#ম্লান_সন্ধ্যায় (১৩)
অনিকের চোখ হঠাৎ কোয়েলিয়ার দিকে পড়লো। আবছা আলোয় মেয়েটার কায়া দেখে, মনে পড়লো বিভাও ঠিক এভাবেই ওর পাশের সিটে বসতো।তবে ওদের যাত্রা এমন রহস্যময় নীরবতার পরিবর্তে খুনসুটি, হাস্যরসে পূর্ণ থাকতো। ড্রাইভিং করাটা রীতিমতো অনিকের শখ,আর বিভা থাকতো ওর সঙ্গী।বিভা ছিল প্রাণোচ্ছ্বল এক মানবী। চারদেয়ালের ভেতরে কাটানো যার সিলেবাসে ছিল না। কতবার ওরা গাড়ি নিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে বেরিয়ে পড়েছে,তার ইয়াত্তা নেই। সাফিয়ার জন্মের পর অবশ্য বিভার ভেতরে মাতৃত্বসুলভ আচরণ চলে আসে,অনিক ও ব্যবসা সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।সেই সাথে ওদের ভেতর ছোট ছোট ঝামেলাও বেশ জায়গা করে নিয়েছিল।তারপর হঠাৎ একদিন তুমুল ঝগড়ার পর বিভা মেয়েকে নিয়ে চলে যায়।পরে ও স্পষ্ট বুঝেছিল, ঝগড়াটা নিতান্তই একটা বাহানা। সেদিনের ঝগড়া ছাড়া আর কোন জোরালো কারণ খুঁজে পায় না যার জন্য বিভা এমনটা করেছিল। অবশ্য দু’জনের ভেতরে তুলনা হলে রিফাত ওর থেকে এগিয়ে থাকবে। কিন্তু ওরা তো বিয়ের আগে থেকেই একে অপরকে ভালোবাসতো।তবে কি সবকিছু ঠুনকো ছিল?যার কারণে রিফাতের হাত ধরে যেতে একটুও বাঁধলো না।রিফাত ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়েছে।এতে রিফাতের দোষ নেই,ও নিজেই তাকে ওদের ভেতর ঢোকার সুযোগ দিয়েছে,বিশ্বাস করেছে। কখনো এটা ভাবেনি আগুন আর বারুদ একত্রে রাখা মানে বিস্ফোরণ ঘটতে দেওয়া।সব দোষের দোষী ও।প্রথমে দু’জনকে খু’ন করার ইচ্ছা জাগলেও সময়ের সাথে সাথে ওদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছে। খোঁজ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হয়নি।যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে জোর করে সংসার হয়না।তার পরিবর্তে ধরেছে মদের বোতল।রিফাতকে পেলে ও শুধু জিজ্ঞেস করতো, বন্ধুত্ব কি একেই বলে? ভাবতে ভাবতে অনিকের মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হলো।চারপাশের সবকিছু ওর কাছে অসহ্য ঠেকলো।
বাংলোয় ফিরে ও কারো সাথে একটা কথাও বললো না।যাদবকে কিছু বলে ওপরে চলে যায়। কোয়েলিয়া ওর পরিবর্তন বুঝলেও কারণটা ধরতে পারলো না। কিছুক্ষণ পর যাদবকে বিয়ারের বোতল নিয়ে যেতে দেখে কারণটা বুঝলো। তবে ওর কাছে সাধারণ ঘটনা বলেই মনে হলো।ও যাদবকে আটকে বললো,
‘আমার কাছে দিন, আমি দিয়ে আসছি।’
কোয়েলিয়া খেয়াল করলো যাদব বরফের টুকরো নেয়নি। অবশ্য লোকটাই বা কিভাবে এসব জানবে!ও কিচেনে গিয়ে একটা গ্লাসে বরফের টুকরো নেয়। এই লোকের সাথে বৈবাহিক সূত্রে কতকিছু জেনে ফেলেছে। কখনো কি ভেবেছিল ওর জীবনটা এরকম হবে? আজকের দিন,এসব ঘটনা এগুলো তো ওর ইচ্ছের থেকেও বহুদূরে ছিল।
অনিক ছাদে ছিল। চারপাশে গাঢ় অন্ধকারের মাঝে ছাদে আলো জ্বলছে।অনিক নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে দূরপানে তাকিয়ে ছিল। সবকিছু ওর অসহ্য ঠেকছে। ইচ্ছে করছে সব ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে রাখছে।
কোয়েলিয়ার উপস্থিতি টের পেলেও ও তাকায় না।এই মেয়েটা ধীরে ধীরে ওর জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু ও চায় না ওর জীবনে কোন নারীর উপস্থিতি। কাউকে ও ভালোবাসতে চায় না।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো,শহরে ফিরেই ও সব ব্যবস্থা করবে।ওর জন্য মেয়েটার জীবন নষ্ট হোক,এটা ও চায়না। নিজের বিবেক এখনও পচেগলে যায়নি।
কোয়েলিয়া দাঁড়িয়ে ছিল।এই চুপচাপ থাকাটা অনিকের অসহ্য লাগে।ও কড়া গলায় বলল,
‘আমি কারো উপস্থিতি চাচ্ছি না।’
কোয়েলিয়া ইতস্তত করে বললো,
‘বেশি খাবেন না প্লিজ।’
‘এখান থেকে যেতে বলেছি।’
অনিকের ধমকে ওর চোখে পানি চলে এলো।ও মাথা নিচু করে চলে আসলো। অনিকের ভালোবাসা আশা করা মরীচিকার পেছনে যাওয়ার মতো। নিজের কক্ষে এসে ও বালিশে মুখ গুজে কাঁদলো। হঠাৎ করে আজ কেন ওর কান্না পাচ্ছে?আজতো এরকম ঘটনা প্রথমবার নয়।ও চোখ মুছে বাইরে গেল। সারাহ যাদবের সাথে গল্প করছে। সরফরাজ গৌরাঙ্গের সাথে বের হয়েছে। কোয়েলিয়া নিজের ব্যাথা চেপে ওদের আড্ডার সামিল হলো।
*
অনিক সরাসরি বিয়ারের বোতলে সীপ দিলো।জল বা বরফ ছাড়া ঝাঁঝালো অ্যালকোহলে খারাপ লাগলেও ও থামলো না। কয়েকবার একনাগাড়ে গলায় ঢালার পর টেবিলের ওপর মাথা রাখলো। সবকিছু কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে,বাতির আলোকে আগুনের ন্যায় উত্তপ্ত মনে হচ্ছে।ও চোখবুঁজে থাকলো।বুঝলো একটু একটু করে নেশা হচ্ছে।হয় হোক! কিছুক্ষণ পর পুনরায় বোতল থেকে তরলটা গলায় ঢেলে মনে স্বস্তি আনলো।
সরফরাজ ফেরার পর যাদব ওদের খাবারের তাগাদা দিলে, কোয়েলিয়া অনিককে ডেকে আনতে ছাদের দিকে পা বাড়ালো। অনিক মদের নেশায় চেয়ার ছেড়ে ছাদের প্রাচীরে হেলান দিয়ে বসেছে, চোখদুটো বোজা।এই ঠান্ডার ভেতরে একটা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার পরা।ওকে এমন অবস্থায় দেখে,কোয়েলিয়া বেশ ভয় পেল।ও অনিকের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর অনিক পিটপিট করে তাকায়। উঠতে চেষ্টা করলেও অতিরিক্ত খাবার কারণে ও ধপ করে বসে পড়ে।জড়ানো গলায় বলল,
‘আমাকে একটু ধরো না।’
কোয়েলিয়া ওর হাত কাঁধে বাঁধিয়ে ওকে উঠতে সাহায্য করে।অনিক হুট করে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘তুমি আমাকে ভালোবাসে?’
কোয়েলিয়া চমকে উঠলেও কন্ঠ শুনে বুঝলো,অনিক এখন মাতাল। হয়তো অন্য পরিস্থিতিতে একথা শুনলে ও আনন্দে আত্মহারা হতো। কিন্তু অনিক নেশার ঘোরে এখন বললেও পরে এসব ভুলে যাবে।মাতালরা সত্যি বলে, কিন্তু পরে ভুলে যায়।ও বললো,
‘আপনি এখন ঘরে চলুন। বাইরে অনেক শীত।’
‘আগে বলো তুমি আমায় ভালোবাসো?’
‘আগে ভেতরে চলুন, তারপর বলবো।’
‘সত্যি তো।প্রতিজ্ঞা কর।’
‘সত্যি।’
অনিককে নিয়ে কোয়েলিয়ার নামতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তবুও ও ওকে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।পা থেকে জুতো খুলে, গায়ের ওপর কম্বল টেনে দেবার সময় আচমকা অনিক ওকে হেঁচকা টান মারতেই ও ওর বুকের ওপর পড়লো।অনিক দুহাত দিয়ে ওর মুখখানি ধরে বললো,
‘তুমি আমাকে ভালোবাসার জালে আটকাচ্ছো কেন? কেনো তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে,তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে ?’
অনিকের শব্দগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে।কোয়েলিয়া ভয় পেল।ও এই মূহুর্তে একজন মাতালের খপ্পরে পড়েছে।এর সাথে তার স্বামীর কোনো মিল নেই।ও উঠতে চাইলেও অনিক ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।
‘আপনি প্লিজ আমাকে ছাড়ুন।’
কোয়েলিয়া ওর থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু অনিক ওকে ছাড়েনা। জীবনে প্রথম পুরুষের স্পর্শের উষ্ণতায় ও খুশি হবার পরিবর্তে ভয় পাচ্ছে।
‘তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো কেন কোয়েলিয়া?’
কোয়েলিয়া জবাব দিলো না।অনিক কোয়েলিয়ার মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে ওষ্ঠ আক্রমণ করতে যাবে, এমন সময় কোয়েলিয়া জোরে ঝটকা মেরে উঠে একরকম দৌড়ে বের হয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকায়।ও দ্রুত পায়ে নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা আটকে হাঁপাতে থাকে।আজ বাঁধা না দিলে পরবর্তীতে পস্তাতে হতো।
*
সকালে চারপাশ কুয়াশায় ঢেকে গেছে।শীতটাও বেশ জেকে বসেছে।সাড়ে সাতটা বাজলেও সূর্যের দেখা নেই।তবুও অনিকের তাড়ায় ওরা তৈরি হয়ে গাড়িতে বসলো। গৌরাঙ্গ কোট গ্লাভস পরে বাইক রাইডিং এর জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছে। আজকে ওদের গন্তব্য সুসং দুর্গাপুর।
অনিক ড্রাইভিং সিটে। গতরাতে যে কিছু হয়েছিল তা ওর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। গতকাল ঝর্ণায় ভেজার কারণে সরফরাজের খুশখুশে কাশি বেঁধেছে। সকালে কড়া এক মগ আদা চা খেয়েও লাভ হয়নি। কিছুক্ষণ পর পর খুকখুক করে কাশছে।সারাহ ব্যঙ্গ করে বললো,
‘খুব তো আমাকে পচাও। আমি নাকি ব্রয়লার মুরগি। এখন!অন্যের পেছনে লাগলে এমনই হবে।’
‘সকাল সকাল তাই কিছু বললাম না।পরে দেখে নেব।’
‘হ্যাঁ,দেখে নিও। তোমার ভয়ে আমি কাঁপছি।’
সারাহ কপট কাঁপুনির ভঙ্গি করলো।রাগে সরফরাজের গা জ্বলে গেল।ও চেঁচিয়ে বললো,
‘সারাহর বাচ্চা, চুপচাপ থাক।নয়তো..’
‘আমার বিয়েই হয়নি, বাচ্চা আসবে কোথা থেকে?তাছাড়া আমার বাচ্চাকে তুমি আম্মু সোনামনি ডাকবা।সারাহর বাচ্চা বলবা কেন?’
‘অনিক ওকে থামতে বল, নয়তো ওর চুল ছিড়বো।’
অনিকের হাসি পেলেও ও হাসলো না।বললো,
‘আর একটা কথা বললে দুজনকে নামিয়ে দেব।আর সরফরাজ, তুই একজন ম্যাচিউর ছেলে হয়েও বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছিস কেন?’
‘ব্যাস,হয়ে গেল।সেধে আরেকজনকে দাওয়াত করে আনলাম।এই গাড়ি থামা।’
অনিক ব্রেক করলো। ওরা ভাবলো সরফরাজ কোন একটা কান্ড ঘটাবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ও সামনের একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলো। সকালের নাস্তাটা ওরা এখানেই করবে।
*
ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা বিঞ্চুরীছড়া ,বাঙাছড়া ঝর্ণা এবং রমফা নদীর মিলিত প্রবাহ, সোমেশ্বরীকে সূর্যের সোনালী কিরণে অপরূপ দেখাচ্ছিল।এই নদীটির নাম কিন্তু পূর্বে ছিল সিমসাং।মান্দি ভাষার সিমসাংকে হাজংরা বলতো ধাপাগাঙ্গ। বহুকাল আগে সোমেশ্বর পাঠক এখানকার রাজাকে বিষ দ্বারা হত্যা করে রাজ্যের সাথে সাথে রাণীকে নিজের দখলে নেন। তারপর নিজের নামে নদীটির নাম করেন সোমেশ্বরী।
নেত্রকোনার এই পরিচিত নদীতে অল্প জল আর স্থানে স্থানে লালচে বালির চর জেগেছে।এর ওপর বাঁশের সেতু দেখে ওরা খানিকটা অবাক হলো।নিচে কাঠ বিছানো,দুপাশে বাঁশে ঘেরা সেতুটি চমৎকার লাগছে।অনিক বললো,
‘গাড়ি ওঠালে যদি ভেঙ্গে পড়ে।’
‘কিছুই হবে না।রোজ এখান দিয়ে অনেক গাড়ি চলাচল করে।’
তবুও অনিকের মনে আশঙ্কা দোলা দেয়।ও সবাইকে নেমে হেটে পার হতে বলে।গাড়ি চলার সময় সেতু কিছুটা কাপলেও ভাঙলো না। সেতু পার হয়ে ওরা গেল বিজয়পুর। গৌরাঙ্গের বন্ধু প্রত্যয় হাজং আগেভাগেই সেখানে এসে অপেক্ষা করছিল।তাকে আজকের ভ্রমণের গাইড বলা চলে।
বিজয়পুরে সাধারণত পর্যটকরা চীনা মাটির পাহাড় আর নীল-সবুজ জল দেখতে আসে।তবে এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হলো বিজয়পুর ক্যাম্প ও রানিখং পাহাড়। ঘড়িতে দশটা বেজে গেছে। ওরা প্রথমে বিজয়পুর ক্যাম্পে গেল।উচু পাহাড়ের ওপর ছাউনিতে দাঁড়িয়ে অতন্দ্র প্রহরীরা রাতদিন জেগে দেশরক্ষায় নিয়োজিত।পরিবার পরিজন ছাড়া যে এসকল সৌন্দর্য মূল্যহীন তা ওদের নিষ্প্রাণ দৃষ্টি বলে দেয়।
এখানে ছবি তোলা নিষেধ।তবে ক্যামেরাবন্দি করতে না পারুক,নিচ দিয়ে বয়ে চলা সোমেশ্বরী আর দূরের মেঘালয় ওদের চোখের তৃষ্ণা মেটালো।
ক্যাম্প থেকে নেমে ওরা পিচঢালা রাস্তা ধরে চললো বিজয়পুর সীমান্তে। সীমান্তের রাস্তাটা চমৎকার, কিছুদূর যেতেই সামনে লোহার ব্যারিকেড, পাশেই লালরঙের সাইনবোর্ডে সতর্কবার্তা লেখা। রাস্তার দুধারে ছোটবড় সবুজ টিলা,তার ওপর বাড়িঘর, টিলার পাদদেশে উঁচু উঁচু সুপারির গাছ আকাশে মাথা তুলেছে।কিছুটা দূরে রাইফেল হাতে দুজন বিজিবিকে দেখা গেল।
প্রত্যয় জানালো,এই পিচঢালা রাস্তাটা বাংলাদেশের কিন্তু দু’পাশের পাহাড় বাড়িঘর ভারতের।সারাহ বললো,
‘ইন্টারস্টিং তো। এখানে এতকিছু আছে, আগে জানা ছিল না।’
বিজয়পুর ক্যাম্প থেকে বের হয়ে ওরা গেল রানিখং মিশনে। দুর্গাপুরের অনান্য স্থানের ন্যায় রানিখং নামের পিছনে একটা কাহিনী রয়েছে।খং অর্থ আত্মহুতি। সুসং রাজার সময়ে কোন এক কারণবশত রানি পাহাড় থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়ে। তখন থেকে এর নাম হয় রানিখং পাহাড়। ভয়ঙ্কর কাহিনী হলেও সুসং দুর্গাপুরের সবথেকে চমৎকার জায়গা এই রানিখং। পাহাড় ঘেঁষে বয়ে চলেছে সোমেশ্বরী,একপাশে মেঘালয় আর সবুজের নিবিড় ছোঁয়ায় এখানে গড়ে উঠেছে রানিখং ক্যাথলিক মিশন।যেকারো চোখ জুড়ানোর মতো নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। পাশেই রানিখং মিশন স্কুল। বাচ্চাদের কলহাস্যের আওয়াজ পাহাড়জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ গারো সম্প্রদায়, এছাড়া হাজং ,কোচ,মান্দি,দালু ও বাঙালির বাস রয়েছে। প্রত্যয় থাকায় ওরা সহজেই মিশনে ঢুকতে পারে।পাখির কিচিরমিচির, পাতার মর্মর শব্দের আলোড়ন ভেঙে ওরা ভেতরে ঢুকলো।আজ অবশ্য কয়েকজন ভ্রমণপিপাসুর দেখা মিললো।ক্যাথলিক চার্চটি টিলার ওপরে , এর পাশে এবং পাদদেশে দুটি ভাস্কর্য।পাশেই কিছুটা জায়গা জুড়ে পাথর দিয়ে দরজা আকৃতির ভেতরে একটি নারী মূর্তি, ওপরে নীল রঙে লেখা ‘প্রণাম মারিয়া।’সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে কালো পাথর।
কোয়েলিয়া একা একাই ঘুরে দেখেছিল। গতরাতের পর অনিকের সামনে যাওয়ার মানেই হয়না।সিড়ি বেয়ে চার্চের ওপরে উঠছিল, খেয়াল করলো অনিক ওর পাশে।অনিক অপেক্ষাকৃত নিচুস্বরে বললো,
‘গতরাতে কি ভুলভাল কিছু বলেছিলাম?’
‘বলেছিলেন।’
‘আসলে নেশা হয়ে গিয়েছিলো তো।দয়া করে ওসব মনে রাখবেন না।’
‘রাখিনি।’
অনিক তাও ইতস্তত করে এদিক ওদিক তাকায়। তারপর বলে,
‘ভুল কিছু করেছিলাম?’
‘আমি এতটাও নির্লজ্জ নই, আপনার মাতলামির সুযোগ নেব।’
অনিক চমকে ওর দিকে তাকায়।এই প্রথম মেয়েটাকে এতো কড়া গলায় কথা বলতে শুনলো। কোয়েলিয়া ওকে উপেক্ষা করে ওপরের দিকে এগিয়ে গেল,অনিক মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।
*
রানিখং পাহাড়ে ঘোরা শেষে ওরা চিনামাটির পাহাড়ে গেল। এখানে গোলাপী-সাদা কাটা পাহাড়ের মাঝে নীল-সবুজ জল,আর পাশ দিয়ে বেগুনি রঙা ফুলের গাছ।আসলে কলমাকান্দা,পাতলাবন দেখার পর ওদের কাছে শুধুমাত্র বিজিবি ক্যাম্পটাই ভালো লাগলো।গারো পাহাড়ে যাবার কথা থাকলেও অনিকের অনাগ্রহের কারণে যাওয়া হলো না। ফেরার পথে কামারঘাটার বহেরাতলী বাজারে হাজংদের স্মৃতিবিজড়িত হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধে গেল।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় হাজংরা সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।যার কারণে তাদের ইতিহাসে বহু আন্দোলন যুক্ত হয়েছিল।এমনই একটির অন্তর্ভুক্ত টংক আন্দোলন যার নেতৃত্বে ছিলেন নিঃসন্তান বিধবা রাশিমণি হাজং।বিদ্রোহ দমাতে পুলিশেরা কাউকে খুঁজে না পেয়ে এক কৃষকের বৌকে ধরে নিয়ে গেলে ,রাশিমণি দলবল নিয়ে পথরোধ করে ঝাপিয়ে পড়ে। তৎক্ষণাৎ একজন পুলিশ মা’রা যায়। এবং পুলিশের গুলিতে রাশিমণি একজন কৃষকের মৃত্যু ঘটলে, বিদ্রোহীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাকি পুলিশদের মে’রে ফেলে। নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য রাশিমণিকে তারা দেয় হাজংমাতা উপাধি।
স্মৃতিস্তম্ভের কাছের বোর্ডে রাশিমণির একটি উক্তি কোয়েলিয়ার চোখে পড়লো।যেটা তিনি পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় বলেছিলেন।যে সাহসের জন্য নিঃসন্তান হয়েও তিনি হয়েছিলেন হাজংমাতা।
‘ময় তিমাদ, তিমাদ হুয়ে আরেগ তিমাদলা মান ময় বাঁচাব, মরিবা লাগে মুরিব।’
নিচে বাংলায় অর্থ লেখা,‘আমি নারী, নারী হয়ে আরেক নারীর সম্ভ্রম রক্ষা আমিই করব, মরতে হয় মরব।’
চলবে…
®️ সুমি খানম
#ম্লান_সন্ধ্যায় (১৪)
সদর দরজা খুলে আফসার শিকদারের সাথে সোয়েটার-টুপিতে মোড়া ছোট্ট একটি মেয়েকে দেখে কোয়েলিয়া একটু না অনেকটাই অবাক হলো।গৌরবর্ণ মুখে নিবিড়কালো দুটো চোখ,টানা নাক, পাতলা ঠোঁটের বাচ্চাটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে অনুমান করতে লাগলো মেয়েটা কে হতে পারে? মনের কোণে সন্দেহ বাসা বাধলেও অপেক্ষা করলো,সবটা জানার।আফসার শিকদার গম্ভীর গলায় বললো,
‘ওকে ডেকে নিয়ে এসো।’
কোয়েলিয়া অনিকের ঘরের দিকে গেল। দুর্গাপুর থেকে এসেছে নয়দিন।ন’দিন কম নয়,এর ভেতর অনেক কিছুই ঘটা সম্ভব।এই যেমন আফসার শিকদার বাইরে গিয়ে সাথে একটা মেয়েকে নিয়ে ফিরে এলেন, যে দেখতে অনেকটা অনিকের মতো। এটাতো ছোট ঘটনা নয়! কিন্তু এতদিনে যে সম্পর্কের উন্নতির আকাঙ্ক্ষা করেছিল,তাতে পরিবর্তনের সামান্য রেশ ও দেখা দেয়নি। ফেরার পর কি হলো কে জানে!অনিক গম্ভীর গলায় বলেছিল,অকারণে তার আশেপাশে যেন না যাওয়া হয়।
কোয়েলিয়া বোধহয় কখনোই একে বুঝতে পারবে না। কেন এতো অনীহা ওর প্রতি? পুরুষেরা এভাবে দূরত্ব বজায় রাখতে পারে,এই লোককে না দেখলে বোধহয় জানতো না।
কোয়েলিয়া অবশ্য আগের থেকে আরও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।ও এতটাও মূল্যহীন হয়নি যে, বেহায়া হয়ে অনিকের আশেপাশে ঘুরঘুর করবে।তবে আফসার শিকদারের নির্দেশ ও অমান্য করার উপায় নেই। অগত্যা অনিকের কড়া নিয়ম ভেঙ্গে ও দরজায় টোকা মারলো।অনিক ঘুমাচ্ছিল,যদিও এখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে।ও ঘুমঘুম চোখে দরজা খোলে, কিন্তু কোয়েলিয়াকে দেখে কোন প্রতিক্রিয়া জানায় না।ও জানে দরজায় এভাবে কড়াঘাত একজনই করে, বাকিরা দরকার পড়লে কল দেয়।ও ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়ায় , কোয়েলিয়া বললো,
‘নিচে আসুন। জরুরী তলব।’
‘আচ্ছা।’
‘হ্যাঁ।’
অনিক তবুও সরে না।কোয়েলিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ও হুট করে মেয়েটাকে চমকে দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আচমকা এমন আক্রমণে কোয়েলিয়া কেঁপে ওঠে। সেই সাথে লজ্জা ভয়ে মস্তক আরও অবনত হলো। অনিক বললো,
‘তাকান আমার দিকে।’
কোয়েলিয়া একপলক ওর দিকে তাকালো। অনিকের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক, দৃষ্টি ঘোলা। কোয়েলিয়া চোখ রাখতে পারে না।
‘ভয় পান কেন আমাকে?’
‘আপনি এত অদ্ভুদ কেন?’
‘প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করছেন?’
‘ছাড়ুন আমাকে।’
‘যদি না ছাড়ি,কি করবেন?’
‘আজ আবার বেশি খেয়েছেন।’
‘আপনি আমাকে মাতাল মনে করেন?’
‘সবসময় যারা মদ্যপান করে তাদের ভালো বাংলায় কি বলে জানা নেই।’
অনিক ওকে ছেড়ে দেয়।ও যে একথায় রেগে গেছে তা বোঝা গেল।পাগল যেমন কখনো নিজেকে পাগল মনে করেনা, তেমনি মদ্যপেরা কখনো নিজেকে মাতাল হিসেবে স্বীকার করে না। কোয়েলিয়া ফের বলে,
‘আপনার আচরণ হুটহাট পরিবর্তন হলে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। দয়া করে আগেভাগে পূর্বাভাস জানান দেবেন।’
অনিক উত্তর দেবার প্রয়োজন করে না। বরঞ্চ উপেক্ষা হিসেবে শব্দ তুলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়।
*
মেয়েটা মনমরা হয়ে বসেছিল। চোখেমুখে কেমন বিষাদের ছাপ আর ভয়ের রেশ। এটুকু বাচ্চারা থাকে হাসিখুশি, দুঃখ পেলে কাঁদে ফের হাসে। অনেকটা মেঘ-বৃষ্টি-রোদের মতো। কিন্তু এই ছোট্ট পুতুলটি কাচুমাচু হয়ে বসে রয়েছে ।অনিক নিচে নেমে মেয়েটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল।যেন বুঝতে চেষ্টা করছে,তার সন্দেহটা ঠিক কিনা।ও বললো,
‘কে ও?’
‘তুমি বলো দেখি কে হতে পারে।’
কোয়েলিয়ার এতক্ষনে বোঝার চেষ্টা করছিল,এই মেয়েটার সাথে এদের কি সম্পর্ক?ও কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিল। আফসার শিকদারের হেয়ালীতে এবার ওর সন্দেহ মিটলো।
অনিক গম্ভীর গলায় বললো,
‘তুমি ইয়ার্কি করতে আমাকে ডেকেছ?’
‘তোমার তাই মনে হচ্ছে?’
‘তাহলে স্পষ্টভাবে সবটা বলো।’
‘তুমি মনে মনে যা ভাবছো,সেটাই।’
‘আমার মেয়ে!’
অনিক থমকে গেল।ওর মনে হলো ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে।নিজের মেয়েকে অবশেষে ও পেল। এজন্যই কি ওকে দেখে চেনা চেনা লাগছিল?অনিক সাফিয়ার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো।নিজের মনের সন্দেহ মেটাতে দুহাত দিয়ে মেয়ের ছোট্ট মুখখানা ধরে বললো,
‘তোমার নাম কি?’
মেয়েটা খুব ভয় পাচ্ছিল।অচেনা পরিবেশে অচেনা মানুষের সান্নিধ্যে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।অনিক সাহস দিলো।
‘বলো সোনামনি, তোমার নাম কি?’
‘সাফিয়া মুসকান ইরা।’
টেনে টেনে বলা কথাগুলো অনিকের অবিশ্বাস্য ঠেকলো।ও কোয়েলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ও কি বললো, আমাকে বলুন তো!’
কোয়েলিয়া নাম বলতেই,ও মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।চোখ কোণে আনন্দাশ্রু জড়ো হতে লাগলো।অনিক এই মুহূর্তে সুখী, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।বাবা মেয়ের এমন সুন্দর মূহুর্তের ভেতরে নাজমা ওদের কাছে এলো। আফসার শিকদারের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘বাচ্চাটা কে?’
‘সাফিয়া।’
‘সত্যি!’
‘অনিক ওকে এখন ছাড়ো। ফ্লাইটের ধকলে ও টায়ার্ড।’
কিছুক্ষণ থেমে কোয়েলিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ওকে আপাতত তোমার ঘরে নিয়ে যাও।’
অনিক এতবছর পর মেয়েকে পেয়ে ছাড়তে চায় না। সাফিয়া বোধহয় নিজের বাবাকে চিনেছে, ওকে ভয়হীন দেখলেও,মুখটা গম্ভীর দেখায়।অনিক মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো,
‘ওনার সাথে যাও। আমি কিছুক্ষণ পরে আসছি।’
সাফিয়া বাধ্য মেয়ের মতো কোয়েলিয়ার হাত ধরে কক্ষের দিকে এগোয়।
*
নীরবতা ভেঙ্গে নাজমা বললো,
‘তুমি ওকে কোথায় পেলে?বিভা তো ওকে দিতে রাজী ছিল না।’
‘ছিল না অতীত।’
‘তুমি খোঁজ কিভাবে পেলে?’
‘রিফাত নিজেই আমার সাথে কন্টাক্ট করেছে।’
‘আর বিভা! তোমরা নিশ্চয়ই ওকে ফাঁকি দিয়ে এনেছ?’
অনিকের কথায় আফসার শিকদার হকচকিয়ে গেলেও, প্রকৃতিস্থ হয়ে বললো,
‘তোমার তাই মনে হচ্ছে!বিভা অনেক বদলে গেছে। এখন ওদের দুটো ছেলেমেয়েও আছে। সাফিয়া কোথায় ছিল জানো? ওইটুকু বাচ্চাকে ওরা একজন ভার্সিটি স্টুডেন্টের দায়িত্বে রেখেছে।ওর মুখ দেখে বোঝো নি!এইটুকু বাচ্চার এমন গাম্ভীর্য স্বাভাবিক?’
‘ওদের কাছে যখন বোঝা হয়ে গেছে, আমাকে বলতো।যে প্রান্তেই থাকুক নিয়ে আসতাম।’
‘তুমি নিজে কখনো মেয়ের খোঁজখবর নিয়েছো। চেষ্টা করেছো ওকে নিজের কাছে আনার।’
‘এনেই বা কি করতাম?বিভা আমাকে দিতো? আমি প্রথমদিকে খোঁজ করিনি?’
‘পরে কেন করোনি?’
‘আমি চাইনি সে তার মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হোক।মা ছাড়া জীবনটা আমি ভালো করেই জানি। আমার মেয়ে সেভাবেই বড় হোক তা আমি কখনো চাইনি। তাছাড়া আমার ছন্নছাড়া জীবনের সাথে ওকে জড়িয়ে কি করতাম। ভেবেছিলাম ওর মায়ের কাছে ভালো থাকবে।’
‘এখন ঠিক সেটাই হলো। তোমার খামখেয়ালির জন্য মেয়েটার শৈশব এমন হয়েছে।যে বয়সে অনবরত কথা বলা, হেসেখেলে বেড়ানোর কথা,সে বয়সে ও চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তুমি জানো,ও আমাকে প্রথমবার দেখে কেমন ভয় পেয়েছিল! মিস নাদিয়া এও বলেছে,ও স্কুলে বাচ্চাদের সাথে মিশতে পারে না,ক্লাসে অন্যমনস্ক থাকে।এর জন্য বাবা হিসেবে তুমিও দায়ী।মদ তোমার বিবেচনাবোধ নষ্ট করেছে। তুমি খোঁজখবর রাখলে ওর এতকিছু সহ্য করতে হতো না। কিন্তু তুমি তো মদের বোতল আর বার ছাড়া পৃথিবীর আর কোন খোঁজ রাখো না।’
অনিকের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। এটা একদম সত্যি,ও শেষ দুটো বছর মেয়ের কোন খোঁজ রাখেনি। মানুষ দোষী হলেও নিজের দোষ স্বীকার না করে চাপা দিতে চায়।ও বললো,
‘আমি মানছি আমি দোষী। তবে আমিও তো চেষ্টা করেছিলাম, আমার মেয়েকে ফিরে পেতে। আমি জোর করিনি,কারণ জোর করে কিছু পাওয়া আমার পছন্দ না। আমার বিশ্বাস ছিল বিভা ওকে আগলে রাখবে। একজন মায়ের থেকে সন্তানকে আলাদা করার ইচ্ছে ছিল না।সত্যি করে বলোতো,বিভা জানে এসব?’
‘এতক্ষণ কি তাহলে আমি মিথ্যে বলেছি!’
‘রেগে যাচ্ছ কেন?কোর্ট কিন্তু মেয়ের কাস্টাডি বিভাকে দিয়েছিল। তখন তুমি হাত গুটিয়ে বসে ছিলে। ইচ্ছে করলে, তুমি সাফিয়া কে আমাদের কাছে রাখতে পারতে। কিন্তু তুমি কি বলেছিলে?ক্ষমতার অপব্যবহার করতে চাও না! মায়ের থেকে সন্তানকে আলাদা করা ঠিক নয়! তুমি ঠিক কি চেয়েছিলে এখন আমি বুঝি।দোষ আমার একলার না।’
আফসার শিকদার হতভম্ব হয়ে গেলেন।এযে ডাল ভাঙতে গিয়ে গোড়াসুদ্ধ উঠে চলে এলো। নাজমা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বললো,
‘পুরোনো কথা বাদ দেও। এখন সাফিয়াকে পেয়েছ, ওর খেয়াল রাখা বাবা হিসেবে তোমার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে তোমার নামরূপী ওয়াইফকে ভরসা না করাই ভালো।’
অনিকের কথাটা ভালো লাগলো না।ও কড়া গলায় বলল,
‘ভালোকে ভালো বলতে শেখো।তার ভেতরে অতিরিক্ত ধৈর্য্য ছাড়া দোষের কিছু পাইনি।’
নাজমার মুখটা অন্ধকার দেখালো।অনিক খেয়াল করেও করলো না।এই মণি আর বাবা মিলে অতীতে যা করেছে,তা তো ও ভোলেনি। পুনরায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চোখের সামনে ঘটতে দিতে পারে না।
বোনের পাংশুবর্ণ মুখ দেখে আফসার শিকদারের মনঃকষ্ট হলো। কিন্তু অনিক আগের মতো নেই। তাকে কিছু বলা মানে মৃত্তিকায় চাপা পড়া বহু কথা বের হয়ে আসা। ভদ্রলোক কথা ঘোরালেন।
‘তোমাকে একটা কথা পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই,যদি তুমি মদ না ছাড়তে পারো তবে তোমায় মেয়েকে আমি আবার ইউকে তে ফিরিয়ে দিয়ে আসবো।’
‘কক্ষনো না। আমার মেয়েকে যখন একবার পেয়েছি, তখন অন্য কোথাও রাখার কথা ভুলেও ভেবো না।’
‘তাহলে তোমাকে সব ছাড়তে হবে।’
‘ছেড়ে দেব, কিন্তু সময় লাগবে।’
‘কথা দিচ্ছো।’
‘তুমি তোমার কথা রাখলে আমিও রাখবো। কিন্তু তোমার এই খেলায় আমার মেয়েকে গুটি বানালে আমি সবথেকে খারাপ হব।’
আফসার শিকদার কোন জবাব দিতে পারলো না।অনিক বসা ছেড়ে উঠে বললো,
‘কোয়েলিয়াকে ওর মতো ছেড়ে দেবে।ওর সুন্দর জীবন নষ্ট করে তুমি অপরাধী। মণি তোমাকে আমি শ্রদ্ধা করি, এতকিছুর পরও।’
অনিক চলে গেল নিজের কক্ষের দিকে।পেছনে ফেলে গেল দুজন হতভম্ব মানুষকে।তার বলা একটুকরো বাক্য এদের মনে বহুদিনের পুরনো প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়ে অপরাধী করে তুললো।
*
সাফিয়া বয়স হিসেবে খুব স্মার্ট। সাহায্য ছাড়াই,একা একা পোশাক পরে এখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধার চেষ্টা করছে। কোয়েলিয়ার ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগলো। এইটুকু বাচ্চারা সাধারণত মায়ের কোলঘেঁষা হয়, কিন্তু সাফিয়া একদম ব্যতিক্রম।ও হেসে বলল,
‘ইরা, আমি চুল বেঁধে দিই?’
কোয়েলিয়ার কন্ঠে ইরা নামটা সাফিয়ার কাছে ভালো শোনালো। কেননা বিভা ওকে ইরা নামে ডাকে।ও কথা না বলে চিরুনিটা এগিয়ে দিলো।
‘ইরা, তোমার বয়স কত?’
‘ছয় বছর।’
‘এই বয়সে তুমি সবকিছু শিখে ফেলেছো।গুড গার্ল।’
কোয়েলিয়া ওর চুলগুলো বিনুনি করে দিচ্ছিল আর ওর সাথে কথা বলছিল। সাফিয়া মাঝেমাঝে হু হা উত্তর ছাড়া বেশি কিছু বলছিল না।একদম বাবার যোগ্য কন্যা।তবে কোয়েলিয়ার ওর সাথে কথা বলতে ভালোই লাগছে। মানসপটে বারংবার ছোট ভাই সালমানের কথা ভেসে আসছে। কতদিন ওদের দেখে না,কথাও হয় না।এবাড়ির প্রত্যেকেই পাষাণে গড়া। সেখানে একটি কোমল ফুল পেয়ে,ওর বেদনাগুলো ভোলার বৃথা চেষ্টা করলো।
‘ইরা।’
‘হু।’
‘তোমার মন খারাপ। বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে?’
ইরা উদাস হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর হুট করে কেঁদে উঠলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,
‘আম্মুর কাছে যাবো।’
কোয়েলিয়া ইরাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা শব্দহীন ফুঁপিয়ে কাঁদছে।ও বললো,
‘ইরা, তোমার মা কোথায় থাকে?’
‘অনেক দূরে।’
‘কতদূরে।’
‘অনেক।’
কোয়েলিয়া খেয়াল করলো, সাফিয়া বাংলা বুঝলেও ঠিক করে বলতে পারে না। বরঞ্চ ইংরেজিটা ও ভালো পারে। মেয়েটা তখনো কেঁদেই চলেছে। কোয়েলিয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘ কেঁদো না সোনা। তোমার মা তোমাকে নিতে ঠিক আসবে।’
‘সত্যি আসবে!আমি অনেকদিন মা’কে দেখিনা।মা আসবে তো?’
কোয়েলিয়ার মনে অনেক প্রশ্ন জমলেও শিশুর কাছ থেকে তার উত্তর জানতে বিবেকে বাঁধলো।ও প্রশ্নগুলোকে একপাশে ফেলে রেখে বলে,
‘সত্যিই আসবে। এখন তোমার চুলটা বেঁধে দিই।দুপুরের খাবার খেতে হবে তো।’
‘আচ্ছা তুমি আমার কি হও?’
কোয়েলিয়া দ্বিধায় পড়ে গেল। সম্পর্কে ওর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী, সোজা বাংলায় সৎমা। কিন্তু এই বাচ্চাটার কাছে ও কি পরিচয় দেবে? সাফিয়া প্রশ্নাবিদ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কোয়েলিয়া ইতস্তত করে বললো,
‘তোমার যা ইচ্ছে হয় বলতে পারো।’
সাফিয়া ভাবনায় পড়ে কিন্তু সম্ভাষণের জন্য সঠিক কিছু খুঁজে পায় না। কোয়েলিয়া নিজেও চিন্তিত।এই মেয়েকে মা ডাকতে বললে এরা হয়তো অনেক ঝামেলা হবে, তাছাড়া সাফিয়াও যথেষ্ট বুদ্ধিমতী ওকে মা হিসেবে মেনে নেবে কিনা সন্দেহ!আর ও তো নামমাত্র অনিকের স্ত্রী।যাদের ভেতরে বন্ধুত্ব তো দূরে থাক, সামান্য কোন সম্পর্ক ও নেই। অনেকক্ষণ ভাবার পর ও সাফিয়া কে বললো,
‘তুমি বরং আমাকে আন্টি ডেকো।’
সাফিয়া খু্শি হয়ে বললো,
‘ওকে।’
‘খেয়ে নেবে,চলো।’
সাফিয়া ওর হাত ধরে বাইরে গেল।
*
অনিক মেয়েকে নিতে কোয়েলিয়ার কক্ষের সামনে এসে সুন্দর একটি দৃশ্য দেখলো। সাফিয়া কোয়েলিয়ার কোলে বসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,আর কোয়েলিয়া ওকে কোন একটা মজার কথা বলে নিজেই হাসছে। সাফিয়ার মুখে হাসি নেই কিন্তু ওকে বিরক্তও দেখালো না।ও কৌতুহল নিয়ে কোয়েলিয়াকে দেখছে।
কোয়েলিয়া কথা বলা অবস্থায় দরজার দিকে তাকাতেই অনিককে দেখলো। তৎক্ষণাৎ ওর মুখ থেকে হাসি গায়ের হলো।বললো,
‘কোন দরকার?’
‘ওকে নিতে এসেছিলাম।’
কোয়েলিয়া সাফিয়ার কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে বললো,
‘ইরা, তোমার বাবার সাথে যাও।পরে আমরা কথা বলবো।’
সাফিয়া ওঠে না।বরং কোয়েলিয়ার বুকে মুখ লুকায়।
‘ইরা,ভয় কেন পাচ্ছো?ওইযে তোমার বাবা।’
সাফিয়া মুখ তুলে একবার তাকায়। তারপর মিনমিন করে বলে,
‘আমার বাবা তো এখানে আসেনি।’
‘ওইযে উনি তোমার বাবা। এখন যাও ভয় নেই।’
সাফিয়া কে দ্বিধান্বিত দেখায়।কোয়েলিয়া অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি ওকে নিয়ে যান,ও এখনও ভয় পাচ্ছে।’
অনিক এসে সাফিয়াকে কোলে তুলে নিলো। সাফিয়া ভয়ে কুঁকড়ে আছে। অনিক মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
‘এখন থেকে আর তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।’
তখনকার মতো সাফিয়া নাকে সেই গন্ধটা পেল না।তার পরিবর্তে খেয়াল করলো ওর এই নতুন বাবার কাছ থেকে কেমন একটা ফ্রেশ স্মেল আসছে। অবশ্য বাচ্চা মেয়েটা কিভাবে জানবে,তার বাবা মদের গন্ধ আড়াল করতে মাউথ ফ্রেশনার ব্যবহার করে। ওকে ভয় পেতে দেখা গেল না। রক্তের টান যে বড় টান। জন্মদাতা বাবাকে কখনো না দেখলেও,তার সম্পর্কে না জানলেও সাফিয়া বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু ও এখনও ভাবছে একজন মানুষের দুটো বাবা কিভাবে হয়?তবে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস হয়ে উঠছে না।
চলবে..
®️ সুমি খানম