#মিশেছো_আলো_ছায়াতে
#Writer_Sintiha_Eva
#part :44
🍁🍁🍁
মেঘার বাবা : আমি যদি তোমাদের এই সম্পর্ক মেনে না নেই। তখন কি করবে
মেঘার বাবার কথায় আয়াশ চমকে যায়। বিচলিত দৃষ্টিতে একবার মেঘার দিকে তাকিয়ে ওর বাবার দিকে দৃষ্টি রাখে। যার ভয়ে এতোদিন লুকিয়ে প্রেম করলো আজ তার সামনেই বসে আছে। মেঘা মুখ কাচুমাচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ল্পনা করছে কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা।
শুক্রবার হওয়ায় বিকেলের দিকে দুজন ঘুরতে বেরিয়েছিলো। পুরো সপ্তাহ পর আজ দুজন দেখা করেছে। সারা বিকেল এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে খাওয়া দাওয়া করে আয়াশের বাইকে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রতিবার বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে বাইক থেকে নেমে যায় মেঘা। কিন্তু আজ কথায় এতোটায় মজে ছিলো কখন বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে সে খেয়াল দুজনের কারোরই ছিলো না৷ আচমকা মেঘার খেয়াল হতেই মেঘা বাইক থামাতে বললে আয়াশ ও দ্রুত বাইক থামায়। আর তখনই মেঘা বাইক থেকে নামার আগেই মেঘার বাবা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ওদের দেখতে পায় আর বাড়িতে নিয়ে আসে।
মেঘার বাবা : এভাবে কাপছো কেনো ( ধমকে)
মেঘার বাবার ধমকে মেঘা বাস্তবে ফিরে। আয়াশকে কাঁপতে দেখে রেগে যায়। এতো ভয় পাওয়ার কি আছে। ওর বাবা কি সিংহ নাকি আশ্চর্য।
আয়াশ : আ আংকেল আ আমি
মেঘার বাবা : ভালোভাবে কথা বলো ( গম্ভীর কণ্ঠে)
আয়াশ : শা/লা/র কপাল একটা। ধরা পড়ার আর সময় পেলো না। কে বলেছিলো আপনাকে ওই সময় বাড়ি থেকে বের হতে। অসুর একটা। ( মনে মনে)
মেঘা : আয়াশের বাচ্চা। আজ তোর খবর আছে। ভালোবাসার সময় বলতে পারে আর বাবার সামনে কথা বলতে পারে না। গবেট একটা। ( মনে মনে)
আয়াশ মেঘার দিকে আড়চোখে তাকায়। মেঘার দৃষ্টি দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়। বুকে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস ছাড়ে। কি ভয়ানক দৃষ্টি। আয়াশ জোরে একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলায়। মেঘার বাবা বিরক্তি নিয়ে আয়াশের দিকে তাকিয়ে আছে।
আয়াশ : আঙ্কেল আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি আপনার মেয়েও আমাকে ভালোবাসে। এখন আপনার মানা না মানার উপরই আমাদের ভবিষ্য নির্ভর করছে। আশা করি আপনি আপনার মেয়ের খারাপ চাইবেন না৷
চোখ বুঁজে একদমে কথাগুলো বলে আয়াশ দম নেয়। ড্রয়িংরুম জুড়ে পিনপিনে নীরবতা। মেঘা হা হয়ে আয়াশের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘার মা তো প্রথমেই আয়াশকে দেখে পছন্দ হয়েছে। প্রথমেই ভেবে রেখেছিলো মেঘা যদি ছেলেটা ভালোবাসে তাতে উনার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু নিজের স্বামীর উপর চরম বিরক্ত লাগছে। এতো পুলিশি জেরা করার কি আছে।
মেঘা : হায় হায় আমার কিউটি টা। আলাবু বেপি। ( মনে মনে)
মেঘার বাবা : কিন্তু তোমাকে আমার পছন্দ হয়নি।
মেঘার বাবার কথায় আয়াশ হতভম্ব হয়ে যায়।
আয়াশ : জ্বি মানে।
মেঘার বাবা : এখন আসতে পারো।
আয়াশ : কিন্তু,,
মেঘার বাবা : যাও
আয়াশ অসহায় দৃষ্টিতে মেঘার দিকে তাকায়। মেঘার ছলছল চোখ দেখে বুকের ভেতর মোচড় মেরে উঠে। মনে মনে মেঘার বাবাকে অসুর নামক শ্বশুর নাম দিয়ে বেরিয়ে যায়। মেঘার বাবা মেঘার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা লাগায়।
এতোটুকু বলে মেঘা শুকনো দৃষ্টিতে সিমথির দিকে তাকায়। রোদেলা, তুহিন একে অপরের দিকে তাকায়।
সিমথি : আয়াশ ভাইয়াকে পছন্দ না হবার কারণ বলেনি আঙ্কেল।
মেঘা : নাহ।
তুহিন : আরে সেন্টি খাস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মেঘা : সিমথি তুই কিছু একটা কর বোন প্লিজ।
মেঘার কথায় সিমথি ভ্রু কুঁচকায়।
সিমথি : আমি কি করবো। তোর বাবা আমার কথা শুনবে।
মেঘা : শুনবে। তুই বলে দেখ প্লিজ।
সিমথি মেঘার চোখে পানি দেখে চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। বিরক্তি নিয়ে বলে,,,,
সিমথি : ছোট বাচ্চার মতো প্যাচ প্যাচ করিস না। বমি দেখছি।
সিমথির কথায় মেঘা কিছু টা ভরসা পায়।
ভার্সিটি ছুটির পর রিকশার জন্য রোদে দাঁড়িয়ে থাকার মতো বিরক্তি আর দ্বিতীয় কিছু তে নেই। আদিবা রাস্তায় রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আজ গাড়ি আসবে না। কপালের উপর হাতের উল্টো পিঠে সূর্যের আলো ঠেকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। ফর্সা মুখশ্রীতে ঘামের বিন্দু বিন্দু কণা জমেছে।
আদিবা : এখন একটা রিকশা নেই। অন্যদিক এদিক ওদিক থেকে ডাকতে শুরু করে কোথায় যাবে কোথায় যাবেন। আর আজ কারো টিকিটি ও নেই।
আদিবা বিরক্তি নিয়ে মাথা নুইয়ে হাঁটতে শুরু করে । কিছুটা হাঁটার শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খাওয়ায় আদিবা দুইপা পিছিয়ে যায়। বিরক্তি যেনো এবার আকাশ ছুঁই ছুঁই। রাস্তার মাঝে খাম্বাগুলো রাখার কি দরকার ছিলো। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই বিরক্তির স্থানে একরাশ চমক এসে হানা দেয়। পরিচিত কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখে বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বেয়ে জায়গা। গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে আসছে আদিবার পা টলছে। আদিবাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সামনে ব্যক্তি ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। আদিবার বুকটা ধক করে উঠে।
আফিন : আরে ভা,, আদিবা তুমি এখানে।
পাশ থেকে পরিচিত কন্ঠে আদিবার হুশ ফিরে। সূর্যের দুই পাশে আফিন, আহান কে দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করে। আলতো হেসে রিনিরিনে স্বরে বলে,,,
আদিবা : পেছনে আমার ভার্সিটি।
আহান : ওহ কোথায় যাচ্ছো হেঁটে।
আদিবা : আ আসলে রিকশা খুঁজতে । আজ বাসার গাড়ি আসেনি। ড্রাইভার আঙ্কেল ছুটিতে আছে। আর ভাইয়ারা ও অফিসে।
আফিন : ওহহহ। আমরা এদিকটায় ঘুরতে এসেছিলাম। এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।
আদিবা : ওহ ( আড়চোখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে)
আহান : তা যাবে কি হেঁটেই। বাড়ি কতদূর এখান থেকে।
আদিবা : ওই ঘন্টা খানেক। দেখি সামনে কিছু পাই কিনা। নয়তো ভাইয়াকে কল করবো।
আহান : ওহ। আদি ভাইয়া, সিমথি ভাবী, মেহের ভাবী সবাই ভালো আছে।
আদি : হুমমম
আহান আফিন চোখে চোখে কিছু একটা ইশারা করে কেশে আদিবার দিকে তাকিয়ে কেবলা কান্ত হাসি দেয়।
আফিন : আমাদের একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। আমাদের এখুনি যেতে হবে। তোমাকে না হয় সূর্য পৌঁছে দেবে।
আফিনের শেষ কথায় আদিবা চমকে সূর্যের দিকে তাকায়। সূর্যের প্রখর চাহনি দেখে আদিবা হাস ফাঁস করে। মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে মিমমিনে গলায় বলে,,,
আদিবা : তার দরকার পড়বে না ভাইয়া। আমি যেতে পারবো।
আহান : আমরা জানি বোন। কিন্তু আজ রোদের প্রখরতা দেখেছো৷ প্রকৃতি জ্বলসে যাচ্ছে। এই গরমে তোমাকে হেঁটে যেতে হবে না। আমরাই দিয়ে আসতাম কিন্তু কাজ পড়ে যাওয়ায় সম্ভব হয়নি।
আদিবা : কিন্তু,,,
আফিন : বড়দের কথা অমান্য করতে নেই। ওই যে সূর্যের গাড়ি৷ তোমরা যাও। আমরা বাইকে করে চলে যাবো।
আদিবা : আপনাদের বাইক কোথায়।
আফিন : রাস্তার ওপাশে রাখা আছে। আচ্ছা যাও তাহলে আসি এখন। আবারো দেখা হবে।
আদিবা : হুমম।
আফিন, আহান দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে সূর্যের কানে কানে কিছু বলে দুজনই হাসতে হাসতে যায়। আদিবা ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা পুনরায় নিচু করে নেয়। আদিবাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সূর্য নিজেই আদিবার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। আচনকা চেনা স্পর্শে আদিবা হকচকিয়ে যায়। সূর্যের হাতে ভাঁজে নিজের হাত দেখে সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বেসামাল হয়ে যায়। আদিবার শরীরের কাঁপুনি টের পেয়ে সূর্য মনে মনে হাসে। গাড়িতে বসে দুজনই সিটবেল্ট বেঁধে নেয়। সূর্য একপলক আদিবার দিকে তাকিয়ে ড্রাইভিং শুরু করে।
সূর্য : বি ইজি আদিবা।
সূর্যের কথায় আদিবা মাথা তুলে একপলক তাকিয়ে আবারো চোখ নামিয়ে নেয়। কোনো কারণ ছাড়া এমন অবস্থায় আদিবা নিজেই নিজের উপর চরম বিরক্ত। ক্লান্তিতে সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বুঁজে একটা লম্বা শ্বাস টানে।
সূর্য আদিবার দিকে একপলক তাকিয়ে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগী হয়।
___________
ইশান : কি ব্যাপার বড় মা মেঝো মা। বাড়িতে কোনো স্পেশাল কিছু নাকি আজ।
আদির মা : সে কি তুই জানিস না।
ইশান : জানবো কিভাবে দুদিন কি বাড়ি ছিলাম।
ইশানের মা : টুডে তোমার শায়লা আপু কামিং
ইশানের মায়ের কথায় ইশান চমকায়। মুখে হাসি ফুটিয়ে চিল্লিয়ে বলে,,,,
ইশান : সিরিয়াসলি! শায়লা আপু আসছে।
শাওনের মা : হ্যাঁ রে বাবা। মেয়েটা কতবছর পর দেশে আসছে বলতো। আদির বিয়ে তে ইনিমা টার এক্সাম থাকায় আসতে পারলো না। কতবছর পর মেয়েটা আসছে নিজের দেশে।
ইশান : ওয়াট এ্যা প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ। ভাইয়ারা জানে।
মেহের : নাহ। শায়লা না করেছে। বলেছে ওদের সারপ্রাইজ দেবে। ছোট মা তো তোমাকে বলে দিলো।
ইশান : যাক গে। দুলাভাই, আপু পুচকি দুটো সবাই আসছে নাকি।
আদির মা : হ্যাঁ
ইশান : যাক অনেক দিন পর আবারো বাড়িতে হৈহল্লা হবে।
শাওনের মা : অন্যদিন হৈহল্লা করিস না নাকি।
আদির মা : এতোদিন তো তোরা করতি। করিম সিমথি আসার পর তো তোরা একেকটা আরো চিল্লাপাল্লা করিস।
ইশান : তুম নেহি জান্না। যায় হোক একটা ঘুম দিয়ে আসি আমি। রাত জাগতে হবে তো
ইশান দৌড়ে রুমে চলে যায়।
শাওনের মা : আজ আর কারোর ঘুম হবে না। সবগুলো ছাঁদে বসে আড্ডা দেবে।
আদির মা : একেকটা বাঁদর।
আদির মায়ের কথায় সবাই হেঁসে দেয়।
চলবে,,,,,,,
( ভুলক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ)
#মিশেছো_আলো_ছায়াতে
#Writer_Sintiha_Eva
#part : 45
🍁🍁🍁
বাড়িতে আসতেই সামনে পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চা কে পড়ে যেতে দেখে সিমথি দ্রুত ধরে নেয়। এতে করে হাতের এপ্রোণ টা নিচে পড়ে যায়। সিমথি সেদিকে খেয়াল না করে বাচ্চা টা কে আগলে ধরে। হাঁটু গেড়ে বাচ্চাটার সামনে বসে হাত-পা চেক করে। অতঃপর বাচ্চার গালে হাত রেখে মোলায়েম গলায় শুধায়,,,,
সিমথি : লাগেনি তো তোমার।
বাচ্চা টা মাথা নেড়ে না করে। সিমথি আলতো হেসে নিচ থেকে এপ্রোণ টা তুলে একবার বাচ্চা টার দিকে তাকায়। ছেলেটা কে চিনতে না পেরে ড্রয়িংরুমের দিকে দৃষ্টি রাখে। আজ আসতে একটু দেরী হবে বিধায় ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলো। আদিকে ও বাড়ি চলে আসতে বলেছিলো। বাচ্চাটা দৌড়ে আদির কোলে উঠে যায়। এতে করে সিমথির ভ্রু কুঁচকায়। আদি বাচ্চা কে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মেইন ডোরের দিকে চোখ পড়তেই মুখের হাসি চওড়া হয়।
আদি : সিমথি ওখানে কি করছো। ভেতরে আসো।
আদির কথায় সবাই সিমথির দিকে তাকায়। সিমথি সবার দিকে চোখ বুলিয়ে অপরিচিত চারটা মুখে দৃষ্টি রাখে।
আদির মা : এসেছিস তুই। এতো দেরী হলো যে।
সিমথি : ওই শেষ মুহূর্তে একজন ইমার্জেন্সি প্রেশেন্ট এসেছিলো তাই।
শাওনের মা : যা মা ফ্রেশ হয়ে আয়। ক্লান্ত লাগছে।
সিমথি : হুম যাচ্ছি।
আদিবা : বউমণি জানো,,,
আদির মা : মেয়েটা কে আগে ফ্রেশ হতে দে। সারাদিন পর আসলো।
আদিবা মুখ ফুলিয়ে বসে পড়ে। সিমথি মুচকি হাসে।
সিমথি : মেহের ভাবী তিন্নি কোথায়।
মেহের : পড়ছে ভেতরে। তোর কন্ঠ শুনছে না। এখনি এসে পড়বে। ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে আয়। নয়তো আর ছাড় পাবি না
সিমথি আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। যাওয়ার আগে আবারো চারজনের দিকে তাকায়।
কথার মাঝে হুট করে নোটিফিকেশনের শব্দে আদি ফোন হাতে নেয়। সিয়াজান লেখাটা দেখে ম্যাসেজ ওপেন করে।
” আদি রুমে আসো কথা আছে ”
ম্যাসেজ টা দেখে আদি সবার দিকে চোখ বুলায়। এভাবে সবার সামনে থেকে উঠে গেলে উল্টাপাল্টা কিছু ভাববে ভেবে একটা ছক কষে। গুনে গুনে একমিনিট পর আদির ফোন বেজের উঠে। আদি সবার ফোন রিসিভ করে,,,
আদি : হ্যাঁ বলুন
______
আদি : কিন্তু ফাইল টা তো আমার বাড়িতে।
_____
আদি : তাহলে একটু পরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
____
আদি : এখনই লাগবে
____
আদি : আচ্ছা ওয়েট করুন।
____
আদি : তোমরা কথা বলো আমি একটা মেইল করে আসছি।
আদির কথায় সবাই সায় জানায়। রুমে এসে আদি সিমথিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে। সিমথি নাক ফুলিয়ে আদির পেতে গুতা মারে।
আদি : আহহ। গ/রু একটা।
সিমথি : মেয়ে মানুষ কখনো গ/রু হয়না।
আদি : হুহ। বাই দ্য ওয়ে সবার মাঝে ডেকে আনলে কেনো।
সিমথি : আদি তোমার,,
আদি : সিয়াজান এটা রোমান্সের সময় না। রাতে যতখুশি আদর করো। এখন বাড়ি ভরা মানুষ। এখন দরজা লাগিয়ে রোমান্স কিভাবে করবো বলো।
সিমথি কটমট দৃষ্টিতে আদির দিকে তাকায়। বুকে কিল মেরে রেগে বলে,,,,
সিমথি : অ/স/ভ্য লোক
আদি : আমি কি করলাম। দেখো জানপাখি আমার রোমান্সের নির্দিষ্ট সময় আছে। এখন না প্লিজ।
সিমথি : ধ্যাতত। আমারই ভুল, সরুন। নিচে যাবো।
সিমথি কে চলে যেতে দেখে আদি লাফিয়ে সিমথির হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে।
আদি : আচ্ছা শান্ত হ। মজা করছিলাম। বল কেনো ডাকলি ।
সিমথি : নিচে ওরা কে।
আদি : কারা।
সিমথি : ওই যে নতুন চারজন।
আদি : ওহ। শায়লা আপু, আপুর বর আর ছেলেমেয়ে।
সিমথি : শাওন ভাইয়ার বোন।।
আদি : হুমমম ( নাক টিপে)
সিমথি : আমি বাচ্চা না।
আদি : এটার জন্য ডেকেছিস।
সিমথি : হুম হুম।
আদি : আমি আরো কত কাহিনী বানিয়ে আসলাম।
সিমথি : মানে।
আদি : মানেটা হলো তুমি এভাবে ডাকলে এটাতো কেউ জানেনা । সবার সামনে থেকে উঠে আসলে ভাবতো তুমি রুমে এসেছো তাই আমিও এসেছি। আর দুলাভাইয়ের মুখে কিছু আটকায় না। প্রচন্ড রসিক মানুষ৷ মা-বাবার সামনে এমন কিছু বলতো যে লজ্জায় পড়ে যেতাম।
সিমথি : তোমার লজ্জাও আছে জানতাম না তো।
আদি : তোমার সামনে তো আমি সবসময় নির্লজ্জ। এটার প্রমাণ প্রতি রাতে পাও।
সিমথি : ছিহহহ। সরো তো। নিচে যাবো।
সিমথি আদির উত্তরের অপেক্ষা না করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আদিও হাসতে হাসতে সিমথির পেছন পেছন যায়।
সিমথি এসে মেহেরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তখনই শায়লা উঠে এসে সিমথির সামনে দাঁড়ায়। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,,,,
শায়লা : ও আমাদের আদির বউ।
মেহের : হুমমম।
শায়লা : মাশাল্লাহ। আমি কিন্তু তোমার বড় ননদ হয়।
শায়লার কথায় সিমথি আলতো হাসে। পায়ে ধরে সালাম করতে গেলে শায়লা আটকে দেয়।
শায়লা : আরে আরে কি করছো। সালাম করতে হবে না।
সিমথি : আপু ওদের নাম কি। ( বাচ্চা দুটোকে দেখিয়ে)
সিমথির কথায় শায়লা হাসে। ইনিমা আর আয়াজ কে ডেকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।
শায়লা : ও হচ্ছে ইনিমা আমার বড় মেয়ে আর ও হচ্ছে আয়াজ।
সিমথি বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে হাসে। বাচ্চা দুটোকে ধরার জন্য হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু শায়লা যদি কিছু মনে করে।
শায়লার বর তুষার এসে সিমথির সামনে দাঁড়ায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সিমথির দিকে তাকায়। মেয়েটাকে কেমন চেনা চেনা ঠেকছে কিন্তু চিনতে পারছে না। সিমথি ও তুষার কে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। প্রথম থেকেই লোকটাকে চেনা চেনা লাগছিলো।
তুষার : আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে চিনি। বাট কোথায় দেখেছি বলোতো।
আদিবা : বউমণিকে তো মাঝে মাঝেই টিভিতে দেখায়।
তুষার : না শ্যালিকা। ওকে আমি সামনা-সামনি দেখেছি।
সিমথি : আমার ও আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।
শায়লা : সেকি তোমরা দুজন দুজনকে কিভাবে চেনো।
আদি : কোথায় দেখলে।
তুষার কিছু ক্ষণ ভেবে আচমকা হালকা চেঁচিয়ে বলে উঠে,,,,
তুষার : তুমি সেই মেয়েটা না যে আমার বন্ধু মৃণাল কে রিজেক্ট করেছিলে। তুষারের কথায় সিমথি হকচকিয়ে তাকায়। আদি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার সিমথির দিকে তো একবার তুষারের দিকে তাকায়।
শাওন : মৃণাল কে।
তুষার : আমারই এক ফ্রেন্ড। তুমি তো লন্ডনে ছিলে তাইনা। তখনই মৃণাল ওকে প্রপোজ করেছিলো। কিন্তু
আদি : কিন্তু
তুষার : কিন্তু সেদিন সিমথি কাট কাট গলায় বলেছিলো ও নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসে।
তুষারের কথায় আদি প্রশান্তির শ্বাস টানে। ছোটরা সবাই ” ওহহোহহ ” করে উঠে। শাওনের মায়েরা মুখ টিপে হেসে একে অপরের দিকে তাকায়। সিমথি ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকায়। এভাবে বড়দের সামনে লজ্জায় পড়তে হবে জানলে নিচেই আসতো না।
তুষার : তা শালা বউ তোমার উনি কি আমার শা/লা বাবু।
তুষারের কথায় সিমথি আড়চোখে আদির দিকে তাকায়। আদিকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে।
আদির মা : চলো বড় ভাবী আমরা রান্না ঘরের দিকটায় যায়। আর এই যে তোমরা রুমে যাও। ছেলেপেলেরা আড্ডা দিক।
আদির মায়ের কথায় আদির বাবা উঠে রুমে চলে যায়। মুহুর্তেই বড়রা স্থান ত্যাগ করে। সবাই কে যেতে দেখে তুষার হা হুতাশ করে বলে,,,
তুষার : তোমার বিরহে আমার বন্ধু একরাতে বারো প্যাগ খেয়েছিলো। বেচারা ওইদিন ও তোমার কথা বলছিলো। আর তুমি তো এদিকে বিয়ে করে সংসার করছো। শালাবাবু জিতছো তুমি।
সিমথি : অজানা মেয়েকে প্রপোজ করার সময় মনে থাকে না হুহ। বারো প্যাগ কেনো এক হাজার প্যাগ খেলেই বা আমার কি ( মনে মনে )
শায়লা : আচ্ছা থামো তো তুমি। তোমার কোন আবাল মার্কা বন্ধু কি করেছে এসব শোনার ইন্টারেস্ট নেই।
ইনিমা : মা উনি কি আমাদের মামণি হোন।
আদি : হুমম মামার বউ তো মামণিই হয় তাই না।
আদির কথায় ইনিমা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। সিমথি ইনিমার দিকে তাকায়। তিন্নির থেকে বয়সে এক-দুই বছর বড় হবে।
শায়লা : তুহা আসলো না যে।
শাওন : আরে বেচারীর আজ ক্লাস টেস্ট ছিলো। কালও আছে। তাই কাল ভার্সিটি সেড়ে এদিকে আসবে।
শায়লা : ওহ।
চলবে,,,,,,,
( ভুলক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ )
#মিশেছো_আলো_ছায়াতে
#Writer_Sintiha_Eva
#part : 46
🍁🍁🍁
বেশ কিছুদিন পর। সিমথির মা-বাবার মৃত্যু আঠারোতম মৃত্যু বার্ষিকের দুইদিন আগের ঘটনা।
শাওনের মা : মেঝো দেখ তো সব ঠিকঠাক আছে কিনা।
আদির মা : তুমিই দেখে নাও না।
তখনই ইশান চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ির ভেতর ঢুকে।
ইশান : আদি ব্রো, শাওন ব্রো কোথায় তোমারা।
ইশানের ডাকে আদিসহ সবাই ইশানের কাছে আসে।
আদিবা : এনেছিস ছোড়দা।
ইশান : টেন টেনা
মেহের হেসে ইশানের হাত থেকে প্যাকেট টা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়।
শাওন : যেই ফ্লভারের বলেছি সেটা এনেছিস তো নাকি গন্ডগোল কটেছিস।
ইশান : আরে না না।
আদি : দাঁড়া সিয়া কে একটা কল করি।
আদি ফোন থেকে ফোন বের করে সিমথির নাম্বারে ডায়াল করে। প্রথমবার ফোন না ধরলেও দ্বিতীয় বার সিমথি ফোন ওঠায়।
সিমথি : কি হয়েছে। ( গম্ভীর কণ্ঠে)
আদি : ক কোথায় তুমি৷
সিমথি : হসপিটালে। দরকারি কিছু বললে বলো নয়তো রাখছি।
আদি : কখন আসবে।
সিমথি : আজ একটু লেট হবে। মা কোথায়।
আদি : মা রান্নাঘরে।
সিমথি : মাকে বলে দিও আজ আমার একটু লেট হবে।
আদি : হ্যাঁ হ্যাঁ যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ লাগাও। কাজ শেষ করে আসবে ঠিক আছে। কাজ একদম পেন্ডিং রাখবে না।
সিমথি : হুহ রাখছি।
আদিকে কিছু বলার না দিয়ে সিমথি ফোন কেটে দেয়। আদি ফোন কান থেকে নামিয়ে দেখে সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আদি হেসে বলে,,,,
আদি : লেট হবে আজ।
আদিবা : উফফস থেংক্স গড। চল চল বাকি কাজগুলো সেড়ে নেই।
ইশান : এই শায়লা আপুরা কখন আসবে।
আদি : দুলাভাইয়ের অফিস শেষ হলে চলে আসবে। আমরা গিয়ে আমাদের কাজ টা সেড়ে রাখি চল।
আদির কথায় সবাই আবারো কাজে লেগে যায়।
রাত বারোটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। আদি রা সবাই সিমথির জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু সিমথির আসার নাম নেই। আদি চিন্তিত পায়ে একবার বাইরে যাচ্ছে তো একবার ফোন করছে। কিন্তু সিমথির ফোন বন্ধ বলছে।
তুহা : ভাবী এতো লেট করছে কেনো।
আদিবা : আর তো মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। কখনই বা আসবে।
বারোটা দশ মিনিটে সিমথি বাড়ি আসে। ড্রয়িংরুমে ডুকতেই টাস্কি খায়। পুরো রুম এমন অন্ধকার দেখে।
সিমথি : বাইরে তো আলো আছে ভেতরে কি হলো। মা রা কি ঘুমিয়ে পড়লো নাকি।
সিমথি ঠোঁট উল্টে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
_ হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, ম্যানি ম্যানি হেপি রিটার্নস অব দ্য ডে।
আচমকা সম্বলিত কন্ঠস্বরে সিমথি চমকে যায়। চোখে মুখে লাইট পড়তেই চোখ বুঁজে নেয়। অতঃপর পিটপিট করে তাকায়। চোখের সামনে ফ্যামিলির প্রত্যেকজনের হাস্যজ্জ্বল মুখ ভেসে আসে। সিমথি মাথা ঘুরিয়ে পুরো রুমের দিকে চোখ বুলায়। সারা ড্রয়িংরুমে বেলুন দিয়ে সাজানো। সামনেই টেবিলে একটা চকলেট ফ্লেভারের কেক। এতোসব আয়োজন দেখে সিমথি দুপা পিছিয়ে যায়। দমিয়ে রাখা বুকের চাপ টা ক্রমশই বাড়তে শুরু করে। সিমথির চোখ-মুখ হঠাৎ ই লাল হয়ে যায়। চোখে অশ্রু টলমল করে। সিমথির হাত থেকে এপ্রোণ টা পড়ে যায়। আদিরা হকচকিয়ে সিমথির দিকে তাকায়। সিমথি পেছাতে পেছাতে শাড়িতে পা বাজিয়ে পড়ে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে নেয়।
আদি : সিয়া ( আতঙ্কিত গলায়)
আদির ডাক কে পাত্তা না দিয়ে সিমথি দু হাতে মাথা চেপে ধরে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুইটা সাদা কাপড়ে ডাকা র/ক্তা/ক্ত দেহ। কানে বেজে ওঠে কিছু কথা।
_ বাবাই- মাম্মাম তোমরা কখন আসবে। আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করেছি।
_ মামণি আমরা কালই চলে আসবো৷ বাবাই- মাম্মাম তোমার জন্য সারপ্রাইজ নিয়ে আসবে।
_ বাবাই বাবাই উঠো না। ও মাম্মাম ওঠো না। মাম্মাম আমাকে প্রিন্সেস সাজাতে হবে না। আমি তোমাদের জন্য কেক রেখেছি। ওঠো না। ও ভাইয়া মাম্মাম-বাবাই উঠছে না কেনো। এতো লাল রঙ কেনো মাম্মা-বাবাইয়ের গায়ে। আমার ভয় করছে ভাইয়া।
সিমথি : আহহহ।
আচমকা সিমথির চেঁচানো তে সবাই ভয় পেয়ে যায়। আদি দৌড়ে সিমথি কাছে যায়।
আদি : সিয়াজান কি হয়েছে তোর। এমন করছিস কেনো।
সিমথি রেগে আদিকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়। আদি দু পা পিছিয়ে যায়। শাওনরা ঘাবড়ে যায়।
সিমথি : আ আপনারা স সবাই বাজে। কাছে আসবেন না কেউ। এসব কেনো করেছেন। আমি বলেছি আমাকে এই দিনটা মনে করাতে। আপনারা সবাই বাজে। সবাই বাজে, সবাই বাজে।
সিমথি রেগে টেবিলের কেক তুলে নিচে ফেলে দেয়। সাজানো রুমটা এলোমেলো করে দেয়। আদির মা, চাচী, মেহেররা এগুতে নিলে সিমথি রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় ।
সিমথি : কেউ আসবেন না। দূরে থাকুন বলছি। সবাইকে শেষ করে দেবো আমি। আমার ইমোশন নিয়ে মজা করবেন না। সরুন বলছি।
সিমথির এহেন আচরণের সবাই হতভম্ব। সবাই কে অবাক করে দিয়ে আচমকা সিমথি দৌড়ে উপরে চলে যায়। পেছনে সবাই স্তব্ধ হয়ে সিমথির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
শাওন : সিমথি এমন করলো কেনো।
ইশান : আমরা ভুল করে ভাবীজ্বিকে আঘাত করে ফেলিনিতো।
আদির মা : মেয়েটা এভাবে ছুটে কোথায় গেলো। ও আদি যা না দেখ না।
আদি যেতে নিলে আদির বাবার কথায় থেমে যায়।
আদির বাবা : এখন যাস না। সায়ন কে ফোন করে একবার আসতে বল তো৷
শাওনের বাবা : কিন্তু এতো রাতে।
আদির বাবা : তো কি মেয়েটা কে একা ছেড়ে দেবো। ওর মুখের অবস্থা দেখেছো তো ভাইজান। এখন ওর সামনে কাউকে পাঠানো বিপদজনক। সায়নের থেকে ডিটেইলসে জানতে হবে।
আদির বাবার কথায় কেউ আর কিছু বলে না। অগত্যা আদি সায়ন কে ফোন করে।
ঘন্টাখানেক পর সায়ন আর ইফাজ আদিদের বাড়ি আসে। দুজনের চোখে মুখেই বিস্ময়। সায়নদের আসতে দেখে সবাই ওদের দিকে এগিয়ে যায়।
সায়ন : কি রে এতোরাতে ডা,,,,
সায়ন পুরো রুমে চোখ বুলায়। সায়নকে থেমে যেতে দেখে ইফাজ ও সায়নের দৃষ্টি অনুসরণ করে। মুহুর্তেই দুজনের চোখে মুখে আতঙ্কের দেখা মেলে।
আদির বাবা : আসলে সায়ন তোমা,,,
সায়ন : আদি তোরা কি পরীর জন্মদিন পালন করতে এসব করেছিস। ( আতঙ্কিত গলায়)
শাওনের বাবা : হুমম কিন্তু
সায়ন : এটা কি করলেন আঙ্কেল। আদি তুই আমাকে একবার জানাবি তো। ( রেগে হালকা চেঁচিয়ে )
আদি : আসলে আমরা
ইফাজ : সিমথি কোথায়।
আদি : ছাঁদে।
সায়ন আর ইফাজ দৌড়ে ছাঁদের দিকে অগ্রসর হয়। ওদের পেছন পেছন বাড়ির সবাই যায়। সায়ন ছাঁদের দরজা বন্ধ দেখে দুজনই ঘাবড়ে যায়। সায়ন চোখের চশমা ঠেলে উপরে তুলে দরজার করাঘার করে।
সায়ন : প পরী দরজা খোল।
____
ইফাজ : সিমথি বোন দরজা খোল।
____
সায়ন : পরী লক্ষ্মীসোনা বোন দরজা খোল। ভাইয়া এসেছি তো। ভয় পাস না খোল। ভাইয়া আছি না। ভাইয়ার কথা শুনবি না। পরী দরজা টা খোল।
সায়নের চোখে পানি চলে আসে। সায়ন হাতে উল্টো পিঠে পানি মুছে দরজায় পুনরায় আঘাত করতে নিলে দরজা খুলে যায়। সায়ন আর ইফাজ দরজা পেরিয়ে ছাঁদে প্রবেশ করে। সিমথিকে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকতে দেখে সায়নের বুক মোচড়ে ওঠে। ইফাজ ওখানেই থেমে যায়। চোখ ছাপিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নেয়। সায়ন নিঃশব্দে সিমথি পাশে বসে সিমথি মাথা টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে। প্রিয় ভাইয়ের স্পর্শ পেয়ে সিমথি মতো বাচ্চাদের ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়। সায়ন সিমথির মাথায় হাত বুলিয়ে ভেজা গলায় বলে।
সায়ন : পরী কাঁদিস না।
সিমথি : ওরা সবাই আমাকে আবারো মনে করিয়ে দিয়েছে ভাইয়া। আ আমি এ দিন টা ভুলে থাকতে চাই। ও ওরা ক কেনো ম মনে করালো।
সায়ন : সোনা বোন আমার ওরা তো জানতো না তাই না।
_____
ইফাজ ঘাড় ঘুরিয়ে ছাঁদের দরজার দিকে তাকায়। আদিদের অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইফাজের খারাপ লাগে। ইফাজ পেছন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সিমথির অপর পাশে গিয়ে বসে।
ইফাজ : আমাদের প্রিন্সেস না অনেক সাহসী। সবাই না বলে ওর মন পাথর দিয়ে তৈরি। তাহলে আজ এমন মোমের মতো গলে যাচ্ছে কেনো সে।
____
সায়ন : পরী তোকে আমরা অনেকবার বুঝিয়েছি এসবে তোর কোনো দোষ নেই। তখন তুই ছোট ছিলিস। একটা ঘটনা আঁকড়ে তুই নিজের লাইফ থেকে বার্থডের মতো পবিত্র দিনটাকে বিষাক্ত বানিয়ে রাখিস। আমরা কেউ কিছু বলিনা। তোর কষ্ট টা আমরা বুঝি। কিন্তু এখন যদি এমন করিস ভাইয়ার কষ্ট হয় না। তুই তো জানিস আমরা তোর চোখের পানি সহ্য করতে পারিনা।
_____
ইফাজ : আদি রা জানতো না তাই এমন টা হয়েছে। আমরা ওদের বারণ করলে আর করবে না। কিন্তু তুই কান্না থামা বোন।
সিমথি : আ আমি বা বাড়ি যাবো।
সিমথির কথায় আদি আহত দৃষ্টিতে ওর মায়ের দিকে তাকায়৷
সায়ন : না বোন। এখন বাড়ি গেলে ওরা ভাববে তুই ওদের জন্য চলে যাচ্ছিস। সবাই কষ্ট পাবে। কাল সকালে যাস।
সিমথি : সবার ভালো লাগা খারাপ লাগা আমাকেই কেনো বুঝতে হবে সবসময়। আমার ও তো ভা ভালো লাগা খারাপ লাগা আছে। তোরা এটা কেনো বুঝিস না ভাইয়া ( বিড়বিড়িয়ে)
বেশকিছু ক্ষণ পর সায়ন সিমথির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সিমথির মাথা তুলে দেখে সিমথি ঘুমিয়ে গেছে। আদি আলতো হেসে দেয়। বোনটার স্বভাব এখনো বদলায়নি দেখে। আদি এগিয়ে এসে সিমথি কে কোলে নিতে গেলে সায়ন বাঁধা দেয়।
সায়ন : আমি নিয়ে যাচ্ছি। তোরা ড্রয়িং রুমে গিয়ে বোস আমি আসছি।
সায়নের কথায় আদিরা নিচে চলে যায়। সায়ন সিমথিকে আদির রুমে শুইয়ে দিয়ে নিচে আসে। ইফাজের পাশে সোফায় বসে একটা লম্বা শ্বাস নেয়। মনে পড়ে কালকের পরদিনই তো ওদের মা-বাবার মৃত্যুর আঠারো বছর পূর্ণ হবে।
সেদিন সিমথির জন্মদিন ছিলো। আহনাফ খান আর উনার স্ত্রী কোনো গোপন কেসের তদন্তের জন্য কোথাও গিয়েছিলো সিমথির জন্মদিনের দুইদিন আগে। কিন্তু ফোনে বলেছিলো সিমথির জন্মদিনের সমস্ত আয়োজন করে রাখতে। উনারা দুইজন বিকেলের মধ্যে চলে আসবে। তারপর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। নীলয় খান সহ বাড়ির সবাই সিমথির জন্মদিনের তোরজোর শুরু করে। সিমথির বয়স তখন সাত বছর। ছোট্ট সিমথির আট-দশ টা বাচ্চার মতোই ভীষণ খুশি ছিলো। সিমথি, তরী, রোজ তিন বাচ্চা সারা বাড়ি খেলছিলো। সায়ন আর ইফাজ ছিলো সমবয়সী। বয়সে সিমথির থেকে পাঁচ বছরের বড়। বড় ভাই হবার সুবাদে দুজনই কাজে ব্যস্ত ছিলো। সিমথি খেলার ফাঁকে ফাঁকে বার বার মা-বাবার আসার জন্য গেটের কাছে যাচ্ছিলো। কিন্তু প্রতিবারই মন খারাপ করে ফিরে আসে। একপর্যায়ে ফোন দিয়ে আহনাফ খানের নাম্বারে ফোন লাগায়।
_ শুভ জন্মদিন মামণি।
_ তোমার মামণি ভীষণ রেগে আছে বাবাই মাম্মাম।
_ ওমা তাই। মামণির রাগ ভাঙাতে বাবাই – মাম্মাম কে কি করতে হবে।
_ তোমরা জলদি জলদি চলো আসো বাবাই – মাম্মাম। আমি ওয়েট করছি।
_ আসবো তো মামণি। বাবাই – মাম্মাম তোমার জন্য সারপ্রাইজ নিয়ে আসবে।
_ সত্যি ( আহ্লাদী স্বরে)
_ হুমম তিন সত্যি।
সিমথি খুশি হয়ে ফোন কেটে দেয়। অতঃপর সিমথি আবারো খেলতে শুরু করে। কিন্তু সময় নিজের মতো গড়াতে থাকে। সিমথির মা-বাবার আসার খবর নেই। সিমথি কেঁদে দেয় আর বলে উঠে মাম্মাম -বাবাইকে ছাড়া কেক কাটবে না। সিমথিকে কেউই বুঝারতে সক্ষম হয়না। শেষমেশ নীলয় খান বলে উঠে,,,
নীলয় খান : সিমথি মামণি তোমার বাবাই-মাম্মাম জ্যামে আটকে গেছে। আমাকে বলেছে তুমি যেনো কেক কেটে নাও। ওরা কিছু সময়ের মধ্যেই চলে আসবে।
নীলয় খানের কথা বিশ্বাস করে সিমথি কেক কাটে। নিজের মাম্মাম – বাবাইয়ের জন্য কেক আলাদা করে রেখে সবাই খেতে দেয়। জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ হলে সব নিমন্ত্রিত অতিথিরা ফেরত যেতে আরম্ভ করে। রাত বারোটার দিকে খান বাড়িতে খবর আসে আহনাফ খান আর তানহা খান যে গাড়িতে আসছিলো সেটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। দুজনের অবস্থা গুরুতর। নীলয় খান তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য। এদিকে মা-বাবা কে আসতে না দেখে সিমথি আরো ডেস্পারেট হয়ে উঠে। কিন্তু কেউই সিমথি, তরী, রোজকে আহনাফ খান আর তানহা খানের এক্সিডেন্টের কথা জানায়নি। পুরো একদিন পর পরের দিন সকালে হসপিটাল থেকে হঠাৎ খবর আসে তানহা বেগম আর আহনাফ খানের অবস্থা শোচনীয়। মৃত্যুর কয়েক মুহুর্ত আগে সায়নকে আহনাফ খান নিজের কাছে ডেকে পাঠায়। সায়ন নিজের বাবাকে এমন অবস্থায় দেখে কেঁদে দেয় ছোট্ট মনটা। আহনাফ ছেলেকে দুর্বল হাতে নিজের কাছে ডাকে।
_ স সায়ন এ এদিকে আ আসো
_ বাবা তুমি এভাবে শুয়ে থেকো না। আমার পরী কষ্ট পাচ্ছে। আমার ও কষ্ট হচ্ছে বাবা।
_ ব বেটা ত তুমি য যদি এএএ অঅঅবস্থায় ভেঙ্গে যাযাও তাতাহললে তোমাড পর রীকে কে দেখববে। ত তুমি ও ওর বড় ভাই। আমার আ আআর তোমমমার মায়েরর অবর্তমানে ওওওর গার্ডিয়ান। তোমমমার হাতে ওর দাদাদায়িত্ব দদিয়ে গগগেলাম। ককখনো আমমমার প্রিনননন্সেস কে ককককস্ট পেতে দিদিও না। সসসর্বদা ও ওওর ঢাঢাল হয়ে থেথেকো। তুতুতুমি ছাছাড়া ওওওর আর কে কেউ নে নেই।
কথাগুলো বলামাত্র আহনাফ খানের শ্বাসকার্য থেমে যায়। সায়ন ডুকরে কেঁদে ওঠে। নীলয় খান প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের মৃত্যুতে অনেকটায় শোকাচ্ছন্ন হশে পড়ে। খান বাড়িতে খবর পাঠানো হয়। পুরো শহরের মুহুর্তেই বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে মেজর আহনাফ খান এবং এডভোকেট তানহা খানের মৃত্যুর খবর।
সিমথি ছোট ছোট পা ফেলে ওর মা-বাবার ডেডবডির সামনে এসে দাঁড়ায়। ছোট্ট সিমথি তখনও বুঝতে পারেনি ওর মাথার উপর থেকে সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল টায় হারিয়ে গেছে।
সিমথি : বাবাই – মাম্মাম তোমরা এখানে ঘুমিয়ে আছো। তোমাদের সাথে আমার জন্মের কাট্টি। জানো আমি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম। ভাইয়া দেখেছিস ওরা এখনো ঘুমাচ্ছে।
সায়ন : বোন
সিমথি : ও বাবাই মাম্মাম উঠো। আমি তোমাদের উপর রেগে নেই। সত্যি বলছি। কেক রেখেছি আমি তোমাদের জন্য। ও মাম্মাম আমি প্রিন্সেস সেজেছি তুমি না বলেছিলে আমার ছবি দেখবে। তাহলে ঘুমিয়ে আছো কেনো ওঠো না।
ইফাজ : সিমথি শোন
সিমথি : ও ইপাজ ( ইফাজ) ভাইয়া মাম্মাম-বাবাইকে উঠতে বলো না। আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে। ওরা কথার খেলাপ কেনো করছে। এটাকে তো প্রতালণা ( প্রতারণা) বলে
সিমথির এই ছোট্ট গলায় একরাশ অভিমান মিশ্রিত কথাগুলো ও সেদিন ওর মা-বাবার ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি। যে ঘুম চিরতরে হয় সেই ঘুম কি কভু ভাঙ্গে হুহু। তারপর ধীরে ধীরে সিমথি কেমন হতে শুরু করে। সেদিনের পর থেকে আর কোনো দিন জন্মদিনের নাম মুখে আনেনি। একবার সায়নরা আয়োজন করেছিলো কিন্তু সিমথি ভয়াবহ রিয়েক্ট করেছিলো। একপর্যায়ে সেন্সলেস হয়ে যায় । সেদিন ডাক্তার জানিয়েছিলো এই নিজের জন্মদিনের উপর ওর প্যানিক আ্যটাক হয়ে গেছে। এই দিনটায় ওর স্টার মাম্মাম-বাবাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। সিমথির বয়স যখন বারো তখনই সিমথি বুঝতে পারে ওর মা-বাবা স্টার হয়ে গেছে এটা কোনো সুখবর না। ওর জীবনের সবচেয়ে বড় শূন্যতার জায়গা। সেদিন থেকে বাড়ির প্রত্যেকে এই দিনটা মনে রেখেও ভুলে যেতো। সিমথি ও সারাদিন নিজেকে রুমবন্দী করে রাখতো।
এতোটুকু বলে সায়ন চোখের কার্নিশের পানি টুকু মুছে আদির দিকে তাকায়। ড্রয়িং রুমে সবাই বাকরুদ্ধ। সামান্য জন্মদিনের মতো পবিত্র দিনটাকে ঘিরেও কারো জীবনে একটা কালো অধ্যায় থাকতে পারে এটা সবার ধারাণতীত ছিলো।
মেহের : নিজেদের অজান্তেই এতো বড় কষ্ট দিয়ে দিলাম মেয়েটা কে।
আদি : সব আমার দোষ। আমি না জানালে তো এসব হতোই না।
সায়ন : না ভাবী, আদি তোমাদের কারো দোষ নেই। তোমরা ওকে খুশি করতে চেয়েছিলে কিন্তু তোমরা তো জানতে না এসব। আমারই ভুল হয়েছে। আমার তোমাদের বলে দেওয়ার দরকার ছিলো। আঙ্ক আন্টি আমি জানি পরীর প্যানিক আ্যটাক হবার পর হয়তো বাজে বিহেভ করেছে তার জন্য দুঃখিত। আপনারা কিছু মনে করবেন না। কাল সকালে দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইফাজ : সায়ন মিম ফোন করেছিলো বাড়ি যেতে হবে।
শাওনের বাবা : অনেক রাত হয়ে গেছে আজ বরং থেকে যাও।
সায়ন : তা হয়না আঙ্কেল। আদ্র টার শরীর ভালো না তেমন। আমাকে যেতে হবে। আপনারা চিন্তা করবেন না। আর সিমথির জন্য আমি আবারো দুঃখিত।
আদির বাবা : না না বাবা এসব বলে আমাদের লজ্জা দিও না। আসল অপরাধী তো আমরা। মেয়েটার ক্ষত জায়গায় আবারো ক্ষত সৃষ্টি করলাম।
সায়ন কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
শাওন : চলো আমরা এগিয়ে দিয়ে আসি।
সায়ন আর ইফাজ সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়।
ইশানের বাবা : হাসির আড়ালেও কিছু মানুষের কষ্ট কেউ দেখতে পারে না। এতোকিছুর পরও মেয়েটা শ্বাস নেয় কিভাবে।
আদির মা : আদি তুই সিমথির কাছে যা। আমি ওর খাবার নিয়ে আসছি। আর তোমরা খেয়ে নাও।
আদিবা : আমি খাবো না মা। ভালো লাগছে না।
তুহা : আমিও না।
একে একে সবাই খাবে না বলে ওঠে। আদির মা রেগে বলে,,,
আদির মা : তোরা যদি শুনেই এমন করিস তাহলে মেয়েটা নিজের চোখের সামনে এতোকিছু দেখেও কিভাবে আছে। তোরা এমন করলে মেয়েটাও নিজের চারপাশে শূন্যতা অনুভব করবে। এটা কি চাস তোরা।
_ না না
শাওনের মা : তাহলে সবাই খেয়ে চুপচাপ রুমে গিয়ে ঘুমা। কাল স্বাভাবিক বিহেভ করবি।
অগত্যা সবাই খেতে বসে। আদি রুমের দিকে অগ্রসর হয়।
বিছানার মাঝে সিমথির নির্জীব মুখটা দেখে আদির চোখ ভিজে উঠে। সিমথির উপর ঝুঁকে কপালে চুমু খায়।
আদি : আম সরি জান। তোকে আবারও কষ্ট দেবার জন্য। সত্যিই সরি।
চলবে,,,,
( ভুলক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ)