#তরঙ্গিনী (পর্ব-১২)
#আরশিয়া_জান্নাত
জিহাদ হাঁটু ভাজ করে ফ্লোরে বসে আছে। ক্লান্ত চোখ দুটো দেখলে যে কেউ বুঝবে অনেক রাত নির্ঘুম কেটেছে তার। বইখাতা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, লাগেজটা পর্যন্ত খোলা হয়নি এখনো। আরাফ দরজায় এসে তার নাম ধরে ডাকলো। জিহাদ উঠে সবকিছু ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করলো, চোখ মুখ মুছে হাসিমুখে দরজা খুলল।
ভাইয়া তুমি এখানে? কবে এলে রাজশাহী থেকে?
আরাফ হেসে ভাইকে জড়িয়ে বলল, কিরে কেমন আছিস তুই? এমন একঘরে হয়ে বসে আছিস কেন? চল কফি খেয়ে আসি।
না ভাইয়া, কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। ভাবী এসেছে? কখন এলে বললে না?
এসেছে,, আর এসেছি অনেকক্ষণ হলো।
ওহ।
আরাফ ভেতরে ঢুকে বলল, তারপর কি হাল তোর?
এই তো ভালোই।
দেখছি তো ভালোর লক্ষণ! এখন মিথ্যে অভিনয় ছাড়। তোর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভালোনেই তুই। কি হয়েছে বল ভাইকে? এতো কষ্ট পাচ্ছিস কেন?
জিহাদ ম্লান হেসে বলল, ভাই আমার উচিত ছিল এখানেই পড়াশোনা করে বিজনেসে জয়েন করা। আমি অযথাই সময় আর টাকা লস করেছি। আমার জীবনের সব সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। সব ভুল সব।। এতো ভুলের মাঝে আমি বাঁচবো কিভাবে?
জিহাদ! ফাইনাল ইয়ারে আসলে এই টার্মটা অনেকেরই আসে। ডিপ্রেসড লাগে, মনে হয় অন্য সাবজেক্ট নিলে হয়তো ভালো হতো। আর তুই সবার অমতে নিজে সব চুজ করেছিস তো তাই তোর মাঝে একটা গিল্টি ফিল হচ্ছে। এসব অস্বাভাবিক না ভাই। তুই এমন ভাবনা ঝেড়ে ফেল।
আমার মনে হচ্ছে আমি এই ৩/৪ বছরে কিছুই শিখিনি, আমার কোনো স্কিল নাই, আমি এক্সাম দিচ্ছি, সিজি ভালো হচ্ছে এইটুকুই! এটার ফিউচার কি?
আরাফ সেল্ফে থাকা মেডেলস আর বাধাই করানো সার্টিফিকেটগুলো দেখতে দেখতে বলল, তোর সেটা মনে হচ্ছে। স্কিল যে হয়নি কথাটা একদম ভুল তোর। তুই তোর এক্টিভিটিস চেক কর, নিজের এচিভমেন্টগুলো রিকল কর।এসব কিন্তু এমনি এমনি তোর ঝুলিতে আসে নি। আমাদের একটা অভ্যাস হলো আমরা যা পাই না সেটাকে মহামূল্যবান ভাবি। আর যা পেয়ে যাই সেটাকে নিছক ভেবে ফেলে রাখি। সাকসেস তেমনি একটা ভ্রম। যে সাকসেস হয় সেও ওতে স্যাটিসফাইড হয় না। আরো বড় কিছু হতে চায়। So, Dear my humble request to you, take e break but don’t give up.
জিহাদ মাথা নীচু করে কাঁদতে লাগল, আরাফ তার কাধে হাত রেখে বলল, মৃত্যু সকল সমস্যার সমাধান না। জীবন মানেই যুদ্ধ, এখানে সবাইকে প্রাণপণ লড়াই করতে হয় টিকে থাকার জন্য।
জিহাদ চমকে আরাফের দিকে তাকায়, আরাফ অসহায় গলায় বলে, ইন্ডিয়াতে তুই হসপিটালাইজ ছিলি এই খবরটা আমি জানতে পারবো না ভেবেছিস? আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া তোর কিছু হয় নি। পরাজিত সৈন্যের মতো পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলি! অথচ ভাবলিনা আমাদের কি হবে, চাচা চাচীর কি হবে?
ভাইয়া এই কথা আর বলো না প্লিজ। আমার ভীষণ লজ্জা হয়।
সিরিয়াসলি?
কি করবো বলো আমার খুব হোপলেস লাগছিল। ইনফ্যাক্ট যখন আমি দেখলাম আমি মরিনি আমার মনে হচ্ছিল আমি আসলেই কোনোদিকেই নেই। মরতেও পারিনাই এতোটাই অকর্মা আমি। আমার এই জীবনটা অনেক কঠিন লাগছে।
আরাফ ইন্টারকমে কল করে বলল রুম ক্লিন করতে লোক পাঠাতে। তারপর জিহাদকে নিয়ে গেল ঢাকা মেডিক্যাল। সেখানের পেশেন্টদের দেখলে হয়তো জিহাদ বুঝবে বেঁচে থাকার কত তীব্র আকাঙ্খা মানুষের।
আরাফের ইচ্ছে করে প্রতিটা ডিপ্রেসড মানুষকে বলতে হাসপাতালে সময় কাটিয়ে আসুন, দেখে আসুন আপনি কতোটা ভালো আছেন। সুস্থ সবল থাকাটা অনেক বড় নেয়ামত। সকলের জীবনটাই কঠিন, কেউই সবদিকে সুখী নয়। তবুও তো বেঁচে থাকতে হয়, জীবনতো একটাই। এই কান্না, হতাশা, দুঃখ এসব আছে বলেই তো জীবন বৈচিত্রময়।
ডিনারে জিহাদকে দেখে সবাই ভীষণ খুশি হলো। ছেলেটা আসার পর থেকে রুম থেকে বের হয় নি। আজ আরাফ তাকে বাইরে নিয়ে কি ম্যাজিক করলো কে জানে। জিহাদ হাসিমুখেই সবার সঙ্গে খেতে খেতে গল্প করলো। সেজ চাচি আনন্দে চোখ মুছলো।
জিহাদ বলল, এটেনশন এভ্রিওয়ান। আমি শুরুতেই সবার কাছে ক্ষমা চাইছি, আমি জানি আমার জন্য আপনারা সবাই খুব ডিস্টার্বড ছিলেন। বিশেষ করে আম্মু এন্ড আব্বু। আমি খুব সরি। তবে এখন আমি রিয়েলাইজ করেছি লাইফ ইজ প্রাইসলেস। আল্লাহ আমাদেরকে খুব ছোট্ট একটা জীবন দিয়েছেন, এই জীবন নিয়েই আমাদের কত অভিযোগ, অভিমান। অথচ আমরা ভালো আছি, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, সুস্থভাবে বেঁচে আছি । এসবে আমরা এতোটাই অভ্যস্ত হয়েছি যে এটাকে Taken for granted ধরে নিয়েছি। যা আমাদের অকৃতজ্ঞ করে তুলেছে। আমি ঠিক করেছি এক্সাম দিবো। আর যেহেতু আমার জন্য একটা খারাপ সময় কেটেছে, তাই আমি আপনাদের অনারে একটা পিকনিক এরেঞ্জ করতে চাই। আমরা সবাই একসঙ্গে পিকনিক করবো। সারাদিন হৈ হুল্লোড় করবো একদম আগের মতো। আর এর সব রেসপন্সিবিলিটি আমার হবে।
জিহাদের বোন সায়মা বললো, ভাইয়া তুই কত বছর পর পিকনিক এরেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিলি! আমি তো অনেক এক্সাইটেড। অনেক মজা হবে ইয়েএএ।
রুহি বলল, ভাবীর সঙ্গে এই প্রথম আমরা পিকনিকে যাবো, জানো ভাবী আমরা আগে প্রতি বছর কিশোরগঞ্জের বাড়িটায় যেতাম পিকনিক করতে। জিহাদ ভাইয়া ইন্ডিয়ায় যাওয়ার পর আর পিকনিক হয় না। দেখবা অনেক মজা হবে।
মুহতাসিম (ছোট চাচার ছেলে) বলল, তাহলে কবে যাচ্ছি আমরা?
জিহাদ বললো, আগামীকালই।
আমি আরাফের দিকে চেয়ে রইলাম, মানুষটাকে যত দেখি ততোই মুগ্ধ হই। তার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে।
আরাফ ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞাসা করে কি?
আমি হেসে মাথা নাড়ি কিছু না।
।
।
রুমে এসে দেখি আরাফ কলে কথা বলছে। আমি বিছানা ঠিক করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আচড়াতে শুরু করি। চুলে চিরুনী চালানোতে মন কম আয়নায় আরাফের দিকেই মনোযোগ বেশি। কি সুন্দর হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে, কথা বলার সময় মাঝেমধ্যে হাসছে, তার অনেকগুলো গুণের মাঝে একটি হলো সে সবসময় হাসিমুখে কথা বলে। কঠিন পরিস্থিতিতেও মাথা ঠান্ডা রাখে। কিন্তু আমি একদম তার বিপরীত। একটু কিছু হলেই প্যানিকড হয়ে যাই তখন মাথা ঠান্ডা রাখা তো অসম্ভব।
আরাফ কথা বলা শেষে আমায় বলল, কি ব্যাপার বলুন তো সেই কখন থেকে দেখছি আমার দিকে পলকহীনভাবে চেয়ে আছেন! প্রেমে পড়লেন নাকি হুম?
আমি চোখ নামিয়ে বললাম, কই না তো। আমি তো আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখছিলাম। চুলগুলো কেমন হয়ে যাচ্ছে!
আরাফ আমার হাত থেকে চিরুনী নিয়ে চুল সব পেছনে নিলো। তারপর ধীরে ধীরে ঝট ছাড়িয়ে বলল, মোটেও না, আপনার চুল বরাবরই সুন্দর। মাশাআল্লাহ! এতো ঘন চুলের অধিকারী হয়েও এমন বলছেন? আপনার উচিত রোজ ২রাকাত শোকরানার নামায পড়া।
তাই বুঝি?
জ্বি। আমার তো ইচ্ছে করে আপনাকে বলি চুল ছেড়ে রাখুন, কিন্তু বলিনা পাছে কারো বদনজর লাগে যদি। তাছাড়া লম্বা চুলে জট বাধে বেশি। আপনিও অস্বস্তিতে পড়বেন।
আপনি কত কি ভাবেন! সারাদিন না রাখি আপনার সামনে এখন থেকে খোলাচুলেই থাকবো।
আমার মনমতো চলা হচ্ছে?
জ্বি! আমার নানী কি বলতো জানেন? আমি নাকি এই চুল নিয়ে আমার বরকে খোপায় বেধে রাখতে পারবো। সে নাকি অন্যদিকে নজর দেওয়ার ফুরসতই পাবে না,,,
একদম ঠিক বলেছেন তিনি। আমি আসলেই ফুরসত পাইনা,
আরাফ আনাড়ি হাতে আমার চুলে বেনুনী করলো। আমি মুগ্ধ হয়ে তার মনোযোগী কর্মকান্ড দেখছি। শেষে বলল, হাহ আপনার কত ধৈর্য! লম্বা চুল সামলানো অনেক কঠিন না?
আমি তার দিকে ফিরে তার হাত দুটো নিয়ে চুমু খেয়ে বললাম, আপনাকে অসম্ভব ধন্যবাদ।
আরাফ বললো, এই এই কি করলেন আপনি এটা! আপনি আপনি আমার হাতে চুমু দিলেন? এই প্রথম এই প্রথম!!! ও মাই গড!! আমি স্বপ্ন দেখিনি তো?!
হ্যাঁ স্বপ্নই এটা। কে দিয়েছে আপনার হাতে চুমু। এই চলে আপনার মনে না? সারাক্ষণ কি সব যে ভাবেন!
এই রেবা একদম না। মিথ্যে বলছেন কেন?
ঢং মিথ্যে বলবো কেন। আমার ভীষণ ঘুম পেয়েছে। আপনি ঘুমোবেন নাকি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখবেন?
আরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হাহ! আছে কি আর আমার জীবনে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা ছাড়া। আমার তো আর নসীবে নেই বৌয়ের,,,,
কি বললেন?
না না কিছু না।
আচ্ছা শুনুন।
জ্বি বলুন?
রাত জেগে হা করে তাকিয়ে থাকবেন না, ঘুমাবেন। রাতের ঘুমটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আরাফ আশাহত গলায় বলল, আপনি ও না একদম ভেজিটেবল। ধুরর। শুনুন আমাদের বয়সটাই এখন রাত জাগার। ইনফ্যাক্ট রাত না জাগলে সমস্যা। আমি আবার খুব সচেতন তাই জেগে থাকি। আপনি বরং ঘুমান।
আমি তার কথা শুনে উঠে বললাম, আপনিতো ভারি ঠোঁটকাটা লোক! কিসব বলা শুরু করলেন।
আরাফ আমার কোমড় জড়িয়ে কোলে মুখ ডুবিয়ে বলল, দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়ে বেঁচে আছি। ও আপনি বুঝবেন না।
আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, এত ধৈর্য ধরার আবশ্যকতা তো ছিল না আপনার। আপনি চাইলেই তো,,,
রেবা! ওতে কি মন ভরতো আমার? আপনি আমার দিকে একটু একটু করে আসছেন আমি সেটা তীব্রভাবে টের পাচ্ছি। আপনার প্রতিটা পদক্ষেপ আমার মনে যে সুখানুভব করাচ্ছে তা আমি ভীষণভাবে উপভোগ করছি।
আপনি অনেক আলাদা আরাফ। আপনার চিন্তাভাবনা অনেক ভিন্ন। আমি জানিনা আমি আপনায় ঠিকঠাক যত্ন করতে পারবো কি না। আমার ভীষণ ভয় হয়।
তাকিয়ে দেখি আরাফ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়িয়েছে। মানুষটার উপর আজ আসলেই অনেক ধকল গেছে। তাইতো ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি তার কপালে পরম মমতায় অধর ছুঁইয়ে বললাম, আপনাকে আমি ভালোবাসি আরাফ। অনেক ভালোবাসি।
চলবে,,,