#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_২২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
ভেজা রাস্তা। ভর দুপুরেও সাঁঝের ছোঁয়া। পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘ, খোলা আকাশের নিচে পিচঢালা রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে সুহা। মনটা ভার ভার লাগছে। কিছুতেই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। নিজের উপরই আস্থা রাখতে পারছে না সে। মনে হচ্ছে একটু পরই তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে। একটা সিদ্ধান্তে স্থির হতে না পারার যন্ত্রণা বোধহয় বিচ্ছেদের যন্ত্রণা থেকেও বেশি পীড়াদায়ক। দুপুরে সবাই ভাতঘুম দিয়েছে। আধাঘন্টা পূর্বে তুমুল বর্ষণে রাস্তাঘাট ভিজে একাকার। গাছপালা সতেজ হয়ে উঠেছে। এখন আবার বৃষ্টি নামবে বলে! তবুও সুহা একা একা বের হলো। আশেপাশে মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। অবনিদের বাসা থেকে একটু দূরে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লো সে।
পুরুনো স্মৃতি ঘাঁটতে গিয়ে উপলব্ধি করলো স্মৃতিতেও ধূলো জমে। মাঝেমাঝে সেই ধূলো সরিয়ে আমরা নাড়াচাড়া করি। প্রথমদিকে কষ্ট হলেও এখন কদাচিৎ অনিকের কথা মনে পড়ে। তবে কষ্ট হয় না। কেবল একটা আফসোসের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে! একটা ভুল প্রেম জীবনটা কীভাবে এলোমেলো করে দিল। মানুষ বরাবরই ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে। কয়েকমাস পূর্বেই অনিকের সাথে বিনা আয়োজনে দেখা। সাথে তার স্ত্রী আর দু-মাসের বাচ্চা ছিল। স্বাভাবিকভাবেই কথোপকথন হয় তাদের। অনিক স্ত্রীর সাথে বন্ধু বলে সুহাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ করেই সুহা ভাবলো অনিক সবকিছু পিছু ফেলে এগিয়ে গিয়েছে। তবে সে কেন পিছুটান থেকে বের হতে পারছে না? সুযোগ তার হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেওয়ার পরও সে কেন তা পায়ে ঠেলে দেবে? জীবনকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো সুহা। পরপরই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিল তাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পাতা বুজে নিলো। চোখের পাতা ছুঁয়ে টপটপ করে বৃষ্টির পানি কপোল বেয়ে পড়লো। সাথে দুই ফোঁটা নোনাজলের মিশ্রণ ছিলো কী না তার পার্থক্য করা গেল না। ভেজা শরীর নিয়েই বাসায় ফিরলো সুহা। সবাই এখনো ঘুমিয়ে। চুপচাপ জামাকাপড় পরিবর্তন করে এক কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় বসলো। অবনি ঘুম থেকে উঠে সোজা বারান্দায় এসে সুহার পাশে দাঁড়ালো।
“তোর চুল ভেজা কেন? জামাও পরিবর্তন করেছিস। বৃষ্টিতে ভিজিছিস?”
চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো সুহা,
“হুম।”
অবনি মুখ ভার করে বলল,
“একাই ভিজলি? আমাকে সঙ্গে নিলে কী হতো?”
সুহা একমনে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বলল, “তুই তো ঘুমাচ্ছিলি। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি অবনি।”
অবনি ছন্নছাড়া গলায় বলল, “কী এমন সিদ্ধান্ত?”
“আমি ইবতেসামকে বিয়ে করবো।”
“কী!” বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো অবনি। তার মুখ এখনো হা হয়ে আছে। সুহা মলিন হাসলো। অবনি নিজেকে ধাতস্থ করে সুহাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো বলল
“তোকে এত্তো এত্তো গুলো ভালোবাসা। এবার অন্তত নিজের কথা ভেবেছিস। আমি বলছিনা তুই ইবতেসামকেই বিয়ে কর। আমি চাই তুই মুভ অন কর। আর মানুষটা হোক তোর পছন্দের।”
সুহা মেয়েটার একটুকরো খুশিকে জয়ী করে নিজেও নরম হাতে জড়িয়ে গালে গাল মিশিয়ে দিল।
★★★
রামি ফ্লাইং এর জন্য প্রস্তুত হয়ে বের হওয়ার পূর্বে অরুর ছবি দেখে শব্দহীন হাসলো। অরু আহ্লাদী মেয়ে। অন্যদের চোখে অরু ন্যাকা হলেও তার এই ন্যাকামী গুলোই রামির ভালোলাগে। শান্ত স্বভাবটা তাকে মানায় না। একটু লা*ফা*লা*ফি করবে, মিছেমিছি সবার সাথে ঝ*গ*ড়া করবে। রামি মাঝেমধ্যেই ন্যাকারানী বলে ক্ষে*পা*তো অরুকে। অথচ এই স্বভাবটাকেই রামি মনে মনে ভীষণ পছন্দ করে। এক সপ্তাহের বেশি সময় পর্যন্ত অরুর সাথে কথা হয় না। কিন্তু রোজ নিয়ম করে সবার কাছ থেকে খবর নেওয়া হয়।
ফোন সুইচড অফ করে বেরিয়ে পড়লো ফ্লাইং এর উদেশ্যে। সাদা ইউনিফর্মে রাজপুত্রের চেয়ে কম লাগছে না রামিকে। যার দৃষ্টি যত সুন্দর তার চোখে তত বেশি মুগ্ধতা।
অরু ইদানীং চঞ্চলতা প্রকাশ করে না। নিজেকে লুকিয়ে রাখে যেন। পরিবারের মানুষের সাথে অযথা কথা বলা মেয়েটাও অল্প কথায় জবাব দিয়ে চুপ করে যায়। সবাই দেখছে অরু নিজেকে এখন আগের তুলনায় বেশিই পড়াশোনায় ডুবিয়ে রাখে। কিন্তু ঘরের ভেতরের কাহিনী কারোরই জানা নেই। অরু রাত জাগে, চোখের নিচে কালসিটে দা*গ। অথচ সে পড়ায় মন বসাতে পারে না। পড়ার টেবিলে বসে রামির কথা ভাবে। ভাবতে ভাবতে একসময় পড়ার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরের আলো চোখে পড়তেই আবার ঘুম ভেঙে যায়। চুল হাত খোঁপা করতে গিয়ে অরুর মনে হলো এতদিন সে প্রেমে মজেছিল। এবার ভালোবাসার ভ*য়*ঙ্ক*র বেড়াজালে আটকে গিয়েছে। রামির প্রতি তার মায়া জন্মে গিয়েছে ভীষণভাবে। কিন্তু নিজের জড়তাকে পাশ কাটিয়ে ফোন করতে পারছে না। রামির উপরও অভিমান জমলো। এতগুলো দিন হলো, অথচ একটা কল পর্যন্ত করলো না। রামির রা*গ করাটা স্বাভাবিক জেনেও অরুর অভিমান হলো।
চট করে ফোন হাতে নিয়ে সকল জড়তা, অভিমান ভুলে রামিকে ফোন লাগালো। সুইচড অফ বলছে। হতাশ হয়ে ফোন রেখে দিল অরু। ডিউটি থাকাকালীন রামিকে ফোনে পাওয়া যায় না। তার বিশ্রামের সময়টুকুই সে সবার সাথে কথা বলার কাজে লাগায়। অরু কিছুক্ষণ পায়চারি করে বের হলো ঘর থেকে। মিঠুও তখন বের হলো। অরুকে দেখে বলল,
“কীরে ঘষেটি বেগম।”
অরু রা*গ করলো না। স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো,
“কী?”
মিঠু অবাক হয়ে বলল,
“এতটা ভালো হয়ে গেলি কবে থেকে? ইদানীং দেখছি কিছু বললেও রাগিস না।”
“এমনিই।”
রামি তুখোড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সন্দিহান গলায় বলল,
“এমনি? না-কি রামির সাথে কিছু হয়েছে?”
অরু বিরক্ত গলায় বলল,
“কী হবে?”
“সেটা তো তুই জানিস।”
“কিছু হয়নি। বের হওয়ার সময় আমাকে নামিয়ে দিও। ক্লাস আছে আমার।”
মিঠু মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে। তৈরি হয়ে নিস।”
অরু নিজের কাজে চলে গেল। মিঠু পকেটে হাত গুঁজে মুঠোফোন বের করলো। রামিকে কল করে ফোন সুইচড অফ পেয়ে বুঝলো সে ডিউটিতে আছে। অরুকে এতটা শান্ত দেখে ভালোলাগছে না। ছোটো থেকেই পাকামো করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। সেই ধারা অব্যহত রেখে এখন ধপ করে সব বন্ধ করে দিলে ভালো না লাগাটাই স্বাভাবিক।
সন্ধ্যার পূর্বে বাসায় ফিরলো অরু। ফোন চেক করলো রামি কল ব্যাক করেছে কি-না দেখার জন্য। এবারও হতাশ হলো সে। আর কল দেবে না সে। অনেকদিন পর মায়ের ঘরে ঢুকলো। আলমারি থেকে মায়ের পুরোনো দিনের একটা শাড়ি বের করে হাত বুলিয়ে দেখলো। ওটা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে জমকালো সাজ সাজলো। নিজে নিজেই পোজ দিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করলো। নিজেকে হাসিখুশি রাখবে। কোন রামি-টামিকে পাত্তা দেবে না সে। যত ন*ষ্টে*র গোড়া ওই রামি। তার জীবন ভাজা ভাজা করে ছেড়েছে।
যাকে জ্বালানোর জন্য এই ভর সন্ধ্যায় সাজসজ্জা, অরু জানতেও পারলো না সে ফ্লাইং করে ক্লান্ত শরীরে ঘুমাচ্ছে।
রামি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ফোন হাতে নিলো। অনেকের সাথে সাথে মিঠু আর অরুর কল দেখা গেল। আগে মিঠুকে কল ব্যাক করলো।
“কী ব্যাপার জমিদার সাহেব আমাকে স্মরণ করেছে!”
“জমিদার উদারমনা বলেই তোর মতো ছ্যা*চ*ড়া*র খোঁজখবর নেয়। তা আমার টুকটুকির মন ভার কেন? তাকে কী বলেছিস?”
অরুর মন ভার শুনে রামি সুর টে*নে বলল,
“ওওওও, এটাই তাহলে জমিদারের আমাকে স্মরণ করার আসল কারণ। তা আপনার বোনের মন ভার কেন তা আপনি কাছে থেকে জানেন না, তবে আমি কীভাবে জানি?”
“তোকে কী এখন স্কুলে ভর্তি করিয়ে স্বরবর্ণ শেখাতে হবে? কী বলেছিস অরুকে? ও কখনোই এতটা চুপচাপ থাকে না। আমি এমনিতেই বাসায় থাকি না। যেটুকু সময় থাকি, সেই সময়টাতেও ওঁকে মন খা*রা*প করে থাকতে দেখি। এমনি এমনি তো এমন পরিবর্তন হয়নি অরু। তোদের মধ্যে যা-ই হয়ে থাকুক আমি জানতে চাই না। শুধু বলবো সবটা ঠিক করে নে। আমার বোনকে এভাবে দেখতে আমার ভালোলাগে না।”
রামি বিড়বিড় করে বলল,
“শা*লা এমন ডা*কা*তে*র কবলে পড়লাম, বোন জ্বালিয়ে মা*র*ছে আর ভাই গলায় ছু*রি ধরে আছে। একটু এদিক-ওদিক করলেই টা*ন মে*রে উপরে পাঠিয়ে দেবে।”
“কিছু বললি?”
মিঠুর প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে মেকি হেসে জবাব দিলো রামি,
“না না, কী বলবো? তুই ফোন রাখ, আমি অরুকে কল দিচ্ছি।”
“ঠিক আছে।”
মিঠুর কল কে*টে অরুকে কল দিয়ে পেল না রামি। ফোন তুলছে না। ফেসবুকে লগইন করে স্ক্রোল করতে গিয়েই অরুর শাড়ি পরা ছবি সামনে পড়লো। সময় দেখে নিলো। এক ঘন্টা আগের পোস্ট। কে বলবে এই মেয়ে মন ভার করে আছে? দিব্যি শাড়ি পরে নেচে-কুঁদে বেড়াচ্ছে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে অরুকে আবার কল দিলো। এবার অরু ফোন তুললো। তবে কথা বললো না।
রামি গমগমে স্বরে বলল,
“কথা না বললে ফোন তুলেছিস কেন?”
সাথে সাথেই খট করে লাইন কে*টে গেল। রামি কান থেকে ফোন নামিয়ে ভুরু উঁচিয়ে কটমট চোখে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। পরপরই আবার কল দিল। এবারেও অরু ফোন তুলে কথা বলছে না। রামি ধমকের সুরে বলল,
“কথা বলছিস না কেন? খবরদার ফোন কাটবি না!”
অরু ত্যাড়া স্বরে জবাব দিলো,
“আমি কী সবার হাতের পুতুল? যে যেভাবে বলবে আমিও সেভাবেই হাত-পা নাচাবো। কল দিয়েছো কেন?”
“তুই কল দিয়েছিস সকালে।”
“ওওও, সেজন্যই কল ব্যাক করেছো। নিজ থেকে তো করতে না।”
রামি মান অভিমান বাড়তে দিলো না। কন্ঠ খাদে নামিয়ে নিলো। কোমল স্বরে বলল,
“মিস ইউ ঝগড়ুটে বউ।”
অরু চুপ করে গেল। তার অভিমান কমেনি, বরং একটুখানি বেড়েছে। অযথাই কেমন কান্না পাচ্ছে তার। রামি নরম গলায় ডাকলো।
“অরু।”
অরু কান্না চাপিয়ে রাখতে গিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
“কে ম*রে*ছে?”
“আমার হৃদয়। সেদিন আমার ছোট্ট হৃদয়টা এক ঝগড়ুটে না*রী* দৃষ্টির কবলে পড়ে খু*ন হয়েছে।”
“একদম আবেগ দেখাতে যাবে না। তোমার দুই টাকার আবেগে আমি সর্দি মুছি।”
রামি শান্ত গলায় বলল,“আচ্ছা।”
অরু রেগে বলল,
“আচ্ছা? শুধু আচ্ছা? আর কিছু না?”
“ভালোবাসা।”
অরু চুপ করে গেল। রামি মলিন হেসে বলল,
“চুপ করে গেলি কেন? আমি কি একপাক্ষিক ভুল করছি? তাহলে বল, আমি ভুল শুধরে নেব।”
অরুর কাছ থেকে ঝটপট জবাব এলো,
“বাড়ি আসবে কবে?”
“এটা আমার প্রশ্নের জবাব নয়। তাছাড়া আমার বাড়ি ফেরা না ফেরা আমার হাতে নেই।”
“অনুমতি পেয়েও আসবে না? বলে দিলাম পরে আর সুযোগ পাবে না।”
রামি ঠোঁটের কোণ প্রশস্ত করে হাসলো। বলল,
“ অনুমতি যখন পেয়েছি, তখন শীঘ্রই বাড়ি ফিরবো আমি।”
★★★
সুহার সাথে আজ অনেকদিন পর সামনাসামনি দেখা হলো। অবনির মা জানিয়েছেন সুহা বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। মিঠু বেশ অবাক হলো এত সহজে সুহাকে রাজি হতে দেখে। তাই আজ সামনাসামনি কথা বলার জন্য রেস্টুরেন্টে ডাকলো। মিঠুর বুক করা টেবিলের উপর একটা সিগারেটের প্যাকেট। এসেই সুহার চোখ পড়লো ওটায়। মিঠু পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করেই বসেছে। চোখে সানগ্লাস। সুহা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো। মিঠুর মতো সি*গা*রে*ট*খো*র*কে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। কিছু না বলে যেভাবে এসেছে, ঠিক সেভাবে ফেরত যেতে নিচ্ছিল। মিঠুর গম্ভীর স্বরে থামতে হলো তাকে।
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“তার কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে হবে?”
“ডেকেছি আমি আপনাকে। কথা না শুনে কোথাও যেতে পারবেন না।”
সুহা সিগারেটের প্যাকেটের দিকে ঘৃ*ণি*ত নজরে তাকিয়ে বলল,
“কোন সি*গা*রে*ট*খো*রে*র কথা শোনার আগ্রহ আমার নেই।”
মিঠু চোখ ঘুরিয়ে সিগারেটের প্যাকেটে দৃষ্টি ফেললো। ঠোঁট টিপে হেসে বেসামাল গলায় বলল,
“সিগারেট সামান্য ঠোঁট পোড়ায়। আপনি তো আমার গোটা হৃদয় পুড়িয়েছেন। তবে কার শা*স্তি বেশি হওয়া উচিত?”
সুহা কঠিন গলায় বলল,
“আপনার শা*স্তি মাথা পেতে নেওয়ার জন্য আমি বসে নেই।”
মিঠু চোখের চাহনি তীক্ষ্ণ করলো। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“কিন্তু আমি শা*স্তি দেব। সেটা আপাতত তোলা থাকুক। সময়ে সঠিকভাবে সবটা প্রয়োগ করবো।”
মিঠুর ঠোঁটের কোণের হাসি দেখে শরীর জ্বলে উঠছে সুহার। কোন কথা না বলেই ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল। মিঠু হাসলো। সিগারেটের প্যাকেটটা রিয়াজের। সুহাকে আসতে দেখেই সে উঠে গিয়েছে। ভুলবশত তার প্যাকেটটা এখানেই রেখে গিয়েছে।
#চলবে…….
#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
সুহাকে বেরিয়ে যেতে দেখে রিয়াজ ছুটে আসলো। মিঠু টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটি হাতে নিয়ে বলল,
“তুই থাক। আমি আসছি।”
অতঃপর বেরিয়ে গেল। সুহা বেশিদূর যায় নি। লম্বা কদম ফেলে তার পাশাপাশি এসে পথ ধরলো। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি ধরে রেখে সুহার সামনেই বারবার সিগারেটের প্যাকেট ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে। সুহা একবার গরম চোখে তাকিয়ে পায়ের গতি আরও দ্রুত করলো। মিঠু গলা ঝেড়ে বলল,
“টেস্ট করবেন?”
সুহার প্রচন্ড রাগ হলো। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে। দাঁতে দাঁতে চেপে বলল,
“আপনার ফা*ল*তু সিগারেট আপনি টেস্ট করুন।”
মিঠু হাসি থামিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“আমি তো সিগারেটের কথা বলিনি।”
তারপরই ধীর, গভীর গলায় বলল,
“আমার প্রেম, একবার টেস্ট করে দেখুন। সারাজীবন মজে থাকতে ইচ্ছে করবে, ট্রাস্ট মি!”
সুহা দু-কদম পিছিয়ে গেল। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে কঠিন গলায় বলল,
“আপনার সে ইচ্ছে, ইচ্ছেই থেকে যাবে।”
মিঠু সিগারেটের প্যাকেট সুহাকে দেখিয়ে দূরে ছুঁ*ড়ে মা*র*লো। মৃদু হেসে বলল,
“এবার ইচ্ছে পূরণ হবে? আমি সিগারেট খাই না, ওটা রিয়াজের ছিল।”
“বললেই বিশ্বাস করতে হবে?”
মিঠু আরেকটু এগিয়ে এসে বলল,
“তাহলে কী করতে হবে? বলুন না, কী করলে বিশ্বাস করবেন!”
সুহা আরেকটু পিছিয়ে গিয়ে জড়ানো গলায় বলল,
“দূরে সরুন।”
মিঠু একই ভঙ্গিতে বলল,
“তাহলে আপনি আমায় বিশ্বাস করুন।”
“কী প্রমাণ আছে বিশ্বাস করার মতো?”
“একেবারে আমার কাছাকাছি চলে আসুন। রোজ নিজেই ইচ্ছে মতো চেক করতে পারবেন। প্লিজ!”
সুহা কটমট চোখে তাকিয়ে বলল,
“যান তো এখান থেকে।”
“দূরে কেন ঠে*লে দিচ্ছেন?”
“এমন পাগলামি আপনাকে মানায় না।”
“সবার জন্য করি না তো। শুধু আপনার জন্য।”
সুহা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,
“কীজন্য ডেকেছেন?”
“আপনি বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন? সত্যটা আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইছি। কেউ আপনাকে ফোর্স করে রাজি করাক আমি তা চাই না। আমি চাই আপনি শুধু আমার জন্য রাজি হোন।”
সুহা শান্ত গলায় বলল,
“আমাকে কেউ জো*র করেনি।”
“সত্যি!”
“কিন্তু এখন আমি আর আপনাকে বিয়ে করবো না।”
মিঠুর কপালে ভাঁজ পড়লো। উত্তেজিত হয়ে শুধালো,
“কেন? কেন?”
“আমি সি*গা*রে*ট*খো*র পছন্দ করি না।”
“ওটা সত্যিই রিয়াজের ছিল। আচ্ছা আমার সম্পর্কে যা যা জানার, অরুকে ফোন করে জেনে নিতে পারেন। ও অন্তত আমার প্রশংসা করবে না, এটা নিশ্চিত! ও যদি বলে আমি সি*গা*রে*ট ফুঁকেছি কখনো, তবে আপনি যা বলবেন সেটাই হবে।”
সুহা বলল,
“নাম্বার দিন।”
মিঠু নাম্বার দিতেই সুহা সত্যি সত্যি অরুর নাম্বারে কল দিল। রিসিভ হতেই সুহা সালাম দিল।
অরু বলল, “কে?”
“আমি সুহা।”
“ওহ্ ভাবি! কেমন আছো?”
“ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“একটা ব্যাপার জানার ছিলো।”
“বলো না, কী বলবে!”
“তোমার ভাইয়ের কি সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে?”
“না তো। কেন?”
“আমি দেখলাম, সেজন্যই জিজ্ঞেস করেছি।”
“কী বলো! ভাইয়ার এসব অভ্যাস নেই। ওর সবচেয়ে বড়ো বদঅভ্যেস ঘর অগোছালো রাখা। সিগারেট ছুঁলে তো ঘরেই জায়গা দিতাম না।”
“আচ্ছা, আমি বোধহয় ভুল দেখেছি। রাখছি।”
“ঠিক আছে।”
সুহা কল কে*টে সামনে তাকাতেই মিঠু ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী বুঝলেন?”
“তুলসী পাতা।”
“তাহলে আমার কদর করা উচিত আপনার।”
সুহা আড়চোখে তাকালো। কিছু বললো না। মিঠু আজ সাহসের কাজ করলো। সুহার হাত নিজের মুঠোয় চেপে ধরলো। সুহা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। তবে সেটা ক্ষীণ সময়ের জন্য। পরক্ষণেই শান্ত হয়ে গেল। মিঠু বলল,
“অফিস শেষে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।”
“আমি একাই পারবো।”
“জানি। তবুও অপেক্ষা করবেন।”
“কেন এত অধিকার দেখাচ্ছেন?”
“কারণ, আপনি আমার হবেন। নিজের সবকিছুই আমি ভীষণ যত্নে আগলে রাখি। আমার যত্নে গড়া কিছু মানুষ আছে। আমার বোনেরা, বাবা-মা, বন্ধু এরা আমার বড্ড বেশিই প্রিয়। আপনিও তাদেরই একজন সুহা।”
সুহা অবাক চোখে দেখছে। আদতে এসব সত্যি হবে! যদি এসব স্বপ্ন হয়ে থাকে, তবে এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিক। এটা মনেপ্রাণে চাইলো সে। বহুদিন পর আবারও নিজের কথা ভাবলো।
★★★
অমি সারাবাড়ি চড়ে বেড়াচ্ছে। দাদুআপুর ঘরে গিয়ে স্থির হলো। ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে আয়েশা সুলতানার বিছনায় উঠে পড়লো। আয়েশা সুলতানা আড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী জন্য এসেছো?”
অমি টুকটুক করে তাকিয়ে বলল,
“এটা আমার বাড়ি।”
আয়েশা সুলতানা বিরোধিতা করে বললেন,
“বললেই হলো? এটা আমার বাড়ি।”
অমি জেদ ধরে বলল,
“বাড়ি আমার, বিছানা আমার, ছেলেও আমার, মেয়েও আমার। সব আমার৷ তোমার কিছুই নেই।”
“ইশ! ছেলে-মেয়ে কোথায় পেয়েছো তুমি?”
“আমি হাসপাতাল থেকে কিনে এনেছি।”
“জন্ম দিলাম আমি। আর ছেলেমেয়ে তোমার হয়ে গেল?”
“যাও একটা মেয়ে তোমাকে দিয়ে দিলাম।”
“কোন মেয়েকে দিলে?”
“অরুকে।”
“অরুকে কেন?”
“অরু আমার সাথে ঝ*গ*ড়া করে। ভালো না।”
আয়েশা সুলতানা উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। বললেন,
“অরু তোমার সাথে ঝ*গ*ড়া করে?”
“হ্যাঁ, আমার চকলেটও খেয়ে নেয়। বলে ‘একটু দে’ তারপর পুরোটা খেয়ে নেয়।”
অরু বাড়ি ফিরে অমির খোঁজে এ বাসায় আসলো। তার হাতে চকলেট। আয়েশা সুলতানার ঘরে ঢুকে চকলেট দেখাতেই অমি অরুর কাছে চলে গেল। আয়েশা সুলতানা বললেন
“একটু আগে না বললে আমার মেয়ে ভালো না! তাহলে আমার মেয়ের কাছে কী?”
অমি অরুর গালে চুমু দিয়ে বলল,
“না, মিষ্টি মেয়ে অরু। তোমার রামি পঁচা ছেলে। ওঁকে নিয়ে যেও।”
★★★
অর্ধরাত্রি। অরু সব গুছিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখনই রামির কল। রিসিভ করে ফোন এক জায়গায় রেখে বইপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে অরু। রামি জিজ্ঞেস করলো,
“পড়া শেষ।”
“হুম।”
“আচ্ছা তাহলে ঘুমিয়ে যা। সকালে আবার উঠতে হবে তোকে।”
অরু জবাব দিলো না। বইপত্র গোছানো শেষ করে ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। বলল,
“কথা বলতে না চাইলে এখন কল দিয়েছো কেন?”
“ভেবেছিলাম তুই পড়ছিস। তুই পড়লি আর আমি কলে থাকলাম। এখন তো পড়া শেষ তোর।”
“তো?”
“এখন ঘুমাবি না?”
“না।”
“কেন?”
“তোমার কি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না? কল দিয়ে বেঁচে যাওয়ার ফন্দি আঁটছো। তবেই না কাল বড়ো গলা করে বলতে পারবে আমি তো কল দিয়েছিলাম।”
রামি স্ক্রিনে এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে হাসলো। অরুর নাক-মুখ কুঁচকে কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে তাকে জ্বালানোর জন্য বলল,
“এখানে অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে বুঝলি?”
অরু চোখ রাঙিয়ে বলল,
“তুমি সুন্দরী মেয়ে দেখতে গিয়েছো না-কি ডিউটি করতে?”
“এক ঢিলে দুই পাখি আরকি।”
“তুমি সুন্দরী মেয়ে দেখ। বাড়িতে আসবে না বলে দিলাম।”
বলেই অরু খট করে লাইন কে*টে দিল।
রামি পরপরই আবার কল দিল। রিসিভ করে অরু বলল,
“ডিস্টার্ব করো কেন?”
রামি মৃদু হেসে বলল,
“বউ দেখতে।”
“না তুমি সুন্দরী দেখ গিয়ে।”
“আমার বউ তো সবার চেয়ে বেশি সুন্দরী। সে ছাড়া আর কোন সুন্দরীকে দেখবো?”
অরু সূঁচালো চোখে তাকিয়ে বলল,
“কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছো?”
“মোটেই না।”
“আমি এখন ঘুমাবো।”
“এখন ঘুমানো যাবে না।”
“বললেই হলো?”
“আমি যখন বলেছি, তখন অবশ্যই হবে।”
“আমার উপর কথা বলো যে, তোমার বুক কাঁপে না?”
“তুই কী এমন যে, বুক কাঁপবে?”
“কী বলতে চাও? আমি কিছু না? বুঝবে একদিন, যেদিন আমি থাকবো না।”
রামি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,“কোথায় যাবি তুই?”
“ঘুরতে চলে যাব কোন দেশে। তখন আমার অভাব বুঝবে।”
রামি হেঁয়ালি করে বলল,“এমন ভাব ধরলি, আমি তো ভেবেছি আমার জীবনটাকে শান্তিময় করে দিয়ে কোন দিকে চলে যাবি।”
“কী ভেবেছো কী চান্দু? তোমাকে আমি এতো সহজে ছেড়ে দেব? এখনো তোমাকে কড়াইয়েই দিলাম না। ভাজা ভাজা করা এখনো বাকি।”
“তোকে কি এমনি এমনি আমি সাং*ঘা*তি*ক বলি? কী অনায়াসে আমার জীবনের সূত্র মিলিয়ে বসে আছিস। মনে হচ্ছে মান হাতে পেলেই টপাটপ অঙ্ক কষে ফেলবি! বে*য়া*দ*ব হচ্ছিস দিন দিন। আদবকায়দা কিছু শেখ আমার কাছ থেকে। ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েরা তোর কাছ থেকে কী শিখবে?”
“আমার কাছ থেকে শেখার অনেক কিছুই আছে। কিন্তু তোমার কাছ থেকে কী শিখবে?”
রামি বুক ফুলিয়ে বলল,
“আমাকে দেখেই তো শিখবে। তোর কাছ থেকে তো শেখার মতো কিছুই নেই।”
অরু হো হো করে হেসে বলল,
“কীভাবে শ*য়*তা*নে*র পেছনের কু*ড়া*ল মা*রা যায় সেটাই শিখবে।”
রামি মাথা চুলকে বলল,
“আসলেই তো। আমাদের কাছ থেকে কী শিখবে?”
একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। দুজন ফোনের দু-পাশ থেকে হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে।
রামি নিজের হাসি থামিয়ে বলল,
“ভালো হয়ে যা অরু। ভালো হতে পয়সা লাগে না।”
“তুমি কাকে জ্ঞান দিচ্ছে? আগে নিজে তো ভালো হও।”
“আমার মধ্যে খা*রা*পে*র কী আছে?”
“সেটা কি বলবো এখন?”
রামি বলল,
“কে যেন আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভিডিও পাঠিয়েছিল! সেটা কি পাঠাবো?”
অরু চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“এটা ডিলিট করো বলছি।”
রামি দাঁত কেলিয়ে বলল,
“করবো না ডিলিট।”
“ভালো হচ্ছে না কিন্তু। ”
“ডিলিট দেব। একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
“আমি যদি ভিডিও ডিলিট দিই, তাহলে আমি কী পাব?”
“যাও, সব জায়গায় দুনম্বরি। ডিলিট দিতে হবে না।”
“সত্যিই ডিলিট দিতে হবে না?”
অরু করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,
“এমন করো কেন? ডিলিট করে দাও না।”
“তোর ঘুমাতে দেরি হচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়। আমি আবার ফ্রি হলে কথা হবে।”
বলে রামি লাইন কে*টে দিল। অরু তবুও অসহায় চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো। ফোন রেখে সে ভাবলো ভবিষ্যৎ বাচ্চা-কাচ্চা তাদের দুজনের কাছ থেকে কী শিখবে!
#চলবে……