#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_৫
#মুমতাহিনা_তারিন
নাম মালতী সুন্দর লম্বাটে মুখ, আচার ব্যবহার মার্জিত এই সুন্দর মধ্যবয়স্ক মহিলার সামনে বসে আছে তুলি। উদ্দেশ্য একটা ছোটো ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া। শাপলা বেগম তুলির পাশে বসে আছেন ।মালতী তুলির পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরোখ করে কিছুটা হাসলেন ।
” মা কিসে পড়?”
মালতী বেগমের প্রশ্ন শুনে একটু অপ্রস্তুত হলো তুলি । তুলিকে কিছু না বলতে দিয়েই শাপলা বেগম নিজে থেকে সব বলা শুরু করলেন ।
” আপা আমার মেয়ে ইন্টার পাশ করেছে। তারপর আর পড়া হয়নি । আমরা যেহেতু এখানে থাকতে এসেছি আপনার কাছে কিছু লুকাবো না । ”
ছল ছল নয়নে সব কিছুই বললো শাপলা বেগম। মালতী বেগম সব শুনে আশ্চর্য হলেন । এইটুকু একটা মেয়ের জীবনের সমীকরণ এতো জটিল!! মুখ দিয়ে কিছু সান্তনা সুর তুললেন । তার সাথে সাথে নিজের স্বামীর সাথে তাদের থাকার বিষয়টা আলাপ করে জানাবে বললেন । যতই হোক কোনো মানুষের মুখের কথায় তো আর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যায় না ।
আজকে ঘুরে ঘুরে তিনটে ফ্ল্যাট দেখেছে তুলি এর শাপলা বেগম । সব কয়টা দেখার শেষে মালতী বেগমের ঠিক করা ঘরটা দেখে দুজনের খুব পছন্দ হয়েছে । তিনটে ঘর একটা ফ্ল্যাটে দুটো ঘর ভাড়া দেওয়া ,,একটা ঘর বাকি আছে, এমন শেয়ার করা ফ্ল্যাটে থাকলে তুলির জন্য সুবিধা । শাপলা বেগম মহিলা মানুষ যদি কোনো সমস্যা হয় সাথে সাথে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না । পাশের ঘরে থাকা দুই পরিবারের কাছ থেকে সহজেই সাহায্য পাবে আশা করা যায় । তার সাথে সাথে আবার ঘর ভাড়াও কম ।
সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে তুলির অবস্থা খারাপ । প্রথম দিকে বমি না হলেও এখন বমি হয় অনেক তার উপর মাথা ব্যাথা পায় ব্যাথা তো আছেই । তুলির বার বার বমি করা দেখে রিনার বড্ড সন্দেহ হচ্ছে।
” আম্মা তুলির বার বার বমি হচ্ছে ওকে তো ডাক্তার দেখাতে হবে”
রিনার কথার উত্তর না দিয়ে শাপলা বেগম কৌশলে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো। আপাতত রিনার মুখটা বন্ধ রাখতে হবে নইলে গ্রামের মানুষ তুলির উপর চড়াও হবে। মেয়ের সম্পর্ককে কেউ খারাপ কথা বলুক শাপলা সেটা চায়না। নিজের মেয়ের চরিত্র সম্পর্কে ভালো ভাবেই অবগত শাপলা ।
তুলির অবস্থা অনেক খারাপ হাজার চেষ্টা করেও আদনানের কথা ভুলতে পারছে না । চোখের নিচে কালি পড়ে যাচ্ছে ঘুম হয় না ঠিক ভাবে । মাঝে মাঝে মনে হয় কোথাও চলে যায় যেখানে গিয়ে মন খুলে কান্নাকাটি করতে পারবে । শাপলা বেগমের সামনে কান্না আটকিয়ে রাখে নইলে নিজের মেয়ের এই অবস্থা মানতে পারবে না সে । নিজেকে দোষ দেবে । অরোরা কেনো এমন করলো! ও তো অরোরাকে নিজের বড় বোনের মতোই দেখতো তারপরেও এমন বিশ্বাসঘাতকতা কেনো করলো!! উত্তর আসে না নিজের অবচেতন মন আদনানের কাছে চলে যেতে চায় একটু তার ভালোবাসা পেতে চায় কিন্তু কে জানে আদনান ও ওকে অবিশ্বাস করে কিনা ।
_____________________
আদনানের মাথাটা ভার হয়ে আছে । মনে হয় জ্বর আসবে কালকে গোসল করে চুল না মুছেই ঘুমিয়ে পড়েছিল । আগেও চুল না মুছেই ঘুমাতো আদনান কিন্তু তখন তুলি ছিল না তাই শরীরটা অবস্থ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু তুলি আসার পর কোনোদিন চুল না মুছে ঘুমাতে পারেনি । প্রতিদিন রাতে চুপি চুপি এসে চুল মুছে দিয়ে যেত তুলি । আদনান বুঝতে পারতো কিন্তু কিছু বলত না ।
আজকে আর অফিস যেতে মন চাচ্ছে না । ম্যানেজারকে কল দিয়ে নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে দিয়েছে আদনান । কিন্তু সারাটা দিন বসে থেকেও কাটানো সম্ভব না তাই অরোরা কে কল দিল অনেক কিছুই জানতে হবে আদনানের ।
একটা বেঞ্চে বসে আছে অরোরা আর আদনান । সামনে বিস্তৃত মাঠ জুড়ে ছোট ছোট ঘাস । মাথার উপরে আছে বড়ো একটা বকুল ফুলের গাছ । বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভরে গেছে চারপাশ । সেদিকে খেয়াল নেই আদনানের তার স্থির দৃষ্টি নিচের দিকে । একটা পিপড়ে পড়ে থাকা সাদা বকুল ফুলের চারপাশ দিয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে । নিচের দিকে তাঁকিয়ে অরোরার উদ্দেশে প্রশ্ন করলো আদনান –
” তুই তুলির সাথে এমনটা কেনো করলি?”
” তুই তো নিজেই বলেছিলি আদনান! আমি যা করেছি সব তোর জন্যই করেছি”
“আমি কখন বলছি আর তুই কখন করেছিস!আর আমি যদি বলেও থাকি তাও তুই তুলির সাথে এমনটা কিভাবে করতে পারলি! বাড়ি ভরা মানুষজনের সামনে ওকে দুশ্চরিত্রা বানিয়ে দিলি। যখন সবাই ওর সম্পর্কে খারাপ খারাপ কথা বলছে আমার নিজেকে অপরাধী লাগছে আমি সেইদিন রাগের বশে সব বলেছিলাম তোকে আর তুই কি করে ফেললি ”
” শান্ত হ যা হয়েছে ভুলে যা । খারাপ লাগাটা বেশিদিন থাকবে না দেখিস দুই বছর ওকে চোখের সামনে দেখছিস এজন্য এমন খারাপ লাগছে । মায়া পরে গেছে ওর উপর ধীরে ধীরে মায়া কেটে যাবে ”
” তুই বুঝতে পারছিস না অরু আমার সবসময় অস্থির অস্থির লাগে ।যেখানে দেখি সেখানেই তুলির স্মৃতি,,আমি জানি না এটা অপরাধ বোধ নাকি অন্য কিছু কিন্তু আমি থাকতে পারছি না । মনে হচ্ছে ওকে আমার একটা বার দেখতে হবে না দেখলে আমি হয়তো বাঁচবো না । মেয়েটা যখন সারাদিন আগে পিছে ঘুরত তখন শান্তি লাগতো না এখন নেই এখনো শান্তি লাগছে না । আমার সব শান্তি নিয়ে চলে গেছে এই মেয়ে!”
আদনানের ব্যাবহারে খুব বেশি অবাক হল অরোরা। মনে অজানা একটা ভয় সৃষ্টি হলো আদনানের কথায়। আদনানের মাথাটা নিজের কাধে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো ।
” সব ঠিক হয়ে যাবে আদনান ”
_________________
‘শিউলি তুমি বুঝতে পারছো তুমি কি করছো!!!”
রোহানের চিৎকারে শিউলী হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। রোহান আর শিউলী সকালের ব্রেকফাস্ট করছিল । কিছুদিন যাবত শিউলিকে অন্যমনস্ক থাকতে লক্ষ করেছে রোহান কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করেনি । আজকে কথায় কথায় তুলির কথা উঠলো ।রোহান গত কালের ঘটনা শিউলিকে খেতে খেতে বলছিলো । আদনানের কালকের ব্যাবহারে অনেক পরিবর্তন দেখে কেমন খটকা লেগেছিল রোহানের ।এই সম্পর্কে শিউলি কিছু জানে কিনা তাই জিজ্ঞাসা করলো রোহান । অনেক ইনিয়ে বিনিয়ে সব বলতেই রোহান এমন রিয়েক্ট করলো।
” আমি সরি রোহান । আমি আসলেই বুঝতে পারিনি এতো কিছু হয়ে যাবে । আমি আমার বন্ধুত্ব রক্ষার্থে এই কাজটা করে ফেলেছি ”
শিউলির কথাই রোহান কি বলবে! ও হতভম্ব হয়ে গেছে মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে । আর শিউলী সেই পাপ কাজে সঙ্গ দিয়েছে। ওর ভাবলেও শরীরে কাটা দিচ্ছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ভালো মানুষের মুখেশের আড়ালেও কত কুৎসিত চেহারা লুকিয়ে থাকতে পারে!
” তুমি ভুল করো নি শিউলী তুমি পাপ করেছো অপরাধ করেছো। তুমি একবারও কি ভাবনি তুলির অবস্থা সম্পর্কে! ওদের পারিবারিক অবস্থা তো জানতে তুমি! মানুষের সামনে একজন ভালো মেয়েকে এইভাবে অপমানিত হতে হলো! আর ওর বাচ্চাকে তুমি বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করলে । যদি এই চিন্তা ভয় থেকে তুলি কোনো ভুল পদক্ষেপ নেই নিজেকে মাফ করতে পারবে?”
” আমি বুঝতে পারিনি বিশ্বাস কর ,,অরোরা এমন কিছু করবে সত্যি বুঝতে পারিনি ”
” আদনানকে আগে থেকে কিছু বলা যাবে না । আগে তুলিকে খুজে বের করতে হবে ”
শিউলির কোনো কথা না শুনেই রোহান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো । শূন্য দৃষ্টি মেলে সেদিকে চেয়ে রইল শিউলি,,,
চলবে ,,,,,