#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৪৯.
“কোথায় তুমি?” আমীর খুব ভালো করেই জানে তোহা এখন কোথায়। তবুও সে হাসিমুখে প্রশ্নটা করেছে। তোহা উত্তর দিল,” কথা ভাবীর সাথে শপিং-এ এসেছি। ভাবী নাকি বাবুর জন্য কেনা-কাটা করবে। আপনি কি করছেন?”
আমীর তার সামনে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে যে তোহার পাশে কেউ নেই। সে একাই শপিংমলে এসেছে। অথচ আমীরকে মিথ্যা বলছে। দুইদিন ধরে কিছু একটা হয়েছে তার। আমীর তোহার আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। সে আমীরকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। গতকাল দেখা করেনি। অথচ আমীরের মনে হচ্ছিল, একদিনেই তার দম বন্ধ হয়ে আসবে। সে দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে৷ তোহাকে না দেখলে কিছুই ভালো লাগে না। অথচ তোহা যেন ইচ্ছে করেই তাকে শাস্তি দিচ্ছে। মেয়েটা কি চায়?
আমীর বলল,” তোমরা কোথায় শপিং করতে গেছো? এড্রেসটা টেক্সট করোতো। আমি আসছি।”
” না, না, আপনার আসার প্রয়োজন নেই।”
সরাসরি প্রত্যাখ্যানে আমীরের সন্দেহ হলো। হাসার ভাণ ধরে বলল,” কেন?”
” এমনি। কি দরকার? দু’টো মেয়ে যখন একসাথে থাকে তখন সেখানে ছেলেমানুষ না আসাই ভালো। ”
” তাই?”
” হ্যাঁ তাই। আচ্ছা, শুনুন। আপনার সাথে পরে কথা বলব। ভাবী ডাকছে আমাকে।”
তোহা ফোন রেখে দিল। আমীর মুখ গম্ভীর করে দেখল তোহা একটা বেঙ্গলী শপে ঢুকছে। সে তোহাকে চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারিতে রেখেছে৷ তোহার প্রতিটি স্টেপ ফলো করছে। এই মুহূর্তে তোহার আশেপাশে হিডেন ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছে শাহেদ। সে আমীরকে প্রতি মুহূর্তে ইনফর্ম করছে যে তোহা কখন কোথায় যায় আর কি করে!
খুব সুন্দর সাজানো, ছিমছাম একটা দোকান। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। প্রাইজ ট্যাগ দেখে তোহা হিমশীম খাচ্ছে। সাধারণ একটা শার্টের দাম ৫০ ইউরো। যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় পাঁচহাজার। চিন্তা করা যায়? তোহা এখানে এসেছে পাঞ্জাবী কিনতে। সে আমীরকে কখনও পাঞ্জাবী পরতে দেখেনি। সবসময় একরঙা পোলো টি-শার্ট আর ফরমাল প্যান্ট পরে কেমন ক্যাজুয়াল থাকে। যদিও তাকে ওই গেটাপেই দারুণ লাগে। তবে তোহা দেখতে চায় পাঞ্জাবী পরলে আমীরকে কেমন লাগবে! সে অনেক দোকান ঘুরেও পছন্দসই কোনো পাঞ্জাবী বের করতে পারছে না। যেগুলো পছন্দ হচ্ছে সেগুলোর দাম অনেক বেশি। আর যেগুলোর প্রাইজ রিজনেবল সেগুলো পছন্দ হওয়ার মতো না। জীবনে প্রথমবার সে তার প্রেমিককে একটা কিছু গিফট করবে। জিনিসটি অবশ্যই স্পেশাল হওয়া দরকার।
আমীর দেখছে তোহা এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরছে। কিন্তু কিছুই কিনছে না৷ শাহেদ বোকার মতো তার পেছনে চক্কর কাটছে। তোহা যদি ভুলেও একবার শাহেদকে দেখে ফেলে তাহলে কেলেঙ্কারী হবে। শাহেদের উচিৎ লুকিয়ে থাকা। সেটা না করে সে অসীম সাহস নিয়ে তোহার পাশাপাশি হাঁটছে। ভাগ্যিস তোহা তাকে এখনও লক্ষ্য করেনি। আমীর মোবাইল তুলে শাহেদকে ফোন করল।
” হ্যালো স্যার।”
” তুমি এসব কি করছো শাহেদ?”
” আপনি যেটা বলেছিলেন সেটাই তো করছি স্যার।”
” আমি এভাবে বলেছিলাম তোমাকে? তুমি ওর পেছনে সবসময় থাকলে তো ও সন্দেহ করবে। কেয়ারফুল থাকো।”
” আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। ম্যাডাম আমাকে চিনবে না৷ আমি তো মাস্ক পরে আছি।”
আমীর ল্যাপটপে আর তোহাকে দেখতে পাচ্ছে না। ভ্রু কুচকে বলল,” মায়া কোথায় শাহেদ?”
” আরে, স্যার আপনার সাথে কথা বলতে বলতে আমি ম্যাডামকে হারিয়ে ফেলেছি।” শাহেদের কণ্ঠে দিশেহারা ভাব। আমীর খুব রেগে বলল,” স্টুপিড। ওকে পাঁচমিনিটে খুঁজে বের করো। ”
” আমি এখনি দেখছি স্যার।”
তোহা দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। একটা অসভ্য বদলোক তাকে অনেকক্ষণ ধরে ফলো করছে। তোহা প্রথমে বিষয়টা বুঝতে পারেনি। যখন বুঝেছে তখন কয়েকবার বাজিয়ে দেখেছে। সে যেখানেই যায় লোকটিও সেখানেই আসে। সে দ্রুত হাঁটলে লোকটিও তার সঙ্গে দ্রুত হাঁটে। তোহা বুঝতে পারছে এখানে ঝামেলা আছে। যখন লোকটি ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল তখন তোহা বাথরুমে চলে এসেছে। এখন বাথরুম থেকে বের হতে তার ভয় লাগছে। কি করবে সে? আমীরকে ফোন করবে? কিন্তু আমীরকে সে মিথ্যা বলেছে। কথা তো তার সঙ্গে আসেনি। সে এখানে আমীরের জন্য সারপ্রাইজ গিফট কিনতে এসেছিল। সারপ্রাইজের ব্যাপারে আমীরকে জানানো যাবে না বলেই মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে। অতএব আমীরকে ফোন করা যাবে না।
তোহা আলিফকে ফোন করে শপিংমলের ঠিকানা দিল। সম্পূর্ণ ঘটনা জানিয়ে বলল তাকে এসে নিয়ে যেতে। আলিফ তোহাকে আশ্বস্ত করে বলল সে বিশমিনিটের মধ্যে আসছে। বেসিনে মুখটা ধুঁয়ে নিল তোহা। তার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এই জায়গাটা কেমন নীরব। গা ছমছম করছে। শপিংমলের একদম শেষদিকে বলে এই বাথরুমে সচরাচর কেউ আসে না। গোছানো বিছানা দেখলে যেমন ঘুম পায় তেমনি সাজানো বাথরুম দেখলেও টয়লেট পায়। তোহা এই মুহূর্তে পেটে চাপ অনুভব করছে। এখানে একটা মানুষও নেই। সে বাথরুমে যাওয়ার জন্য দরজা খুলতেই চমকে উঠল। বিভৎস দেখতে একটা লোক ভেতরে বসে আছে। তোহা বিস্ময় নিয়ে ইংরেজিতে বলল, ” আপনি এখানে কি করছেন? এটা তো লেডিস টয়লেট।”
লোকটি দাঁত বের করে হাসল। তোহার গা শিরশির করে উঠল। সে চলে আসতে নিলেই লোকটি পেছন থেকে এসে তার হাত ধরল। তোহা চেঁচিয়ে বলল,” হাউ ডেয়ার ইউ? লীভ মি। আই উইল শাউট। হেল্প, হেল্প।”
” ইউ আর বিউটিফুল গার্ল। একচুয়েলি, ভেরি বিউটিফুল এন্ড সেক্সি গার্ল!”
” হোয়াট?”
তোহা তার হাঁটু দিয়ে লোকটির গোপন অঙ্গে আঘাত করেই দ্রুত ছুটে বাইরে এলো। তোহাকে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াতে দেখে শাহেদ মাস্ক খুলে সামনে এলো,” ভাবী, আপনার কি হয়েছে?”
তোহা হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চারণ করল,” শাহেদ ভাই, আপনি এখানে?”
শাহেদ মিথ্যা করে বলল,” নিজের জন্য কিছু শপিং করতে এসেছিলাম। তারপর আপনাকে দেখলাম। কিছু হয়েছে নাকি ভাবী?”
” না। কিছু হয়নি।”
শাহেদ বাথরুমে উঁকি দিতেই লোকটিকে দেখল। তোহার অবস্থা লক্ষ্য করার পর আসল ঘটনা বুঝতে আর অসুবিধা হলো না তার৷ এই খবর এখনি আমীরকে জানাতে হবে। এখনি! তোহার ভয় লাগছে। তাকে এখানে একা দেখে শাহেদ যদি আমীরকে কিছু বলে দেয়! তাহলে আমীর বুঝে ফেলবে তোহা তাকে মিথ্যা বলেছিল। ব্যাপারটা কেমন হবে? তোহা ভাবল শাহেদকে অনুরোধ করবে তাদের দেখা হওয়ার কথা যাতে সে আমীরকে না জানায়। কিন্তু পেছন ফিরতেই সে দেখল শাহেদ কোথাও নেই। তোহা কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল। এতো দ্রুত একটা মানুষ কিভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে?
তোহা তাড়াহুড়ো করে একটা পাঞ্জাবী কিনে ফেলল। তারপর আর দোকান থেকে বের হলো না। তার আরও কিছু কেনা-কাটা বাকি ছিল। সেগুলো না হয় আরেকদিন করবে। ভীড়ের মাঝেই গুটিশুটি হয়ে বসে রইল তোহা। বাথরুমের লোকটির কথা ভেবেই গা শিউরে উঠছে। তখন যদি সে বের হতে না পারতো তাহলে কি হতো?
আলিফ বিশমিনিটের মধ্যেই হাজির হলো। তোহা তার সঙ্গে গাড়িতে উঠতে নিবে ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনায় পরিবেশে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। বিশতলা শপিংমলের টপ ফ্লোর থেকে রোগা পাতলা একটা মানুষকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেকেন্ড না গড়াতেই হৈচৈ বেঁধে গেল জায়গাটিতে। তোহা আর আলিফ দৌড়ে সেখানে দেখতে গেল। আহত লোকটি রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। অনেকের গায়ে রক্ত ছিটকে পড়েছে। তারা অস্বাভাবিক কণ্ঠে চিৎকার করছে। একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে মনে। কয়েকজন অ্যাম্বুলেন্স ডাকার কথা বলছিল। এর মধ্যেই লোকটি প্রাণ হারিয়ে ফেলে। সবার দৃষ্টি একবার হলেও উপরের দিকে যায়। কে করল এই নিষ্ঠুরতা? এতোবড় শপিংমলের টপ ফ্লোরে কারো যাওয়ার কথা না। তাই সেখানে কি হয়েছিল দেখাও সম্ভব না। এটা কি এক্সিডেন্ট নাকি মার্ডার সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। সবাই ধরে নিচ্ছে এক্সিডেন্ট। কারণ লোকটিকে মানসিকভাবে অসুস্থ মনে হচ্ছে। তোহার হাত-পা ইতিমধ্যে কাঁপতে শুরু করল। আলিফ তাকে ধরে বলল,
” ভয় পেও না। কাম ডাউন। আমার সাথে এসো।”
আলিফ তাকে জায়গাটা থেকে দূরে নিয়ে গেল। তবুও তোহা স্বাভাবিক হতে পারছে না। কারণ যেই লোকটির মৃ-তদেহ এই মুহূর্তে দেখেছে সে বাথরুমের ওই সাইকো! আলিফ গাড়ি থেকে পানির বোতল বের করে তোহাকে দিল। এমন ভয়ংকর একটা দৃশ্য দেখে যেকোনো মানুষ ট্রমাটাইজ হয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। আলিফের ভয় হচ্ছে তোহাকে নিয়ে। সে ক্রমাগত তোহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পানি খাওয়ার সময় তোহার হাত থেকে বোতল ফসকে পড়ে গেল৷ সে শরীরে কোনো বল পাচ্ছে না।
” আই এম স্যরি আলিফ ভাইয়া।” তোহা কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করল।
” কোনো ব্যাপার না৷ ইটস ওকে।” আলিফ মেঝে থেকে বোতল তুলে নিল। গাড়িতে উঠে এয়ারকুলার ছাড়ল। তোহা অনেক ঘেমে গেছে। আলিফ বলল,” বি নরমাল। এতো ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। সম্ভবত লোকটি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। এটা সুইসাইড কেইস হতে পারে।”
তোহা নিচের দিকে চেয়ে স্পষ্ট গলায় বলল,” এটা সুইসাইড কেইস না।”
” তুমি কিভাবে বুঝলে?”
” লোকটিকে আমি আগেও দেখেছি। সে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল না। সুইসাইড করার কোনো লক্ষণও তার মধ্যে নেই। সে জাস্ট অ্যালকোহলিক। তোমার কি মনে হয় আলিফ ভাইয়া? একটা মাতাল লোক লিফটে করে বিশতলায় উঠবে তারপর টপ ফ্লোরে গিয়ে সেখান থেকে লাফ দিবে? এটা সম্ভব?”
” হতেও তো পারে। মাতাল অবস্থায় কে শপিংমলে আসে? নিশ্চিত তারছেঁড়া মানুষ। ”
তোহা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,” না। বললাম তো লোকটিকে আগেও দেখেছি আমি। সে মেয়েদের বাথরুমে ঢুকে বসেছিল। এমন ধরণের মানুষ আর যাইহোক সুইসাইড করতে পারে না।”
তোহা তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনাটি আলিফকে জানাল। সবকিছু শুনে আলিফ মাথায় হাত দিয়ে উচ্চারণ করল,” সর্বনাশ!” এই মুহূর্তে সে পুরোপুরি নিশ্চিত যে এই ঘটনা আমীর ঘটিয়েছে। তোহা স্বাভাবিক হয়ে এলেও এখন আলিফের হাত-পা কাঁপছে। সে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না। তোহা ভ্রু কুচকে বলল,”তোমার আবার কি হয়েছে?”
” কিছু না।”
আলিফ গাড়ি থেকে বের হলো। যাওয়ার আগে বলল,” আমি না আসা অবধি গাড়ি থেকে বের হবে না প্লিজ।”
” ওকে। কিন্তু তুমি যাচ্ছো কোথায়?”
আলিফ জবাব না দিয়ে হনহন করে চলে গেল। শপিংমলটি আলিফের চেনা। সে এখানে প্রায়ই কেনা-কাটার জন্য আসে। তার আনাচে-কানাচে মুখস্ত হয়ে গেছে। যেখানে সিসিটিবি নেই সেখানে গেলেই ক্লু পাওয়া যেতে পারে। আলিফ ব্যাকইয়ার্ডের কাছে আসতেই আমীরের গাড়ি দেখতে পেল। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল তখনি। তাহলে সে যা ভেবেছিল ঘটনা আসলেই তাই! আমীর লিফট থেকে বের হচ্ছে। সে হ্যান্ড গ্লাভস পরেছিল। সেই গ্লাভস খুলে একটা ব্যাগে ভরল। তার সঙ্গে সাদা শার্ট পরিহিত যে ছেলেটি আছে, তার মুখ দেখামাত্রই আলিফ চিনে ফেলল। একবার মাঝরাতে এই ছেলেটিই তো দারোয়ানকে মার-ধোর করে তাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হচ্ছে আলিফের কাছে। আমীর গাড়ি চালু করা মাত্রই সে আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। তার বুকের কম্পন থামছে না। মুখ ঘেমে একাকার। ভয়ে চেহারা চিমসে আছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আলিফ গাড়িতে এলো। তোহা প্রশ্ন করল,” কোথায় গেছিলে?”
আলিফ শান্ত কণ্ঠে বলল,” কোথাও না।”
সে গাড়ি চালাতে শুরু করল। তোহা তাকে চিন্তিত দেখে পুনরায় প্রশ্ন করল,” ভাইয়া, তোমার কি কিছু হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? প্লিজ, আমাকে বলো কি ব্যাপার?”
আলিফ বুঝতে পারছে না সে কিছুক্ষণ আগে যা দেখে এসেছে তা তোহাকে কিভাবে বলবে? তোহা যদি বিশ্বাস না করে? কিন্তু তার জানাটাও জরুরী৷ আমীরের মতো মানুষ কখনোই তোহার জন্য সঠিক হতে পারে না।
একটা নিরিবিলি জায়গায় আলিফ গাড়ি থামিয়ে তোহাকে জিজ্ঞেস করল,” আইসক্রিম খাবে তোহা?”
তোহা শর্ত দিয়ে বলল,” খেতে পারি। কিন্তু তুমি কি নিয়ে এতো চিন্তা করছো সেটা আমাকে বলতে হবে।”
” আচ্ছা বলব।”
দু’টো বাটার স্কচ নিয়ে আলিফ-তোহা পাশাপাশি একটা লোহার বেঞ্চে বসল। ধীর-স্থির ভঙ্গিতে আলিফ কথা শুরু করল। প্রথমেই বলল,” তোমাকে আমি এখন যে কথাগুলো বলব তা শোনার জন্য অবশ্যই মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আগেই রেগে গেলে কিন্তু চলবে না। প্রথমে আমার পুরো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে তারপর কোনো সিদ্ধান্ত নিবে।”
” মনে হচ্ছে খুব সিরিয়াস কোনো বিষয়? ঠিকাছে বলো।”
” আমার মনে হয় আমীর….”
আলিফ কথা শুরু করা মাত্রই তোহার মোবাইল বেজে উঠল। আমীরের নাম্বার। সে রিসিভ করতে নিলেই আলিফ ফট করে তার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিল। প্রথম নিয়ে লাইন কাটল তারপর ফোন সুইচড অফ করে দিল। তোহা রূঢ় গলায় বলল,” এসব কি হচ্ছে?”
” আমাকে আগে কথা শেষ করতে দাও। তারপর ফোন পেয়ে যাবে।”
” কিন্তু আমার ফোন বন্ধ দেখলে আমীর টেনশন করবে।”
” করুক টেনশন।”
তোহা হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কপালে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করে বলল,” ঠিকাছে বলো।”
” আমীরের সাথে তোমার বিয়েটা কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত না। যদি তুমি তবুও এই বিয়ে করো তাহলে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করবে।”
” মানে?” তোহা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল।
আলিফ বলল,”আগেই রেগে যেও না। পুরো কথা শেষ করতে দাও।”
তোহা বাকি কথা শোনার আগ্রহই পাচ্ছে না। তবু ধৈর্য্য ধরে বসে রইল। আলিফ শেষ করুক তার কথা! আলিফ নিজের মতো বলে গেল। প্রথমেই সে শাহেদের ঘটনাটা বলল। যা তোহা সহজেই বিশ্বাস করে ফেলল। কারণ আজাদের ব্যাপারটা সে জানে! এবার সে এটাও বুঝতে পারল যে আমীর কেন সেদিন বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসেছিল। তার হয়তো ধারণা ছিল তোহা সুইসাইড করবে। কিন্তু এটা তো আমীরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো কারণ হতে পারে না। আমীর একটু বেশি প্রটেক্টিভ। এটা বাড়াবাড়ি হতে পারে কিন্তু দোষ বলা যায় না। আলিফ এবার শপিংমলের ঘটনাটাও বলল। ব্যাকইয়ার্ডে সে যা দেখেছিল তা জানাল। এই পর্যায়ে তোহার হাত থেকে আইসক্রিমের কাপ পড়ে গেল। এটা কোনো বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা নয়। আমীর আর যাই করুক, এতো নৃশংসভাবে কাউকে খু-ন করতে পারে না!
তোহা বলল,” অসম্ভব। তুমি ভুল ভাবছো।”
” নিজেকে বোকা বানিও না তোহা। আমি অবশ্যই ঠিক দেখেছি। তোমার যদি তবুও বিশ্বাস না হয় তাহলে আরেকটা ঘটনা শোনো। এটা আমি এখন পর্যন্ত কাউকে বলিনি। তোমাকে বলছি কারণ তোমার জানা দরকার।”
” কি কথা?” তোহার অস্থির লাগছে। খোলা জায়গাতেও কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছে। এগুলো সত্যি হলে সে ম-রে যাবে। আলিফ যে সন্ধ্যায় আমীরের হোটেলে গিয়েছিল এবং সেখানে কি কি ঘটেছিল তার সবকিছু সে তোহাকে বলে দিল। এই পর্যায় তোহা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চোখ বড় করে, প্রায় অবিশ্বাসী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” উনি আসলেই তোমার সাথে এইসব করেছে?”
” বিশ্বাস হয় না?”
” যদি এগুলো সত্যি হয় তাহলে আমি তাকে ছাড়ব না।”
তোহা চিৎকার করে উঠল। রাগে কাঁপছে তার পুরো শরীর। আলিফ ভয় পেয়ে বলল,” তোহা কাম ডাউন। তুমি আবার আমীরের সাথে এসব আলোচনা করতে যেও না।”
” কেন যাব না? তার সাহস কিভাবে হয় তোমার গায়ে হাত তোলার?”
” তুমি কিন্তু আমাকে বিপদে ফেলবে।”
” কোনো বিপদ না। তুমি ওকে কেন ভয় পাচ্ছো? ও তোমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে এখনি ওই সাইকোটার বাড়িতে নিয়ে চলো।”
” এটা একদমই ভালো আইডিয়া না।”
তোহা ক্রোধে চিৎকার দিয়ে উঠল,” আমি কিছু শুনতে চাই না। তুমি যদি আমাকে ওখানে না নিয়ে যাও তাহলে আমি একাই চলে যাবো।”
আলিফ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েকবার মাথায় মালিশ করল। তোহাকে সব বলে দেওয়া ঠিক হয়েছে নাকি ভুল? সে বুঝতে পারল না৷ তোহা কাঁদছে৷ দুইহাতে মুখ ঢেকে খুব বিষণ্ণ ভঙ্গিতে কাঁদছে। আলিফ বলল,” আচ্ছা চলো যাই।”
আমীরের হোটেলে পৌঁছাতে সময় লাগল পনেরো মিনিট। তোহা গাড়ি থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে ভেতরে ঢুকল। আলিফ ঢুকতে পারল না। ভয় লাগছে তার। আমীর তোহার কোনো ক্ষতি করবে না৷ তাই তোহা একা গেলেও সমস্যা নেই৷ এই ব্যাপারে নিশ্চিত বলেই সে গাড়িতে বসে রইল।
ধড়াম ধড়াম শব্দে দরজায় আঘাত করছিল তোহা৷ আফশান দরজা খুলে হাসিমুখে বলল,” ভাবী, আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন ভাবী?”
” আমি কারো ভাবী না। ফারদার আমাকে ভাবী ডাকবেন না।”
ইস্পাতের মতো শক্ত মুখে এই কথা শুনিয়ে তোহা ভেতরে ঢুকল। আফশানের মুখ শুকিয়ে গেল। লিভিংরুমে যে কয়জন আড্ডা দিচ্ছিল তারা সবাই একদৃষ্টিতে তোহার দিকে চেয়ে আছে। তার অগ্নিমূর্তির কাছে পরিবেশ গুমোট হয়ে গেছে। তোহা সোজা গিয়ে ঢুকল আমীরের বেডরুমে। মাত্র গোসল সেরেছে আমীর। চুল এখনও ভেজা। শপিংমল থেকে ফিরেই সে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়েছে। কাউকে খু-ন করার পর গোসল করা তার পুরনো অভ্যাস। যতক্ষণ গোসল না হয় ততক্ষণ মনে হতে থাকে শরীর অশুচি হয়ে আছে। তোহাকে দেখে আমীরের ঠোঁটে হাসি ফুটল। সে আবেগে এতো উৎফুল্ল হলো যে অন্যকিছু খেয়ালও করল না। কাছে এসে তোহাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল। আদুরে গলায় বলল,” ওয়েলকাম সুইটহার্ট। আই মিসড ইউ সো মাচ।”
তোহা পাথরের মতো শক্ত গলায় বলল,” ছাড়ুন।”
” উহুম। আমি তোমাকে পাঁচমিনিট এভাবেই ধরে থাকব। কালকে দেখা না করার শাস্তি এটা।”
তোহা শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আমীরকে ধাক্কা মারল। সবাই দরজার কাছে জড়ীভূত হয়েছে। তারা বিস্ময় নিয়ে ঘটনা দেখছে। আমীর হঠাৎ তোহার এমন আচরণে হতভম্ব হয়ে গেল। তোহা কাঁপতে কাঁপতে বলল,” আলিফ ভাইয়াকে সেদিন আপনি আটকে রেখেছিলেন তাই না? আপনি তার গালে চড় মে-রেছেন?”
আমীর বিভ্রান্ত হলো। তোহার এসব জানার কথা নয়। কে জানাল তাকে? আলিফ? তার কি এতো সাহস হবে? ঘরে যারা ছিল তাদের ইশারায় আমীর চলে যেতে বলল। সম্পূর্ণ ঘর ফাঁকা হলে আমীর তোহাকে ধরে বলল,” বসো।”
তোহা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,” আমার কথার জবাব দিন আগে।”
সে ইতস্তত করে কিছু বলার আগেই তোহা উচ্চারণ করল,” কোনো এক্সপ্লানেশন শুনতে চাই না। শুধু হ্যাঁ অথবা না বলুন।”
আমীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উচ্চারণ করল,” হ্যাঁ। ”
তোহা আহত হলো। ভীষণ কষ্ট পেল। তার দুইচোখ অশ্রুতে ভরে এলো। কান্না মেশানো গলায় জানতে চাইল,” কেন?”
সত্যিটা বললে তোহা কষ্ট পাবে। সে তার আপনজনদের অনেক ভালোবাসে। আমীর আলিফের কুৎসিৎ রূপ তোহার সামনে আনতে চায় না। তাই গম্ভীর গলায় বলল,” তোমার ভাইয়া আমাদের বিয়ে নিয়ে ঝামেলা করতে চাইছিল। আমাকে বলেছে তোমাকে যেন বিয়ে না করি। বলো এটা কি আমি মেনে নিতাম?”
” তাই বলে আপনি উনার সাথে এসব করবেন? ছি, এতো নিচ আপনি? আপনার সাহস কিভাবে হলো? আলিফ ভাইয়া আমার বড়ভাই। এর মানে সে আপনারও গুরুজন। আপনি তার গায়ে কি করে হাত তুলতে পারলেন?”
” তোহা আমি কিন্তু….”
তোহা খেঁকিয়ে উঠল,” একদম চুপ। কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাই না আমি আপনার থেকে আর। সেদিন রাতে বাড়ির সবাই এতো টেনশন করছিল, কথা ভাবী এতো কাঁদছিল তাও আপনি একটাবার সত্যিটা বললেন না। একবারও বললেন না যে ভাইয়া আপনার কাছে আছে। উল্টা তাকে থ্রেট দিয়ে রেখেছিলেন যাতে সেও কোনোদিন এই ঘটনা আমাদের না বলে! ডাকাতির নাটক সাজিয়েছেন। এতোবড় প্রতারক আপনি? ছি! ”
তোহা আমীরকে সজোরে আবার একটা ধাক্কা মারল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আর আজকে শপিংমলে এটা কি করলেন আপনি? একটা মানুষকে এইভাবে মে-রে ফেললেন? হাত কাঁপল না? মানুষ মা-রা কি এতোই সহজ আপনার কাছে?”
আমীর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” তুমি একদম ঠিক নেই। বসো এখানে।”
হাত ধরে তাকে বিছানায় বসাতে গেল আমীর। সে রেগে বলল,” খবরদার আমাকে ধরবেন না। ডন্ট ডেয়ার টু টাচ মি এগেইন।”
আমীর কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে তোহার হাত ছেড়ে দিল। তোহা কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদল। দুইহাতে মাথা আঁকড়ে ধরে দিশেহারার মতো বলতে লাগল,” আপনাকে কত বিশ্বাস করেছিলাম। কত ভরসা করতাম আমি! কিন্তু আপনি আমাকে এইভাবে ধোঁকা দিলেন? আমাদের সম্পর্কের দ্বিতীয় শর্ত কি ছিল তা কি আপনার মনে আছে?”
” আছে।”
” বলুন, কি?”
” তোমাকে কখনও মিথ্যা বলা যাবে না।”
” তাহলে আপনি কি করেছেন?”
” মিথ্যা বলেছি।”
” কেন বলেছেন?”
” বিকজ আই লভ ইউ।”
তোহা তাচ্ছিল্য হাসল। দুঃখ মেশানো হাসি। হৃদয় পুড়িয়ে দেওয়ার হাসি। হিংস্র গলায় বলল,” ভালোবাসলে কাউকে মিথ্যা বলতে হয় তা প্রথম আপনার কাছে শুনলাম। ভালোবাসলে যে খু-নও করতে হয় সেটাও আপনার কাছে প্রথম শুনলাম। এখন আপনি শুনুন,এই ধ্বংসাত্মক ভালোবাসা নিজের কাছেই রাখুন। আমার দরকার নেই। যে ভালোবাসা মানুষকে ধ্বংস করে সেই ভালোবাসা আমার কোনো দরকার নেই!আপনাকে ভালো মনের মানুষ ভেবেছিলাম আমি। কিন্তু আপনি তো জানোয়ারের চেয়েও অধম! ধিক্কার আপনাকে। ছি!”
তোহা ছুটে বেরিয়ে যেতে নিলেই আমীর তার হাত চেপে ধরল। প্রশ্ন করল মরিয়া হয়ে,” কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
তোহা ঝাঁকি মেরে হাত ছাড়িয়ে বলল,” চলে যাচ্ছি। আজকে থেকে আমাদের মধ্যে সবকিছু শেষ। ”
আমীর এই কথা শুনে রাগান্বিত হলো। তীব্রভাবে চেপে ধরল তোহার দুই বাহু। তোহা হকচকিয়ে গেল। আমীর খটমট স্বরে বলল,” এই সামান্য কারণে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে? এতোই সহজ সবকিছু?”
” এটা সামান্য কারণ মনে হচ্ছে আপনার? ”
” তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আগে আমার পুরো কথা শুনতে হবে।”
” আমি কিছু শুনবো না। আমার হাত ছাড়ুন। ব্যথা পাচ্ছি।”
আমীর হাত ছাড়ল না। আরও শক্ত করে চেপে ধরল। দৃঢ় গলায় বলল,” আমার সব কথা না শুনে তুমি যেতে পারবে না। আর সব কথা শুনলেও যেতে পারবে না। বলেছিলাম না, কোনো অবস্থাতেই তোমাকে যেতে দিবো না?”
তোহা দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল,” আমি আপনাকে গিয়ে দেখাব। আর আপনি আমাকে আটকে রাখতেও পারবেন না। কোনো অবস্থাতেই না।”
” মায়া, এরকম কোরো না। প্লিজ। আমি পাগল হয়ে যাবো।” আমীরের কণ্ঠে আকুতি। তোহা নিষ্ঠুর গলায় বলল,” আপনি আগে থেকেই পাগল। নতুন করে পাগল হওয়ার কিছু নেই। আপনার মতো সাইকোর সাথে থাকা অসম্ভব। লীভ মি।”
তোহা আমীরকে দুইহাতে ধাক্কা মেরে বের হয়ে গেল। আমীর স্থিরমূর্তির মতো বসে রইল বিছানাতে। মূহুর্তেই পুরো পৃথিবীটা শূন্য মনে হচ্ছে তার।
______________
বাড়ি ফিরে তোহা দরজা বন্ধ করে দিল। সারাদিন একবারও সে দরজা খুলল না। খাওয়ার জন্যেও বাইরে এলো না। জাবিদা খুব দুশ্চিন্তা করতে লাগল। হাসি-খুশি মেয়েটার কি হয়েছে হঠাৎ? আলিফকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সে কোনো জবাব দিল না। রাতে জাবিদা খুব ডাকাডাকি করল,” তোহা মা, খেতে আয়। তুই সারাদিন কিছু খাসনি।”
তোহা বালিশে মুখ ডুবিয়ে কাঁদছিল তখনও। ফুপুর আওয়াজ শুনে গলা পরিষ্কার করে বলল,” আমি শুয়ে পড়েছি ফুপু। ক্ষিদে নেই। সকালে উঠে খাবো।”
জাবিদা মনখারাপ করে বলল,” ঠিকাছে ঘুমা।”
তোহা বাথরুমে ঢুকল হাত-মুখ ধুঁয়ে নিতে। তখনি খেয়াল করল বেসিনের আয়নায় সে লিপস্টিক দিয়ে লিখে রেখেছে,” Amir” পাশে একটা রেড হার্ট আঁকা। এই পাগলামি সে আজ সকালে শপিং-এ যাওয়ার আগে করেছিল। নিজের উপর প্রচবড বিরক্ত লাগল হঠাৎ। লেখাটা দেখে তার আরও কান্না পাচ্ছে কেন? সে ভুলতে চায় সবকিছু। সাবান আর পানি নিয়ে ঘঁষে ঘঁষে আয়নাটা পরিষ্কার করল। গায়ে যত রাগ ছিল, সব কাঁচের আয়নার উপর ঝারল। তারপর বিছানায় শুতে এলেই দেখল ফোন বাজছে। আমীরের নাম ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। সারাদিনে কমপক্ষে দুইশোবার সে ফোন করেছে। তোহার মোবাইলের চার্জ পর্যন্ত ফুঁড়িয়ে গেছে ফোনকলের জ্বালায়। সে সিদ্ধান্ত নিল মোবাইল সুইচড অফ করে দিবে। তারপর হঠাৎ ইচ্ছে করল, শেষবারের মতো একবার ফোনটা ধরতে। তোহা নিজের মনের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিল। ফোন রিসিভ করে রুক্ষ গলায় বলল,” হ্যালো।”
আমীর তার নির্জীব কণ্ঠে অক্লান্ত কাতরতা ঢেলে বলল,” মায়া, নিচে আসো প্লিজ।”
তোহার ভেতরটা সামান্য কেঁপে উঠল। নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,” মানে? নিচে কেন আসব?”
” শুধু একটু কথা বলব। প্লিজ!”
” শুনুন, এসব হাস্যকর আর ছেলেমানুষী কান্ড করে কোনো লাভ হবে না। আপনার কি ধারণা রাত-বিরাতে বাসার নিচে এসে দাঁড়ালেই আমি সব ভুলে যাব? আপনাকে মাফ করে দিবো? আমি ঘৃণা করি আপনাকে। কোনো অবস্থাতেই আপনার সঙ্গে থাকব না আমি।”
আমীর মিনতি ভরা কণ্ঠে বলল,” তুমি এতো দ্রুত ডিসিশন নিতে পারো না। আমাদের উচিৎ ব্যাপারটা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ডিসকাস করা।”
“আমি কোনো ডিসকাশনে যেতে চাই না। আপনি যেগুলো করেছেন তার কোনো এক্সকিউজ হয় না আমীর।”
তোহা ফোন কেটে দিল৷ তার বেহায়া মন তবুও ছটফট করছে। সত্যি ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে বাগানে। কিন্তু সে যাবে না। অসম্ভব! আমীর আবার ফোন করছে। তোহা মোবাইল সুইচড অফ করে রাখল। এবার আমীর তার বারান্দায় ঢিল ছুঁড়তে শুরু করল। তোহা আৎকে উঠল। লোকটার আসলেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? বাধ্য হয়েই বারান্দায় গেল সে। আমীর হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে৷ কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তোহার দিকে। তোহা ফোন করে বলল,” কি শুরু করেছেন? সবাইকে জাগাবেন নাকি?”
” তুমি নিচে না নামলে সেটাই করতে হবে।”
” খবরদার, এসব করে আপনি আমাকে আরও রাগাচ্ছেন।”
” তুমি নিচে না এলে আমি উপরে উঠে আসব। এটাই কি চাও তুমি?”
” আশ্চর্য মানুষ তো!”
তোহা আর কিছু বলার আগেই দেখল আমীর ফোন কে-টে দিয়েছে। সে তুমুল বেগে বাড়ির ভেতরে ঢুকছে। দূরে আজাদকে দাঁড়ানো দেখে তোহা অনুরোধ করল যেন সে অন্তত আমীরকে থামায়। কিন্তু আজাদ তোহাকে দেখেও না দেখার ভং ধরে বাঁশি বাজানো শুরু করল। তোহা কপালে হাত রাখল৷ বুকে দামামা বাজছে তার। ফুপা অথবা ফুপু যদি এই রাতের বেলা আমীরকে বাসায় দেখে ফেলে তাহলে কি হবে? প্রচন্ড লজ্জার একটা ব্যাপার হবে। আমীর দরজা ধাক্কাতে লাগল৷ এতো জোরে ধাক্কাচ্ছে যেন ভেঙেই ফেলবে। তোহা বাতাসের গতিতে দরজা খুলল। আমীর ভেতরে ঢুকতেই সে দরজা বন্ধ করে দিল যাতে কেউ না দেখে।
” কি শুরু করেছেন এসব? সবার সামনে আমার মান-সম্মানের দফারফা করতে চান?”
আমীর পাশের টেবিল থেকে ফল কা-টার ধারালো ছু/রিটা হাতে নিল। তোহা এই অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল। আমীরের দৃষ্টি রক্তিম, চোখমুখ শক্ত। সে যা কিছু করতে পারে এই মুহূর্তে। তোহা কাঁপা গলায় বলল,” এটা কি হচ্ছে? কি করবেন ছু/রি দিয়ে?”
আমীর থমথমে গলায় বলল,” চলো একটা গেইম খেলি। ব্রেকাপ গেইম। আমি নিজেকে দশবার আঘাত করব। এর মধ্যে একবারও যদি তুমি আমাকে আটকাতে না আসো তাহলে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। আমি বুঝে নিবো ইউ ডন্ট কেয়ার এবাউট মি। কিন্তু যদি তুমি আমাকে দশবারের মাঝে একবারও আটকাও তাহলে মনে করো তুমিও আটকে গেছো। আমাদের সম্পর্ক আবার আগের মতো হতে হবে।”
” এসব কি পাগলের মতো কথা বলছেন? আমি এমন ফালতু গেইম খেলব না। এটা আমাকে দিন।”
তোহা ছু/রি নিতে গেলেই আমীর তার হাত সরিয়ে ফেলল। কয়েক কদম পিছিয়ে সে ছু/রিটা নিজের হাতের উপর চেপে ধরল,” রেডি?”
” না। দেখুন আপনি কিছু করবেন না।”
তোহা দুইহাতে চোখ ঢেকে নিল। এই কঠিন পরিস্থিতি কিভাবে সামলানো যায় তা বুঝে ওঠার আগেই আমীর চূড়ান্ত পাগলামি করল। নিজের হাত নিজেই র/ক্তাক্ত করে ফেলল। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল তোহা। কাঁদতে কাঁদতে ছু/রিটা কেঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। র/ক্তাক্ত হাতটা চেপে ধরে বলতে লাগল,” এটা কি করেছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে? আল্লাহ, কত রক্ত বের হচ্ছে!”
আমীর কাতর স্বরে বলল,” আমাকে ছেড়ে যেও না মায়া। তাহলে সত্যি পাগল হয়ে যাবো।”
তোহা ধমকে উঠল,” চুপ করুন। আপনি এমনিতেই পাগল। বদ্ধ উন্মাদ। সাইকো!”
আমীরের র-ক্তে তোহার হাতও রঙিন হয়ে যাচ্ছে। সে কি শিরা কে-টে ফেলেছে? এখনি রক্ত বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তোহা দিশেহারার মতো ফার্স্ট এইড খুঁজতে লাগল ড্রয়ারে ড্রয়ারে। আমীর তোহার কান্ড দেখে মুচকি হাসছে। অসীম প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে তার বুক। মনে হচ্ছে অন্ধকার পৃথিবীটা পুনরায় আলোর দিশা খুঁজে পেয়েছে!
চলবে
®Sidratul মুন্তায
#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৫০.
যত্ন করে হাতে ব্যান্ডেজটা বেঁধে দিল তোহা। র-ক্ত পড়া থেমে গেছে কিন্তু তোহার হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে। আমীর পুরোটা সময় তোহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তোহা কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজে৷ সে বলল,” অনেক পাগলামি হয়েছে। এবার উঠুন।”
আমীর উঠল। আর সাথে সাথেই তোহাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। তোহা থতমত খেয়ে বলল,” এসব কি? ছাড়ুন।”
” তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না আমি।”
” একেবারে ছেড়ে দিতে বলিনি। এখন ছাড়তে বলেছি।”
আমীর ছাড়ল কিন্তু ব্যান্ডেজের হাতটা দিয়ে তোহার ডানহাত ধরেই রাখল। মাথা নিচু করে বলল,” তাহলে কি আমাদের সব ঠিক হয়ে গেছে?”
” জানি না।”
তোহার কণ্ঠ অত্যন্ত রূঢ় শোনালো। আমীরের চোখে টলমল করছে অশ্রু। তোহা আঙুলের ডগা দিয়ে তার চোখের কোণ থেকে একফোঁটা অশ্রু নিয়ে বলল,” কথায় কথায় যে মানুষ খু-ন করে… সে সামান্য একটা মেয়েকে হারানোর ভয়ে কাঁদছে! ব্যাপারটা কি হাস্যকর না?”
আমীর গাঢ় স্বরে বলল,” তুমি নিজেকে সামান্য ভাবলেও আমার কাছে আমার পৃথিবী তুমি।”
তোহা হেসে ফেলল। যেন সে জোক্স শুনেছে। আমীর ভ্রু কুচকে তাকাল,” হাসার মতো কি বললাম? আমার ভালোবাসা নিয়ে কি তোমার সন্দেহ আছে?”
” এটাকে ভালোবাসা বলে না। আপনি পাগলামি করছেন।”
” তুমি পাগল বানাচ্ছো আমাকে। কেন এমন করছো মায়া? তোমার রিয়েকশন দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার নতুন রূপ দেখছো! তুমি কি আমাকে চেনো না?”
তোহা দুইপাশে মাথা নাড়ল। রাশভারী হয়ে বলল,” না। আমি আসলেই আপনাকে চিনি না। আপনার এই রূপ আমি দেখিনি। আপনার নিজেকে শোধরাতে হবে। আপনি না মাত্র বললেন আমি আপনার পৃথিবী? তাহলে কি আমার জন্য সব বিসর্জন দিতে পারবেন? এইসব খু-ন-খারাবী আর ক্ষমতা ছেড়ে সাধারণ মানুষের মতো চলতে পারবেন?”
” তুমি একবার বলেই দেখো আমি পারি কি-না!”
হঠাৎ করেই পেট মোচড় দিল তোহার। প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে। আজ সারাদিন ধরে সে না খাওয়া। আচ্ছা, তার মতো আমীরও কি না খেয়ে আছে? তোহা জিজ্ঞেস করল,” রাতে খেয়েছেন?”
” খাওয়ার কথা মনেই ছিল না।”
” এইটা আবার কেমন জবাব! খাওয়ার কথা মনে থাকবে না কেন? চলুন আপনাকে খেতে দেই।”
” না। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
” তাহলে কি ইচ্ছে করছে?”
” তোমার হাত ধরে বসে থাকতে।”
তোহার হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু সে হাসল না। এই মুহূর্তে হেসে ফেলা মানেই আমীরকে প্রশ্রয় দেওয়া। মুখ যথাসাধ্য গম্ভীর রাখার চেষ্টা করে বলল,” আমার ক্ষিদে পাচ্ছে। আমি আজ সারাদিন না খেয়ে আছি।”
আমীর অবাক হয়ে উচ্চারণ করল,” কেন?” তোহা রাগান্বিত গলায় জবাব দিল,” আপনার মতো পাগল জীবনে আছে তো, সেজন্য।”
” স্যরি।”
” হয়েছে এখন স্যরি বলে সাধু সাজতে হবে না। আপনাকে আমার চেনা হয়ে গেছে। চুপচাপ এখানে বসে থাকুন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
এতোরাতে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে তোহা জাবিদার বেডরুমে গিয়ে দরজায় নক করল। জাবিদা এসে দরজা খুলতেই সে লাজুক মুখে বলল,” খাওয়ার মতো কিছু আছে ফুপু?”
জাবিদা মৃদু হেসে বলল,” খুব ক্ষিদে পেয়েছে? ফ্রীজে তোর প্রিয় পাস্তা আছে। ওভেনে গরম করে দিবো? ”
” শুধু পাস্তা? আর কিছু নেই?’
“কি খেতে চাস বল। আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
” আমার জন্য না। একজন গেস্ট এসেছে।”
“এতোরাতে গেস্ট এসেছে মানে?”
তোহা মাথা নিচু করে বলল,” আমীর এসেছে।”
জাবিদা প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে হেসে ফেলল। আন্দাজ করেই বলল,” এবার বুঝলাম। তোদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। এজন্যই সারাদিন দরজা আটকে বসেছিলি তাই না?”
তোহার মুখ লজ্জায় এতোটুকু হয়ে এলো। জাবিদা তার হাত ধরে বলল,” চল। দেখি কি ব্যবস্থা করা যায়!”
প্রায় পনেরো মিনিট পর তোহা গরম গরম পিজ্জা নিয়ে হাজির হলো। আমীর বলল,” আমার তো হাতে ব্যান্ডেজ। কিভাবে খাবো?”
তোহা ধমক দিয়ে উঠল,” ঢং করবেন না। ব্যান্ডেজ তো বামহাতে। আপনি কি বামহাত দিয়ে খান?”
আমীর বিব্রত হলো। খুব আফসোস হচ্ছে, বামহাত না কে-টে ডানহাত কা-টলে বেশি ভালো হতো। দুঃখ ভরা গলায় বলল,” শুধু একহাত দিয়ে আমি খেতে পারি না।”
” থাক আর বাহানা বানাতে হবে না। বসুন। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
আমীর হাসল, বলল,” থ্যাংকস।”
তোহা গম্ভীরমুখে তাকে খাইয়ে দিল। নিজেও একটু-আধটু খেল। কিন্তু বেশি খেতে পারল না। অতিরিক্ত ক্ষিদে নিয়ে কখনও বেশি খাওয়া যায় না।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আমীর বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তোহা কোমড়ে হাত গুঁজে বলল,” আজব মানুষ তো! খেতে দিয়েছি বলে এখন শুতেও চাচ্ছেন? উঠুন আমার বিছানা থেকে।”
“বিছানাটা তো খুব নরম। অনেক আরামদায়কও। ঘুম এসে যাচ্ছে। ”
” একটা থাপ্পড় দিবো। উঠুন বলছি।”
” তুমি রেগে যাচ্ছো কেন? জায়গা তো অনেক আছে। তুমিও শুতে পারবে। এসো।”
আমীর হাত বাড়ালো। তোহা শক্ত করে হাতটা ধরে মুচড়ে দিল। ব্যথায় ককিয়ে উঠল আমীর,” আউচ!”
” খুব শখ না আমার সাথে শোয়ার? এবার শখ মিটেছে?”
” স্যরি, স্যরি, আর বলব না। ছাড়ো। ব্যথা।”
” আরও ব্যথা লাগবে যখন আপনার হাতটা আমি ভাঙবো। ”
আমীর অন্যহাত দিয়ে হেচকা টান মেরে তোহাকে বিছানায় শুইয়ে ফেলল। তোহা ক্ষেপে উঠে ছটফটিয়ে বলল,” খুব খারাপ হচ্ছে। আমাকে ছাড়ুন নয়তো এমন চিৎকার করব যে ফুপা লাঠি নিয়ে দৌড়ে আসবে।”
আমীর তোহার কপালে চুমু দিল। দুই গালে চুমু দিল। নাকেও চুমু দিল। তোহা দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” সুযোগ পেয়েই এডভান্টেজ নিচ্ছেন? খুব খারাপ আপনি।”
আমীর আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” চলো বিয়ে করে ফেলি।”
” বিয়ে করব? তাও আপনার মতো মানুষকে? অসম্ভব!”
তোহার ফোনের এল্যার্ম বেজে উঠল। অর্থাৎ এখন সময় ঠিক বারোটা। তোহা বিছানায় শুয়ে আছে। আমীর তার অতি কাছে। দুইহাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। তোহা ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। ঠিক এই অবস্থায় সে হঠাৎ উচ্চারণ করল,” হ্যাপি বার্থডে।”
” মানে?” আমীর সামান্য চমকে গেল।
তোহা গোমরা মুখে বলল,” হ্যাপি বার্থডে মানে শুভ জন্মদিন।”
বিস্ময়ে কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল আমীর। তার জন্মদিন আজ, আসলেই কি? অনন্যার মৃ-ত্যুর পর থেকে আর কখনও নিজের জন্মদিন মনে রাখেনি সে। তারিখটাও ভুলতে বসেছিল৷ এতোগুলো বছরেও নিজেকে নিয়ে ভাবার একদম সময় হয়নি। তোহা জীবনে না এলে সে হয়তো ভুলেই যেতো যে তারও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে! তারও সূক্ষ্ম কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে। মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজন আছে। আমীরকে এমন হতভম্ব বনে যেতে দেখে তোহা তার মুখের উপর চুটকি বাজিয়ে বলল,” কি ব্যাপার? বিশ্বাস হচ্ছে না? আরে আজকে সত্যিই আপনার জন্মদিন!”
আমীর বলল,” এই প্রথম কেউ জন্মদিনের কথা মনে করালো। কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে?”
” রানু আন্টির থেকে জেনেছি। প্রতিবছর এই দিনে আপনার মা আপনার জন্য কেক বানাতো তাই না? আমি অবশ্য কেক বানাতে পারি না। কিন্তু সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করেছি।”
আমীর যন্ত্রের মতো বলল,” কি সারপ্রাইজ?” সে আসলে এসবে অভ্যস্ত না। কেউ কখনও তাকে সারপ্রাইজ দেয়নি। তার খুশির কথা চিন্তা করবে এমন আপন মানুষ তার দুনিয়াতে নেই। তোহা বলল,” আগে উঠুন। তারপর দেখাচ্ছি।”
আমীর উঠে বসল। তোহা তার আলমারি থেকে পাঞ্জাবীর প্যাকেট বের করল। ইতস্তত কণ্ঠে বলল,” জানি না আপনার পছন্দ হবে কি-না। আপনাকে তো কখনও এসব পরতে দেখিনি৷ কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করছিল পাঞ্জাবীতে আপনাকে কেমন লাগে সেটা দেখব। তাই কিনেছি।”
আমীর সঙ্গে সঙ্গে তার টি-শার্টের বোতাল খুলতে লাগল। তোহা চোখ বড় করে বলল,” কি করছেন?”
” পাঞ্জাবী পরছি।”
” তাই বলে আমার সামনেই পরে ফেলবেন?”
” কেন? তোমার সামনে লজ্জার কি আছে?”
” আপনার লজ্জা না থাকলেও আমার তো লজ্জা আছে।”
তোহা এই কথা বলে সামনে ঘুরে দাঁড়াল। আমীর পোশাক বদলে পাঞ্জাবীটা পরল। তারপর হৃষ্টচিত্তে বলল,” দেখো এবার।”
তোহা ঘুরে তাকাল। পাঞ্জাবীতে আমীরকে দেখে সে সত্যি অভিভূত হয়ে গেল। এতো মানিয়েছে! তোহা ভাবতেও পারেনি সামান্য একটা পোশাক কাউকে এভাবে বদলে দিতে পারে। আমীর প্রশ্ন করল,” কেমন লাগছে?”
তোহার বলতে মন চাইল,” মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”
অথচ সে মুখে শুধু বলল,” সুন্দর। ”
আমীর মৃদু হেসে বলল,” আমার মনে হচ্ছে মা আমার সাথেই আছে। আগে কখনও এরকম মনে হয়নি। এটা আমার জীবনের বেস্ট বার্থডে।”
তোহার কান্না পেয়ে গেল। ভেজা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” বাড়িয়ে বলছেন। আমি আপনার মায়ের মতো কখনও হতে পারব না।”
” কিন্তু তুমি সাথে থাকলে আমার সবসময় মায়ের কথা মনে পড়ে।”
তোহা চোখ মুছে মনে মনে বলল,” আর আপনি সাথে থাকলে আমার মনে পড়ে বাবার কথা।”
আমীর হাত ধরে টেনে তোহাকে কাছে আনল। মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করল,” এবার মনে হয় আমাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে, তাই না?”
” এর উত্তর আমি এখন দিতে পারব না। আমাকে ভাবতে হবে। কাল আমি আপনার হোটেলে আসব। তখন বলব।”
” সত্যি আসবে?”
” কথা দিতে পারছি না।”
তোহা তার হাতের রিংটা খুলে আমীরের কাছে দিয়ে দিল। আমীরের বুকের বামপাশটা কেমন অসাড় হয়ে এলো হঠাৎ। তোহা যদি তার জীবন থেকে হারিয়ে যায় তাহলে সে আবারও শূন্য হয়ে যাবে। আগে শূন্যতা নিয়েও জীবন কেটে গেছে। কিন্তু এবার আর কা-টবে না। কারণ না পাওয়ার চাইতে পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা অনেক বেশি!
_______________________________________
কলিংবেল অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। রোজিনা বেগম পানি চেয়ে কাশতে শুরু করেছে। হাসান কি মাকে আগে পানি দিবে নাকি দরজা খুলবে সেটা বুঝতে পারছে না। পানি নিতে অনেক সময় লাগছে। জগে একফোঁটাও পানি ছিল না। কলসি থেকে পানি জগে ঢালতে নিয়ে একটা ধেত্তেরিকি অবস্থা হলো। পুরো কলসি উল্টে পানি দিয়ে মেঝে ভরে গেল। রোজিনা বিছানায় শুয়ে থেকেই বলছে,” কি হইছে বাপ? কিসের শব্দ হইল? কি ভাঙল?”
“কিছু হয় নাই আম্মা। তুমি শুয়ে থাকো। আমি পানি দিচ্ছি।”
রোজিনা কাশতে কাশতে বলল,” দরজাটা একটু খোল বাপ। অনেকক্ষণ ধইরা বেল বাজতাছে।”
হাসান পানির কলসি ঠিক করে দরজা খুলতে গেল। বাইরে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখেই সে চমকে উঠল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। হতভম্ব কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আপনি?”
স্নেহা মিষ্টি করে হাসল,” কেমন আছো হাসান?”
হাসান দরজা ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কোনো উত্তর দিল না। পাশের ঘর থেকে রোজিনা চিৎকার করল,” কে আইছে? কে?”
স্নেহা বলল,” আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিবে না?”
হাসান লজ্জায় দ্রুত সরে দাঁড়ালো দরজা থেকে। সে কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করেনি যে আমীরের স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। স্নেহা ভেতরে ঢুকতেই তার জুতো ভিজে গেল। পুরো ঘর পানিতে ভেসে যাচ্ছে। হাসান অস্বস্তিতে জড়সড় হয়ে বলল,” ঘরের অবস্থা বেশি ভালো না। আপনাকে যে কোথায় বসতে দেই…”
স্নেহা আন্তরিক হেসে বলল,” কোনো অসুবিধা নেই। আমি আন্টির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। ভেতরে যাই?”
” অবশ্যই ম্যাডাম। আসুন।”
স্নেহাকে দেখে রোজিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। স্নেহা হাসিমুখে বলল,” আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন?”
” ওয়া আলাইকুম আসসালাম। তুমি কে?”
হাসান পরিচয় করিয়ে দিল,” আম্মা, উনিই আমাদের স্নেহা ম্যাডাম। কত গল্প করেছি না তোমার কাছে? আগে আমি যেখানে চাকরি করতাম সেই অফিসের বসের বউ।”
রোজিনা মাথা নেড়ে বলল,” ও বুঝছি, বুঝছি, চিনতে পারছি। তোমার কথা অনেক শুনছি আমার পোলার কাছে। ভালো আছো মা?”
” আমি ভালো আছি আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
” ভালো না। কেমন আর থাকমু কও? পোলাটার চাকরি গেল অসময়ে…”
রোজিনা তার সংসারের দুঃখ-দূর্দশার গল্প শুরু করল। যদিও এতো দুঃখ নেই এখন আর। তবুও বয়স হওয়ার পর থেকে এটিই তার একমাত্র সমস্যা। পরিচিত কিংবা অপরিচিত মানুষ পেলেই গল্প বলে বলে কাঁদতে শুরু করবে। তার মধ্যে মৃ-ত্যু ভয় ঢুকে গেছে। এটাই তার কান্না-কাটির আসল কারণ। যদিও সে এখন পুরোপুরি সুস্থ। তবুও তার ভয়, একমাত্র ছেলের বিয়ে হলেই বুঝি তার মৃ-ত্যুর ডাক আসবে। হাসান ঘর পরিষ্কার করতে ড্রয়িংরুমে এলো। ফ্রীজে কোনো ভালো খাবার নেই৷ তাকে একবার দোকানে যেতে হবে। স্নেহা এই প্রথমবার তার বাড়িতে এসেছে। কি কারণে এসেছে তা হাসান বুঝতে পারছে না। কিন্তু বসের বউ বলে কথা, তাকে তো যেমন তেমন আপ্যায়ন করা যায় না। হাসানের মনের কিঞ্চিৎ আশা, আমীর যদি আবার তাকে কাজে ডাকে! সে তো একসময় আমীরের ডানহাত ছিল। নিশ্চয়ই আমীর তাকে এতো সহজে ভুলে যাবে না।
হাসানের মনের উদয় হওয়া এই কিঞ্চিৎ আশাটুকু দপ করে নিভে গেল স্নেহার সাথে কথা বলার পর। স্নেহা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,” আমি যে এখানে এসেছি তা আমীর জানে না। জানার কথাও নয়। সে আর আমি এখন ভিন্ন পথের যাত্রী। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।”
হাসান এই কথা শুনে মনঃক্ষুণ্ণ হলো। এর মানে আমীর স্নেহাকে তার কাছে পাঠায়নি৷ তাহলে স্নেহা কেন এসেছে তার কাছে? তার সাথে স্নেহার কি কাজ থাকতে পারে? স্বার্থ ছাড়া স্নেহা কখনও নিঃশ্বাসও নেয় না। এখানে আসার পেছনে অবশ্যই তার বড় কোনো স্বার্থ আছে।
” আমি জানি হাসান, এখন তোমার মনে বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরছে। ধীরে ধীরে আমি সবকিছুর উত্তর দিবো। কিন্তু তার আগে তুমি আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও। আর খবরদার, ভুলেও মিথ্যা বলবে না। কারণ তুমি ভালো করেই জানো, কেউ মিথ্যা বললে আমি সেটা অতি সহজেই ধরে ফেলতে পারি।”
হাসান বলল,” ঠিকাছে, প্রশ্ন করুন ম্যাডাম। আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।”
” চেষ্টা করব বললে হবে না। তোমাকে উত্তর দিতেই হবে।”
হাসান নিশ্চুপ রইল। স্নেহা তার প্রথম প্রশ্ন করল,” তোমার কি জাবিদ আলম সাহেবের কেইসটার কথা মনে আছে?”
হাসানের স্মৃতিতে ভেসে উঠল একটি অন্ধকার রাত। মিনতি ভরা একজোড়া চোখ, আকুতি, কান্না! মানুষটি মৃত্যুর আগেও ছটফট করছিল। একমাত্র মেয়ের কথা চিন্তা করে দিশেহারা হচ্ছিল। হাসানের হাত কেঁপে উঠল। সে মানুষটিকে গুলি করতে চাইল না। মানুষটির আর্তনাদ শুনে এতো মায়া হলো যে একবার ভাবল ছেড়েই দিবে। কিন্তু আমীরের আদেশে গুলি করতেই হলো। ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস! এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল লোকটি নির্দোষ। তাকে খু-ন করা অন্যায় হয়েছে। তারপরেই মনে পড়ল তোহার কথা। কি মিষ্টি, প্রাণচঞ্চল একটি মেয়ে। তাকে দেখে প্রতি মুহূর্তে অপরাধবোধে জর্জরিত হচ্ছিল হাসান। সে একবার ভেবেছিল তোহাকে সব সত্যি জানিয়ে দিবে। কিন্তু এর আগেই আমীর তাকে বরখাস্ত করেছে। আর কখনও দেখা হয়নি তোহার সাথে। কেমন আছে সে এখন?
” চুপ করে থাকলে তো হবে না হাসান। আমার কথার উত্তর দাও। জাবিদ সাহেবের ব্যাপারটা মনে আছে তোমার?”
” জ্বী আছে ম্যাডাম।”
” ভেরি গুড। তাহলে নিশ্চয়ই তোহার কথাও মনে আছে?”
হাসান কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে নিচু গলায় বলল,” আছে।”
” দারুণ৷ আমি তোমার থেকে একটা ফেবার চাইতে এসেছি। তুমি এটাকে ফেবার না বলে অর্ডারও বলতে পারো। কারণ আমার কাজ করা ছাড়া তোমার কাছে অন্যকোনো উপায় নেই।”
হাসান আতঙ্ক অনুভব করছে। স্নেহা জানতে চাইল,” আচ্ছা, আন্টি তো ক্যান্সারের পেশেন্ট ছিলেন। এখন কি সুস্থ হয়েছেন?”
” ইন্ডিয়ায় নিয়ে চিকিৎসা করানোর পর এখন আলহামদুলিল্লাহ অনেকটাই সুস্থ ম্যাডাম।”
” চিকিৎসা করানোর টাকা কোথায় পেলে? তোমার তো চাকরিও ছিল না।”
হাসান মিথ্যা বলল,” গ্রামের কিছু জমি ছিল। সেসব বিক্রি করতে হয়েছে।”
সত্যি কথাটা হলো, আমীর তাকে চাকরি থেকে ছাটাই করলেও মাসিক বেতন দেওয়া বন্ধ করেনি। ঠিকই প্রতি মাসের এক তারিখে তার বেতন একাউন্টে পৌঁছে যায়। কাজটা আমীর মূলত রোজিনা বেগমের জন্যই করেছে। সে জানতো হাসানের মা অসুস্থ। ওই অবস্থায় হাসানের টাকার কত প্রয়োজন! এই জন্য হাসান সবসময় আমীরের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এই ব্যাপারটা সে স্নেহাকে জানাতে চায় না। স্নেহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
” ভেরি স্যাড। জমি বিক্রি করে আর কতদিন চলবে? রাজার ভান্ডারও একসময় ফুরিয়ে যায়। তোমার কি মনে হয় না নিজের ফিউচার সিকিউর করার জন্য তোমার কিছু করা উচিৎ? ”
” তা তো অবশ্যই মনে হয়।”
” আমি তোমাকে একটা সুযোগ দিতে চাই।”
হাসান সাথে সাথেই বলল,” আমি এসব কাজ ছেড়ে দিয়েছি ম্যাডাম। আমার আম্মা যদি কখনও জানতে পারে তাহলে খুব কষ্ট পাবে। আমি আর তাকে প্রেশার দিতে চাই না। কিছু করলে হয় চাকরি না হয় ব্যবসা করব। কিন্তু এ ধরণের কাজে আর জড়াবো না।”
স্নেহা কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে হাসানের দিকে চেয়ে থেকে হেসে ফেলল। বলল,” চাকরি যে করবে, চাকরির বাজারের অবস্থা জানো? আর ব্যবসা করার জন্য তো আগে ইনভেস্টমেন্ট দরকার। সেই টাকা কি তোমার কাছে আছে?”
হাসান কিছু বলল না। সে বিব্রতবোধ করছে। স্নেহার কোনো কাজ সে করতে চায় না। তাহলে আমীরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। স্নেহা পরিষ্কার গলায় বলল,
” যদি আমার এই একটা কাজ করে দিতে পারো তাহলে তোমার পুরো জীবন বদলে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি। আন্টির চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিবো। তোমাকে ব্যবসা করার জন্য টাকাও দিবো। তুমি যা চাও তাই পাবে। শুধু ছোট্ট একটা কাজের বিনিময়ে।”
” স্যরি ম্যাডাম, আমি তো বলেছিই। আমি এসব কাজে আর জড়াতে চাই না।”
” যদি আমার পরিবর্তে এখানে আমীর আসতো তাহলেও কি তোমার সিদ্ধান্ত একই রকম হতো?”
হাসান মিথ্যা বলল,” হ্যাঁ হতো।”
” তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি এখনও অপেক্ষায় আছো যে আমীর তোমাকে ডাকবে৷ আমাকে দেখে প্রথমে তুমি খুব আনন্দিত হয়েছিলে। কারণ তোমার ধারণা ছিল আমাকে আমীর এখানে পাঠিয়েছে। তারপর হঠাৎ করেই তোমার মনখারাপ হয়ে গেল যখন তুমি বুঝতে পারলে আমি নিজের ইচ্ছায় এসেছি। আমীর আমাকে পাঠায়নি।”
হাসানের মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। স্নেহা নরম গলায় বলল,” আমার কাজ করতে তুমি ভয় কেন পাচ্ছো হাসান? আমি তোমাকে দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিবো। তাছাড়া তোমার এই কাজে একটা মেয়ের জীবন বাঁচবে। সেটা কি তুমি চাও না?”
হাসান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” কার জীবন বাঁচবে?”
স্নেহা স্মিত হেসে বলল,” তোহা।”
হাসান কিছুটা বিভ্রান্ত হলো৷ তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সঠিক জায়গায় হাত পড়েছে। এবার সে রাজি হবেই। স্নেহা আরও বলল, “সে এখন ইটালির মিরানো শহরে আছে। তোমার প্রথম কাজ তার ঠিকানা খুঁজে বের করা। আমি তোমার ইটালি যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিবো। কাজটা খুব সহজ কারণ আমীরও সেই একই জায়গায় আছে। আমি যদি ভুল না হই তাহলে শীঘ্রই তাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে। অথচ তোহা এখনও সত্যিটা জানে না৷ তোমার দায়িত্ব হলো প্রমাণসহ সব সত্যি তোহার সামনে উপস্থাপন করা। ভেবে দেখো, যদি তুমি এই কাজ না করো তাহলে আমি অন্যকাউকে দিয়ে করাবো। কিন্তু তুমি যেহেতু এই খু-নের সবচেয়ে বড় সাক্ষী তাই তোমার দ্বারাই কাজটা বেশি সহজ।”
হাসান বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার সকল বিপদে আমীর পাশে ছিল। সে এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতা কিভাবে করবে? স্নেহা এবার তার চূড়ান্ত অস্ত্র কাজে লাগাল,” তুমি ছাড়া তোমার মায়ের আর কে আছে? যদি তোমার কিছু হয়ে যায় তাহলে তোমার মায়ের কি হবে? তাছাড়া আন্টি যদি জানতে পারে তুমি আগে কি কাজ করতে তাহলে…. ”
এতোক্ষণে হাসানের মুখে বুলি ফুটল,” ম্যাডাম প্লিজ, আমার আম্মাকে এইসব বিষয়ে টানবেন না। সে ম-রেই যাবে এগুলো জানলে।”
স্নেহা আলতো হেসে বলল,” তাহলে বলো, তুমি রাজি? ডিল?”
স্নেহা তার হাত বাড়িয়ে দিল। হাসান কিছুক্ষণ টলমল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে স্নেহার বাড়ানো হাতটি ধরল। যন্ত্রের মতো বলল,” ডিল।”
________________________________
তোহা বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কার্ণিশে। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন তার মন। আলিফ ঠিক তার পাশে এসেই দাঁড়ালো। সাবধানে প্রশ্ন করল,” অ্যানি প্রবলেম?”
তোহা হালকা চমকে উঠল। তারপর হেসে বলল,” কিছু না।”
” তাহলে কি চিন্তা করছো এতো? তোমাদের মধ্যে তো সব ঠিক হয়ে গেছে দেখলাম। ”
” তোমাকে এই কথা কে বলল?” তোহা কপাল কুচকে তাকাল। হয়তো সামান্য রেগেও গেল।
আলিফ প্রশমিত গলায় বলল,” মায়ের কাছে শুনলাম, কালরাতে নাকি আমীর সাহেব এসেছিল?”
তোহা গম্ভীর হয়ে বলল,” হ্যাঁ। এসেছিল।”
আলিফ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল,” সবকিছু কি ঠিক হয়ে গেছে তাহলে?”
তোহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিল,” জানি না আলিফ ভাইয়া। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
” কি বুঝতে পারছো না?”
” সেটাও জানি না। ওকে আমি বুঝতে পারছি না। ও আসলে কি চায়? কেন এমন পাগলামি করে? এগুলোর নাম কি আসলেই ভালোবাসা? আচ্ছা, ভালোবাসা কি সত্যি এমন হয়?”
” তোমার মন কি বলে তোহা?”
” আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু ও যা করেছে সেজন্য আমি ওকে ক্ষমা করতে পারব না। ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলেছে। তোমার গায়ে হাত তুলেছে। এগুলো কি কোনো স্বাভাবিক বিষয়? এতোকিছুর পরেও কি তাকে মাফ করা যায়?আমি চিন্তা করতে করতে পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
আলিফের মনে সন্দেহ জাগল। এতো ঘটনার পরেও আমীর কেন তোহাকে সত্যিটা বলেনি? আলিফ সেদিন হোটেলে বসে তোহাকে জড়িয়ে যে সকল নোংরা কথা বলেছিল সেজন্য সে মন থেকে অনুতপ্ত। কিন্তু আমীরের তো উচিৎ ছিল নিজেকে বাঁচাতে তোহাকে প্রথমেই সব জানিয়ে দেওয়া। সে জানালো না কেন? আলিফ সত্যিই বিষয়টা বুঝতে পারছে না। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” তোমার উচিৎ সময় নেওয়া। কিছুদিন ওর থেকে দূরে থাকো।”
তোহা বিরক্ত গলায় বলল,” আমি চাইলেই সেটা পারব না আলিফ ভাইয়া। দেখলে না কালরাতে কেমন বাড়ি চলে এলো? কত সিনক্রিয়েট হলো!”
” হুম। তুমি এক কাজ করো। কয়েকদিনের জন্য লুকিয়ে থাকো।”
” লুকিয়ে থাকব মানে? কি পাগলের মতো কথা বলছো!”
” ঠিকই বলছি। এছাড়া অন্য উপায় নেই। ভেবে দেখো, তুমি এখানে থাকলে আমীর তোমাকে ডিস্টার্ব করবেই। ওর থেকে মুক্তি পেতে চাইলে লুকিয়ে থাকা সবচেয়ে ভালো অপশন। তুমি চাইলে আমি ব্যবস্থা করব। আমার একটা ফিমেল কলিগের বাসা খালি আছে। আজাদকে বলব তোমাকে নিয়ে সেখানে রেখে আসতে। কিছুদিন ফোন বন্ধ রাখবে। আমীর কিছু জানতেও পারবে না। ”
তোহা উচ্চশব্দে হেসে উঠল। আলিফ তোহার হাসি দেখে ভড়কে গেল,” কি ব্যাপার হাসছো কেন?”
” হাসছি তোমার কথা শুনে। আজাদ ভাই আমাকে রেখে আসবে আর আমীর কিছু জানবেও না? খুব মজা পেলাম। আসলে তুমিই কিছু জানো না। আমীর কি করতে পারে সেই সম্পর্কে তোমার ধারণাই নেই।”
” তোমার ধারণা আছে?”
তোহার মুখ মলিন হয়ে এলো। উদাস কণ্ঠে বলল,” না। আমারও বোধ হয় নেই।”
_______________
সারাদিন আমীর অপেক্ষা করেছে। কিন্তু তোহা আসেনি। অথচ আমীরের অগাধ বিশ্বাস, তোহা আসবেই। রাত বারোটা বাজলেও আসবে। না এসে সে থাকতেই পারবে না। আজকে যদি সে আসে তাহলে আমীর কি কি বলবে সব ঠিক করে রাখল। এবার আর সে তোহার কোনো নিষেধ শুনবে না। যত দ্রুত সম্ভব বিয়েটা করে ফেলবে। এমনিতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি করা যাবে না। আমীর অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, তোহা এসেছে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছে। আমীর চোখ খুলে দেখল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি তার সামনে! তোহার গায়ে মিষ্টি রঙের একটা শাড়ি। সে এমনিও মিষ্টি, শাড়িতে আরও মিষ্টি লাগছে। আমীর মুগ্ধ চোখে বলল,” আমি জানতাম তুমি আসবে।”
” কি করে জানলেন?”
” হয়তো বিশ্বাস ছিল। ”
তোহা হাত বাড়িয়ে বলল,” আমার আংটিটা দিন। আংটি ছাড়া হাত খুব খালি খালি লাগছে।”
আমীর সঙ্গে সঙ্গে তার পকেট থেকে আংটি বের করতে নিয়ে দেখল আংটি নেই। কি আশ্চর্য! আংটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমীর খুব বিচলিত বোধ করছে। এর মাঝেই তার ঘুম ভাঙল। সে কয়েকবার বড় করে শ্বাস নিয়ে পকেটে হাত রাখল। হ্যাঁ, আংটি পকেটেই আছে। আমীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। কিন্তু তোহা এখনও আসেনি। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আমীর মোবাইল হাতে নিল তোহাকে ফোন করার উদ্দেশ্যে। ঠিক তখনি তার ফোন বেজে উঠল। আজাদের নাম্বার দেখে আমীর শঙ্কিত হলো। মনের মধ্যে ডঙ্কা বেজে উঠল। তোহার কোনো বিপদ হয়নি তো?”
” হ্যালো আজাদ।”
” স্যার, একটা বড় ব্লেন্ডার হয়ে গেছে।” আজাদের কণ্ঠে ভয়, অস্থিরতা। আমীর উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,”মানে? ক্লিয়ারলি বলো। মায়ার কিছু হয়েছে?”
” ম্যাডাম ঠিকাছে। কিন্তু একটু আগে এখানে একজন ডেলিভারিম্যান এসেছিল। তার কাছে তোহা ম্যাডামের নামে পার্সেল ছিল। সেই পার্সেল এসেছে বাংলাদেশ থেকে।”
” কি বলছো? বাংলাদেশ থেকে পার্সেল মানে?”
” হ্যাঁ স্যার। যে পার্সেল নিয়ে এসেছে তাকে দেখে আমার সন্দেহ হচ্ছিল। তার মুখে মাস্ক ছিল সেজন্য চেহারা দেখিনি। আমি পার্সেলটা খুলে দেখতে চাইলাম। কিন্তু আমাকে দেওয়া হলো না। মনে হচ্ছে ওই পার্সেলের মধ্যে কিছু আছে স্যার। আর যে পার্সেল নিয়ে এসেছে তাকে দেখতে কিছুটা হাসানের মতো লাগছিল।”
আমীরের মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। হাসান এখানে কি করে আসবে? আর তোহাকে বাংলাদেশ থেকে এতো আয়োজন করে পার্সেলই বা কে পাঠাবে? তার তো বাংলাদেশে কেউ নেই!
” পার্সেলটা কার থেকে এসেছে? সেন্ডারের নাম দেখেছো?”
” কোনো নাম লেখা ছিল না স্যার।”
আমীরের তবু সন্দেহ হচ্ছে যে স্নেহা এই কাজ করেছে। সে ছাড়া এমন দুঃসাহস আর কেউ দেখাবে না। আমীর শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল,” পার্সেলটা এখন কোথায় আজাদ?”
” ছোটস্যার নিয়ে গেছেন। আমি আটকাতে পারিনি।”
” ছোটস্যার মানে কে? আলিফ?”
” জ্বী স্যার।”
আমীর বিরক্তিতে অযথাই সামনের চেয়ারটা ধাক্কা মে-রে ফেলে দিল। পার্সেলে যেটাই থাকুক, আলিফের কাছে সেটা পৌঁছে গেছে মানে বিপদ নিশ্চিত।
চলবে
® Sidratul Muntaz