁকা মাঠটা চোখের ইশারায় দেখাল মাইমূনকে। সে পেছন পেছন হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল তার ভালোবাসার কাছে। মধ্যাহ্নের সূর্যের উত্তাপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। চোখের পলকে ঘামের দানা জমে গেল অরুণিমার নাকের চূড়ায়। চোখ মেলে থাকা কষ্টকর। কুঁচকে আসতে আসছে চোখের পাপড়ির নরম দেয়ালগুলো। সে আকাশের দিকে মুখ করে বলল,
” এই রোদে ছেলেমেয়েগুলো বসে ছিল কিভাবে? আমার তো ঘাম বেরুচ্ছে! ভালোবাসা, ঐদিকটায় চলো। গাছের ছায়া আছে। ”

মাইমূনের দেখানো স্থানটার দিকে ঘাড় ফেরালেও এগুনোর আগ্রহ নেই অরুণিমার ভাবভঙ্গিতে। বলল,
” আমার কাজ আছে। গল্প করার সময় নেই। তুমি এখন যাও। পরে দেখা করব। ”
” যেমন করে বিদায় করো তেমন করে ডাক পাঠাও না। ”

তার কণ্ঠে অভিমানের আভাস। একের পর এক অভিযোগ পেয়েও অরুণিমার আচরণে বদল আসছে না। সে বুঝতে পারে, অনুতপ্তও হয়। যার রেশটা মাইমূনের উপস্থিত পর্যন্তই স্থায়ী হয়। সে চলে গেলে অনুতপ্তের আ’গু’ন ধপ করে নিভে যায়। ছাইয়ের ছিটেফোঁটাও থাকে না। অরুণিমার দৃষ্টি হালকা হয়। ঘাসের দিকে স্থির হতে মাইমূন বলল,
” চলে যাচ্ছি। ইচ্ছে হয় তো, আমার প্রিয় খাবার ছুঁয়ে দেখ। ”

অরুণিমা কথা বাড়াল না। চুপচাপ খাবারের বাটি হাতে নিল। মাইমূনকে এখানে রেখে স্বর্ণলতা ক্যান্টিনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। পা বাড়াবে সেই সময় নজরে পড়ল বাবাকে। হাতে হাজিরা খাতা ও কিছু কাগজপত্র। বাবার চোখে চোখ রেখে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ আমরা দুজনেই দুজনের বিশ্বাস ভেঙেছি, কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু পার্থক্যটা কোথায় জানো, বাবা? আমি সত্যি বলেছিলাম আর তুমি মিথ্যা। মিথ্যা বলে আমাকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়েছিলে আর এখন ভালো মানুষটাকে আমার চোখে খারাপ বানাতে চাচ্ছ। ‘ শেষ বাক্যটা উচ্চারণ করামাত্র বুকের ভেতরটা কেঁ’পে ওঠল। ঝড়ো হাওয়ার মতো দুলে ওঠল পুরো শরীর। চড়কির ন্যায় মাথার ভেতরটাও চক্কর দিচ্ছে। বাবাসহ চারপাশটা আবছা হয়ে আসতে মৃদু স্বরে বলল,
” আমাকে ধরো। ”

কারও ধরার অপেক্ষা করল না। হাতের বাটিটা ফেলে দিল। ডান হাতটা পেছনে নিয়ে শক্ত কিছু অনুসন্ধান করছে মরিয়া হয়ে। মাইমূন এক লাফে তার নিকট চলে এলো। হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে কিছু একটা বলল। যার একটা শব্দও অরুণিমার কানে পৌঁছাল না। সে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল মাইমূনের শ’ক্ত শরীরটায়।

অরুণিমা জ্ঞান ফিরে পেয়ে বুঝল, সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। আশ্চর্যের মুখ করে তড়ি-ঘড়িতে উঠে বসতে দেখল, তার শিয়রের কাছে বাবা বসে আছেন চেয়ার পেতে। গত কয়েক দিনে বাবা তার রুমে ঢুকেনি। সামনে আসেনি। নিজ থেকে কথা বলেনি। আজ সেই বাবা তার পাশে মাথার কাছে বসে আছে। চোখে, মুখে উদ্বিগ্নের ছায়া। মুখটা শুকনো, অন্যমনস্ক। চেতনা ফিরল নার্সের গলা পেয়ে। তিনি বলছেন,
” বলেছিলাম না তেমন কিছু হয়নি? এখনই জ্ঞান ফিরবে। মিলল আমার কথা? ”

অসীউল্লাহ নার্সের দিকে এক ঝলক চেয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। অরুণিমা তখনও নার্সের দিকে চেয়ে আছে। সে তার কাছে হেঁটে এসে অভিযোগের সুরে বলল,
” এত বার করে বললাম, এটা প্রাইভেট হসপিটাল, ভর্তি করাবেন না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট হবে। শুনল না। জোর করে ভর্তি করাল। এখন বসে বসে টাকা গুণুণ। ”

অরুণিমা বুঝতে পারল, শেষ কথাটা তার বাবার উদ্দেশ্যে বলেছে। নার্স বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
” উনি সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি স্যারকে পাঠাচ্ছি। আজই ছুটি নিবেন। নাহলে টাকা গুণে শেষ করতে পারবেন না। সুস্থ মানুষটাও অসুস্থ হয়ে যাবে। ”

সে বেরিয়ে যেতে অরুণিমা বলল,
” আমাকে এখানে এনেছ কেন, বাবা? আবার ভর্তিও করেছ? নিশ্চয় অনেক টাকা বিল হয়েছে। শোধ করবে কিভাবে? ”

অসীউল্লাহ বিরক্ত স্বরে বললেন,
” আমি করিনি, তোর গু’ণ্ডাটা করেছে। বে’য়া’দব একটা! আমার কথা শোনে? কত করে বললাম, সরকারি হাসপাতালে নিয়ে চলো। পাত্তাই দিল না। ”
” আমাকে মাইমূন নিয়ে এসেছে? ”
” হ্যাঁ। ”
” তোমাকেও? ”
” কী আশ্চর্য! আমাকে আনতে যাবে কেন? আমি কি তোর মতো জ্ঞান হারিয়েছি? ”

কথাটা ধ’ম’কের মতো শোনালেও অরুণিমা ভ’য় পেল না। আগ্রহসহিত জিজ্ঞেস করল,
” তুমি নিজ থেকে এসেছ, বাবা? ”
” আসব না? চোখের সামনে তুই জ্ঞান হারালি আর আমি মুখ বাঁকিয়ে চলে যাব? ”

অরুণিমার বুকের ভেতরটা আবারও দুলে ওঠল। এবার আনন্দের, খুশির। তার বাবা তাকে পুরোপুরি ত্যাগ করেনি। এখনও ভালোবাসে। যত্ন করে। পরোয়া করে। সে আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। বাবাকে জড়িয়ে ধরল আচমকা। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল,
” আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। ”

অসীউল্লাহ দ্বিধা নিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেও জোরের সাথে উত্তর করলেন,
” জানি। ”
” আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না। খুব কষ্ট হয়। মনে হয়, মরে যাই। ”
” আমি দূরে সরাতে চাইনি। তুই নিজেই সরি গেছিস। ”

অরুণিমা আগের চেয়ে আরও শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরল জন্মদাতাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” ক্ষমা করে দাও। আর কখনও তোমার কথার বাইরে যাব না। ”

অসীউল্লাহ চুপ হয়ে গেলেন। মেয়ের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। আড় চোখে তাকালেন দরজার কাছটায়। মাইমূনের ছায়া দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা আধ ঘণ্টা ধরে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিমা যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল তখন ছেলেটা এত ভ’য় পেয়েছিল যে, লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছিল! হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে নিথর শরীরটা আলগোছে ধরে রেখেছিল। তিনি বিপদ টের পেয়ে বাধ্য হয়ে যখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কী হয়েছে ওর? ‘ সে বোকার মতো উত্তর করেছিল, ‘ জানি না। ‘ তারপর তিনিই এগিয়ে আসেন। মেয়ের শরীর হাতিয়ে জানান, জ্ঞান হারিয়েছে। এই যে জানতে পারল? ব্যস! তারপর দুনিয়া ভুলে গেল। অরুণিমাকে কাঁধে করে দৌড়ে দৌড়ে এই হাসপাতালে পৌঁছাল। অথচ কলেজ থেকে বেরুলেই রিকশা, অটো পাওয়া যায়। ঐ মুহূর্তের জন্য সে ভুলেই গেছিল পৃথিবীতে এমন যান যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছে। ব্যবহার হচ্ছে যুগ যুগ ধরে।

” তোর গু’ণ্ডা’টাকে ভেতরে ডাক। ”

অরুণিমা বাবাকে ছাড়ল। চোখের পানি মুছতে মুছতে সুধাল,
” ও কি বাইরে আছে? ”
” হ্যাঁ। ঐ তো দাঁড়িয়ে আছে। ”

বাবার চোখের ইশারা পেয়ে সে দরজার দিকে তাকাল। ছায়াটা নজরে আসতে বলল,
” ভেতরে এসো। বাবা কথা বলবে তোমার সাথে। ”

মাইমূন ভেতরে এলো। অসীউল্লাহর দিকে নজর দেওয়ার ধৈর্য হলো না। নিজের ভালোবাসার কাছে এগুতে এগুতে বলল,
” আমাকে স্বাস্থ সচেতনের উপদেশ দিয়ে নিজেই অসচেতন হয়ে পড়েছ। ওখানে আর থাকতে হবে না। আমার সাথে চলো। আজ থেকে তুমি আমার সাথে থাকবে, আমার বাড়িতে। ”
” বিয়ে না করেই একসাথে থাকবে? ”

প্রশ্নটা অসীউল্লাহর কাছ থেকে ছুটে এলো। মাইমূন তার দিকে ফিরতে তিনি বিদ্রুপের সুরে বললেন,
” তোমার থেকে এমনটাই আশা করা যায়। ধর্ম কর্মহীন ছেলেরা সামাজিকতা মানে নাকি! ”

অরুণিমা বুঝতে পারল, বাবা আবার রে’গে যাচ্ছেন। ক’ঠো’র হয়ে পড়ছেন। তাই দ্রুত দুজনের মাঝে কথা বলল,
” বাবা, তুমি ভুল বুঝছ। আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা হচ্ছে তাই এরকম বলে ফেলেছে। ”

মাইমূন কিছু একটা বলতে চাইল। অরুণিমা চোখ রা’ঙা’তে সে চুপ হয়ে গেল। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আঁটসাঁট দেহে দাঁড়িয়ে থাকল। অসীউল্লাহ তখনই কিছু বললেন না। নীরবে ভাবলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর মেয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
” তুই এই ছেলেকেই বিয়ে করবি? এটাই কি তোর শেষ সিদ্ধান্ত? ”

মাইমূনকে এই প্রথম গু’ণ্ডা’র পরিবর্তে ছেলে হিসেবে সম্বোধন করেছেন। অরুণিমা একটু সাহস পেল। প্রত্যুত্তরে বলল,
” হ্যাঁ। কিন্তু তোমার মত নিয়ে। ”
” আমি মত না দিলে করবি না? ”
” না। ”
” যদি কখনই না দিই, তাহলে? ”
” সারা জীবন অবিবাহিত থাকব। ”
” ঠিক তো? ”

প্রশ্নটা সূঁচের মতো আ’ঘা’ত করল অরুণিমাকে। তার বাবা কি চাচ্ছে, সে আজীবন অবিবাহিতই থাকুক? সে ব্যথিত মনে উত্তর করল,
” হ্যাঁ। ”
” তুই যে এখনও আমাকে এত গুরুত্ব দিস জেনে খুশি হলাম। এর উপহার হিসেবে তোকে ক্ষমা করে দিব। কিন্তু এই ছেলেকে আমার মেয়ের জামাই হিসেবে মানতে পারছি না। ”
” কেন পারছ না? ”
” সেটা কি তোর অজানা, অরু? ”

অরুণিমা চিন্তায় পড়ে গেল। অস্থিরচিত্তে তাকাল মাইমূনের দিকে। সে এখনও অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে চেয়ে বলল,
” দয়া করে মেনে নাও। দেখ, বিয়ে হলে ও বদলে যাবে। ”
” যদি বদলেই যাবে তাহলে বিয়ের পরে কেন? এখনই বদলাক। ”

অরুণিমার দৃষ্টি ফিরে এলো বাবার মুখটায়। তিনি পুনরায় বললেন,
” তুই বলেছিলি না, নেশা থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে? পুরোপুরি সরেছে? না সরলেও এখন সরতে হবে। শুধু নেশা থেকে না সকল খারাপ দিক থেকে সরে আসতে হবে। দলবল নিয়ে না ঘুরে চাকরি করতে হবে। ভদ্রলোক হতে হবে। তবেই আমি বিয়ের মত দিব। ”
” চাকরি! ওর তো পড়াশোনা সম্পূর্ণ হয়নি, বাবা। ”
” তাহলে ব্যবসা করুক। তবে এখানে শর্ত আছে আমার। ”
” কী শর্ত? ”
” ওর বাবার কাছ থেকে কোনো সাহায্য নিতে পারবে না। রাজনীতীর ক্ষ’ম’তার দা’প’টও দেখাতে পারবে না। যা করবে নিজ যোগ্যতায়। বুদ্ধি ও গায়ের জো’র খাটিয়ে। ”

চলবে