ওয়ান ফোর থ্রি পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
454

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৩৭.
মাহমুদ সাহেব রাতে ঔষধ খেয়ে ঘুমান। তাই এতো ঝামেলার মধ্যেও তাঁর ঘুম ভাঙল না। জাবিদার ইনসোমিয়া আছে। রাতে ঘুমাতে পারে না। ওইসময় সে জেগেই ছিল। কথার চেঁচামেচি শুনে বাধ্য হয়েই বিছানা ছেড়ে উঠে এলো। তখন দেখল তোহা করিডোরের মাথায় দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে। ঘটনা আঁচ করতে জাবিদার অসুবিধা হলো না। সে এগিয়ে গেল তোহার কাছে। তার হাত ধরে নরম স্বরে বলল,” এদিকে আয়, মা।”

তোহা একটু চমকালো। তারপর অভিমানী স্বরে বলল,” আমি এখান থেকে চলে যাবো ফুপু।”

” লক্ষী মেয়ে, আমাকে ভুল বুঝিস না। তুই আমার অনেক আদরের ভাতিজি। কিন্তু কি করব? এই সংসারের কাছে আমি অসহায়। তুই কি এই ব্যাপারে কিছুই জানতি না? তোর বাবা তোকে কখনও বলেনি?”

তোহা চোয়াল শক্ত করে বলল,” না। আমি কিছুই জানতাম না।”

জাবিদা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল৷ তারপর ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল,” তুই তখন সবে মাত্র কলেজে উঠেছিস। আলিফ নতুন চাকরি পেয়ে আমাকে আর তোর ফুপাকে জানাল, ও তোকে বিয়ে করতে চায়।”

এটুকু শুনেই তোহা চোখ টিপে বন্ধ করে ফেলল। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে এলো শরীর। কখনও চিন্তাও করেনি আলিফকে নিয়ে সে এসব শুনবে। বড়ভাই হিসেবে সম্মান করেছে ছোট থেকেই৷ অথচ সে কি-না এই চোখে দেখেছে তোহাকে! জাবিদা দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলে গেল,” প্রথমে তোর ফুপা মানতেই চায়নি। সংসার করার জন্য একটু বেশিই ছোট তুই। তবে আমি খুশি হয়েছিলাম। এই বাড়িতে এলে তুই আমার মেয়ের মতো থাকবি। তোর মা নেই। ছোট থেকে তোকে মায়ের মতো আদর-যত্ন করেছি। সেই তুই আমার বাড়ির বউ হবি। এরচেয়ে আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে? কিন্তু বাঁধ সাধল জাবিদ। সে কিছুতেই তোর বিয়ে দিবে না। তোর বিয়ের বয়স হয়নি এটা মূল বিষয় ছিল না। আমরা অপেক্ষা করতেও রাজি ছিলাম। কিন্তু জাবিদ মুখের উপর বলে দিল, তোকে আলিফের কাছে বিয়ে দিবে না।”

তোহা চুপ করে আছে। জাবিদা তোহার মুখের দিকে তাকাল। একই সময় তোহাও তাকাল। লজ্জায় আবার চোখ ফিরিয়ে নিল সে। এই ধরণের কথা চোখে চোখ রেখে শোনা তার পক্ষে সহজ নয়। জাবিদা আক্ষেপ ঝরা গলায় বলল,” আমি তো ভেবেছিলাম জাবিদ তোর সঙ্গে কথা বলেছে। তুই বিয়েতে মত দিসনি বলেই হয়তো ও নিষেধ করেছে। অথচ তুই এই ব্যাপারে কিছুই জানতি না? জাবিদ অযথা ঘাড়ত্যাড়ামি কেন করল তাহলে? তখন তোর সঙ্গে আলিফের বিয়েটা হলে কত ভালো হতো। কত সুখে থাকতে পারতি তুই আমাদের কাছে।”

তোহা মনে মনে ভাবল, তার বাবা কখনও ভুল করতে পারেন না। বাবা ওই সময় যেটা করেছিলেন সেটাই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। তোহা তার বাবাকে খুব মানতো। বাবা অন্ধের সাথে বিয়ে ঠিক করলেও তোহা নির্দ্বিধায় রাজি হতো। কিন্তু তিনি কখনও অন্য বাবাদের মতো সন্তানের ঘাড়ে নিজের মত চাপিয়ে দেননি। সবসময় তোহার পছন্দকে সবকিছুর উর্ধ্বে গুরুত্ব দিয়েছেন। বাবার চেয়ে ভালো তোহার মন আর কেউ বুঝবে না। তিনি জানতেন, আলিফকে তোহা কখনও ওই নজরে দেখতে পারবে না৷ তাই বিয়ের কথা বলে তিনি তোহাকে বিব্রত করেননি। এইজন্য বড়লোক বোনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছেন। তাও তোহাকে কিছু জানাননি। এসব জানলে তোহা বাবার মন রাখতে বিয়েতে রাজি হতো। কিন্তু তার মনটা ম-রে যেতো। তোহা নিজের বাবা ভাগ্যে সন্তুষ্ট। তিনি ছাড়া এমন করে সন্তানকে আর কোনো বাবা কি বুঝতে পারেন? কত ভাগ্যবতী ছিল তোহা। তার মাথার উপর বিশাল ছাউনি হয়ে তার বাবা ছিলেন। যিনি সমস্ত দুঃখ-কষ্ট থেকে অবলীলায় বাঁচিয়ে রাখতেন তোহাকে। কিন্তু এবার কি হবে? এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বাবাহীন বটগাছ ছাড়া তোহা কিভাবে বাঁচবে? তার খুব অসহায়বোধ হয়। নিজেকে শূন্য মনে হয়।

জাবিদা অসহিষ্ণু গলায় বলছে,” তখন তোর বাবাকে কত বুঝিয়েছিলাম। তার কিছু হয়ে গেলে তোকে কে দেখবে? কে আছে তোর? সবসময় শুধু একটাই উত্তর দিতো,” আমার মেয়ের জন্য আমিই যথেষ্ট।” অথচ এখন কি হলো? সেই আমাদের কাছেই তো আসতে হলো তোকে। আর এমন একটা সময় এলি যে না পারছি তোকে রাখতে আর না পারছি দূরে সরাতে। শত হলেও তুই আমার ভাগ্নী। এদিকে আলিফও আমার ছেলে। যখন তোর বাবা বিয়ের জন্য নিষেধ করে দিল, আলিফ কত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল জানিস? তোর সঙ্গে দেখা করতে বাংলাদেশে অবধি ছুটে গিয়েছিল। তোর মনে আছে সে কথা?”

তোহা মাথা নাড়ল। মনে আছে তার। একদিন বিকেলে কোচিং থেকে এসে দেখল আলিফ বসে আছে তাদের ড্রয়িংরুমে। বাবা তার সঙ্গে কথা বলছেন গম্ভীরমুখে। তোহা হাসি-খুশি গলায় জানতে চাইল,” আরে, আলিফ ভাই!কেমন আছো? দেশে হঠাৎ কি মনে করে?”

আলিফ মৃদু হেসে বলেছিল,” তোমাকে দেখতে এলাম।”

তোহা ভেবেছিল, মজা। কিন্তু সেই কথা সত্যি ছিল। জড়তা-সংকোচে মাথা ঝিমঝিম করছে। কিছু সত্যি কখনও জানতে হয় না। এখন থেকে আলিফের সামনে দাঁড়াতেও অস্বস্তি লাগবে। তাদের সহজ-সরল, সুন্দর সম্পর্কটার সমীকরণ হঠাৎ কেমন জটিল হয়ে গেল। কেন হলো এমন?

জাবিদা চিন্তিত কণ্ঠে বলল,” অনেক কষ্টে আলিফকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছি। কথার সাথে বিয়েটা পারিবারিকভাবেই হয়েছে। আমি ভাবলাম বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। হলোও তাই। প্রথম একটা বছর ওরা কত সুন্দরভাবে সংসার করল। তারপর জাবিদের মৃ-ত্যুসংবাদ আর তোর এখানে আসা সবকিছু এলোমেলো করে দিল। আলিফ আবার কেমন যেন হয়ে গেল। আফসোস করছে নিজের বিয়ে নিয়ে। আর একটু অপেক্ষা করলেই ও তোকে পেয়ে যেতো।”

তোহা অস্বস্তি ভরা কণ্ঠে বলল,” আলিফ ভাই এখনও এসব চিন্তা করে?”

” চিন্তা করে না, তবে আফসোস তো অবশ্যই করে। আর কথাও সব জানে। তাই আমার ভয় হচ্ছে। যদি ওদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়? কথা খুব সেন্সিটিভ মেয়ে। কনজার্ভেটিভ পরিবার থেকে এসেছে তো! তার উপর সে প্রেগন্যান্ট। ”

” তুমি ভাবছো আমার জন্য ওদের সংসার ভেঙে যাবে?”

” ঠিক ভেঙে যাবে না। কিন্তু সংসারে তো অশান্তি হচ্ছে। তুই আসার পর থেকেই তো দেখছিস।”

“এজন্যই সেদিন আমার বিয়ের কথা বলেছিলে। তাই না?”

জাবিদা ইতস্তত করে বলল, “ভেবেছিলাম তোর বিয়ে হয়ে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু আলিফ তোর বিয়ের কথা শুনে রেগে গেল। অবশ্য ওর রাগে কিছু যায়-আসে না। তুই যদি রাজি থাকিস!”

তোহা তাচ্ছিল্য হাসল৷ জাবিদা তোহার কাঁধে হাত রেখে কোমল স্বরে বলল,” দ্যাখ মা, ফ্যামিলি সবার দরকার। তুই একা একটা মেয়ে কিভাবে থাকবি? তোরও তো একটা ফ্যামিলি দরকার আছে। বিয়েটা করে নিলে ক্ষতি কি? আমার কাছে খুব ভালো একটা ছেলে আছে। তোর ব্যাপারে সবকিছু জেনেই সে বিয়েতে রাজি হয়েছে। তোর ছবি দেখে খুব পছন্দও করেছে। ছেলে এখানকারই নাগরিক। খুব ভালো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড।”

তোহা এসব শুনে চোখ বড় করে চেয়ে রইল। অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল,” আমার অনুমতি না নিয়েই তুমি আমার ছবি পাঠিয়ে দিলে?”

” তাতে কি হয়েছে? আমি কি তোকে নিয়ে ভাবতে পারি না? এখন তো আমিই তোর গার্ডিয়ান।”

তোহা বিরস মুখে বলল,” বুঝতে পেরেছি। সব সমস্যার মূল সমস্যা আমিই। তুমি চিন্তা কোরো না ফুপু। আমি এখানে থেকে তোমাদেরকে আর জ্বালাবো না। কালই বাংলাদেশে ফিরে যাবো।”

” রাগ করছিস কেন? আমি কি তোকে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছি একবারও?”

” তুমি বলোনি। কিন্তু আমি বুঝি। আমাকে যেতেই হবে। এই বাড়ি আমার থাকার জায়গা নয়। আর আমার বিয়ে নিয়েও অযথা তোমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।”

তোহা এই কথা বলে আর দাঁড়ালো না৷ করিডোরের সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে এলো। পেছন থেকে জাবিদা কাঠখোট্টা স্বরে বলছিল,” একদম বাপের মতোই জেদি হয়েছিস। আমার কি? পরে নিজেই পস্তাবি।”

তোহা শুনল না। বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে তার। কোথায় তার বাবা? তোহা আকাশের দিকে তাকাল। তারাদের উদ্দেশ্য করে বলল,” কেন এভাবে একা ছেড়ে গেলে বাবা? আমাকে সঙ্গে নিয়ে কেন গেলে না? আমি তোমাকে প্রচন্ড মিস করছি। আমি এই পৃথিবীতে থাকতে চাই না। আমিও চলে যেতে চাই। যেখানে তুমি আছো সেখানে।”

তোহা কার্ণিশে উঠে দাঁড়ালো। অশ্রুপূর্ণ দৃষ্টিতে ভেসে উঠল বাবার মুখ। গোটা আকাশটাই যেন কাঁপছে। তোহা তাকিয়ে রইল আকাশে, দাঁড়িয়ে রইল কার্ণিশে। আরেকটু এগোলেই সে পড়ে যাবে। শাহিদ দূরবিন দিয়ে এই দৃশ্যটা দেখে সাথে সাথে আমীরকে ফোন করল। তখন বাংলাদেশে সকাল এগারোটা বাজে। আমীর মিটিং-এ ব্যস্ত। কিন্তু শাহিদের ফোন দেখে সে মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে এলো।

” হ্যালো শাহিদ।”

” স্যার, স্যার আমি এই মাত্র কি দেখলাম জানেন?”

শাহিদের বিচলিত কণ্ঠ শুনে আমীর অস্থিরবোধ করল,” কি দেখেছো?”

শাহিদ ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিল। কাঁপা গলায় বলল,” দেখলাম, ম্যাডাম দুইহাত মেলে ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় সুইসাইড করতে চাইছে।”

আমীরের মাথা ফাঁকা হয়ে গেল। দুই সেকেন্ড চুপ থেকে উত্তেজিত গলায় বলল,” কি বলছো? মানে?”

” আমি কি করব স্যার? বুঝতে পারছি না।”

” বুঝতে পারছো না মানে? তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো কেন? দ্রুত যাও ওর কাছে।”

” ওকে স্যার। যাচ্ছি।”

শাহিদ আমীরকে লাইনে রেখেই গার্ডকে দু’টো ঘুষি মেরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। চপল পায়ে হাঁটতে লাগল ছাদের দিকে। গার্ড বাঁশি বাজালো। পুরো বাড়িতে আলো জ্বলে উঠল। তোহা হৈ-চৈ শুনে কার্ণিশ থেকে নেমে পড়ল। দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে যেতে নিয়ে দেখল বাবা দাঁড়িয়ে আছে সামনে।অন্ধকার সিঁড়িতে বাবার ছায়া দেখতে পেয়ে তোহা দাঁড়িয়ে পড়ল। অশ্রুসিক্ত হলো তার দৃষ্টি। বাবা- বাবা বলে ডাকল কয়েকবার। গায়েবী আওয়াজ শুনতে পেল সে। অতঃপর পা পিছলে পড়ে গেল। শব্দ পেয়ে শাহিদসহ সবাই ছুটে এলো। ফোনের ওই পাশ থেকে তোহার আর্তচিৎকার শুনে আমীরের বুক কেঁপে উঠল। দুনিয়া যেন থমকে গেল।
অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণ করে গৃহে প্রবেশের অপরাধে শাহিদকে পুলিশে দেওয়া হয়। তাই পরবর্তীতে তোহার আর কোনো খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয় না আমীরের পক্ষে। এদিকে সে অস্থিরতাও দমাতে পারে না৷ তোহা কেন চিৎকার করল? তার সাথে কি হলো? এটুকু না জানা পর্যন্ত স্বস্তিতে নিঃশ্বাসও নিতে পারবে না আমীর। সেই মুহূর্তেই প্রস্তুতি নিয়ে সে ফ্লাইটে উঠে গেল। প্রায় আটঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশ থেকে ইটালি পৌঁছালো। সম্পূর্ণ সময়টা আমীর কাটালো একটা ঘোরের মধ্যে। তোহাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় তার নার্ভ শিথিল হয়ে আসছিল। একমুহূর্তের জন্যেও হৃৎপিন্ডের অস্বাভাবিক কম্পন থামল না।

____________
স্নেহার হাতে প্লাস্টিকের কৌটা। এতে বড় বড় অক্ষরে লিখা,’ র‍্যাটম’। আপাতত সারা বাড়ি খুঁজে এই জিনিসটাই সংগ্রহ করতে পেরেছে সে। রাশেদ বারান্দায় বসে আছে। স্নেহা চায়ের সাথে র‍্যাটম মিশিয়ে নিল। সবকিছু তার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আজকে সে এর শেষ দেখতে চায়। হয় এসপার, নয় ওসপার। স্নেহা সযত্নে চা তৈরী করে বারান্দায় নিয়ে এলো। রাশেদ বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছে আর শিষ বাজাচ্ছে। তার মনে এখন বেজায় সুখ। স্নেহাকে দেখেই সে বলল,” গুড আফটারনূন সুইটহার্ট।”

স্নেহা হাসার ভাণ করল। তাকে আর বেশিক্ষণ অভিনয় করতে হবে না। রাশেদের ন্যাকামিও আর সহ্য করতে হবে না৷ এসব ভেবেই শান্তি লাগছে। স্নেহা চায়ের কাপ তুলে রাশেদের হাতে দিয়ে বলল,” তোমার জন্য বানিয়েছি। দেখোতো চিনি ঠিক হলো কি-না?”

রাশেদ খেয়াল করল স্নেহার হাত মৃদু কাঁপছে। সে মুচকি হেসে চায়ের কাপ হাতে নিল৷ তারপর সেটা দেয়ালের উপর রাখল। স্নেহা ভ্রু কুচকে বলল,” কি ব্যাপার? খাবে না?”

” খাবো। কিন্তু একটু পর।”

” ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।”

” হোক ঠান্ডা। তুমি এদিকে এসো।”

রাশেদ স্নেহাকে কাছে এনে জড়িয়ে ধরল। স্নেহার অসহ্য লাগল, কিন্তু সে চুপ রইল। আর একটু পরেই সব ঝামেলার অবসান হবে। রাশেদ অনুতপ্ত গলায় বলছে,” আই এম স্যরি জান। কাল দুপুরে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছিল। আমি তোমার সাথে রুড হতে চাইনি।”

নিজেকে সামলে স্নেহা নম্র কণ্ঠে বলল,” ভুলটা আমারই ছিল। আমিই বেশি সিন ক্রিয়েট করে ফেলেছি। তোমার দোষ নেই। আমাকে মাফ করে দাও। এরকম আর হবে না।”

রাশেদ আঁড়চোখে তাকাল। সন্দিহান গলায় বলল,” সত্যি? আর হবে না?”

” হুম। একদম সত্যি।”

রাশেদ স্নেহার হাত নিয়ে তালুতে চুমু দিল। তখনি ইঁদুর মা-রার ঔষধের গন্ধ নাকে লাগল। স্নেহা নিজের হাতটা ছাড়িয়ে অধৈর্য্য গলায় বলল,” হয়েছে। এবার ছাড়ো। তোমার চা ঠান্ডা হচ্ছে।”

রাশেদ চায়ের কাপের দিকে তাকাল,” আগে তুমি খাও।”

” মানে?” স্নেহার মুখ শুকিয়ে গেল। রাশেদ সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,”আমার জন্য বানানো চা তুমি খেতে পারবে না এমন তো কোনো কথা নেই। তুমি খাওয়ার পর আমি খাবো।”

এই কথা বলে রাশেদ চায়ের কাপ স্নেহার মুখের সামনে ধরল। স্নেহার বুক ধুকপুক করছে। রাশেদ কি কিছু বুঝে ফেলল? স্নেহা চোখমুখ শক্ত করে বলল,” তুমি কি ভেবেছো? চায়ে বিষ মিশিয়ে রেখেছি? সেজন্য আমাকে খেতে বলছো?”

রাশেদ হেসে ফেলল। জীভ কেটে বলল,” ছি, ছি, আমি এমন কেন ভাববো?”

” তুমি এটাই ভেবেছো৷ মিথ্যা বোলো না।”

” সত্যি জান। আমি এরকম কিছুই ভাবিনি।”

” তাহলে চা খেয়ে প্রমাণ করে দেখাও যে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো। আর যদি অবিশ্বাস করো, তাহলে ফেলে দাও।”

” আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, ভালোওবাসি। তাই তো তোমাকে খেতে বলছি। আগে তুমি খাও, তারপর আমি খাবো। এতে কি অসুবিধা?”

স্নেহা ভাবল, অল্প করে এক চুমুক খেলে কিছু হবে না। পরে না হয় ফেলে দিবে। আর রাশেদের বিশ্বাস অর্জন করাও জরুরী। নয়তো এই চা তাকে কিছুতেই খাওয়ানো যাবে না। এসব ভেবে সে এক চুমুক চা খেল। তারপর বলল,” খেয়েছি। এবার খুশি?”

” উহুম। আরেকটু খাও। অর্ধেকটা তুমি, বাকি অর্ধেক আমি।”

এবার স্নেহার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। কোনমতে বলল,” আমি এতো মিষ্টি চা খেতে পারি না।”

রাশেদ ঝরঝরে কণ্ঠে বলল,” প্লিজ খাও৷ একদিন মিষ্টি খেলে কিছু হয় না। অন্তত আমার জন্য।”

স্নেহার মুখে একপ্রকার জোর করেই চা ঢুকিয়ে দিল রাশেদ। স্নেহা খুকখুক করে কেশে উঠল। খ্যাঁক করে চা ফেলে দিল। ভয়ে চোখমুখ রক্তাভ হয়ে এলো তার। রাশেদ এই অবস্থা দেখে হেসে উঠল উচ্চশব্দে। স্নেহা অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সে ব্যর্থ হয়েছে আবারও। এই হার, এই অপমান আর মানতে পারছে না। রাগে চায়ের কাপ আছাড় মেরে ভেঙে ফেলল। রাশেদ হাসতে হাসতেই বলল,” আমি এখনও বিশ্বাস করি, চায়ে বিষ ছিল না। তুমি আমাকে মা-রতে পারো না।”

রাশেদের চোখ টলমল করছে। স্নেহা ক্রোধে পাগল হয়ে মনে মনে আওড়াল,” আই হেইট ইউ রাশেদ। আই হেইট ইউ মোর দ্যান মাই ডেথ।”

______________
সিঁড়ি থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিল তোহা। তেমন গুরুতর কিছু হয়নি। কিন্তু জাবিদা খুব কান্নাকাটি করল। শেষরাতে সে তোহার সঙ্গে ঘুমাতে এলো। নিজের কটূবাক্যের জন্য তোহার কাছে ক্ষমাও চাইল। আলিফ কথার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। সকালে যখন কথা তার জন্য নাস্তা নিয়ে এলো তখন আলিফ খুব গম্ভীর স্বরে জানাল,” আমার মনে হয় এভাবে চলবে না কথা। আমাদের স্পেস দরকার।”

” মানে? কি বলতে চাও?” কথা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আলিফ অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে বলল,” আমি ডিভোর্স চাই।”

কথার মাথা ঘুরে উঠল। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ক্ষয়ে গেল। পায়ের নিচে মাটিও যেন সরে গেল। নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। সে কি ঠিক শুনছে? অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর কথা প্রশ্ন করল থমথমে কণ্ঠে, ” হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ জানতে পারি?”

” কারণ তুমি জানো। খুব ভালো করেই জানো।”

কথা চোখের জল মুছল। সিক্ত দৃষ্টিতে বলল,” মানছি আমার ভুল হয়েছে। সেজন্য আমি তোহার কাছে ক্ষমাও চাইব।”

আলিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,” এজ ইউর উইশ। তবে আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। আমার পক্ষে এই টক্সিক রিলেশন আর কন্টিনিউ করা সম্ভব না। আমি তোমাকে অসংখ্যবার বারণ করেছি যে এই ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না। কিন্তু তুমি শোনোনি আমার কথা। নাউ আই এম স্যরি।”

আলিফ ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া মাত্রই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল কথা। সে বুঝতে পারছে তার বড় ভুল হয়েছে। তোহাকে দোষারোপ করাই উচিৎ হয়নি। সব দোষ তার স্বামীর, তার নিজের ভাগ্যের। এখানে তোহার দোষ কই? সেও তো অসহায়। সকালে তোহার ঘরে ঢুকে তার কাছে বিনীতভাবে ক্ষমা চাইল কথা।

” আই এম স্যরি তোহা। রাতে রাগের মাথায় অনেক কিছু বলে ফেলেছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। খুব খারাপ আমি।”

তোহা শুয়েছিল। মাথায় ব্যান্ডেজ। দূর্বল কণ্ঠে বলল,”বাদ দাও ভাবী। আমি সব ভুলে গেছি।”

কথা চোখের জল মুছতে লাগল। তোহা তাকে কাঁদতে দেখে সামান্য অবাক হলো,” কাঁদছো কেন? বললাম তো আমি কিছু মনে রাখিনি। সত্যি বলছি।”

কথা মাথা নিচু করে বলল,” তোমার ভাই বলছে আমাকে ডিভোর্স দিবে। তোমার সামনে নাকি আমি ওর মাথা হেঁট করে দিয়েছি। ওর মান-সম্মানের পরোয়া করিনি। এজন্য ও আর আমার সঙ্গে থাকতে চায় না।”

তোহা উঠে বসতে নিয়ে দেখল তার মাথা ঘুরে আসছে। আবার শুয়ে পড়ল। কথা এসে তাকে ধরল। তোহা ভ্রু কুচকে বলল,” কি বলছো এসব?”

” ঠিকই বলছি। একটা সম্পর্ক ভাঙা কি এতোই সহজ তোহা? মানছি আমি রাতে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করেছি। সেজন্য ও আমার সাথে এতোবড় অন্যায় করবে? আমি যে প্রেগন্যান্ট এই কথা এখনও ওকে বলিনি। সারপ্রাইজ দিবো ভেবেছিলাম। মা জানেন শুধু।”

” তাহলে বলে দাও। আমার বিশ্বাস, ভাইয়া এই কথা জানলে আর ডিভোর্স দিতে চাইবে না।”

” তুমি তাহলে ওকে চেনো না। ও যেটা বলে সেটাই করে। এখন বাচ্চার কথা জানলে ও হয়তো আমাকে এবোর্শন করাতে নিয়ে যাবে।”

” ছি, ছি, এরকম কিছু হবে না।”

” এরকমই হবে। তুমি ওকে চেনো না। কিন্তু আমার মনে হয়, তুমি বুঝিয়ে বললে ও বুঝবে। ও তোমার কথা শুনবে।”

তোহা হাসল। কথা তাহলে এইজন্যেই তার কাছে এসেছে! ক্ষমা চাওয়া তো একটা বাহানা মাত্র। সে আসলে অনুতপ্ত নয়, বাধ্য! তোহা মনমরা গলায় উচ্চারণ করল,” তোমাদের পারসোনাল ব্যাপারে আমার কথা বলা কি ঠিক হবে? আমি তো বাইরের মানুষ। আজ আছি, কাল নেই।”

” এভাবে বোলো না তোহা। বললাম তো স্যরি। খুব, খুব স্যরি আমি। তুমি বাইরের মানুষ না। তুমি এই বাড়ির মেয়ে। বরং আমিই স্বার্থপরের মতো করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

কথা তোহার হাত দু’টি টেনে ধরে রাখল।তোহা বাধ্য হয়ে বলল,” ঠিকাছে, আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলব। কিন্তু সে আমার কথা শুনবে কি-না তা আমি বলতে পারছি না।”

” আরেকটা অনুরোধ, তোমার ভাইয়া যাতে না বোঝে যে আমি তোমার সাথে এসব শেয়ার করেছি।”

” বুঝবে না।”

তোহা কাউকে বলেনি যে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার আগে সে তার বাবাকে দেখেছিল। কিন্তু বিষয়টা তাকে একদম শান্তি দিচ্ছে না। একা ঘরে থাকতেও কেমন ভয় ভয় লাগছে৷ তার মনে হয় সে খুব শীঘ্রই মা-রা যাবে। নাহলে বার-বার বাবাকে সে কেন দেখে? বাবা কি সত্যি তাকে নিয়ে যেতে চাইছে? তোহার ঘর থেকে বের হতেই কথা দেখল আলিফ দাঁড়িয়ে আছে। সে মাথা নিচু করে বলল,” আমি তোহার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।”

আলিফ অন্যদিকে চেয়ে বলল,” গুড।”

” ও তোমার সাথে একটু কথা বলতে চায়।”

” আমার সাথে?” আলিফ অনেক অপ্রস্তুত হলো। এতোকিছুর পরে সে তোহার সামনে কিভাবে দাঁড়াবে? ব্যাপারটা সহজ না৷ কথা বলল,” ও জানতে চাইছিল, এক্সিডেন্টের পর ওর সাথে দেখা করতে গেলে না কেন তুমি?”

আলিফ অবিশ্বাসী গলায় প্রশ্ন করল,” সত্যি এটা বলেছে ও?”

” হুম। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

আলিফ প্রথমে ভাবল যাবে না। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে গেল। এভাবে লুকিয়ে-বাঁচিয়ে থাকা কোনো সমাধান নয়। আজ না হোক কাল তোহার মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। আলিফকে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে দেখে তোহা উঠে বসল। বিন্দুমাত্র বিব্রত না হয়ে হাসি মুখে বলল,” আলিফ ভাই, এসো।”

” কেমন আছো তোহা?”

” ভালো আছি। গতরাতে ফুপু আমার সাথেই ছিল। আমার কোনো অসুবিধা হতে দেয়নি।”

” মা তোমাকে নিয়ে খুব টেনশনে ছিল। তোমাকে খুব স্নেহ করে।”

তোহা বিরস মুখে বলল,” জানি।”

তারপর আর কেউই কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। আলিফ বুঝতে পারছে না, তার কি গতরাতে কথার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিৎ? কিন্তু পুনরায় ওই প্রসঙ্গ তুলতে ইচ্ছে করছে না৷ তোহা একটু ভেবে বলল,” আলিফ ভাই।”

“হুম?”

” সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। আমার জন্য তোমাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হলে আমার সেটা মোটেও ভালো লাগবে না। ফুপুও তোমাদের সংসার নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় আছে। অসুস্থ মানুষ সে। প্লিজ এমন কিছু কোরো না যাতে ফুপু আর ফুপা কষ্ট পায়। তারা তোমাকে খুব ভালোবাসে, তোমার উপর ভরসা করে।”

আলিফ বুঝতে পারল কথা নিশ্চয়ই তোহাকে ডিভোর্সের ব্যাপারে কিছু বলেছে। নাহলে তোহা এই কথা বলতো না। সে সপ্রতিভ স্বরে জানাল,” তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। তোমার জন্য আমাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হবে না। যেটা হবে সেটা হয়তো আমাদের ভাগ্যেই ছিল।”

আলিফ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় মাথা রাখল তোহা। তার খুব ঘুম আসছে। সম্ভবত জ্বরও আসছে। ইদানীং জেগে থাকার চেয়ে ঘুমাতে বেশি ভালো লাগে তার। সে বাস্তবের চেয়েও স্বপ্নে বেশি ভালো থাকে। কারণ স্বপ্নে তার বাবা-মা আসে। আজ অবশ্য তোহার স্বপ্নে বাবা-মা এলো না৷ সূঠামদেহী সুদর্শন সেই নিষ্ঠুর মানব এলো। যে শুধুই দায়িত্ব পালন করতে তোহাকে একের পর এক বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে, মায়ায় জড়িয়েছে, ভালোবাসার অনুভূতি জাগিয়েছে। আর তারপর খুব নিঃসঙ্গ করে ছেড়ে চলে গেছে! সেই মানুষটিই স্বপ্নে তার একজোড়া গভীর চোখে পৃথিবীর সমস্ত মায়া নিয়ে তোহার দিকে তাকিয়ে আছে। কি আশ্চর্য সুন্দর তার সেই চাহনী। জাবিদার ডাকে তোহার ঘুম ভাঙল। সে বেশ বিরক্ত হলো। সুন্দর স্বপ্নটা শেষ হলো না। আবার কখনও এরকম স্বপ্ন আসবে কি-না কে জানে?

” কি হয়েছে ফুপু? এভাবে ডাকছো কেন?”

জাবিদা ব্যস্ত স্বরে বলল,” তোর সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন দেখা করতে এসেছে।”

” বাংলাদেশ থেকে? কারা?”

” কয়েকজন ভদ্রলোক। লিভিংরুমে বসিয়ে রেখেছি। তুই কি উঠে যেতে পারবি? বাইরের মানুষকে তো আর বেডরুমে আনা যায় না।”

তোহা ভাবতে লাগল,বাংলাদেশে তার কে আছে যে দেখা করতে আসবে? কৌতুহলবশতই সে উঠে গেল। লিভিংরুমে আমীর শান্ত মুখে মাহমুদ সাহেবের সাথে গল্প করছে। তাকে দেখে তোহার নিশ্বাস আটকে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না। সে কি স্বপ্ন দেখছে এই মুহূর্তে? হয়তো সে এখনও বিছানাতেই শুয়ে আছে। ফুপু তাকে ডাকেনি। পুরো ব্যাপারটাই তার স্বপ্নে ঘটছে। নাহলে আমীর কিভাবে এখানে আসবে? এটা অসম্ভব!

চলবে

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৩৮.

ফ্রীজে কোনো খাবার নেই। রাশেদ ঘরে তালা দিয়ে বাজার করতে বের হলো। সুপারশপ থেকে স্নেহার পছন্দের শ্যাম্পু, বডিওয়াশ, লোশনসহ অনেক কিছু কিনল। কয়েকটা কূর্তি, সেলোয়ার, জুয়েলারি নিল। স্নেহার প্রিয় চকলেট আর আঁচাড়ও নিয়ে নিল। সকালে স্নেহার বাদাম খাওয়ার অভ্যাস। তাই রাশেদ বাদামও কিনল। বড় মাছ কিংবা মাংস কেনা প্রয়োজন। ডিম দিয়ে আর কতদিন চলবে? রাশেদ সবকিছু কিনে দেখল তার কাছে আর এক টাকাও অবশিষ্ট নেই। তাই রিকশা না নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হলো। স্নেহা সকাল থেকে দরজা আটকে বসে আছে। চায়ের ঘটনার জন্য হয়তো অপরাধবোধে ভুগছে। রাশেদ একাই সব রান্নাবান্না শেষ করল। দুপুরে গোসল সেরে স্নেহার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল,

” ম্যাডাম, বের হোন। আপনার জন্য লাঞ্চ রেডি করেছি। আপনার ফেভারিট টুনা মাছ ভাজি।”

ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। রাশেদ দুষ্টমি করে বলল,” ভয় নেই। আপনার মতো বিষ মিশিয়ে দেইনি। একদম সেইফ এন্ড পিউর। খেতে আসুন।”

অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকির পরেও স্নেহা টু-শব্দটি করল না। রাশেদ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ব্যাপারটা কি? মুহূর্তেই তার অস্থির লাগা শুরু হলো। স্নেহা কি ঠিক আছে? কোনো শব্দ করছে না কেন? সে এক্সট্রা চাবি দিয়ে লক খুলে ভেতরে ঢুকল। অতঃপর স্নেহার অবস্থা দেখে স্তব্ধীভূত হয়ে গেল। রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে স্নেহার দেহ। একটা সাদা কাগজ তার হাতের মুঠোয় পাওয়া গেল। রক্তাক্ত সেই কাগজে লেখা,” তোমার সাথে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।”

রাশেদ তাড়াহুড়ো করে স্নেহাকে পাজাকোলায় তুলল। তার মাথা কাজ করছে না। এম্বুল্যান্স ডাকতে হবে। কিন্তু সে একা কিভাবে এতোকিছু করবে? স্নেহাকে কিভাবে বাঁচাবে! পরমুহূর্তেই রাশেদের মনে পড়ল, সামান্য হাত-পা কাটলে কারো মৃ-ত্যু হয় না। আর স্নেহা আত্ম-হত্যা করার মেয়েও নয়। সে যা করছে পুরোটাই রাশেদকে আতঙ্কে ফেলার জন্য। কিন্তু সে এখন অচেতন৷ এই অবস্থায় হাসপাতালে না নিলে যদি সত্যি কোনো ক্ষতি হয়? তাছাড়া কতগুলো রক্ত বের হয়েছে। রাশেদ রিস্ক নিতে চায় না। সে স্নেহাকে অসম্ভব ভালোবাসে। স্নেহার কিছু হলে সে থাকতে পারবে না।

আহত স্নেহাকে কোলে নিয়ে সড়কে নামল রাশেদ। খুব দ্রুতই একটা সিএনজি পাওয়া গেল। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর স্নেহাকে ইমারজেন্সীতে নেওয়া হলো। ইমারজেন্সী রক্ত লাগবে। দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করতে গিয়ে রাশেদকে অনেক ছুটাছুটি করতে হলো। নার্স একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে কিছু এন্টিবায়োটিক আনতে বলল। রাশেদের হাতে টাকা নেই। অথচ ঔষধ কিনতে বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন। সে একটা ইলেকট্রনিক্সের দোকানে গিয়ে তার হাতের ঘড়িটা বিক্রি করে দিল।
বিকাল হয়ে এসেছে। রাশেদ ঔষধ কিনে ফিরে আসার পর জানতে পারল, স্নেহার জ্ঞান ফিরেছে। খবরটা শুনে সে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে খুশি হলো। তখনি নার্স অত্যন্ত মেজাজ খারাপের সাথে জানাল,” সম্ভবত আপনার স্ত্রীর মাথায় সমস্যা আছে।”

রাশেদ হকচকানো গলায় বলল,” মানে? ”

” উনি জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই পালিয়েছে।”

রাশেদ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল,”কোথায় পালিয়েছে? আপনারা পালাতে দিলেন কিভাবে?”

নার্স রেগে আগুন হয়ে বলল,” এখানে আমাদের দোষ নেই। উনি আমাদের সাথে একরকম ধস্তাধস্তি করে হাতে কামড় দিয়ে পালিয়ে গেছে। এতোবার বললাম আপনার হাসব্যান্ড আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। কিন্তু শুনলই না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে অন্য স্টাফদের জিজ্ঞেস করুন। ”

” তাই বলে আপনারা ওকে ছেড়ে দিবেন? আর একটু অপেক্ষা করতেন।”

” আপনি এতো দেরি করেছেন কেন?উনাকে আটকাতে গেলে অন্য পেশেন্টদের ক্ষতি হতো। হসপিটাল লন্ডভন্ড করে ফেলছিল একদম।এমন বেয়াদব পেশেন্ট আমি আমার লাইফে কখনও দেখিনি। ”

রাশেদ হতাশ হয়ে ওয়েটিংরুমের চেয়ারে বসে পড়ল। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। জোরে জোরে কয়েকবার নিশ্বাস নিল সে। স্নেহাকে কোথায় খুঁজবে এখন?

______________
” কেমন আছো মায়া?”

তোহা শীতলতা অনুভব করল। কতদিন পর ‘মায়া’ ডাকটা শুনছে। বাবার পরে তাকে ‘মায়া’ বলে ডাকার অধিকার আমীর ছাড়া আর কাউকে দেয়নি সে। আলতো হেসে উত্তর দিল,” ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

” হুম। ভালো। ” আমীর তাকাল তোহার কপালের সাদা ব্যান্ডেজের দিকে। খানিক রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করল,” কি হয়েছে মাথায়?”

তোহা অবজ্ঞার স্বরে জানাল,” তেমন কিছু না। ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট।”

আমীরের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। মিথ্যা বলছে তোহা। গতকাল সে সুইসাইড করতে গিয়েছিল। তারপরই ঘটেছে এই অঘটন। তাহলে সেটা স্বীকার করছে না কেন? আমীর সিরিয়াস হয়ে জানতে চাইল,” এইখানে থাকতে কি তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে?”

” এটা আপনি কেন জানতে চাইছেন?”

” আমাকে সত্যিটা বলো। তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভালো নেই।”

তোহা হাসার চেষ্টা করল। ধারালো কণ্ঠে বলল,” এতো চিন্তা কেন করছেন আমাকে নিয়ে? আপনার দায়িত্ব ছিল আমাকে ইটালি পৌঁছে দেওয়া। আপনি সেটা পালন করেছেন। আপনার কাজ শেষ। এখন আমি ভালো আছি কি নেই সেটা জেনে কি করবেন? বাবা কি আপনাকে আমার ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্বও দিয়ে গেছেন?”

আমীর গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে। তোহা ঠাট্টার স্বরে বলল,” যদি আমি বলি আমি ভালো নেই, তাহলে আপনি কি করবেন? আমার ভালো থাকার ব্যবস্থা করবেন? কিভাবে করবেন? বডিগার্ড নিয়োগ দিবেন?”

আমীর ভারী গলায় উচ্চারণ করল,” আমি কি করব সেটা বিষয় না। তুমি আমাকে সত্যি কথা বলো।”

তোহা হেসে ফেলল। যেন খুব মজার কথা শুনছে সে। তার হাসি দেখে সামান্য বিব্রতবোধ করল আমীর। ইতস্তত কণ্ঠে বলল,” আমি তোমাকে এখানে রাখব না।”

তোহা অবাক হয়ে তাকাল। প্রশ্ন করল,” আপনি আমাকে এখানে না রাখার কে? আপনি আমার গার্ডিয়ান নাকি?”

আফশান আমীরের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। সে সব কথা শুনছে। তার মুখ ক্রমশ মলিন হয়ে যাচ্ছে। আমীরের ফোন বাজল আবারও। সে বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিল। অনেকক্ষণ ধরে রাশেদ কল করছে। তোহা এই পর্যায় বলল,” ফোনটা ধরুন। কোনো জরুরী কলও হতে পারে।”

আমীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ার থেকে উঠল। অনেকটা দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করল। রাশেদ এতোবার যেহেতু ফোন দিচ্ছে, অবশ্যই জরুরী কিছু হবে। তোহা উঠে যেতে নিলেই আফশান তাকে থামিয়ে বলল,” ম্যাডাম, দয়া করে স্যারের সাথে এভাবে কথা বলবেন না।”

তোহা ভ্রু কুচকালো,” কিভাবে কথা বলেছি? আপনাদের স্যারের সাথে কথা বলতে হলে কি কুর্ণিশ করতে হবে? চোখে চোখ রাখা যাবে না? হাসা যাবে না? কোনটা বলুন তো? আমার কোথায় ভুল হয়েছে?”

আফশান অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” আপনি মনে হয় স্যারের উপর কোনো কারণে রেগে আছেন ম্যাডাম।”

তোহা গাঢ় করে হাসল,” একদম না। আপনার স্যারের উপর রাগ করব আমি? সেই সাহস কি আমার আছে?”

” স্যার শুধু আপনার জন্য পুরো একমাসের প্ল্যান এলোমেলো করে বাংলাদেশ থেকে ইটালি ছুটে এসেছেন। কত কেয়ার করে আপনার। অথচ আপনি এসব কি বলছেন?”

এই কথা শুনে তোহার পিলে চমকে উঠল। সে টাশকি খাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

রাশেদ কান্নাকাটি করছে। যে কারণে তার কথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। আমীর বিরক্ত হয়ে বলল,” মেয়েদের মতো কাঁদবে না রাশেদ। কি হয়েছে স্পষ্ট করে বলো। স্নেহা পালিয়েছে মানে কি?”

” হসপিটাল থেকে পালিয়ে গেছে স্যার। আমি বুঝতে পারছি না ওকে কোথায় খুঁজব। যেখানে যেখানে সে যেতে পারে, সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। আমি এখন আপনার কাছে আসছি স্যার।”

” আমার কাছে এসে লাভ নেই। আমি দেশের বাইরে আছি।”

” কি বলেন স্যার? তাহলে এবার?”

” আচ্ছা, আমি দশমিনিট পরে ফোন করছি। স্নেহা কোথায় আর যাবে? আমি ভেবে তোমাকে জানাচ্ছি।”

” প্লিজ স্যার কিছু একটা করুন।”

” টেনশন কোরো না। অবশ্যই পাওয়া যাবে।”

আমীর ফোন রেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। স্নেহা কোথায় পালাতে পারে? পেছন থেকে শব্দ এলো,” এহেম, এহেম।”

আমীর ঘুরে দেখল তোহা ঠোঁট টিপে হাসছে। একটা মিষ্টি গন্ধে চারিপাশ ভরে উঠল। সবকিছু কেমন প্রাণবন্ত লাগল হঠাৎ করেই। বহুদিন পর মরুভূমিতে বৃষ্টি নামলে যেমন হয়, ঠিক তেমন। নিজের অনুভূতি ধামাচাপা দিয়ে আমীর ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল,” হাসছো কেন?”

তোহা বলল,” হাসছি আপনার অবস্থা দেখে।”

” আমার অবস্থা মানে?” নিজের দিকে তাকাল আমীর। তোহা কৌতুহল প্রকাশ করল,” একটা প্রশ্ন করব?”

” কি?”

” এখানে কেন এসেছেন?”

আমীর এই প্রশ্নে চমকালো,” মানে?”

” মানে হঠাৎ কি প্রয়োজনে ইটালি আসলেন? সেটাই জানতে চাইছি।”

” আমার এখানে একটা জরুরী কাজ ছিল।”

” কি সেই জরুরী কাজ?”

” একটা মিটিং। মিরানোতে আমার একজন ক্লায়েন্ট আছে। বিকালে আমরা তার বাসাতেই উঠবো। ভাবলাম তুমিও এই শহরে আছো তাই একবার দেখা করে যাই। আমার মনে ছিল না তোমার কথা। আফশান মনে করিয়ে দিল।”

তোহা এমন সাজানো-গোছানো মিথ্যা শুনে অভিভূত হয়ে বলল,” আমার কথা আপনার মনেই ছিল না?”

আফশানকেও দেখা গেল আমীরের সাথে তাল মিলিয়ে মাথা নাড়ছে। কি পল্টিবাজ! তোহা চোখ কুটি করে আফশানের দিকে তাকাল। আমীরের এই মাত্র মনে পড়ল, স্নেহা তার গ্রামের বাড়ি যেতে পারে। সেখানে একটা সিকরেট ফার্ম হাউজ আছে তার। সেই কথা রাশেদও জানে না। ব্যাপারটা মাথায় আসতেই আমীর রাশেদকে ফোন করার জন্য করিডোরের দিকে চলে গেল। তোহা এই সুযোগে চড়াও হলো আফশানের উপর।

” কি ব্যাপার আফশান ভাই? আপনি মিথ্যা বললেন কেন? উনি নাকি আমার জন্য এখানে এসেছেন?”

আফশান অপরাধী স্বরে বলল,” সত্যি বলছি ম্যাডাম। স্যার আপনার জন্যই এসেছেন। এখানে স্যারের কোনো মিটিং বা ক্লায়েন্ট নেই। আই সুয়্যার।”

” আমাকে খুশি করছেন না তো? তাহলে উনি বিকালে ক্লায়েন্টের বাড়িতে উঠবেন_ এটা কেন বললেন?”

” স্যার হয়তো হোটেলে উঠতে চাইছেন। সেজন্য বলেছেন।”

” কিন্তু উনি মিথ্যা কেন বলছেন? উনার এটা স্বীকার করতে প্রবলেম কি যে আমার জন্য এখানে এসেছেন?”

আফশান লাজুক মুখে বলল,” এটা কি সরাসরি বলা যায় ম্যাডাম? স্যারকে তো আপনি চেনেন।”

তোহাও লজ্জা পেল এবার। হালকা বিব্রত হয়ে বলল,” ও। আচ্ছা যাইহোক, আপনার স্যারের মুখ থেকে সত্যি কথা বের করতে হবে। নয়তো আমার শান্তি হবে না।”

” কিভাবে? স্যার ম-রে গেলেও স্বীকার করবে না।”

” অবশ্যই স্বীকার করবে।”

হঠাৎ স্মরণে আসায় তোহা জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা, উনি এখানে আসার সময় স্নেহা কিছু বলেনি? বাঁধা দেয়নি? সে তো জানে আমিও এই দেশে আছি।”

” স্নেহা ম্যাডাম কোথ থেকে আসবেন? উনি তো এখন নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। উনার তো বিয়ে হয়ে গেছে।”

আফশান এই কথা বলেই বত্রিশ পাটি বের করে হাসল যেন অনেক বড় কোনো সুসংবাদ জানাচ্ছে। এদিকে তোহা কিছু বুঝতে পারল না। চমকপ্রাপ্ত গলায় শুধাল,” বিয়ে হয়েছে মানে? স্নেহার বিয়ে? ”

আফশান সবঘটনা তোহাকে বিস্তারিত জানাল। এসব শুনে তোহা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা ভুলে গেল। তার হৃদয়ে অনাবিল আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়ল। দয়াময় তার প্রার্থনা কবুল করেছেন। এখন থেকে আমীরকে জ্বালাতন করার জন্য স্নেহা নামক বিভীষিকা আর থাকবে না। এর থেকে ভালো ব্যাপার আর কি হতে পারে? তোহা হাত তালি মেরে বলল,” স্নেহার সাথে সত্যি রাশেদ সাহেবের বিয়ে হয়ে গেল? এই বছরের সেরা সুসংবাদ এটা। সাধ্য থাকলে আমি এখনি আপনাকে একলাখ টাকা বকশিশ দিতাম।”

” বকশিশ লাগবে না। স্যারের জীবন থেকে স্নেহা ম্যাডাম দূর হয়েছেন এটাই আমার সবচেয়ে বড় বকশিশ।”

তোহা এই কথায় শব্দ করে হেসে উঠল। একইসাথে আফশানও হাসতে লাগল। হঠাৎ আমীরের আগমনে তারা দু’জনই চুপ হয়ে গেল। আমীর বলল,” বের হতে হবে আফশান। দেরি হচ্ছে আমাদের। শাহিদের ব্যাপারটা মনে আছে?”

আফশান সিরিয়াস হয়ে বলল,” হুম, হুম স্যার। চলুন।”

” মানে? কোথায় যাবেন?” তোহা প্রশ্ন করল উৎকণ্ঠা নিয়ে।

আমীর বলল,” কাজ আছে।”

” এখনি চলে যাচ্ছেন? ফুপু, ফুপু!”

তোহার ডাকে জাবিদা ও কথা প্রায় ছুটে এলো। জাবিদা জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে?”

” দেখো ওরা চলে যাচ্ছে।”

মহাসর্বনাশ হয়ে গেছে এমনভাবে উত্তেজিত হয়ে জাবিদা বলল,” ওমা, কেন যাচ্ছেন? আপনাদের ডিনার না করিয়ে আমি ছাড়ছি না। ”

কথা মলিন মুখে বলল,” হ্যাঁ তাইতো। মা কত আয়োজন করছেন আপনাদের জন্য।”

আমীর ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে জানাল,” আসলে আমাদের খুব জরুরী একটা কাজ আছে। এখনি না গেলে সমস্যা হয়ে যাবে।”

জাবিদা অটলভাবে বলল,” হোক সমস্যা। কোথাও বের হতে পারবেন না এখন। আপনারা কত উপকার করেছেন তোহার। আচ্ছা, জাবিদের সাথে আপনার কয়বছরের বন্ধুত্ব ছিল? ”

আফশান বলল,” দশবছর।” একই সময় আমীর বলল,” দুইবছর।” তারপর দু’জনই চমকে উঠল, বিব্রত হলো।

কেউ অবশ্য তাদের উত্তরের পার্থক্য খেয়াল করল না। তোহা হেসে বলল,” কয়বছরের বন্ধুত্ব তা দিয়ে কি যায়-আসে ফুপু? আসল কথা হচ্ছে বাবা উনাকে অনেক ভরসা করতো। ঠিক বললাম না আমীর সাহেব?”

আমীর ছোট্ট করে উত্তর দিল,” হুম।”

জাবিদা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুব আনমনা হয়ে বলল,” আমার ভাই সহজে কাউকে বিশ্বাস করতো না। তোহা ছিল তার কলিজার টুকরো। নিজে এতো কষ্ট করেছে সারাজীবন তাও মেয়ের ব্যাপারে এতোটুকু রিস্ক নেয়নি কখনও। সেখানে আপনাকে ও তোহার দায়িত্ব দিয়ে গেছে মানে বিরাট কিছু। আপনি নিশ্চয়ই জাবিদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন, তাই না?”

জাবিদার চোখ টলমল হয়ে এলো আবেগে। ভাইয়ের কথা ভেবে হঠাৎ কান্না পাচ্ছে। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে লাগল। আমীর কি বলবে খুঁজে পেল না। জাবিদ সাহেব তোহার দায়িত্ব আমীরের কাছে দিয়ে গেছেন তবে ভরসা করে নয়, বাধ্য হয়ে!

” আপনারা যান। জরুরী কাজটা বরং সেরেই আসুন। কিন্তু আবার আসবেন তো?” জাবিদা এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন একবার ছেড়ে দিলে তারা আর ফিরবে না। আমীর মৃদু হেসে বলল,” আসব।” এই কথা বলেই সে তোহার দিকে তাকিয়ে রইল। তোহা হাসছে।

আলিফ বলল,” চলুন আমি তাহলে আপনাদের এগিয়ে দেই।”

তারা সবাই একসাথে বের হলো। তোহা এসে তার ফুপুকে জড়িয়ে ধরল। জাবিদা ফিসফিস করে বলল,” ছেলেটা খুব চমৎকার। তুই এই ছেলেকে বিয়ে কর। তোর বাবার পছন্দের পাত্র।”

তোহা লজ্জা পেয়ে বলল,” ছি, কি যে বলো না আবোল-তাবোল! উনি তো আগেই বিবাহিত। যদিও এখন ডিভোর্স হয়ে গেছে।”

জাবিদা এই কথা শুনে হতাশ হলো। আফসোস করে বলল,” কি বলিস! এমন সুন্দর একটা ছেলের বিয়ে হয়ে আবার ডিভোর্সও হয়ে গেল?”

তোহা মুখ টিপে হেসে বলল,” কেন? সুন্দর ছেলেদের কি ডিভোর্স হওয়া নিষেধ?”

জাবিদা ভালো করে তোহার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,” তুই হঠাৎ করে এতো খুশি হয়ে গেলি কেন? কি হয়েছে তোর?”

“আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ফুপু।”

” কি সিদ্ধান্ত?”

” পরে বলব। ডিনারে যখন সবাই একসাথে বসবে, তখন ঘোষণা করব।”

জাবিদা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। তোহা রহস্যময়ীর মতো আচরণ করছে। সে আমীরদের বিদায় জানাতে ধীরপায়ে হেঁটে করিডোরের দিকে গেল। তখন দেখল আফশানের সাথে কেবল আলিফ হাঁটছে। আমীর নেই কেন? সে এদিকে-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগল। তখনি কেউ পেছন থেকে হাত টেনে নির্জনে নিয়ে এলো তাকে। হঠাৎ এমন ঘটনায় তোহা ঘাবড়ে গেল। বুকে থু দিয়ে বলল,” কি করছেন এসব?”

আমীর কঠোরভাবে প্রশ্ন করল,” সত্যি কথা বলো, কালরাতে কি হয়েছিল?”

তোহা বুঝতে পারল না, কোন ঘটনার কথা জানতে চাইছে আমীর? আলিফের ব্যাপারে কিছু না তো? কিন্তু সেই ব্যাপারে তো আমীরের জানার কথাই নয়৷ তোহা কোনমতে উচ্চারণ করল,” মানে?”

” তুমি ছাদে উঠে সুইসাইড করতে যাওনি কাল?”

” এসব কথা আপনি কিভাবে জানলেন?”

” যেভাবেই জানি সেটা ফ্যাক্ট না। কিন্তু তুমি এমন কেন করবে? এখানে এসে তোমার কি এমন হলো যে এইরকম একটা কাজ করতে যাচ্ছিলে? মায়া আমাকে সবকিছু বলো প্লিজ। এরা তোমার সাথে কি করেছে?”

তোহা খানিক রেগে বলল,” আপনার তাতে কি? কেন আমাকে নিয়ে এতো মাথা ঘামাচ্ছেন আপনি? যদি আমি ম-রেও যাই তাতেও বা আপনার কি? ”

” মায়া!”

আমীর এতো রেগে তাকাল যে তোহা চুপসে গেল। মাথা নিচু করে নরম স্বরে বলল,” আমি আপনার কে হই যে এতো ভাবছেন আমাকে নিয়ে?”

আমীর তোহার বাহু শক্ত করে ধরেছিল এতোক্ষণ। এই প্রশ্নের পর সে বাহু ছেড়ে দিল। একটু সময় চুপ থেকে স্পষ্ট করে বলল,” ইউ আর মাই রেসপন্সিবিলিটিজ।”

রেগে আগুন হয়ে গেল তোহা। ঝলসানো দৃষ্টিতে বলল,” দয়া করে আমার উপর দয়া দেখানো বন্ধ করুন, প্লিজ।আমি কারো রেসপন্সিবিলিটিজ হতে চাই না। নিজেকে সামলানোর জন্য আমি নিজেই যথেষ্ট। আপনার প্রটেকশন আমার কোনো প্রয়োজন নেই।”

আমীর পকেটে হাত রেখে অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলল,” ওকে।” তারপর হেঁটে চলে গেল। তোহা চোখের কার্ণিশে জমে থাকা জলটুকু মুছল এবার। বিড়বিড় করে বলল,” কিছুতেই স্বীকার করবেন না আপনি। কিন্তু আমিও হার মানব না৷ আপনার মুখ থেকে সত্যি কথা বের করেই ছাড়ব। এটা আমার চ্যালেঞ্জ।”

চলবে