#তরঙ্গিনী_পর্ব_১৯
#আরশিয়া_জান্নাত
আজ পিহুর অ্যাঙ্গেজমেন্ট। সকালেই ইভেন্ট ম্যানেজার তার টিম নিয়ে এসে পড়েছে। কাজিনরা সবাই একজোটে আড্ডা আর খোশগল্পে মত্ত। এ সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে। তাই আত্মীয় স্বজনসকলেই চলে এসেছে একদম বিয়ে পর্যন্ত থাকার প্রস্তুতি নিয়ে। তাই কাজ নেই বললেও অনেক কাজ।
আরাফ রুমে বসেই ল্যাপটপে কাজ করছে, তখন রেবা ব্যস্তভঙ্গিতে এসে বলল, আপনার কিছু লাগবে? কল করলেন যে?
এতো ছোটাছুটি করছেন কেন আপনি হুম? অনেক মানুষ আছে তো। আপনার হাল দেখে তো আমি চিন্তায় পড়ে যাচ্ছি!
রেবা বেডের প্রস্থে সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করল। পিঠটা যেন আরাম পেয়ে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে।
আপনিও না কেমন! আমার ননদের অ্যাঙ্গেজমেন্ট, আমি একটু তদারকি করবোনা? তাছাড়া সবাই এসেছেন, আমি যদি চুপচাপ ঘরে বসে থাকি ওনারা কি ভাববে বলুন তো?
আরাফ রেবার পেটে মাথা রেখে শুয়ে বলল, ওসব কেউ ভাববে না। সবাই জানে এখনকার বৌরা স্মার্ট আর অলস হয়। ওরা অনুষ্ঠানে কাজ করার চেয়ে পরিপাটি থাকতেই বেশি পছন্দ করে।
টিপ্পনীটা ভালো ছিল। তবে এরকম করে ভাবাটা ভুল। বড়লোকদের খবর জানিনা , তবে আমরা তো অনেক খাটতাম, আপা আর ভাইয়ার বিয়েতে দম ফেলবার জো ছিল না। সবার পাতে ঠিকঠাক খাবার পড়লো কি না, কেউ আবার না খেতে পেয়ে চলে গেল কিনা সহ কতদিক দেখতে হয়। প্রতিটা খাবার টেবিলে গিয়ে হাজিরা না দিলে কত বদনাম হয় জানেন? বলে দাওয়াত দিয়ে এনে আপ্যায়ন করছেনা, একেকজনের ফুট ফরমায়েশ খাটতে খাটতে শরীর একদম অর্ধেক হয়ে যায়,,, আমিতো ওভাবে দেখেই অভ্যস্ত। বিয়ে মানেই অনেক কাজ আর লাল পিপড়ের মতো বিষকামুড়ে খোঁচা! ঘরের লোকের পরিপাটি হয়ে থাকা সেখানে বিলাসীতা।
আরাফ হেসে বলল, তা যা বলেছেন। অনেক মানুষ জমায়েত হওয়া মানেই কত কি আলাপ আলোচনা। ঐসব বিষকামুড়েই বটে!
রেবা ওর অনামিকার রিংটা নাড়াচাড়া করে বলল, আপনার পছন্দ সবসময়ই খুব সুন্দর!
তাই? হঠাৎ এই কথা কেন?
এই শুনুন
হুম?
আমায় রিংটা আবার পড়িয়ে দিন তো,,
আরাফ উঠে বলল, কি ব্যাপার বলুন তো আবার বিয়ে করতে মন চাইছে বুঝি?
নাহ,,, পড়ান না?
আরাফ রেবার অনামিকায় রিং পড়ালো। রেবা হেসে বলল, কিউট না ব্যাপারটা?
হুম অনেক কিউট।
রেবা
জ্বি
রেডি হবেন না?
কয়টা বাজে? সময় হয়ে গেছে নাকি?
নাহ। এখনো ঘন্টাখানেক আছে।
তাহলে?
শুরু করে ফেলুন, টাইম তো লাগবেই না?
রহস্য কি বলুন তো? এতো তড়িঘড়ি কেন?
আপনি সাজবেন আর আমি দেখবো, আপনার সাজগোজ শেষ হবার পরো আপনি আমার সামনে বসে থাকবেন। আমি মন ভরে দেখবো। আমার তো মনে হয় ২ঘন্টায় পোষাবে না।
আপনি ও না পারেন বটে!
আমি কিন্তু সিরিয়াস।
আচ্ছা বেশ।
রেবা কাভার্ড খুলে সিলেক্ট করে রাখা লেহেঙ্গা বের করলো। ওয়াশরুমের দিকে যেতেই আরাফ তাকে আটকে বললো, কি বলেছি বোঝেন নি বোধহয়,,
রেবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আরাফ বললো, এখানেই চেইঞ্জ করুন, আমি হেল্প করি।
রেবার নিরবতাকে সম্মতি ভেবে আরাফ ওর কাধে থাকা আচলের পিন খুলল, সে নিজ হাতে ওকে শাড়ি বদলে লেহেঙ্গা পড়িয়ে দিলো। তারপর রেবা আয়নার সামনে বসে সাজতে শুরু করে। আরাফ তার দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে থাকে সাথে এটা ওটা এগিয়ে দেয়।
রেবা আরাফকে বলে, আপনি বুকে কাঁপুনী ধরানো কাজকর্ম করেন!
কই দেখি!
কি দেখবেন?
বললেন না কাঁপুনী ধরেছে একটু কান পেতে শুনি কেমন কাঁপছে?
খুব চালাক না?
রেবা একটা সিক্রেট বলি শুনবেন?
কি?
আপনি যখন আয়নার সামনে বসেন আপনাকে অন্যরকম লাগে। মনে হয় ক্লিওপেট্রাও আপনার রহস্যের সামনে ফেইল। এতো আবেদময়ী লাগে কি বলবো!
বেশি বাড়িয়ে বলছেন।
নাহ সত্যি।
এদিকে আসুন তো
কেন?
গলার হারটা পড়িয়ে দিন।
আরাফ উঠে এসে হারের হুক এটে বলল, মনে আছে লাস্টবার এখানে আপনার পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম আর কি করেছিলেন?
রেবা নিজের খোপার কাঠি সরিয়ে সারা পিঠময় ঢেউ খেলানো চুল ছড়িয়ে বলল, সেদিনের মতো নিবিড় হয়ে জড়িয়ে ধরুন দেখি।
আরাফ টিপ্পনী কেটে বলল, শোধ করছেন বুঝি? শোধ হবেনা ওটা।
কে চাইছে শোধ দিতে?
চাইছেন না?
নাহ। ঐসব বিরহ ছিল বলেই তো এখন প্রতিটা স্পর্শ এতো অনুভূতিসম্পন্ন!
আরাফ ওর চুলে নাক ডুবিয়ে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলল, তাই বুঝি?
হুম। এই শুনুন
জ্বি?
আপনি কি জানেন আপনি যখন আমার পেছনে থাকেন, আপনার প্রতিটা নিঃশ্বাস আমি তীব্রভাবে অনুভব করি? আর এটা আমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা,,,,
জানি।
কিভাবে?
আপনি কোন স্পর্শে বেশি প্রভাবিত হন তা আমি জানবো না তো কে জানবে?
তাও কথা!
বোকা মেয়ে।
হুহ! চালাক বর।
উহু চালাক না।
রেবা হঠাৎ পেছন ঘুরে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে আরাফের ঠোঁটে চুমু খেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আরাফ স্ট্যাচু হয়ে গেল। রেবা হাসির রিনঝিন শব্দ তুলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আরাফ নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে মুচকি হাসলো, পাগলী একটা!
।
।
সিলেট থেকে রেবার মা আর আপা আসেন। গতমাসে ওর ভাইপো হওয়ায় ভাই ভাবি আসেনি। অনেকদিন পর মা বোনকে পেয়ে রেবার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। সবার সাথে কুশল বিনিময় করার পর রেবা তাদের একটা ঘরে নিয়ে বসায়। রেবা বলল, ভাইয়া ভাবী মিমি, বাবু সবাই ভালো আছে?
হুম ভালো আছে। জামাই কোথায় ওকে দেখছি না যে?
একটু আগেই বের হয়েছে, চলে আসবে। ছোটন এমন গাল ফুলিয়ে রেখেছে কেন?
আপা বলল, ওর কথা আর বলিস না, মোবাইলটা হাত থেকে নিলেই গাল ফুলে লুচি হয়। বদ হচ্ছে দিনদিন।
দুলাভাই ভালো আছেন? আসেননি কেন?
সে এখন ছুটি পায় নি, আমি বললাম বিয়েতে তো আসতেই হবে। তখনই বরং এসো।
ওহ!
হ্যাঁ রে শুনেছি খুব ভালো জায়গায় সম্বন্ধ করেছে। ছেলে কি করে?
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।
বাহ!
আপা তোরা ফ্রেশ হয়ে নে, আমি কিছু নিয়ে আসি।
নাহ কিছু লাগবেনা, তুই আসবার আগে তোর চাচীশাশুড়ি খাইয়েছেন।
আচ্ছা। আমি যাই দেখি পিহুর কি অবস্থা। তোমরা তৈরি হয়ে আসো।
রুহি মুখ ভার করে পিহুর অপরপাশে বসে আছে। ওদিকে মেকাপ আর্টিস্ট সেই কখন থেকেই পিহুর মুখে কত কি ঘষে যাচ্ছে! রেবাকে দেখে রুহি বলল, ওয়াও ভাবী তোমাকে যা লাগছে না! আমার ভাইয়া তো আরেকবার তোমার প্রেমে পড়ে যাবে।
পিহু বলল, আসলেই ভাবী তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে, আমিতো ভাবছি সবাই আমাকে বাদ দিয়ে তোমার দিকেই না তাকিয়ে থাকে!
তোমাদের দুজনকে ফেলে আমার দিকে চোখ দেওয়ার ফুরসত পাবেনা গো ননদীরা। ঐসব ছাড়ো, মা বলেছেন উনারা রওয়ানা দিয়ে ফেলেছে তোমাদের আর কতক্ষণ লাগবে?
এই তো ম্যাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ে যাবে।
আচ্ছা।
বৌমা তোমাকে বড় ভাবী ডাকছেন, জলদি যাও।
রেবা দোতলায় তার শ্বাশুড়ীর রুমে গিয়ে বলে, মা ডেকেছেন?
হ্যাঁ এদিকে আয়। পিহু রেডি হয়েছে?
হুম আরেকটু বাকী।
আরাফ কোথায় গেছে?
উনার কোন ফ্রেন্ড নাকি আসছে, তাকে আনতে গেছেন।
ওহ।
মা আপনার কি খারাপ লাগছে? চেহারা কেমন যেন দেখাচ্ছে!
রেহানা হেসে বললেন, না রে তেমন কিছু না। মেয়ের বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে তো, খারাপ লাগছে।
রেবা উনার পাশে বসে জড়িয় ধরে বলল, মন খারাপ করবেন না মা।
রেহানা ওর হাত ধরে বলল, মাঝেমধ্যে কি ভাবি জানিস! এ নিয়ম সৃষ্টি না হলে কি হতো? ছোট থেকে আদরযত্নে বড় করা মেয়েটাকে পরের ঘরে পাঠানোর দরকার কি? বুঝদার মনটাও অবুঝ হয়ে যায়। আমার বড় মেয়েটাতো দেশেই আসেনা, সেই বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকে। মেয়েটাকে কতদিন ধরে আদর করিনা, গায়ের গন্ধ নিতে পারি না। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিলে আগের মতো চাইলেও আদর করা যায়না, যখন তখন যাওয়া যায়না ওরাও আসতে পারেনা। অথচ একটা সময় ছিল চোখের সামনে না দেখলে বুক ধড়ফড় করতো, রাতে কপালে চুমু না দিলে ঘুম হতোনা। রুহি পিহু সারাক্ষণ পিছে পিছে ঘুরে, ওদের বিয়ে দিয়ে দিলে ওরাও আর আঁচল ধরে থাকবেনা, পরের বাড়িতে গিয়ে মায়ের কথা ভুলে যাবে,,,,,,,,
মা শান্ত হন। আপনি এখুনি ভেঙে পড়লে চলবে বলুন?
কি করবো বল, মন যে মানতে চাইছেনা। আমার ছোটছোট সন্তানেরা কত বড় হয়ে গেল! সেইদিন ই তো ওঞদের স্কুলে ভর্তি করালাম যেন,, হেলায় খেলায় কত বেলা হয়ে গেল না রে! তোকেও তো অন্যের কলিজা ছিড়ে এনেছি। নতুন সম্পর্কে এসেছিস।
রেবা চুপচাপ তাকে ধরেই বসে রইলো। রেহানা ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল, আমার কত ভয় ছিল জানিস? ছেলের বৌ কেমন হবে, আমার সংসারটায় মন টিকাতে পারবে কি না। আমার ছেলেমেয়েদের ভালোবাসবে কি না। আল্লাহর রহমতে আমি তোকে পেয়েছি। তুই আমার এই ভরা সংসারটাকে একজোটে রাখিস। কখনো ভাঙতে দিস না। সামনেই ছেলেগুলোর বিয়ে করাবো, নতুন বৌয়েরা আসবে। আমরা জায়েরা যেমন মিলেমিশে থাকি তোরাও তেমন থাকার চেষ্টা করিস। একা থাকায় কষ্ট অনেক বুঝলি,দেখিস নি ওখানে একা হাতে সামলাতে তোর কত সমস্যা হয়েছিল, ভরা ঘরে থাকাই ভালো। বাচ্চারাও হাতে হাতে বড় হয়ে যায়। একা লাগেনা। অবশ্য এখন মানুষ একা থাকতেই পছন্দ করে। শ্বশুড় শাশুড়িদের নিয়ে খেতে চায় না।
একজন দরজায় কড়া নেড়ে বললো, ম্যাডাম গেস্টরা এসে গেছেন।
রেহানা চোখমুখ মুছে ব্যস্তস্বরে বলল, দেখেছ কান্ড ওরা চলে এসেছে আমি কি না রাজ্যের গল্প জুড়ে বসলাম। কে জানে তোর বাবা আর আরাফ কোথায়। ওরা দরজায় দাড়ালো কি না!
চলুন গিয়ে দেখি।
বৌমা একটু খেয়াল রাখিস কেমন? আপ্যায়নের যেন ত্রুটি না থাকে।
চিন্তা করবেন না মা আমরা সবাই আছি তো।
রেহানা মৃদু হাসলো।
চলবে,,,
#তরঙ্গিনী_পর্ব-২০
#আরশিয়া_জান্নাত
পিহুকে যখন নীচে আনা হলো তখনই আরাফের সাথে তার বড়বোন আরজু এসে দাঁড়ায়। আরজুকে দেখে সবাই সারপ্রাইজড হয়ে যায়। আরাফের মা-বাবা তো যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। আরজু সবাইকে সারপ্রাইজ দিতেই আসার কথা কাউকে বলেনি। আনন্দের মাঝেও চোখের কোণ ভরে যায় সবার।
কেমন সারপ্রাইজ দিলাম সবাইকে হু?
রেহানা মেয়েকে জড়িয়ে বলল, কত বছর পর তুই এলি বলতো? আমি তো ভাবতেই পারছিনা তুই এসেছিস।
আপু তুই এসেছিস আমার তো নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছেনা! (রুহি)
আমার ভাগ্নীরা কই? দুলাভাই আসেনি? (রাজিব)
সবাই এসেছে ঐ তো,,
আরজুর দুই মেয়ে আর হাজবেন্ড ভেতরে ঢুকলো। সবার সাথে কুশল বিনিময় সেরে সবাই সোফায় বসলো। তখন হাই হিলের কটকট শব্দ তুলে একটা মেয়ে প্রবেশ করলো। রেবার চোখ যেন ধাধিয়ে গেল, একদম বলিউডের নায়িকাদের মতো দেখতে একটা মেয়ে। জিন্স প্যান্ট আর ব্লু টপ পড়া, চুলগুলো স্ট্রেইট করা, হাতে দামী ওয়াচ, আর রিং। রেবা এমন ঝকঝকে মেয়ে এই প্রথম দেখেছে।
হ্যালো এভ্রিওয়ান!
রুহি ফিসফিস করে রেবাকে বলল, এটা হচ্ছে আপুর একমাত্র ননদ সানজেনা।
রেবা বলল, ওহ!
পিহুর আংটিবদল শেষে সবাই ফটোশেসনে যোগ দিলো, রেবা সবার সাথে আন্তরিকতার সহীত টুকটাক গল্প করলো। খুব ভালোভাবেই ইভেন্টটা শেষ হলো।
রাতে সব অতিথি চলে যাওয়ার পর পরিবারের সবাই বিয়ের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করছিল।
আরজু কিচেনে গিয়ে বলল, রেবা!
জ্বি আপু
তোমার সাথে আলাদা করে কথাই বলা হলো না। কেমন আছ?
ভালো আছি আপু। আপনি কেমন আছেন?
বেশ ভালো আছি। মায়ের কাছে তোমার কত গল্প শুনি জানো? মা সবসময় তোমার কথা বলেন। তোমাদের বিয়েতে আমি আসতে পারিনি, এ নিয়ে ভাই অনেক আপসেট ছিল। কি করবো বলো চাইলেই তো আর সবসম। আসা যায় না।
আপনাকে সবাই অনেক মিস করে, আপনারা আসবার একটু আগেও মা আপনার কথা বলে কাঁদছিলেন,,
আমার মা খুব নরম মনের, সবাইকে কাছে রাখতে চায়। আমার রুমে এসো, সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
রেবা আরজুর সঙ্গে তার রুমে প্রবেশ করে দেখে ভাইবোন সব তার ঘরেই ভীঢড় জমিয়েছে।
মুহতাসিম বলল, ভাবি কোথায় থাকেন আপনি? সেই কখন থেকে বসে আছি আপু তো নাছোড়বান্দা। আপনাকে না এনে ব্যাগ খুললোই না।
রুহি বললো ভাবি এসো, আপু আমাদের সবার জন্য গিফট এনেছে বলেই এই হট্টগোল।
আরজু লাগেজের সামনে বসে বলল, তোরা একেকটা এতো অধৈর্যশীল! ব্যাগ থেকে শুরুতেই রেবার গিফট বের কে বলল, এটা আমার পক্ষ থেকে তোমার বিয়ের গিফট।
রেবা আরাফের দিকে তাকালো, আরাফ ইশারা করলো নিতে।
ধন্যবাদ আপু।
আরজু মুচকি হেসে বলল, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
একে একে সবাইকে গিফট দেওয়া শেষে আরাফ বলল, তুই সবাইকে গিফট দিলি অথচ আমাকে কিছু দিলিনা?
আরজু লাগেজ সরিয়ে বলল, তোর জন্য কিছু পাইনি, তাই আনিনি।
এটা ঠিক না।
এহ আসছে আমারে ঠিক বেঠিক শেখাতে।
আপু সত্যিই তুই এই সবকয়টা বাদরের জন্য আনলি অথচ আমি তোর কত ভালো ভাই, আমার জন্য আনলি না।
রেবা দেখেছ! তোমার বর কেমন গিফটের জন্য গাল ফুলাচ্ছে!
আরজুর হাজবেন্ড এমদাদ বলল, শালাসাহেব তোমার গিফট তোমার বোন সবার আগে কিনেছে। ও নিয়ে চিন্তা করোনা।
আরজু ভাইয়ের নাক টেনে বলল, তুই একটুও বদলাবিনা। ধর তোর গিফট।
সানজেনা রুমে এসে বলল, ভাবী আমার রুমের এসি অন হচ্ছেনা, কি করবো?
আরাফ বলল, ডোন্ট ওরি সাঞ্জু আমি দেখছি।
উম দ্যাটস গ্রেট।
রেবা মনে মনে লুচির মতো ফুলে উঠলো বিড়বিড় করে বলল সাঞ্জু!!
আরাফ ভাইয়া, তুমি কিন্তু একদম চেইঞ্জ হও নি। এখনো আগের মতোই ড্যাশিং!
রিয়েলি! হাহাহা
হুম। রেবা ইজ এ লাকি গার্ল আই মাস্ট সে!
ও লাকি কি না জানিনা, তবে আমি ভীষণ লাকি ওকে পেয়ে।
সিরিয়াসলি? ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং ও অতো আহামরি নয়, তুমি ওর চেয়ে বেটার ডিজার্ভ করো। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, ইউ নো আমি সরাসরি ওপিনিয়ন রাখতে পছন্দ করি।
একটা কথা কি জানো? সাধারণ কিছুর মাঝেই অসাধারণ ব্যাপার থাকে। আর সৌন্দর্য দেখার জন্য বিশেষ চোখ প্রয়োজন। আমার চোখে ও সেরা, এখন তোমার কাছে সেটা নাও লাগতে পারে। যাই হোক এসি চলছে, তুমি রেস্ট করো।
আরাফ ভাইয়া ওয়েট!
হুম?
আমি তোমার জন্য একটা গিফট এনেছিলাম।
আমার জন্য?
হুমম প্লিজ টেক ইট।
থ্যাঙ্কস।
প্লেজার
আরাফ নিজের রুমে এসে দেখে রেবা নাক লাল করে বসে আছে।
আরাফ টেবিলের উপর গিফটবক্স রেখে বলল, কি ব্যাপার চেইঞ্জ না করে বসে আছেন যে?
রেবা গিফটের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা দিতেই বাহানা করে ডাকলো বুঝি?
আরাফ বাঁকা হেসে বলল, আপনি জেলাস রেবা?
মোটেই না, আমি কেন জেলাস হবো?
ও মাই গড এজন্যই আপনার নাক লাল হয়ে গেছে?
রেবা খোপায় সেট করা ক্লিপ টেনে খুলতে খুলতে বললো, আমার নাক লাল না। আপনার চোখে সমস্যা। ডাক্তার দেখান।
এই দাঁড়ান, এরকম করে টেনে ছিড়ছেন কেন ব্যথা পাবেন তো। দেখি আমি করে দিচ্ছি।
ঢং করতে হবেনা। আপনি গিয়ে আপনার সাঞ্জুকে হেল্প করুন। আমাকে হেল্প করতে হবেনা।
ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার! আরেহ ও আমার হাটুর বয়সী মেয়ে, ওকে আমি স্নেহ করি, নাথিং ইলস।
আপনিও না কি যে ভাবেন।
রেবা গয়নাগাটি খুলে বলল, বেশ তবে।
রেবা!
জ্বি?
আমাকে ভরসা করেন?
করিতো,
তবে?
আমি স্মার্ট না আরাফ, আমি মফস্বলে বেড়ে উঠেছি। শহুরে মডার্ন মেয়েদের মতো হাইহিল পড়তে পারি না, আমার চুল স্ট্রেইট না, চেহারায় ঝকঝকে ভাব নেই। কথার মাঝে ইংরেজিও বেশি আসেনা, বাংলাই বলি সবসময়। মাঝেমধ্যে আঞ্চলিক টানও এসে যায়। আমি এটাও জানিনা কোন ব্র্যান্ডের প্রচলন এখন। মোট কথা স্টাইল ফ্যাশন সম্পর্কে আমার ধারণা নেই বললেই চলে। কিন্তু আপনি একদম বিপরীত। আপনিই আমার সবকিছু শপিং করেন বলে আমার এই ঘাটতি ঢাকা পড়ে। নয়তো সবার সাথে গেটাপ ম্যাচ করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।
আরাফ রেবা চিবুক তুলে বলল, বাহ্যিকভাবে মানুষকে বিচার করছেন হুম? কৃত্রিমতার আড়ালে যাদের চকচকে ঝকঝকে মনে হয় তারা কি আদৌ তা? আপনি আমার কাছে শুভ্র বেলী ফুল, আপনার কোমলতার সামনে কোনোকিছুর তুলনা হয় না। আপনি সানজেনার লাইফস্টাইল দেখে ইনসিকিওর ফীল করছেন! অথচ আপনি জানেনই না আমি আপনাকে আপনার এমন সাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী জেনেই ভালোবাসি।
আরাফ আপনি বাড়িয়ে বলছেন মন রাখতে,, আমি জানি ঢাকার মেয়েরা অনেক স্মার্ট হয়। আপনার অফিসেও নিশ্চয়ই অনেক আছে। আমিতো একজনকে দেখেই,,
আরাফ রেবার ঠোঁট চেপে বলল, হুসস আর একটা কথাও না।
রেবা বোকার মতো দৃষ্টিতে আরাফের দিকে চেয়ে রইলো। আরাফ ওর মুখ দেখে হেসে ফেলল।
আমার বৌতা কত্ত কিউট!! এতো আদর লাগে, ইচ্ছে করে একদম,,,
রেবা আরাফকে জড়িয়ে ধরে বললো, নিন বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলুন। একদম পিঞ্জিরাতে রেখে দিন,,
আরাফ হেসে বললো, এই তো বুঝলেন।
শুনুন,
জ্বি?
আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ
যাক বাবা সানজানার উছিলা বৌয়ের ভালোবাসা পাওয়া যাবে।
রেবা ওর বুকে ধাক্কা দিয়ে বললো, ছাড়ুন আমাকে। আমি যেন এমনি ভালোবাসি না। কেমন নাশোকর আপনি!
আরাফ আরো শক্ত করে বলল, ইশ রাগলে তো আপনার গায়ে ভালো জোর আসে, কিন্তু এইটুকুতে কি আমি ঘায়েল হবো হুম??
আপনার গায়ে একটু জোর বেশি বলে অবহেলা করছেন?
নাহ। মোটেই না। আমি তো বোঝাতে চাচ্ছি এভাবে ঘায়েল হবো না। অন্য ভাবে ট্রায় করুন।
অন্যভাবে?
হুম।
কিভাবে?
হাহ এটাও বলে দিতে হয় আমার! আপনি জানেন না আপনার বর কিসে ঘায়েল হয়ে যায়??
আমি কি করে জানবো? আমি কি তার সঙ্গে রোজ লড়াই করি নাকি?
না জেনেই কুপোকাত করে ফেলেন। জানলে কি করবেন! ভাগ্যিস জানেন না,,,
বলুন না কি?
নাহ বলবো না।
ধুরর ভাল্লাগেনা।
বুদ্ধি খাটান, আল্লাহ ব্রেইন দিয়েছে কিজন্য হুম?
আরাফ ফ্রেশ হতে চলে গেল, রেবা গালে হাত দিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো কি সেই হাতিয়ার যাতে আরাফ কুপোকাত হয়ে যায়?
।
।
সকালে সবাই একসঙ্গে নাস্তা খেতে বসে, আরজুর মেয়ে ইনায়া বলল, মম আমি মাম্মানীর পাশে বসবো। ওকে বলোনা আমায় খাইয়ে দিতে,,
রেবা হাসিমুখে বললো, আসো আমার পাশে।আমি খাইয়ে দিবো।
রেবা এটাসেটার গল্প করতে করতে আদর করে ইনায়াকে খাইয়ে দিলো। আরজু আর রেহানা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে, আরজু ধীর গলায় বলল, মা তোমার ছেলের সপ্তপুষ্পের খবর কি?
প্ল্যান বদলে ফেলেছে শুনলাম।
হাহাহা ওর থেকে এটাই আশা করা যায়। বাবার উপর গেছে কি না!
আল্লাহুম্মা বারিকলাহু!
আরাফ সবার দিকে তাকিয়ে একফাঁকে রেবার মুখে খাবার তুলে দিলো।
বিষয়টা ভাইবোন কারোই দৃষ্টি এড়ালো না। রুহি ফিসফিস করে বলল, ভাইয়া আর ভাবীর এই লুকোচুরি ব্যাপারগুলো খুব রোমান্টিক তাই না পিহু বলল,তা আর বলতে!
মুহতাসিম বলল, ভাইয়ার থেকে তোদের বরকে ট্রেনিং নিতে বলিস, আমরা তো নিচ্ছিই,,
রাজিব বলল, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস?
কি?
সানজেনা কেমন করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে?
রুহি চোখ সরু করে সানজেনার দিকে তাকালো, পিহু বলল, এ তো হবারই ছিল।
রাজিব–তা যা বলেছিস!
মুহতাসিম বলল, আহারে বেচারী, পুড়ে ছাড়খাড় হতে বাংলাদেশ এলো,,,
রুহি– তোর বড্ড মায়া হচ্ছে না? যা না গিয়ে বরফ পানি ঢেলে দে।
মুহতাসিম–আমার ছোট হলে ট্রাই করতাম।
পিহু– ফাজিল পোলা।
রুহি–ভাবীকে বলিস না কিন্তু এর ব্যাপারে। এমনিতেই কাল যখন ভাইয়া সাঞ্জু বলে ডাকলো ভাবীর মুখ বদলে গেছিল।
পিহু– হুম, আমিও দেখেছি সেটা। ও আসার পর থেকেই ভাবী ওকে পর্যবেক্ষণ করছে।
মুহতাসিম– কিন্তু সানজেনা আপুর চেয়ে আমাদের ভাবীই বেশি কিউট। এ তো ময়দা সুন্দরী
রুহি– মেয়েদের মনে একটু আধটু হিংসে থাকবেই।
রাজিব–হ তোদের মনে এটা অনেক বেশিই থাকে।
রুহি ভেংচি কেটে বলল, তো থাকবেনা?
হঠাৎ সানজেনা দাঁড়িয়ে গেল, সবাই ওর দিকে তাকালো। এমদাদ বলল, কি রে উঠে গেলি যে?
পেট ভরে গেছে ভাইয়া। আপনারা কন্টিনিউ করুন।
রুহি আর পিহু ফিসফিস করে বলল, জ্বলেরে জ্বলে,,
চলবে,,,,,,