কৃষ্ণডাহুক পর্ব-২৯+৩০

0
360

#কৃষ্ণডাহুক – ২৯
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

ক্লান্ত দেহ নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে অরিন। বাহিরে শো শো বাতাস তার দেহ ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে নিজ গতিতে। ঘর্মাক্ত দেহ ধীরে ধীরে হালকা হালকা ঠান্ডা হচ্ছে। শরীর শুকিয়ে কাঠির ন্যায় হয়ে গিয়েছে, গায়ের রঙ চাপা হয়ে গিয়েছে, আগের তুলনায় পরিবর্তন যেনো কয়েক’শ! দূর্বল শরীর নিয়ে হেলেদুলে হাঁটছে। রিকশার আশায়,পাচ্ছে না। বাড়ি ভাড়া করে থাকে এখানেই, দশ মিনিটে রাস্তা। সচারাচর হেঁটেই যায় কিন্তু আজ যেনো শরীরে তার কূলাচ্ছে না! আচমকা এক দমকা বাতাস এসে চুল ছুঁলো, চুলগুলো মূহুর্তেই কপালের সামনে এসে পড়লো, চুল সরাতে বাম দিয়ে দিলো অরিন, বাম হাতে সেলাই করা কাটা দাগ স্পষ্ট ভেসে উঠছে।

কোনোরকম হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছালো অরিন। বাড়ির সামনে বিশাল ট্রাক দেখতে পেয়ে ভ্রুকুঁচকালো, আগ্রহ দেখালো না। বাড়ির গেটের সামনে যেয়ে প্রবেশ করতে নিলেই এক সুঠাম দেহী পুরুষ বেরিয়ে এলো গেট থেকে। অরিন মাথা নত করে সরে দাঁড়ালো, ছেলেটি দরজা থেকে বের হলো, অরিনকে বলল,’ আপনি কি এই বাড়িতে থাকেন? ‘

অরিন মিহি স্বরে বলল,’ জ্বী। ‘

‘ কত তলায় থাকেন? ‘

‘ তিন তলায়। ‘

ছেলেটি চমৎকার হেসে বলল,’ ওহ! আমিও তিন তলাতেই থাকছি। আপনি মিস অর মিসেস? ‘

‘ আমার নাম অরিন, আমি এখনো আনম্যারিড সেহেতু মিসই। ‘
সৌজন্যতার খাতিরে একটুখানি জোরপূর্বক হেসে জবাব দিলো অরিন। লোকটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল,’ ওহ, আমার নাম অনয়। ‘

_

হলুদের পাট চুকিয়ে যে যার ঘরে এসে পড়েছে, মীরা ও আদ্রিকও সবে ঘরে এলো। ঘরে আসতেই আদ্রিক বলল,’ তুমি শুয়ে পড়ো। ‘

‘ একটু পরে। ‘

আদ্রিক তাড়াহুড়া দেখিয়ে বলল,’ একটু পরে কেনো? ফ্রেশ হয়ে এখনি শুয়ে পড়ো! কয়েকদিন ধরে না তোমারও শরীর ভালো যাচ্ছে না? ‘

‘ তা যাচ্ছে না, কিন্তু সবকিছু গোছগাছ তো করা লাগবে? ‘

‘ কাল সকালে উঠে করো, তখন অহরহ সময় পাবে। এখন ফ্রেশ হয়ে ঘুমাও। ‘

মীরা ব্যাগ থেকে জামা বের করতে করতে আড়চোখে আদ্রিকের দিকে তাকালো, আদ্রিক জোরপূর্বক হাসলো তা দেখে।

মীরা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখে আদ্রিক বিছানায় বসে আছে, তাকে দেখেই আদ্রিক বলল,’ ঘুমাও। ‘

মীরা কোনো কিছু না বলে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ার ভাণ করলো। মীরা ঘুমিয়ে গেছে ভেবে আদ্রিক ঘর থেকে সাথে সাথে বের হলো। আদ্রিকের যেতেই আড়মোড়া হয়ে মীরা চোখ খুললো। ঘরে আদ্রিককে না পেয়ে নিজেও উঠে বাহিরে এলো মীরা। আদ্রিক তখন কোথাও যাচ্ছিলো, মীরাও আদ্রিকের পিছন পিছন যেতে লাগলো, আচমকা আদ্রিক থেমে গেলো, মীরা লক্ষ্য করলো আদ্রিক সাহিল হুমায়ূনের ঘরে ঢুকেছে কিন্তু মীরা বুঝলো না কেনো ঢুকেছে? উলটো পায়ে মীরা হাঁটা ধরলো নিজের ঘরে, কারো ঘরে আড়িপাতের স্বভাব নেই তার! হয়তো আদ্রিকেরই কোনো কাজ আছে!

_

কলিংবেলের শব্দে চোখ কচলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো অরিন। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এসেছে। দরজা খুলে গতকালের সেই লোককে দেখে বিরক্ত হলো! কি যেনো নাম হ্যাঁ! অনয়! অনয় অরিনকে দেখেই মুচকি হেসে বলল,’ ঘুমাচ্ছিলেন? ডিস্টার্ব করলাম না তো? ‘

অরিন জোরপূর্বক হেসে বলে,’ না করেননি, হঠাৎ এইখানে? ‘

‘ আজ শুক্রবার তো, নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছিলেন এতক্ষন? ‘

‘ হ্যাঁ, ঘুমাচ্ছিলাম। ‘

‘ ওহ তাহলে তো ডিস্টার্ব করলামই, মিথ্যা বললেন কেনো? ‘

অরিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’ আপনি ভেতরে আসুন, বাকি কথা কি এখানে দাঁড়িয়েই করবেন? ‘

অনয় জুতা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো। দু রুম বিশিষ্ট ফ্ল্যাট, পরিপাটি, সুন্দর করে আশপাশ সাজিয়ে রেখেছে অরিন। অনয় মুগ্ধ দৃষ্টি ঘর দেখে বলল,’ আপনি কি এইখানে একা থাকেন? মানে আপনার মা-বাবা কোথায়?তারা কি অন্য জায়গায়? ‘

অরিন শান্ত স্বরে বলল,’ আমার মা-বাবা নেই! ‘

‘ ওহ, সরি। ‘
মাথা চুলকে বলল অনয়। অরিন প্রতুত্তরে কিছু বলল না,অনয়কে আবারো বলল,’ আপনি কিছু খাবেন? চা,কফি? ‘

‘ জ্বী, কফি। একচুয়ালি আমি কফি চাইতেই এসেছিলাম। নতুন উঠেছি তো এখনো এতো জিনিস অযথা কিনিনি, গতকাল ভেবেছিলাম বের হবো পরে আর বের হওয়া হয়নি। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো কফি ছাড়া চলবে না, নিচে যেতেও মন চাচ্ছিলো না তাই ভাবলাম প্রতিবেশী থাকতে নিচে যাওয়া লাগে না? ‘

‘ জ্বী, জ্বী! আপনি বসুন আমি কফি আনছি এখনি। ‘

‘ আপনি যদি বানিয়ে আনেন বেটার হয়, নিজের হাতেরটা খেতে খেতে আমি বোরিং ফিল করছিস, নতুন হাতের স্বাদ পেলে মন্দ হয় না। ‘

অরিন একটু হেসে, রান্নাঘরে গেলো কফি বানাতে। সাত সকালে উঠে কাজ করতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু না পেরেও উপায় নেই! লোকটি সোজাসুজিই বলেছে তার হাতের কফি খেতে চায়না, মুখের উপর না করলে অভদ্রতা দেখায় বিধায় বাধ্য হয়েই এসেছে নয়তো কফির প্যাকেট ধরিয়ে বিদায় করতো।

#চলবে?

#কৃষ্ণডাহুক – ৩০
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)

বাংলাদেশে আসার একমাস হয়ে গিয়েছে। সবকিছুই স্বাভাবিক ভাবে কাটছে, যদিও মীরার কাছে কেউ তেমন মিশে না, সুযোগ পেলেও কথা শোনাতে ছাড়েনা কিন্তু মার্জিয়া বেগম বাঁচায় তাকে, হয়তো তিনি মেনে নিয়েছেন এই সম্পর্ক! না মেনে নিয়েই বা উপায় কি? সবাই থাকা সত্ত্বেও চব্বিশ ঘন্টাই মীরা সেবাযত্ন করে উনাকে সুস্থ করে তুলছে অথচ তার নিজের শরীরই একমাস যাবত ঠিক যাচ্ছে না।

আদ্রিক একদিন মীরাকে বলেই দিয়েছিলো,’ মীরা, তোমার শরীরও তো খারাপ, এতো কাজ করো না, আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে তুমি। মার সেবা করার জন্য আমি তো আছিই, বাড়ির কাজে সাহায্য করার জন্য সাহিদুন খালাও আছে। ‘

মীরা জবাব দেয়নি আদ্রিকের কথায়। আদিলও তাই বলেছিলো তাকে, মীরা তার কথাও শোনেনি, অবাক বিষয় ধীরে ধীরে আদিলও তাকে মেনে নিতে শুরু করেছে, গম্ভির ভাবে কথা বললেও কথাগুলো থাকে কোমল।

মীরা রান্না করেছে নিজ হাতে সবার জন্য। একমাসে হয়তো প্রথমবারই এই বাড়িতে নিজ হাতে রান্না করেছে। অনেকবারই চেয়েছিলো নিজে রান্না করতে, সুযোগ হয়নি রান্না করার, সেই ইচ্ছা আজ পূরণ করলো আজকে।

_

গোসল শেষে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো মীরা। মাথা আচমকাই ঘুরিয়ে উঠলো, নতুন না এ! গতকাল থেকেই হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে উঠছে তার। এর কারণ হিসেবে সে ভেবে নিয়েছে ইদানিং তেমন একটা না খাওয়ায় দূর্বলতা এসে শরীরে ভর করেছে তার জন্যই মাথা ঘুরাচ্ছে। এই ভাবতে ভাবতেই মীরার মাথা আবারো ঘুরালো, চোখের সামনেই সবকিছু অন্ধকার দেখতে লাগলো, মনে হতে লাগলো আজই পৃথিবীর শেষ দিন।

সাহিদুন তখন সেই ঘর হয়ে যাচ্ছিলো, দরজা ভিড়িয়ে থাকায় হালকা উঁকি মারতেই মীরাকে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো,’ হায় হায়! মীরা ভাবীয়ে মই-রা গেছে! খালা,খালু সবাই কই? আদ্রিক ভাই! ‘

_

অনয়ের বিরক্ত করা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে। অরিন অনয়ের কাজকর্মে বিরক্ত! বলা নেই কওয়া নেই অনয় হুটহাট তার বাড়ির সামনে আসে, আবার হুটহাট তার জন্য খাবার নিয়ে আসে, আবার হুট করেই তাকে উপহার দেয় যেমন চুড়ি, পায়েল ইত্যাদি। বিরক্ত হয়ে প্রথমে না করলেও অনয় জোর করে ধরিয়ে দেয় সৌজন্যতার খাতিরে ভদ্র ব্যবহার করতেই হয়! নয়তো আচ্ছা মতো কথা শুনিয়ে ফেরত দিতো! বিরক্ত হলেও কেনো যেনো মনের মাঝে প্রশান্তি আসে। মাঝে মাঝে অনয় বিরক্ত না করলেও কেন যেনো মন ছটফট করে, মন উতলা হয়ে আসে। এমন হওয়ার কারণ অরিন জানে! আদ্রিকের প্রেম যেদিন থেকে পড়লো সেদিন থেকেই যেনো তার মন ছটফট করতো! বন্ধু ছিলো আদ্রিক সেহেতু আদ্রিকের সাথেই সবসময় চলাফেরা করতে হতো! আদ্রিকের প্রতিটি পদক্ষেপও যেনো তার হৃদয়ের গতি বাড়িয়ে দিতো! প্রথম প্রেম ছিলো বলে! কিন্তু অনয়ের ক্ষেত্রে এমন হয় কেনো? সে কি তবে অনয়ের প্রেমে পড়েছে? নাহ! এমনটা হবে কেনো? অনয় হয়তো প্রতিবেশী বলে এমন করে তারও এইগুলো সেই হিসেবেই নেওয়া উচিত! এইসব দুষ্টুমি, বাঁদরামি গুলো অন্যভাবে নিলে দিনশেষে সেই কষ্ট পাবে আর চায়না সে কষ্ট পেতে।

‘ অরিন, আজ আমার সাথে ঘুরতে যাবে? ‘

অনয়ের কথায় অরিনের ধ্যান ভাঙ্গে। একটু আগেই অনয় এসেছে তার ফ্ল্যাটে! ছেলেটা বলা নেই কওয়া নেই চলে আসে হুটহাট! জিজ্ঞেস করলে বলে তার মর্জি কিনা! অরিন অনয়কে জিজ্ঞেস করলো,’ কেনো,যাবো?’

‘ আরে জানোই ত! আমি এখানে নতুন, চিনিও না কিছু তাই চাচ্ছিলাম তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। ‘

‘ তো আপনি আপনার কোনো বন্ধু, বান্ধুবি বা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে যান, প্রতিবেশীকে কেনো? ‘

অনয় মনমরা হয়ে বলে,’ আমার কোনো বন্ধু নেই, না আছে বান্ধুবি আর না আছে গা র্ল ফ্রে ন্ড! তাই তো চাচ্ছি প্রতিবেশী সুন্দর মেয়েটিকে নিতে। ‘

‘ গা র্ল ফ্রে ন্ড ‘ শব্দটা টেনে বলায় খিলখিল করে হেসে উঠলো অরিন। অনয় মুগ্ধ, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই হাসির দিকে! হাসিটা তার ভীষণ পছন্দের! অথচ মেয়েটা হাসতেই জানে না যেনো! মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে অনয়ের যখন অরিন তার প্রতি বিরক্ত হয়! আচ্ছা একমাসে কি মেয়েটার মনে তার প্রতি কোনো অনুভূতি হয়নি? মেয়েরা নাকি এইসব উপহার অনেক পছন্দ করে, হুটহাট বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, খাওয়ানো এইগুলাই মেয়েদেফ পছন্দের শীর্ষে! আর যারা এগুলা দেয় তাদেরও নাকি মেয়েরা পছন্দ করে! তাহলে কেনো অরিন করে না? নাকি অরিন অন্য মেয়েদের মতো না? অরিনের কি কোনো অতীত আছে? যার জন্য সে ছেলেদের সাথে মিশেও না তেমন, আবার কথাও বলে না! থাকতেই পারে! সে তো অরিনকে ভালোবাসে! তো অরিনের অতীত দিয়ে তার কিছু আশে যায়না! সে অরিনকে বর্তমানে, ভবিষ্যতে ভালোবাসবে! অতীতে ভালোবাসার সাধ্য থাকলে অতীতেও ভালোবাসতো!

‘ গেলে মন্দ হয়না! আমারও কোনো বন্ধু নেই। আপনার সাথে গেলে বন্ধুর কমতিটাও পূরণ হবে অবশ্য। ‘

‘ আমাকে তুমি বন্ধু মানো? ‘

অরিন গম্ভির মুখে বলল,’ নাহ! বন্ধুর মতো বলেছি। ‘

অনয় গোমড়া মুখে বলল,’ ওহ। সমস্যা নেই, বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু হবো। ‘
বলেই ঠোঁট টেনে হাসলো অনয়, অরিন জবাব দিবে তখন অনয় বলল,’ আচ্ছা! আর কিছু বলো তার আগেই বলে নেই আমি! আজ কিন্তু তুমি শাড়ি পড়বে, নীল রঙের আর আমি পড়বো নীল পাঞ্জাবি! তারপর দাঁড়িয়ে থাকবো এক গুচ্ছ কদম হাতে নিয়ে। ‘

অরিন হচকিয়ে গেলো অনয়ের কথায়, অনয় এক গাল হেসে বলল,’ তুমি আমাকে বন্ধু না মানলেও আমি তোমাকে বান্ধুবি মানি, বান্ধুবির সাথে মিলিয়ে পোশাক পড়াই যায়! ‘

জবাবে অরিন জোরপূর্বক একটুখানি হাসলো।

_

হুমায়ূন মঞ্জিলে সবাই স্তব্ধ হয়ে আদ্রিকের রুমের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে মার্জিয়া বেগমও দাঁড়িয়েছেন, সামনে ডাক্তার আর আদ্রিক চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে। ডাক্তার তখন হাসি হাসি মুখে বললেন,

#চলবে?