#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৪৬
গভীর রাত। প্রগাঢ় নিস্তব্ধতায় নিজের বুকের ঢিপঢিপ শব্দটাও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। তার ভয় হচ্ছে। আমীরও এই শব্দ শুনে ফেলবে না তো? তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। তোহা পা টিপিয়ে টিপিয়ে বাগানের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। দূরে মেইন গেইটের বাইরে আমীরের ভাড়া গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। সে নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও আছে। উত্তেজনায় তোহার হাত-পা মৃদু কাঁপছে। পা চলছে না। যেন অসাড় হয়ে এসেছে।
” ভালো আছেন ম্যাডাম?”
তোহা ভয়ে আৎকে উঠল। আজাদকে দেখে খানিক শান্ত হয়ে বুকে থু দিয়ে বলল,” ও, আপনি?”
” ভয় পেলেন নাকি?”
” আপনার স্যার কোথায়?”
” বাইরেই আছেন। আরেকটু এগোলেই দেখতে পাবেন। আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি৷ পাহারা দিচ্ছি। কেউ এলে বলবো। আপনি নিশ্চিন্তে যান।”
তোহা একটা বিরক্তি ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আজাদের সাথে দেখা হওয়ায় ভালোই হয়েছে। তার চোখেমুখে একটা গম্ভীর ভাব চলে এসেছে। আমীর তাকে এই অবস্থায় দেখলে তার মনের অতি বিগলিত অনুভূতি বুঝতে পারবে না। তোহা ধীরপায়ে বাইরে এলো। মানুষটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা একটা ছায়া অবয়ব দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর!তোহা নিজেকে স্বাভাবিক করল। সে আমীরের সামনে কঠিন থাকতে চায়।
তোহাকে দেখতে পেয়েই আমীরের চেহারায় একটা শান্তি শান্তি ভাব ফুটে উঠল। সে প্রশ্ন করল কোমল গলায়,” কেমন আছো?”
তোহা ইস্পাতের মতো শক্ত কণ্ঠে বলল,” আমি কেমন আছি সেটা জিজ্ঞেস করার জন্য নিশ্চয়ই আসেননি।”
আমীর মনমরা কণ্ঠে বলল,” না।”
” কেন ডেকেছেন সরাসরি বলুন। আমার হাতে বেশি সময় নেই। ফুপু যেকোনো সময় আমার ঘরে আসবে। আমাকে খুঁজে না পেলে অস্থির হবে।”
তোহা ইচ্ছে করেই তাড়া দেখালো। গতরাতে সে যা কিছু করেছে তার জন্য এখনও লজ্জায় আমীরের চোখে চোখ রাখতে পারছে না। দীর্ঘসময় আমীরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাও তার জন্য অস্বস্তিকর। সে কথা বলছে আমীরের সাথে কিন্তু তাকিয়ে আছে ব্যস্ত রাস্তায়। আমীর ভারী কণ্ঠে বলল,” আমি চলে যাচ্ছি।”
” কোথায়?”
” বাংলাদেশে।”
” ও। তার মানে বিদায় নিতে এসেছেন?” মুহূর্তেই অভিমানী হয়ে উঠল তোহার মুখ। আমীর সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,” না। দেখা করতে এসেছি।”
” দেখা তো হয়েছেই। এখন কি তাহলে আমি যেতে পারি?” তোহার কণ্ঠ নিভে আসল। আমীরের বিদায়ের খবর তার মন ভেঙে দিয়েছে।
তোহাকে বিস্মিত করে দিয়ে আমীর হঠাৎ তার ডানহাতটা চেপে ধরল। স্বতঃস্ফূর্ত গলায় বলল,” না, যেতে পারো না।”
তোহার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে নিল। সে কাঁপা গলায় উচ্চারণ করল,” কেন?”
” আমার কথা শেষ হয়নি।”
” কি বলতে চান দ্রুত বলুন।”
আমীর এক কদম এগিয়ে এলো,” এতো তাড়া কিসের? কালরাতে কি করেছিলে মনে আছে?”
তোহা শিউরে উঠল। মাথা নিচু করতে করতে একদম থুতনি লেগে গেল বুকের সাথে। এই ভয়টাই পাচ্ছিল সে এতোক্ষণ। আমীর গতরাতের প্রসঙ্গ তুললেই সে লজ্জায় পড়ে যাবে। সেটাই হলো। তোহা অপ্রতিভ স্বরে বলল,” আমার কালরাতের কথা কিছু মনে নেই।”
” সত্যি মনে নেই?” আমীরকে বিস্মিত মনে হলো। যেন সে তোহার কথা বিশ্বাস করছে না। তোহা দমল না। খুব স্পষ্ট করে বলল,” না।”
” কিছুই মনে নেই?”
তোহা বিরক্তিভরা কণ্ঠে আওড়াল,” বললাম তো, মনে নেই।”
” ঠিকাছে। তাহলে আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। গাড়িতে ওঠো।”
” গাড়িতে কেন উঠব?” তোহা চমকালো। আমীর বলল,” আগে ওঠো তারপর বলছি।”
তোহা আর প্রশ্ন না করে গাড়িতে উঠল। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে তার। আমীর কি বলবে? সে ড্রাইভিং সিটে এসে বসল এবং নিঃশব্দে ড্রাইভিং শুরু করল। তোহা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,” কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
আমীর রহস্যময় কণ্ঠে বলল,” গেলেই দেখবে।”
তোহা কৌতুহল চেপে রাখতে পারছে না। তার এখন একটু ভয়-ভয়ও লাগছে। আমীর বলার সাথে সাথেই সে গাড়িতে উঠে পড়ল কেন? ব্যাপারটা অদ্ভুত না!
গাড়ি থামল গতকালের ওই নদীটির সামনে। যেখানে তোহা পাগলের মতো বসে কেঁদেছিল। তার সব মনে আছে। সে আড়ষ্ট গলায় জানতে চাইল,” আমরা এখানে কেন এসেছি?”
আমীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তোহাকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করল। তার হাত ধরে নদীর কিনারে এনে বলল,” কালরাতে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আমাকে কিস করেছিলে। মনে আছে?”
তোহা আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গি করে বলল,” কি? ”
” হুম। তাও একবার না, কয়েকবার!”
” অসম্ভব! আমি এমন কিছুই করিনি। আপনি মিথ্যা বলছেন।”
” তোমার তো কিছু মনে নেই। তাহলে বুঝলে কিভাবে মিথ্যা বলছি?”
তোহা নিজের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,” আমি এমন কিছু করিনি তা আমি জানি। মনে না থাকলেও নিজের সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। আপনি যা বলবেন সেটাই বিশ্বাস করব নাকি?”
” তাহলে তুমিই বলো, তুমি কি করেছো?”
” আমার মনে নেই।”
” মনে না থাকলে আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে।”
তোহাকে অসহায় দেখালো। বিপর্যস্ত কণ্ঠে বলল,” আরে, কি মুশকিল! আপনি এমন করছেন কেন? এভাবে কিভাবে বিশ্বাস করব? আমার সত্যিই কিছু মনে নেই।”
আমীর তোহার থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলল। আদেশ করার ভঙ্গিতে বলল,” আমার দিকে তাকাও।”
তোহা তবুও তাকাবে না। চোখ দু’টো নিচে নামিয়ে রাখল। আমীর আবারও বলল,” তাকাও।”
তোহা দু’পাশে মাথা নাড়ল। আমীর মুচকি হেসে বলল,” তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন? তোমার হাত কাঁপছে।”
” কারণ আপনি আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছেন। আমার হাত ছাড়ুন। কেউ যদি জেনে যায় আমি এতোরাতে আপনার সাথে এখানে এসেছি তাহলে কি হবে?”
” কিছুই হবে না। আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবো। কেউ আটকাতেও পারবে না।”
” কোথায় নিয়ে যাবেন?”
” বাংলাদেশে।”
” আশ্চর্য, আপনি বললেই আমি যাবো কেন? আর বাংলাদেশে গিয়ে আমি কি করব?”
আমীর কণ্ঠে কাতরতা ঢেলে বলল,” এখন যা করো তাই করবে।”
” মানে? এখন কি করি?”
” আমাকে জ্বালাও। সবসময়, সারাজীবন এভাবেই আমাকে জ্বালাতে হবে। পারবে না?”
তোহা দৃষ্টি নত রেখেই বলল,” আমি আপনার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না। এসবের মানে কি?”
” মানে হলো আই লভ ইউ।”
তোহা চোখ বড় করে তাকাল। আমীর প্রায় সাথে সাথেই পৃথিবীর মধুরতম প্রস্তাবটি দিল,” উইল ইউ ম্যারি মি?”
তোহার বড় বড় চোখ দু’টো আরও বড় হয়ে গেল। যেন এখনি চোখের মণি ঠিকরে বের হয়ে আসবে। ঝিরঝির করতে লাগল সারা শরীর। কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো চেয়ে থাকার পর সে হঠাৎ বলল,”আপনি কি আমার সাথে হেঁয়ালি করছেন?”
” হেঁয়ালি না। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি। মায়া,আ’ম ভেরি সিরিয়াস। দ্রুত বলো আমাকে বিয়ে করবে?”
তোহা তার চোখ বুজে ফেলল। সে নিশ্চিত স্বপ্ন দেখছে। এটা স্বপ্ন ছাড়া অন্যকিছু হতেই পারে না। বাস্তব এতো ভয়ংকর সুন্দর কখনোই হয় না৷ তাকে চোখ বন্ধ রেখে বিড়বিড় করতে দেখে আমীর হেসে ফেলল। অধৈর্য্য কণ্ঠে বলল,” উত্তর দাও মায়া। আ’ম ওয়েটিং।”
তোহা চোখ মেলে তাকাল। দূর্বল গলায় বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,” কিভাবে উত্তর দিবো? এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব? আমি এখনও কিছু বুঝতে পারছি না।”
আমীর শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। তোহার ঠোঁট দু’টি কিভাবে কাঁপছে! আমীর নির্দ্বিধায় চেয়ে আছে সেই আলোড়নের দিকে। তারপর খুব আচমকা সে নিবিড় চুমু দিল ওই ঠোঁটে। ঠকঠক করে কেঁপে উঠল তোহা। আমীর থামল না, বুভুক্ষের মতো তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছিল। তোহা কোনোমতে দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল আমীরের পিঠ। হ্যাঁ, এটা বাস্তব। স্বপ্ন কখনও এতো সংবেদনশীল হয় না। শরীরের পুরো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল সে। আমীর তাকে দুইহাতে আগলে ধরে আছে। কয়েকটি নৈসর্গিক মুহূর্ত অতিবাহিত হলো। তারপর তোহা হঠাৎই কাঁদতে শুরু করল। আমীর অবাক হয়ে বলল,” কি ব্যাপার?”
তোহা তাকে ধাক্কা মেরে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,” আপনি আমাকে চুমু দিলেন কেন?”
আমীর হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্ময়ে কাটিয়ে বলল,” যাকে বিয়ে করব, তাকে চুমু দিতে পারব না?”
” বিয়ে করবেন মানে? আমি কি এখনও ‘হ্যাঁ’ বলেছি?”
” তাহলে বলো।”
” কেন বলবো? এতো সহজ না। আমি আপনাকে বিয়ে করব না।” এই কথা বলে সে আবার কাঁদতে লাগল। চোখের জল যেন বাঁধ মানছে না।
আমীর হকচকিয়ে গেল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,” ঠিকাছে। বিয়ে করতে হবে না। কিন্তু কাঁদছো কেন?”
” জানি না। খবরদার আমার কাছে আসবেন না আপনি।”
আঙুল উঠিয়ে এই কথা বলেই তোহা গাড়িতে গিয়ে বসল। আমীরও তার পেছনে এলো। গাড়িতে উঠে টিস্যু এগিয়ে দিল। তোহা সেই টিস্যু দিয়ে চোখ মুছল। তারপর অভিমানী কণ্ঠে বলল,” আমার কিছু শর্ত আছে।”
” বলো।”
” বিয়ের পর আমাকে প্রতিদিন এভাবে প্রপোজ করতে হবে।”
আমীর হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে বলল,” আচ্ছা করব। এর চেয়েও অনেক সুন্দরভাবে করব।”
” আমাকে কখনও মিথ্যা বলা যাবে না।”
আমীর চুপ করে গেল। তার হাসি হাসি মুখে মেদুর ছায়া পড়ল। তাদের সম্পর্কের ভিত্তিটাই তো সবচেয়ে বড় মিথ্যা দিয়ে তৈরী। কিন্তু সেই মিথ্যার পেছনে আসল সত্যি সে কখনও জানতে দিবে না তোহাকে। আজীবন লুকিয়ে রাখবে। এছাড়া তোহাকে সুখে রাখার অন্যকোনো পথ নেই। আমীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” ঠিকাছে। বলবো না মিথ্যে।”
” আমাকে কখনও ছেড়ে যেতে পারবেন না।”
কি নিঃসংকোচ আবদার! আমীর হেসে বলল,” আচ্ছা। কিন্তু যদি কখনও তুমি আমাকে ছেড়ে যাও?”
” অসম্ভব। আপনাকে ছেড়ে আমি থাকতেই পারব না।”
কথাটা বলে শেষ করেই সে খুব শক্ত করে আমীরকে জড়িয়ে ধরল। আমীরের চোখ ভরে এলো অশ্রুতে। বুকের বামপাশে খুব তীব্র একটা ব্যথা শুরু হলো। নরম, শীতল অনুভূতিতে ছেয়ে গেল চারপাশ। আমীর ফিসফিস করে বলল,” এটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন মায়া। আমি জীবনে এতো খুশি আগে কখনও হইনি।”
তোহা কান্নামাখা কণ্ঠে বলল,” আমিও না।”
________________
তখন শেষরাত। আলিফ অনবরত পায়চারী করছে ছাদে। তোহার ঘরের লাইট জ্বালানো দেখে তার সন্দেহ হয়েছিল। পরে সেই ঘরে গিয়ে দেখল তোহা কোথাও নেই। আলিফ নিশ্চিত তোহা আজকে আবারও আমীরের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। গতরাতেও তার বাড়ি থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল আমীরের সাথে দেখা করা। আলিফ সব বুঝতে পারছে। কিন্তু ওই লোকের সাথে রাতেই কেন দেখা করতে হবে? দিনেরবেলা দেখা করলে কি সমস্যা? আলিফ আজ তোহাকে হাতে-নাতে ধরবে এবং এই বিষয়ে প্রশ্ন করবে। সেজন্যই তার দাঁড়িয়ে থাকা।
আমীরের গাড়ি এসে থামল মেইন গেইটের সামনে। তোহা লাজুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” আমাদের আবার কখন দেখা হবে?”
” যখন তুমি চাইবে তখনি।”
ভালো লাগার আবেশে তোহার মন ভরে উঠল। কি সুন্দর কথা! যখন সে চাইবে তখনি দেখা হবে। তোহা গাড়ি থেকে নামতে নিলেই আমীর বাঁধা দিয়ে বলল,” এভাবেই চলে যাবে? আমাকে বায় বলবে না?”
তোহা নরম কণ্ঠে বলল,” বায়।”
আমীর অসন্তুষ্ট হলো। গম্ভীর মুখে বলল,” এভাবে কেউ বায় বলে?”
” তাহলে কিভাবে বলব?” তোহা কনফিউজড। আমীর কেমন ঘোর মাখা দৃষ্টিতে কাছে এলো। তোহার ঠোঁটে চুমু দিতে উদ্যত হলেই তোহা সরে গিয়ে বলল,” পাগল হয়ে গেছেন? বাড়ির সামনে চলে এসেছি আমরা। কেউ যদি দেখে ফেলে?”
আমীর হতাশ হলো। বলল,”ওকে। বায়।”
তোহা হাসিমুখে গাড়ি থেকে নামল। হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। আমীরও হাত নাড়ল। তোহা যতক্ষণ বাসায় না ঢুকল ততক্ষণই আমীর তাকিয়ে রইল। ছাদের উপর থেকে এই সম্পূর্ণ ঘটনা অবলোকন করল আলিফ।
ঘরে এসে তোহা বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার মন এখনও শান্ত হয়নি। মনে হচ্ছে ঘুম আসবে না। ঘুমিয়ে পড়লেই বুঝি সব স্বপ্ন হয়ে যাবে। তোহা এই অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন থেকে বের হতে চায় না। তার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের চেহারা দেখেই লজ্জা হলো। অকারণেই হাসি পাচ্ছে। হঠাৎ আয়না দিয়ে দরজার সামনে আলিফকে দাঁড়ানো দেখে তোহা চমকে উঠল। থতমত খেয়ে বলল,” ভাইয়া তুমি, এইরাতে?”
আলিফ তোহার বিছানায় বসতে বসতে বলল,” কিছুক্ষণ আগে আমি এসেছিলাম৷ তুমি রুমে ছিলে না।”
তোহা আমতা-আমতা করে বলল,” ঘুম আসছিল না তাই বাগানে হাঁটতে গেছিলাম।”
তোহার স্পষ্ট মিথ্যা শুনে আলিফের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসলো। রাগে চোয়াল শক্ত করে সে বলল,” আমি ছাদে ছিলাম এতোক্ষণ। আমীর সাহেবের গাড়ি থেকে তোমাকে নামতে দেখেছি।”
তোহা অপ্রস্তুত হলো। তৎক্ষণাৎ কি বলবে খুঁজে পেল না। আলিফ রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করল,” ওই লোকের সাথে তোমার কি এমন সম্পর্ক যে কাউকে না জানিয়ে রাত-বিরাতে দেখা করতে হবে? সবাইকে মিথ্যা বলতে হবে?”
তোহা মাথা নিচু করে বলল,” মিথ্যা বলার জন্য স্যরি।”
” তোমাদের মধ্যে কি কোনো অ্যাফেয়ার আছে?”
তোহা সত্যি কথাই বলল,” হ্যাঁ। আমি ওকে ভালোবাসি। আমরা বিয়ে করব।”
এই কথা শুনে আলিফের রক্ত গরম হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল,” ওই ছেলে ডিভোর্সি। তোহা তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?
তোহা অবাক হয়ে তাকাল,” তুমি এমন করছো কেন? ডিভোর্স হলে কি কেউ আবার বিয়ে করতে পারে না? আমি তাকেই বিয়ে করব। আর তার পাস্ট নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।”
” তোমার কি মনে হয় ছোটমামা বেঁচে থাকলে মানতো এই সম্পর্ক? ”
” অবশ্যই মানতো। বাবা উনাকে যথেষ্ট পছন্দ করতো। নাহলে মৃ-ত্যুর আগে তার কাছে আমার দায়িত্ব দিয়ে যেতো না।”
আলিফ মাথা ঠান্ডা করে বলল,” তোহা বোঝার চেষ্টা করো। দায়িত্ব দেওয়া আর বিয়ে দেওয়া এক ব্যাপার নয়।”
” আমি আমার বাবাকে তোমার থেকে ভালো চিনি। আর আমার লাইফ নিয়ে তোমার বদারড হওয়ার প্রয়োজন দেখছি না। নিজের ভালো বোঝার মতো বয়স আমার হয়েছে। প্লিজ এখন যাও৷ আমার ঘুম আসছে।”
তোহা আলিফের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। অর্থাৎ সে এই বিষয়ে আর কথা বাড়াতেই চায় না। আলিফ কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।মুখে কিছুই বলল না। তবে তীব্র ক্রোধ নিয়ে মনে মনে উচ্চারণ করল,” আমিও দেখব তোমাদের বিয়ে কিভাবে হয়।”
চলবে
®Sidratul মুন্তায
#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৪৭.
কথার মনে হচ্ছে আজকের দিনটা অশুভ। ভোরে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙেছে। তারপর সে আর ঘুমাতে পারেনি। সকালে নাস্তা বানানোর সময় তার মনখারাপ দেখে জাবিদা জিজ্ঞেস করল,
” কি হয়েছে মা? কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করছো নাকি?”
কথা মনখারাপ করা গলায় বলল,” সেরকম কিছু না মা। আজকে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। তারপর আর ঘুম হয়নি।”
” দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছো? এই সময় তো ভয় পাওয়া ঠিক না। কেমন স্বপ্ন ছিল?”
কথা চিন্তিত গলায় বলল,” মায়ের কাছে শুনেছিলাম সাপ স্বপ্ন দেখা ভালো লক্ষণ না। এতে নাকি শত্রুর উপদ্রব হয়। আমি আজ সকালে স্বপ্নে দেখেছি আপনার ছেলেকে সাপে কে-টেছে। ঘুম ভেঙেই পাঁচশোবার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়েছি। তাও মনে শান্তি লাগছে না।”
জাবিদার মুখ শুকিয়ে গেল। কথা এতো আধুনিক মেয়ে হয়েও এসবে বিশ্বাস করে? তাহলে সে কি করবে? এমন সময় তোহা এসে পেছন থেকে জাবিদাকে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী গলায় বলল,” ফুপু… কি করছো?”
তোহার উপস্থিতিতে জাবিদা অবাক,” কিরে, আজ মহারানীর এতো সকাল সকাল ঘুম ভাঙল?”
তোহা জবাব না দিয়ে হাসল। রাতে তার একদম ঘুম হয়নি। অতিরিক্ত খুশিতে যে মানুষের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুমও উধাও হয়ে যেতে পারে তা নিজেকে না দেখলে সে বিশ্বাসই করতো না। জাবিদা বলল,” ভালোই হয়েছে উঠে গেছিস। এখন ননদ আর ভাবী মিলে নাস্তা তৈরী কর। আমি তোর ফুপা ঘুম থেকে উঠেছে কি-না দেখে আসি।”
তোহা মাথা নিচু করে বলল,” ফুপু শোনো, তোমার সাথে আমার একটা জরুরী কথা ছিল।”
” হ্যাঁ বল।”
তোহার লজ্জা লাগছে। এই বিষয়ে সে কিভাবে কথা বলবে? কিন্তু না বললেও হবে না। আলিফ ইতিমধ্যে জেনে গেছে। তার কাছে ব্যাপারটা শোনার থেকে ভালো তোহা নিজেই বলে দিক।
” ফুপু আমি বিয়ে করছি।”
কথা হেসে ফেলল। জাবিদা চোখ বড় করে তাকাল,” বিয়ে করছিস মানে? কাকে?”
তোহা লাজুক ভঙ্গিতে বলল,” আমীরকে।”
কথা হতবাক দৃষ্টিতে তাকাল,” আমীর মানে? ওই চশমাওয়ালা লোকটার কথা বলছো?”
তোহা গর্বের সাথে উচ্চারণ করল,” হ্যাঁ। ”
জাবিদা দ্বিধাভরা কণ্ঠে বলল,” কিন্তু ওই ছেলে তো ডিভোর্সি। তুই ওকে বিয়ে করবি মানে?”
এবার সামান্য রেগেই গেল তোহা। চোখমুখ কুচকে বলল,” তোমাদের মা-ছেলের প্রবলেমটা কি বলোতো? ডিভোর্স হয়েছে বলে কি সে আর বিয়ে করতে পারবে না?”
” কথা সেটা না। যে ছেলের একবার ডিভোর্স হয়েছে তার যে আবার ডিভোর্স হবে না এমন কি গ্যারান্টি আছে? এমন ছেলেরা সংসার সম্পর্কে উদাসীন হয়। তাছাড়া তুই একটা সুন্দর, অবিবাহিত মেয়ে। তুই কেন ডিভোর্সি ছেলে বিয়ে করতে যাবি?”
কথা বলল,” আলিফও এই ব্যাপারে জানে নাকি?”
তোহা গম্ভীর গলায় বলল,” হ্যাঁ জানে। আর ফুপু শোনো, এটা এরেঞ্জ ম্যারেজ না যে এতো বাছবিচার করে বিয়ে হবে। আমাদের মধ্যে রিলেশন চলছে। আমি বিয়ে করলে একমাত্র ওকেই বিয়ে করব। সে ডিভোর্সি হোক কি দশবাচ্চার বাপ হোক। তাতেও আমার কিছু যায়-আসে না।”
তোহা তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। জাবিদা বিরস কণ্ঠে বলল,” তোদের রিলেশন আবার কবে হলো?”
তোহা উত্তর দিল না। কথা শাশুড়ীর কাছে এসে বলল,” ও মনে হয় আপনার কথায় রাগ করেছে মা।”
” করুক রাগ। তাই বলে ওই ছেলের সঙ্গে সত্যি সত্যি ওর বিয়ে দিবো নাকি? বললেই হলো?”
” ছেলেটা তো মা খারাপ না। কত সুন্দর দেখতে। তোহার প্রতি কেয়ারও করে। সেদিন বৃষ্টির রাতে দেখলেন না? তোহাকে কেমন বাড়ি নিয়ে এলো। উনি না থাকলে কি হতো?”
” হ্যাঁ বুঝলাম ছেলে ভালো। কিন্তু ভালো হলেই কি বিয়ে দিতে হবে? তুমি এসব কেমন কথা বলছো? আমার ভাতিজি কি কোনো জায়গা দিয়ে পঁচে গেছে যে ডিভোর্সি ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দিবো? আমার ভাই বেঁচে থাকলে কখনও রাজি হতো না। তাই আমিও রাজি হবো না।”
জাবিদা আলিফের ঘরে ছুটে গেল এই বিষয়ে কথা বলার উদ্দেশ্যে। আলিফ জানাল,” যাই হয়ে যাক, এই বিয়েতে আমি মত দিবো না।”
” কিন্তু তোহা কি আমাদের কথা শুনবে? সে তো এই ছেলেকে বিয়ে করার জন্যই পাগল হয়ে গেছে।”
” ও যতই পাগল হোক, বিয়ে হচ্ছে না৷ তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মা।”
আলিফ এতো আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলছে যে জাবিদার ভয় হচ্ছে। সে শঙ্কিত হয়ে বলল,”তোহা কিন্তু যথেষ্ট জেদী। একদম বাবার মতোই হয়েছে। ওকে রাগাতে গেলে দেখা যাবে বাড়ি ছেড়েই চলে গেল। তাছাড়া ও প্রাপ্তবয়স্ক। যা ইচ্ছা করতে পারে।”
আলিফ হেসে বলল,” তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তোহাকে এই বিষয়ে কিছুই বলবো না। ও যা ইচ্ছা তাই করুক। কিন্তু ছেলেটাই যদি ওকে বিয়ে করতে রাজি না হয়… তাহলে কি বিয়ে হবে?”
” আমীর রাজি হবে না কেন? সেও নিশ্চয়ই রাজি৷ তোহা তো আমাকে বলল তাদের মধ্যে সম্পর্ক চলছে।”
আলিফ তাচ্ছিল্য হাসল। সম্পর্ক ভাঙা এমন কোনো জটিল ব্যাপার না। কিন্তু ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগানোই সবচেয়ে জটিল।
তোহা ঘরে এসে বিছানায় পা উঠিয়ে বসল। মেজাজটা অত্যন্ত খারাপ। মোবাইল বাজছে। কিন্তু ধরতে মন চাইছে না। তারপর হঠাৎ আমীরের কথা মনে পড়ল। সে যদি ফোন করে থাকে? তোহা দ্রুত মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল আমীরই ফোন করেছে। খুশিতে টইটম্বুর হয়ে সে ফোন রিসিভ করল,” হ্যালো।”
” গুড মর্ণিং।”
তোহা মিষ্টি গলায় বলল,” গুড মর্ণিং!”
” ঘুমিয়ে ছিলে নাকি? মনে হয় সকাল সকাল ডিস্টার্ব করে ফেললাম।”
” একদম না। বরং মনটা খারাপ ছিল। আপনার ফোন পেয়ে ভালো হয়ে গেল।”
” মনখারাপ ছিল কেন?”
” সেটা এখন বলতে ইচ্ছে করছে না। বাদ দিন।”
আমীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” ওকে। বাদ দিলাম। তাহলে একবার বারান্দায় আসো। দেখি তোমার মন ভালো করার ব্যবস্থা করা যায় কি-না!”
” মানে? বারান্দায় কি?”
” এলেই দেখবে।”
তোহা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আগে নিজেকে পরিপাটি করল। ঘুম থেকে উঠেছে কিন্তু ফ্রেশ হওয়া হয়নি। কেমন তেলতেলে একটা ভাব মুখে লেগে আছে। সে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বারান্দায় গেল। নিচে আমীর দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে হলুদ টি-শার্ট, সাদা প্যান্ট। তোহা বিস্মিত হয়ে বলল,” আপনি এখানে কি করছেন?”
আমীর একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,” তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। তাই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি।”
তোহা প্রথমে ভেবেছিল খুশিতে সে নিজেই আধপাগল হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আমীরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সে তো পুরোপুরি পাগল! তোহা শব্দ করে হেসে উঠল,” ভালো করেছেন। এবার ভেতরে আসুন।”
” উহুম। তুমি নিচে আসো। আজকে আমরা একটা জায়গায় যাবো।”
কিছুক্ষণ আগে যেভাবে জাবিদার সাথে কথা কাটাকাটি হলো, এরপর আমীরকে বাড়িতে এনে বসানোটা সুবিধাজনক হবে না। এই ভেবে তোহা বলল,” ঠিকাছে আসতে হবে না। আপনি ওখানেই অপেক্ষা করুন। আমি নামছি। কিন্তু আমরা কোথায় যাবো?”
” সারপ্রাইজ।”
তোহা আবারও হাসল,” আচ্ছা।”
ঘরে এসে একটা সুন্দর কমলা রঙের জামা বের করল তোহা। আমীর হলুদ পরেছে তাই সে পরবে কমলা। সেজে-গুজে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় জাবিদা প্রশ্ন করল,” কোথায় যাচ্ছিস?”
তোহা গোমরা মুখে উত্তর দিল,” কাজ আছে।”
জাবিদা জানে কি সেই কাজ! তাই আর প্রশ্ন করল না। যা ইচ্ছা করুক। সে কিছুই বলবে না আপাতত। তোহা বাইরে এসে দেখল আমীর ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তার মুখে লেপ্টে আছে হাসি। চোখে মুগ্ধতা। তোহাকে দেখেই বুকের বামপাশে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,” ইশ, এতো সুন্দর কেন?”
লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল তোহা। আমীর হাত বাড়িয়ে তোহার হাতটা ধরল। তারপর পরম আদর নিয়ে হাতের পিঠে চুমু দিল। তোহার হঠাৎ করেই অনুভব হলো জীবনটা বড় সুন্দর। গতকালও তার মনে হচ্ছিল বেঁচে থাকার চেয়ে ম-রে যাওয়া সহজ। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে মানুষের আয়ুষ্কাল এতো সংক্ষিপ্ত কেন? সে অনন্তকাল ধরে বাঁচতে চায়!
_________
তখন গোধূলী বেলা। যেকোনো সময় সূর্য ডুব দিবে। মিরানো শহরের ট্যাপেইনারওয়েগের রাস্তা ধরে হাঁটছে আমীর আর তোহা। খুব উঁচুতে তাদের অবস্থান। তোহার মনে হচ্ছে যেকোনো সময় সে পড়ে যাবে। আমীর হাত ধরে থাকায় ভয় একটু কম লাগছিল। কিন্তু এখন আমীর তার সাথে নেই। সে ইচ্ছে করেই আমীরের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে। তার পেছনেই মাথা নিচু করে আসছে আমীর। সরু রাস্তার একপাশে বেরিকেড অন্যপাশে পাহাড়। নীল আকাশ এখন লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সবুজ পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছে সোনালী স্তূপ। তোহার চোখে মুগ্ধতা। কিন্তু মুখ গম্ভীর। অনেকক্ষণ ধরে সে কোনো কথাই বলছে না। আমীর কাছে এসে হাতটা ধরতে নিলেই তোহা সরে গেল।
” এখনও রেগে আছো?” সাবধানে প্রশ্ন করল আমীর।
তোহা ত্যাড়া গলায় উত্তর দিল,” না, রেগে থাকব কেন? রাগার মতো কিছু কি ঘটেছে?”
” তাহলে হাত ধরতে দিচ্ছো না কেন?”
তোহা টিপ্পনী কাটতে বলল,” আসলে খুব হ্যান্ডসাম মানুষের হাত ধরে হাঁটতে আমার অস্বস্তি হয়।”
আমীরের হাসি পেলেও সে চুপ রইল। কি একটা অবস্থা! কিছুক্ষণ আগে এক বিদেশীনি পাহাড়ে আরোহণ করার সময় পিছলে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। ঠিক ওই সময় আমীর আর তোহা সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। মেয়েটি পড়লে ঠিক আমীরের উপরে এসে পড়বে। তাই বাধ্য হয়ে আমীর মেয়েটিকে ধরে ফেলেছে। অল্প সময়ের নীরবতা। তারপর মেয়েটি হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল,” থ্যাঙ্কিউ হ্যান্ডসাম।”
সেই ‘হ্যান্ডসাম’ শব্দটা শোনার পর থেকেই তোহা রাগে চোখমুখ অন্ধকার করে হাঁটছে। আমীর বুঝতে পারছে না এখানে তার দোষটা কই? একটা মানুষ পড়ে যাচ্ছে আর সে ধরবে না? চেয়ে চেয়ে দেখবে? আমীর অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,” মেয়ে মানুষের শিরায় শিরায় যে এতো ঈর্ষা তা আগে জানতাম না।”
তোহা তার চোখ দু’টো মার্বেলের মতো গোল বানিয়ে বলল,” বাই এনি চান্স, আপনি কি আমাকে হিংসুটে বললেন?”
” না, তোমাকে বলব কেন? ফলের জুস খাবে?”
” আপনিই খান।”
তোহা পাংশুটে মুখ করে রাস্তার একপাশে দাঁড়াল। আমীর জুস কিনতে গেল। তখনি তোহা দেখতে পেল সেই বিদেশী মেয়েটি তার বন্ধুদের সাথে এদিকেই আসছে। তারাও ফলের জুস কিনবে। আমীরও সেখানেই গিয়েছে। তোহার বুক ধ্বক করে উঠল। তার মনে হচ্ছে আমীরকে একা যেতে দেওয়া ঠিক হয়নি৷ তারও আমীরের সঙ্গে যাওয়া উচিৎ ছিল। আচ্ছা, সে কি বেশি পজেসিভ হয়ে যাচ্ছে? এভাবে চলতে থাকলে আমীর কি তাকে টক্সিক ভাববে? তোহা নিজেকে সংবরণ করতে চাইল। মনে মনে বলল,” হে আল্লাহ, তুমি আমার ধৈর্য্যশক্তি বাড়িয়ে দাও। আমাকে সহ্য করার শক্তি দাও। ওর দিকে কোনো মেয়ে তাকালেই আমার ইচ্ছে করে মেয়েটির চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলি। আমি যেন আমার এই বাজে স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তুমি আমাকে স্বাভাবিক থাকার ক্ষমতা দাও। আমিন।”
তোহা চোখ খুলতেই দেখল আমীর অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। তার দুইহাতে ঠান্ডা ঠান্ডা লাল রঙা ফুলের জুস। তোহা লজ্জায় পড়ে গেল। আমীর বলল,” চোখ বন্ধ করে কি বিড়বিড় করছো?”
তোহা ইতস্তত হয়ে বলল,” কিছু না। কি জুস এনেছেন দেখি…”
এই কথা বলেই সে এক গ্লাস জুস নিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেলল। অনেকক্ষণ হাঁটার কারণে খুব তৃষ্ণাও পেয়েছে। আমীর হেসে বলল,” তুমি তো বলেছিলে খাবে না।”
” তো? আপনি দুই গ্লাস এনেছেন কেন? নাকি দু’টো গ্লাসই নিজের জন্য এনেছেন?”
” না, ঠিকাছে। আমি জানতাম তুমি খাবে।”
” দেখুন, ওই মেয়েটা বার-বার আপনার দিকেই তাকাচ্ছে।”
আমীর গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলল,” মুখ ঢেকে রাখব নাকি? তুমি একটা কাজ করো, তোমার ওরনা দিয়ে আমার মুখটা বেঁধে দাও।”
তোহা রেগে তাকাল,” আপনি কি আমার সাথে ফাজলামি করছেন? দেখি, এদিকে দিন।”
সে খপ করে আমীরের হাত থেকে গ্লাস ছিনিয়ে নিল। আমীর চমকে উঠল,” আরে, কি করছো?”
” অনেক খেয়েছেন। এখন এটা ফেলে দিবো। আপনার শাস্তি।”
তোহা জুসের গ্লাস নিয়ে ওই মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেল। ধাক্কা খাওয়ার বাহানায় ইচ্ছে করেই মেয়েটির গায়ের উপর জুস ফেলে দিল। মেয়েটি শব্দ করে বলল,” আর ইউ ইনসেন?”
তোহা বিড়বিড় করে শাসাল,” হি ইজ মাইন। ডন্ট ডেয়ার টু লুক এট হীম৷ আদারওয়াইজ আই উইল কিল ইউ।”
মেয়েটি হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল। তোহা তার কথা শেষ করে চুপচাপ হেঁটে এলো। মেয়েটি তার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল,” শী ইজ ক্রেজি!” আমীর কপালে কুচকে পুরো ঘটনা দেখল। তোহা কাছে আসতেই সে জিজ্ঞেস করল,” তুমি মেয়েটাকে কি বললে?”
” কিছু না, ভুল করে ধাক্কা লেগে গেছিল। তাই স্যরি বলেছি।”
” সত্যি? ভুল করে ধাক্কা লেগেছে?”
” আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন? আমি মিথ্যা কেন বলব?”
” সন্দেহ করিনি। স্যরি।”
তোহা হেসে আমীরের হাত ধরে বলল,” চলুন অন্যকোথাও যাই। এখানে অনেক গরম।”
সূর্য অস্ত যেতে শুরু করেছে। শহরটা যেন খুব দ্রুত অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তীব্র বাতাস শুরু হলো। তোহার ছোট চুলগুলো উড়ছে। তার মন এখন যথেষ্ট ফুরফুরে। সে অকারণেই হাসছে। আমীর তাকে নিয়ে সিঁড়ি ভাঙছে একটা উঁচু জায়গায় ওঠার উদ্দেশ্যে। তোহা ভীত কণ্ঠে বলল,” আমরা ওখানে কেন যাচ্ছি?”
” একটা মজা দেখাবো। চলো।”
” আপনি আবার আমাকে উপরে নিয়ে ফেলে দিবেন না তো?”
আমীর অবাক হয়ে তাকাল,” এটা কি ধরণের কথা?”
তোহা খিলখিল করে হাসল,” মজা করলাম।”
উপরে ওঠার পর তোহা অভিভূত হয়ে গেল। কমলা আকাশে সূর্য অস্তমিত যাওয়ার দৃশ্যটা এতো অপূর্ব!এখান থেকে পুরো মিরানো শহরটাই নজরে পড়ে। সে দুইহাত গালে ঠেঁকিয়ে তীব্র উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,” চমৎকার! চমৎকার! এতো সুন্দর কেন পৃথিবী? আমার অনেক ভালো লাগছে।”
আমীর পেছন থেকে তোহার কোমড় ধরে তাকে উপরে তুলল। ভয়ে কাবু হয়ে চোখ-মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলল তোহা। আতঙ্ক ভরা কণ্ঠে আওড়াল,” কি করছেন?”
আমীর শীতল কণ্ঠে বলল,” ফেলে দেই?”
” দেখুন ফাজলামি করবেন না। আমার হাইট ফোবিয়া আছে। প্লিজ আমাকে নিচে রাখুন।”
আমীর তোহাকে নিচে রাখল না। আরও উপরে তুলল। তোহা চিৎকার করে উঠল। আমীর সটান করে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে চুমু দিল। তোহার ভয় তাতেও কমল না। আমীর তাকে কার্ণিশের উপর বসালো। নিচের দিকে একনজর তাকাতেই তোহার হৃৎস্পন্দন থমকে যাওয়ার অবস্থা হলো। সে মিনতির স্বরে বলল,” প্লিজ আমাকে নিচে নামান। খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু।”
আমীর হাঁটু গেঁড়ে বসল তোহার পায়ের কাছে। তার কম্পিত বাম হাতটা ধরল। ভয়ে তার আঙুলগুলোও কাঁপছে। আমীর মুচকি হেসে তোহার হাতে চুমু দিল। তোহা চোখ খুলতেই দেখতে পেল অন্ধকারে চকচক করছে তার অনামিকা আঙুল। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে সে উচ্চারণ করল,” এটা, এটা অনেক সুন্দর!”
তোহার কণ্ঠ কাঁপছে। খুশিতে টলমল করছে চোখ দু’টো। যেন এখনি সে কেঁদে ফেলবে। আমীর বলল,” প্রতিদিন প্রপোজ করব। বলেছিলাম না?”
তোহার চোখ থেকে এবার টুপ করে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সে হাতের রিংটার দিকে তাকিয়ে বলল,” আপনার চয়েজ খুব সুন্দর। আমার এটা অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে।”
আমীর উঠে দাঁড়ালো। তোহাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল,” মিষ্টি মেয়ে, চলো বিয়ে করি।”
” এখন?” কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল তোহা।
আমীর আদুরে কণ্ঠে বলল,” হুম এখুনি। আজকে বিয়ে করে রাতের ফ্লাইটেই চলো বাংলাদেশ চলে যাই।”
তোহা আমীরের বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলল,” এখন না। আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন। ফুপু আর আলিফ ভাইয়া রাজি হলেই আমরা বিয়ে করব।”
” তারা কি রাজি হয়নি?”
তোহা আসল কথা আমীরকে জানাল না। মিথ্যা করে বলল,” আমি এখনও বাড়িতে কিছু বলিনি। আগে বলি, আমার ধারণা রাজি হবে। এখন তারা ছাড়া আমার কে আছে বলুন? খারাপ সময়ে তারা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। যদি তাদের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করি তাহলে বেঈমানি হবে।”
আমীর বলল,” ঠিকাছে, তুমি সময় নাও। আমি অপেক্ষা করব।”
” এবার আমাকে নামান। ভয় লাগছে!”
আমীর তোহার হাত দু’টো নিজের কাঁধের উপর রাখল।তার কাঁধে ভর দিয়ে তোহা নিচে নেমে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” আমি ভেবেছিলাম কালকের দিনটাই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। কিন্তু আজকের দিনটা আরও সুন্দর। ”
আমীর বলল,”আগামীকালটা হবে আরও সুন্দর। ”
তোহা লাজুক কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আপনি সাথে থাকলেই প্রতিটি দিন হবে আগের দিনের চেয়ে সুন্দর। ”
তারপর সে গভীর আবেগ নিয়ে আমীরের ঠোঁটে চুমু দিতে উদ্যত হলো। তোহার সুবিধার জন্য আমীর সামান্য নিচু হলো। চারদিকে শনশন বাতাস। সূর্য ডুবে গেছে। প্রকৃতি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। সে এক মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা! একজোড়া মানব-মানবী তখন তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত উপভোগ করছে।
_______________
আলিফ আধঘণ্টা ধরে অপেক্ষমাণ। একটু আগে আফশান এসে জানাল,” আর মাত্র পাঁচমিনিট অপেক্ষা করুন। স্যার আসছেন।”
আলিফ ঘড়ি দেখল, সাতমিনিট হয়ে গেছে। এখনও আমীরের আসার নাম-গন্ধ নেই। সে বাড়িতে ফোন করে জানতে পেরেছে তোহাও নাকি এখনও বাড়ি ফিরেনি। অর্থাৎ সহজেই ধারণা করা যায় যে তারা দু’জন একসাথে আছে৷ আলিফ বুঝতে পারল না, সারাদিন ধরে তারা একসাথে করছেটা কি? আমীর এলো আরও পনেরো মিনিট পর। তোহাকে বাড়িতে ড্রপ করে সে একটা সুপার শপে গিয়েছিল। সেখান থেকে কিছু প্রয়োজনীয় কেনা-কাটা সেরে হোটেলে এসেছে। আলিফকে লিভিংরুমে অপেক্ষারত দেখে সে সর্বপ্রথম সেখানেই গেল৷ সোফায় বসতে বসতে আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল,” ওয়েলকাম আলিফসাহেব। কেমন আছেন?”
আলিফ ভদ্রতার খাতিরে হাসল। আমীরের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল,” ভালো আছি। আমার অফিস এই কাছেই। শুনলাম আপনি নাকি এই হোটেলে উঠেছেন। তাই ভাবলাম একটু দেখা করে যাই।”
” ভালো করেছেন। আপনি কতক্ষণ ধরে বসে আছেন? ওরা আপনাকে চা-কফি কিছু দিয়েছে?”
” না। আমি আসলে কিছু খাবো না। এমনিই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। জরুরী একটা বিষয়ে কথাও ছিল।”
” তাই? ঠিকাছে বলুন।”
আলিফ কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারল না। আমীর আসার সাথে সাথেই তার খুব ইতস্ততবোধ হচ্ছে। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। সে যেই উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে সেটা সফল করতেই হবে। একটু আমতা-আমতা করে বলল,” তোহার সাথে আপনার সম্পর্কের ব্যাপারে আমরা কালই জানতে পেরেছি।”
” ও আচ্ছা। আপনি কি এই বিষয়ে কথা বলার জন্য এখানে এসেছেন?”
” জ্বী। ”
” বলুন।”
“আমি আপনাকে ছোট্ট একটা সাজেশন দিবো। এই বিয়েটা আপনি করবেন না। তাহলে কিন্তু পস্তাবেন।” অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাটা বলেই আলিফ আমীরের দিকে তাকাল।
আমীরের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। সে চোয়াল শক্ত করে বলল,” কেন?”
আলিফ হাসল,” আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। কারণটা আপনার নিজেরই বোঝা উচিৎ। বিয়ের জন্য তোহার মতো মেয়েকে আপনি কিভাবে পছন্দ করলেন সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না। নিজের বোন বলে তার দোষ আমি আড়াল করব না। আপনাকে আমি সত্যি জানাতে এসেছি।”
আলিফ ঝেড়ে গলা পরিষ্কার করে নিল। অতি সন্তর্পণে সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যা বলল,” আমার বিয়ের আগে তোহার সাথে একটা সম্পর্ক ছিল। ও নিশ্চয়ই এই কথা আপনাকে জানায়নি। অবশ্য আমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা অনেকেই জানে না। আমার মাও না। এমনকি আমার স্ত্রীও না। এটা কাউকে জানানোর মতো ঘটনাই না। ব্যাপারটা খুবই অকওয়ার্ড। বলতে আমার লজ্জাই লাগছে। কিন্তু… ”
আলিফ নির্দ্বিধায় একগাদা বিশ্রী মিথ্যা অবলীলায় বলে গেল। আমীর অনেকক্ষণ ধৈর্য্য ধরে বসেছিল। হঠাৎ সে উঠে আলিফের গালে ঠাটিয়ে চড় মা-রল। চড়ের জোর এতোই বেশি ছিল যে আলিফ সোফায় শুয়ে পড়ল। উচ্চ শব্দ শুনে আফশানসহ আরও কয়েকজন ছুটে এলো।
_________________
তোহা বাড়ি ফিরে দেখল কথা খুব কান্নাকাটি করছে। জাবিদাও অস্থির হয়ে উঠেছে৷ রাত আটটা বাজে। কিন্তু আলিফ এখনও বাড়ি ফিরেনি। সে এতো দেরি কখনও করে না। তার ফোনও বন্ধ। কথা কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আমার স্বপ্নটাই সত্যি হয়েছে। দেখলেন তো মা? এজন্যই আজ ওকে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলাম৷ কিন্তু ও আমার কথা শুনলে তো!”
জাবিদা তোহার দিকে চেয়ে বলল,” দ্যাখ তো মা, কি শুরু করেছে মেয়েটা! ওর কান্নাকাটি দেখে এখন আমারও ভয় লাগছে।”
তোহা বিচলিত ভঙ্গিতে বলল,” আমাকে আগে জানালে না কেন? তাহলে আমি গিয়ে ভাইয়ার অফিসে একবার খোঁজ নিতে পারতাম।”
কথা উদগ্রীব হয়ে বলল,” এখন পারবে না?”
” ভাবী তুমি টেনশন কোরো না। আমি দেখছি।”
তোহা তার ঘরে এসে আমীরকে ফোন করল। আমীর তখন আলিফের আঘাতকৃত গালে বরফ ডলে দিচ্ছে। জায়গাটা অনেক ফুলে গেছে। দেখতে কেমন বাজে লাগছে। অন্যদিক থেকে আফশান তার মাথায় পিস্তল ঠেঁকিয়ে রেখেছে। নিঃশ্বাস আটকে রোবটের মতো বসে রয়েছে আলিফ৷ সে এখন জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে আছে। অনবরত ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ পড়ার চেষ্টা করছে। আমীর তাকে চড় মে-রে আবার গালে বরফ ডলে দিচ্ছে। মাথায় পিস্তলও তাঁক করে রেখেছে। এসবের মানে কি? আলিফ বুঝতে পারছে না আমীরের উদ্দেশ্য। ভয়ে তার আত্মা নিভু নিভু করছে।
আমীর অন্য হাতে ফোন রিসিভ করে বলল,” হ্যালো সুইটহার্ট।”
তোহা অস্থিরচিত্তে বলল,” আলিফ ভাইয়া এখনও বাড়ি ফিরেনি। বাসার সবাই খুব টেনশন করছে। কি করি বলুন তো?আপনি কি একবার আসতে পারবেন? আমি আপনাকে নিয়ে আলিফ ভাইয়ের অফিসে যাবো।”
” কি বলো! আচ্ছা আমি এখনি আসছি। তুমি টেনশন কোরো না।” আমীর তার কণ্ঠে কৃত্রিম দুশ্চিন্তার ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। তোহা বলল,” থ্যাঙ্কিউ। দ্রুত আসুন প্লিজ।”
” এইতো, জাস্ট ফাইভ মিনিটসে বের হচ্ছি আমি।”
ফোন রেখে আমীর আফশানকে আদেশ করল,” একে পানিতে চুবিয়ে রাখবে। আমি না আসা পর্যন্ত ছাড়বে না।”
” ওকে স্যার।”
আলিফ করুণ গলায় বলল,” প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দিন। প্লিজ।”
কে শোনে কার কথা? একজন বালতি ভরা ঠান্ডা পানি নিয়ে এলো। আফশান ঘাড় ধরে সত্যি সত্যি আলিফকে পানিতে চুবানো শুরু করল। প্রত্যেকবার আলিফের নিঃশ্বাস আটকে আসে। মনে হয় সে এখনি ম-রে যাবে। ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে ওঠানো হয়। কয়েকবার প্রাণপণে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিয়ে তাকে পুনরায় চুবানো হয়৷ এমন ভয়ংকর অত্যাচারের মানে কি?
চলবে
® Sidratul মুন্তায
#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৪৮.
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে আলিফকে খোঁজা হচ্ছে। অফিস থেকে সে বের হয়েছিল সন্ধ্যা নামার আগে। কোনো বন্ধুর বাড়িতেও যায়নি। যেসব কলিগের বাড়িতে আড্ডা দিতো সেখানেও খোঁজ নেওয়া হয়েছে। সে কোথাও নেই। অবশেষে তোহা দুশ্চিন্তায় টিকতে না পেরে বলল,” চলুন আমরা থানায় যাই।”
আমীর শান্ত গলায় বলল,” এখনি থানায় যাওয়ার মতো কিছু হয়নি। আজকে রাতটা অন্তত অপেক্ষা করা উচিৎ। তারপরেও খুঁজে না পেলে সকালে যাবো।”
তোহা মাথায় হাত ঠেঁকালো। আপনমনে বলল,” আলিফ ভাইয়া তো কখনও এমন করে না। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে। সে কি জানে না বাসার সবাই যে টেনশন করছে! উফ, আমি এখন ভাবী আর ফুপুকে কি বলব?আমার খুব ভয় লাগছে।”
” ভয়ের কিছু নেই। আমি বলছি তো কিছু হবে না।”
” আপনি এতো শিউর হচ্ছেন কিভাবে?”
তোহা চোখে হাত দিয়ে প্রায় কান্না কান্না ভাব শুরু করল। তার আসলেই প্রচন্ড খারাপ লাগছে। কথা প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় যদি আলিফের কিছু হয়… তোহা ভাবতেই পারছে না। এতো খারাপ সময় না আসুক। আমীর তোহার অবস্থা দেখে গাড়ি থেকে নেমে গেল। মোবাইল বের করে আফশানকে একটা মেসেজ লিখল। তারপর পুনরায় গাড়িতে এসে বসতেই তোহা জিজ্ঞেস করল,” কি ব্যাপার? কোথায় গিয়েছিলেন?”
” কিছু না। একটা ফোন এসেছিল।”
” ওহ।”
আমীর তোহার একটা হাত নিজের কাছে এনে বলল,” ট্রাস্ট মি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কেঁদো না।”
তোহা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” কথা ভাবী নাকি আজ ভোরেই খুব ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। জানেন, বাবার মৃ-ত্যুর আগে আমিও দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। আমার স্বপ্নটা তো সত্যি হয়েছে। যদি এবারও সেরকম কিছু হয়?”
তোহা কাঁদতে শুরু করল। আমীর তার মাথাটা বুকে চেপে ধরল। কপালে চুমু দিয়ে বলল,” শশশ, এরকম কিছুই হবে না। চলো আমরা বাসায় যাই।”
” বাসায় গিয়ে কি করব?”
” অপেক্ষা করব।”
” না। আমার বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। ফুপু আর ভাবীর কান্না দেখার চেয়ে ভালো এখানেই বসে থাকি।”
তোহা আমীরের বুকে আরও ভালো করে মাথা রাখল। আমীর প্রশান্তিতে চোখ বুজে বলল,” আচ্ছা। বসে থাকো।”
তারা বেশ কিছু সময় এভাবেই বসে থাকে। ব্যস্ত রাস্তার দিকে নির্ণিমেষ তাকিয়ে থাকে তোহা। তার মাথায় হাজারো স্মৃতি ঘুরপাক খায়। শৈশবের স্মৃতি, কৈশোরের স্মৃতি… সব স্মৃতিতেই বাবা খুব আধিপত্য নিয়ে বিরাজমান। তোহা তার বাবাকে প্রচন্ড মিস করে। আমীরের বুকের ঢিপঢিপ শব্দ শুনতে শুনতে সে আকাশের দিকে তাকায়। আজ অন্ধকার আকাশে যেই তারাটা সবচেয়ে উজ্জ্বল, সেদিকে আঙুল উঠিয়ে বলল,” জানেন, ওই তারাটা আবার বাবা। যতবার আমি আকাশে তাকাই ততবার মনে হয় বাবা বুঝি আমাকে দেখছে!”
আমীর গাঢ় বেদনা নিয়ে প্রশ্ন করল,” তোমার কি মনে হয়? তিনি তোমাকে দেখে খুশি হচ্ছেন নাকি কষ্ট পাচ্ছেন?”
” জানি না।”
তোহা হঠাৎ আমীরের বুক থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসল। ছেলেমানুষী কণ্ঠে বলল,” এখন আমার একটা পাগলামী করতে ইচ্ছে করছে। আপনি কিন্তু খবরদার হাসবেন না। ”
আমীর মৃদু হেসে বলল,” আচ্ছা।”
তোহা গাড়ি থেকে নেমে গেল। আমীরও তার সাথে নামল। সড়কের একদম কিনারে গিয়ে তোহা দুইহাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলল,” বাবা শোনো, আমি তোমাকে প্রচন্ড মিস করি বাবা। আই মিস ইউ সো মাচ।”
আমীরের চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল সরলরেখার মতো গড়িয়ে যায়। তোহা দেখে ফেলার আগেই সে জলটা মুছে নেয়। তোহা আমীরের কাছে এসে তাকে স্পর্শ করে বলল,” দেখো বাবা, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশি পেয়ে গেছি। এই মানুষটা আমার সাথে থাকলে দুঃখ কখনও আমার কাছে ভিড়তেই পারবে না। আমরা খুব দ্রুত বিয়ে করছি বাবা। তুমি আমাদের জন্য দোয়া করবে তো? আমরা যাতে সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে পারি। কোনোদিন যেন আলাদা না হই।”
তোহা প্রবল উচ্ছ্বাস নিয়ে আমীরকে জড়িয়ে ধরে। আমীর দাঁড়িয়ে থাকে স্থাণুর মতো। সে হাত বাড়িয়ে তোহাকে ধরছিল না। তাই তোহা তার হাত দু’টো নিয়ে নিজেই নিজের পিঠের উপর রাখল। আর ফিসফিস করে বলল,” আই লভ ইউ।”
তোহার মুখে আনন্দের হাসি লেগে আছে। অথচ আমীরের চেহারা গম্ভীর। সে মনে মনে বলল,” মায়াবতী, আই এম স্যরি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
_________________
আলিফ বাড়ি ফিরেছে আহত অবস্থায়। তার গালে, চোখের কোণে, ঠোঁটে আঘাতের চিহ্ন। মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা সবকিছু রেখে দেওয়া হয়েছে। যেন পুরো ব্যাপারটাকেই একটা দূর্ঘটনা মনে হয়। সে এসেছে বিশমিনিট হবে। কথার কান্না এখনও থামেনি। সে আলিফকে দেখে খুশিতে এখন আরও বেশি কাঁদতে শুরু করেছে। জাবিদা আফসোস করে বলল,” আহারে, কি বিপদ! তুই আজ গাড়ি না নিয়ে কেন বের হলি বলতো বাবা?”
মাহমুদ সাহেব বললেন,” রাতের বেলা অপরিচিত মানুষের গাড়িতে ওঠাই তো বোকামি। বাড়িতে ফোন করলেই আজাদকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। তুই কেন কিছু জানালি না?”
আলিফ মাথা নিচু করে বসে আছে। তার সামনেই বরাবর সোফায় বসে আছে আমীর। তার পেছনেই তোহা দাঁড়ানো। ভয়ে আলিফ কোনো কথাই বলার সাহস পাচ্ছে না৷ তাকে যা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাড়ি এসে শুধু সেটুকুই বলেছে। ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছিল সে। তারা টাকা-পয়সা আর মোবাইল হাতিয়ে নিয়ে চলে গেছে।
মাহমুদ সাহেব বললেন,” সকালেই পুলিশের কাছে গিয়ে একটা ডায়েরী করে আসবি। এতোগুলো টাকা, এতো দামী ফোন হারিয়ে গেল, এসব খুঁজে বের করতে হবে না?”
আলিফ বিরক্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” জীবন নিয়ে যে ফিরেছি এটাই বেশি বাবা। ফোন, টাকা-পয়সা দিয়ে আমি কি করব?”
জাবিদা ছেলের সঙ্গে একমত হয়ে বলল,” হ্যাঁ সেটাই। ছেলে যে আমার ঘরে ফিরেছে এটাই বড় পাওয়া। ইশ, কি একটা বিপদ গেল!”
কথা কান্না মাখা কণ্ঠে বলল,” এখন থেকে তুমি গাড়ি ছাড়া কোথাও বের হবে না। সবসময় বডিগার্ড সঙ্গে রাখবে। যেখানেই যাবে আজাদকে নিয়ে যাবে।”
” আমি আজাদকে নিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরলে বাড়িতে তোমাদের দেখবে কে?”
” আমাদের এতো দেখে রাখার কিছু নেই। প্রয়োজনে নতুন দারোয়ান রাখবে। তোমার সেইফটি সবার আগে। আজকে যদি কিছু হয়ে যেতো?”
তোহা মলিন মুখে বলল,” সেটাই ভাইয়া। ভাবী ঠিক কথাই বলেছে। তুমি আজাদ ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বের হবে এখন থেকে। ”
আমীর এতোক্ষণে উঠে দাঁড়ালো। আলিফের দিকে চেয়ে শীতল হাসি দিয়ে বলল,” আসছি আলিফ সাহেব। এখন থেকে একটু সাবধানে চলা-ফেরা করবেন। বলা যায় না, এরকম বিপদ আবার হতে পারে।”
আমীর সরাসরি হুমকি দিচ্ছে যেন। আলিফের গলা শুকিয়ে এলো। সে ধীরগতিতে মাথা নাড়ল। জাবিদা বলল,” আজরাতে থেকে যাও বাবা। তুমি কত কষ্ট করেছো!”
” না আন্টি। আজ থাকতে পারব না। আরেকদিন আসব।”
” অবশ্যই এসো কিন্তু।”
” আচ্ছা।”
তোহা বলল,” আমি আপনাকে এগিয়ে দিচ্ছি।”
তারা দু’জন মেইন গেইট পর্যন্ত গেল। তখনি আলিফ বলল,” ওদের বিয়েটা মনে হয় এবার দিয়ে দেওয়া উচিৎ। তাই না মা?”
জাবিদা এই কথা শুনে বিস্মিত হয়ে তাকাল,” মানে? কাদের কথা বলছিস?”
” তোহা আর আমীরসাহেব। মানে ওরা তো একজন-আরেকজনকে পছন্দ করেই ফেলেছে। আমরা আর বাগড়া দিয়ে কি করব?”
কথা স্বামীর সাথে সুর মিলিয়ে বলল,” হ্যাঁ সেটাই। আমিও আজ সকালে মাকে এই কথা বলছিলাম।”
জাবিদা হতবাক কণ্ঠে জানতে চাইল,” তোর হঠাৎ কি হয়েছে? আজ সকালেই না তুই বললি এই বিয়েতে কোনোভাবেই মত দিবি না?”
” হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাওয়াই মঙ্গল।”
“বিয়ে হয়ে যাওয়া মঙ্গল কেন?”
মাহমুদ সাহেব বললেন,” ঠিকই আছে। এমনিতেও মেয়েটা এখানে এসে বাড়তি ঝামেলা করছে। তার একটা বিয়ে দিতে পারলেই বরং বাঁচি আমরা। তাছাড়া অনাথ মেয়েকে কে বিয়ে করবে? এমন ছেলেও যে বিয়ে করতে চাইছে সেটাই অনেক।”
জাবিদা আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। বিপদের সময় ডাকার সঙ্গে সঙ্গে আমীর চলে এসেছে। সবদিক দিয়েই ছেলেটা ভালো। শুধু আগে একবার বিয়ে হয়েছিল এটাই একটা সমস্যা। তাছাড়া তোহারও তো বাবা-মা কেউ নেই। সহজে অনাথ মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। ভেবে দেখতে গেলে তারা একে-অপরের জন্য ঠিকই আছে। তোহাও যেহেতু আমীরকে এতো পছন্দ করে…জাবিদা নিজের মনকে মানিয়ে নিল। হোক তবে বিয়েটা! ভাগ্যে থাকলে কত-কিছুই তো হয়!
তোহা মিষ্টি করে হেসে বলল,” আজকে সারাদিনের জন্য আপনাকে থ্যাংকস। ”
আমীর দুষ্ট গলায় বলল,” শুধু থ্যাংকস?”
তোহা হেসে ফেলল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বলল,” তাহলে কি চান?”
আমীর তোহাকে হাত ধরে টেনে কাছে আনল। চুমু দিতে নিলেই কোথ থেকে যেন বিকট শব্দে বাঁশি বেজে উঠল। ভয়ে ছিটকে সরে গেল তোহা। আমীর দেখল মেইন গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আজাদ বাঁশি বাজাচ্ছে। সে ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল,” আজাদ, সমস্যা কি তোমার? ”
আমীরের কণ্ঠ শুনে আজাদ একটু ভড়কে গিয়ে বলল,” আশেপাশে কোনো বিপদ আছে নাকি সেজন্য স্যার। মানে বাঁশি বাজালে সবাই সতর্ক হয়ে যায়।”
তোহা হেসে উঠল। আমীর বলল,” আশেপাশে কোনো বিপদ নেই। কিন্তু আরেকবার বাঁশি বাজালে তোমার বিপদ অবশ্যই আছে।”
আজাদ ভয়ে বলল,” স্যরি স্যার। আর হবে না।”
সে সঙ্গে সঙ্গে বাঁশি ফেলে দিল। তোহার হাসি যেন থামছেই না। আমীর গাড়িতে উঠে তোহাকে মেসেজ করল,” সবসময় এভাবে হাসবে মায়াবতী। তোমার কাজই হলো হাসতে হাসতে আমার পৃথিবীটাকে ছন্দময় করে তোলা।”
তোহা এক নিঃশ্বাসে মেসেজটা টানা তিনবার পড়ে ফেলল। এতো সুন্দর করে কেউ হাসতে বলেনি আগে। সে লিখল,” আর আপনার কাজ হলো সারাক্ষণ ছায়ার মতো আমার কাছাকাছি থাকা। তবেই আমি হাসবো সবসময়। বুঝতে পেরেছেন?”
সেকেন্ড না গড়াতেই আমীর রিপ্লাই করল,” যথা আজ্ঞা মহারানী। বুঝতে পেরেছি।”
_________________
স্নেহা যত্ন করে চিঠি লিখতে বসেছে। হঠাৎ রাশেদ ঘরে ঢুকে পড়ল। স্নেহা বাতাসের গতিতে চিঠির কাগজটা সরিয়ে বলল,” কি ব্যাপার? অনুমতি ছাড়া তুমি আমার ঘরে ঢুকেছো কেন?”
” নিজের বউয়ের ঘরে ঢুকতেও অনুমতি লাগবে? কি আশ্চর্য! ”
রাশেদ বিছানায় আয়েশ করল শুয়ে পড়ল। স্নেহা টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,” সবারই একটু-আধটু প্রাইভেসির দরকার আছে।”
” আমার কাছে কিসের প্রাইভেসি? আর তুমি কি এমন করছিলে যে এতো প্রাইভেসির দরকার হয়ে গেল? দেখি…”
রাশেদ উঠতে নিলেই স্নেহা তড়িঘড়ি করে বলল,” কিছু না।” তার মুখ ইতিমধ্যে আতঙ্কে শুকিয়ে গেছে। রাশেদ চিঠি দেখে ফেললে সর্বনাশ হবে। সে পরিস্থিতি সামলানোর নিমিত্তে বলল,” তুমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলে? আমার একা একা থাকতে একদম ভালো লাগছিল না।”
রাশেদ ভ্রু কুচকালো,” এই মাত্রই না বললে তোমার প্রাইভেসি দরকার? এখন আবার বলছো একা একা থাকতে ভালো লাগছিল না। তোমার মতলবটা কি স্নেহা?”
” কিছু না। তুমি না, খুব বেশি কথা বলো ইদানীং।”
স্নেহা রাশেদের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করল। গায়ের শাড়ি টেনে খুলে ফেলল। রাশেদ সবকিছু ভুলে স্নেহাতে ডুব দিল। খিলখিল করে হাসল স্নেহা। ছেলেমানুষ যতই চালাক হোক, তাদেরকে বোকা বানানোর মূল অস্ত্র হলো আদর। প্রেয়সীর আদর পেলেই তারা সবকিছু ভুলে যায়। তবে সেটা শুধু সাময়িক সময়ের জন্য প্রযোজ্য। রাশেদও সাময়িক সময়ের জন্য বোকা বনে রইল। স্নেহা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে ঠিকই মনে করে টেবিলের কাছে এলো। এখানে বসেই কাগজে কিছু একটা লিখছিল স্নেহা। রাশেদের কেমন খটকা লাগছে। কি এমন ব্যক্তিগত জিনিস যা কাউকে দেখানো যাবে না?
______________
আজকে তোহা প্রথমবারের মতো আমীরের হোটেলে এসেছে। সম্মুখ দরজাতেই দেখা হয়ে গেল আফশানের সাথে। সে আনমনে সিগারেট টানছিল। তোহাকে দেখা মাত্রই দ্রুত সিগারেটের শলা ফেলে দিল। ভদ্র কণ্ঠে বলল,” আসসালামু আলাইকুম ভাবী।”
তোহা হেসে ফেলল। ‘ভাবী’ ডাক শুনে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠল। আফশান শুধু এতোটুকুতেই থেমে থাকল না। সবাইকে ডেকে সরগরম করে বলতে লাগল,” এই আমাদের ভাবী এসেছে। কে কোথায় আছো, দেখে যাও।”
সেকেন্ড না গড়াতেই অনেকজন ছুটে এলো। সবাই তোহাকে ভাবী বলে ডাকছে।
” ভাবী বসেন না।”
” ভাবী কি খাবেন?”
” ভাবী কখন এলেন?”
” ভাবী আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।”
একজন তো ছুটে এলো পায়ে ধরে সালাম করতে। তোহা অস্বস্তিতে অস্থির হয়ে বলল,” আরে, আরে, কি করছেন? আমি কি আপনাদের মুরব্বি নাকি? থামুন। আপনাদের স্যার কি ভেতরে আছেন?”
আফশান বলল,” স্যার তো এখন গোসলে ভাবী। আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। এদিকে বসুন।”
তোহা বসল না। হাত ভাঁজ করে প্রশ্ন করল,” উনার রুম কোনটা?”
শাহেদ বলল,” অনুমতি ছাড়া তো স্যারের বেডরুমে যাওয়া নিষেধ। ”
আফশান ইশারায় শাহেদকে চোখ রাঙালো। তোহা এক ভ্রু উঁচু করে বলল,” আমারও কি অনুমতি লাগবে?”
আফশান সাথে সাথে বলল,” না ভাবী। ছি, ছি, আপনি যেতে পারেন।”
তোহা হাসি মুখে বেডরুমে ঢুকল। পরিপাটি, গুছানো বিছানা দেখে সে মুগ্ধ হয়ে যায়। সামনেই একটা বিশাল বারান্দা। ফুরফুর করে বাতাস আসছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই তোহার লাল ওরনা পতপত করে উড়তে লাগল। এখান থেকে শহরটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগে। তোহা টেবিলে কফি মেকার দেখে ভাবে এক কাপ কফি বানাবে৷ হাতের ব্যাগটা একপাশে রেখে সে যত্ন করে কফি বানায়। অসম্ভব সুন্দর একটা সুঘ্রাণে ঘর ভরে যাচ্ছে। আমীর দরজা খুলে বের হয়। তার কোমরে শুধু তোয়ালে জড়ানো। আচমকা তোহাকে দেখে সে যেভাবে বেরিয়েছিল সেভাবেই আবার ভেতরে ঢুকে যায়। তার লজ্জা পাওয়া দেখে তোহা হাসতে শুরু করে। আমীর অপ্রস্তুত গলায় বলল,” তুমি এখানে কি করছো?”
” কেন আসতে পারি না? আপনি দেখি একদম মেয়েদের মতো লজ্জা পাচ্ছেন।”
তোহা ইচ্ছে করেই টিপ্পনী কাটে। আমীর দরাজ গলায় বলল,” লজ্জা না, হঠাৎ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।”
“তাই? ”
আমীর যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই আবার বের হলো। কফির সুগন্ধ ছাড়িয়ে এবার মেনস শ্যাম্পুর গন্ধে ভরে উঠল ঘর। তোহার কেমন লজ্জা করতে লাগল। আমীর ওভাবেই এসে তার পাশে দাঁড়ালো। তার কোমর জড়িয়ে ধরে আদুরে কণ্ঠে বলল,” কি করছে আমার মায়াবতী?”
তোহা আমীরের হাত সরিয়ে বলল,” এসব কি? যান আগে ড্রেস পরে আসুন।”
” এখন দেখি তুমিই লজ্জা পাচ্ছো।”
তোহা মাথা নিচু করে রাখল। সে একবারও আমীরের দিকে তাকায়নি। আসলেই লজ্জা লাগছে তার। বিশালদেহী একটা মানুষ কেমন অর্ধনগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। এই মানুষটা তার নিজস্ব। একান্ত ব্যক্তিগত!ভাবতেই কেমন সুখ সুখ লাগে। আমীর বলল,” কাঁপছো কেন?”
” আপনার শরীর খুব ঠান্ডা।”
” তুমি গরম করে দাও।”
তোহা রেগে আমীরের হাতে খামচি মেরে বলল,” নির্লজ্জ!”
তীক্ষ্ণ ব্যথায় আমীর চোখ কুচকে ফেলল। বিড়বিড় করে বলল,” মেয়ে নাকি রাক্ষসী?”
” আমি দু’টোই।”
তোহা বিছানায় এসে বসল। আমীর তোহার বানানো কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,” ওয়াও, এক্সিলেন্ট! এতো দারুণ কফি আমি লাইফে কখনও খাইনি।”
তোহা ঠোঁট বাঁকা করে বলল,” হয়েছে আর পাম মে-রে খুশি করতে হবে না। আমি ভুলে চিনি দিয়ে ফেলেছি৷ আপনি তো চিনিসহ কফি খান না।”
আমীর তোহার পাশে এসে বসতে বসতে বলল,” এখন থেকে খাবো। একদম তোমার মতো মিষ্টি হয়েছে।”
তোহা লজ্জায় অন্যদিকে ঘুরে বলল,” হঠাৎ সকাল সকাল কেন এলাম জিজ্ঞেস করবেন না?”
” আসার জন্য আবার রিজন লাগে নাকি? যখন ইচ্ছা হবে আসবে। চুপ করে বসে থাকবে। আমি দিনের বেলাতেও চাঁদের আলো দেখবো।”
আমীর বিভোর দৃষ্টিতে তাকালো। তোহা লাজুক মুখে বলল,” একটা গুড নিউজ আছে। বাড়িতে সবাই বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছে। স্পেশালি ফুপু আর আলিফা ভাইয়া।”
” সিরিয়াসলি?” আমীর এই কথা শুনে অবাক হলো না। কিন্তু অবাক হওয়ার ভাণ করল। সে তো আগেই জানতো আলিফ বিয়েতে দ্বিমত করার সাহস দেখাবে না। সে তোহার দুই হাত ধরে বলল,” চলো তাহলে আজকেই বিয়ে করে ফেলি।”
” পাগল হয়ে গেছেন? এতো তাড়া কেন? বিয়ে আস্তে-ধীরে হবে।”
” সবাই যখন মেনে গেছে তখন আর দেরি কেন? হোটেলে থাকতে আর ভালো লাগছে না আমার। তোমাকে নিয়ে দ্রুত নিজের বাড়ি ফিরতে চাই।”
” কিন্তু আমার তো ইটালি খুব ভালো লাগছে। আমি এখানেই থাকব।”
” ঠিকাছে,রোমশহরে একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করি চলো। যতদিন ইচ্ছা হয় থাকব। কিন্তু তার আগে বিয়ে করি, প্লিজ।”
” আপনি বিয়ের জন্য এতো অধৈর্য্য হচ্ছেন কেন? আমি তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না।”
” বলা যায় না, যদি পালিয়ে যাও!”
তোহা উদাস কণ্ঠে বলল,” আপনাকে ছেড়ে আমি কোথায় পালাবো? কে আছে আমার আপনি ছাড়া?”
আমীরের নিশ্চুপ হয়ে গেল। গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তোহার দিকে। অল্প সময়ের নীরবতা। ঘোর লাগা দৃষ্টি নিয়ে তোহার কোমল ঠোঁট স্পর্শ করতে চাইল আমীর। তোহা বাঁধা দিয়ে নরম স্বরে বলল,” উহুম, বিয়ের আগে আর একবারও না। ”
” কেন?” আমীর অবাক। তোহা রহস্য করে বলল,” এমনি৷ ধরুন কোনো কারণে আমাদের বিয়েটা হলো না। তখন কি হবে?”
” বিয়ে হবে না কেন?”
” যদি বিয়ের দিন সকালে হঠাৎ আমি বলি, বিয়ে করব না। তখন?”
আমীর ভাব ধরে বলল,” তুলে নিয়ে আসব।”
” ইশ, এতো সহজ! আমি না চাইলে আপনি আমাকে জীবনেও তুলে আনতে পারবেন না।”
” আর আমি না চাইলে তুমি আমাকে জীবনেও ছেড়ে যেতে পারবে না।”
” তাই?”
” হ্যাঁ তাই।”
তোহা খিলখিল করে হেসে উঠল। সে ভেবেছিল আমীর তার মতোই মজার ছলে কথাটা বলেছে। কিন্তু আমীর ওই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সিরিয়াস ছিল। সে তোহাকে কখনও নিজের জীবন থেকে যেতে দিবে না। কোনো অবস্থাতেই না। প্রয়োজনে পুরো দুনিয়ার সাথে লড়বে। তবুও তোহাকে নিজের করে রাখবে।
চলবে
®Sidratul Muntaz