অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী ২ পর্ব-১২+১৩

0
274

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

ব্যাগপত্র গুছিয়ে রামি বিরসমুখে তৈরি হতে গেল। এখনও প্রচুর সময় বাকি। বড়োভাই ঠে*লে*ঠু*লে তাকে সময়ের আগেই পাঠিয়ে দিচ্ছে। দরজায় নক করে ঘরে ঢুকলো মাহমুদ। রামির মুখের দিকে তাকিয়ে অগোচরে হাসলো। বলল,
“আমার সাথে আয়।”

গম্ভীরমুখে জবাব দিলো রামি।
“তৈরি হতে হবে।”

মাহমুদ আবারও আলতো হাসলো।
“এখনও ঢের সময় বাকি। চল আমার সাথে।” এই বলে রামির হাত চেপে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। রামি বাইক চালাতে জানে। তার কাছ থেকেই মাহমুদ আর সাদাদ ভাইয়ার শেখা। রামি চাকরিতে জয়েন করলেও শখের বাইকটা বিক্রি করা হয়নি। ঘুরেফিরে কিছুদিন পরপর সাদাদ আর মাহমুদ বাইকটা নিয়ে ঘুরেফিরে। রামিও বাসায় আসলে মাঝেমধ্যে বাইক নিয়ে বের হয়। বাসা থেকে কিছু দূরে রামিকে বাইকের সামনে দাঁড় করালো মাহমুদ। রামি কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে মাহমুদের দিকে। মাহমুদ বলল,
“অরুকে পাঠাচ্ছি। সময় দু’ঘন্টা। তোকে আবার ফিরতে হবে।”

রামি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অবাক চোখে মাহমুদকে দেখছে। ওর পিঠে আলতো হাতে চাপড় দিয়ে মাহমুদ বলল,
“সময়টা আমিও পার করেছি। বিয়ের দিনই দুজন দুই বাসায়। তবুও আমাদের দেখা করার সুযোগ ছিল।”

রামি কৃতজ্ঞতা থেকে নয়, ভালোবাসা থেকে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। নিজের এই বে*হা*য়া*প*না*য় রামি মোটেও লজ্জিত নয়। প্রেমিকই প্রেমিকের মর্ম বুঝে। তার ভাই শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। সে অন্তত কঠিন প্রেমিক না হলে সম্মান থাকবে না।
দেখতে দেখতেই অরু বাসা থেকে বেরিয়ে এদিকওদিক তাকালো। একটা লং কুর্তি, গলায় ওড়না পেঁচিয়ে বের হলো। মাহমুদ ডেকে পাঠিয়েছে বলে তরী তাকে এদিকে পাঠালো। বাইরে এসেই অরুর চোখ পড়লো রামি আর মাহমুদের উপর। এগিয়ে যেতেই মাহমুদ “বেস্ট অফ লাক” বলে হেসে চলে গেল। রামি বাইকে উঠেই স্টার্ট দিয়ে বলল,
“উঠে বস।”

অরুর কিছুই বোধগম্য হলোনা। মাহমুদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রামি আবারও বলল,
“পেছনে উঠে বস। আমার লেইট হচ্ছে। ”

অরু জিজ্ঞেস করলো,
“উঠবো মানে? কোথায় যাবো?”

“তা তোর জানার প্রয়োজন নেই।” বলে নিজেই অরুর হাত টে*নে বাইকের কাছে নিয়ে আসলো। অরু হাত ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“না বললে যাবো কেন?”
“গেলেই বুঝতে পারবি। ততক্ষণ ধৈর্য ধর।”
উঠে পড়লো অরু। তার মাথায় হাজারও প্রশ্ন কিলবিল করছে। রামি বলল,
“আমাকে ধরে বস।”

অরু রামির কাঁধে হাত রেখে বসতেই রামি মুচকি হাসলো। ইচ্ছে করেই বলল,
“আরও শক্ত করে ধরে বস।”
বলতে না বলতেই কাঁধে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করলো। অরু ঠিকভাবেই বসেছে। শক্ত করে ধরতে বলায় ইচ্ছে করেই নখ ডুবিয়ে দিল রামির কাঁধে। ধমকে উঠলো রামি,
“তোকে বলেছি ধরে বসতে। আমার মাংস তুলতে বলিনি বে*য়া*দ*ব!”

অরু গলায় ধারালো ছু*রি ধরার ভঙ্গিমায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“একদম গলাটা এক*টা*নে আ*লা*দা করে দেব। আমার সাথে কোন ধমকাধমকি চলবে না। আর আজই বিয়ে করার জন্য এত লা*ফি*য়ে*ছে কে?”

রামি বাইক টা*ন দেওয়ার আগেই তার গলায় ফাঁ*সে*র মতো অরুর হাত আটকে রইলো। দ্রুত নেমে গিয়ে ধমকে বলল,
“এই নাম, তুই আমার বাইক থেকে নাম। একটু হলে আমার জান কেঁ*ড়ে নিচ্ছিলি। তুই তো ডাক্তারি করে জীবন বাঁচাবার পরিবর্তে জলজ্যান্ত মানুষকে ফুঁ*তে ফেলবি। বে*য়া*দ*বে*র পাশাপাশি জ*ল্লা*দ ধরে গলায় ঝুলিয়েছি।”
এই বলে বড়োসড়ো দম নিলো রামি।

অরু ফুঁসে উঠে বলল,
“সবার আগে তোমাকেই ফুঁ*তে ফেলবো।”

“তোকে বলেছি আমার বাইক থেকে নামতে। ছিঃ! কেমন নোং*রা করে ফেলেছিস।”

অরু বাইক থেকে নেমে একদলা থুতু ছুঁড়তে গেলেই রামি ঝট করে বাঁধা দিয়ে বলল,
“এই এই তুই আমার বাইকে থুতু ফেলবি না।”

“তুমি বলেছো না আমি তোমার বাইক নোং*রা করেছি! আজ থুতু ফেলেই ছাড়বো, সরো।”

“তুই শুধু একবার থুতু দিয়ে দেখ। আমি যদি ঠা*টি*য়ে দুটো চ*ড় না মে*রে*ছি, তবে আমার নামও রামি না।”

অরু একদলা থুতু ছিটিয়ে পেছন ফিরে ছুট লাগালো। রামি একবার বাইকের দিকে তাকাচ্ছে, একবার অরুর দিকে। ব্যাপারটা বোধগম্য হতে হতেই অরু রাস্তা পেরিয়ে গেইটের ভিতর ঢুকে পড়লো।
অরু চলে যেতেই রামির মনে পড়লো অরুকে নিয়ে তার দুই ঘন্টা সময় কাটানোর কথা ছিল। এরপরই সে একমাসের জন্য চলে যাচ্ছে। অথচ কী থেকে কী হয়ে গেল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে রুমাল দিয়ে বাইক মুছে বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়েই দেখলো অরু গেইটের আড়ালে লুকিয়ে তাকে দেখছে। দুর্বোধ্য হাসলো রামি। দুই কদম পিছিয়ে অরুদের গেইটে পা রাখলো। না দেখার ভান করে খপ করেই অরুর হাত ধরে টে*নে নিয়ে গেল বাইকের কাছে। সাবধান করে বলল,
“চুপচাপ উঠে বস। নয়তো বাইকের চা*কা*র সাথে বেঁধে টা*ন*তে টা*ন*তে নিয়ে যাবো।”

অরুকে বসিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে টা*নে*র সাথে অনেকটা পথ চলে এলো। অরুর ঝুঁটি বাঁধা চুল বাতাসে হেলেদুলে উঠছে। মাঝেমাঝে সামনের গ্লাসে অরুর উপর চোখ রাখছে রামি। প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে দুজন এসে পড়লো একটা বড়ো মাঠে। পাশেই একটা লেক, তার পাশে লাল থোকায় কৃষ্ণচূড়ার বাহার। নরম ঘাসের উপর টকটকে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি স্থানটির সৌন্দর্য আরও দ্বিগুণ করলো। অরু মুগ্ধ চোখে চারদিক দেখলো। কৃষ্ণচূড়া তার ভীষণ পছন্দের। প্রকৃতিতে মুগ্ধ অরুরকে বিভোর হয়ে দেখছে আরেক জোড়া মুগ্ধ দৃষ্টি। অরুর পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়ে ডান হাতটি ছুঁয়ে দিল রামি। ঝট করেই হাত সরিয়ে নিলো অরু। কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। রামি আলতো হাসলো। নরম গলায় বলল,
“আমি একটু পরই চলে যাবো। তোর যখন ইচ্ছে হবে, তখন ফোন দিলেই কিন্তু আমাকে পাবিনা। আমি যতক্ষণ না অবসরে আসবো, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আমি জানি তুই ফোন করবি না আমায়, তবুও বলে রাখছি। তবে আমি যখন সময় পেয়ে ফোন করবো, তখন অন্তত ফোন তুলিস।”

রামির চোখে ব্যাকুলতা টের পেয়েও অরু চুপ করে রইলো। অনেকটা সময় কাটলো নিরবতায়। রামি সময় দেখলো। এখনই বাড়ি ফিরতে হবে। অথচ কিছুক্ষণ একান্তে সময় কাটাতে পারবে বলে দুজনের এখানে আসা। যদি না রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু’জন গন্ডগোল বাঁধাতো, তবে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যেত। রামি মলিন হেসে বলল,
“বাড়ি ফিরতে হবে, চল।”

অরু মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। বাইক কিছুূদূর আসতেই একটা দোকানের সামনে নেমে পড়লো রামি। দোকানে বসা ছেলেটাকে বলল,
“ঠিকঠাক দিয়েছিস তো?”

“হ্যাঁ, নিশ্চিন্তে যা।”

রামি একটা গিফট বক্স অরুর হাতে দিয়ে বলল,
“বিয়ের দিন না-কি স্ত্রীকে কিছু না কিছু দিতে হয়! এটা তোর জন্যই কিনেছি। আশা করঢ়ি তোর খুব পছন্দ হবে।”

অরুর মাঝে উৎকণ্ঠা। কৌতুহলী নজরে তাকিয়ে বলল,
“কী আছে এতে?”

“আমি চলে যাওয়ার পর দেখিস।”

অরু বক্স হাতে নিয়ে বসে রইলো। তাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে রামি ওদের বাড়ি ঢুকতেই সাদাদের মুখোমুখি হলো। ধারালো নজরে তাকিয়ে মুহূর্তেই রামিকে ফা*লা*ফা*লা করে ফেললো সাদাদ। রামি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই সাদাদ খ্যাঁক করে উঠলো,
“তোর এতবড়ো সাহস! তুই আমার কথা অমান্য করে বউ নিয়ে ঢং করতে বেরিয়েছিস।”

রামি বলল,
“তো তুমিও যাও তোমার বউ নিয়ে। আমি কী বাঁধা দিয়েছি না-কি? অবশ্য এক বাচ্চার বাপ তুমি। এই বুড়ো বয়সে রংঢং তোমায় মানায় না।”

ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠলো সাদাদ। গলা উঁচিয়ে বলল,
“তুলে যাস না রামি, অরু আমার এককালের বউ ছিল। আমি না চাইলে তুই ওঁকে বিয়ে কেন, ওর ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারতি না। কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।”

রামি উল্টো গর্জন করে উঠলো,
“কোন কালে তোমার বউ ছিল? আমাকে প্রমাণ দেখাও। বুড়ো বয়সে অরুর পেছনে ঘুরে যখন পাত্তা পাওনি, তখন কৃতজ্ঞতা নিয়ে হাজির হয়েছো।”

“তুই এখন আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিস? ভুলে যাস না….”
সাদাদকে আর বাকি কথা সম্পন্ন করতে দিলোনা রামি। হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল। বলল,
“হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি আজ থেকে আমাকে এই ডায়ালগ শুনতে শুনতে বুড়ো হতে হবে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ভাই, আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ চাই।”

লম্বা কদম ফেলে বাড়ির ভেতর চলে গেল রামি। পেছন পেছন সাদাদও গেল। একেবারে তৈরি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে অরুর বাবার সাথে দেখা করতে গেল। তবে অরুর সাথে দেখা হলোনা। সে দরজায় খিল দিয়ে বসে রইলো। উদাস মনে অরুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিঠুকে কল দিয়ে জানালো আমি যাচ্ছি।

গাড়িতে উঠে অর্ধেক পথ যেতেই মুঠোফোন তীব্র শব্দ করে উঠলো৷ রামির ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। অরু এখনই একটা বো*ম ফা*টা*বে। ঠিক হলোও তাই। রামি কল রিসিভ করতেই চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“কী দিয়েছো তুমি আমায়? এটা গিফট?”

রামি শব্দহীন শরীর দুলিয়ে হাসলো। অরুর একটা ছোটোবেলার ছবি বাঁধাই করে দিয়েছে। যেটাতে স্পষ্ট অরুর নাক দিয়ে পানি পড়ছে।
খট করেই লাইন কেটে দিল অরু। ছুটে রামির বাসায় গিয়ে ওঁর ঘরে ঢুকলো। আলমারি থেকে দুটো শার্ট বের করে পায়ের তলায় রাখলো। মুহূর্তেই ভিডিও কল দিল রামিকে।
অরুর কাছ থেকে ভিডিও কল পেয়ে রিসিভ করতেই রামির চোখ চড়কগাছ। মনে পড়ে গেল মিঠু তাকে সাবধান করে নিজের জিনিস সামলে রাখতে বলেছিল। অরু পায়ের তলায় দুটো শার্ট রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফ্লোর পরিষ্কার করছে।

★★★

এমদাদুল হকের সাথে বুঝাপড়ায় বসলো মিঠু। এমদাদুল হকের শরীরে বেশ কিছু ক্ষ*ত চিহ্ন স্পষ্ট। মিঠু ক্ষ*ত*গু*লো টার্গেট করে বিদ্রুপ করে বলল,
“ব্যথা পেলেন কীভাবে? রাস্তায় চলার পথে হোঁচট খেলেন না-কি?”

অগুন চোখে তাকালো এমদাদুল হক। ওই নজরে উত্তপ্ত দাবানল। হিসহিসিয়ে বলল,
“এর উচিত জবাব তুই পাবি। আমাকে এভাবে হেনস্তা করার পরিণাম খুব ভ*য়া*ব*হ।”

মিঠু ঠোঁট টিপে হাসলো। মজবুত কন্ঠে বলল,
“ইবতেসাম হাত গুটিয়ে বসে থাকার জন্য মাঠে নামেনি। এনিওয়ে ট্রিটমেন্ট খরচ দেব না-কি?”

এমদাদুল হক তেতে উঠলেন। বাজখাঁই গলায় বললেন,
“তুই আমাকে টাকার গরম দেখাস? তোর মতো দশটা ইবতেসামকে কিনে পায়ের তলায় রাখি আমি।”

মিঠু ফের হাসলো। নজর তীক্ষ্ণ করে মাথা ঝুঁকিয়ে নিলো। বলল,
“ইবতেসাম একটাই তৈরি হয়েছে। তাকে কেনার যোগ্যতা কোন অমা*নুষের হয়নি, আর না কোনদিন হবে।”

#চলবে……

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

রামির ঘর থেকে বের হতে নিতেই তরীর মুখোমুখি হতে হলো অরুকে। তরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই রামির ঘরে কী করছিস?”

অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল অরু। আমতা আমতা করে বলল,
“আমার দরকার ছিল।”

তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো তরী। সন্দীহান গলায় বলল,
“কী দরকার?”

অরু গাল ফুলিয়ে আছে। গোমড়ামুখে বলল,
“এখন কি এই বাসায় আসতেও আমায় অনুমতি নিতে হবে?”

তরী মৃদু হাসলো। বলল,
“অনুমতি লাগবে কেন? এই বাসায় আসতে তো তোকে নিষেধ করা হয়নি। শুধু সংসার করার অনুমতি নেই।”

অরু নাক ফুলিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
“আমি কি সংসার করতে এসেছি না-কি? প্রয়োজন ছিল তাই এসেছি।”

তরী মিটিমিটি হেসে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। স্বামীর ঘরে তার স্ত্রী আসবে। আমরা তো আর না করতে পারিনা।”

অরুর গাল দুটো লজ্জায় আরক্তিম হলো। রামির বউ বললেই তাকে লজ্জারা আষ্টেপৃষ্টে ধরে। অথচ তার সাথে রামির তেমন মাখোমাখো সম্পর্ক কোন কালেই ছিলনা। এই বাড়ির প্রতিটি পুরুষ সদস্য আর মিঠুর সাথে তার সম্পর্ক বরাবরই ঝগড়ার। তাদের সাথে কথা শুরু হয় ঝগড়া দিয়ে, শেষটাও ঝগড়ায় থামে। তবুও এই মানুষগুলোর চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা খুঁজে পায় সে। অরু ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল। তরীর চোখ পড়লো ফ্লোরে। রামির দুটো শার্ট হামাগুড়ি দিচ্ছে। তরী আফসোসের সুরে বলল,
“স্বেচ্ছায় বি*প*দ ডেকে আনলি রামি! খাল কে*টে ডেকে আনা কুমির তোকে আস্ত গিলে খাবে।”

★★★

নিশুতিরাত। একা শুয়ে আছে অরু। বারকয়েক তার ফোন ভাইব্রেট হলেও ফোন তুললো না সে। অজানা কারণেই তার লজ্জা লাগছে। রামি অনেকক্ষণ যাবত তাকে কল দিচ্ছে। তা-ও ভিডিও কল।
বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন। মিঠু বাসায় ফিরলো বেশ রাত করে। বসার ঘরের আলো জ্বলতে দেখে অরু বুঝলো মিঠু এসেছে। উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এত দেরি হলো যে?”

মিঠু যেন অরুকে এখানে আশা করেনি এমন ভান করে কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“কী ব্যাপার? তুই এখনও শশুর বাড়ি যাসনি? আমরা তো বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।”

অরুর তীক্ষ্ণ চোখের চাহনি বলে দিচ্ছে সে ক্ষে*পে যাচ্ছে। মিঠু তাকে রাগানোর জন্য বলল,
“এমন চেয়ে আছিস কেন? দেখ্, তুই যদি ভেবে থাকিস আমরা তোকে গয়নাগাটি দিয়ে প্রচুর টাকা খরচ করে ধুমধাম করে স্বামীর ঘরে পাঠাবো, তাহলে ভুল ভাবছিস। এমনিতেই ছোটোবেলা থেকে এই পর্যন্ত তোর পেছনে কতটাকা খরচ হয়েছে তার হিসেব নেই। আমরা ভেবে রেখেছি হিসেব করে তোর বরের কাছ থেকে টাকাগুলো নেব। এতগুলো বছর তার বউকে যে আমরা পেলেপুষে বড়ো করলাম, আমাদের নিশ্চয়ই অনেক টাকা খরচ হয়েছে!”

অরু ফোঁস করে উঠলো।
“এক টাকা নয়, যদি বল এক পয়সা চাই, সেটাও দেব না।”

মিঠু চোখ বড়ো করে বলল,
“তুই কী কিপটে বুড়ীরে অরু৷ রামিকে তো অল্পদিনে কোটিপতি বানিয়ে দিবি। না বাপু তোকে ঘরের চাল খাইয়ে লাভ নেই। রামির ঘরের অন্ন ধ্বং*স কর। তার এতটাকা খাবে কে? আমাকেও কিছু টাকা দান করিস।”

অরু খোঁচা মে*রে বলল,
“তুমি না জমিদার? তাহলে ভিক্ষা করার স্বভাব কেন?”

“তুই তো দেখছি একদিনেই দল পরিবর্তন করেছিস! রামির পক্ষে কী সুন্দর যুক্তি দাঁড় করাচ্ছিস। নাহ্ এই মীরজাফরকে কিছুতেই ঘরে রাখা যাবে না। ঘরের শত্রু বিভীষণ।”

অরু ছ্যাৎ করে উঠলো। বিছানার ঝাড়ু হাতে নিয়ে ছুটে এলো। তীর নিকটে আসার পূর্বেই মিঠু জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠলো। কৌশলে অরুর পেছনে চলে গেল৷ চুল ধরে টা*ন দিতেই থেমে গেল অরু। হাত থেকে বিছানার ঝাড়ু ঝরঝর করে নিচে পড়ে গেল। সাথে ধপ করে বসে পড়লো সে। ছোটোবেলার মতোই ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে । মিঠু দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“নাটক বাজ উঠ। এতটাও জোরে তোর চুল ধরিনি।”

অরু উঠছেনা। একই ভঙ্গিতে শুয়ে কাঁদছে। বরং কান্নার তেজ আগের তুলনায় বেড়েছে। মিঠুর নজর বাবার ঘরের দিকে। বাবা জেগে গিয়ে মেয়ের নাটক বাজিতে গদগদ হয়ে এই বয়সে তার গালে দুটো থা*প্প*ড় বসাতে পিছপা হবেন না। আর যাইহোক, আল্লাহ চাইলে সে আগামীদিনের সংসদ সদস্য হবে। এই পর্যায়ে এসে বাবার হাতে মা*ই*র খাওয়া শোভা পায় না। শেষে ঘু*ষে*র ধার ধারলো মিঠু। বলল,
“টাকা দেব। এবার উঠে যা।”

অরুর কান্নাকাটি থেমে গেল। সোজা হয়ে বসে বিরক্তি গলায় বলল,
“আরও আগে বলে দিলেই হতো। শুধু শুধু এতক্ষণ গড়াগড়ি করতে হলো।”
মিঠু উদাস হয়ে দেখছে ঘরে কতবড়ো ডা*কা*ত তৈরি হয়েছে।
অরু হাত পেতে বলল,“দাও।”

মিঠু ওয়ালেট অরুর হাতে দিয়ে রুমে চলে গেল। চেইক করে অরু মাত্র দুই টাকার একটা নোট ছাড়া কিছুই পেল না। ফোঁস করে মিঠুর দরজার সামনে দাঁড়লো। তীব্র করাঘাত করে চেঁচিয়ে বলল,
“বেঈমান, বি*শ্বা*স*ঘা*ত*ক। আমার বিশ্বাসের মর্যাদা দিলেনা। ফেরত দাও, আমার বিশ্বাস ফেরত দাও।”

মিঠু দরজা খুললো না। ভেতর থেকেই বলল,
“যা এখান থেকে। তোর বিশ্বাস বেচে আমি চানাচুর খেয়ে নিয়েছি। ভাঙারি ওয়ালার কাছে যা।”

“দিন অরুরও আসবে। আজ ক্ষমা করে দিলাম।”
ক্ষিপ্ত গলায় কথাখানা বলে অরু আর দাঁড়ালো না। রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রামির বারোটা কল। ভেবেচিন্তে কল ব্যাক করলো। সাথে সাথেই রিসিভ হয়ে গেল। অরু নিজেকে প্রস্তুত করার সময়ও পেল না। রামি ধমকে উঠলো,
“বে*য়া*দ*ব ফোন তুলিসনি কেন?”

অরু দ্বিগুণ জোরে ধমকে উঠলো,
“আমি বে*য়া*দ*ব হলে তুমি ডবল বে*য়া*দ*ব।”

“থা*প*ড়ে তোর দাঁত ফে*লে দেব। আমি কী বে*য়া*দ*বি করেছি বল?”

“তো আমি কী বে*য়া*দ*বি করেছি?”

“তুই ভালো ব্যবহারই আর কবে করলি। তুই যে উন্নত জাতের বে*য়া*দ*ব সেটা সবাই জানে।”

অরুর সম্মানে লাগলো কথাটা। ফিরতি তীর ছুঁড়ে বলল,
“তুমি যে উন্নত জাতের গরু, এটাও গত একমাসে সবাই জেনেছে।”

“এই বে*য়া*দ*ব আমাকে কোনদিক থেকে তোর গরু মনে হয়? জীবনে সবচেয়ে বড়ো পা*প করেছি তোকে বিয়ে করে। মনে হচ্ছে অল্পদিনে আমাকে কবরের বাসিন্দা হতে হবে।”

“হায়াত শেষ হলে এমনিতেই ম*র*বে। নয়তো আমি টুঁটি চেপে ধরলেও ফরমালিন দেওয়া ফলের মতো চেয়ে থাকবে।”

রামি বলল,
“তুই বড়ো সাং*ঘা*তি*ক মেয়ে। কোথায় স্বামী সেবা করবি তা না, তুই আমাকে মে*রে ফেলতে চাইছিস! আমার শার্ট ধুয়েছিস?”

“আমার কি ঠেকা পড়েছে?”

রামি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তুই সোজা কথার মানুষ না। ভিডিও কল দিচ্ছি। খবরদার লাইন কাটবি না বলে দিলাম!”

অরু রুমের আলো নিভিয়ে কল রিসিভ করলো। রামিকে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ছাঁই রঙা একটা টি-শার্ট পরে শুয়ে আছে। অন্ধকারে কিছুই দেখতে না পেয়ে রামি বিরক্তি গলায় বলল,
“তোর চশমা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আলো জ্বালা।”

অরু ত্যাড়া জবাব দিলো,
“পারবো না। আমাকে দেখার এত শখ কেন?”

রামি বিদ্রুপ করে বলল,
“আমি বেকার জনগণ। তোকে না দেখলে আমার পেটে ভাত পড়বে না। বেতন-ভাতা দেবে না সরকার৷ আমাকে একমাত্র তোকে দেখার জন্যই হায়ার করা হয়েছে।”
মুহূর্তেই স্বর পাল্টে ধমকে উঠলো,“ আমি কী করবো না করবো তাতে তোর অনুমতি নিতে হবে? আলো জ্বালা।”

“আমি আলো জ্বালাবো নাকি জ্বালাবো না, সেটা আমার ব্যাপার। তুমি বললেই কেন শুনতে যাবো?”

“তুই শুনবি না তোর বড়োটা শুনবে।”

“আমার বড়োটাকেই তাহলে কল দাও।”
বলেই খট করে লাইন কেটে দিল অরু। মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। রামি কল দিচ্ছে, অরু ধরছেনা। অনেকক্ষণ পর একটা মেসেজ আসলো।
❝আমি বাসায় আসি একবার। বে*য়া*দ*বি*র শোধ কড়ায়গণ্ডায় তুলবো।❞

★★★

নির্ঘুম রাত্রি কাটছে মিঠুর। ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কিছু ইমপোর্টেন্ট কাজ শেষ দিয়ে বসলো। সেদিনের পর থেকে সুহা আর তার সামনে পড়েনি। মেয়েটা যে ইচ্ছেকৃত তাকে এড়িয়ে চলছে, সেটা স্পষ্ট। মিঠু হাসলো। কতদিন নিজেকে আড়াল করবে? সংসদে একটি আসন পাওয়ার জন্য খেটে যাচ্ছে সে। কতটুকু সফল হবে জানা নেই। তবে চেষ্টার কমতি রাখছে না। এর মাঝে অবনির কাছ থেকে সুহার নম্বরটা জোগাড় করে নিয়েছে। নম্বর তুলে ডায়াল করতে গিয়েও সময় দেখে ফোন রেখে দিল। কাল সকাল দশটায় এক জায়গায় গেস্ট হিসেবে নিমন্ত্রিত সে। সকালে নাস্তা করে অরুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাকে নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজের উদ্দেশ্যে চলে গেল।

অনুষ্ঠান থেকে এক ঘন্টার মাঝে বেরিয়ে গেল মিঠু। কল পেয়ে চোখমুখ শক্ত করে গাড়ি হাঁকিয়ে চললো। কপালের রগ দপদপ করে উঠছে। কলেজের মেয়েদের উ*ত্য*ক্ত করা নিয়ে মিঠুর দলের কয়েকজন শ*ত্রু পক্ষের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। দু-দলের হাতাহাতি এক পর্যায়ে তুমুল আকার ধারণ করেছে। সেখানেই যাচ্ছে মিঠু। কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতেই ভীড় ঠে*লে তাকে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিল সাথে থাকা ছেলেপুলেরা। মিঠু কোনদিকে না তাকিয়ে কোমর থেকে বেল্ট খুলে হাতে নিলো৷ আহত বা*ঘে*র মতো হিং*স্র হয়ে উঠলো যেন। চোখজোড়া রক্তিম হয়ে উঠেছে। মেয়েদের উ*ত্য*ক্ত করা ছেলে দুটোকে বেধড়ক পি*টা*লো। কপাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম বৃষ্টি কনার মতো টপটপ করে ঘরছে। রিয়াজ অসুস্থ থাকায় তার পরিবর্তে সুজন সেসব দায়িত্ব পালন করছে। মিঠুর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিতেই হাত ধুয়ে বোতল ছুৃঁড়ে দিল তার দিকে। বোতল ক্যাচ করে মিঠুর সাথে এগিয়ে গেল। লম্বা কদমে সকলকে পেছনে ফেলেই গাড়ির কাছে এসে থামলো মিঠু। সুজন দৌড়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। মিঠু গাড়িতে চড়তেই গাড়ি এগিয়ে গেল। কিছুদূর যেতেই ড্রাইভারকে চলে যেতে বলে নিজেই ড্রাইভিং সিটে বসলো মিঠু। সুহার অফিস টাইম শেষ। এখনই বাসায় ফিরবে সে। মিঠু স্পিড তুলনামূলক বাড়িয়ে সুহার অফিসের সামনে দাঁড়ালো। তখনই সুহা বের হলো অবনির সাথে কথা বলতে বলতে। এতক্ষণের বি*ক্ষি*প্ত মেজাজ ঠান্ডা হয়ে গেল মিঠুর। শরীরে বয়ে গেল শীতল স্রোত। অপলক তাকিয়ে রইলো সুহার পানে। তাকে এড়িয়ে সুহা রাস্তার ওপাশে গাড়ির জন্য দাঁড়ালো। মিঠু কল দিল সুহার নম্বরে। আননোন নম্বর দেখে প্রথমবারে রিসিভ করেনি সুহা। দ্বিতীয়বারে রিসিভ করে সালাম দিলো। মিঠু সালামের জবাব দিয়েই বলল,
“গাড়িতে আসুন।”

সুহার বুঝতে বাকি রইলো না কে তাকে কল দিয়েছে। চোখমুখ কঠিন করে একবার রাস্তার বিপরীত পাশের গাড়িটি দেখে শক্ত হয়ে নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। কান থেকে ফোন নামিয়ে সাথে সাথে সুইচড অফ করে দিল। আজ রিকশায় উঠে পড়লো সুহা। যদিও রিকশা ভাড়া তুলনামূলক বেশি। তবুও আজ মিঠু থেকে নিজেকে আড়াল করতে রিকশা নিলো। তা দেখে হাসলো মিঠু। সুহা বাসায় এসে গোসল সেরে নিল৷ বাইরে প্রচুর গরম পড়েছে। জামাকাপড় মেলে দিতে বারান্দায় গিয়েই থমকে গেল। পরিচিত গাড়িটি নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরের কাউকে দেখা না গেলেও সুহা বুঝে গেল ভেতরে মিঠু আছে। রুমে ফিরে ফোন হাতে নিয়ে সুইচ অন করে মিঠুর নম্বরে কল দিল। সাথে সাথেই রিসিভ হলো। সুহা একনাগাড়ে বলে গেল,
“আপনি এভাবে এখানে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কী চাইছেন আপনি?”

মিঠু জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওখানে একটু আগে সুহা ছিল এখন কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তবুও সে নজর স্থির রাখলো। ধীর গলায় বলল,“আমি তো আপনার কাছে আসিনি সুহা। আমি আমার সুখের কাছে এসেছি। এখন থেকে রোজ তার কাছে আমায় আসতে হবে।”

#চলবে……