#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-২৪
“মারে, এতদিন যেমন মনে হয়েছে তোর সাথে তেমন ব্যবহার করেছি। কিন্তু এখন থেকে আর না। বরং তুই যেমন বলবি তেমনভাবে চলবো আমরা। তোর উপর অবিশ্বাস করেছিলাম এখন বিশ্বাসের ভার তোর কাঁধে ছেড়ে দিলাম। এখন তোর ইচ্ছাই আমাদের ইচ্ছা।”
আজমল শেখ শোভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কথাগুলো বললো। শোভা মুচকি হাসলো-“সত্যি বলছো তো বাবা? আমি যেমন বলবো তেমন হবে সবকিছু?”
আজমল শেখ মাথা নাড়লো। শোভা গম্ভীর হলো-“তাহলে আমাকে আর বিয়ে নিয়ে জোরাজোরি করবেনা। আমি পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করতে চাই। বিয়ে তো করতেই হবে তবে এখন না। আগে নিজের পায়ে দাঁড়াই তারপর। ঠিক আছে?”
আজমল শেখ চেহারার হাসি মুছে গেলো। বিয়ের কথা কিছু মলিন স্মৃতি মনে এলো। গোলাম রসুলের বউ সেদিন বড্ড কষ্ট দিয়ে কথা বলেছে। এতোটা অপমানিত এর আগে বোধ হয়নি। গোলাম রসুলের কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করেনি সে। বড্ড আশা করে তার কাছে নিজের মেয়েকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেও দুনিয়ায় বাকী মানুষের মতো করলো। মনের হাল মেয়েকে বুঝতে দিতে চাইলো না বলে মুখে হাসি ফুটিয়ে নিল আজমল শেখ-“ঠিক আছে। এখন বিয়ে না করলে না করবি। কিছু বলবো না আমি। তবে রেজাল্ট কিন্তু ভালো হওয়া চাই।”
“সেটা কি আর বলতে হবে? এতদিনে বোঝনি?”
আজমল শেখের চোখে স্নেহের ছায়া-“খুব বুঝি। তুই তো আমার লক্ষী মা। কিছু বলতে হয় না আগেই বুঝে যাস।”
সাজেদা ডাকলো-“বাবা মেয়ের পুনরমিলনী শেষ হলে খেতে এসো। খিচুড়ি করেছি আজ। খিদেয় পেট জ্বলছে আমার।”
আজমল শেখ হাসলেন-“শুনলি তোর মায়ের কথা? শুরু হয়ে গেছে হিংসে।”
“মা ভুল কি বলেছে বাবা? আমাদের তো তুমি ভালো বাসো না। এই যে না খেয়ে বসে আছি বলছোনা যে তোরা খেয়ে নে।”
বিভা ঠোঁট ফুলায়। শোভা হেসে দিলো-“আচ্ছা হয়েছে খেয়ে নে আর অভিমান করতে হবে না।”
“এই আপা, একটা কথা বলি?”
বিভা উত্তেজিত কন্ঠে অনুমতি চাইলো।
“হ্যা বল।”
“তোমার ভিডিওতে যে ছেলেটা ছিলো ওকে চেন তো?”
“কোন ছেলেটা?”
“ওই যে মার খেলো যে?”
“না চিনি না। কেন বলতো?”
“সত্যি চেন না? দুলাভাই দেখায়নি?”
“দুলাভাই! কিসের দুলাভাই?”
“কি বলছিস বিভা পরিস্কার করে বল। এতো রহস্য করছিস কেন?”
আজমল শেখ মেয়েকে ধমক দিলেন। বিভা অবশ্য বাবার ধমকে দমে গেল না।
“বাবা, তুমিও চেননি? গোলাম রসুল চাচার ছোট ছেলে ওটা৷ তোড়ার মোবাইলে ছবি দেখেছিলাম আমি।”
আজমল শেখের খাওয়া থেমে গেল। চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলেন-“সত্যি বলছিস?”
বিভা কাঁধ ঝাঁকাল-“মিথ্যে বলবো কেন। ভালোমতো ভিডিও দেখ তুমিও চিনবে।”
“তারমানে গোলাম রসুলের ছেলের সাথে আদৃতার সম্পর্ক? ওরা নিশ্চয়ই জানতো না। কি ধুরন্ধর মেয়ে রে বাবা? যে পাতে খায় সেই পাতে হাগে? ছিহ।”
সাজেদা নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারে না।
শোভার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে। বিভা যা বলছে তা কি সত্যি? ছেলেটা রিফাতের ভাই? সত্যি হলে বিষয়টা মোটেও ভালো হয় নি। ছেলেটাকে ভাইরাল করা ওর উদ্দেশ্য ছিল না। আদৃতার সাথে সাথে ছেলেটাও তো ভাইরাল হলো। এমনটা ঠিক হয়নি মোটেও। ওর উচিত ছিল ভিডিওতে আদৃতা বাদে বাকি সবাইকে ব্লার করে দেওয়া। এখন ব্যাপারটা এমন হলো যে, আদৃতা ওর ক্ষতি করেছিল তাই ও আদৃতার চাচাতো ভাইয়ের ক্ষতি করলো। ধ্যাৎ, এটা কি হয়ে গেলো? অপরাধবোধে মন আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। রিফাত নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ভালো ভাবে নেবে না? এমনকি বাবার বন্ধুও মাইন্ড করতে পারে। ধ্যাৎ, কেন যে একটা ঠিক করতে যেয়ে আরেকটা দিকে ঘেঁটে যায়। শোভা আর খেতে পারে না। ওর খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবে, ওকে কি চিনতে পেরেছিল ছেলেটা? এইজন্যই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেনি?
★★★
“ইচ্ছে করেই এমন করেছ তাই না? ইচ্ছে করে আমার ভাইয়ের ভিডিও করেছ। তোমার অপমানের প্রতিশোধ এমন করে না নিলেও পারতে।”
ম্যাসেজ দেখে থমকে গেল শোভা। শোভা ফোন ধরে না বলে রিফাত ফোন করা বাদ দিয়েছে আগেই। আজ ম্যাসেজ দেখে নিজ থেকেই ফোন দিলো। রিফাতকে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা দরকার।
“হ্যালো।”
“কি বলতে চাও? ফোন দিলে ধরো না আজ হঠাৎ এতো উদার হওয়ার কারণ কি?”
রিফাতের কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান শোভা ইগনোর করে-“আপনার সাথে কথা আছে। আসতে পারবেন?”
“আমি গেটে আছি তুমি এসো আধাঘন্টার মধ্যে।”
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিলো রিফাত। বোকা হয়ে বসে রইলো শোভা। এই ছেলে ভার্সিটির গেটে দাড়িয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে? সে জানতো এমন ম্যাসেজ দেখলে শোভা ফোন করবে? আশ্চর্য! মেজাজ খারাপ করতে যেয়েও হেসে দিলো। আজব পাগল ছেলে তো?
শোভা আসার পর কোন কথা না বলে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল রিফাত। শোভা চুপচাপ বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করে। শোভা জানতে চাইলো তারা কোথায় যাচ্ছে কিন্তু রিফাত উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ পর পর মিররভিউয়ে শোভাকে দেখছে আড়চোখে। অনেকদিন পরে দেখা। যেন চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। শোভা অনেকটা শুকিয়ে গেছে কিন্তু তাতে যেন ওর শ্যামা মুখের সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে গেছে। রিফাতের গাড়ি থামিয়ে শোভার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মেয়েটা এখনও পর্যন্ত ওর দিকে তাকায়নি। রিফাত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নজর ফিরিয়ে নেয়।
ঘন্টাখানেক পর সেই প্রথম দিনের জায়গায় এসে থামলো। রিফাত এবারও কোন কথা না বলে গাড়ি থেকে নেমে শোভার দিকের দরজা মেলে ধরে। শোভা নিঃশব্দে নেমে এলো। নদীর পাড়ে বাঁধানো বেদীতে বসে রিফাত শোভার দিকে ফিরে জানতে চাইলো-“বলো কি বলবে। কি কৈফিয়ত দেবে।”
“ছেলেটা যে আপনার ভাই তা জানতাম না আমি। বিভা বলার পর জানতে পারি।”
“গালিব তো তোমাকে ঠিকই চিনেছে। তুমি নাকি ওকে ম্যাসেজ করেছিলে আদৃতার ব্যাপারে?”
শোভার এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কাজ করেছে এখন ফল তো ভোগ করতেই হবে।
“আপনার ভাইয়ের সাথে আদৃতার সম্পর্ক এটা তো আমি ভাবতেও পারিনি। তার উপর তাকে আমি কোনদিন দেখিনি। চেনার কোন উপায় আছে? আর আমি ইচ্ছে করে কেন এমন করবো? আপনি তো আমাকে চেনেন। জানেন আমি কেমন।”
রিফাত হঠাৎ রেগে গেল-“না আমি তোমাকে চিনি না। জানার তো প্রশ্নই ওঠে না। তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে কয়দিন? কথাই বা ক’দিন বলেছ? তুমি কি করতে পারো কি করতে পারো না সেসব কি করে জানবো আমি?”
শোভা স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো। বোঝা যাচ্ছে রিফাত তার এতোদিনের কথা না বলার রাগ ঝাড়ছে। তবুও ভীষণ খারাপ লাগলো শোভার। সে মুখচোখ কাচুমাচু করে বসে রইলো। শোভার দিকে তাকিয়ে রিফাত বুঝলো ভুল করে ফেলেছে। এতোটা কড়া কথা বলা উচিত হয়নি তার। সে কন্ঠস্বর খানিকটা নরম করে বললো-
“কিছু বলতে চাইনি তোমাকে কিন্তু বলতে বাধ্য করলে। আমার সাথে যোগাযোগ রাখলে দু’জন মিলে বেটার প্ল্যান করে জিনিসটার সমাধান করতে পারতাম। আমাদের পরিবারের মান সন্মান নিয়ে টানাহেঁচড়া হতো না। কিন্তু তুমি তো আমার সাথে কথাই বলো না। নিজেকে সর্বজ্ঞানী মনে করেছ। গালিবটা না বুঝে তোমার ফাঁদে পড়ে গেছে।”
শোভা কাতর গলায় বললো-“এভাবে বলছেন কেন? আমি সত্যিই জানতাম না। জানতে তার মুখটা ব্লার করে দিতাম।”
“অনেক বড় উপকার করতে।”
“সরি। প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না।”
“তোমাকে ঠিকও বুঝতে পারছি না। বাবা মা গেছিল তোমাদের বাসায়। আঙ্কেলের কাছে মাফ চেয়েছে মা। কিন্তু আঙ্কেল তবুও পুনরায় বিয়ের ব্যাপারে রাজি না। মানা করে দিয়েছে। বলেছে তুমি নাকি এখন আর বিয়ে করতে চাও না। তার হাতে আর কিছু নেই। একমাত্র তুমি রাজি হলেই বিয়েটা সম্ভব। তার মানে কি দাঁড়ায়? তুমি সত্যি সত্যি আমাদের বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছ। কেন?”
রিফাতের কন্ঠে পূনরায় কঠোরতা ফিরে এলো। শোভা মাথা নাড়ে-“আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম। বিয়েটা কেবলমাত্র বাবার করতে চেয়েছি।”
“মা তার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছে মেঘা তবুও কেন জেদ আঁকড়ে ধরে আছো? আমার প্রতি কি একটুও অনুভূতি জন্মেনি তোমার মনে? এতোটা নিষ্ঠুর হচ্ছ কি করে?”
শোভা অসহায় চোখে রিফাতকে দেখলো-“আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। কিন্তু আমি সত্যি এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাই না। আগে পড়ালেখা শেষ করবো চাকরি করবো তারপর বিয়ের কথা ভাববো।”
“আর ইউ ক্রেজি মেঘা? সব তো মিটমাট হয়ে গেছে এখন কেন এসব বলছো? আর বিয়ে করে কি ক্যারিয়ার করা যায় না? আমি কি বাঁধা দেব তোমায়?”
“আপনি বলুন এতো কিছু হওয়ার পর কি আমাদের বিয়েটা হওয়া উচিত? সুখে থাকতে পারবো আমরা? আমার মনেহয় না পারবো।”
শোভা অনড়ভাবে বললো।
“তুমি এতো শিওর হচ্ছ কি করে? আমাকে দেখে খারাপ মানুষ মনেহয় তোমার?”
শোভা জবাব দিলো না। রিফাতের অস্থির লাগে। মেয়েটা কেন বুঝতে পারছে না তাকে? ওর মধ্যে কি কোন অনুভুতি কাজ করছে না? সে পা নাচাতে থাকে, অস্থির পায়চারি করে। শেষমেষ পরাজিত মানুষের মতো শোভার পাশে এসে বসলো-“আচ্ছা, ঠিক আছে। মেনে নিলাম তোমার কথা। বিয়ে করতে হবে না এখন। তবে একটা শর্ত আছে। আগামীকাল থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহ প্রতিদিন আমার সাথে বেরুবে তুমি। দু’ঘন্টা বসে থাকবে আমার সাথে। কথা বলা না বলা তোমার ইচ্ছা বাট বসে থাকবে। রাজি আছো?”
শোভা অসহায় চোখে তাকায়-“আগামীকাল থেকে আমার এক্সাম। কিভাবে সম্ভব?”
“তাহলে এক্সামের পরে।”
“এক্সাম শেষ হলে বাবা বলেছে বাড়ি যাবে।”
“দেন এক্সামের মধ্যেই। কোন অজুহাত শুনতে চাইছি না। দু’টো সপ্তাহ বিরক্ত করবো। এরপরও যদি তোমার মনেহয় এখন বিয়ে করা যাবে না দেন আমি তোমার জীবন থেকে বিদায় হবো। ঠিক আছে?”
কিছুসময় চুপচাপ বসে ভাবলো শোভা। তারপর বলবো-“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি রাজি।”
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-২৫
শোভাকে বই খুলে বসতে দেখে রিফাতের ভ্রু কুঁচকে গেল। শোভা দাঁত বের করে হাসলো-“আপনি বলেছেন চুপ থাকলেও সমস্যা নেই। ভাবলাম চুপ থেকে সময় নষ্ট না করে পড়ি। কাজে লাগবে।”
রিফাত জবাব দিলো না। মন দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো। শোভা আবার বললো-“তাছাড়া বই আনা যাবে না এমন কোন শর্ত আপনি দেননি।”
“আমি তোমাকে কিছু বলেছি? পড়ছো পড়ো। এতো কথা বললে তো মনোযোগ নষ্ট হবে।”
শোভা চুপ করে গেল। মনে মনে রিফাতকে উদ্দশ্য করে ভেংচি কাটলো কয়েকবার। কি দরকার ছিলো পরিক্ষার মধ্যে ঢং করার? এভাবে কি পড়া যাবে? শুধু শুধু তার সময়গুলো নষ্ট করা। শোভা বলেই ফেলে-“শুনুন, এভাবে হবে না আসলে। পরীক্ষার মধ্যে এক এক সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে দু’ঘন্টা নষ্ট করার কোন মানে নেই। মাফ করুন আমাকে। পরীক্ষা শেষ না হওয়া অবধি আমি আর বেরুব না।”
রিফাত একবার তাকিয়ে শোভাকে একনজর দেখে নিলো। বেশ শান্ত গলায় বললো-“তুমি কোন কথা মনেহয় ভেবে বলো না তাই না? মনে চাইলো আর বলে দিলে। এর কনসিকোয়েন্স কি হবে সেটাও ভাবো না। পরীক্ষার মধ্যে বেরুলে পড়ার ক্ষতি হবে সেটা আগেই ভাবা উচিত ছিলো তোমার। এখন বলছো কেন?”
শোভা মুখ কাচুমাচু করলো-“তখন বুঝিনি।”
রিফাত সামনের দিকে চোখ নিবন্ধিত রেখে বললো-“এখনো বুঝছো না। আজই তো প্রথম বেরুলে তাহলে বুঝলে কিভাবে সময় নষ্ট হবে কি হবে না? তুমি ভাবছো এই দু’ঘন্টা সময় নষ্ট হবে। আসলে হবে না। আজ পরীক্ষা দিলে। পরীক্ষার পর ব্রেনটা ফাঁকা থাকে। পড়তে বসলেই যে পড়া হবে তা না। এই যে বাইরে এসেছ, ঘুরছো, সবুজ গাছপালা দেখছো এতে তোমার ব্রেনটা ফ্রেশ হচ্ছে নতুন কিছু ধারণ করার জন্য। ফিরে গিয়ে যখন পড়তে বসবে তখন দেখবে পড়াটা চট করে মাথায় ঢুকে যাচ্ছে। বিশ্বাস না হলে আজ টেস্ট করে দেখো।”
শোভা অনিচ্ছায় হাসলো-‘”আপনি বুঝি এমন করতেন?”
রিফাত অবশ্য হাসলোনা-“আমি যা করতাম তা কখনোই তোমার পছন্দ হবে না। তাছাড়া আমি কি করতাম তা কে জানতে চায়। বাদ দাও।”
শোভা বাদ দিলো। বইতে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। সত্যি বলতে পারলোনা। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে আছে। পড়া মাথায় ঢুকছে না। বিরক্ত লাগছিল বলে সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বাইরেটা দেখলো তারপর বই বন্ধ করে চোখ বুজলো। রিফাত ওকে দেখে মুচকি হাসলো কেবল।
যখন চোখ খুললো দেখলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। পাশে তাকিয়ে রিফাতকে ড্রাইভিং সিটে না দেখে ভয় পেয়ে গেলো শোভা। ওকে একা ফেলে কোথায় গেলে ছেলেটা? পালিয়ে টালিয়ে যায়নি তো? ভাবনার রেলগাড়ী বেশিদূর যেতে পারলোনা। তার আগেই গাড়ির জানালায় ঠকঠক। তাকিয়ে দেখলো রিফাত। সে শোভাকে গাড়ি থেকে নেমে আসতে ইশারা দিলো।
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে ডাকিনি। দেরি হয়ে যাবে বলে আমি এসে আগে খাবার অর্ডার করে দিয়েছি। এসো খেয়ে নেই তারপর তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি ফিরবো।”
শোভা চুপচাপ রিফাতের পিছু পিছু এগুলো। টেবিলে নিজের পছন্দের চাওমিন দেখে খুশি হয়ে খেতে শুরু করে দিলো। রিফাত নিজের জন্য নিয়েছে হোয়াইট সস পাস্তা। পরের পাঁচ মিনিট ওরা কোন কথা বললো না। খাওয়া শেষে রিফাত চা নিয়ে এসে শোভার হাতে দিলো-“যেদিন পরীক্ষা থাকবে আমাকে বলো চলে আসবো। এভাবে তোমার ব্রেনটাকে রিফ্রেশ করে দিয়ে যাব। বাকী দিনগুলোতে এসে তোমার ক্ষতি করবো না। তাই বলে পনেরো দিনের কথা ভুলে যাব ভেব না। প্রতিটা দিন কাউন্ট করবো। পনেরো দিন পরে সব বাদ।”
“কিন্তু ঢাকায় গেলে আমি বাসা থেকে বের হই না। তখন আপনার সাথে দেখা করবো কি করে?”
শোভার মুখে চিন্তার ভাজ।
“কি করো কি করবে সেসব জানতে চাইনি আমি। তুমি আমাকে কথা দিয়েছ আমার সাথে বের হবে সে কথা রাখবে ব্যাস।”
শোভা উত্তর না দিয়ে আনমনে চায়ে চুমুক দিলো। মন ভালো হয়ে গেলো তার। চা টা খেতে অতি চমৎকার। ধুর, কিছু একটা উপায় করে নেবে আপাতত চা এনজয় করা যাক।
★★★
শেষ পরীক্ষার দিন যথারীতি রিফাত গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। শোভা বাসায় যাবে ভাবছিল। সে কথা রিফাতকে জানাতে সে অফার করলো শোভাকে সে মোহাম্মদপুর নামিয়ে দেবে। শোভা রাজি হয়ে যায়।
“এখন তো পরীক্ষা শেষ তাহলে সময়ের বাঁধাধরার বিষয়টা আর থাকলো না।”
শোভা না বুঝে তাকায়-“মানে কি? আমি সারাদিন আপনার সাথে থাকবো?”
“সারাদিনের কথা বলিনি তবে দু’ঘন্টার বেশি তো থাকতে পারবে। আরেকটা কথা, পারলে বাড়ি যাওয়াটা পিছিয়ে দাও। আজ নিয়ে পাঁচ দিন এলাম। আর দশদিন বাকী। এরপরে যেখানে খুশি যাও কিছু বলবো না।”
“কিন্তু বাবাকে কি বলবো? পরীক্ষা শেষ এটা বাবা জানে।”
শোভাকে অসহায় দেখালো।
“তোমার পরীক্ষা শেষ কিন্তু বিভা আর সাদাতেরও কি শেষ? ওদের ছাড়া বাড়ি যাবে?”
“আরে তাই তো। এটা তো আমার মাথায় আসেনি। আচ্ছা দেখি কিছু একটা ব্যবস্থা করবো।”
“করলেই ভালো।”
শোনা যায় না এমনভাবে কথাটা বললো রিফাত। বাসা থেকে কিছুটা দূরেই নামিয়ে দেয় শোভাকে। তারপর বিদায় না নিয়েই চলে গেলো। শোভা অনেকটা সময় সেদিকে তাকিয়ে রইলো। রিফাত কেন যেন তার মনের সব কথা আগাম বুঝে যায়। এই যে এতোটা পথ এলো, ভাবছিল রিফাত বাসার সামনে নামালে, কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে। বলবে কিছু দূরে নামিয়ে দিতে। মানুষটা বলার আগেই তো বুঝে যায় সব। মনের কথা কি করে বোঝে সে?
★★★
গোলাম রসুলকে অপ্রশন্ন দেখায়। বিরাগভাজন হয়ে জানতে চাইলেন-“আর ইউ শিওর? ভেবে চিন্তে ডিসিশন নিচ্ছ তো?”
“হ্যা বাবা। ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“তুমি কি তোমার মায়ের উপর রাগ করে আছো? সে কিন্তু তার কাজে লজ্জিত। তার তরফ থেকে চেষ্টাও করেছে। তবে আমি জানতাম আজমল রাজি হবে না। ছোটবেলা থেকেই দেখছি তো? ওর আত্মসমবোধ বেশ প্রখর। যতদূর মনে হলো ওর মেয়েটাও ওরই মতন।”
“একদম। বাপের ফটোকপি।”
মনে মনে কথাটা বললেও মুখে কলুপ এটে রইলো সে। গোলাম রসুল বললেন-
“শোন, একদম নতুন নতুন ঘটনা তো। আমার মনেহয় কিছুদিন পর আজমল নরম হবে। মেয়েটাও তো কম বয়সী। এখন রক্ত গরম। সে হয়তো দিন গড়ালে আরও একটু বুঝদার হবে। তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও হতে পারে। আমরা না হয় সে পর্যন্ত অপেক্ষা করি। পাত্র হিসেবে তো তুমি ফেলনা না। যথেষ্ট কোয়ালিটি আছে তোমার মাঝে। অপছন্দের কোন কারন নেই।”
বাপের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জা পায় রিফাত-“আরে না বাবা। আমি অতোটাও ভালো না। তোমার ছেলে বলে হয়তো দোষগুলো তুমি দেখতে পাও না।”
“এটা তোমার বিনয়। তুমি জানো ছেলে বলেই আমি তোমার প্রসংশা করবো তেমন বাপ আমি না। তবে যাইহোক, একটা অনুরোধ করি। তুমি মায়ের উপর রাগ রেখো না। ডিপলি ভাবলে তোমার মাকে খুব একটা দোষ দিতে পারি না। সে কিছুটা নরম মনের আর আদৃতাকে তো কিছুটা জানো। ও তোমার মায়ের মাথাটা যথেষ্ট খেয়েছিল। আর তোমার বোকা মা ওর ফাঁদে পা দিয়েছিল। ভুল তো মানুষই করে আর মা হলেও সে তো মানুষই।”
“রাগ করিনি বাবা। মায়ের উপর আমার কোন রাগ নেই। তুমি এসব নিয়ে ভেবনা।”
“তাহলে সিদ্ধান্তটা পরিবর্তন করো। এরকম হঠকারী সিদ্ধান্ত কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য ভালো হয় না। তোমার মায়ের মনে অপরাধবোধ জন্মাবে।”
“ভালো মন্দ জানি না বাবা। তবে ডিসিশনটা যেহেতু নিয়েছি তাই কাজটা আমায় করতেই হবে। এর বিকল্প নেই কোন। আর মায়ের সাথে কথা বলবো আমি। তুমি প্লিজ আর মানা কোরো না।”
গোলাম রসুল হতাশ চোখে ছেলেকে দেখলেন। ভেবেছিলেন কথা বলে ছেলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সক্ষম হবে। কিন্তু পারলেন না। রিফাত তার সিদ্ধান্তে অটল।তিনি উঠে দাঁড়ালেন-“ঠিক আছে তোমার যা ভালো মনেহয় করো। আমার দোয়া আছে তোমার সাথে।”
চলবে—
©Farhana_Yesmin