ভালোবাসার রং মিছিল পর্ব-২০

0
477

#ভালোবাসার_রং_মিছিল💚
#লেখিকা:ইশা_আহমেদ
#পর্ব_২০

৪১.
অর্ষার অবস্থা প্রচন্ড শোচনীয়।সে যে ইরহামকে ভালোবেসে ফেলেছে তা এই একয়েকদিনে খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে।একদিন ইরহাম তাকে জ্বালায়নি।এমনকি সামনেও খুব কম পরেছে গতকাল।ইগনোর করেছে তাকে এক কথায়।অর্ষা আজকে এর বিহিত করেই ছাড়বে আর পারছে না।অন্য কাউকে ভালোবাসলেও ইরহামের তার সাথেই থাকতে হবে।সে কখনোই ছাড়বে না ইরহামকে।

অর্ষা সাদা রঙের একটা থ্রি পিস পরে হালকা একটু সেজে রুশানের সাথে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।ভার্সিটিতে যেতেই অর্ষা একটা ঝটকা খায়।ইরহামের সাথে একটা মেয়ে।তার হাত ধরেই ঘুরছে ইরহাম।অর্ষার চোখ জ্বলছে, বুকে ভীষণ ব্যাথা করছে।
ভালোবাসার মানুষকে অন্য মেয়েদের সাথে দেখতে আসলেই হৃদয় পুরে যায়।অর্ষা সহ্য করতে পারে না।দৌড়ে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যায়উশা,নাইম,মুহিব,রুশান হা করে তাকিয়ে থাকে।কি হলো কিছুই বুঝতে পারছে না।

রুশানের মাথা খারাপ হয়ে যায়।ও ভার্সিটির বাইরে যায় দৌড়ে গিয়ে দেখে অর্ষা এলোমেলো পায়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।রুশান দৌড়ে ওর কাছে যায়।অর্ষা অশ্রুসিক্ত চোখে তাকায় রুশানের দিকে।রুশানের বুক ধপ করে উঠে।যে বোনকে কাঁদতে দিতে চায় না সে আজ কাঁদছে।রুশানের সহ্য হয় না।অর্ষাকে বুকে চেপে ধরে বলে,,,

—“কি হলো তুই কাঁদছিস কেনো অর্ষু বল আমায়।তুই কাঁদিস না”

—“রুশান ওই লোকটা অন্য মেয়ের সাথে।আমার সহ্য হচ্ছে না কি করবো আমি।আমার হৃদয় পুরছে”

—“তুই কাঁদিস না আমি দেখছি এই ইরহামকে আমার বোনকে কাঁদিয়েছে।আমি এর একটা কিছু করেই ছাড়বো”

ইরহাম মেয়েটাকে নিয়ে ভার্সিটি থেকে বের হচ্ছিল।তখনই দেখে অর্ষা একটা ছেলের বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটা উল্টো দিকে ঘুরে থাকায় চিনতে পারে না।মাথায় আগুন ধরে যায় ইরহামের।ধুপধাপ পা ফেলে অর্ষার কাছে এসে টেনে ওকে ছাড়ায়।রাগে থরথর করে কাঁপছে ও।কিন্তু সামনে রুশানকে দেখে থতমত খায়।

ইরহামকে দেখেই রুশান রেগে যায়।অর্ষার হাত ইরহামের হাত থেকে টেনে ছাড়ায়।রুশান রাগে না আর যখন রাগে তখন ভয়ংকর রেগে যায়।ইরহামের কলার ধরে বলে,,,

—“আপনার জন্য আমার বোনের চোখের পানি ঝরেছে ছাড়বো না আমি।ফারদার আমার বোনের আশেপাশে না দেখি আপনাকে।”

রুশানের ব্যবহারে ইরহামের রাগ তিরতির করে বেড়ে যায়।ঝাঁকি মেরে রুশানের হাত ছাড়ায়।এরপর অর্ষাকে টেনে নিজের কাছে এনে কোমড় চেপে ধরে বলে,,,

—“ও আমার বউ আমি ওর আশেপাশে একবার না হাজার বার আসবো কি করবে তুমি করে নিয়ো”

অর্ষা ইরহামকে সহ্য করতে পারছে না।আরো ইরহামের গাড়ির সামনে সেই মেয়েটাকে দেখে রাগ বেড়ে যায়।ধাক্কা মেরে দূরে সরায় ইরহামকে।রেগে চিল্লয়ে বলে,,,

—“আই হেইট ইউ।আপনি চলে যান এখান থেকে আমি দেখতে চাইছি না আপনার মুখ”

ইরহামের রাগ দ্বিগুণ করতে এই একটা কথাগুলোই যথেষ্ট ছিলো।ইরহাম অর্ষাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরে।রুশান আটকাতে চায় কিন্তু ব্যর্থ হয়।ইরহাম অর্ষাকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়।মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে,,,

—“তুই এখান থেকে রিকশা করে বাসায় যা আমি আসছি কিছুক্ষণ পর”

মেয়েটা মাথা নাড়ায়।ইরহাম গাড়ি চালাতে শুরু করে।অর্ষা পাশে বসে কেঁদে যাচ্ছে।ইরহামের সহ্য হচ্ছে না অর্ষার চোখের পানি।তবুও কিছু বলছে না কারণ সে রেগে আছে।কাজল লেপ্টে গিয়েছে।টানাটানির সময় কাঁচের চুড়ি ভেঙে অর্ষার হাত কেটেছে কিছুটা।কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরেছে অর্ষা।

একটা বাগান বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামায় ইরহাম।অর্ষাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরে।বাড়ির দারোয়ান বাড়ির মেইন দরজা খুলে দেয়।ইরহাম অর্ষাকে নিয়ে সোজা একটা রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়।অর্ষার চোখ মুখ ফুলে গিয়েছে কাঁদার জন্য।ইরহাম কপালে চুমু দিয়ে অর্ষার হাতে মলম লাগিয়ে দেয়।চুড়িগুলো যত্ন করে হাত থেকে খুলে রেখে দেয়।

—“তুমি এমন কেনো করলে আজকে জানি নাহ আমি কিন্তু তোমাকে অন্য পুরুষের সাথে দেখা সম্ভব না।রুশানকেও এখন সহ্য হচ্ছে না তোমার পাশে কি করবো বলো তো”

অর্ষার দিকে নেশাক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,,

—❝তুমি নেশার চেয়েও ভয়ংকর প্রেয়সী❞

অর্ষার ঘুম ভাঙতেই নিজেকে একটা অচেনা রুমে আবিষ্কার করে।উঠে বসে সামনে তাকাতেই ইরহামকে চোখে পরে।ইরহাম গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।অর্ষার মনে পরে একটু আগের ঘটনা।রাগটা বেড়ে যায়।মনে পরে সকালের মেয়েটার সাথে কিভাবে হেসে হেসে কথা বলছিলো।

—“আপনার সাহস কি করে হলো আমাকে এখানে নিয়ে আসার হ্যা।হাউ ডেয়ার ইউ মিস্টার ইরহাম চৌধুরী”

ইরহাম অর্ষার কাছে এসে বলে,,,”আমার অধিকার আছে বলেই নিয়ে এসেছি তোমাকে এখানে”

ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে রেগে চিল্লিয়ে বলে,,,

—“তোর কোনো অধিকার নেই আমার কাছে আসার।ক্যারেক্টারলেস পুরুষ।তোর সাথে থাকবো না আমি ডিভোর্স দিবো হ্যা হ্যা আজকে বাসায় গিয়ে বলবো বাবাকে।”

ইরহামের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়।তাকে ডিভোর্স দিবে এ কথা শুনেই আবার রাগ উঠে এতো সময় ধরে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিলো কিন্তু অর্ষা আবার তার রাগ উঠিয়ে ছাড়লো।ইরহাম অর্ষার একদম কাছে এসে কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে আনে।দূরত্ব নেই দু’জনের মাঝে একটুও।অর্ষা ধাক্কা মেরেও এক চুল সরাতে পারে না ইরহামকে।

ইরহাম চুলে হাত দিয়ে অর্ষার মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।অর্ষা চোখ বড়বড় হয়ে যায়।প্রথম স্পর্শ।অর্ষা নিজেকে ইরহামের থেকে ছাড়াতে চায়।কিন্তু ইরহাম তো ইরহাম সে কি ছাড়ার মতো মানুষ।রাগ উঠিয়েছে যখন তার মাসুল তো দিতেই হবে অর্ষাকে।
অর্ষাকে ছেড়ে দেয় অনেকক্ষণ পর।অর্ষা হাঁপাচ্ছে।ইরহামকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে দূরে সরায়।ইরহাম ঠোঁট স্লাইড করতে করতে বলে,,,

—“উফ জান মিষ্টিটা খুব মজা ছিলো আরো একবার খেতে ইচ্ছে করছে আমার এখন কি করি বলো আরেক বার…..”

অর্ষা ইরহামের দিকে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুড়ে মারছে।অর্ষা চিল্লিয়ে বলে,,,

—“ইউ অসভ্য পুরুষ মানুষ আপনি কেনো আমাকে স্পর্শ করলেন।ক্যারেক্টারলেস পুরুষ মানুষ।একদিন নিহানা তো আরেক দিন ওই মেয়েটা আর শেষে আমার কাছে আসে।ছিহ”

ইরহাম রেগে অর্ষার কাছে এসে ওকে বিছানার সাথে চেপে ধরে।অর্ষার কাটা হাতে বেশ ব্যাথা লাগছে।ইরহামের চোখ লাল বর্ন ধারণ করেছে।অর্ষা ভয় পেলেও মুখ ভঙ্গি স্বাভাবিক।যেন কিছুই হয়নি।

—“আমি ক্যারেক্টারলেস না।আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার আগে দশবার ভাববি।”

৪২.

রুশান অর্ষা বসে আছে ছাদে।অর্ষা নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিয়েছে সবার কাছ থেকে।বাড়ির সবাই অর্ষার এমন পরিবর্তন দেখে কিছুটা চিন্তিত।রুশান অর্ষাকে মন মরা দেখে বলল,,,

—“তুই ভালোবাসিস ইরহাম স্যারকে?”

—“হয়তো”

অর্ষার অস্পষ্ট উত্তর।রুশানের ভালো লাগছে না।ইরহাম অর্ষার জীবনে আসার পর মেয়েটা কেমন হয়ে গিয়েছে।বিকালে বাসায় আসার পর রুমে বসে ছিলো।সন্ধ্যার দিকে রুশান টেনে রুম থেকে বের করে নিয়ে এসেছে।রুশান অর্ষার মন ভালো করতে বলে,,,

—“অর্ষা চল ঘুরে আসি আমাদের আগের বাসা থেকে”

—“যেতে ইচ্ছে করছে না তুই যা”

রুশান অর্ষাকে টুল থেকে টেনে উঠিয়ে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসে।বাইক বের করে দু’জন চলে আসে পুরোনো সেই বাড়িতে যেখানে তাদের ছোটবেলা কেটেছে।এটা ছিলো ওদের দাদুর বাড়ি।৮মাস হলো ওদের বাপ চাচা মিলে বর্তমান বাড়িটা করেছে।পুরোনো বাড়িটা এখন ফাঁকা পরে আছে।বাগান বাড়ির ন্যায় হয়েছে।রুশান মিথ্যা বলেছে অর্ষা সে পুরোনো বাড়িতে না এসে অর্ষাকে নিয়ে ফুসকা খেতে এসেছে সাথে উশা নাইম,মুহিব আছে।

সবাই মিলে অর্ষার মন ভালো করে দেয়।নয়টা পর্যন্ত এদিক ওদিক ঘুরে আড্ডা দিয়ে বাসায় চলে যায় সবাই।অর্ষা নিজের রুমে যাওয়ার সময় রুশানের গাল টেনে দিয়ে বলে,,,

—“ধন্যবাদ ছোট ভাই রুশাইন্না”

রুশান হাসে।বোনের মন ভালো করতে পেরেছে এতেই সে খুশি।ছোটবেলা থেকে দুজন মারামারি করেই বড় হয়েছে।ওদের সম্পর্কটা আপন ভাই-বোনের চেয়েও উপরে।

৪৩.

ইরহাম বারান্দায় ইজিচেয়ার বসে আছে।রুম অন্ধকার।চারপাশের কিছুই তেমন ভাবে দেখা যাচ্ছে না।কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে।অর্ষার কথাগুলো এখনো কানে বাজছে তার।সে ক্যারেক্টারলেস!জীবনে কোনো মেয়ের দিকে ফিরে তাকায়নি সে।আর এখন নিজের বউয়ের মুখ থেকে চরিত্রহীন শুনতে হচ্ছে।প্রচুর ইগোতে লেগেছে ইরহামের।

—“তুমি জ্বলবে প্রেয়সী কাল থেকে জ্বলবে এবং নিজের আমার কাছে আসবে।আমি আর যাবো না তোমার কাছে তুমি যতক্ষন না আমার কাছে আসছো”

প্রিয়া তখনই রুমে নক করে।ইরহাম আসতে বলে।প্রিয়া লাইট জ্বালিয়ে সোফায় বসে পরে।প্রিয়া হেসে বলে,,,

—“কিরে অসুস্থ তুই?”

—“নাহ।ভালো লাগছে না আরকি”

—“কেনো অর্ষা ঝগড়া করেছে”

—“আর বলিস না আপুই মেয়েটা বোঝেই না আমাকে।আমি ওকে ভালোবাসি তাও বোঝে না”

প্রিয়া হাসে।প্রিয়া ইরহামের ফুফাতো বোন।সকালে যখন সে ইরহামের সাথে ছিলো তখন অর্ষার চোখে হিংসা দেখেছে।অর্ষাও যে ইরহামকে ভালোবাসতে শুরু করেছে তা বেশ বুঝতে পারছে।কিন্তু এই বলদ তো বলেই না তার মনের কথা।

—“তুই ওকে বলেছিস নিজের মনের কথা যে ও বুঝবে আগে তাই বল।ও তো জানেই না তুই ওকে ভালোবাসিস”

—“বলবো আপুই কিন্তু এখন না আর কিছুদিন যাক ও যে আমায় ভালোবাসে তা বুঝি আগে তারপর বলবো”

—“ঠিক আছে।কিন্তু ভাই ইয়াদকে দেখলাম কেমন মনমরা হয়ে আছে।আগে তো কখনো এমন করেনি ও।কি হয়েছে ওর।হাসে না আগে তো আমার সাথে দেখা হলে ছাড়তেই চায়তো না এখন তো ধরে বেঁধেও রাখা যাচ্ছে না”

—“আমিও জানি না জিজ্ঞেস করতে হবে ওকে”

—“করিস তুই দেখ কি হলো ছেলের।”

প্রিয়া কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে চলে যায়।ইরহাম নিজের রুমে থাকা আরেকটা সিক্রেট রুমে যায়।রুমটা জুড়ে অর্ষার ছবি।বড় করে বিয়ের পরের দিনে ঘুরতে যাওয়া ছবিটা টানানো।এরপর বিয়ের দিনের ছবি অর্ষার হুট করে হেসে ওঠা অর্ষার বিভিন্ন রকমের ছবি আছে।রুমের এক জায়গায় বড় করে লেখা “আমার মনের রাজ্যের রানী” নিচে অর্ষা লেখা।

ইরহাম ছবিগুলো দেখতে থাকে।রং তুলি নিয়ে আবারও বসে সে।ছবি আঁকে অর্ষার।আঁকতে আঁকতে রাত কত বাজে খেয়াল নেই ইরহামের।ইরহাম ছবিটা আঁকা শেষ করে রুমে আসে।মন ভালো হয়েছে তার কিছুটা তবে পুরোপুরি না।

#চলবে