#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৪৩.
আকাশে ঘন, কালো মেঘ জমেছে। তোহা উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তারাশূন্য আকাশের দিকে। আজ-কাল মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখলেই তার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সে অধীর হয়ে অপেক্ষায় থাকে একটি তারা ভরা রাতের জন্য। যে রাতে সে বিশাল আকাশের দিকে চেয়ে তারাদের মাঝে হারিয়ে যাবে। হাজার তারার মাঝে একটা বিশেষ তারাও আছে যার নাম দেওয়া হয়েছে-বাবা।
জাবিদা পেছনে এসে দাঁড়াল। জানালার বাইরে মুখ দিয়ে কেমন আনমনা হয়ে বসে আছে তোহা। হঠাৎ করেই জাবিদার মনে হলো, পাত্রপক্ষ আসেনি বলে তোহার মনখারাপ। সে একহাতে তোহার বাহু স্পর্শ করে বলল,” মনখারাপ করিস না, মা।”
ফুপুর কণ্ঠ শুনে তোহা দ্রুত চোখের কোণ মুছে ফেলল। হাসার ভাণ করে বলল,” মনখারাপ কোথায়? আমি একদম ঠিকাছি ফুপু।”
জাবিদা বিরস মুখে উচ্চারণ করল,” তুই বলতে না চাইলেও আমি জানি। ওরা আসেনি বলে তুই ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেয়েছিস।”
তোহা ভ্রু কুচকালো,” কাদের কথা বলছো?”
” রাফায়েত, তোকে দেখতে আসার কথা ছিল যার।”
হেসে ফেলল তোহা। স্পষ্ট করে বলল,” একদম না ফুপু। এই বিষয়টা তো আমি ভুলেই গেছি। আর এই নিয়ে আমার কষ্ট পাওয়ার কি আছে? বরং যে আসেনি তার কপাল পুড়েছে। ”
” কপাল পুড়েছে কেন?”
” আহা, আমার মতো সুন্দরী বউ মিস হয়ে গেল না?” তোহা এই কথা বলে খিলখিল করে হেসে উঠল। জাবিদাও হেসে ফেলল।
তোহা ফুপুর কাঁধে মাথা রেখে বলল,” আমি অনেকক্ষণ ধরে একটা কথা চিন্তা করছি ফুপু। ব্যাপারটা তোমাকে বলব কি-না সেটাই ভাবছি। তুমি হয়তো এর উত্তর জানো।”
” কি কথা? বলতো।”
তোহা মাথা তুলে সরাসরি জাবিদার চোখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,” ফুপা আমাকে দেখতে পারে না কেন?”
” এ আবার কেমন কথা? তোকে এই কথা কে বলল?”
” ফুপা নিজেই বলেছে।”
জাবিদা সামান্য অপ্রস্তুত হলো এবার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” বুঝেছি। এতো বয়স হওয়ার পরেও লোকটার বিবেক-বুদ্ধি হয়নি। তোর মতো বাচ্চা মেয়ের সাথে রাগ দেখানোর কি আছে আমি বুঝি না।”
” কি নিয়ে রাগ দেখাচ্ছে ফুপা? বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চায়নি বলে?”
” ঠিক সেজন্য নয়। এসব কথা জেনেই বা কি করবি? বাদ দে না!”
” আমি শুনতে চাই।” তোহার কণ্ঠে দৃঢ়তা। সে যথেষ্ট জেদী। একবার যখন বলেছে শুনবে তার মানে শুনবেই। জাবিদা বাধ্য হয়ে বলল,
” তোর বাবা খুব নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসার ছিল। কখনও কারো কাছে মাথা নত করেনি। শুধু একবার একটা প্রয়োজনে তোর ফুপার থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছিল। বলেছিল সময়মতো শোধ করবে। কিন্তু তোর ফুপা টাকার বিনিময়ে তোকে চেয়েছিল। তারপর থেকেই শালা আর দুলাভাইয়ের মধ্যে নীরব দ্বন্দ্ব শুরু হয়। টাকার বিনিময়ে তোকে পুত্রবধূ হিসেবে চাওয়ায় তোর বাবার আঁতে ঘা লাগে। সে নিজের মেয়েকে বিক্রি করবে না। এই নিয়ে তাদের মধ্যে বিরাট ঝগড়া হয়। জাবিদ আলিফের বাবাকে খুব অপমান করে কথা বলেছিল। তারপর সে রাতদিন পরিশ্রম করে ধারের টাকা শোধ করেছে। কিন্তু সেই অপমান তোর ফুপা এখনও গায়ে মেখে বসে আছে। আমার মনে হয় এ কারণেই তোর সঙ্গে সে দূর্ব্যবহার করছে।”
” ধারের টাকা সত্যি শোধ হয়েছিল তো ফুপু?”
জাবিদা ইতস্তত করে বলল,” কিছু বাকি আছে। তোর বাবা বেঁচে থাকলে সেটাও শোধ হয়ে যেতো।”
” কত বাকি ছিল?”
জাবিদা হকচকিয়ে গেল। তোহার মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে ইতোমধ্যে। তাকে খুব রাগান্বিতও দেখাচ্ছে। জাবিদা নরম গলায় বলল,” তুই এভাবে প্রশ্ন করছিস কেন? কত বাকি ছিল তা দিয়ে তুই কি করবি? জাবিদ ম-রে গেছে। এখন কি তার ধারের টাকার হিসাব নিয়ে আমি বসে আছি? আমাকে কি এতোই খারাপ মনে হয় তোর?”
তোহা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আগের চেয়েও কড়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” ধারের টাকা কত বাকি ছিল ফুপু? তুমি যদি না বলো তাহলে আমি এখনি ফুপার কাছে যাবো।”
জাবিদা দ্রুত বলল,” পাঁচলাখ টাকা বাকি ছিল।”
তোহা আর কিছু না বলে সোজা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। জাবিদা ভয়ে অস্থির হয়ে নিজেও তোহার পিছু নিল। তোহা একেবারে থামল মাহমুদ সাহেবের ঘরের সামনে এসে। দরজায় কড়া নাড়ল। ভারী কণ্ঠে ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,” কে?”
” আমি। আসতে পারি?”
” কি দরকার?” মাহমুদ সাহেবের কণ্ঠ থেকে বিরক্তি ঝরে পড়ল। তোহা কোনো উত্তর না দিয়ে সরাসরি ঘরে ঢুকে পড়ল ভেতরে। জাবিদাও তার পেছনে এসেছে। সে কিছু বলার আগেই তোহা খুব রূঢ় স্বরে বলল,” আপনার পাঁচলাখ টাকা আপনি খুব দ্রুত পেয়ে যাবেন। আমি শোধ করব।”
” তাই নাকি?”
” হ্যাঁ তাই। আমার মৃ-ত বাবা ঋণের বোঝা নিয়ে পরপারে অশান্তিতে থাকবে সেটা আমি হতে দিবো না। আপনার ঋণ শোধ করে আমি বাবার আত্মাকে শান্তি দিবো।”
জাবিদা অসহায় গলায় বলল,” ছি, ছি, এসব কেমন কথা? আমরা কি টাকার দাবী রেখে দিয়েছি নাকি? তোকে শোধ করতে হবে না। তুই…”
মাহমুদ জাবিদাকে থামিয়ে বললেন,” টাকার মালিক তুমি না, টাকার মালিক আমি৷ তাই দাবী ছাড়লে আমি ছাড়বো। আবার দাবী রাখলেও আমিই রাখবো। তোহা নিজে থেকে যখন শোধ করতে চাইছে, তাহলে করুক। আমিও দেখি। তোমাকে একমাস সময় দেওয়া হলো।”
মাহমুদ সাহেব তোহার দিকে তাকালেন ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে। তিনি নিশ্চিত তোহা এটা কখনোই পারবে না। তাঁর অহংকার বজায় থাকবে। আর তোহা মাথা নত করে ক্ষমা চাইবে। দয়া ভিক্ষা চাইবে৷ এতেই তার ইগো সেটিসফাইড হবে।
” এসব তুমি কি বলছো? ও বাচ্চা একটা মেয়ে। একমাসের মধ্যে এতোটাকা কোথায় পাবে?” জাবিদা করুণ গলায় আর্তনাদ করল। মাহমুদ চোয়াল শক্ত করে বললেন,” সেটা আমাকে চ্যালেঞ্জ করার আগে ভাবা উচিৎ ছিল।”
তোহা দৃঢ়চিত্তে বলল,” চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড।”
_______________
ফ্লোর থেকে স্নেহার শাড়ি তুলে প্রথমেই গুলজারের দুইহাত পেছনে নিয়ে বাঁধল রাশেদ। অতঃপর তার নাকে-মুখে এলোপাতাড়ি পাঁচটা ঘুঁষি দিল। দরজার বাইরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে স্নেহা তৃপ্তির সঙ্গে এই দৃশ্য দেখছে। সে মনে-প্রাণে চাইছে রাশেদ যেন গুলজারকে মে-রে ফেলে আজ।
মা-র খেয়ে ক্লান্ত গুলজার শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” আমার কথা শোনো রাশেদ। তুমি অনেক বড় ভুল করছো।”
রাশেদ খুব অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে বলল,” আমার বউয়ের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস তোর কিভাবে হয়? আজকে তোকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব আমি। কেউ বাঁচাতে পারবে না।”
গুলজার হেসে উঠল। গা জ্বালানো হাসি। রাশেদের তীক্ষ্ণ মেজাজ আরও তীক্ষ্ণ হলো। সে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে গুলজারকে আঘাত করল। নাকে-মুখে র-ক্তের স্রোত নিয়ে গুলজার উচ্চারণ করল,” কে বউ? ও কারো বউ হতে পারে না। যদি সত্যিই তোমার প্রতি ভালোবাসা থাকতো বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছিল কেন তোমাকে ছেড়ে?”
গুলজারের কথা শুনে রাশেদ সামান্য অবাক হয়ে স্নেহার দিকে তাকাল। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে ফেলল স্নেহা। সে ভুল করেছে আর ভুলের জন্য অনুতপ্ত বোধ করছে। কিন্তু সেটা রাশেদকে কিভাবে বোঝাবে? রাশেদ বলল,” যেটাই করুক। ও আমার স্ত্রী। ওর দিকে কেউ তাকালে আমি তার চোখ উপড়ে ফেলব।”
স্নেহা ফুঁপিয়ে উঠল। গুলজার তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,” ও একটা কালসাপ। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই তোমাকে ছোবল মা-রবে।”
” সেটা আমি বুঝবো। তোর এই বিষয়ে চিন্তা করতে হবে না গুলজার। তুই নিজের চিন্তা কর।”
” কিন্তু আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। ভেবে দেখো রাশেদ, এই মহিলাকে তুমি কিসের ভিত্তিতে বিশ্বাস করছো? তুমি কি জানো সে আমাকে কি নির্দেশ দিয়েছিল? সে বিদেশে যাওয়ার পর যেন আমি তোমাকে খু-ন করি। এরপরেও তুমি ওর হয়ে সাফাই গাইবে? আর কত প্রেমে অন্ধ থাকবে রাশেদ? একটু মাথাটা খাটাও। ও আসলে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। তোমাকেও ও বুঝবে না।”
স্নেহা চোখ বড় করে তাকাল মিথ্যুক গুলজারের দিকে। রাশেদকে হ-ত্যা করার কোনো ইচ্ছাই স্নেহার ছিল না। তবে এটা ঠিক যে সে রাশেদের থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। সেজন্যই বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু গুলজার এখন বানিয়ে বানিয়ে এসব মিথ্যা কেন বলছে? রাশেদ তো সহজেই তার মিথ্যা বিশ্বাস করে ফেলবে!
রাশেদ আহত দৃষ্টিতে স্নেহার দিকে চেয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” সত্যি? আমাকে মা-রার এতো শখ তোমার?”
তারপর কিছুটা এগিয়ে এসে কঠিন গলায় বলল,” তাহলে গুলজারের হাতে কেন? ম-রলে তোমার হাতেই ম-রব আমি। খু-ন করো আমাকে।”
স্নেহার চোখ টলমল করছে। স্থির দাঁড়িয়ে রইল সে। মাথা তুলে তাকাল পর্যন্ত না। গুলজার উঁচু কণ্ঠে বলল,” এখন ও তোমাকে মা-রবে না। কারণ তুমি ওর রক্ষাকবচ। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।”
রাশেদ স্নেহার দিকে প্রত্যাশা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। স্নেহা অন্তত কিছু একটা বলুক। সে যাই বলবে রাশেদ সেটাই বিশ্বাস করবে। সে শুধু সান্ত্বনা চায়। কিন্তু স্নেহা কোনো কথা বলল না।
গুলজার বলল,” তুমি অনেক বড় ভুল করবে যদি ওকে বাঁচাও। ও আজ নাহয় কাল তোমাকে অবশ্যই খু-ন করবে। সেজন্যই বলছি বাঁচতে চাইলে চলো আমরা ওকে মে-রে ফেলি। ”
ভয়ে স্নেহার চোখমুখ অন্যরকম হয়ে গেল। সে আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল,” বিশ্বাস করো রাশেদ, আমি তোমার ক্ষতি চাই না। গুলজার মিথ্যা বলছে। তুমি ওর কথা বিশ্বাস কোরো না।”
এবার গুলজার শয়তানী হাসি দিয়ে বলল,” দেখলে, এতোক্ষণ মুখ খুলছিল না। যখনি আমি ওকে মা-রার কথা বললাম তখনি তোমার মন গলানোর জন্য নাটক শুরু করল। এই মায়া কান্না দেখে ভুলে যেও না৷ তাহলে তোমারই ক্ষতি। আমি সাবধান করছি।”
স্নেহা রাগে চেঁচিয়ে বলল,” চুপ। আরেকটা কথা উচ্চারণ করলে তোকে জ্যান্ত কবর দিবো আমি। জানোয়ার!”
স্নেহা এগোতে নিলেই পেছনের ছেলেগুলো তাকে জাপটে ধরল। গুলজার সহাস্যে উচ্চারণ করল,” আমাকে তো আপনি চেনেন ম্যাডাম। আমি জাত হারামি ছিলাম, এখনও আছি। ওরা সবাই আসলে আমারই লোক। আপনাকে শায়েস্তা করার জন্য ওদের এনেছি। আমি ইশারা দিলেই ওরা আপনাকে মা-রবে নয়তো বাঁচিয়ে রাখবে।”
রাশেদ এই কথা শুনে ভড়কে গেল। সে অন্ধকারে ফার্ম হাউজের রাস্তা খোঁজার জন্য ছেলেগুলোর সাহায্য নিয়েছিল। কিন্তু এরা যে গুলজারের হয়ে কাজ করছে তা ঘূণাক্ষরেও টের পায়নি।
গুলজার আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,” কিছুক্ষণ পর রাশেদও আমার দলে চলে আসবে। তারপর আপনাকে বাঁচানোর আর কেউ থাকবে না ম্যাডাম। আমিও দেখবো আপনি কিভাবে নিজেকে রক্ষা করেন।”
স্নেহার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা চারটি ছেলে হেসে উঠল। আশান্বিত দৃষ্টি নিয়ে স্নেহা তাকালো রাশেদের দিকে। দুনিয়া উল্টে গেলেও রাশেদ তার ক্ষতি করবে না। এই বিশ্বাস এখন স্নেহার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। তাই সে খুব ভরসা মাখা কণ্ঠে বলল,” আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো রাশেদ, প্লিজ।”
স্নেহার ভরসাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে রাশেদ দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” অসম্ভব। তুমি আসলেই একটা কালসাপ স্নেহা। তোমাকে বিশ্বাস করলে আমি আবার ভুল করব। তার চেয়ে ভালো গুলজার ভাই যা চায় তাই হবে। ভাই, বলুন আপনি কি চান?”
এই কথা বলেই গুলজারের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসল রাশেদ। স্নেহা স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মাথার মধ্যে বিকট শব্দ হলো। সে দুঃস্বপ্ন দেখছে না তো? সত্যিই কি রাশেদও তার হাত ছেড়ে দিবে?
গুলজার উল্লাসিত কণ্ঠে বলল,” এই না হলে আমার ভাই! দেরিতে হলেও বুঝলা। আমি শুধু ম্যাডামকে চাই।”
বাকি ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলল,” আমাদের কি হবে ওস্তাদ? আমরা কি কিছু পাবো না?”
” অবশ্যই পাবি। কে বলল পাবি না? আমার পরে তোরাও সুন্দরী ম্যাডামের সাথে আয়েশ করবি।”
সবার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আর স্নেহার গা গিনগিন করতে লাগল। গুলজার অসভ্যের মতো হেসে বলল,” আর রাশেদ ভাই, তুমি বসে বসে দেখবা কেন? ইচ্ছে হলে নিজের বউয়ের সাথেই আরও একবার…”
কথা শেষ না করে চোখ টিপল সে। রাশেদের শরীরের রক্ত ফুটন্ত গরম পানির মতো টগবগ করতে লাগল।
” এখন থেকে শুরু করে কাল সারাদিন আমরা আয়েশ করব। স্নেহা ম্যাডাম আমাদের নাচ দেখাবে, গান শোনাবে, ঘুম পাড়াবে। তারপর রাতে তাকে খু-ন করে মাটিতে লাশ পুঁতে আমরা এখান থেকে চলে যাবো। মামলা ডিশমিশ। বলো সবাই রাজি?”
গুলজারের দৃষ্টি চকচক করছে। স্নেহা ভয়ে কাঁপতে লাগল৷ ছেলেগুলো উল্লাসে চেঁচিয়ে জানাল, তারা রাজি। এমনকি রাশেদও মাথা নেড়ে বলল,” রাজি।”
স্নেহা কেমন পাথরের মতো জমে গেল৷ নিজের মৃত্যুর অপেক্ষা করা ছাড়া এখন তার কাছে আর অন্যকোনো পথ খোলা নেই। নিয়তি কি এতোই নিষ্ঠুর? এমনটাই কি হওয়ার ছিল তবে? এতো ভয়ংকর!
_____________
গভীর রাত। জাবিদা পাশ ফিরে দেখল, তোহা পাশে নেই। সে চমকে শোয়া থেকে উঠে বসল। আশেপাশে চোখ বুলিয়েও তোহাকে কোথাও পেল না। বাথরুমের দরজা বন্ধ। বাইরে খুব বর্ষণ হচ্ছে। এই অন্ধকার বৃষ্টির রাতে মেয়েটা একলা কোথায় গেল? দুশ্চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা হলো। জাবিদার মাথা ঘুরছে। সে কোনোমতে হেঁটে আলিফদের ঘরে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল। কথা ঘুমে বিভোর৷ দরজা খুলল আলিফ।
” কি হয়েছে মা?”
জাবিদা ক্লান্ত এবং চিন্তিত কণ্ঠে বলল,” তোহাকে কোথাও পাচ্ছি না, বাবা।”
” মানে? কি বলছো এসব?”
” হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি পাশে নেই। বাথরুমেও নেই। এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যেতে পারে বলতো?”
” ছাদে খুঁজেছো?” আলিফকে তুমুল বিচলিত দেখাচ্ছে। জাবিদা অবাক হয়ে বলল,” ছাদে কেন যাবে? বাইরে বৃষ্টি না?”
আলিফ কোনো উত্তর না দিয়ে দ্রুত ছাদে উঠল। কিন্তু তোহাকে সেখানেও পাওয়া গেল না৷ আলিফের মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত নিচে নামল সে। জাবিদা সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল,” পেয়েছিস?”
” না৷ ছাদেও নেই। বাইরে কোথাও গেছে হয়তো।”
জাবিদা কাঁদতে কাঁদতে বলল,” মেয়েটা কি আমাদের ছেড়ে চলে গেল অভিমান করে?”
” অভিমান করে মানে? আবার কিছু হয়েছিল নাকি?”
জাবিদা আজকে সন্ধ্যার ঘটনা খুলে বলতেই আলিফ মাত্রাতিরিক্ত রেগে বলল,” কি দরকার ছিল ওকে এইসব জানানোর? তুমি জানো না, তোহা তার বাবার প্রতি কতটা সেন্সিটিভ! শিট মা, এটা কি করলে? না তোমার কোনো বুদ্ধি আছে আর না বাবার কোনো বিবেক আছে।”
” আমি বুঝিনি বাবা যে এতোকিছু হয়ে যাবে। এখন কি হবে?”
” দেখছি। আজাদকে ঘুম থেকে তুলে দু’জন মিলে খুঁজতে বের হবো। আল্লাহই জানে কোথায় গেছে মেয়েটা। ওর কিছু হলে বাবাকেও আমি ছাড়ব না। মনে রেখো।”
আলিফ ঝড়ের গতিতে ঘর থেকে বের হলো। আজাদ ঘুমায়নি। সে তখন জেগেই ছিল। মাত্র কিছুক্ষণ আগেই তোহাকে মেইন গেইট টপকে বের হতে দেখেছে সে। তার কাঁধে ছিল একটা ব্যাগ, হাতে ছাতা, গায়ে জিন্স আর টি-শার্ট। আজাদ ভেবেছিল তোহাকে অনুসরণ করবে। কিন্তু সেও তোহার সাথে চলে গেলে বাড়ির সবাই সন্দেহ করতে পারে। তাই সে আমীরকে ফোন করেছে৷ আমীর বলেছিল সে পাঁচমিনিটের মধ্যে আসবে।
আজাদকে জাগ্রত দেখে আলিফ সামান্য অবাক হলো।
” এখনও ঘুমাওনি তুমি?”
” না স্যার, আমি একটু দেরি করে ঘুমাই।”
” ঠিকাছে গাড়ি বের করো। এখনি বের হতে হবে।”
আজাদ জানে আলিফ এখন কোথায় বের হবে। তাও সে জিজ্ঞেস করল,” কিছু কি হয়েছে স্যার?”
আলিফ চিন্তিত গলায় বলল,” তোহাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
আজাদ আৎকে ওঠার ভাণ করল। যদিও সে খুব ভালো করেই জানে, তোহা আমীরের কাছে বেশ সুরক্ষিতই থাকবে। তাকে খুঁজে বের করার কোনো প্রয়োজনই নেই। তবুও সে আলিফের সাথে গাড়ি নিয়ে বের হলো।
_____________
উদ্দেশ্যহীনভাবে ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটছে তোহা। বৃষ্টির জলের সাথে তার চোখের জল মিশে একাকার হচ্ছে। সে জানে না এই অন্ধকার রাতে কোথায় যাবে! তার কাছে বেশি টাকাও নেই। তবে একটা স্বর্ণের আংটি আর চেইন আছে৷ এগুলো বিক্রি করে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিবে নাকি সেটাই ভাবছে। ওই বাড়িতে আর থাকা সম্ভব নয়। আচমকা একটা বড় গাড়ি এসে তোহার সামনে থামল। চমকে উঠল তোহা। গাড়ি থেকে বের হলো আমীর। তার গাঁয়ে ধূসর পোলো টি-শার্ট, চোখে চশমা যা বৃষ্টির পানিতে ঝাপসা হয়ে উঠেছে। তোহা কয়েক কদম পিছিয়ে বলল,” আপনি এখানে কি করছেন?”
আমীর কোমরে হাত গুঁজে শাসনের সুরে বলল,” গাড়িতে উঠো।”
” অসম্ভব। আমি উঠব না। আপনি এখান থেকে চলে যান।”
তোহা এই কথা বলেই দ্রুত আমীরকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইল৷ আমীর শক্ত করে তার হাতটা ধরে ফেলে বলল,” রাস্তার মধ্যে সিন ক্রিয়েট করবে না৷ গাড়িতে উঠতে বলেছি তোমাকে।”
” উঠব না। কি করবেন?”
আমীর তার কপালের ভেজা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে রুক্ষ গলায় বলল,” তুমি দেখতে চাও কি করব?”
তোহা ভয় পেল। আমীর যদি রাস্তার মাঝখানে তাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে ওঠায় তাহলে ব্যাপারটা মোটেও ভালো দেখাবে না। অবশ্য এই অন্ধকার রাস্তায় তাদের দেখার মতো কেউ নেই। তোহা দাঁতে দাঁত চিপে বলল,” আমার হাত ছাড়ুন। ভালো হবে না।”
আমীর হঠাৎ খুব উদগ্রীব হয়ে বলল,” তোমার গা গরম কেন?”
সঙ্গে সঙ্গে নিজের শীতল হাত তোহার উত্তপ্ত কপালে ঠেঁকালো সে। সত্যিই জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। আমীর বিচলিত কণ্ঠে বলল,” গায়ে এতো জ্বর নিয়ে তুমি রাস্তায় হাঁটছো? মাথা ঘুরে পড়ে গেলে কি হবে মায়া?”
তোহা কাঁদতে শুরু করল,” কেন আসলেন আপনি আমার জীবনে? এর চেয়ে না আসাই তো ভালো ছিল।”
আমীর আর দেরি করল না। তোহাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে তুলল। তোহা আমীরের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আমাকে মে-রে ফেলুন প্লিজ। আমি এই জীবন চাই না। ঘৃণা করি নিজের জীবনকে। এতো দূর্ভাগ্য নিয়ে কেন জন্মালাম আমি?”
” এরকম কথা আর কখনও বলবে না। তোমার সব সমস্যার সমাধান করে দিবো আমি। তুমি শুধু আমাকে একবার বলো, কি হয়েছে তোমার?”
” সত্যি আমার জন্য সব করতে পারবেন?”
” একবার বলেই দেখো পারি কি-না!”
তোহা খুব আকুতি নিয়ে বলল, ” আমাকে ভালোবাসতে পারবেন প্লিজ?”
আমীর থমকে গেল। তার হাত দু’টো অসাড় হয়ে এলো। তোহাকে সিটে বসিয়ে গম্ভীরমুখে উঠে দাঁড়ালো চুপচাপ। জ্বরের ঘোরে তোহা আরও প্রলাপ বকতে লাগল,” আপনার সাথে থাকলে পৃথিবীটা আমার কাছে রঙিন মনে হয়। আপনিই আমার সব ভালোলাগার উৎস। আপনার মধ্যে আমি আমার বাবাকে খুঁজে পাই৷ এর চেয়ে বড় পাওয়া একটা মেয়ের জন্য আর কি হতে পারে বলুন? প্লিজ, আমাকে ছেড়ে কখনও যাবেন না আপনি৷ কথা দিন!”
তোহা কথা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। আমীরের মনে হলো একমুহূর্তের জন্য তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, হৃৎস্পন্দন থেমে আসছে, পৃথিবী খুব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে…
চলবে
®Sidratul মুন্তায
#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৪৪.
বিষাক্ত নীরবতা ছাপিয়ে বিকট শব্দে বজ্রপাত শোনা গেল। মেঘে মেঘে ঘর্ষণ লেগে আলোকিত হলো আকাশ। সেই এক ঝলক আলোয় ক্ষণিকের জন্য আমীর দেখতে পেল তোহার কান্নাভেজা করুণ মুখটি। বুকের বামপাশে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেল তখনি। এতোদিন তো শুধু নিজের অনুভূতির সাথে যুদ্ধ করেছে সে। এখন তোহার অব্যক্ত অনুভূতির কথা জানতে পেরে পৃথিবী অন্ধকার বোধ হচ্ছে। ভূমিকম্প শুরু হয়েছে হৃদয়ে। তোহার মন ভাঙার মতো গুরুতর অপরাধ সে করতে পারবে না। অথচ তাকে গ্রহণ করার ক্ষমতাও নেই। কত অপারগ সে, কত অসহায়! জীবন তাকে নিয়ে এ কেমন খেলা খেলছে!
আমীরকে মূর্তির মতো স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাড়িয়ে রাখা হাতটা গুটিয়ে ফেলল তোহা। বামহাতে চোখের জল মুছতে মুছতে খুব ঠান্ডা গলায় বলল,” থাক, কথা দিতে হবে না আপনাকে। অন্তত নিজের মনের কথাই বলুন। আমার প্রতি কি আপনার এতোটুকুও অনুভূতি তৈরী হয়নি? কখনও একবারের জন্যেও কি আমাকে ভালোবাসেননি?”
আমীর বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল। তার নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসছে বিষাক্ততা। অপরাধবোধের তিক্ততা। সে শান্ত গলায় উচ্চারণ করল,” এখন এসব কথা বলার সময় না।”
” তাহলে কখন সময়? আমি আর কত অপেক্ষা করব?আপনি কি চান আমাকে মে-রে ফেলতে? এই মুহূর্তে আপনাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন সেটা কেন বুঝতে পারছেন না? আপনাকে এখনি সব বলতে হবে। এই মুহূর্তে বলতে হবে।”
তোহা খুব ক্ষেপে উঠল৷ আমীরের টি-শার্টের কলার টেনে তাকে কাছে এনে কাটা কাটা গলায় প্রশ্ন করল,” বলুন মিস্টার আমীর, কি চান আপনি আমার কাছে? কেন বার-বার আমার সামনে আসেন?আমার বিপদে সবকিছু তুচ্ছ করে ছুটে আসেন কেন? মুখে বলেন এক কথা অথচ কাজ করেন ভিন্ন। এসব কেন? আপনার উদ্দেশ্যটা কি?”
আমীর তোহার চোখের দিকে তাকাল না। ওই চোখে তাকিয়ে মিথ্যা বলা অসম্ভব। দৃষ্টি নত রেখে রোবটের মতো শক্ত গলায় বলল,” তোমার বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, সবসময় তোমার খেয়াল রাখব।”
তোহা বিস্মিত হলো, আহত হলো, ভীষণ কষ্টে জর্জরিত হয়ে আওড়াল,” শুধু বাবাকে দেওয়া কথা রাখার জন্য এসব করছেন? ”
পরমুহূর্তেই খুব তেজ নিয়ে জানতে চাইল,”তাহলে বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় ওইরাতে, রানু আন্টির বাড়িতে আমাকে কিস করেছিলেন কেন? সেটাও কি বাবাকে দেওয়া কথা রাখার জন্য? ”
আমীর নিশ্চুপ। সেটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। ওই ভুলের মাশুল দেওয়া এতো কঠিন হবে তা কে জানতো? তোহা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,” নাকি মেয়েদের চুমু দেওয়া আপনার কাছে কোনো ব্যাপারই না? এরকমই সস্তা আপনার ক্যারেক্টার! আমার সাথে যা করেছেন তা অনায়াসে সবার সাথে করতে পারেন, তাই না?”
আমীরের মন বলল,” তোমার সাথে যা করেছি তা অন্যকারো সাথে করা সম্ভব না। তুমি আমার কাছে কি তা তুমি কোনোদিন জানবেই না।”
অথচ মুখ বলল,” হয়তো তাই।”
তোহা আর থাকতে না পেরে সটান করে আমীরের গালে চড় মা-রল। আমীর চমকে উঠল। বুকের মধ্যে আঘাতের ভারী পাহাড় ধ্বসে পড়ল। তোহা মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” ভীষণ নোংরা আপনি৷ আমি আপনাকে ঘৃণা করি। প্রচন্ড ঘৃণা করি।”
এই কথা বলেই তোহা বাতাসের গতিতে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে লাগল। আমীর উত্তেজিত গলায় বলল,” মায়া থামো।”
কে শোনে কার কথা? তোহা খুব দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছে। আমীর দ্বিগুণ বেগে তার পেছনে গেল৷ তোহার থেকে সে উচ্চতায়ও প্রায় দ্বিগুণ। তাই খুব দ্রুত তোহাকে ধরে ফেলল। তোহা পাগলের মতো চিৎকার করে বলল,” ডন্ট টাচ মি। আমাকে ছাড়ুন৷ একদম ধরবেন না। খবরদার একদম ধরবেন না।”
” আমার কথা শোনো মায়া, তুমি কিন্তু পাগলামি করছো।”
” আমাকে মায়া বলে ডাকবেন না। আপনার মুখ থেকে ওই নাম আমি শুনতে চাই না। আপনি আমার কেউ না। বুঝতে পেরেছেন? কেউ না আপনি!”
” ঠিকাছে, আমি কেউ না। তবুও প্লিজ আমার কথা শোনো।”
” শুনবো না আপনার কথা। আমার আর কিছুই শোনার নেই। আমি সব বুঝে গেছি। সব জেনে গেছি। আর কিছুই জানতে চাই না আমি।”
” কিছুই বোঝোনি তুমি। প্লিজ, আমাকে একটু সময় দাও।”
তোহা দুইহাতে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমীরকে ধাক্কা দিল। কিন্তু আমীর এতটুকুও নড়ল না। তাই বাধ্য হয়ে সে বামপায়ের হাঁটু দিয়ে আঘাত করল আমীরের স্পর্শকাতর অঙ্গে। আমীর ব্যালেন্স হারিয়ে তোহাকে ছেড়ে দিল। সাথে সাথেই তোহা দৌড়ে পালালো। আমীরও দৌড়াতে লাগল। এক পর্যায় ক্লান্ত হয়ে একটা নদীর সামনে এসে থামল তোহা। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে তখনও। দু’জনেই ভিজে একাকার। নদীর পানিতে টুপটুপ শব্দ করে বৃষ্টির জল মিশছে। বড় অপরূপ সেই দৃশ্য। তোহা নদীর কিনারায় বসে দুইহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। মনের সব কষ্ট এই মুহূর্তে এখানেই বিসর্জন দিতে চায় সে।
আমীর গাড়ি থেকে তোহার ছাতাটা নিয়ে তার মাথার উপর ধরল। তোহা কিছু বলল না। করুণ শব্দে কাঁদছে সে। আমীর রক্তিম দৃষ্টিতে তোহার কান্না দেখছে। থরথর করে কাঁপছে তার ভেতরটা। দূর থেকে কেউ দৃশ্যটি দেখলে মনে হবে ক্যানভাসে আঁকা বিষণ্ণ সুন্দর কোনো ছবি। একটি মেয়ে প্রেম বিরহে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। পাশেই একজন ব্যর্থ প্রেমিক পরম যত্নে তার মাথার উপর ছাতা ধরে রেখেছে। প্রেয়সীর কান্না দেখছে সে নিরুপায় হয়ে। বিবেকের তাড়নার কাছে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। বড় নিদারুণ তাদের ভালোবাসার পরিণতি।
_____________
অন্ধকার ঘরে স্নেহাকে আটকে রাখা হয়েছে প্রায় দুইঘণ্টা যাবৎ। দরজা জানালা সব বন্ধ থাকায় এখন সকাল না দুপুর সেটাও বোঝার উপায় নেই। স্নেহা গতরাত থেকে কিছু খায়নি। একফোঁটা পানিও না। তবুও ক্ষুধা, তৃষ্ণা কিছুই অনুভব হচ্ছে না। নিজের মৃ-ত্যুর প্রহর গুণে চলেছে সে প্রতি মুহূর্তে। বাইরে থেকে সবার হৈ-হল্লা শোনা যাচ্ছে। ভয়ে স্নেহার শরীরের শিরা কেঁপে কেঁপে উঠছে বার-বার। হঠাৎ খট করে শব্দ হলো দরজায়। স্নেহা আশান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল সেদিকে। তার মনে হলো রাশেদ এসেছে। তাকে উদ্ধার করবে এবার। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। ভেতরে ঢুকল গুলজার। খালি গা, মুখে কদাকার হাসি। স্নেহার শরীর শিরশির করতে লাগল। ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল সে। গুলজার পা দিয়ে ধাক্কা মেরে দরজা আটকালো৷ ধপাশ করে শব্দ হলো। স্নেহা আৎকে উঠল সেই শব্দে। করুণ কণ্ঠে আর্তনাদ করে বলল,
” প্লিজ গুলজার, এরকম কোরো না। আমার এতোবড় ক্ষতি করে তোমার কি লাভ? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। দয়া করো, আমার সবকিছু তোমার নামে করে দিবো। তাও আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ।”
” এখন শুধু আপনাকে আমার নামে করে দিন ম্যাডাম। আমার আর কিছু চাই না।”
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল গুলজার। তার চোখ দু’টো চকচক করছে। সে মেঝেতে আসন গেঁড়ে বসল। স্নেহার দিকে ঝুঁকে এলো। রাশেদের শার্ট স্নেহার গায়ে জড়ানো ছিল। সেই শার্টের প্রতিটি বোতাম একটা একটা করে খুলতে লাগল। স্নেহা গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল। চারদিক সুনসান আর নীরব। কেউ তার চিৎকার শুনছে না কেন? এতোটুকু দয়াও কি হচ্ছে না কারো? স্নেহা তড়পাতে লাগল ডাঙায় তোলা মাছের মতো। গুলজারের হাতে ধর্ষিত হওয়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় বলে মনে হলো। সে এই মুহূর্তে মৃত্যু চায়।
আচমকা বিকট শব্দ করে রাশেদ ঢুকল। গায়ের আঘাতে দরজা খুলে ফেলেছে সে। গুলজার ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল,” তুই এসেছিস কেন? পরে আসবি। যা এখন।”
” যাবো না।”
রাশেদের উত্তর শুনে গুলজার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলল। খিটখিটে গলায় ডাকল,”এই কে আছিস? একে এখান থেকে বের করে নিয়ে যা। গাছের সাথে বেঁধে রাখ।”
কেউ এলো না। গুলজার একবার রাশেদের দিকে চেয়ে আবার ডাকল,” শরীফ, রনি!”
রাশেদ শীতলভাবে হেসে বলল,” সবাই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে আছে। কেউ আসবে না এখন।”
” মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে আছে মানে?” সাথে সাথেই গুলজারের মনে পড়ল আজ সকালে মদ কিনতে রাশেদকে পাঠানো হয়েছিল। সে আবার মদের সাথে কিছু মিশিয়ে আনেনি তো? গুলজার চোখ গরম করে বলল,” খবরদার রাশেদ, কোনো চালাকির চেষ্টা করলে কিন্তু তোর বউয়ের সাথে তুইও ম-রবি।”
রাশেদ প্রচন্ড আক্রোশে লাথি মা-রল গুলজারের মুখ বরাবর। এক লাথিতেই মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে গেল গুলজার। স্নেহা দ্রুত দেয়ালের সাথে সেঁটে নিজেকে গুটিয়ে ফেলল। গুলজার উঠে দাঁড়ানোর আগেই রাশেদ তার বুকের উপর পা দিয়ে চাপ মারল। ব্যথায় কোঁকাতে লাগল সে। রাশেদ তীব্র ক্ষোভ নিয়ে গুলজারকে আঘাত করতে লাগল। দশমিনিটের মধ্যেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। রাশেদ তাও মে-রে যাচ্ছিল। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে সে। স্নেহা বলল,” ছাড়ো রাশেদ প্লিজ, এভাবে মা-রলে ম-রে যাবে।”
রাশেদ চিৎকার করে বলল,” এই কু*র বাচ্চাকে আমি খু-ন করব আজ।”
সে দৌড়ে বাইরে গেল আর ফিরল একটা বিশাল আকারের পাথর নিয়ে। সেই পাথর গুলজারের মাথায় ফেলে থেতলে দিতে নিচ্ছিল কিন্তু বাঁধ সাধল স্নেহা। রাশেদের পায়ের কাছে মাথা ঠেঁকিয়ে অনুরোধ করে বলল,” প্লিজ, এটা কোরো না৷ আমি চাই না তুমি খু-ন করো। প্লিজ ছেড়ে দাও।”
এই কথা শুনে রাশেদ থামল। বড় বড় শ্বাস নিয়ে শান্ত হলো কিছু সময়ের জন্য। তারপর পাথরটা মেঝেতে ফেলে বসে পড়ল। স্নেহা কাঁদতে শুরু করেছে। রাশেদ ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। স্নেহা হঠাৎ খুব করুণ গলায় বলল,” আই এম স্যরি রাশেদ। এক্সট্রিমলি স্যরি।”
রাশেদ কাতর গলায় প্রশ্ন করল,” আর কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো?”
স্নেহা ক্রন্দনরত গলায় উচ্চারণ করল,” না, কখনও না।”
রাশেদ কাছে এসে স্নেহাকে জড়িয়ে ধরল খুব শক্ত করে। তারপর দু’জনেই কাঁদতে লাগল। কিছুসময় এভাবে কেটে গেল। হঠাৎ রাশেদ বলল,” চলো এবার উঠতে হবে। ওদের জ্ঞান ফিরে এলে কিন্তু আমি আর কিছু করতে পারব না।”
স্নেহা হেসে বলল,” তুমি থাকতে আমার কিছুই হবে না। ওরা কেউ তোমার সাথে পারবে না।”
এই কথা শুনে রাশেদও হাসল। স্নেহার কপালে চুমু দিয়ে তার হাতের বাঁধন খুলে দিল।
চলবে।
®Sidratul Muntaz
#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৪৫.
বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে সাথে তোহার কান্নাও! সে পাথুরে মূর্তির মতো বসে আছে নদীর কিনারায়। জ্বরের তীব্রতায় সবকিছু ঝাপসা লাগছে, মাথাব্যথা করছে। চোখ দু’টি ক্রমশ লাল হয়ে আসছে। আমীর ছাতা একপাশে রেখে তোহাকে কোলে তুলে বলল,” যথেষ্ট পাগলামি হয়েছে। এবার চলো।”
তোহা নিষ্প্রভতা কাটিয়ে বলল,” এভাবে আর কতদিন আমাকে সেইফ করবেন? একদিন আপনাকেও চলে যেতে হবে। এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মানুষগুলোও খুব ক্ষণস্থায়ী৷ সবাই চলে যায়। কেউ আজীবন পাশে থাকে না।”
তোহার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ল আক্ষেপ। তাকে পেছনের সিটে বসিয়ে আমীর দৃঢ় গলায় বলল,” আমি থাকব।”
” কিসের পরিচয়ে থাকবেন? আপনার সাথে আমার কি সম্পর্ক? ”
আমীর উত্তর খুঁজে পেল না। একটু সময় চুপ থেকে বলল,” পাশে থাকার জন্য সম্পর্ক থাকা জরুরী না।”
তোহা মৃদু হাসল। ঘাড় কাত করে বলল,” ঠিকই বলেছেন। আমার সবচেয়ে আপন সম্পর্ক ছিল আমার বাবার সাথে৷ পিতা-কন্যার সম্পর্ক। কিন্তু কি লাভ হলো সেই সম্পর্ক দিয়ে? বাবা তো আমাকে ছেড়ে চলেই গেল।”
” এসব কথা এখন ছাড়ো। তোমার গায়ে খুব জ্বর। ভেজা ড্রেসে থাকা ঠিক হচ্ছে না। আমি বাইরে যাচ্ছি৷ তুমি ড্রেস চেঞ্জ করো।”
আমীর এ কথা বলে উঠতে নিলেই তোহা তার টি-শার্ট চেপে ধরল। ঘোর মাখা কণ্ঠে বলল,” শুনুন, আই লভ ইউ।”
আমীরের হৃদয়ে রক্তপাত শুরু হলো পুনরায়৷ ইচ্ছে করল এই মুহূর্তে তোহাকে জড়িয়ে ধরে ভেতরের অশান্ত ঝড়টাকে শান্ত করতে৷ পরমুহূর্তেই তোহা ভ্রু কুচকে বলল,” কিন্তু আপনি আর কখনও আমার সামনে আসবেন না। আমি আপনাকে দেখতে চাই না। একদম দেখতে চাই না।”
এই কথা বলেই সে সজোরে আমীরকে ধাক্কা মারল। শরীরের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা আমীর সাথে সাথে গাড়ির বাইরে চলে এলো। তোহা ভেতর থেকে দরজা, জানালা সব বন্ধ করে দিল। তার কান্নার করুণ শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু। আমীর নিথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল চোখেমুখে একরাশ বেদনাভরা বিস্ময় নিয়ে।
অনেক সময় পার হলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া আসছে না। ড্রেস চেঞ্জ করতে এতো সময় তো লাগার কথা না। তোহা ঠিকাছে তো? জ্বরের কারণে আবার জ্ঞান হারায়নি তো? ভয়ে টিকতে না পেরে আমীর ভেতরে দেখতে বাধ্য হলো। যা ভেবেছিল তাই, তোহা সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমাচ্ছে৷ ভেজা কাপড় তখনও তার গায়ে। সে চেঞ্জ করেনি। আমীর কয়েকবার ডাকল,
” মায়া, ওঠো। চেঞ্জ করবে না?”
তোহা কোনো জবাব দিল না। যেন তার কোনো হুশই নেই। অথচ গা মাত্রাতিরিক্ত গরম৷ ক্রমশ শরীরের তাপ বাড়ছে। ভালো বিপদ হলো। এই অবস্থায় থাকলে জ্বর জীবনেও কমবে না। শীতে তার শরীরও কাঁপছে। সে গুটিয়ে আছে বিড়ালছানার মতো। গায়ের কাপড়টাও ভেজা। অথচ কাপড় বদলানোর মতো অবস্থাও তার নেই। আমীর কি করবে? খুব দ্বিধায় পড়ে গেল। অনেকক্ষণ সাত-পাঁচ চিন্তা করে সে গাড়ির লাইট নিভিয়ে দিল। তোহা অচেতন অবস্থায় নড়ে উঠল। আমীর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি।”
অনেক রাত পর্যন্ত আলিফ গাড়ি নিয়ে তোহাকে খুঁজল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। দুশ্চিন্তায় আলিফের মাথার শিরা দপদপ করছে। আজাদ বলল,” স্যার বাড়ি চলুন। ম্যাম হয়তো ফিরে এসেছে।”
” তুমি কিভাবে বুঝলে ফিরে এসেছে?”
” আমার মন বলছে। মাঝে মাঝে আমার সিক্সথ সেন্স খুব ভালো কাজ করে।”
আজাদ ভেবেছিল আলিফ এখন রেগে যাবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সে আজাদের কথা বিশ্বাস করে গাড়ি ঘুরালো। তারও মন বলছে যে তোহা ফিরে এসেছে। এই অচেনা শহরে মেয়েটা একা যাবেই বা কোথায়?
তোহার গায়ে প্রচন্ড জ্বর। কথা ঘুম থেকে উঠে তার মাথায় জ্বরপট্টি দিতে শুরু করেছে৷ জাবিদা দুশ্চিন্তায় অনবরত পায়চারী করছে। আলিফ বাড়ি ফিরে এই অবস্থা দেখে প্রশ্ন করল,” কোথায় ছিল ও?”
জাবিদা জবাব দিল,” বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটছিল। ভাগ্যিস আমীর দেখতে পেয়ে নিয়ে এসেছে।”
” আমীর নিয়ে এসেছে মানে? উনি কিভাবে পেলেন? নাকি তোহা উনার কাছেই গিয়েছিল?”
” তোহা ওর কাছে যাবে কেন? এটা কেমন কথা বলছিস!”
আলিফ এই মুহূর্তে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো যে তোহা আর আমীরের মধ্যে গভীর কোনো সম্পর্ক আছে। নয়তো রাত-বিরাতে আমীর তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে কেন? প্রচন্ড মেজাজ খারাপ নিয়েও সে চুপ রইল৷ জাবিদাকে এই বিষয়ে কিছু জানালো না। জাবিদা বিচলিত কণ্ঠে বলল,” মেয়েটা যখন এখানে এসেছে তখন একদম হুশ ছিল না। গায়ে প্রচন্ড জ্বর। এখনও জ্বর কমছে না। কি করি বলতো?”
আলিফ তোহার দিকে তাকাল। জ্বরের ঘোরে সে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। তার কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু দুই চোখের কার্ণিশ বেয়ে অঝোরে বৃষ্টি নামছে। এতো কাঁদছে কেন সে?
তোহাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পর আমীর গাড়ি নিয়ে সারারাত ঘুরল। হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে করল না। তার মনে হচ্ছে তোহা পাশেই আছে। তার কাঁধে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। অথচ কিছুক্ষণ আগেই সে তোহাকে রেখে এসেছে। এখনও তোহার শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ মিশে আছে প্রতিটি কোণে। যা আমীরকে শ্বাস নিতে দিচ্ছে না। জাবিদা খুব অনুরোধ করেছিল রাতে আমীরকে থাকার জন্য। কিন্তু আমীর থাকেনি। তোহা তাকে বলেছে আর কখনও সামনে না যেতে। তার কান্নার শব্দ, অশ্রুমাখা চাহনী, বেদনায় ক্লিষ্ট মুখ, কিছুই আমীর ভুলতে পারছে না। এক মুহূর্তের জন্যেও না। এভাবে চললে সে পাগল হয়ে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিল সকালের ফ্লাইটেই বাংলাদেশে ফিরবে। আর কখনও ইটালি আসবে না৷ তোহার মুখোমুখি হবে না।
______________
তোহার ঘুম ভাঙল অনেক বেলা করে। মাথাটা তখনও ধরে আছে। জ্বর সেরে শরীর ঘাম দিয়েছে। তোহা হাই তুলে উঠে বসতেই গতরাতের পাগলামির কথাগুলো মনে পড়তে লাগল৷ প্রচন্ড লজ্জায় তখনি ম-রে যেতে মন চাইল তার। নিজের কপালে হাত ঠেঁকিয়ে সে ভাবতে লাগল, এসব কি করেছে? এখন আমীরের কাছে কিভাবে মুখ দেখাবে? অবশ্য সে আমীরের সামনেও আর যেতে চায় না। আমীর তার মন ভেঙেছে৷ পাষাণ মানব!
জাবিদা নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকল। সর্বপ্রথম তোহার কপালে হাত রেখে শরীরের তাপমাত্রা পরখ করল। তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে মৃদু হেসে বলল,” জ্বর সেরেছে। আলহামদুলিল্লাহ। ”
তোহা মাথা নিচু করে বলল,” কালরাতের জন্য স্যরি ফুপু। আমি যে কি করেছি… একদম হুশ ছিল না।”
” কোনো ব্যাপার না। বাদ দে। কিন্তু আমীর ছেলেটা অনেক কষ্ট করেছে। সেই মেইন গেইট থেকে রুম পর্যন্ত তোকে কোলে করে এনেছে। বৃষ্টিতে ভিজে তার বেহাল দশা।”
তোহা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। রাতে সে বৃষ্টিতে ভিজে কি পাগলামিটাই না করেছিল! ভাবতেই কেমন লাগছে। ছি! আমীরের কাছে তার অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।
জাবিদা বলল,” এখন কিছু খেয়ে নে। অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে আছিস। আর কথাকে একটা থ্যাংকস দিস। মেয়েটা কাল সারারাত তোর মাথার কাছে বসে থেকেছে। তোর কপালে জ্বরপট্টি দিয়েছে। একটুও ঘুমাতে পারেনি।”
তোহা হেসে বলল,” তাই? ভাবী অনেক ভালো।”
” হুম। শুধু মেজাজটা একটু চড়া। তোর সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে। কিছু মনে রাখিস না মা। মেয়েটার মন খুব ভালো । ”
” আরে ধূর, আমি কেন এসব মনে রাখতে যাবো? ভাবীর প্রতি আমার এতোটুকু রাগ নেই।”
” রাতে কেন বের হয়েছিলি?”
তোহা চুপ করে গেল। জাবিদা বলল,” আচ্ছা বাদ দে। এই বিষয়ে পরে কথা হবে। তুই গোসল করবি? তাহলে গিজার ছেড়ে দেই।”
” ঠান্ডা পানিতেই করে নিবো। গিজার লাগবে না।”
” মাত্র জ্বর থেকে উঠেছিস। ঠান্ডা পানি ঠিক হবে না। গরম পানিতেই গোসল কর।”
জাবিদা ঘর থেকে বের হতে নিলেই তোহা ডাকল,” ফুপু শোনো।”
” কি?”
তোহা একটু ইতস্তত করে জানতে চাইল,” আমার জামা কে বদলেছে? তুমি নাকি ভাবী?”
জাবিদা বিস্মিত হয়ে বলল,” কেউ না। আমরা তো তোর জামায় হাতও লাগাইনি।”
” তাহলে এই জামা আমার গায়ে কি করে এলো?” তোহা হতভম্ব। জাবিদা শুধাল,” মানে? তোর গায়ে তো এই জামাই ছিল।”
তোহা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল,” আচ্ছা ঠিকাছে, তুমি যাও।”
জাবিদা বের হয়ে গেল৷ তোহা ভালো করে তাকাল আয়নার দিকে। তার স্পষ্ট মনে আছে সে এই জামা পরে বাড়ি থেকে বের হয়নি। আর বৃষ্টিতে ভিজলে তো তার জামাও ভেজা থাকার কথা। তাহলে কি… তোহার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। গতরাতে আর কি কি হয়েছিল আল্লাহ মালুম। তার তো সব মনেও নেই। সর্বনাশ করেছে!
________________
রাত দুইটা বাজে। তোহা ঘুমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু একদম ঘুম আসছে না। আজকে সারাটা দিন অস্থিরতায় কে-টেছে। আমীর একবার তাকে ফোন পর্যন্ত করেনি। সে কেমন আছে এইটুকু জানার জন্য অন্তত ভদ্রতার খাতিরে হলেও মানুষ ফোন করে। লোকটার মধ্যে সামান্য সৌজন্যতাবোধও কি নেই? অদ্ভুত মানুষ! তোহা প্রপোজ করেছে বলে কি ভাব বেশি বেড়ে গেছে? যদিও তখন নিজের প্রতি তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। স্বাভাবিক থাকলে জীবনেও এতো সহজে মনের কথা বলতো না সে। নিজেকে এখন খুব ছোট মনে হচ্ছে। আমীর কি ভাবছে তার সম্পর্কে? মনের মধ্যে ভীষণ অশান্তি অনুভব হচ্ছে। তোহা উঠে দাঁড়ালো। ঘুম আসবে না এভাবে। বাগান থেকে একটু হেঁটে এলে কেমন হয়? এই ভেবে তোহা চুল আঁচড়ে নিল। তখনি ফোন বেজে উঠল তার।
” হ্যালো, কে বলছেন?”
ওই পাশ থেকে ভেসে এলো প্রচন্ড উদগ্রীব কণ্ঠ,” মায়া, একবার নিচে আসতে পারবে?”
তোহার শরীর বরফের মতো জমে গেল। প্রথম কয়েক মুহূর্ত কোনো কথাই বের হলো না মুখ দিয়ে। আমীর পুনরায় বলল,” প্লিজ!”
” আপনি কোথায়?”
” মেইন গেইটের সামনে আছি।”
” এতোরাতে কেন এসেছেন?”
” জানি না।”
তোহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” ঠিকাছে অপেক্ষা করুন। আসছি আমি।”
ফোন রেখেই সে বড় বড় শ্বাস নিল কয়েকবার। নিজেকে সামলালো,” কাম ডাউন তোহা। এতো এক্সাইটেড হওয়ার মতো কিছু হয়নি। ওই পাষাণ মানব এইরাতে তোমাকে প্রপোজ করতে আসবে না নিশ্চয়ই। তোমার স্বাভাবিক থাকা উচিৎ। কাম ডাউন।”
চলবে
®Sidratul Muntaz