আঙুলে আঙুল পর্ব-৩৭+৩৮

0
216

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৩৭)

মাইমূন আজ তার ভালোবাসার দিকে চেয়ে কথা বলছে না। রাস্তার দিকে চেয়ে থেকে উত্তর করল,
” তোমার করা আর আমার করা এক নয়। মেয়েদের চাওয়া থাকে তার জীবনসঙ্গীর সামাজিক মর্যাদা তার চেয়ে একটু হলেও উঁচুতে থাক। ”

অরুণিমা উত্তর করল,
” আমি হয়তো সেই মেয়েদের মতো নয়। ”

মাইমূন ঝটিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল এই ভিন্নরূপী মেয়েটির উপর। অতি উৎসাহে সুধাল,
” এর মানে অনুমতি দিচ্ছ? ”

হঠাৎ তৈরি হওয়া আনন্দ ও উত্তেজনায় তার একস্থির চাহনির পলকগুলো মৃদু কাঁপছে। দীপ্ত ছড়ানো বদনখানির দিকে চেয়ে সরাসরি ‘ হ্যাঁ ‘ বলতে পারল না অরুণিমা। সংশয় মনে বলল,
” এই কাজে তোমাকে মানাবে কি? যে পরিচয়ে বড় হয়েছ, যেভাবে বেড়ে উঠেছ তার সাথে এর কোনো মিল নেই। তুমি মানিয়ে নিতে পারবে? খুব কষ্ট হবে। কঠিন লাগবে। ”
” তুমি আমার পাশে থাকলে সব সহজ হয়ে যাবে। ”

মাইমূনের কণ্ঠস্বরে এত দৃঢ়তা ও পোক্তবল ছিল যে তার হৃদয় উষ্ণতা অনুভব করল। কিছু মুহূর্তের জন্য কথা বলতে পারল না। অল্পক্ষণ নীরব সময় কাটিয়ে সবিস্ময়ে বলল,
” আমাকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? ”
” যেখানে তুমি আছ সেখানে ঠিক-বেঠিক শব্দ দুটোর মূল্য নেই আমার কাছে। ”
” মূল্য দিতে হবে। পাগলের মতো যা ইচ্ছে হবে তাই করলে চলবে না। ”

মাইমূন সামান্য হাসল। প্রফুল্লচিত্তে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
” যা ইচ্ছে তা করছি না। আমি ভেবেই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। ”
” কী ভেবে নিলে শুনি। ”
” ভালো চাকরির যোগ্যতা নেই আমার। চট করে সেই যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যবসা করার জন্য যে সামর্থ্যটা আমার নেই সেটা একটু সময় লাগলেও তৈরি করা সম্ভব। আমি ঠিক করেছি, এই চাকরির মাধ্যমে টাকা-পয়সা সঞ্চয় করব। তারপর সেটা দিয়ে ছোট-খাটো একটা ব্যবসা ধরব। ”

অরুণিমা হতভম্ব হয়ে গেল তার পরিকল্পনা শুনে। সেলসম্যানের চাকরি করেছে সে। বেতন যৎসামান্য। সেখান থেকে সঞ্চয় করা অসম্ভব প্রায়। মাইমূনের পক্ষে তো একেবারেই অসম্ভব। যে মানুষটার বিচক্ষণ ও আবেগি কথা শুনলে তার হৃদয় কেঁপে ওঠে সেই মানুষটা এই দিক দিয়ে এতটা বোকা! নাকি আয় ও ব্যয়ের হিসেব কখনও করতে হয়নি? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে উদয় হতে প্রকাশ করল,
” তুমি কখনও চাকরি করোনি? ”

মাইমূন স্বাভাবিকভাবেই উত্তর করল,
” না। ”
” তাহলে এতদিন চলেছ কিভাবে? তোমার খরচাপাতি যোগাড় করেছ কিভাবে? ”
” বাবা দিয়েছেন। তিনি প্রতি মাসের শুরুতে আমার এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন। ”

অরুণিমার ধারণাই ঠিক। এই ছেলের আয়-ব্যয়ের হিসেব কষতে হয়নি কখনও। তার ইচ্ছে হলো একটু হিসেবটা কষে বুঝিয়ে দেয়। পর মুহূর্তে মন বদলাল। তার প্রবল আগ্রহ ও উদ্যমী মনটাকে ভাঙতে ইচ্ছে হলো না। বলল,
” এই চাকরি থেকে টাকা সঞ্চয় করতে অনেক সময় প্রয়োজন। ”

মাইমূন আগ্রহ ও উদ্বিগ্ন নিয়ে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” কেমন? ”
” চার-পাঁচ বছর তো লাগবেই। ”

তার উদ্বিগ্নভাবটা দূর হয়ে গেল মুহূর্তে। বলল,
” মাত্র! আমি ভাবলাম এক যুগ, দুই যুগ লাগবে। ”
” পাঁচ বছর তোমার কাছে মাত্র মনে হচ্ছে? ”
” হ্যাঁ। আর এই বছর-টছরের হিসেব করেই কী লাভ? আমরা একে-অপরকে ভালোবাসি। পাশে আছি। ব্যস! আর কী চাই? বিয়েটা তোমাকে খুশি করার জন্য করতে চাই। আমার এতে অতটাও আগ্রহ নেই। আমার শুধু তোমাকে চাই। আর সব থেকে বড় কথা, তোমার বাবা আমাকে কোনো নির্দিষ্ট বাঁধা সময় দেয়নি। ”

অরুণিমার কথা বলার শক্তি আবারও থেমে গেল। এই ছেলের বিয়েতে আগ্রহ নেই! অগুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হচ্ছে। অথচ তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য, শক্তিশালী ও অবশ্যই পালনীয় ঘটনা হলো বিয়ে। যেটাকে মাইমূন নির্দ্বিধায় অপালনীয় তালিকায় ফেলে দিতে পারে। অরুণিমা যদি চায়, তাহলে বিয়ে না করেও দুজন একত্রে থাকতে পারে, সংসার করতে পারে। মাইমূন খুশিমনে মেনে নিবে। সমাজ, আইন, ধর্ম কিছুকেই পরোয়া করবে না। তার এই স্বভাবটা কি তাহলে জন্মদাতার কাছ থেকে পেয়েছে? পেতেই পারে, সমাজের চোখে সে দিদারুল করিমের ছেলে হলেও তার শরীরে তো অন্য কারও র’ক্ত বয়ছে! সেই মানুষটার নাম মস্তিষ্কে ও হৃদয়ে অনুরণিত হতে তার বুক কেঁ’পে ওঠল। মনেপ্রাণে চাইল, মাইমূনকে সে যেমন ভাবছে, যেমন দেখছে তেমনই যেন থাকে সারাজীবন।

” আজ সারাদিন আমার সাথে থাকবে? ”

মাইমূনের আবদার ও অনুরোধের কন্ঠস্বরে অরুণিমার চিন্তাভাব ভাঙল। জিজ্ঞেস করল,
” সারাদিন? হঠাৎ? কোনো বিশেষ প্রয়োজন আছে কি? ”
” হ্যাঁ, কাল ভোরে আমি গাজীপুরের জন্য বাস ধরব। আমার চাকরির স্থান ওখানে। শুনেছি, নতুন অবস্থায় ছুটি দেয় না। তোমার সাথে আবার কবে দেখা হবে জানি না। ”
” গাজিপুর! ”

মাইমূন রিকশা থামাল। নামতে নামতে বলল,
” হ্যাঁ, আমার থাকা-খাওয়াও ওখানে। ”

অরুণিমা দ্রুত রিকশার পেছন দিক দিয়ে ঘুরে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করল,
” এতদূরে কেন? এই চাকরি তো আমাদের এখানে অনেক আছে। তুমি চাইলে….”

মাইমূনের ভাড়া দেওয়া শেষ। অরুণিমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” ঐ যে বলছিলে না, আমার পরিচয় ও বেড়ে উঠার সাথে চাকরিটা মানাবে না? তাই এগুলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট না হই। ”

অরুণিমা মাটির পুতুলের মতো শক্ত ও নিশ্চল হয়ে গেল। অভিব্যক্তি শূণ্য হয়ে একমনে তাকিয়ে আছে মাইমূনের দিকে। মাইমূনের এই পরিবর্তন, চিন্তাভাবনাগুলো তার অবিশ্বাস্য ঠেকছে। সত্যি তার মতো সাধারণ মেয়ের জন্য এতকিছু করছে?

” সারাদিনে হবে না। আজকের রাতটাও আমাকে দিতে হবে। ”

অরুণিমা চমকে বলল,
” রাতে তোমার সাথে থাকতে বলছ নাকি? অসম্ভব! ”

মাইমূন প্রথমে বুঝতে পারল না। পরক্ষণে নিজের কথাটার অর্থ অনুধাবন করে দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরল। একহাতে কান টেনে ধরে বলল,
” ছি! ছি! আমি ঐ থাকা বলিনি। রাতে একসাথে খেতে চাচ্ছি। শুধু আমরা না। আমার ছোট ভাইগুলোও থাকবে। অনেক দিন একসাথে খাওয়া হয় না৷ এখন তো ওদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিছি৷ তাই ভাবলাম যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে একটু সময় কাটিয়ে যাই। ”

কথাগুলো বলতে বলতে মাইমূন কান ছেঁড়ে দিয়েছে। একটু সহজ হয়ে তৃপ্তভরে সহাস্যে বলল,
” আজ সবাই মিলে তোমার হাতে রান্না খাব। বাজার-সদাইয়ের দায়িত্ব ওদের উপর দিয়েছি। আমরা যেতে যেতে করে ফেলবে। চিন্তা করো না, তোমাকে একা করতে হবে না। আমরাও সাহায্য করব। ”

অরুণিমা নিরুত্তর। দ্বিধাভর্তি চোখজোড়া স্থির হয়ে আছে মাইমূনের মুখটায়। কতক্ষণ আগে যেই ছেলেটা বিয়ের প্রতি অনাগ্রহ দেখানোতে তার মনে দুশ্চিন্তা জড়ো হয়েছিল সেগুলো এই ছেলের উচ্ছ্বসিত চেহারা ও আমোদি কন্ঠস্বরে কাটছে না। জোর করে যেমন সম্মতি দিতে পারছে না তেমন অসম্মতিও। অদ্ভুত দোমনায় মনের ভেতর অস্থিরতার হাওয়া বয়ে চলছে৷ অথচ গতকালও এই বাড়িটিতে মাইমূনের সাথে এক দুপুর সময় কাটিয়ে এসেছে।

” অরুণিমা? কিছু বলছ না যে? ”
” কী বলব? ”

মাইমূন অবাক স্বরে বলল,
” এতক্ষণ কী বললাম আমি? শুনোনি? ”
” শুনেছি। ”
” এখনই বাসায় যাবে? নাকি বাইরে কোথাও থেকে সময় কাটিয়ে আসবে? ”

অরুণিমা সামান্য ঘুরে দাঁড়াল বামে। চাহনি অন্য দিকে সরিয়ে নিতে নিতে বলল,
” বাইরে থাকি। ”
” কোথায় যাবে বলো? কোলাহল মুক্ত জায়গার নাম বলো। আমার একটু নিরিবিলি সময় লাগবে। ”

অরুণিমার চোখের চাহনি ফিরে এলো মাইমূনের দিকে। মৃদু উত্তেজিত স্বরে সুধাল,
” নিরিবিলি লাগবে কেন? ”

মাইমূন উত্তর দিতে চেয়েও থেমে গেল। গভীর চোখে তাকাল তার মুখটায়। চোখের তারা ও পলকের অস্থিরতা নজরে পড়তে বলল,
” কী হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা? ”

অরুণিমা খানিক ভড়কে গেল। অপরাধ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে এমন ভাব। মাইমূন এই অভিব্যক্তিটাও লক্ষ্য করে বলল,
” তোমাকে আগে থেকে কিছু বলিনি বলে অসুবিধা হচ্ছে? ”

সে ধরা পড়ে গিয়েও লুকাতে চেষ্টা করল। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বলল,
” না। ”
” তাহলে? তোমার বাবা কিছু বলেছে? আমার সাথে দেখা করতে মানা করেছে? ”

অরুণিমা প্রথম উত্তরটা মিথ্যা বলেছে। তারপরে তার বুক কাঁ’প’ছে, গলার স্বর বরফের মতো জমে গেছে এমন ভাব। মনে হচ্ছে, কিছু বললে আরেকটা মিথ্যা হয়ে যাবে। তার এই চুপ করে থাকার মধ্যে মাইমূন নিজের মতো উত্তর খুঁজে নিল। খানিক বিরক্ত নিয়ে বলল,
” এই ভ’য়টাই পাচ্ছিলাম! ”

তারপরে মিনতির স্বরে বলল,
” আজকে কোনোভাবে তাকে সামলাতে পারবে না? তোমার সাথে একটু একান্ত সময় না কাটাতে পারলে আমার খুব খারাপ লাগবে। ”

অরুণিমার ভেতরটা এবার দ’গ্ধ হতে শুরু হলো। পরিস্থিতি কোথা থেকে কোথায় গড়াচ্ছে! তার ইচ্ছে হলো মনের যত ভয়, সংশয়, সংকোচ এক লহমায় নিষ্পন্ন করে ফেলতে। সে কী করবে বা বলবে বুঝতে না পেরে যখন অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল মিনতিপূর্ণ মুখটায়। তখনই মাথায় সুবুদ্ধি এলো। দ্রুত বলল,
” না বাবা এমনটা বলেননি। ”

মাইমূন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ধপ করে বিপদমুক্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
” তাহলে চলো। ”

অরুণিমা বাঁধা দিয়ে বলল,
” তুমি যে এখান থেকে চলে যাচ্ছ, তোমার বাবা-মা জানে? তাদের থেকে বিদায় নিয়েছ? ”

হঠাৎ তার বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ আসায় তার মুখের রঙ বদলে গেল। মলিন মুখে উত্তর করল,
” না। ”
” কেন? তোমার উচিত তাদের সঙ্গে দেখা করা, দোয়া নেওয়া। ”
” প্রয়োজন নেই। ”
” আছে। নতুন একটা জীবন শুরু করতে যাচ্ছ। অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানীয় মানুষ দুজনের দোয়া নিবে না এটা হয়? ”

মাইমূন অপ্রসন্ন হয়ে বলল,
” এসব কেন বলছ, অরুণিমা? তুমি আমার অতীত ও বর্তমান সবই জানো। বাবার সাথে বছর ঘুরে দুই-একবার প্রয়োজনীয় আলাপ হলেও মায়ের সাথে কথা একদমই বন্ধ। আমি তাদেরকে স’হ্য করতে পারি না। বিশেষ করে মাকে। চোখে পড়লে মাথা য’ন্ত্র’ণা হয়, বুকের মধ্যে আ’গুন জ্বলে ওঠে। মৃ’ত্যু ক্ষুধা জাগে। মনে হয় নিজে ম’রে যাই নাহয় কাউকে মে’রে ফেলি। ”

অরুণিমা খেয়াল করে মাইমূনের কথা বলার ভঙ্গি বদলে গেছে। মুখের ভাবে এসেছে অত্যন্ত কঠোরতা ও নিষ্ঠুরতা। তার আত্মা কেঁপে ওঠে। ভীত হয় এই ভেবে, সত্যি কি মানুষ খুনের মতো জঘন্য অপরাধ মাইমূনের দ্বারা সম্ভব হবে? তার একমনে চাইল, এই বিষয়টা এখানে শেষ করে দেয়। তাদের মধ্য থেকে সরে দাঁড়ায়। আরেকমন চাইল, দৃঢ় হতে। নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে। বিষয়টি অযথায় টেনে আনলেও এখন মনে হচ্ছে, সত্যি এদের সম্পর্কটা ঠিক করার দায়িত্ব নেওয়া উচিত তার। তাই বলল,
” আমি মানছি আন্টি অনেক বড় অন্যায় করেছে, এর শাস্তিও ভোগ করছে। এরপরও তোমার রাগ পড়ছে না কেন, মাইমূন? আমার মনে হয়, তার অন্যায়টা তোমার চেয়েও তোমার বাবার কাছে অনেক বেশি বড়। মাফ পাওয়ার অযোগ্য। এরপরও তো তিনি মাফ করে দিয়েছেন। তোমাকে আপন করে নিয়েছেন। তারা চাইলে দ্বিতীয় সন্তান নিতে পারত, নেয়নি। ”
” তোমার কাছে ব্যাপারটা যত সহজ মনে হচ্ছে ততটাও নয়। ”
” তাহলে সহজ করে দিই? ”

মাইমূন কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” কিভাবে? ”
” আমি তোমার পাশে থেকে। মনে আছে, কিছুক্ষণ আগে কী বলেছিলে? আমি তোমার পাশে থাকলে সব সহজ হয়ে যায়। সত্যি সহজ হয় নাকি এটা দিয়ে প্রমাণ হয়ে যাক। ”
” জোর করে মাফ হয় না। শুধু শুধু সময় নষ্ট করছ। ওদের আমার প্রয়োজন নেই। ”
” আমার আছে। আমার শুধু স্বামী না, শ্বশুর-শাশুড়িসহ সম্পূর্ণ একটা শ্বশুরবাড়ি লাগবে।

অরুণিমা একপ্রকার জোর করে মাইমূনকে নিয়ে গেল তার বাড়ির সামনে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গিয়ে দাঁড়াল তাদের মুখ্য দরজায়। কলিংবেল চাপ দেওয়ামাত্র মাইমূন ফিসফিসে বলল,
” তোমার সত্যিই এসব দরকার? শুধু আমাকে দিয়ে হবে না? ”
” না, হবে না। আমার তো এটাও জানা দরকার, ছেলের বউ হিসেবে আমাকে তাদের পছন্দ হয়েছে কিনা৷ ”
” তাদের পছন্দ-অপছন্দে আমার কিছু যায়-আসে না। ”
” আমার আসে। যাদের সাথে সারাজীবন থাকব, তাদের পছন্দসই বউ না হলে শান্তি পাব নাকি? ”
” তোমার ওদের সাথে থাকতে হবে না। ”
” হবে। চুপ করে দাঁড়াও তো। এত কথা বলছ কেন? ”

চলবে

#আঙুলপ_আঙুল
পব (৩৮)

প্রায় মিনিট সমান সময় অপেক্ষার পর দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক মহিলা। সুতি শাড়ি জড়ানো শরীরটা বড্ড ক্লান্ত ও দুর্বল। আঁচল দিয়ে মাথার অর্ধেকটা ঢাকা। অনুজ্জ্বল মুখটায় ভালো করে চায়তে অরুণিমার মনে হলো, এই মুখটাকে সে দেখেনি কোনোদিন। অথচ এই বাসায় থাকছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। তার এই ভাবনার মধ্যে ফিসফিসে স্বর শুনতে পেল,
” আমার মা। ”

মাইমূনের মুখে কথাটা শুনে সে মৃদু চমকাল। উজ্জীবিত বদনে পাশ ঘুরে তাকাল তার দিকে। কিছু বলার পূর্বেই টের পেল, মাইমূনের মা দরজা থেকে সরে যাচ্ছেন। অরুণিমা চট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল মায়ের দিকে। সত্যি ধীর কদমে ক্লান্তভাবে হেঁটে চলে যাচ্ছেন ভেতরঘরে৷ সে অস্থিরচিত্তে বলল,
” চলে গেলেন যে? তোমাকে দেখে খুশি হোননি? ”
” হয়েছে। ”
” তাহলে কিছু বললেন না কেন? ”

তার কণ্ঠে সন্দেহ, কৌতূহল। সামান্য ভয়। মাইমূন মৃদু স্বরে বলল,
” বলার চেষ্টা করেছেন অনেক। কিন্তু আমার থেকে কোনোরূপ জবাব না পেয়ে চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ”
” এবার চুপ করা থাকা চলবে না। যাও, কথা বলো। ”
” না। দরকার নেই। তুমি চলো তো এখান থেকে। ”

অরুণিমা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়৷ সে আঁটসাঁট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নিজের সিদ্ধান্ত অটুট রেখে বলল,
” না। যাব না। ”

মাইমূনের মুখে বিরক্তের ভাঁজ পড়ল। জে’দি মেয়েটির দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াল। অসহায়ভঙ্গিতে করুণ স্বরে বলল,
” এমন করে না। আমাকে বুঝার চেষ্টা করো। এটা আমার দ্বারা হবে না। ”
” হবে। চেষ্টা তো করো আগে। ”

এইটুকু নরম স্বরে বললেও পরক্ষণে গোঁ ধরে শ’ক্ত গলায় বলল,
” মায়ের সাথে পরিচিতি না হয়ে কোথাও যাব না। ”

এর বিপরীতে কোনোরূপ অভিব্যক্তি খুঁজে পেল না মাইমূন। শুধু চোখ মেলে একস্থির চেয়ে আছে সহানুভূতির আশায়, পেল না। অরুণিমা তাগিদ দিয়ে চলল,
” চলে যাচ্ছেন তো! ডাক দেও। ”

মাইমূন বুঝতে পারল এই মেয়ের হাত থেকে মুক্ত পাবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সে নিরূপায়! তাই বাধ্য হয়ে সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় বিরস গলায় উচ্চারণ করল,
” মা? ”

তার মা দাঁড়িয়ে পড়লেন। পেছন ফিরে তাকালেও উত্তর নিলেন না। সন্দেহজনক দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকলে মাইমূন বলল,
” ও অরুণিমা। তোমার ছেলের বউ। ”

মায়ের সন্দেহ কেটে গেল মুহূর্তে। ক্ষণিকের জন্য বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন দূরে। অতঃপর বড় বড় কদম ফেলে দ্রুত হেঁটে এলেন ছেলের কাছে। আবেগে উত্তেজিত হয়ে মুখটা ছুঁয়ে বললেন,
” তুই আমার সাথে কথা বলছিস? ”

মাইমূন উত্তর দিল না। সে অখুশি, বিরক্ত। মায়ের হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে দিল একটানে। তিনি এই আচরণটাকে গ্রাহ্যই করলেন না। আনন্দের অশ্রু ভর্তি চোখজোড়া নিয়ে বললেন,
” একটু আগে মা বলেও ডেকেছিস, তাই না? আমি তাহলে ভুল শুনিনি! ”

মাইমূন নিরুত্তর। বিরক্তের ভাব বাড়ছে। মায়ের সামনে থেকে সরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ল। অরুণিমার দিকে চেয়ে বলল,
” পরিচিতি হয়েছ? এবার চলো। ”

সে কিছু বলার আগে মা বললেন,
” এখনই যাবি? বসবি না একটু? ঘরে নতুন বউ এসেছে। মিষ্টি মুখে না দিলে হয়? আয়, বাবা। বউকে নিয়ে বসবি কিছুক্ষণ। ”

কথার মাঝে তিনি অরুণিমার হাত ধরে ফেললেন। একপ্রকার জোর করে ভেতরে টেনে আনলেন। বসার রুম ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে চললেন নিজের রুমের দিকে। আদর ও যত্নের সাথে বিছানায় বসিয়ে দিতে অরুণিমা লাজুক চাহনি রেখে বলল,
” আমরা বিয়ে করিনি এখনও। ”

মাইমূন না চাইলেও বাসার ভেতরে ঢুকতে হলো। অরুণিমা ও মায়ের পেছন পেছন এই রুমের দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখনই কথাটা শুনে উত্তর করল,
” তাতে কী? একে-অপরকে ভালোবাসি। এরচেয়ে বড় কিছু আছে? ”

অরুণিমা দূর থেকে জবাব দিল,
” ভালোবাসলে স্বামী-স্ত্রী হয় না। এরজন্য বিয়ে করতে হয়। ”

মাইমূন এর উত্তর দেওয়ার সময় পেল না। দুজনের মাঝে আসলেন তার মা। বললেন,
” এখন ভালোবাসছ, পরে বিয়ে করবে। এই নিয়ে ঝ’গ’ড়া করার কী আছে? বসো, তোমরা। আমি নাস্তা-পানির ব্যবস্থা করছি। ”

তার এই মাঝে ঢুকে কথা বলা ও মিটমাট করে দেওয়ার ব্যাপারটি পছন্দ হলো না মাইমূনের। খানিক রা’গা’ন্বি’ত স্বরে বলল,
” আমরা ঝ’গ’ড়া করছি না। কখনও করিনি। ভবিষ্যতেও করব না৷ ”

তিনি মনখারাপ করলেন না। হেসে উঠে বললেন,
” ঠিক আছে, করিস না৷ এখন মেয়েটার পাশে গিয়ে শান্ত হয়ে বস। ”

মাইমূন চুপচাপ হেঁটে গিয়ে বসল। মা রুম থেকে বেরিয়ে পড়তে অরুণিমা বলল,
” দেখলে, মা কতটা খুশি হয়েছে? ”

সে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আমরা বিয়ে করিনি, এই কথাটা বললে কেন? ”
” মিথ্যা বলেছি কিছু? ”
” সত্য-মিথ্যা যাই হোক৷ আমার খারাপ লেগেছে। ”

মাইমূন মিথ্যা বলছে না। খারাপ লাগাটা পুরো মুখটায় ভেসে উঠেছে। অরুঙিমার চোখদুটিতে মায়া উপস্থিত হতে সে পুনরায় বলল,
” আমি কাল চলে যাব, ভালোবাসা। সেজন্য তোমার সাথে ভালো সময় কাটাতে চেয়েছিলাম আর তুমি! ”

তার স্মরণে এলো, মাইমূনের চাকরি ও গাজিপুরে চলে যাওয়ার ব্যাপারটি। মুহূর্তে তার বুকের ভেতর দরদ জড়ো হতে শুরু করল। অপরাধবোধ তৈরি হতে বলল,
” এখান থেকে বেরুই মন ভালো করে দিব। ”
” এখনই বেরুচ্ছ না কেন? তাহলেই তো আমার মন ভালো হয়ে যায়। তুমি যে কারণে এসেছ সেটা পূরণ হয়েছে। আর কিসের জন্য অপেক্ষা করছ। ”
” চাকরির খবর দাওনি। দোয়াও নেওনি৷ আমি চাই, তুমি দোয়া চেয়ে বিদায় নেও। ”

এরমধ্যে মা ট্রে হাতে রুমে প্রবেশ করলেন। ট্রে ভর্তি কাটা ফল, মিষ্টি ও সরবত। সরবতের গ্লাসটি অরুণিমার দিকে বাড়িয়ে বললেন,
” এসিটা ছেড়ে দিতে ভুলে গেছি একদম। গরমে কষ্ট হচ্ছে, না? রা’গ করো না। এখনই ছেড়ে দিচ্ছি। ”

পাশ থেকে মাইমূন বলল,
” ভুলে যাওনি, ইচ্ছে করেই বন্ধ করে রেখেছ। এমনই করে এসেছ সবসময়। ”

মা আশ্চর্য হলেন৷ ছেলের দিকে চেয়ে আছেন বিস্মিত বদনে। তাঁর এমন কোনে ঘটনা মনে পড়ছে না যেখানে ইচ্ছেকৃত এসি বা পাখা বন্ধ করে রেখেছে।

অরুণিমা অন্য একটি সরবতের গ্লাস এগিয়ে দেয় মাইমূনের দিকে। সে গ্রহণ করল না। উপরন্তু অরুণিমার হাতেরটাও কে’ড়ে নিয়ে ট্রে’তে ফিরিয়ে রাখল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে কাঠ স্বরে বলল,
” আমি চাকরি পেয়েছি। কাল গাজিপুর যাব। ইচ্ছে হয়তো দোয়া করো। ”

তার দিকে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়ার আশা না করে অরুণিমার দিকে চাইল। মিনতির স্বরে বলল,
” এবার বেরুবে? মনে হচ্ছে, আমি দো’য’খে আছি। ”

___________
টানা সাতদিন জ্বরে ভুগেছে শূভ্রা। প্রথম দুইদিন সঞ্জয়ানের রুমে থাকলেও তিনদিনের দিন স্বর্ণলতা ছেলের বউকে নিজের রুমে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। যে ছেলে বাইরের কেউ অসুস্থ শুনলেও সেবাশুশ্রূষা করার চেষ্টা করে সেই ছেলে নিজের অসুস্থ বউয়ের দিকে ভালোভাবে তাকাচ্ছিল না। বলে-কয়ে তার হাত দিয়ে ওষুধ খাওয়ানো যাচ্ছিল না। প্রথমবার ডাক্তার বাড়ির ভেতর ডেকে আনলেও দ্বিতীয়বার রোগীকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে হয়েছে। সেটাও সঞ্জয়ান করেছে মায়ের অসহ্য বকা খেয়ে। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠার পর একত্রে নাস্তা করতে বসেছে শূভ্রা। স্বর্ণলতা পাশের চেয়ারটি দখল করে আছেন। বউমার প্লেটের পাশে গরম দুধের গ্লাসটা রেখে বললেন,
” দুধটা খেয়ে নিও, মা। অনেক শুকিয়ে গেছ। শরীরটা এখনও দুর্বল। ”

তারপরে ছেলের দিকে চেয়ে বললেন,
” ঠিক বলেছি না? চোখদুটো গর্তে ঢুকে গেছে। মুখটা কালো হয়ে গেছে। ”

সঞ্জয়ান তাকানের প্রয়োজন মনে করল না। নিজের খাবার খেতে খেতে উত্তর করল,
” ও আগে থেকেই কালো। ”

শূভ্রা সবে খাবার প্লেটে হাত দিয়েছিল। স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে অপমান বোধ করল। গাল ফুলিয়ে, চোখ রা’ঙি’য়ে তাকাল। স্বর্ণলতা ছেলেকে ধ’ম’ক দিয়ে বললেন,
” তুই কিন্তু মা’র খাবি আমার হাতে৷ ”

সে উত্তর করল,
” সত্য কথা বললেও আজকাল শাস্তি পেতে হয়! ”
” কী সত্যটা বলেছিস? আমার বউমার গায়ের রঙ মোটেও কালো নয়। ”
” সত্যকে মিথ্যার চোখে দেখলে অমনই মনে হবে। ”

স্বর্ণলতা মৃদু ক’ঠি’ন স্বরে প্রশ্ন করলেন,
” আমি মিথ্যার চোখে দেখছি? ”

সঞ্জয়ান নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
” প্রমাণ চাই? তোমার আর ওর হাতটা একসঙ্গে করো। ”

তিনি হাত মেলালেন না। শূভ্রার গায়ের রঙ কালো না হলেও তার মতো ফর্সা নয়। প্রসঙ্গ বদলে বললেন,
” মেয়েটা এখানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। বাবা-মাকে জানাতে দেয়নি দুশ্চিন্তা করবে তাই। ”
” এটাও মিথ্যা। জানাতে না দেওয়ার কারণ অন্য কিছু হবে। ও নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে চিন্তা করে না। ”

স্বর্ণলতা এবার একটু বেশি ক’ঠি’ন হলেন। গ’র’ম চোখে তাকিয়ে রু’ক্ষ স্বরে বললেন,
” সব ব্যাপারে উল্টোটা বলা বন্ধ কর। ”
” আচ্ছা করলাম। ”
” আজ কোথাও যাওয়ার থাকলে ফোন করে বলে দে, যেতে পারবি না। ”
” কেন? তুমি কোথাও যাবে, মা? ”
” আমি না। তুই যাবি। বউমাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবি। ”

সঞ্জয়ান জোর দাবিতে নাকচ করতে চাইল, পারল না। মায়ের মুখে শুনল,
” আর একটা কথাও শুনতে চাই না। আমি যেতে বলেছি মানে যেতে হবে। ”

আদেশ শুনে তার বাকি খাবারটুকু খাওয়া হলো না। চুপচাপ চেয়ার সরিয়ে উঠে চলে গেল।

__________
শূভ্রাকে নিয়ে তাদের বাসায় পৌঁছাতে রাত হয়ে গেছে। সঞ্জয়ান জামাই আদর নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল,
” অরুণিমাকে দেখছি না। বাসায় আসেনি এখনও? ”

নাজিয়া বেগম এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন,
” এসেছে তো। মনে হয়, ছাদে গেছে। ও কে কি দরকার? ডেকে পাঠাব? ”

প্রশ্নগুলো করে নিয়াজের দিকে তাকালেন। সে সঞ্জয়ানের পাশে বসে আছে। সঞ্জয়ানই ডেকে এনে হাতে বিস্কিট দিয়েছে। তার দিকে ইশারা করতে উঠে দাঁড়াল। রুম থেকে দৌড়ে বেরুতে ধরলে সঞ্জয়ান বলল,
” তোমাকে যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি। গরম লাগছে, বাইরের হাওয়ায় শরীরটাও ঠান্ডা হবে। ”

বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়াল। পরনের শার্টটা টান টান করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিয়াজ দৌড়ে আসে মূল দরজার কাছে। সিঁড়ি দেখিয়ে দিতে সঞ্জয়ান ধীর পদক্ষেপে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে বেয়ে ছাদে উঠে আসে।

চলবে