#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_৯
#মুমতাহিনা_তারিন
আদনান এর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে । বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আর যাই হোক নিজের সন্তান রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করা আদনানের পক্ষে সম্ভব না । নিজেই তো প্রায় বাবা ছাড়া মানুষ,, সবসময় সিরাজ সাহেব নিজের ব্যাবসায়িক কাজে ব্যাস্ত থাকতেন নিজের সন্তানদের প্রতি বিন্দু মাত্র আগ্রহ দেখাতেন না আর এখন ও তাই ,,,। তারা বেচেঁ আছে নাকি মরে গেছে এইটুকুই শুধু খোঁজ রাখে এতেই কি বাবার দায়িত্ব শেষ? নাকি মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করে! নিজের সন্তান বাবা ছাড়া মানুষ হোক সেটা আদনান কোনোভাবেই চাইবে না যাতে যা হওয়ার হবে । আর তুলি? তুলিকে যে ও ভালোবাসে সেটা বুঝে গেছে আদনান আর কোনো জড়তা নেই ওর মধ্যে । আর অরোরা কে ও নিজের ফ্রেন্ড ছাড়া অন্য নজরে কোনোদিন দেখি নি তাই এই বিয়েটা এক প্রকার বোঝা ছিল তার কাছে।
বসার ঘরের সোফায় বসে ছিল আদনান আর চারপাশে অরোরা সহ বাড়ির সকল ব্যাক্তি উপস্থিত আর আদনান আদরী আর মালেক কে কল দিয়ে আসতে বলে দিয়েছিল তারাও চুপ চাপ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ।সব নিরবতা ভেঙে লিতুন বেগম গলায় জোর এনে বলে উঠলেন –
” কার না কার বাচ্চা তোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে তার কি কোনো ঠিক আছে !? আর তুই ও তাই বিশ্বাস করছিস!”
” আম্মা ওটা আমার বাচ্চা”
আদনান এর এমন কথা শুনে আদরী বিস্ফোরিত চোখে আদনানের দিকে তাকালো । কণ্ঠে সর্বোচ্চ জোর দিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠলো –
“তুই কি পাগল হলি!! শেষমেশ দুশ্চ”*রিত্র একটা মেয়ের অবৈধ সন্তান কে নিজের বলছিস! এটা কি কোনো নাটক হচ্ছে আমি ভাবতে পারছি না ”
” আমার সন্তান সে,, অবৈধ না আমি আজকে এইখানে সবাইকে ডেকেছি কারণ আমি অরোরা কে বিয়ে করতে পারবো না। আমার পক্ষে সম্ভব না আমি তুলিকে ভালোবেসে ফেলেছি আর আমি ওর সাথেই থাকবো সারাজীবন। বুঝতে দেরি হলেও বুঝতে পেরেছি আমি ”
আদনানের শেষের কথা শুনে অরোরা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না । মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো তার,,,চোখের সামনে সব কেমন আবছা হয়ে আসতে লাগলো । চোখের পাতা বন্ধ হওয়ার আগে আদনানের দিকে এক আকাশ সমান শূন্যতা নিয়ে তাকালো । এইটাই যখন হওয়ার ছিল তখন কেনো এত জমকালো আয়োজন? ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো অরোরার ছিমছিমে শরীরটা।
________________________
” রোহান আমি কি করবো বল ! তুলি এতো বড়ো একটা কথা কিভাবে লুকাতে পারলো!!”
আদনান করুন কণ্ঠে বলে উঠলো । আদনান এর এরূপ কথাতে তাচ্ছিল্য হাসলো রোহান ,,,,,
” বললেও বা কি করতিস?যখন তুলিকে সবাই চরিত্রহীন বলে যা নয় তাই বলছিলো তখন কই ছিল তোর এই ভালোবাসা? নাকি বাচ্চার জন্য এই ভালোবাসাটা উদয় হয়েছে?”
” এমন কিভাবে বলতে পারছিস তুই? হয়তো আমার বুঝতে দেরি হয়েছে কিন্তু আমি তো বুঝতে পেরেছি। যখন কেউ তুলির উপর আঙ্গুল তোলে আল্লাহর কসম আমার অন্তর ভেঙে চুরমার হয়ে যায় । নিজেকে সব থেকে নিকৃষ্ট স্বামী বলে মনে হয় আমার নিজেকে । আচ্ছা আমি যদি ওকে ফিরিয়ে আনতে চায় তুলি কি আসবে?”
” আমি কিভাবে বলবো বল? কিন্তু একটা আত্ব মর্যাদা সম্পন্ন মেয়ে কখনোই ফিরবে না এইটুকু বলতে পারি ”
রোহান কথাটা বলেই উঠে গেলো । বর্তমানে ওর মন মেজাজ ভালো থাকে না তুলির সাথে এতো অন্যায় হাওয়া সত্বেও রোহান কিছুই করতে পারলো না । কেনো না নিজের প্রিয় স্ত্রী এতো বড়ো ঘটনায় অন্যতম দোষী ব্যাক্তি । নিজের স্ত্রী কে রক্ষা করা প্রত্যেক স্বামীর দায়িত্ব । কিন্তু তাঁর অন্যায় অপরাধেও কি তাকে নিরাপত্তা দেওয়া যায়?? জানা নেই রোহানের,,,,
_______________________
আয়নায় নিজের বেড়ে উঠা পেট নিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তুলি । কেমন অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে । গ্রামের এক ভাবি যখন গর্ভবতী হয়েছিল তার স্বামী কতটা যত্ন করত । সকাল ভোরে নামাজ পরে দুইজন পুকুর পাড়ে এসে গল্পঃ করতো আর সূর্যোদয় দেখতো । তুলি নামাযের জন্য অজু করতে গিয়ে হরহামেশাই এই দৃশ্যটা উপভোগ করত । নিজের অজান্তেই আশা করতো সে যখন গর্ভবতী হবে নিশ্চয় তার স্বামীও তাকে এমন আদর যত্ন করবে । কিন্তু আল্লাহর লেখা ছিল ভিন্ন ,,,,আজকে একা একাই নিজের সন্তানের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে তুলি ।
যে বিল্ডিংয়ে তুলিরা থাকছে তার দুই বিল্ডিং পরেই একটা আর্কিটেক্টচারের অফিস । ঐখানে একটা ছোটো পদে চাকরি করে নিলয় । গোলগাল চেহারার অধিকারী চোঁখ দুটো গাঢ় কালো বর্ণের । প্রতিদিন এই অফিস পার করেই তুলিকে স্কুলে যেতে হয় আর নিলয় সেটা পর্যবেক্ষণ করে । এতদিন সে খোঁজ খবর নিয়ে তুলির বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে পেরেছে । কেনো এমন খোঁজ খবর নেয় নয় সেটা নিজেই জানে না কিন্তু ভালো লাগে । যেই বাসায় সে থাকে সেইখান থেকে অফিস অনেক দূর হয়ে যায় তাই আজকে সে মালতী বেগমের কাছে দেখা করতে এসেছে ।
” তো তুমি তো ব্যাচেলর ,,, ব্যাচেলরদের তো ঘর ভাড়া দেওয়া হয়না বাবা ”
” আসলে আণ্টি আমার অফিস এইখানে কিন্তু অনেক দূর থেকে আসতে হয় । একটু যদি দেখতেন ”
মুখে অসহায়ত্ব ভাব নিয়ে বললো নিলয় । যদিও মালতীর এমন ব্যাচেলর ছেলেদের ঘর ভাড়া দেওয়ার নিয়ম নেই । তখন আবার খুলনা থেকে মালতীর ছেলে কল দিল তাকে । ঝটপট কল ধরে একটু দূরে দাড়ালো –
” আম্মু নিলয় আমাদের সাথে পড়ত ,, ও ভালো ছেলে তুমি ওকে একটা থাকার ব্যাবস্থা করে দাও । পারিবারিক চাপে আর পড়া হয়নি ওর ”
” তোর বাবার সাথে কথা বলে দেখি । নিজে একা একা কি সিদ্ধান্ত নেবো? ”
” হ্যা দরকার হলে ওর সম্পর্কে আশেপাশে খোঁজ নিও তবু একটা কিছু ব্যাবস্থা করে দিয়ো । কলেজে থাকতে অনেক হেল্প করেছে আমাকে ও ”
” আমি দেখছি বিষয়টা এখন রাখি ”
” আল্লাহ্ হাফেজ”
নিজের স্বামীর সাথে কথা বলে জানাবেন বলে জানালো মালতী বেগম । নিচতলায় থাকেন মালতী বেগম সামনাসামনি যে ঘরটা সেটা তুলির । গর্ভাবস্থায় সিড়ি দিয়ে হাঁটাচলা করতে অনেক অসুবিধা হয় সেইসব মাথায় রেখে নিচের ঘরটা ওদের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন মালতী । আর নিজের ও সুবিধা এক জায়গায় হওয়ায় গল্পঃ করতে যেতে পারবে ।
নিলয় ঘর থেকে বেরোতেই তুলির সাথে দেখা বাইরে যতবার দেখেছে সবসময় বোরকা পরা অবস্থায় । হালকা গোলাপি রঙের ম্যাক্সি ,,আর সাথে লম্বা উড়না গায়ে জড়ানো চেহারায় কি অসীম মায়া । উচু পেটে আরো বেশি কিউট লাগছে একবার সেদিকে তাকিয়ে নিচে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো নিলয় । নইলে তুলি আবার লজ্জায় পড়তে পারে । তার সাথে কোনো কথা না বলেই বাইরে বেরিয়ে গেলো সে।
হঠাৎ কোনো পুরুষ মানুষের সাথে দেখা হওয়ায় একটু থমকে গিয়েছিল তুলি । আজকে বাসায় কুমড়োর ফুল ডিম দিয়ে খুব সুন্দর ভাজি করেছে শাপলা বেগম সেটাই দিতে আসছিল মালতীর কাছে কিন্তু পথিমধ্যেই একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার হতে হলো । কোনো পুরুষের সামনে এমন পরিস্থতিতে কেউ কি পড়তে চাইবে! কি লজ্জা!
_______________________
আজকে শনিবার সরকারি ছুটির দিন । তুলি বাসায় বসে জানালার কাছে কয়েকটা টবে ফুল গাছ লাগাচ্ছে । আর শাপলা বেগম জামা সেলাই করছে । তুলির এইটুকু কাজ করতে গিয়ে তাই অনেক কষ্ট হচ্ছে বর্তমান ছয় মাস চলছে মনে মনে ঠিক করেছে আট মাসে স্কুল থেকে মাতৃকালীন ছুটি নেবে । চার রকমের লিলি গুলো ছোটো ছোটো রঙের বয়েমে লাগিয়েছে । এইগুলো পড়ে ছিল মালতী বেগমের ঘরের এক কোণে । সেইগুলো এনে রং করে সুন্দর ডিজাইন করেছে তুলি তাতেই গাছ লাগাচ্ছে সে।
কলিং বেল বেজে উঠলো সকাল সকাল আবার কে আসলো? আর অ্যান্টি তো আসলে ডাক দেয় তার নাকি কলিং বেল বাজাতে ভালো লাগে না । আর এই ফ্ল্যাটে উঠার এতদিন হলেও কারোর সাথে তেমন ভাবে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি তুলীদের তাহলে আবার কে আসলো । শাপলা বেগম উঠতে চাইলেন কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে জানালার গ্রিল ধরে উঠলো তুলি । ধির পেয়ে এগিয়ে গেলো দরজার কাছে। দরজা খুলে সামনে তাকাতেই চরম অবাক হলো তুলি…
” আপনি এইখানে!!!”