#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_11
#Writer_NOVA
ফ্লোরার লা’শবাহী গাড়িটা নিঃশব্দে এগিয়ে চলছে গন্তব্যের উদ্দ্যেশে। সাইরেনটাও অফ করে দেওয়া হয়েছে। রুহানি ব্লুটুথে কানেক্টেড আছে একজনের সাথে। সে রুহানিকে রাস্তা বলে দিচ্ছে আর রুহানি সেই অনুযায়ী মাসুমকে গাড়ি চালাতে বলছে। মাসুম গাড়ি চালাতে চালাতে রুহানিকে শুধালো,
‘রুহানি, এখন যদি ফ্লোরার লা’শটা উঠে আমাদের দুজনের ঘাড় মটকে দেয় তাহলে কেমন হবে?’
রুহানি নাক ফুলিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। মাসুমের অযাচিত প্রশ্নে সে বিরক্ত। দাঁত কিড়মিড় করে, চোখ পাকিয়ে তাকালো। মাসুম কাচুমাচু করে ভীতি চোখে দৃষ্টি দিলো।
‘সত্যি কথা বলছি।’
রুহানি ধমকে উঠলো,
‘আরেকবার উল্টোপাল্টা কথা বললে লাত্থি মেরে মে’রে গাড়ি থেকে ফেলে দিবো। দিনে-দুপুরে লাশ উঠে ওর ঘাড় মটকাবে। খেয়েদেয়ে কাজ নেই তো।’
‘কাজ নেই দেখেই বলছি।’
রুহানি দুমদাম করে মাসুমের বাহুতে কতগুলো ঘুষি বসিয়ে দিলো৷ মাসুম ব্যাথায় চোখ কুঁচকে ফেললো। এই পুঁচকে মেয়েটার শরীরে শক্তি আছে। একেকটা ঘুষি ইটের বারির সমান। রুহানির ব্লুটুথে কানেক্টেড থাকা মানুষটা উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। রুহানির কথা শুনে সে আন্দাজ করে ফেলছে এখানে কি হচ্ছে। হাসির শব্দ রুহানির কানে আসতেই সে সাগরের ঢেউয়ের মতো গর্জন করে উঠলো,
‘এই তুমি হাসছো কেন?’
হাসির ছটা কমতে সে বললো,
‘তোমাদের কান্ডে।’
‘তোমার আশকারায় মাসুমটা এমন হয়েছে।’
সে গলার স্বর পানসে করে বললো,
‘যা বাবা আমি আবার কি করলাম?’
‘তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া।’
মাসুম রুহানির কানের সামনে চেচিয়ে অভিযোগ করে বসলো,
‘ভাই, আমাকে কতগুলো ঘুষি মেরে বসলো। আমি বেজাতনীকে আর সহ্য করতে পারবো না। আপনার সম্পত্তি এবার আপনি নিয়ে যান।’
রিহানি ঠোঁট কামড়ে চোখ গরম করে মাসুমকে ভয় দেখালো। কাজে দিলো। মাসুম এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে আরেক হাত দিয়ে মুখ ধরে ফেললো। রুহানিকে ঠান্ডা করতে সে বললো,
‘মারামারি, ঝগড়া পরে করো। আগে আমার কথায় মনোযোগ দাও।’
কথাটা জাদুর মতো কাজ করলো। রুহানি মুহুর্তে সব ফেলে সিরিয়াস হয়ে গেলো। কান খাড়া করে বললো,
‘হুম বলো।’
‘এখন এই গাড়ি নিয়ে সোজা জেলার শেষ সীমানায় যাবে। সেখানে তাদের মানুষ থাকবে। তুমি তাদেরকে লাশটা বুঝিয়ে দিয়ে মাসুমকে নিয়ে অন্য গাড়িতে চলে আসবে। তবে সাবধান! মাস্ক পরে নিবে। তোমাদের যাতে কেউ না চিনে এমন করেই যাবে।’
‘তুমি যাবে না?’
‘না, আমাকে দেখলে নেগেটিভ রিয়াকশন দিতে পারে। তাই আমি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার মোবাইলে লোকেশন আর লোকের যাবতীয় ইনফরমেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি চেক করে নিও।’
ফ্লোরার বাবা রায়হান খান বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখছে। গতকাল রাতে তার মোবাইলে অদ্ভুত একটা ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজটা ছিলো এমন “আপনার মৃত মেয়েকে ফেরত পেতে চাইলে জেলার শেষ সীমানার বড় ব্রীজে দাঁড়িয়ে থাকবেন। সময় ৪টা।” প্রথমে ভেবেছিলেন ভুয়া সংবাদ। কেউ তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সকালে সেই নাম্বার থেকে কল আসে। কলে তাকে শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে চারটা বাজে ব্রীজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। সাথে লাশবাহী গাড়ির চালক নিয়ে৷ তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে যায়৷ এরপর কতশত বার কল দিলো কিন্তু সীম বন্ধ বলছে। উনি আসবে না আসবে না বলেও চলে এলেন। যদি সত্যি হয় সেই আশায়। পুরনো কথায় ডুব দিয়েছিলেন। ধ্যান ভাঙলো চালকের কথায়।
‘চারটা বিশ বাজতে চললো, এখনো তো এলো না। আর কতখন লাগবে বলুন তো?’
রায়হান খান ইতস্তত করে বললো,
‘বেশি সময় লাগবে না। এই চলে এলো বলে।’
চালক বিরক্তি প্রকাশ করলো। রায়হান খানকে তাড়া দিয়ে বললো,
‘জলদী কল করে আসতে বলুন।’
‘সীম বন্ধ কল দিলেও কাজ হবে না।’
চালক বিরক্তি নিয়ে খানের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো৷ কাউকে কল দিয়ে একটু সাইডে সরে গেলো। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট পাঁচেক পর একটা লাশবাহী গাড়ি তাদের সামনে এসে থামলো। গাড়ি থেকে মাস্ক পরিহিত একটা মেয়ে বের হয়ে এলো।
রুহানি মোবাইলটা জিন্সের পকেটে গুঁজে রায়হান খানের সামনে দাঁড়ালো। মাসুম তখনও গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসা। রুহানি গলার স্বর মোটা করে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি কি মিস্টার রায়হান খান?’
‘জ্বী!’
‘আপনার মেয়ের লাশ গাড়িতে আছে। দয়া করে আপনি লাশটা নিয়ে এই মুল্লুক ত্যাগ করুন। আপনাদের গ্রামের বাড়ি তো সিলেট তাই না?’
রায়হান খান চমকে উঠলো। তাদের গ্রামের বাড়ির খবর এই মেয়ে জানলো কি করে? বিস্মিত নয়নে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি কি করে জানলে মা?’
রুহানি চোখ নাচিয়ে হাসলো৷ সামনের বেবী চুলগুলো গুছিয়ে নরম গলায় বললো,
‘আমি অনেক কিছু জানি।’
‘কিভাবে?’
রায়হান খানের বিস্ময়ের পরিমাণ আরো বাড়লো। রুহানি মুচকি হাসলো। তবে উত্তর দিলো না। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
‘বেশি কথা বলার সময় নেই আঙ্কেল। আপনি যত দ্রুত এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাবেন ততই ভালো। সিলেটে গিয়ে মেয়ের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করুন। আর কিছু দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকুন। যাতে রাক্ষসটা আপনাদের খুঁজে না পায়। খুঁজে পেলে আপনার মেয়ের লাশ কবর থেকে উঠাতেও দ্বিধা করবে না।’
রায়হান খান হালকা কেঁপে উঠলো। তবে দেখলেন শেষের কথাগুলো বলার সময় মেয়েটার চোখ, গলার স্বর কেমন কঠিন বর্ণ ধারণ করলো।
রুহানি চোখ দিয়ে পরিমাপ করতে লাগলো রায়হান খানের মতিগতি। বুঝতে পেরে নিজে থেকেই বললেন,
‘আপনার নিশ্চয়ই এখনো কোন কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না।আপনি চাইলে নিজের মেয়ের লাশটা দেখে নিতে পারেন।’
রায়হান দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বললো,
‘সেটাই ভালো।’
রুহানি দ্রুত পায়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুললো। ফ্রিজিং গাড়ির ভেতর থেকে হু হু করে এক দমকা হাওয়া এসে গায়ে লাগলো৷ রুহানি ভেতরে ঢুকে পরলো। রায়হান খানের পা দুটো চলছে না। তবুও টেনেটুনে নিজেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কফিনের ওপর ঝুঁকতেই নিজের একমাত্র মেয়ে ফ্লোরা দৃষ্টিগোচর হলো। মেয়ের সাদা ফ্যাকাশে, পাণ্ডুর মুখটা দেখে রায়হান খান স্থির থাকতে পারলেন না। মাথা ঘূর্ণি দিলো। টলতে টলতে পরে যেতে নিলে রুহানি ধরে ফেললো। ঠোঁট চেপে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলেন। নিজের একমাত্র মেয়ের করুন দশা সে সহ্য করতে পারছেন না। রুহানি তাকে ধরে বাইরে নিয়ে এলো। মাসুমের থেকে পানি নিয়ে তা খাওয়ালো।
রায়হান খান কিছুটা স্বাভাবিক হতেই রুহানি তাড়া দিয়ে বললো,
‘চাচা, বেশি সময় দেরী করা ঠিক হবে না। এতখন নিশ্চয়ই মন্ত্রী টের পেয়ে গেছে। সে সারা জেলা চষে ফেলবে। একবার যদি ফ্লোরার লাশ ওর হাতে পরে যায় তাহলে সারাজীবনের জন্য মেয়ের লাশ কবরের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।’
‘আমার স্ত্রী প্রতিদিন কেঁদেকেটে আল্লাহর কাছে আর্জি জানায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহান। তিনি আমাদের কথা শুনেছেন। তুমি কে মা?’
রুহানি মিষ্টি হেসে বললো,
‘ধরুন, আমি আপনারি আরেক মেয়ে।’
ওমর বাসায় বসে বসে বোরিং হচ্ছিলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো তবুও ইয়াসফির আসার খবর নেই। এতো কল দিচ্ছে তবুও কল ধরছে না। বাসার মোটামুটি সব কাজ করা শেষ। আজকে একটা নতুন গৃহ পরিচারিকা আসার কথা ছিলো। সেও এলো না। বিরক্তি ভাব কমাতে টিভি অন করলো।
চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে কোলিং বেল বেজে উঠলো। ফোঁস করে বিরক্তির শ্বাস ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দিলো।দরজার অপরপাশে শ্যাম বর্ণের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ঢোলাঢুলা সেলোয়ার-কামিজ। চোখ মোটা করে কাজল পরায় তার চোখ দুটো ভীষণ মায়াবী দেখাচ্ছে। ওমর এক নজরে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাসা ভাসা চোখ দুটোতে অস্থির ছটফটানি। নিজেকে এক মুহুর্তে হারিয়ে ফেলেছিলো। মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। অস্থির চিত্তে এদিক সেদিক তাকালো। রিনরিন গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘মন্ত্রী সাব আছে?’
‘জ্বি?’
‘জিগাইলাম মন্ত্রী সাব আছে?’
ওমরের ঘোর কাটলো। নিজের এহেন ব্যবহার নিজেই লজ্জিত হলো৷ নিজেকে সামলে উত্তর দিলো।
‘না। আপনি কে?’
‘আমি কাজের মেয়ে হিসেবে জয়েন করতে আইছিলাম।’
‘ওহ আচ্ছা। ভেতরে আসুন।’
‘না, আজকে আমু না। কালকের থিকা জয়েন করমু তাই কইতে আইছিলাম।’
ওমর মেয়েটার নাম জানার জন্য উসখুস আরম্ভ করলো। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারছিলো না। সেটা মেয়েটা টের পেয়ে নিজেই বলে উঠলো,
‘আপনি কি কিছু কইতে চান?’
‘না মানে হ্যাঁ। আপনার নাম কি?’
‘রু…..
রু শব্দটুকু বলে থেমে গেলো। ওমর চোখ গোল করে জিজ্ঞেস করলো,
‘রু কি?’
‘রুবি, মোর নাম রুবি।’
সারা রুমের জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে পরে আছে। কিছু জিনিসপত্রে ভেঙে এদিক সেদিক ছিটকে রয়েছে। রুমটা দেখে বোঝার উপায় নেই ঘন্টা খানিক আগেও এটার অবস্থা ভালো ছিলো। দুই হাতে মাথা চেপে ফ্লোরে চুপ করে বসে আছে ইয়াসফি। সে খুব বেশি রাগলে তার মাথা চেপে বসে থাকে। চোখ দুটো টকটকে লাল। মনে হচ্ছে এই বুঝি চোখ ফেটে রক্ত গড়িয়ে পরলো। সারা দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা এক করেও ফ্লোরার লাশের কোন সন্ধান সে পায়নি। এতেই তার মাথা নষ্ট। তার ভালোবাসার মানুষকে সে কখনো দেখতে পারবে না এটা ভাবলেই তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। হাতের কাছে থাকা ফুলদানিটা দেয়ালে ছুঁড়ে মেরে বিরবির করে উঠলো,
‘আমি তোকে ছাড়বো না। তুই আমার থেকে একে একে সব কেড়ে নিচ্ছিস। অপেক্ষা কর আমিও তোর সব কেড়ে নিবো।’
চিনামাটির ফুলদানি ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। টুকরো গুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে গেলো। ল্যাম্পশেটের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে অপুকে কল লাগালো। রিসিভ হলো ত্রিশ সেকেন্ড পর।
‘হ্যালো ভাই।’
‘কোন খোঁজ খবর পেলে?’
অপু শুকনো ঢোক গিললো। না শব্দটা বলতে তার ভীষণ ভয় করছে। গলার কাছে আটকে রয়েছে। গিলতেও পারছে না বের করতেও পারছে না। ইয়াসফি ধমকে উঠলো,
‘বলছো না কেনো? খবর পেলে?’
‘না।’
অপুর না বলতে দেরী ইয়াসফির মোবাইলটা আছাড় মারতে দেরী নয়। আছাড়ের শব্দে অপু কেঁপে উঠলো। হ্যালো, হ্যালো করেও রেসপন্স না পেয়ে দ্রুত বুকে থুথু দিলো। ভয়ে তার হাত-পা শুদ্ধ কাঁপছে।
ইয়াসফি হাঁটুতে মাথা দিয়ে চুপ করে বসে রইলো। মাথার ভেতরটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। তখুনি শব্দ করে মোবাইলটা বেজে উঠলো। ইয়াসফি ভ্রু কুঁচকে মাথা উঠালো। মাত্র মোবাইলটা আছাড় মারলো এর মধ্যে বাজছে কি করে? ইয়াসফি হাতে নিয়ে দেখলো মোবাইল কিছুই হয়নি। ড্রপ খেয়ে ফ্লোরে থাকা একটা বালিশের ওপর পরেছে। কোণার দিকে একটু খানি স্ক্রিনের কাচ নষ্ট হয়েছে। আননোন নাম্বার দেখে রিসিভ করবে কি করবে না তা ভেবে দ্বিধায় পরে গেলো। অবশেষে রিসিভ করলে। রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে তার মামাতো বোন তিশার গলার আওয়াজ ভেসে এলো।
‘ইয়াসফি মাহবুব তার নিজের বন্ধু নিহানকে চিনতে পারেনি। লোকে জানলে তো ছিঃ ছিঃ করবে। বিষয়টা কেমন ঘাপলা লাগছে।’
তিশাকে সে এমনিতেও এড়িয়ে চলে। আর সেই মেয়ে নিজ থেকে কল করেছে। বিষয়টা মোটেও সুখবর নয়।ইয়াসফির বুকটা ধ্বক করে উঠলো। নিজেকে সামলে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কেন কল দিয়েছো?’
তিশা খিলখিল করে হেসে উঠলো। ইয়াসফির বুকের ভেতরে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। সে প্রশ্ন করলো আর মেয়েটা হাসছে। তিশা হাসতে হাসতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। গমগমে গলায় শুধালো,
‘আপনি কে বলুন তো?’
#চলবে
#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_12
#Writer_NOVA
বারান্দায় উদাস হয়ে বসে আছে পলাশ হায়দার। পাশে এসে দাঁড়ালেন মিশি বেগম। স্ত্রীর উপস্থিতি টের পেয়েও তার অন্যমনস্ক ভাব কমলো না। মিশি বেগমের বুক চিড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে গেলো। নিজেকে শান্ত করে স্বামীর কাঁধে হাত রেখে বললেন,
‘তুমি এতো চিন্তা কেন করছো বলো তো? শুধু শুধু নিজের স্বাস্থ্যের অবনতি ছাড়া কি আর কিছু হচ্ছে? তোমার মেয়ে ঠিক আছে।’
ঘোলাটে চোখে তাকালেন পলাশ হায়দার। স্ত্রীর মনভুলানো কথা তার মনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারিনি। স্ত্রীর হাতের ওপর হাত রেখে মৃদুস্বরে বললো,
‘প্রতিদিন মৃত্যুর সাথে খেলা করে। আমার ভীষণ ভয় করে মিশি। মনে হয় এই বুঝি মেয়েটার মৃত্যুর খবর পেলাম। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে জেগে উঠি। আগে তাও মাস অন্তর বাড়িতে আসতো। কিছু দিন বেড়াতো। এখন তাও হয় না।’
‘তুমি নিজেই ওকে আইন নিয়ে পড়তে বললে। ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। এখন ভয় পেলে কি চলবে?’
‘আমি এইক্ষেত্রে বিরাট ভুল করেছি। মেয়েটাকে জেনেশুনে এই চাকরিতে যোগ দিতে দেওয়া ঠিক হয়নি।’
‘তুমি একটু ঠান্ডা হও। হয়তো ওর চাকরি ক্ষেত্রে থেকে ওকে কোন অপারেশনে পাঠানো হয়েছে।’
পলাশ হায়দারের মাঝে উদাস ভঙ্গিটা আবার ফিরে এলো। সামনের ধূ ধূ মাঠের দিকে তাকিয়ে তার মনে হতাশার করুন সুর বেজে উঠলো। স্ত্রীকে বিষয়টা জানাবে না ভেবেছিলো। কিন্তু আর লুকিয়ে রেখে লাভ নেই। তাই কাটা কাটা সুরে বললো,
‘তোমার মেয়ে মাস খানিক আগে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছে।’
‘কি বলছো?’
মিশি বেগম চমকে উঠলেন। বিস্মিত নয়নে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিজের কানে শোনা কথাকে সে বিশ্বাস করতে রাজী নন। পলাশ হায়দার চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করায় সে মুষড়ে পরলো। পলাশ হায়দার নীরবে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন। তখনও মিশি বেগম বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে। পলাশ হায়দার ভীরু পায়ে মেয়ের রুমে ঢুকলেন। মেয়ের এটা সেটা ছুঁয়ে দেখছিলেন। ল্যাম্প শেটের সাথে থাকা ছোট ফ্রেমের ছবিটা হাতে নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন। ছবির দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন,
‘রুহানি মা আমার! কোথায় তুই?’
মেয়েকে কবর দেওয়ার পর থেকে শুভা খানকে কিছু খাওয়ানোই যাচ্ছে না। সারাদিন শুধু কান্না করেন। রুম থেকে বের হোন না। ঠিকমতো গোসল, রান্না কিছুই করেন না। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে মুষড়ে পরেছেন। রায়হান খানের হয়েছে যত জ্বালা। মেয়ে হারিয়েছেন এখন স্ত্রীও হারিয়ে যাওয়ার বন্দবস্ত করছে। মাঝে সে পরে গেছেন মাইনকা চিপায়। বুকের ভেতরটা চিনচিন করে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। দু চোখের পাতা উল্টে আসে। তবুও সে কাঁদতে পারেন না। সে কাঁদলে স্ত্রীকে সামলাবে কে?
‘ফ্লোরার মা, একটু খেয়ে নাও। এভাবে নিজের ক্ষতি করলে কি হবে? তুমি কাঁদলে মেয়ে ফিরে আসবে? যদি ফিরে আসতো তাহলে দুজনে মিলে গলাগলি ধরে কাঁদতাম।’
খাটের ওপর খাবারের প্লেট রাখতে রাখতে বললেন রায়হান খান। শুভা খান তখনও একঘেয়ে সুরে বালিশের ওপর আছড়ে পরে কেঁদে যাচ্ছেন।
বিয়ের তিন বছর পর মেয়েটা হয়েছিলো। প্রথম প্রথম সে যখন কনসিভ করতে পারছিলেন না তখন শাশুড়ী তো বলেই দিয়েছিলেন তার স্বামীকে আরেকটা বিয়ে করাবেন। সে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। রায়হান খান অবশ্য তার পাশে ছিলেন। ডাক্তার, কবিরাজ কোন কিছু বাদ রাখেননি। কত তাহাজ্জুদের নামাজ পরে মোনাজাতে কেঁদেছেন। বান্দার কান্না আল্লাহ সহয করতে পারেন না। তাই তার ঘরে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান দান করলেন। আল্লাহ যখন তার বান্দার ওপর খুশি হোন তখন কন্যা সন্তান দান করেন। এতো সুন্দরী মেয়ে খান বংশে একটাও ছিলো না। দুধে আলতা গায়ের রং, হরিণ টানা চোখ, সরু পাতলা ঠোঁটে রিনরিনে হাসি যে কোন পুরুষের মনে কামুকতার ঝড় তুলতে প্রস্তুত।
একমাত্র মেয়েকে অনেক যত্ন, আদরে লালনপালন করেছে খান দম্পতি। অনেক সাধনার ফল। মেয়েকে বাহিরের কলুষিত দুনিয়া থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর মেয়ে জিদ করলো লন্ডনে পড়াশোনা করবে। খান দম্পতি কিছুতেই রাজী নন। তাদের মেয়ে আরো বেশি জেদী। সে লন্ডনেই পড়াশোনা করবে৷ খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে নিজেকে রুমে বন্দী করে ফেললো। যতক্ষণ পর্যন্ত তার বাবা-মা রাজী না হচ্ছে ততক্ষণ অব্দি সে এক ফোঁটা পানিও মুখে দিবে না। একদিন গেলো, দুই দিন গেলো। তিনদিনের দিন বাবা-মা সহ্য করতে না পেরে অনুমতি দিয়ে দিলেন। জেদী ফ্লোরা খুশিতে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরেছিলো।কিন্তু কে জানতো তার এই জেদ তাকে নিঃশেষ করে দিবে। মাঝে মধ্যে রায়হান খান ভাবেন মেয়েকে লন্ডনে যেতে দিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন। যেতে না দিলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। মেয়েটা তো বেঁচে থাকতো।
চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কতশত পরিমাণ ভারী তা অন্য কেউ জানবে না। ভেতরেটা তার কুঁকড়ে যাচ্ছে তবুও সে স্বাভাবিক। সে যে বাবা, তার তো চিৎকার করে কাঁদার অধিকার নেই। চোখ মুছে স্ত্রীর পিঠে হাত রেখে বললো,
‘আমি না আমাদের আরেক মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। অনেকটা আমাদের ফ্লোরার মতো দেখতে। তুমি চাইলে আমি ওর সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারি।’
কথাটা মিরাকেলের মতো কাজ করলো। বিস্ময় নিয়ে শুভা খান উঠে বসলো। ফোলা চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘তুমি সত্যি বলছো? মেয়েটা অনেকটা আমাদের ফ্লোরার মতো?’
‘হ্যাঁ!’
‘তুমি ওর সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দিবে?’
বাচ্চাদের মতো অনুনয় করলেন শুভা খান। রায়হান খান হাত ধুয়ে ভাতের প্লেট হাতে নিলেন। তরকারি মেখে স্ত্রীর মুখে এক লোকমা তুলে দিতে দিতে বললেন,
‘অবশ্যই দিবো। তবে এর জন্য তোমাকে আগে পুরো প্লেটের খাবার খেতে হবে।’
সারা রুম জুড়ে পায়চারি করছে সে। চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। আজ আট দিন হতে চললো রুহানি ইয়াসফির বাসায় গেছে। সেখান থেকে প্রথম পাঁচ দিন নিয়মিত আপডেট এলেও গত তিনদিন ধরে কোন খবর আসছে না। ইয়াসফি ভীষণ ধূর্ত। রুহানি ধরা পরে গেলে ওকে আস্ত রাখবে না।
মাসুম পা চালিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। ভেতরে ঢুকে দেখলো সে অস্থির চিত্তে সারা রুমে পায়চারি করছে। কার্ণিশে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। তার এই একটা দোষ। কোন উত্তর না পেলে মাথা ভীষণ চুলকায়।
‘রুহের খবর পেলে?’
‘না, ভাই।’
‘মেয়েটার কি কোন বিপদ হলো? কোন খবর না পেলে আমরা যে এখানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো না তা কি ও জানে না?’
তার কন্ঠস্বর হালকা ঝাঁঝালো শুনালো। মাসুম বিব্রত বোধ করলো৷ সে কি উত্তর দিবে? সে নিজেই যেখানে কিছু জানে না।
‘ভাই, একবার কি ঐ বাসায় যাবেন?’
সে চোখ তুলে তাকালো। ঠান্ডা দৃষ্টি। তবে গা কাঁপিয়ে দেয়। কি তেজ, কি উত্তাপ সেই চাহনির। বেশি সময় তাকিয়ে থাকার জো নেই। মাসুম চোখ নামিয়ে ফেললো। সে আরো কিছু সময় এদিক সেদিক পায়চারি করলো। হঠাৎ পায়চারি থামিয়ে গমগমে গলায় বললো,
‘আগামীকাল রাতে একবার ঢুঁ মারতে যাবো৷ তৈরি থেকো। আমি চুপচাপ বসে থাকতে পারবো না। সবার আগে আমার কাছে রুহ ইম্পরট্যান্ট।’
এখন খাবার-দাবার নিয়ে ওমরকে কোন চিন্তা করতে হয় না। যা করার রুবি নামের মেয়েটা করে। ওমর এতে হাফ ছেড়ে বেচেছে। মেয়েদের মতো রান্না নিয়ে চিন্তা করতে তার ভালো লাগে না। মেয়েটা বেশ চটপটে। সব কাজ আগ্রহ নিয়ে করে। বলার সাথে সাথে সব হাজির। ইয়াসফিও মনে মনে খুশি। আগ্রহ নিয়ে নির্ভূল কাজ করলে কে না পছন্দ করবে! তবে একটা সমস্যা। আঞ্চলিক ভাষায় টেনে টেনে কথা বলে। যদিও তাকে বেশ কয়েকবার কড়া করে নিষেধ করা হয়েছে এভাবে কথা না বলতে। সে মানতে নারাজ। সে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলবে। তাই ইয়াসফি, ওমর দুজনেই হাল ছেড়ে দিয়েছে।
‘টেবিলে খাওন দিছি। মন্ত্রী সাব রে ডাইকা আনেন।’
ওমরের ঘোর ভাঙলো রুবির কথায়। মেয়েটা লাজুক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি লজ্জা পায় সে। ওমর বিষয়টা বেশ উপভোগ করে। মনে মনে তো এমন একটা বউয়ের কল্পনা করে সে। যে সবসময়েই লাজুক মুখ নিয়ে তার আশেপাশে ঘুরে বেড়াবে। মেয়েটাকে ওমরের মনে ধরেছে প্রথম দিন দেখার পর থেকে। কি সুন্দর চাহনী! বুকের ভেতরটাকে ঝড় তুলে দেয়। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে একদমে কথা বলার ভঙ্গি দারুণ। দীঘল কালো চুলগুলো নজরকাড়া। মাঝে মধ্যে লাজ শরম ভুলে ওমর তাকিয়ে থাকে। রুবি চোখের সামনে তুড়ি বাজালে তার ঘোর ভাঙে। এই যে এখন যেমন লাজলজ্জা ভুলে এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। রুবি চোখের সামনে হাত নাড়াতেই তার ধ্যান ভাঙলো। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো ওমর।
‘এমতে চাইয়া কি দেখেন?’
ইতস্তত করে বললো,
‘কি কিছু না। তুমি টেবিলে খাবার দাও। আমি ইয়াসফি ভাইকে ডেকে আনি।’
ওমর এক প্রকার পালিয়ে গেলো সেখান থেকে। রুবি ওরফে রুহানি কিট কিটিয়ে হেসে উঠলো। মুখটা পানসে করে বিরবির করে বললো,
‘শালা!’
এরপর লম্বা চুলগুলো খোঁপা করতে করতে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলো।
রাতে খাবারের সময় কেউ তেমন কথা বললো না। ইয়াসফি ওমরের সাথে নিচুস্বরে দু-চারটা রাজনৈতিক আলাপ করলো। তারপর সব চুপচাপ। রুবি ওরফে রুহানি এঁটো বাসনপত্র ধুয়ে, নিজে খেয়ে বাকি খাবার ফ্রীজে রেখে দিলো। সবকিছু গুছিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। অপেক্ষা করতে লাগলো রাত গভীর হওয়ার জন্য। আজ তার একটা ছোট অপারেশন আছে ইয়াসফির রুমে।
গভীর রাত। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। রাতের আঁধার কমে জোস্নার আলো উঁকি ঝুঁকি মারছে। আলো আঁধার লুকোচুরি খেলছে। নিজের ব্যাগ থেকে রিভলভারটা নিয়ে পা টিপে টিপে ইয়াসফির রুমের দিকে এগুচ্ছে রুহানি। চোখে তার সাবধানি দৃষ্টি। নিঃশব্দে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। বিছানার দিকে রিভলবার তাক করে এগিয়ে গেলো। একি! বিছানা খালি কেনো? তখুনি রুমের আলো জ্বলে উঠলো। রুহানির মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে ইয়াসফি বলে উঠলো,
‘কি খবর মিসেস মাহবুব?’
রুহানি পাল্টা নিজের হাতের রিভলবার ইয়াসফির দিকে তাক করে উত্তর দিলো,
‘আমার খবর তো ভালো, আপনার কি খবর মিস্টার মাহ…..
#চলবে