#তরঙ্গিনী পর্ব-৩১
#আরশিয়া_জান্নাত
রেবা চলুন ঘুরে আসি।
এখন?
হুম, রাতের ঢাকা শহর না দেখলে চরম মিস! ঝটপট রেডি হন,,
কিন্তু…..
কোনো কিন্তু না।
অগত্যা রেবা রেডি হয়ে আরাফের সঙ্গে বের হলো রাত্রিভ্রমণ করতে। যানজটপূর্ণ ব্যস্ততম শহরটায় রাত বেশ মায়াময়। স্ট্রিট লাইটের সোডিয়াম আলোয় ওরা এগিয়ে যায় গন্তব্যহীনভাবে। একটা জায়গায় এসে আরাফ বলে আসুন, রেবা চারদিক তাকিয়ে দেখে এখানে বেশ সমাগম আছে। দেখে বোঝার উপায় নেই রাত ১১টা বাজে!
আরাফ ওকে রাস্তার পাশে একটা টুলে বসিয়ে মালাই চা আনলো, চা খেতে খেতে বলল, এখানে অনেক মজার মজার আইটেম আছে ট্রায় করবেন?
সবে না ডিনার করলাম?
কি যে বলেন! এক ঘন্টায় মানুষের পেটের সব হজম হয়ে যায়। আচ্ছা দাঁড়ান আমিই দেখছি কি কি বেস্ট হবে, আরাফ বেছে বেছে কিছু আইটেম নিলো, মসালা ডোসা, চিকেন মোমো, ভেলপুরী। ঘুরে ঘুরে এই স্টিটফুডগুলো দু’জনে ভাগ করে টেস্ট করতে মজাই লাগছিল রেবার। মানুষদের হাসি আড্ডার শব্দে মুখোরিত রাস্তার ধার, ব্যস্ততার মাঝে একটুখানি ফুরসতে সবাই জিরিয়ে নিচ্ছে যেন। এ সবকিছুই চারপাশটাকে আরো বেশি মোহনীয় করে তুলল- রাতের শহর মায়ার শহর ঢাকাকে !
পার্কিং পর্যন্ত আরাফের হাত ধরে এই আধার আলো মেশানো রাতে একসঙ্গে হেঁটে চলা রেবার কাছে স্বর্গীয় মনে হতে থাকে।
আরাফ ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লেগেছে?
অনেক সুন্দর আর শান্তিপূর্ণ। আমি তো আরো কয়েকবার আসতে চাইবো,,
আমার শহরের প্রেমে পড়লেন বুঝি?
আপনি কেন্দ্রীয় সবকিছুই এতো আবেদনপ্রিয়, প্রেমে না পড়ে উপায় আছে?
তাই বুঝি ম্যাম?
ইয়েস স্যার।
বেশ এখন থেকে সুযোগ পেলেই আসবো কেমন? চলুন তবে ফেরা যাক,,
আচ্ছা।
এই রেবা দাঁড়ান।
জ্বি?
ঐ দেখুন,,, আরাফ ইশারায় আকাশ দেখালো,
রেবা তাকিয়ে দেখলো আকাশভর্তি তারকারাজী ঝলমল করছে। চাঁদ না থাকায় তারাদের উজ্জ্বলতা চোখের পড়ার মতোই সুন্দর দেখাচ্ছে। তখনই একটা স্টার ফল করে, আরাফ চিৎকার করে বলে উঠে “আমার সঙ্গেই রেবা সুখী হোক,,,,,
রেবা খিলখিল করে হেসে উঠে, আপনিও না এতো বাচ্চামো করতে পারেন! এসব উইশ ট্রু হয় নাকি?
আরাফ মাথা চুলকে বলে, কিছু জিনিস থাকেই সত্যি হোক বা না হোক বিশ্বাস করতে ভালো লাগে।
হুম বুঝেছি, তবে আমার তো ভয় ছিল চেঁচিয়ে নাকি বলে উঠেন সপ্তর্ষীর জনক হই,,,
ঐটা বিয়ের আগ পর্যন্ত বহুবার উইশ করা হয়ে গেছে,,,
আপনি সিরিয়াসলি এমন বলতেন?
হুম। এর পেছনে একটা বিশ্বাস আছে আমার
কি সেটা?
আমরা যখন কোনোকিছু দোআ করি বা বলি আমাদের সাথে থাকা ফেরেশতারাও আমিন বলে। তাই আমি উইশ করতে কিপ্টেমি করিনা। সবসময় মুখে বলে ফেলি।
বাহ! দারুণ তো। আপনি অনেক কিউট আরাফ! কেমন আদুরে আদুরে চিন্তাভাবনা!
গাড়ির সামনে এসে আরাফ বলল, ওয়েট এ মিনিট।
রেবা কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে রইলো। আরাফ গাড়ি থেকে একটা রেড ভ্যালভেট কেক এনে রেবার সামনে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলো, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ডিয়ার রেবা,
আল্লাহ, আপনার মনে ছিল! এজন্যই বুঝি এতো আয়োজন?!
আমার ১০টা না ৫টা না ১টা মাত্র বৌ। তার জন্মদিনটা কত স্পেশাল আইডিয়া আছে? আজকের দিনে সে এই পৃথিবীতে আমার জন্যই তো এসেছিল- আমাকে পরিপূর্ণ করতে,,নিন কেকটা কাটুন।
রেবা কেকটা কেটে আরাফকে খাইয়ে দিলো।আরাফ ওকে খাইয়ে দিতে গিয়ে দেখে রেবার চোখ পানিতে টলমল করছে।
কি ব্যাপার কাঁদছেন কেন?
জানেন আমি লাস্ট যে বছর জন্মদিনে কেক কেটেছিলাম সেই কেকটা আব্বু এনেছিল। উনার পর আজ আপনি আনলেন,,,,
মন খারাপ করবেন না রেবা।
উহু মন খারাপ করছিনা তো।
আরাফ ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, আল্লাহ আপনাকে সুখী করুন। আপনি নেক হায়াৎ লাভ করুন।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এতো সুন্দর একটা রাত উপহার দেয়ার জন্য।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
🌸🌸🌸🌸
বাড়ির সবাই একে একে ড্রইং রুমে এসে ভুত দেখার মতো চমকে যাচ্ছে। এ কে এসেছে তাদের বাড়িতে?
রেবা সবাইকে এভাবে জমা হতে দেখে কৌতুহলে সামনে এগিয়ে সোফায় বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকালো। মাথায় চুল ঝুটি করে রেখেছে, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি, রোদে পুড়ে গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। ট্র্যাভেলিং ব্যাগ পাশে দেখে রেবা অনুমান করলো এ নিশ্চয়ই তার দেবর আরুশ! যদিও ছবির সাথে তার কোনোকিছুই মিলছেনা।
হেই ভাবি! কেমন আছ? চিনতে পেরেছ আমাকে? এটা আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ তাই না?আচ্ছা তোমরা সবাই এমন চোখ গোলগোল করে চেয়ে আছ কেন বুঝলাম না। ঘরের ছেলে ফিরেছ কোথায় সবাই জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করবা তা না এমনভাবে দেখছ লাইক চিড়িয়াখানা থেকে একটা গরিলা পালিয়ে এসেছে তোমাদের বাড়ি!
ওর কথা শুনে মেজ চাচী ওর কান মলে দিয়ে বলল, ঘরের ছেলে বনে বেড়িয়ে বাঁদর বনতে পারে আর আমরা রিয়েক্ট করলেই দোষ? হ্যাঁ রে আরুশ এতো নিষ্ঠুর তুই একটাবার এসে দেখে গেলি না!
ওহো মেঝ আম্মু লাগছে খুব, তুমিও না! সবার সামনে বেইজ্জতি করে দিচ্ছ।
মুহতাসিম বলল- ভাইয়া তুই আমাদের সবাইক যে ঝাটকা টা দিয়েছিস না! আমার তো নিজের চোখকে বিশ্বাসই হচ্ছেনা
রুহি– এলিই যখন আর ক’টা দিন আগে আসতি। বড় আপু তোকে দেখতে কত হা হুতাশ করে গেল!
আরুশ– কি রে তুই এখনো এই বাড়িতে? বিদায় হসনি? আমি আরো ভাবলাম পেত্নি দুইটা বিদেয় হয়েছে এখন গিয়ে শান্তিতে ঘুরে আসি,,
রুহি– ছোট ভাইয়া!
আরুশ– ওরে এতো জোর তোর গলায় আমার কানের পর্দা ছিড়ে গেল।
সেজ চাচী– সারাদিন কি এখানেই কাটানোর ফন্দি আছে? ছেলেটাকে একটু ফ্রেশ হয়ে খেতে দিবি না? আরুশ বাবা যা তো ফ্রেশহয়ে আয়। আমরা তোর জন্য খাবার বাড়ছি।
আরুশ–বাবা-মা কি রুমে আছেন?
রুহি–হুম। যা ঐখানে গিয়ে নিজের প্রত্যাশা পূরণ কর। কান্নাকাটি দেখে যদি তোর মন গলে!
আরুশ চুপিচুপি দোতলায় নিজের মা-বাবার রুমে গেল।
রুহি বলল, এ বছর সব কত ভালো ভালো ঘটছে তাই না ভাবী? বড় আপু এসেছিল, ছোট ভাইয়াও এসেছে সামনে কারিয়ানও আসবে। আহা সব মিলে বছরটা একদম সোনায়সোহাগা।।
রেবা টিপ্পনী কেটে বলল, কারিয়ান ভাইয়া আসবে বলে সোনায়সোহাগা? এই চলছে ননদীনির মনে হুম?
ইশশ ভাবী তুমিও না।
আমিও না কি হুম? দেখছি তো যবে থেকে তাদের আসার ডেট ফিক্সড হয়েছে তুমি আর এই পৃথিবীতে নেই, উড়ে উড়ে মহাকাশে চলে গেছ!
রুহি লাল হয়ে বলল, তা না। আসলে,
হয়েছে ভাই আর অজুহাত দিও না। আমায় মিথ্যে বলতে হবেনা। তুমি যে ওর উপর লাড্ডু আমি ভালোই জানি।
এই ভাবী একটা সত্যি কথা বলবে?
কি?
আঙ্কেলদের পক্ষ থেকে কি গ্রিন সাইন দিয়েছে? আই মিন কারিয়ানের মত আছে কি না কিছু বলেছে?
গ্রিন সাইন না দিলে কি বাড়িতে বিয়ের তোড়জোর পড়তো?
এটা তো পারিবারিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আসল খবর কি?
কারিয়ানকে জিজ্ঞাসা করো?
সে তো আমায় পাত্তাই দেয় না ভাবী! আমিও বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে পারছিনা পরে যদি ভাবে তাকে বিয়ে করার জন্য মুখিয়ে আছি?
সেটাও ঠিক!
ভাইয়াকে বলো না খোঁজ নিতে।
আচ্ছা বলবো।
থ্যাঙ্ক ইউ ভাবী।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
।
।
রেবা বেলকনীতে রাখা গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিল আর আপনমনে তাদের সাথে গল্প করছিল। এমন সময় আরাফ এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। রেবা হেসে বলল, আজ হঠাৎ এ সময়ে ফিরলেন?
আরুশ ফিরেছে খবরটা পেয়ে চলে এসেছি। ওর তো ভরসা নেই দেখা যাবে এসে টুকটাক কথা বলেই ফুড়ুৎ!
তাই নাকি? উনি সবসময় এমন করেন?
হুম। ওর ভাষ্যমতে হোমসিকনেস খুব খারাপ একটা রোগ। তাই ও মায়া বাড়ায় না। পিছুটান রাখেনা। পিছুটান রাখলে বিশ্বভ্রমণ অসম্ভব!
দার্শনিক চিন্তাভাবনা! আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল,
করেন?
রুহির বিয়ের ব্যাপারে আর কি! শুনেছি কবির আঙ্কেল বাবার অনেক ক্লোজ ফ্রেন্ড, সেই সুবাদেই কারিয়ানের সঙ্গে রুহির বিয়ের আলাপচারিতা চলছে।
হ্যাঁ এটা একটা ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। সরাসরি ফয়সালা এখনো না হলেও দুইপক্ষই এটা ভেবে রেখেছে।
কারিয়ানের মনোভাব কি এই বিষয়ে? জানেন কিছু?
কারিয়ান ছোট থেকেই বর্ণচোরা, তবে রুহির বিষয়ে ওর মনে কি চলছে খোলাসা না করলেও নিষেধও করেনি।
ওহ।
ডোন্ট ওরি! যা হবে ভালোই হবে।
চিন্তা না করে পারছিনা আসলে। রুহি খুব আগ্রহী হয়ে অপেক্ষা করছে, ওর চোখেমুখে আনন্দ ঠিকরে পড়ছে। আমি চাই না পরিবারের হাই এক্সপেক্টশনে ভাঁটা পড়ুক। কারিয়ানের মতামত জানাটা আবশ্যক।
আরাফ চিন্তিত মুখে বলল, ও কি রুহির সাথে কনট্যাক্ট করেনা?
না!
রুহি নক করে?
বলল তো করে,, বাট রেসপন্স পায়না। তাই তো আমায় বললো আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে।
আরাফ বলল, আচ্ছা আমি দেখছি!
চলবে,,,,
#তরঙ্গিনী পর্ব-৩২
#আরশিয়া_জান্নাত
আরুশ ফ্লোরে শুয়ে বেডের উপর দুই পা তুলে মনের সুখে গলা ছেড়ে গান গাইছে। গানের গলা ওর বিশেষ ভালো না হলেও গান গাইতে তার অস্বস্তি নেই। কে কি বলল তাতে সে থোরাই কেয়ার করে। সে চলছে তার নিজের ইচ্ছেমতো এলোমেলো গতিতে। বাহ্যিকভাবে তাকে দেখলে বা তার সম্পর্কে জানলে যে কারোই মনে হবে বড়লোক বাপের অকর্মা সন্তান। কেননা একটা মানুষ তার জীবনটাকে ছকে বেধে এগোয়। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, বিয়ে, বাচ্চা ইত্যাদি নিয়েই জীবন। যারা এই নিয়মের বাইরে জীবনযাপন করে তাদের নামকরণ হয় বাউন্ডুলে, ভবঘুরে বা ছন্নছড়া!
আরুশ অনেক জেলার মানুষের সাথে মিশেছে, আঞ্চলিক জীবনধারা জেনেছে। প্রকৃতির কাছ থেকে যতটুকু আনন্দ আহরণ করা যায় তাই করারা চেষ্টায় আছে। ওর মতে পৃথিবীতে শুধু বেঁচে থাকার জীবনোপকরণ পুঁজি করা আর খরচ করাই মানুষের আসল কাজ না। যদি এটাই আসল কাজ হতো সৃষ্টিকর্তা এতো সুন্দর করে পৃথিবীটা সাজাতেন না। শুধু খাদ্যশস্য আর বাঁচার মতো আশ্রয় দিয়েই দায়সারা হতেন।
বাসায় আসলে আরুশের বেশিদিন মন টিকে না। ও ভয়ে থাকে এই বুঝি মন বসে গেল মায়ায় আটকে! মানুষের মন অনেক সাংঘাতিক। যতোই ট্রেনিং দিয়ে শক্ত করা হোক না কেন আপনজনদের কাছে এলে সব গলে যায়। তাইতো সে সহজে আসেনা। এই যে এবার এসে দেখলো তার বাবা অনেকটা নরম হয়ে এসেছেন,মায়ের কালো চুলে পাক ধরেছে। তার শক্তপোক্ত চাচা-চাচীরাও বয়সের সাথে সাথে বদলাচ্ছেন। এসব দেখে ওর মন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। এই ছোট্ট জীবনটা সে ঘুরেফিরে পার করছে ঠিকই কিন্তু এই আপন মানুষগুলোর সান্নিধ্যও তো হারাচ্ছে। একটা সময় পর যখন সে ঘরে ফিরবে দেখবে ওরা কেউ নেই, কেমন লাগবে সেদিন? মানুষ তো চিরকাল থাকবেনা!
নাহ নাহ বেশি ভাবছে ও, এখনো অনেক দেরী। এতো তাড়াতাড়ি ওরা হারাবেনা, আরো অনেক বছর সবাই বেঁচে থাকুক।
ছোট ভাইয়া?
কি বলবি বলে ফেল
তোর বেসুরা গলার গান থামালে তো বলতাম!
দেখ রুহি গান হচ্ছে মনোরঞ্জনের একটা মাধ্যম। আমি আমার মনোরঞ্জন করছি ইচ্ছামতো গেয়ে। এখানে তুই বাধা দিতে পারিস না। আমাদের সবারই ইচ্ছেমতো কথা বলার,গান গাওয়ার, নাচার, হেহে হোহো করার অধিকার আছে!
ও মা রে মা! আমার ভুল হইয়া গেছে আমারে মাফ কইরা দেন।
পা ধরে চা তাহলে দিবো।
এহহ!
এহহ না হ্যাঁ। কেন আসছোস আমার রুমে? কাজ কি?
দেখতে আসছি কি হালে আছে,, কত দিন পর এই রুমের মালিক আসছে, তোর ঘরের পেত্নিটাও বোধহয় তোর শোকে শোকে মরে গেছে!
নাহ মরে নাই, ও আরে ভালোভাবে আশ্রয় গড়ে তুলেছে। খালিঘর পেয়ে জামাই নিয়ে এসে থাকছে!
ধুর ভাইয়া কি বলোস।
ফান করছি না সত্যিই বলছি। বিশ্বাস না হলে পিছু ফিরে দেখ বাচ্চা দুইটা কোলে নিয়ে কিভাবে তোর দিকে তাকিয়ে আছে,,
ভাইয়া,,, ভয় দেখাইস না তো।
ভয় না সত্যি। আর শোন আমি না থাকলে এই ঘরে এসে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদবিনা ওদের ডিস্টার্ব হয়। আমি ঘরে ঢুকতেই তোর নামে নালিশ দিলো। বললো এবার যাওয়ার সময় যেন ঘরের তালার চাবিটা নিয়ে যাই।
তুই অনেক নিষ্ঠুর ভাইয়া! কোথায় তুই অবাক হয়ে বলবি এতোদিন পর না বলে এসেও ঘরটা চকচকে পেয়ে খুশি হয়েছিস। তা না ভুত পেত্নি নিয়ে পড়েছিস।
আরুশ উঠে বসলো। রুহির দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলল, শোন রুহি। তুই ছোট থেকেই বেশি আবেগপ্রবণ। বাসায় যারা থাকে তাদের প্রতি যেমন তোর অনেক মায়া, যে থাকে না তার বেলা আরো দ্বিগুণ! আমি নেটওয়ার্কে বাইরে থাকলেও তোর ১০১টা মেসেজ দিতে হয়। তোর ঐসব মেসেজের তোপে আমি ডাটা অন করতেই ফোন হ্যাং হয়ে যায়। আমার তখন কি ইচ্ছে করে জানিস? হেলিকপ্টার ভাড়া করে আধ ঘন্টার মধ্যে ঢাকায় এসে তোকে কষে দুটোচড় মেরে ফেরত যাই!
নেক্সটবার থেকে চড় মারার জন্য হলেও চলে আসিস।
জানতাম তোর উত্তর এমনটাই হবে। তোর জন্য আমি অনেককিছু জমিয়েছি। ঐ ব্যাগটা তোর।
রুহি ফ্লোরে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল, ছোট ভাইয়া, আগামীবার এলে হয়তো আমায় দেখবি না। তখন কি করবি?
তোর শ্বশুড়বাড়ি যাবো, সমস্যা কি?
আমার বিয়ে দেখে যাবি না?
বলতে পারছিনা, কিছু ভাবিনি এখনো। তবে রুহি একটা কথা বলতো
কি?
কারিয়ানকে তোর বিয়ে করতে হচ্ছে কেন? দেশে কি ছেলের অভাব আছে?
তোর কি ওকে পছন্দ নয়?
পছন্দ অপছন্দ না আসলে, বন্ধুত্ব হচ্ছে মনঃস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক। এর মাত্রা কোনোকিছু দিয়ে পরিমাপ করা যায়না। কিন্তু ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখানে নতুন আরেকটা লেয়ার লাগানো আমার কাছে অহেতুক মনে হয়। এটা করে সম্পর্কের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়। যেমন ধর যেকোনো সমস্যা বাবা কবির আঙ্কেলকে শেয়ার করতে পারছেন, মেয়ের শ্বশুড়কে তা করতে পারবেন? এরকম আরো অনেককিছু আছে যা আসলে সম্পর্কের প্যাঁচে পড়ে ভিন্ন হয়ে যাবে। জানিনা সবাই কি ভাবে, এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত আর কি!
তবে তুই কি বলিস বিয়েটা না হোক?
আমি বলার কে? আর এখন সব কথাবার্তা এগিয়ে গেছে না বলার পথ নেই।
ভাইয়া এখনো সব হয়নি, তুই বললে আমি না করে দিবো।
আমার ধারণা বিয়েটা হবেনা। তুই হ্যাঁ বললেও হবেনা। আর সেজন্যই আমি তোকে এর খারাপ দিক বলে আগে থেকে কনভিন্স করছি, যাতে তুই হার্ট না হস। মনে রাখিস- Nothing can hurts us except our own expectations!
So, be careful!
রুহি মাথা নীচু করে চোখ মুছল,,,,
।
।
আরাফ ছুটির দিনে শান্তিতে বেলা অবধি ঘুমাচ্ছে। রেবা তাকে কয়েকবার ডেকে গেলেও বিশেষ পাত্তা দিলোনা। বরং কোল বালিশ জড়িয়ে আরো গভীর ঘুমে ডুব দিলো।
এ কি আরাফ আপনি জুমাবারে ১২টা অবধি ঘুমাচ্ছেন? নামাযে যাবেন না? উঠুন,,
আহ রেবা সবদিন তো ঘুমাই না। আজ একটু ঘুমাতে দিন না,,
অনেক ঘুমিয়েছেন আর না। উঠুন। উঠে হাত পায়ের নখ কেটে, গোসলে যান।
আপনি কেটে দেন, আমি ততক্ষণে আরেকটু ঘুমাই।
আপনি না শুক্রবারে একদম অলস হয়ে যান।
রেবা নেইল কাটার এনে ওর নখ কাটতে লাগলো। আরাফ হেসে বলল, আমার দোষ নেই রেবা, আপনিই আমাকে যত্ন করে করে অলস বানিয়েছেন।
হুহ খাটবোও আমি দোষও হবে আমার! ভালো তো ভালো না?
এই রেবা,
হু?
এভাবে নাক ফুলিয়ে রাখবেন?
কই ফুলিয়েছি?
ঐ যে?
আপনার চোখে সমস্যা।
উহু, আপনার নাক সত্যিই ফুলেছে,,
ধুরর না।
সত্যিই
ইইইইই মেজাজ গরম করে দিচ্ছেন!
হাহাহাহা এই তো ফুলকো লুচি ফুলেছে। রাগলে আপনাকে যা লাগে না! ইচ্ছে করে একদম,,,
রেবা রেগে ওর হাতে জোরে কামড় বসিয়ে দিলো।
আরাফ হেসে বলল, খুব চালাক না? আমার ইচ্ছে শুনবার আগেই কামড়ে দিলেন?
বললেন না রাগলে সেই লাগে? নিন এটা “সেই লাগার” উপহার।
আরাফ হাতের দিকে চেয়ে বলল, আপনি দেখি হাতে ঘড়ি এঁকে দিলেন, এটা আরো বেশি সুন্দর! এতো সুন্দর উপহার পেয়ে বিনিময় না দেওয়া অন্যায় হবে তাই না?
রেবা একছুটে পালিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, গিফটের বিনিময় আমি নেই না। ঐটা আপনি রেখে দিন।
এই রেবা শুনে যান, এখন না হলেও পরে আমি ঠিকই শোধ দিবো। আরাফ চৌধুরী ঋণী থাকেনা। কতক্ষণ পালিয়ে বাঁচবেন দেখবো তো,,,
🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸
দেখেন ভাবী কিছু মনে করবেন না, আমরা তো পর নই। কাছের ভেবেই বলছি, মেয়েদের বয়স বেড়ে গেলে প্রেগ্ন্যান্সীতে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়। বিয়ের বছর তো গড়িয়ে গেছে ওরা এখনো বাচ্চা নিচ্ছেনা কেন? আপনি শাশুড়ি হিসেবে ছেলের বৌকে এই বিষয়ে বলতেই পারেন, দোষের তো কিছু নেই।
ওদের সময় হলে ওরা নিবে। আমি আলাদা চাপ দিতে চাই নাহ,,
আপনিও না বুঝতেই চাইছেন না। আপনাদের এখন নাতী নাতনী নিয়ে খেলা করার বয়স, শক্তপোক্ত থাকা অবস্থায় ওদের যেভাবে বড় করতে পারবেন, বয়স বাড়লে কি তা পারবেন? ওদেরকে বলেন, না হলে ডাক্তার দেখাতে বলেন। এখন তো রোগের শেষ নাই। অল্পতে ট্রিটমেন্ট করলে অনেকসময় ঠিক হয়ে যায়,,
আপনি এসব কি যা তা বলছেন ভাবী? ওরকম কিছুই না। দোআ করবেন ওদের জন্য, এসব আজেবাজে কথা বলার মানে হয় না।
যাহ বাবা ভালো কথার দাম নেই। রেগে যাচ্ছেন কেন? কত বছর ধরে আপনার সাথে চেনা পরিচয়, আপন ভেবেই তো বললাম। থাক ভাই মাফ করে দেন। আর বলবোনা।
রেহানা চুপচাপ বসে রইলো। মুখে যাই বলুক ভেতরে একটা দাগ ঠিকই কেটে যায়। কথাটা তো ভুল নয়, সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট বয়স আছে। তাছাড়া এখন কত নতুন নতুন সমস্যা বেরিয়েছে। বাচ্চা হওয়াও কঠিন সাধনা! তবে কি রেবা কে একবার বলে দেখবে এই বিষয়ে?
ও আবার কিছু মনে করে যদি!
আজ বহুদিন পর দুই ছেলের সঙ্গে জুম্মার নামায আদায় করে আরাফের বাবা ইফতেখার চৌধুরীর মন ভীষণ ভালো। তিনি ফেরার পথে পারিবারিক কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করে ফিরলেন। গাড়িতে বসে দুই ছেলেকে অনেক কথাই বললেন। আনন্দ তার চোখমুখ ঠিকরে পড়ছে যেন।
তোদের মনে আছে তোরা যখন ছোট ছিলি আমার দু হাতের দু’আঙুল ধরে মসজিদে আসতি। শুক্রবারে তোদের মধ্যে সবসময় তাড়া
থাকতো। অন্য বাচ্চারা শুক্রবারে সবকিছু দেরীতে করলেও তোরা গোসল করে পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে তৈরী হয়ে থাকতি আমার সাথে আসার জন্য! সময় কত দ্রুত চলে গেল, অথচ মনে হয় এই তো সেদিন তোরা জন্মালি!!
আরুশ বললো, ড্রাইভার সাহেব গাড়ি থামান,
আরাফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আরুশের দিকে। আরুশ বলল, বাবা ছোটবেলা যখন ফিরে এসেছেই, তাহলে আইসক্রিমটাও কিনে দাও। আমি কিন্তু চকবার খাবো,,
ইফতেখার সাহেব হোহো করে হেসে উঠলেন, বাপ বেটা মিলে বহুবছর পর আইসক্রিম খেতে লাগলো।
উহ বয়স হলে দাঁতে যে কেন জোর থাকে না, খালি শিরশির করে,,,
চলবে,,,,