#ফিরে_আসা
৪৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
সিগারেটের ধোঁয়া ঘিরে রেখেছে আরশাদকে। ধোঁয়ার প্রখরতা ভেদ করে তার মুখটা দেখাও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ঠিক সামনেই বসে রয়েছেন ধানমন্ডি থানার ওসি হানিফ সাহেব। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা। ওই ম্যাসেজটা পাওয়ার পর এক মুহুর্তও অপেক্ষা করেনি আরশাদ। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছে পুলিশের ডিআইজিকে। ডিআইজি সাহেব আবার আরশাদের বিরাট ভক্ত। তার স্ত্রী নিখোঁজ এই সংবাদ শোনার পর তিনি হুলুস্থূল কান্ড বাঁধিয়েছেন।
আরশাদের হকের স্ত্রী নিখোঁজ, এই খবর সারা দেশে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার প্রতিটা রাস্তায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশ গাড়ি চেক না করে কাউকে ঢাকা ছাড়তে দিচ্ছে না। প্রতিটা থানায় পৌঁছে গেছে অরার ছবি। পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তাকে যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে বের করার। অরাকে যে কিডন্যাপ করা হয়েছে – এ বিষয়ে পুলিশের কোনো সন্দেহ নেই।
আরশাদ নিজেই পুলিশ স্টেশনে যেত, তার আগেই হানিফ সাহেব দলবল নিয়ে চলে এসেছেন বাড়িতে। ইতোমধ্যে সীমাও এ বাড়িতে চলে এসেছে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে। অরার মতো বুদ্ধিমতী একটা মেয়েকে কেউ কিডন্যাপ করে কী করে এটাই সীমার মাথায় খেলছে না। তার থেকেও বেশি রাগ লাগছে আরশাদের ওপরে। কোনো বিচার বিবেচনা না করে আগেই পুলিশ খবর দিয়েছে। পুলিশকে খবর দেওয়ায় কিডন্যাপার যদি অরার কোনো ক্ষতি করে ফেলে?
যে প্রাইভেট নম্বর থেকে ম্যাসেজটা এসেছিল, পুলিশ সেটা ট্রাক করার চেষ্টা করছে। অরার মোবাইল নম্বরটাও ট্রাক করা হচ্ছে। অরার মোবাইলটা কোনোক্রমে হাতে এলে সেখান থেকে কোনো ক্লু পাওয়া গেলেও যেতে পারে।
ওসি সাহেব কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে বললেন, “আপনার কি কোনো শত্রু আছে?”
কথাটা আরশাদের কর্ণকুহরে পৌঁছালেও জবাব দেওয়ার আগেই তার মস্তিষ্ক চিন্তায় ডুবে গেল। আসলেই তো! আরশাদের প্রচুর শত্রু আছে। সফল মানুষের শত্রুর অভাব হয় না। যারা তাদের সফলতা দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যায়, তারাই শত্রু। এমন কেউ চাইলেই তো অরার ক্ষতি করতে পারে। নিজের ওপর নিজেই রাগে জ্বলে উঠছে আরশাদ। তার উচিত ছিল অরার জন্যে বডিগার্ড রেখে দেওয়া। যে বডিগার্ড সর্বক্ষণ অরাকে চোখে চোখে রাখবে। আরশাদের বোঝা উচিত ছিল অরা এখন আর তার ম্যানেজার নয়, তার স্ত্রী। তার জীবনের সঙ্গে অরার জীবনটাও জড়িয়ে রয়েছে।
হানিফ সাহেব সংযত কণ্ঠে বললেন, “আরশাদ ভাই?”
আরশাদ সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “হুঁ?”
“আপনার কি কোনো শত্রু আছে যে ভাবিকে কিডন্যাপ করতে পারে? আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”
আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আমার শত্রুর অভাব নেই। স্পেসিফিকালি কারও নাম মনে পড়ছে না।”
হানিফ সাহেব কিছু একটা বলতে যাবেন তার আগেই একজন পুলিশ অফিসার এসে শুকনো মুখে বলল, “স্যার! নম্বরটা ট্র্যাক করা যাচ্ছে না।”
হানিফ সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “সেটাই তো স্বাভাবিক। কিডন্যাপার একটা সিম থেকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে সেই সিম নিশ্চয়ই আস্ত রাখবে না। তবে আমার ধারণা সে আবারও যোগাযোগ করবে। মুক্তিপণ দাবি করতে হলে তো…”
আরশাদ দৃঢ় কন্ঠে বলল, “আমার মনে হচ্ছে না মুক্তিপণের উদ্দেশ্যে ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এর পেছনে বড় কোনো উদ্দেশ্য আছে।”
সীমা এতক্ষণ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আরশাদের এ কথাটা শুনে ফিরে এসে তার পাশের সোফায় বসতে বসতে বলল, “আমারও তাই মনে হচ্ছে ভাইয়া। মুক্তিপণ দাবি করতে হলে তো প্রথম ম্যাসেজেই করতো। ওর উদ্দেশ্য মুক্তিপণ না, অরা।”
সীমার এই কথাটা শুনে তড়িৎ গতিতে রাগের স্রোত বয়ে গেল আরশাদের মস্তিষ্কে। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। রাগে তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। জ্বলন্ত সিগারেট দুমড়ে মুচড়ে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলল আরশাদ। সে নিজের চোখদুটো দেখতে পাচ্ছে না, তবে নিশ্চিত তারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। যে অরাকে কিডন্যাপ করেছে, সে জানে না কোথায় হাত দিয়েছে। ওই কিডন্যাপারকে একবার হাতে নাগালে পেলে তার অবস্থা ঠিক এই সিগারেটার মতো করবে আরশাদ। বসার ঘরে উপস্থিত সকলে দেখলো শান্ত-শিষ্ট, জেন্টেলম্যান আরশাদ হক রেগে গেলে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
আরশাদ উঠে গেলো দোতলায়। তার ঘরের উত্তর দেয়ালজুড়ে বিশাল এক ছয় দরজার আলমারি। আলমারির রঙ ধবধবে সাদা। যদিও এ বাড়িতে আরশাদ জামা-কাপড় রাখার জন্যে আস্ত একটা ঘর রয়েছে, তবুও এখানে তার কিছু পছন্দের জামা-কাপড় রাখা হয়। দৃপ্ত পায়ে হেঁটে আমারির দিকে এগিয়ে গেল আরশাদ। পকেট থেকে চাবিটা বের করে তৃতীয় দরজা খুলে নিলো। এই দরজার পেছনে মাঝামাঝি অবস্থানে একটা ড্রয়ার রয়েছে। ড্রয়ারটা খুলল আরশাদ। তার টাইগুলো সুন্দর করে সাজানো এখানে। আর একরাশ টাইয়ের নিচেই জিনিসটা লুকানো।
বের করে আনলো সেই জিনিস আরশাদ। ক্যারিয়ারের প্রথম কয়েকটা সিনেমা হিট হওয়ার পরেই আরশাদ যখন সুপারস্টার খেতাব পেয়ে যায়, তখন আত্মরক্ষার জন্যে একে কেনা হয়েছিল। আজও ঠিক প্রথম দিনের মতো ঝলমল করছে।
আবারও আরশাদের হাত ফিরে গেল পকেটে। নিজের মোবাইল বের করে এনে ধীরে-সুস্থে ডায়াল করলো নম্বরটায়। আরশাদ জানে না অরা কোথায়। তবে কেন জানি তার অবচেতন মন বারবার বলছে অরার কিডন্যাপের পেছনে এই মানুষটার কোনো না কোনো ভূমিকা আছে। নওশীন। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্যে সে সব পারে। নওশীন কতটা ভয়ঙ্কর সেটা আর কেউ না জানলেও আরশাদ জানে। তবে সে হয়তো ভুলে গেছে, প্রয়োজনে আরশাদ তার থেকেও অধিক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।
কয়েকটা রিং বাজতেই কল রিসিভ করলো নওশীন। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “অরা কোথায়?”
একটু যেন ভড়কে গেল নওশীন। ঠিক এই প্রশ্নটা আশা করছিল না আরশাদের কাছ থেকে।
নওশীন বিভ্রান্ত গলায় বলল, “এসব তুমি কী বলছো শাদ? আমি কী করে জানবো ওই মেয়েটা কোথায়?”
আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “তাহলে আমার সিক্সথ সেন্স কেন বলছে এর পেছনে কোনো না কোনো ভাবে তুমি জড়িত?”
নওশীন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল, “তোমার সিক্সথ সেন্স তো ধরেই নিয়েছে আমি পৃথিবীর সবথেকে খারাপ মানুষ। আমাকে ছাড়া আর কার কথা মাথায় আসবে তোমার? আমার অত সময় নেই তোমার সো কল্ড ওয়াইফকে কিডন্যাপ করার।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “সো কল্ড না? নওশীন ভুলে যেও না, আমার লাইসেন্স করা রাশিয়ান পিস্তলটা এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছি। কখনো ব্যবহার করিনি তো কী হয়েছে? সময় এলে অবশ্যই করবো।”
“ভয় দেখাচ্ছো আমাকে?”
“না। সাবধান করছি। তুমি জড়িত থাকলে এখনি বলে দাও। যদি কোনমতে জানতে পারি তুমিই অরাকে কিডন্যাপ করেছো, তাহলে আমিই হবো পৃথিবীর সবথেকে খারাপ মানুষ।”
দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা আর উদ্বেগের মাঝে কেটে গেল একটি রাত। গোটা একটা রাত অরা বাড়ির বাইরে। অচেনা কারও কাছে বন্দী হয়ে আছে। সে কি ঠিক আছে? তার কি কষ্ট হচ্ছে? আরশাদ কিছুই জানে না। সারারাত ধরে অশান্ত মনটা ছটফট করেছে কেবল।
পুলিশ ইতোমধ্যেই তার কাজেকর্মে বহুদূর এগিয়ে গেছে। অরার ফোনের শেষ লোকেশন ধানমন্ডি ২৭ এর ব্যস্ত রাস্তায়। আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ঠিক এখান থেকে গতকাল বিকেলে অরাকে কিডন্যাপ করা হয়। মুখোশ পরিহিত একটা লোক টেনেহিঁচড়ে তাকে মাইক্রোবাসে তোলে। বিশাল একটা ক্লু। এই একটা মাত্র ক্লু ধরে এগোলেই অরাকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। পুলিশ রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ যোগাড় করছে।
রাস্তার মোড়ে এক পান-সিগারেটের দোকানদার দেখেছে কিডন্যাপার যখন অরাকে টেনেহিঁচড়ে মাইক্রোবাসে তোলার চেষ্টা করছিল তখন তার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা রাস্তায় পড়ে যায়। আর এক শ্রেণীর বাঙালির চৌর্যবৃত্তির অভ্যাস তো দীর্ঘদিনের। একটা মেয়েকে ব্যস্ত রাস্তায় তুলে নিয়ে যাওয়া হলো, কেউ এগিয়ে এলো না। অথচ তার ফোন রাস্তায় পড়ে থাকায় ঠিকই কেউ একজন চুরি করে নিয়ে গেছে।
চোরকে খুঁজে বের করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না পুলিশকে। তাকে পাওয়া গেল গুলিস্তান এলাকার চোরাই মার্কেটে। অরার ফোনটাও সেখান থেকে উদ্ধার করা হলো। হাত থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাওয়ায় ফোনের ডিসপ্লে ভেঙে গেছে। পুলিশ আপাতত সেটা সারাতে ব্যস্ত। ফোনটা একবার সারাতে পারলেই এখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসবে।
গত রাতে আরশাদের কল পাওয়ার পর থেকে ঝিম মেরে বসে রয়েছে নওশীন। আরশাদ কি তাকে রাশিয়ান পিস্তল দিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিলো? তাও আবার একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের জন্য? নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে নওশীনের। সব দোষ তার। ভালোমানুষী করে ওই মেয়েটাকে এতিমখানা থেকে তুলে না আনলে আজ এত এত ঝামেলার সৃষ্টি হতো না। খুব শখ তার আরশাদ হকের বউ হবার। নওশীন যদি সেদিন ওই এতিমখানায় না যেত তাহলে আজও সেখানেই পড়ে থাকতে হতো তাকে, পেটেভাতের শিক্ষিকা হয়ে।
নওশীনের ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে অপরিচত নম্বর। মোটেও বিচলিত হলো না নওশীন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রিসিভ করলো ফোনটা।
অপরপ্রান্তের ব্যক্তি কিছু বলে ওঠার আগেই নওশীন থমথমে গলায় বলল, “সাবের? সব ঠিকঠাক?”
“জি।”
“খেয়াল রাখবে মেয়েটা যেন কোনমতে পালিয়ে যেতে না পারে।”
সাবের আশ্বাস দিয়ে বলল, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ওকে যে ঘরটাতে রেখেছি সেখানে কোনো জানালা নেই। একটা মাত্র দরজা। তার ওপরে আবার চেয়ারের সঙ্গে হাত পা বেঁধে রেখেছি। পালানোর কোনো উপায় নেই।”
“ভেরি গুড। শোনো, প্ল্যানে একটা চেঞ্জ এসেছে।”
“কী চেঞ্জ?”
নওশীন নির্দেশের ভঙ্গিতে বলল, “তোমাদের লোকেশন শিফট করতে হবে। যেখানে আছো সেটা নিরাপদ হলেও আমি ভরসা পাচ্ছি না। ওখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে আরেকটা পরিত্যক্ত বাড়ি আছে। মেয়েটাকে নিয়ে সেখানে চলে যাও।”
“এখন ওকে নিয়ে যাবো কী করে?”
নওশীন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “যেভাবে ঢাকা থেকে নিয়ে গিয়েছ। অজ্ঞান করে। শোনো সাবের, পুলিশ কিন্তু হন্তদন্ত হয়ে মেয়েটাকে খুঁজছে।”
সাবের বিচলিত গলায় বলল, “আপনি তো বলেছিলেন পুলিশ কিছুতেই আমাদের খুঁজে পাবে না।”
“সেটা তো এখনও বলছি। বাড়তি সতর্কতার জন্য লোকেশন শিফট করতে বলছি।”
“জি আচ্ছা। আমাদের ওখানে কতদিন থাকতে হবে?”
“খুব বেশি হলে আর একটা দিন। এরমধ্যেই তোমাদের পাসপোর্ট রেডি হয়ে যাবে।”
সাবের ছেলেটা বেশ কাজের। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নওশীন তাকে যতগুলো নির্দেশ দিয়েছে, তার সবই ঠিক ঠিক পালন করেছে সে। তিতিলির প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন ফার্মের বদৌলতে সাবেরকে তার খুঁজে পাওয়া। ভার্সিটির ক্যাম্পাসের সবাই না-কি সাবেরের নাম দিয়েছে লুজার রোমিও। একটা সময়ে অরার সঙ্গে বেশ ভাব ছিল, তবে এখন ছেলেটা তার চোখের বিষ। কেউ জানে না ঠিক কী কারণে অরা তাকে আর সহ্য করতে পারে না। কারণটা অবশ্য নওশীনও জানতে চায় না। সে এমন একজনকে খুঁজে পেয়েছে, যার দুর্বলতা অরা। এটাই অনেক।
মাস দুয়েক আগের ঘটনা। নওশীন ডেকে পাঠায় সাবেরকে। সেলিব্রিটির কাছ থেকে ডাক পেয়ে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও শেষমেশ দেখা করতে আসে সাবের।
নওশীন কোনপ্রকার ভনিতা না করে বলল, “তুমি অরাকে ভালোবাসো?”
সাবের থতমত খেয়ে বলল, “জি।”
নওশীন বাঁকা হাসি হেসে বলল, “সে এখন অন্য আরেকজনের স্ত্রী। তবুও ভালোবাসো তাকে?”
“জি।”
নওশীন ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার নিখুঁত অভিনেত্রীর মুখোশটা পড়ে বলল, “তোমার অরাকে যে বিয়ে করেছে তাকে আবার আমি ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি।”
সাবের ইতস্তত করে বলল, “আমাকে এখানে কেন ডেকেছেন?”
নওশীন নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “একটা ডিল করতে।”
“ডিল?”
“হুঁ। এই ডিলে অরা তোমার আর শাদ আমার। তোমাকে শুধু আমার কথা মতো কাজ করতে হবে।”
“মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“বুঝতেও হবে না। শুধু আমার কথামতো কাজ করলেই হবে। তবেই তো তুমি অরাকে পাবে।”
প্রায় অনেকটা সময় চুপ করে থেকে সাবের বলল, “কী করতে হবে আমাকে?”
নওশীন গুছিয়ে বলতে লাগলো, “প্রথমত অনেকগুলো সিম কিনতে হবে তোমাকে। তবে ভুলেও নিজের নামে সিমগুলো রেজিষ্টার করবে না। ভুয়া নামে করবে। সেই সিমগুলো ব্যবহার করে একমাস ধরে অরাকে কল করবে। বেশি না, দিনে-দুদিনে একবার করে। প্রথম প্রথম অরা ফোন রিসিভ করার পর চুপ করে থাকবে, কথা বলবে না। অনেকগুলো সিম কিনতে বলছি কারণ অরা নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে তোমার প্রতিটি নম্বর ব্লক করে দেবে। এরপর আমি যেদিন বলবো সেদিন ওকে ফোন করে প্রথমবারের মতো কথা বলবে।”
“কী বলবো?”
“ব্ল্যাকমেইল করবে।”
“কীভাবে?”
“সেটা নিয়ে তোমাকে আপাতত ভাবতে হবে না। যথাসময়ে শিখিয়ে দেওয়া হবে। ব্ল্যাকমেইল করে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ডাকবে ওকে।”
সবার আঁতকে উঠে বলল, “আমি বললেই কী চলে আসবে না-কি? তাছাড়া আমার ভয়েস অরা চেনে।”
“ভয়েস কোনো ব্যাপার নয়। আজকাল অনেক অ্যাপ বের হয়েছে সেগুলো ব্যবহার করে নকল কণ্ঠে ফোনে কথা বলা যায়। ওগুলোর একটা ব্যবহার করে নিও। আর তুমি বললেই অরা আসবে না, এমনভাবে ব্ল্যাকমেইল করবে যে অরা আসতে বাধ্য হবে। সেখান থেকে ওকে কিডন্যাপ করবে।”
সাবের বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “কিডন্যাপ?”
নওশীন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলল, “চমকে ওঠার কী হলো?”
“কিডন্যাপ করবো? কী করে?”
“সেটা তো আমি শিখিয়ে দিতে পারবো না।বেশি বেশি করে থ্রিলার সিনেমা দেখে শিখে নিও।”
“আমি তো আপনার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না। একবার বলছেন ব্ল্যাকমেইল, এখন আবার কিডন্যাপ। শুধু শুধু কিডন্যাপ করতে যাবো কেন?”
“কিডন্যাপ না করলে কী করে পাবে ওকে?”
“কিন্তু আমি একা কিডন্যাপ করবো কী করে?”
“তোমাকে একটা মাইক্রোবাস দিয়ে দেওয়া হবে। একজন লোক ওটা চালাবে। তোমার কাজ হবে ওকে টেনে-হিচড়ে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে গাড়িতে উঠানো।”
“মাঝপথে যদি পুলিশ ধরে?”
নওশীন বিরক্তির চূড়ায় পৌঁছে বলল, “পুলিশ ধরলে বলবে এটা আমার বউ। ঘুমিয়ে পড়েছে। বলতে পারবে না?”
নওশীনের এমন ঝাঁঝালো কণ্ঠে চুপসে গেল সাবের।
নওশীন আবারও বলল, “গাজীপুরের গহীন জঙ্গলে একটা বাড়ি তোমাদের জন্য রেডি থাকবে। অরাকে নিয়ে সেখানে থাকবে কিছুদিন।”
“কিছুদিন?”
“খুব বেশি না। বড়জোর দুয়েক দিন। এরমধ্যে আমি তোমাদের নকল পাসপোর্ট আর ভিসা রেডি করে ফেলবো। সেগুলো নিয়ে তোমরা বর্ডার পাড় করে যাবে।”
সাবের চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল নওশীনের দিকে। প্রতিটা কথাই যেন তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
নওশীন আশ্বস্ত করে বলল, “চিন্তা কোরো না। আগামী দুই বছর হেসেখেলে কাটিয়ে দেওয়ার মতো টাকা আমি তোমাকে দিয়ে দেবো। তুমি শুধু ওই মেয়েটাকে আরশাদ হকের জীবন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে। পারবে না?”
টাকার কথা শুনেই সাবেরের মুখভঙ্গি বদলে গেল। ভয়-জড়তা কেটে দিয়ে বিচিত্র এক উজ্জ্বলতার দেখা মিলল তার চোখে।
সাবের দৃঢ় কন্ঠে বলল, “অবশ্যই পারবো। কিন্তু একটা কথা।”
“আবার কী?”
“আমি যখন অরাকে নিয়ে বর্ডার পাড় করে যাবো তখনও তো ও আরশাদ হকের স্ত্রী থাকবে। তার আগে কি কোনমতে ডিভোর্সটা করিয়ে নেওয়া যায় না?”
নওশীন বিরক্ত গলায় বলল, “তুমি একটা আধুনিক ছেলে হয়ে বিয়ে নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছো কেন? ওকে নিয়ে বর্ডার পাড় করে অন দেশে সারাজীবন একসাথে থাকতে পারছো এটাই তো অনেক।”
সিসিটিভি ফুটেজের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশাদ। ভরা রাস্তায় অরাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিচ্ছে মুখোশ পরিহিত কেউ। অরা প্রাণপণ নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। আরশাদ পুলিশ স্টেশনে পা রাখার পর থেকে কারও মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হয়নি। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি পুরো পৃথিবীটাকে পুড়িয়ে ফেলবে নিজের রাগ দিয়ে। প্রচন্ড রাগে হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল আরশাদ।
আরশাদ পুলিশ স্টেশনে এসেছে শুনে সীমাও ছুটে এসেছে সঙ্গে সঙ্গে। অরার জন্যে দুশ্চিন্তা তার নেহায়েত কম হচ্ছে না।
আরশাদ গম্ভীর গলায় ওসি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আর অরার ফোন থেকে কিছু পেলেন?”
হানিফ সাহেব বললেন, “হ্যাঁ পেয়েছি। প্রায় এক মাস যাবত বিভিন্ন আননোন নম্বর থেকে ফোন আসছিল।”
মনে মনে কিছুটা অবাক হলো আরশাদ। এক মাস যাবত অরার ফোনে আননোন নম্বর থেকে ফোন আসছে? কই! আরশাদ তো কিছুই জানে না। এমন তো নয় যে গত এক মাসে তাদের মধ্যে বস-ম্যানেজারের সম্পর্ক ছিল। এই মাসটায় দুজনের একে অপরের সঙ্গে কাটিয়েছে দীর্ঘ সময়। তাহলে এত বড় একটা কথা কেন গোপন করলো অরা?
হানিফ সাহেব আবারও বললেন, “আমরা ধারণা করছি এই কিডন্যাপই তাকে ভয় দেখাচ্ছিল। কারণ যতবারই ভাবি ফোন রিসিভ করেছিলেন, ততবারই সে কোনো কথা বলেনি। শেষ কলটা আসে গতকাল বিকেলে। মূলত গতকালই কিডন্যাপার তাকে ফোন করে ব্ল্যাকমেইল করে। কল রেকর্ডও আমরা বের করেছি। চলুন আপনাদের শোনাই।”
ফোনের পুরো কথোপকথন মন দিয়ে শুনলো আরশাদ। অরার ভড়কে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যেসকল তথ্য দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে, ওই তথ্য খুব কম মানুষের কাছে আছে। আরশাদ আর অরার বিয়ের সত্যতা জানে এমন কেউই কি তাহলে অরাকে কিডন্যাপ করলো? আরশাদ কি তাহলে এতক্ষণ শুধু শুধু নওশীনকে সন্দেহ করছিল?
তাদের বিয়ের সত্যতা জানে কেবল তিনজন মানুষ। তুফান, মেহেদী এবং হিমেল। তুফান আরশাদের বডিগার্ড, সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকে। এমনকি এখনও থানার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে এই কাজ করবে কী করে? মেহেদী অরাকে বড় বোনের চোখে দেখে। সেও এই কাজ করবে না। বাকি রইল কেবল হিমেল। কিন্তু হিমেলই তো আগ বাড়িয়ে বিয়েটার ব্যবস্থা করলো। সে কেন অরাকে কিডন্যাপ করতে যাবে। মাথায় কিছুই খেলছে না। সবার আগে জানতে হবে এই রোবোটিক কণ্ঠস্বরের পেছনে কে রয়েছে।
আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “এই ভয়েসটা থেকে আসল ভয়েস বের করা যাবে না?”
ওসি সাহেব জোর গলায় বললেন, “অবশ্যই যাবে। কাজ চলছে।”
কয়েক ঘন্টা পর পুলিশ ওই এনক্রিপ্টেড ভয়েস থেকে আসল ভয়েসটা বের করলো সক্ষম হলো। আরশাদ নিশ্চিত হলো এটা হিমেলের কণ্ঠস্বর না। তবে সীমা আঁতকে উঠে বলল, “ভাইয়া! এটা তো সাবেরের কণ্ঠ!”
আরশাদ অবাক স্বরে বলল, “সাবের?”
নিজের তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির কারণে কিছুই ভুলে যায়নি আরশাদ। তার স্পষ্ট মনে আছে অরা সাবের নামের একটা ছেলের কথা তাকে বলেছিল। যে ছেলেটা তার সঙ্গে বিশ্বাসাতকতা করেছে। তাহলে শেষ পর্যন্ত এই সাবেরই? কিছুই বুঝতে পারছে না আরশাদ। কাকে রেখে কাকে সন্দেহ করবে তার মাথায় ঢুকছে না। অরার ক্ষতি করার জন্যে যে এত এত মানুষ উদগ্রীব হয়ে ছিল, কে জানত?
(চলবে)
#ফিরে_আসা
৪৮+৪৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
গহীন অরণ্যে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। পুরো জঙ্গলটা ঘিরে রেখেছে তারা। সবটাই করা হচ্ছে অনুমানের ভিত্তিতে। অরা আদৌ এই জঙ্গলে আছে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী মূল রাস্তায় মাইক্রো বাসটা এসে থামে। তারপর সাবের অরাকে একটা অটোরিকশায় তুলে নেয়। সিসিটিভি ফুটেজে অটোরিকশা ট্র্যাক করা সম্ভব হয়নি। কারণ সেই অটোরিকশার পেছনে নেই কোনো নম্বর প্লেট। আর এই এলাকার সব অটোরিকশা একই রকম দেখতে। তবে পুলিশের ধারণা এই জঙ্গলেই কোথায় অরাকে লুকিয়ে রেখেছে সাবের।
কিছুটা দূরে নিজের গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে লম্বা একটা টান দিলো আরশাদ। পুলিশ অরাকে খুঁজতে এত দূর পর্যন্ত চলে এসেছে, অথচ সে ঘরে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে তা তো হতে পারে না। যদিও জঙ্গল সব একই রকম দেখতে, তবুও কেন জানি আরশাদের বারবার মনে হচ্ছে এই জায়গাটায় সে এর আগেও এসেছে।
টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে পুলিশের এই অভিযান। নওশীন তা দেখে যেন বাড়তি সজাগ হয়ে গেল। কথা ছিল আজ রাতের অন্ধকারে সাবের অরাকে নিয়ে বর্ডার পাড় হয়ে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা হবে নিতান্তই বোকামির কাজ। নওশীন হন্তদন্ত হয়ে ডায়াল করলো সাবেরের নম্বরে।
সাবের ফোন রিসিভ করতেই নওশীন ব্যস্ত গলায় বলল, “সাবের! তোমাদের এক্ষুনি বের হতে হবে।”
সাবের অবাক হয়ে বলল, “এখন? এখন তো কেবল বিকেল!”
নওশীন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “পুলিশ তোমাদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। একবার ধরা পড়ে গেলে কী হবে বুঝতে পারছো? শাদ ওই মেয়েটাকে তো পেয়েই যাবে, সাথে সাথে তোমাকেও জেলে যেতে হবে!”
সাবের ভয়ার্ত গলায় বলল, “আমাকে জেলে যেতে হবে কেন? এসব প্ল্যান তো আপনার।”
নওশীন বাঁকা হাসি হেসে বলল, “পুলিশ তোমার কথা বিশ্বাস করবে কেন?”
সাবের ভয়ে থতমত খেয়ে গেল। আসলেই তো। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেলে পুলিশ কি বিশ্বাস করবে এতসব প্ল্যানের পেছনে রয়েছে নওশীন?
নওশীন বলল, “এত চিন্তা করে লাভ নেই সাবের। পুলিশ তোমাদের ধরতে পারবে না। তার আগেই তোমরা বহুদূর পৌঁছে যাবে।”
সাবের কথাগুলো বলছিল অরার ঠিক সামনে বসে। সাবেরের মোবাইলটা এমন, লাউডস্পিকারে না রাখলেও পাশে থাকা মানুষটা অপরপ্রান্তের কথা শুনতে পারে। অরার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। তাহলে নওশীন সাবেরকে দিয়ে এই জঘন্য কাজটা করাচ্ছে? কিন্তু কেন? কোন উদ্দেশ্যে? নওশীন কি চাইছে আরশাদের জীবন থেকে অরাকে সরিয়ে দিতে? হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অরার মস্তিষ্কে। প্রশ্নগুলোর উত্তর কি আদৌ সে কোনোদিন পাবে? সাবের যদি আজ সত্যি সত্যি তাকে আরশাদের থেকে বহুদূরে নিয়ে যায়?
ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। অরা স্পষ্ট শুনেছে নওশীন বলেছে, পুলিশ না-কি কাছাকাছিই আছে। বেশি দেরি করলে সাবের ধরা পড়ে যাবে তাদের হাতে। তাহলে দেরিটাই করতে হবে। যতটা সম্ভব সময় নষ্ট করতে হবে। যাতে সাবের কিছুতেই তাকে নিয়ে বেশিদূর না যেতে পারে। তার আগেই যাতে পুলিশ পৌঁছে যায়।
আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। দূরে কোথাও থেকে বজ্রপাতের শব্দ ভেসে আসছে। ঝুম বৃষ্টি নামার আশঙ্কা। তবুও নিরলসভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ফলস্বরূপ একটা পরিত্যক্ত বাড়ি খুঁজে পেল তারা। বাড়িতে কোনো জনমানব নেই। তবে মেঝেতে এলোমেলভাবে ছড়িয়ে আছে কতগুলো জিনিস। একটা কাঠের চেয়ারের নিচে ক্লোরোফর্মের বোতল, দড়ি, কাপড়ের টুকরা, স্কচটেপ। এগুলো দেখে পুলিশের বুঝতে বাকি রইল না এখানে কাউকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। মূলত এই বাড়িতেই সাবের সর্বপ্রথম এনেছিল অরাকে। পরবর্তীতে নওশীনের নির্দেশনায় লোকেশন শিফট করে সে। নওশীনের অভিজ্ঞ মস্তিষ্ক সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছিল পুলিশ এই জায়গাটা ঠিকই খুঁজে পাবে।
চেয়ারের নিচে পড়ে থাকা জিনিসগুলোর দিকে চোখ আটকে আছে আরশাদের। অরাকে এতটা কষ্ট দিয়েছে ওই সাবের? কিংবা এখনো দিচ্ছে? তীব্র রাগে লম্বা একটা শ্বাস নিলো আরশাদ। ওই সাবেরকে শুধু একবার হাতে পেলে তার অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়বে সে।
চেয়ার থেকে কিছুটা দূরে চকচকে একটা জিনিস নজর কেড়ে নিলো আরশাদের। আরশাদ ধীর পায়ে অগ্রসর হলো সেটার দিকে। চকচক করছে অরার আংটি। এতক্ষণ মনে সামান্য অনিশ্চয়তা থাকলেও এখন সেটা নেই। অরাকেই এখানে কিডন্যাপ করে আনা হয়েছিল। মুঠোয় পুরে নিলো আংটিটা আরশাদ। সে কখনো হারতে শেখেনি। আজও হারবে না। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ঠিকই খুঁজে বের করবে সে।
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। জঙ্গলের দুই-মানুষসমান গাছগুলো বাতাসের তীব্রতায় এপাশ থেকে ওপাশে হেলে পড়ছে। সেসবে তোয়াক্কা না করে আরশাদ বেরিয়ে এলো বাড়িটা থেকে। ভালো করে চোখ বোলাতে লাগলো আশপাশটায়। এই জায়গাটাকে কেন পরিচিত বলে মনে হচ্ছে? সে কি আগে কখনো এসেছে এখানে?
মাঝারি সাইজের কুচকুচে কালো চামড়ার একটা ব্যাগ। চওড়া হাসি হেসে ব্যাগের চেইন এক টানে খুলে ফেলল সাবের। ব্যাগ বোঝাই হয়ে আছে টাকার বান্ডিলে। দু হাতে দুটো বান্ডিল তুলে আনলো সাবের। তার মুখের হাসি যেন বেড়েই যাচ্ছে। এক এক করে দুটো বান্ডিলের গন্ধ শুকলো সে। নতুন টাকার গন্ধ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নেশাদ্রব্য। একবার শুকলে আজীবন এই গন্ধে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়।
সাবের অরার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসি নিয়ে বলল, “কী অরা? আমাকে খুব লোভী ভাবছো?”
অরা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চুপ করে রইল। অরা বলতে চাইলেও তার উপায় নেই। তার মুখের ওপরে জোরালো স্কচটেপ।
সাবের আবারও হাসি হাসি গলায় বলল, “আমি লোভী না সুইটহার্ট। তোমাকে পেয়েছি এটাই অনেক। টাকা-পয়সা নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। পরে ভেবে দেখলাম, নতুন একটা জায়গায় যাচ্ছি। নতুন করে সংসার পাতবো, টাকা-পয়সা তো লাগবেই। তাই নিলাম। ভালো করেছি না সুইটহার্ট?”
ঘৃণায় অরার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে। ঘৃণাটা সাবেরের ওপরে নয়, নওশীনের ওপরে। একটা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হলে এমন কাজ করতে পাবে? একে তো অরাকে কিডন্যাপ করানোর প্ল্যান করেছে, তার ওপরে আবার তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সাবেরকে টাকা দিয়েছে! সে কী ভেবেছে? অরা আরশাদের জীবন থেকে চলে গেলেই, আরশাদ সব ভুলে তাকে আপন করে নেবে?
সাবের ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলল, “এবার আমাদের বের হতে হবে বুঝলে অরা। তোমাকে বেঁধে রেখেছি বলে খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? চিন্তা করো না, এই শেষ। জীবনে আর কোনোদিনও তোমাকে কষ্ট পেতে দেবো না আমি।”
কথাগুলো বলতে বলতে সাবের অরার পায়ের বাঁধন খুলে ফেলল। অরা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না। তড়িৎ গতিতে তার হাই হিল দিয়ে সজোরে সাবেরের এমন একটা জায়গায় লাথি মারলো, যেখান আঘাত পেলে পুরুষের পুরো দুনিয়া ঘুরে যায়।
সাবের ঝড়ের বেগে ছিটকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বলল, “তোর এত বড় সাহস! একবার এখান থেকে চলে যাই, দেখিস তোর কী অবস্থা করি আমি!”
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে সাবের ঘরের বাইরে চলে গেল। অরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক! কিছুটা সময় এখানে নষ্ট হবে। এর ফাঁকে পুলিশও এগিয়ে আসবে তাদের কাছাকাছি। অরা মনে মনে প্রার্থনা করছে সাবের যেন তার লক্ষ্যে সফল না হয়। কিছুতেই যেন তাকে নিয়ে দূরে কোথাও যেতে সক্ষম না হয়।
নওশীনের কাছ থেকে আজ সকালে যে লোকটা টাকা নিয়ে এসেছে তার নাম হাসু মিয়া। হাসু মিয়া নওশীনের বাড়ির বিশ্বস্ত কেয়ারটেকার। এখান থেকে বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছানো বড়ো ভেজালের কাজ। দুয়েকবার নৌকা বদল করতে হবে। বাসে উঠে আবারও নৌকায় কিছু পথ যেতে হবে। এতসব ভেজালের কাজ সাবের একা পারবে না বলে হাসুকে পাঠিয়ে দিয়েছে নওশীন।
সাবেরকে ব্যথায় কাতরাতে দেখে হাসু মুখ টিপে টিপে হাসছে।
সাবের আহত গলায় বলল, “আপনি হাসছেন হাসু ভাই?”
হাসু হাসতে হাসতেই বলল, “হাসমু না? তুমি মিয়া একটা মাইয়া মানুষের কাছে লাথি খাইলা? তাও আবার যে মাইয়ার হাত-পা বান্ধা।”
সাবের গম্ভীর গলায় বলল, “অরা অন্য মেয়েদের মতো না। এই মেয়ে ডেঞ্জারাস।”
“মাইয়া মানুষ মানেই ডেঞ্জারাস। আমাগো নওশীন ম্যাডাম কম ডেঞ্জারাস না-কি? দেখলা না? কেমনে স্বামীর দুই নাম্বার বউরে সরায় দিতেছে?”
সাবের চুপ করে রইলো।
হাসু কী যেন ভেবে হালকা গলায় বলল, “তয়, পুরুষ মানুষ যখন ডেঞ্জারাস হয়, তখন তার সামনে ডেঞ্জারাস মাইয়া মানুষ ফিকা পইড়া যায়।”
“বুঝলাম না।”
“আরশাদ স্যারের কথা বলতেছি আর কি। বাপ রে বাপ! কী রাগ তার! একবার রাইগা গেলে চোখ দিয়াই মানুষকে শেষ কইরা দেয়।”
সাবেরের মনে কিছুটা হলেও ভয় ঢুকে গেল। যদি সত্যি সত্যিই আরশাদের হাতে ধরা পড়ে যায় সে? না, না! এসব কী ভাবছে সে? ধরা পড়তে যাবে কেন?
হাসু শুকনো গলায় বলল, “তোমারে একটা বুদ্ধি দিবো?”
“কী বুদ্ধি?”
“আমার বুদ্ধি মানতেই হইবো এমন কোনো কথা নাই। তারপরেও বুদ্ধিটা দিয়া রাখলাম।”
“কী বুদ্ধি বলবেন তো!”
হাসু নিচু গলায় বলল, “এইখানে ঘাপটি মাইরা বইসা থাকো। বর্ডারের ধারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা কইরো না।”
সাবের হতবাক হয়ে বলল, “কী বলছেন এইসব?”
“ঠিকই বলতেছি। এইখানে ধরা পড়লে বলতে পারবা নওশীন ম্যাডাম জোর কইরা তোমারে দিয়া কিডন্যাপ করাইছে। তোমার কোনো দোষ নাই। এইভাবে বাঁচলেও বাঁচতে পারো। তয়, দূরে গিয়া ধরা পড়লে তুমি শেষ।”
“কী যে বলেন হাসু ভাই! ধরা পড়বো কেন?”
“টিভি-ঠিভি কিছু তো দেখো না মিয়া। প্রায় পঞ্চাশজন পুলিশ এই জঙ্গলে ঘুরঘুর করতেছে।”
সাবের ঢোক গিলে বলল, “বলেন কী? তাহলে তো আমাদের এখনই বের হতে হবে?”
“আমার বুদ্ধিটা শুনবা না তাইলে?”
সাবের জোর গলায় বলল, “না হাসু ভাই। আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই প্ল্যানে রাজি হয়েছি অরাকে পাবো বলে। এত কষ্ট করে শেষমেশ ওকে অন্য কারো হতে আমি দেবো না।”
নিশ্চুপ ভঙ্গিতে ড্রাইভ করছে আরশাদ। তার ডান হাত স্টিয়ারিং হুইলে, আর বাম হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। এটা যে আজকের কততম সিগারেট তার হিসাব সে হারিয়ে ফেলেছে। চেতনা আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না। মস্তিষ্কে শুধুমাত্র একটাই লক্ষ্য ভর করছে। অরাকে খুঁজে পাবার লক্ষ্য।
আরশাদের গাড়িকে অনুসরণ করছে পুলিশের একটি জিপ। বাকি পুলিশ সদস্যরা অভিযান অব্যাহত রেখেছে জঙ্গলে। আরশাদের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন ওসি হানিফ। যদিও এই অভিযানে তার আসবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ডিআইজি সাহেব নিজে এই কেসের ওপর নজর রাখছেন বলে এসেছেন। ওপর মহলের সুনজরে থাকতে কার না ভালো লাগে? তবে আরশাদের হাবভাব তার কাছে মোটেও ভালো ঠেকছে না। সেই তখন থেকে মুখে কুলুপ এঁটে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে একবারের জন্যেও বলছে না।
ওসি সাহেব সাহস করে মুখ খুললেন, “আরশাদ ভাই? আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
আরশাদ প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে বলল, “একটা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট রেডি করতে বলুন। আপনাদের কাজ অনেকটাই এগিয়ে থাকবে।”
ওসি সাহেব কিছু বুঝে না উঠে বললেন, “অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট? কার নামে?”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “নওশীন হক।”
হকচকিয়ে গেলেন ওসি সাহেব। নওশীন যে আরশাদের প্রাক্তন স্ত্রী এটা দেশের সকলেরই জানা। তবে আরশাদ কেন তার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট রেডি করতে বলছে? এই কেসের সঙ্গে কি তার কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে?
আরশাদ আবারও গম্ভীর গলায় বলল, “আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আমার কোনো শত্রু আছে কিনা! এই হলো আমার শত্রু।”
“আপনি কী করে এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন?”
আরশাদ জবাব না দিয়ে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো। শুরু থেকেই এই জঙ্গলটা তার কাছে পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল কারণ এখানে সে আগেও একবার এসেছিল। নওশীনের সঙ্গে। নওশীন ইন্টারনেটে বহু খোঁজাখুঁজি করে এই জঙ্গলে একটা পুরনো কাঠের বাড়ির সন্ধান পেয়েছিল। সেবারই ছিল শেষবারের মতো তাদের একসঙ্গে বেড়াতে আসা।
শুরু থেকেই আরশাদ নওশীনকে সন্দেহ করছিল। সন্দেহটা এবার আরও পাকাপোক্ত হলো। আরশাদ নিশ্চিত ওই বাড়িতে গেলেই খুঁজে পাওয়া যাবে অরাকে। যত দ্রুত সম্ভব ড্রাইভ করে সেই বাড়িটা খুঁজে পাবার চেষ্টা করছে আরশাদ। পুলিশের অভিযানের কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। নওশীন নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে নেই। সাবেরকে দিয়ে অরাকে সরিয়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছে।
নওশীনের সঙ্গে একটু বেশিই ভালোমানুষী করে ফেলেছে আরশাদ। এতকাল তার সকল নোংরামি আড়ালে রেখেছিল যাতে সমাজে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে নওশীন। তবে আর নয়। এবার আরশাদ সত্যি সত্যিই নওশীনের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষে পরিণত হবে। একবার শুধু খুঁজে পাক অরাকে, নওশীনের জীবনটাই সে ছারখার করে দেবে।
অরাকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করলো সাবের। ক্লোরোফর্মের অভাবে এবার আর অজ্ঞান করতে পারলো না তাকে। আকাশ ফেটে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে ধরণীর বুকে। বৃষ্টিতে ভিজতে অরার চিরকালই ভালোবাসে। তবে আজ যেভাবে ভিজতে হচ্ছে, সেটা তার মোটেই সহ্য হচ্ছে না। সাবের জোর করে তার হাতদুটো নিজের মুঠোয় পুরে রেখেছে। অরা বারবার নিজের হাতের ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে তার শক্তির কাছে হেরে যাচ্ছে।
অরা এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক চুলও নড়ছে না। সাবের তার হাতদুটো ধরে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে চাইছে তবে সাবের তার মুখে শক্ত করে গামছা বেঁধে রেখেছে। সাবের শক্তি প্রয়োগ করলেও অরার সঙ্গে পেরে উঠছে না। টানাটানির কারণে অরার জামার পেছনের অংশ বেশ অনেকটাই ছিঁড়ে গেল। তীব্র ভয় আকড়ে ধরলো অরাকে। এবার কি সে সত্যিই চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে?
এই কাঠের বাড়ির ঠিক পেছনেই জঙ্গলাবৃত একটা নদী। নদী পাড় করে ওপাড়ে গিয়ে খানিকক্ষণ হাঁটতে হবে। তারপর আরও একটা নদী পাওয়া যাবে। কোনোমতে টেনেহিঁচড়ে অরাকে নদীর কাছে নিয়ে এলো সাবের। মেয়েটার হাত বাঁধা, মুখ বাঁধা – তবুও এত তেজ কোথা থেকে আসছে কে জানে? নৌকার কাছে এসে অরাকে ছইয়ের ভেতরে ফেলে দিলো সাবের।
আছড়ে পড়ার কারণে অরার কপাল কেটে রক্ত বেয়ে পড়তে লাগলো। ব্যথায় তার কোনো তোয়াক্কা নেই। ভয়ে আর আতঙ্কে সে জমে পাথর হয়ে আছে।
হাসু মিয়া নৌকায় উঠতে উঠতে বলল, “মাঝি ভাই! জলদি চলো।”
মাঝি উদাস গলায় বলল, “বারিশ থামলে যাই?”
হাসু ব্যস্ত গলায় বলল, “আরে না না! আমাগো সময় নাই। তাড়াতাড়ি চলো।”
অরার শুকনো গলা আরেকটু শুকিয়ে এলো। এরা তাহলে সত্যিই তাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে বহুদূর। সে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। আরশাদও এলো না শেষমেশ তাকে বাঁচাতে। ভালোবাসার মানুষটার ওপর আস্থা রেখে তাহলে কি ভুল করলো অরা?
তার মাথা আর কিছুতেই কাজ করছে না। শুধুমাত্র মনে হচ্ছে সে কোনো পণ্য নয়, যে কেউ চাইলে তাকে কিডন্যাপ করে নিজের করে নিতে পারে না। এ জীবন থাকতে সে কিছুতেই নিজেকে সাবেরের কাছে সপে দেবে না। সাবের যদি অরাকে পেতেই চায়, তবে সে যা পাবে তা হলো অরার লাশ।
সাবের ও হাসু মিয়া ওদিকে মাঝির সঙ্গে কী যেন কথা বলছে। অরার সামনে আপাতত কেউ নেই। শরীরটা ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে, তবুও বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালো অরা। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেল নৌকার পাটাতনের দিকে। পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে জলের দিকে তাকালো অরা। তীক্ষ্ণ শূলের গতিতে বৃষ্টির ফোঁটা নদীর ওপর আছড়ে পড়ছে। যদিও সে সাঁতার জানে, তবুও একবার নদীতে পড়ে গেলে নিজেকে বাঁচানোর কোনোপ্রকার চেষ্টা করবে না। ডুবে যাবে গহীনে। সাবেরের সঙ্গে দূর দেশে হারিয়ে যাওয়ার থেকে এভাবে হারিয়ে যাওয়া ঢের ভালো।
অরা নদীতে ঝাঁপ দিতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে দুটো হাত তার দুই বাহু আকড়ে ধরলো। সাবের দূর থেকে অরাকে এখানে দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছে। আবারও শুরু হলো দুজনের মধ্যকার ধস্তাধস্তি। অরা সাবেরের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে চাইছে, আর সাবের চাইছে তাকে ফিরিয়ে আনতে। অরার মুখে গামছা জড়িয়ে থাকার কারণে তার মুখ থেকে কেবল গোঙানির আওয়াজ আসছে।
তবে সাবের উঁচু স্বরে চিৎকার করতে করতে বলছে, “না অরা! আমি কিছুতেই তোমাকে ঝাঁপ দিতে দেবো না।”
এই ঘটনা যতক্ষণে ঘটলো ততক্ষণে আরশাদের গাড়ি এসে থেমেছে কাঠের বাড়ির সামনে। তার পিছু পিছু পুলিশের জিপটাও থামলো। পুলিশ এবাড়িতেও কারও বন্দী হয়ে থাকার আলামত পেলো। সেই সঙ্গে পেলো ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া কতগুলো সিমকার্ড। তবে এবারও বাড়িটা জনমানবশূন্য। কোনো মানুষ না দেখে পুলিশ আশাহত হলেও আশা হারাচ্ছে না আরশাদ। তার দৃঢ় বিশ্বাস, ঠিকই খুঁজে পাবে অরাকে।
জ্যাকেটের পকেট থেকে রাশিয়ান পিস্তলটা বের করে নিলো আরশাদ। কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে অরা আশেপাশেই কোথাও আছে। নিজের প্রখর সিক্সথ সেন্সের প্রতি বিশ্বাস আছে আরশাদের। সেই বিশ্বাস নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে সে। বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো আরশাদ। প্রকৃতি ভীষণ তান্ডব শুধু করেছে। প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে বয়ে যাচ্ছে ঝড়ো হাওয়া। মেঘের গর্জনে কোনো কিছু শোনার উপায় নেই।
আরশাদ পিস্তলটা হাতে নিয়ে বাড়ির পেছনে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনি দূর থেকে অস্পষ্ট একটা চিৎকার ভেসে এলো। “না অরা! আমি কিছুতেই তোমাকে ঝাঁপ দিতে দেবো না।”
সে কি ঠিক শুনলো? অরার নামটাই শুনলো না-কি আবারও ছলনা শুরু করেছে? অরা ঝাঁপ দিতে চাইছে কেন? কোথায় ঝাঁপ দেবে? একরাশ প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে গেল আরশাদের মস্তিষ্ক। অশান্ত মনটাকে বহুকষ্টে সে চেষ্টা করছে শান্ত রাখার। এই মুহূর্তে ধৈর্য হারা হলে চলবে না। লম্বা শ্বাস নিয়ে আওয়াজটাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল আরশাদ।
সাবের অরাকে টেনেহিঁচড়ে নৌকার ভেতরে নিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে, তখনি সকলের কানে ভেসে এলো পুলিশের গাড়ির সাইরেন।
হাসু মিয়া আতঙ্কিত গলায় বলল, “পুলিশ আইসা পড়ছে। তাড়াতাড়ি চলো!”
সাইরেনটা শুনে অরা আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লো ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে। কিছুতেই সে সাবেরের সঙ্গে যাবে না। এদিকে সাবেরের টানাটানির মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। আড়ষ্ট হাতে আকড়ে ধরে রেখেছে অরার বাহু। অরা মুক্তি পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছে না সাবেরের সঙ্গে।
আচমকা ভয়ানক একটা শব্দ হলো। মেঘের গর্জন নয়। বজ্রপাতও নয়। তার থেকেও ভয়ানক একটা শব্দ। ভয়ে স্তব্ধ হয়ে নৌকায় বসে পড়লো অরা। সাবের আর অরার বাহু আকড়ে নেই। প্রচন্ড ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে সে নৌকার ওপরে লুটিয়ে পড়লো। কেউ একজন তার পায়ে গুলি করেছে। রক্তে নৌকার আশপাশ ভিজে গেছে। সাবের নৌকায় লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের পলকে নদীতে ঝাঁপ দিলো মাঝি এবং হাসু মিয়া। সাঁতরে ওপাড়ে পৌঁছে যাওয়াটাই তাদের লক্ষ্য।
ভয়ে আতঙ্কে পাথরের মতো জমে আছে অরা। হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো কেউ একজন দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে নৌকার দিকে। সেই কেউ একজনটা সে-ই যাকে দেখার জন্যে তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল অরার চোখদুটো, আরশাদ। আরশাদকে দেখতে পেয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অরা। এতটা স্বস্তিবোধ সে জীবনে কখনো করেনি। এতটা সময় সে নিজেকে ধরে রেখেছিল, ভেঙে পড়েনি। নিজেকে সমালবে বলে। তবে এখন আর তার প্রয়োজন নেই। তাকে সামলানোর মানুষটা তো চলেই এসেছে।
নদীর তীরবর্তী ঝোঁপের আড়াল থেকে আরশাদ লক্ষ্য করছিল কেউ একজন টেনেহিচড়ে একটা মেয়েকে নৌকার ভেতরে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মেয়েটা যে অরা এটা বুঝতে তার বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি। অরাকে নিজ চোখে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পায় আরশাদ। তবে সেই সঙ্গে উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তাও বাড়তে থাকে তার মাঝে। মাঝি সবে বৈঠা হাতে নিয়েছে নৌকা ছাড়বে বলে। সাবের ছেলেটা আরও জোর দিয়ে অরাকে টানছে। এক মুহূর্তও অপচয় না করে আরশাদ গুলি ছোঁড়ে সাবেরের পা লক্ষ্য করে।
নৌকায় উঠেই আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে অরার হাতের আর মুখের বাঁধন খুলে দিলো। কোমল স্পর্শে অরার গালে হাত রেখে বলল, “তুমি ঠিক আছো অরা?”
অরা কিছুই বলতে পারলো না। দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরিয়ে লুটিয়ে পড়লো আরশাদের বুকে। এই বুকটাই যেন তার সবথেকে ভরসার আশ্রয়। পৃথিবীতে কারও সাধ্য নেই তাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার। আরশাদও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। গত আটচল্লিশ ঘন্টায় যতবার সে শ্বাস নিয়েছে, প্রতিবারই মনে হয়েছে ফুসফুসের বড় একটা অংশ অপূর্ণ রয়ে গেছে। এবার আর তা মনে হচ্ছে না।
(চলবে)
#ফিরে_আসা
৪৮+৪৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
গহীন অরণ্যে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। পুরো জঙ্গলটা ঘিরে রেখেছে তারা। সবটাই করা হচ্ছে অনুমানের ভিত্তিতে। অরা আদৌ এই জঙ্গলে আছে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী মূল রাস্তায় মাইক্রো বাসটা এসে থামে। তারপর সাবের অরাকে একটা অটোরিকশায় তুলে নেয়। সিসিটিভি ফুটেজে অটোরিকশা ট্র্যাক করা সম্ভব হয়নি। কারণ সেই অটোরিকশার পেছনে নেই কোনো নম্বর প্লেট। আর এই এলাকার সব অটোরিকশা একই রকম দেখতে। তবে পুলিশের ধারণা এই জঙ্গলেই কোথায় অরাকে লুকিয়ে রেখেছে সাবের।
কিছুটা দূরে নিজের গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে লম্বা একটা টান দিলো আরশাদ। পুলিশ অরাকে খুঁজতে এত দূর পর্যন্ত চলে এসেছে, অথচ সে ঘরে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে তা তো হতে পারে না। যদিও জঙ্গল সব একই রকম দেখতে, তবুও কেন জানি আরশাদের বারবার মনে হচ্ছে এই জায়গাটায় সে এর আগেও এসেছে।
টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে পুলিশের এই অভিযান। নওশীন তা দেখে যেন বাড়তি সজাগ হয়ে গেল। কথা ছিল আজ রাতের অন্ধকারে সাবের অরাকে নিয়ে বর্ডার পাড় হয়ে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা হবে নিতান্তই বোকামির কাজ। নওশীন হন্তদন্ত হয়ে ডায়াল করলো সাবেরের নম্বরে।
সাবের ফোন রিসিভ করতেই নওশীন ব্যস্ত গলায় বলল, “সাবের! তোমাদের এক্ষুনি বের হতে হবে।”
সাবের অবাক হয়ে বলল, “এখন? এখন তো কেবল বিকেল!”
নওশীন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “পুলিশ তোমাদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। একবার ধরা পড়ে গেলে কী হবে বুঝতে পারছো? শাদ ওই মেয়েটাকে তো পেয়েই যাবে, সাথে সাথে তোমাকেও জেলে যেতে হবে!”
সাবের ভয়ার্ত গলায় বলল, “আমাকে জেলে যেতে হবে কেন? এসব প্ল্যান তো আপনার।”
নওশীন বাঁকা হাসি হেসে বলল, “পুলিশ তোমার কথা বিশ্বাস করবে কেন?”
সাবের ভয়ে থতমত খেয়ে গেল। আসলেই তো। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেলে পুলিশ কি বিশ্বাস করবে এতসব প্ল্যানের পেছনে রয়েছে নওশীন?
নওশীন বলল, “এত চিন্তা করে লাভ নেই সাবের। পুলিশ তোমাদের ধরতে পারবে না। তার আগেই তোমরা বহুদূর পৌঁছে যাবে।”
সাবের কথাগুলো বলছিল অরার ঠিক সামনে বসে। সাবেরের মোবাইলটা এমন, লাউডস্পিকারে না রাখলেও পাশে থাকা মানুষটা অপরপ্রান্তের কথা শুনতে পারে। অরার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। তাহলে নওশীন সাবেরকে দিয়ে এই জঘন্য কাজটা করাচ্ছে? কিন্তু কেন? কোন উদ্দেশ্যে? নওশীন কি চাইছে আরশাদের জীবন থেকে অরাকে সরিয়ে দিতে? হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অরার মস্তিষ্কে। প্রশ্নগুলোর উত্তর কি আদৌ সে কোনোদিন পাবে? সাবের যদি আজ সত্যি সত্যি তাকে আরশাদের থেকে বহুদূরে নিয়ে যায়?
ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। অরা স্পষ্ট শুনেছে নওশীন বলেছে, পুলিশ না-কি কাছাকাছিই আছে। বেশি দেরি করলে সাবের ধরা পড়ে যাবে তাদের হাতে। তাহলে দেরিটাই করতে হবে। যতটা সম্ভব সময় নষ্ট করতে হবে। যাতে সাবের কিছুতেই তাকে নিয়ে বেশিদূর না যেতে পারে। তার আগেই যাতে পুলিশ পৌঁছে যায়।
আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। দূরে কোথাও থেকে বজ্রপাতের শব্দ ভেসে আসছে। ঝুম বৃষ্টি নামার আশঙ্কা। তবুও নিরলসভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ফলস্বরূপ একটা পরিত্যক্ত বাড়ি খুঁজে পেল তারা। বাড়িতে কোনো জনমানব নেই। তবে মেঝেতে এলোমেলভাবে ছড়িয়ে আছে কতগুলো জিনিস। একটা কাঠের চেয়ারের নিচে ক্লোরোফর্মের বোতল, দড়ি, কাপড়ের টুকরা, স্কচটেপ। এগুলো দেখে পুলিশের বুঝতে বাকি রইল না এখানে কাউকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। মূলত এই বাড়িতেই সাবের সর্বপ্রথম এনেছিল অরাকে। পরবর্তীতে নওশীনের নির্দেশনায় লোকেশন শিফট করে সে। নওশীনের অভিজ্ঞ মস্তিষ্ক সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছিল পুলিশ এই জায়গাটা ঠিকই খুঁজে পাবে।
চেয়ারের নিচে পড়ে থাকা জিনিসগুলোর দিকে চোখ আটকে আছে আরশাদের। অরাকে এতটা কষ্ট দিয়েছে ওই সাবের? কিংবা এখনো দিচ্ছে? তীব্র রাগে লম্বা একটা শ্বাস নিলো আরশাদ। ওই সাবেরকে শুধু একবার হাতে পেলে তার অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়বে সে।
চেয়ার থেকে কিছুটা দূরে চকচকে একটা জিনিস নজর কেড়ে নিলো আরশাদের। আরশাদ ধীর পায়ে অগ্রসর হলো সেটার দিকে। চকচক করছে অরার আংটি। এতক্ষণ মনে সামান্য অনিশ্চয়তা থাকলেও এখন সেটা নেই। অরাকেই এখানে কিডন্যাপ করে আনা হয়েছিল। মুঠোয় পুরে নিলো আংটিটা আরশাদ। সে কখনো হারতে শেখেনি। আজও হারবে না। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ঠিকই খুঁজে বের করবে সে।
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। জঙ্গলের দুই-মানুষসমান গাছগুলো বাতাসের তীব্রতায় এপাশ থেকে ওপাশে হেলে পড়ছে। সেসবে তোয়াক্কা না করে আরশাদ বেরিয়ে এলো বাড়িটা থেকে। ভালো করে চোখ বোলাতে লাগলো আশপাশটায়। এই জায়গাটাকে কেন পরিচিত বলে মনে হচ্ছে? সে কি আগে কখনো এসেছে এখানে?
মাঝারি সাইজের কুচকুচে কালো চামড়ার একটা ব্যাগ। চওড়া হাসি হেসে ব্যাগের চেইন এক টানে খুলে ফেলল সাবের। ব্যাগ বোঝাই হয়ে আছে টাকার বান্ডিলে। দু হাতে দুটো বান্ডিল তুলে আনলো সাবের। তার মুখের হাসি যেন বেড়েই যাচ্ছে। এক এক করে দুটো বান্ডিলের গন্ধ শুকলো সে। নতুন টাকার গন্ধ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নেশাদ্রব্য। একবার শুকলে আজীবন এই গন্ধে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়।
সাবের অরার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসি নিয়ে বলল, “কী অরা? আমাকে খুব লোভী ভাবছো?”
অরা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চুপ করে রইল। অরা বলতে চাইলেও তার উপায় নেই। তার মুখের ওপরে জোরালো স্কচটেপ।
সাবের আবারও হাসি হাসি গলায় বলল, “আমি লোভী না সুইটহার্ট। তোমাকে পেয়েছি এটাই অনেক। টাকা-পয়সা নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। পরে ভেবে দেখলাম, নতুন একটা জায়গায় যাচ্ছি। নতুন করে সংসার পাতবো, টাকা-পয়সা তো লাগবেই। তাই নিলাম। ভালো করেছি না সুইটহার্ট?”
ঘৃণায় অরার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে। ঘৃণাটা সাবেরের ওপরে নয়, নওশীনের ওপরে। একটা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হলে এমন কাজ করতে পাবে? একে তো অরাকে কিডন্যাপ করানোর প্ল্যান করেছে, তার ওপরে আবার তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সাবেরকে টাকা দিয়েছে! সে কী ভেবেছে? অরা আরশাদের জীবন থেকে চলে গেলেই, আরশাদ সব ভুলে তাকে আপন করে নেবে?
সাবের ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলল, “এবার আমাদের বের হতে হবে বুঝলে অরা। তোমাকে বেঁধে রেখেছি বলে খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? চিন্তা করো না, এই শেষ। জীবনে আর কোনোদিনও তোমাকে কষ্ট পেতে দেবো না আমি।”
কথাগুলো বলতে বলতে সাবের অরার পায়ের বাঁধন খুলে ফেলল। অরা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না। তড়িৎ গতিতে তার হাই হিল দিয়ে সজোরে সাবেরের এমন একটা জায়গায় লাথি মারলো, যেখান আঘাত পেলে পুরুষের পুরো দুনিয়া ঘুরে যায়।
সাবের ঝড়ের বেগে ছিটকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বলল, “তোর এত বড় সাহস! একবার এখান থেকে চলে যাই, দেখিস তোর কী অবস্থা করি আমি!”
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে সাবের ঘরের বাইরে চলে গেল। অরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক! কিছুটা সময় এখানে নষ্ট হবে। এর ফাঁকে পুলিশও এগিয়ে আসবে তাদের কাছাকাছি। অরা মনে মনে প্রার্থনা করছে সাবের যেন তার লক্ষ্যে সফল না হয়। কিছুতেই যেন তাকে নিয়ে দূরে কোথাও যেতে সক্ষম না হয়।
নওশীনের কাছ থেকে আজ সকালে যে লোকটা টাকা নিয়ে এসেছে তার নাম হাসু মিয়া। হাসু মিয়া নওশীনের বাড়ির বিশ্বস্ত কেয়ারটেকার। এখান থেকে বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছানো বড়ো ভেজালের কাজ। দুয়েকবার নৌকা বদল করতে হবে। বাসে উঠে আবারও নৌকায় কিছু পথ যেতে হবে। এতসব ভেজালের কাজ সাবের একা পারবে না বলে হাসুকে পাঠিয়ে দিয়েছে নওশীন।
সাবেরকে ব্যথায় কাতরাতে দেখে হাসু মুখ টিপে টিপে হাসছে।
সাবের আহত গলায় বলল, “আপনি হাসছেন হাসু ভাই?”
হাসু হাসতে হাসতেই বলল, “হাসমু না? তুমি মিয়া একটা মাইয়া মানুষের কাছে লাথি খাইলা? তাও আবার যে মাইয়ার হাত-পা বান্ধা।”
সাবের গম্ভীর গলায় বলল, “অরা অন্য মেয়েদের মতো না। এই মেয়ে ডেঞ্জারাস।”
“মাইয়া মানুষ মানেই ডেঞ্জারাস। আমাগো নওশীন ম্যাডাম কম ডেঞ্জারাস না-কি? দেখলা না? কেমনে স্বামীর দুই নাম্বার বউরে সরায় দিতেছে?”
সাবের চুপ করে রইলো।
হাসু কী যেন ভেবে হালকা গলায় বলল, “তয়, পুরুষ মানুষ যখন ডেঞ্জারাস হয়, তখন তার সামনে ডেঞ্জারাস মাইয়া মানুষ ফিকা পইড়া যায়।”
“বুঝলাম না।”
“আরশাদ স্যারের কথা বলতেছি আর কি। বাপ রে বাপ! কী রাগ তার! একবার রাইগা গেলে চোখ দিয়াই মানুষকে শেষ কইরা দেয়।”
সাবেরের মনে কিছুটা হলেও ভয় ঢুকে গেল। যদি সত্যি সত্যিই আরশাদের হাতে ধরা পড়ে যায় সে? না, না! এসব কী ভাবছে সে? ধরা পড়তে যাবে কেন?
হাসু শুকনো গলায় বলল, “তোমারে একটা বুদ্ধি দিবো?”
“কী বুদ্ধি?”
“আমার বুদ্ধি মানতেই হইবো এমন কোনো কথা নাই। তারপরেও বুদ্ধিটা দিয়া রাখলাম।”
“কী বুদ্ধি বলবেন তো!”
হাসু নিচু গলায় বলল, “এইখানে ঘাপটি মাইরা বইসা থাকো। বর্ডারের ধারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা কইরো না।”
সাবের হতবাক হয়ে বলল, “কী বলছেন এইসব?”
“ঠিকই বলতেছি। এইখানে ধরা পড়লে বলতে পারবা নওশীন ম্যাডাম জোর কইরা তোমারে দিয়া কিডন্যাপ করাইছে। তোমার কোনো দোষ নাই। এইভাবে বাঁচলেও বাঁচতে পারো। তয়, দূরে গিয়া ধরা পড়লে তুমি শেষ।”
“কী যে বলেন হাসু ভাই! ধরা পড়বো কেন?”
“টিভি-ঠিভি কিছু তো দেখো না মিয়া। প্রায় পঞ্চাশজন পুলিশ এই জঙ্গলে ঘুরঘুর করতেছে।”
সাবের ঢোক গিলে বলল, “বলেন কী? তাহলে তো আমাদের এখনই বের হতে হবে?”
“আমার বুদ্ধিটা শুনবা না তাইলে?”
সাবের জোর গলায় বলল, “না হাসু ভাই। আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই প্ল্যানে রাজি হয়েছি অরাকে পাবো বলে। এত কষ্ট করে শেষমেশ ওকে অন্য কারো হতে আমি দেবো না।”
নিশ্চুপ ভঙ্গিতে ড্রাইভ করছে আরশাদ। তার ডান হাত স্টিয়ারিং হুইলে, আর বাম হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। এটা যে আজকের কততম সিগারেট তার হিসাব সে হারিয়ে ফেলেছে। চেতনা আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না। মস্তিষ্কে শুধুমাত্র একটাই লক্ষ্য ভর করছে। অরাকে খুঁজে পাবার লক্ষ্য।
আরশাদের গাড়িকে অনুসরণ করছে পুলিশের একটি জিপ। বাকি পুলিশ সদস্যরা অভিযান অব্যাহত রেখেছে জঙ্গলে। আরশাদের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন ওসি হানিফ। যদিও এই অভিযানে তার আসবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ডিআইজি সাহেব নিজে এই কেসের ওপর নজর রাখছেন বলে এসেছেন। ওপর মহলের সুনজরে থাকতে কার না ভালো লাগে? তবে আরশাদের হাবভাব তার কাছে মোটেও ভালো ঠেকছে না। সেই তখন থেকে মুখে কুলুপ এঁটে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে একবারের জন্যেও বলছে না।
ওসি সাহেব সাহস করে মুখ খুললেন, “আরশাদ ভাই? আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
আরশাদ প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে বলল, “একটা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট রেডি করতে বলুন। আপনাদের কাজ অনেকটাই এগিয়ে থাকবে।”
ওসি সাহেব কিছু বুঝে না উঠে বললেন, “অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট? কার নামে?”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “নওশীন হক।”
হকচকিয়ে গেলেন ওসি সাহেব। নওশীন যে আরশাদের প্রাক্তন স্ত্রী এটা দেশের সকলেরই জানা। তবে আরশাদ কেন তার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট রেডি করতে বলছে? এই কেসের সঙ্গে কি তার কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে?
আরশাদ আবারও গম্ভীর গলায় বলল, “আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আমার কোনো শত্রু আছে কিনা! এই হলো আমার শত্রু।”
“আপনি কী করে এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন?”
আরশাদ জবাব না দিয়ে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো। শুরু থেকেই এই জঙ্গলটা তার কাছে পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল কারণ এখানে সে আগেও একবার এসেছিল। নওশীনের সঙ্গে। নওশীন ইন্টারনেটে বহু খোঁজাখুঁজি করে এই জঙ্গলে একটা পুরনো কাঠের বাড়ির সন্ধান পেয়েছিল। সেবারই ছিল শেষবারের মতো তাদের একসঙ্গে বেড়াতে আসা।
শুরু থেকেই আরশাদ নওশীনকে সন্দেহ করছিল। সন্দেহটা এবার আরও পাকাপোক্ত হলো। আরশাদ নিশ্চিত ওই বাড়িতে গেলেই খুঁজে পাওয়া যাবে অরাকে। যত দ্রুত সম্ভব ড্রাইভ করে সেই বাড়িটা খুঁজে পাবার চেষ্টা করছে আরশাদ। পুলিশের অভিযানের কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। নওশীন নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে নেই। সাবেরকে দিয়ে অরাকে সরিয়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছে।
নওশীনের সঙ্গে একটু বেশিই ভালোমানুষী করে ফেলেছে আরশাদ। এতকাল তার সকল নোংরামি আড়ালে রেখেছিল যাতে সমাজে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে নওশীন। তবে আর নয়। এবার আরশাদ সত্যি সত্যিই নওশীনের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষে পরিণত হবে। একবার শুধু খুঁজে পাক অরাকে, নওশীনের জীবনটাই সে ছারখার করে দেবে।
অরাকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করলো সাবের। ক্লোরোফর্মের অভাবে এবার আর অজ্ঞান করতে পারলো না তাকে। আকাশ ফেটে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে ধরণীর বুকে। বৃষ্টিতে ভিজতে অরার চিরকালই ভালোবাসে। তবে আজ যেভাবে ভিজতে হচ্ছে, সেটা তার মোটেই সহ্য হচ্ছে না। সাবের জোর করে তার হাতদুটো নিজের মুঠোয় পুরে রেখেছে। অরা বারবার নিজের হাতের ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে তার শক্তির কাছে হেরে যাচ্ছে।
অরা এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক চুলও নড়ছে না। সাবের তার হাতদুটো ধরে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে চাইছে তবে সাবের তার মুখে শক্ত করে গামছা বেঁধে রেখেছে। সাবের শক্তি প্রয়োগ করলেও অরার সঙ্গে পেরে উঠছে না। টানাটানির কারণে অরার জামার পেছনের অংশ বেশ অনেকটাই ছিঁড়ে গেল। তীব্র ভয় আকড়ে ধরলো অরাকে। এবার কি সে সত্যিই চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে?
এই কাঠের বাড়ির ঠিক পেছনেই জঙ্গলাবৃত একটা নদী। নদী পাড় করে ওপাড়ে গিয়ে খানিকক্ষণ হাঁটতে হবে। তারপর আরও একটা নদী পাওয়া যাবে। কোনোমতে টেনেহিঁচড়ে অরাকে নদীর কাছে নিয়ে এলো সাবের। মেয়েটার হাত বাঁধা, মুখ বাঁধা – তবুও এত তেজ কোথা থেকে আসছে কে জানে? নৌকার কাছে এসে অরাকে ছইয়ের ভেতরে ফেলে দিলো সাবের।
আছড়ে পড়ার কারণে অরার কপাল কেটে রক্ত বেয়ে পড়তে লাগলো। ব্যথায় তার কোনো তোয়াক্কা নেই। ভয়ে আর আতঙ্কে সে জমে পাথর হয়ে আছে।
হাসু মিয়া নৌকায় উঠতে উঠতে বলল, “মাঝি ভাই! জলদি চলো।”
মাঝি উদাস গলায় বলল, “বারিশ থামলে যাই?”
হাসু ব্যস্ত গলায় বলল, “আরে না না! আমাগো সময় নাই। তাড়াতাড়ি চলো।”
অরার শুকনো গলা আরেকটু শুকিয়ে এলো। এরা তাহলে সত্যিই তাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে বহুদূর। সে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। আরশাদও এলো না শেষমেশ তাকে বাঁচাতে। ভালোবাসার মানুষটার ওপর আস্থা রেখে তাহলে কি ভুল করলো অরা?
তার মাথা আর কিছুতেই কাজ করছে না। শুধুমাত্র মনে হচ্ছে সে কোনো পণ্য নয়, যে কেউ চাইলে তাকে কিডন্যাপ করে নিজের করে নিতে পারে না। এ জীবন থাকতে সে কিছুতেই নিজেকে সাবেরের কাছে সপে দেবে না। সাবের যদি অরাকে পেতেই চায়, তবে সে যা পাবে তা হলো অরার লাশ।
সাবের ও হাসু মিয়া ওদিকে মাঝির সঙ্গে কী যেন কথা বলছে। অরার সামনে আপাতত কেউ নেই। শরীরটা ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে, তবুও বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালো অরা। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেল নৌকার পাটাতনের দিকে। পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে জলের দিকে তাকালো অরা। তীক্ষ্ণ শূলের গতিতে বৃষ্টির ফোঁটা নদীর ওপর আছড়ে পড়ছে। যদিও সে সাঁতার জানে, তবুও একবার নদীতে পড়ে গেলে নিজেকে বাঁচানোর কোনোপ্রকার চেষ্টা করবে না। ডুবে যাবে গহীনে। সাবেরের সঙ্গে দূর দেশে হারিয়ে যাওয়ার থেকে এভাবে হারিয়ে যাওয়া ঢের ভালো।
অরা নদীতে ঝাঁপ দিতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে দুটো হাত তার দুই বাহু আকড়ে ধরলো। সাবের দূর থেকে অরাকে এখানে দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছে। আবারও শুরু হলো দুজনের মধ্যকার ধস্তাধস্তি। অরা সাবেরের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে চাইছে, আর সাবের চাইছে তাকে ফিরিয়ে আনতে। অরার মুখে গামছা জড়িয়ে থাকার কারণে তার মুখ থেকে কেবল গোঙানির আওয়াজ আসছে।
তবে সাবের উঁচু স্বরে চিৎকার করতে করতে বলছে, “না অরা! আমি কিছুতেই তোমাকে ঝাঁপ দিতে দেবো না।”
এই ঘটনা যতক্ষণে ঘটলো ততক্ষণে আরশাদের গাড়ি এসে থেমেছে কাঠের বাড়ির সামনে। তার পিছু পিছু পুলিশের জিপটাও থামলো। পুলিশ এবাড়িতেও কারও বন্দী হয়ে থাকার আলামত পেলো। সেই সঙ্গে পেলো ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া কতগুলো সিমকার্ড। তবে এবারও বাড়িটা জনমানবশূন্য। কোনো মানুষ না দেখে পুলিশ আশাহত হলেও আশা হারাচ্ছে না আরশাদ। তার দৃঢ় বিশ্বাস, ঠিকই খুঁজে পাবে অরাকে।
জ্যাকেটের পকেট থেকে রাশিয়ান পিস্তলটা বের করে নিলো আরশাদ। কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে অরা আশেপাশেই কোথাও আছে। নিজের প্রখর সিক্সথ সেন্সের প্রতি বিশ্বাস আছে আরশাদের। সেই বিশ্বাস নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে সে। বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো আরশাদ। প্রকৃতি ভীষণ তান্ডব শুধু করেছে। প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে বয়ে যাচ্ছে ঝড়ো হাওয়া। মেঘের গর্জনে কোনো কিছু শোনার উপায় নেই।
আরশাদ পিস্তলটা হাতে নিয়ে বাড়ির পেছনে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনি দূর থেকে অস্পষ্ট একটা চিৎকার ভেসে এলো। “না অরা! আমি কিছুতেই তোমাকে ঝাঁপ দিতে দেবো না।”
সে কি ঠিক শুনলো? অরার নামটাই শুনলো না-কি আবারও ছলনা শুরু করেছে? অরা ঝাঁপ দিতে চাইছে কেন? কোথায় ঝাঁপ দেবে? একরাশ প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে গেল আরশাদের মস্তিষ্ক। অশান্ত মনটাকে বহুকষ্টে সে চেষ্টা করছে শান্ত রাখার। এই মুহূর্তে ধৈর্য হারা হলে চলবে না। লম্বা শ্বাস নিয়ে আওয়াজটাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল আরশাদ।
সাবের অরাকে টেনেহিঁচড়ে নৌকার ভেতরে নিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে, তখনি সকলের কানে ভেসে এলো পুলিশের গাড়ির সাইরেন।
হাসু মিয়া আতঙ্কিত গলায় বলল, “পুলিশ আইসা পড়ছে। তাড়াতাড়ি চলো!”
সাইরেনটা শুনে অরা আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লো ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে। কিছুতেই সে সাবেরের সঙ্গে যাবে না। এদিকে সাবেরের টানাটানির মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। আড়ষ্ট হাতে আকড়ে ধরে রেখেছে অরার বাহু। অরা মুক্তি পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছে না সাবেরের সঙ্গে।
আচমকা ভয়ানক একটা শব্দ হলো। মেঘের গর্জন নয়। বজ্রপাতও নয়। তার থেকেও ভয়ানক একটা শব্দ। ভয়ে স্তব্ধ হয়ে নৌকায় বসে পড়লো অরা। সাবের আর অরার বাহু আকড়ে নেই। প্রচন্ড ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে সে নৌকার ওপরে লুটিয়ে পড়লো। কেউ একজন তার পায়ে গুলি করেছে। রক্তে নৌকার আশপাশ ভিজে গেছে। সাবের নৌকায় লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের পলকে নদীতে ঝাঁপ দিলো মাঝি এবং হাসু মিয়া। সাঁতরে ওপাড়ে পৌঁছে যাওয়াটাই তাদের লক্ষ্য।
ভয়ে আতঙ্কে পাথরের মতো জমে আছে অরা। হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো কেউ একজন দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে নৌকার দিকে। সেই কেউ একজনটা সে-ই যাকে দেখার জন্যে তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল অরার চোখদুটো, আরশাদ। আরশাদকে দেখতে পেয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অরা। এতটা স্বস্তিবোধ সে জীবনে কখনো করেনি। এতটা সময় সে নিজেকে ধরে রেখেছিল, ভেঙে পড়েনি। নিজেকে সমালবে বলে। তবে এখন আর তার প্রয়োজন নেই। তাকে সামলানোর মানুষটা তো চলেই এসেছে।
নদীর তীরবর্তী ঝোঁপের আড়াল থেকে আরশাদ লক্ষ্য করছিল কেউ একজন টেনেহিচড়ে একটা মেয়েকে নৌকার ভেতরে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মেয়েটা যে অরা এটা বুঝতে তার বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি। অরাকে নিজ চোখে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পায় আরশাদ। তবে সেই সঙ্গে উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তাও বাড়তে থাকে তার মাঝে। মাঝি সবে বৈঠা হাতে নিয়েছে নৌকা ছাড়বে বলে। সাবের ছেলেটা আরও জোর দিয়ে অরাকে টানছে। এক মুহূর্তও অপচয় না করে আরশাদ গুলি ছোঁড়ে সাবেরের পা লক্ষ্য করে।
নৌকায় উঠেই আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে অরার হাতের আর মুখের বাঁধন খুলে দিলো। কোমল স্পর্শে অরার গালে হাত রেখে বলল, “তুমি ঠিক আছো অরা?”
অরা কিছুই বলতে পারলো না। দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরিয়ে লুটিয়ে পড়লো আরশাদের বুকে। এই বুকটাই যেন তার সবথেকে ভরসার আশ্রয়। পৃথিবীতে কারও সাধ্য নেই তাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার। আরশাদও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। গত আটচল্লিশ ঘন্টায় যতবার সে শ্বাস নিয়েছে, প্রতিবারই মনে হয়েছে ফুসফুসের বড় একটা অংশ অপূর্ণ রয়ে গেছে। এবার আর তা মনে হচ্ছে না।
(চলবে)