#ম্লান_সন্ধ্যায় (১৭)
বৃদ্ধ বয়সে ত্রিশোর্ধ্ব ছেলেকে নিয়ে চিন্তায় রক্তচাপ বাড়বে, ভদ্রলোক বোধহয় কখনো ভাবেনি।আজ ওনার মনে হচ্ছে, সন্তানকে সময় না দেওয়ার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে। গতরাতে সিয়াম বাইক নিয়ে অনিকের গাড়ি অনুসরণ করার পরও দূর্ঘটনা থেকে অনিককে রক্ষা করতে পারেনি।ভাগ্য ভালো ব্রেক কষতে গিয়ে গাছের সাথে লেগেছিল। সামনের ট্রাকটায় যদি সত্যিই ধাক্কা লাগতো!উফ ভাবতে পারছেন না? বারবার কল্পনায় তখনকার দৃশ্যপট ভেসে উঠলে শিউরে উঠছেন। সিয়াম তৎক্ষণাৎ অ্যাম্বুলেন্স কল করেছিল বলে রক্ষা।ছেলের এমন অবস্থায় রাগের মাথায় সিয়ামকে একদফা ধমকেছেন।যদিও অনিকের তেমন ক্ষতি হয়নি, মাথায় আঘাত পেয়েছে, সেই সাথে ঘাড় এবং ডানপা টাও মচকে গেছে। আপাতত ঘাড়ে ব্যাথার সাথে সাথে বেশ কয়েকদিন হাঁটাচলা করতে সমস্যা হবে।
অবশ্য সিয়ামের এতে কোন দোষ নেই, ওকে ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। সবকিছু ভেবে দেখলে দোষটা ওনার। গতরাতে যেটা হলো তার উপলক্ষ্য ওই মেয়েটা হলেও, অপরাধী তিনি। কিন্তু ভদ্রলোক ই বা কিভাবে জানবেন ছেলে তার ,মেয়েটার মায়াজালে এমনভাবে আটকে গেছে। জ্ঞান ফিরতেই ছেলের পাগলামি দেখে তিনি রীতিমতো অবাকের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন।পারলে ওই আঘাত নিয়েই মেয়েটাকে আনতে চলে যায়। তাকে বুঝিয়েও যখন লাভ হয়নি, শেষমেশ সমস্ত ইগো দূরে সরিয়ে নাজমাকে পাঠিয়েছেন।
*
কোয়েলিয়া যখন হাসপাতালে পৌঁছাল, তখন বেলা ১০,টা। ওষুধের প্রভাবে অনিক ঘুমাচ্ছিল। মাথা পায়ে ব্যান্ডেজ মুখটা মলিন। কোয়েলিয়া অনিকের হাতটা আঁকড়ে ধরে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো। পুরোটা সময় ও শঙ্কায় ছিল, অনিকের খুব ক্ষতি হয়নি তো!ওমন লম্বা চওড়া মানুষকে ও কিছুতেই চোখের সামনে অচল দেখতে পারবে না। কোয়েলিয়া আরও শক্ত করে দুহাতে অনিকের হাতটা ধরলো। সাধারণ ঘুম হলে হয়তো অনিক চমকে উঠে ধমকাধমকি করতো। কিন্তু এখন তেমন কিছুই ঘটলো না।
সরফরাজ কোয়েলিয়াকে ডাকতে এসেছিল।এমন দৃশ্য দেখে ওর মুখটা মলিন দেখায়।ও বললো,
‘আপনাকে নাদিম আঙ্কেল ডাকছেন।’
কোয়েলিয়া অনিকের হাত ছেড়ে ওর ঘাড়টা সোজা করে বালিশে রাখে। অতঃপর সরফরাজকে অনুসরণ করে ও ডাঃ নাদিমের কেবিন গেল।
নাদিম ওকে দেখে স্মিত হেসে বলল,
‘এইযে মিসেস আহসান।ব্যস্ততার কারণে তোমার সাথে পরিচয় হয়নি। আমি তোমার শশুর মহাশয়ের বন্ধু। তোমার আসার অপেক্ষায় ছিলাম,বসো।’
কোয়েলিয়া প্রতিত্তরে সালাম দিয়ে বসলো। আফসার শিকদারের পাশে এভাবে বসতে ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সেদিনের ঘটনা খুব ভালো করেই ওর মনে গেঁথে আছে। ওনার বাড়ি বলেই যখন ইচ্ছে বের করে দেবেন! এখানে এসেছে শুধুমাত্র অনিকের জন্য,ওর সাথে কথা বলে ও চলে যাবে। স্বেচ্ছায় ও বাড়িতে ফিরে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া, নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করা।
ডাঃ নাদিম ওদের দিকে পর্যবেক্ষণ করে বললো,
‘মনোযোগ দিয়ে দুজনে আমার কথা শোন।এক্সিডেন্টটা সামান্য হলেও মেজর প্রবলেমটা কিন্তু তোমাদের ধারণাতেও নেই।’
আফসার শিকদার নড়েচড়ে বসলেন। কোয়েলিয়া একবুক আশঙ্কা নিয়ে সমস্যার কথা শোনার অপেক্ষায় । নাদিম বললো,
‘তোর কথামতো ওর ফুল বডি চেক আপ করেছি।প্রথম কথা হলো, ও অ্যালকোহলে এডিক্টেড।তাও কখনো কখনো মাত্রারিক্ত পান করে।নামী ব্রান্ডের মদগুলো উন্নতমানের পাশাপাশি খুব ক্ষতিকর।মদ্যপানকে এমনিতেও অসুখ ধরা হয়।ও যদি এখন থেকে এসব ছেড়ে না দেয়, খুব শীঘ্রই মারাত্মক পরিণতির শিকার হতে হবে।’
‘মানে,তুই কি বলতে চাইছিস?’
নাদিম আফসার শিকদারের সামনে রিপোর্টগুলো এগিয়ে দিলে ভদ্রলোক ওগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। নাদিম গলা খাঁকারি দিতেই আফসার শিকদার ওর দিকে তাকায়।ও বললো,
‘দেখ এমনিতেই অল্পস্বল্প মদ খাওয়াটাও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সেখানে ওর রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রাতিরিক্ত ট্রেস পাওয়া গেছে। এরকম চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই ওর লিভার সিরোসিস হবে, এখন যে ফেজে ও আছে ওর স্ট্রোকের সম্ভাবনা এইটটি পার্সেন্ট।আর্টারিতে অলরেডি কোলেস্টেরল জমে গেছে, যা ধীরে ধীরে অ্যারিথমিয়ার দিকে গড়াবে।অ্যারিথমিয়া বুঝতে পারছো,হৃৎপেশী দূর্বল হয়ে যাবে যার জন্য হার্ট ফেইলিউরের সম্ভাবনা দেখা দেবে।গত কয়েক বছরে ও এগুলোতে এতো পরিমাণ এডিক্ট যে ওর লিভার,কিডনি,হার্ট সবকিছুর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে এসবের সাথে সাথে ওর মেমোরি লস দেখা দেবে, ইমিউনিটি এমনিতেই কমে গেছে। তাছাড়া ওর শরীরে টেস্টোস্টেরন এর মাত্রাও পূর্বের তুলনায় কম।’
আফসার শিকদারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখালো। ভেতরে ভেতরে তার ছেলের অবস্থা এতটা খারাপ ভাবতে পারেনি। নাদিম হয়তো সেটা খেয়াল করলো,ও বললো,
‘তবে যদি আস্তে আস্তে ও কমায় এবং মেডিকেল ট্রিটমেন্টে থাকে তবে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু ওকে মদ পুরোপুরি ছাড়তে হবে। নয়তো ডাক্তারদের কিছুই করার থাকবে না। এজন্য তোমাদের এখানে ডেকেছি।তবে ও যেন এসব কিছুই জানতে না পারে। বুঝতে নিশ্চয়ই পারছো, নিজের ব্যাপারে সহজে কেউ এগুলো মেনে নিতে পারে না। তবে আমি আশাবাদী,সঠিক নিয়ম মেনে চললে ও সুস্থ হবে, কিন্তু সেটা একসপ্তাহ বা মাসে নয়,বেশ অনেকটা সময় লাগবে। ততদিন ধৈর্য্য ধরে ওর খেয়াল রাখতে হবে।’
নাদিম একটু থেমে ফের বললো,
‘মিসেস আহসান,এই দায়িত্ব কিন্তু তোমারও।সে তোমাকে ভালবাসে, তোমার কথায় এগুলো ত্যাগ করা অসম্ভব নয়।ইনফ্যাক্ট অনেক বাঙালি স্ত্রীর জন্য এসব স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয়।’
কোয়েলিয়া মনে মনে হাসলো।ওর কথায় অনিক মদ ছাড়বে?অনিককে ও খুব ভালো করে চেনে।তবে যা শুনলো তাতে অনিকের এগুলো থেকে সরে আসাটাও খুবই জরুরি।
*
হাসপাতালে সারাহ সাফিয়াকে নিয়ে এসেছিল।সাফিয়া কোয়েলিয়াকে দেখা মাত্রই একরকম দৌড়ে এসে কোমর জড়িয়ে ধরল। অভিমানী গলায় বলল,
‘কোথায় গিয়েছিলে আন্টি।সবার কাছে কতো জিজ্ঞেস করেছি, কেউ কিছু বলেনি।’
কোয়েলিয়ার মনে প্রশান্তি খেলা করলো। সন্তানের ডাক এতোটা মধুর বলেই হয়তো অনেক মায়েরা সন্তানের মুখ চেয়ে এক জীবন কাটিয়ে দেয়।ও সাফিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘একটু কাজ ছিল ইরা।এইতো এখন চলে এসেছি।’
‘আন্টি আম্মু কবে আসবে?’
‘খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে।চলো বাবার কাছে যাই।’
‘আচ্ছা চলো।’
‘বাহ, দু’জনে আমাকে ভুলেই গেছো দেখছি।’
কোয়েলিয়া হেসে বলল,
‘তোমাকে ভুলতে চাইলে ভুলতে কি দেও।’
‘তোমার এতো রাগ, ভাবতেই পারিনি।’
‘রাগ ভালোবাসা আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে আছে। কারোরটা বেশি প্রকট কারোরটা চাপা পড়ে থাকে।তবে রাগ ছাড়া মানুষ অসম্ভব।’
ওরা অনিকের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। বিকেলে ওকে বাড়ি নিয়ে যাবে,যদিও কোয়েলিয়া স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও ওই বাড়িতে ফিরবে না।সারাহ অপেক্ষাকৃত আস্তে বললো,
‘একটা বিশেষ খবর দিই তোমাকে।’
‘কি!’
‘গতরাতে ভাইয়া তো পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিল।তখন ই তোমাকে আনতে যাবে। কোনোমতে ওকে সামলে রেখেছিল।’
কোয়েলিয়ার হঠাৎ ভালো লাগলো, খুব ভালো লাগলো।মনজুড়ে শয়ে শয়ে প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াতে লাগল। একজন মেয়ের কাছে এইতো বড় পাওয়া।এক জীবনে বৈধ পুরুষের ভালোবাসার বিনিময়ে শত বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতেও আপত্তি নেই।
*
অনিকের ঘুম ভাঙ্গার পর কোয়েলিয়ার হাতের মুঠোয় নিজের হাতটা দেখেও কিছু বলেনি,হাতটাও সরিয়ে নেয়নি। তবে কোয়েলিয়ার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি দেখে ও অন্যকিছু ভাবলো। কন্ঠে গাম্ভীর্য ঢেলে বললো,
‘আমি শুধু আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে যাচ্ছিলাম।অন্য কিছু ভাববেন না।’
‘আচ্ছা ভাবছি না।’
‘কিন্তু আপনি ভাবছেন।’
‘তাই নাকি! কি ভাবছি?’
‘এই যে আপনাকে আমি ভালোবাসি। সেজন্য আপনার অনুপস্থিতিতে বিরহে ছিলাম।’
‘সত্যি ভালোবাসেন! বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘ওহ গড। আমি বলেছি আপনি ভাববেন না যে আমি আপনাকে ভালোবাসি বলে আপনার কাছে যাচ্ছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমা চাওয়া। মেয়েদের গায়ে হাত তোলা আমার পছন্দ না,তাই নিজেকে ছোট মনে হচ্ছিল।’
‘ওহ আচ্ছা। আপনি ফোনকল করতে পারতেন। এরকম ঝুঁকি নিলেন কেন?’
‘রিস্ক আমি নিয়েছি।তাতে আপনার কি?’
‘আমার কিছুই না।’
অনিক কোয়েলিয়ার দিকে তাকালো। এলোমেলো চুলগুলো কোনোরকমে গোঁজা। কপালে ছোট্ট ছোট্ট কোঁকড়া চুলগুলো পড়ে রয়েছে। চোখের দৃষ্টি শ্রাবণের ধারার ন্যায় স্নিগ্ধ।কি সুন্দর ওই মুখখানা। কোয়েলিয়া মুচকি হেসে বলল,
‘কি দেখছেন ওভাবে?’
অনিকের ঘোর ভাঙলে লজ্জায় অন্যদিকে তাকালো। এমনিতেই বেইমান সারাহ গতরাতের সব ঘটনা নিশ্চয়ই এতক্ষনে বলে দিয়েছে। এইটুকু মেয়ের কাছে ওর জন্য তা লজ্জার। মেয়েটা কি ভাবছে ওকে!ও বললো,
‘শুনুন মনে মনে আকাশকুসুম রচনা করার দরকার নেই।পরে সত্যি মেনে নিতে কষ্ট হবে।’
‘তাই নাকি!’
‘অবশ্যই। মেয়েদের কাজ হলো একটুতে অনেকটা ভেবে নেওয়া।’
‘মেয়েদের নিয়ে রিসার্চ করছেন নাকি!’
‘আপনাকে দেখেই বুঝেছি।ড্রাংক ছিলাম তাই এক্সিডেন্টটা হয়েছে। অথচও আপনি ভাবছেন অন্যটা।ভাববেন না আপনার অনুপস্থিতিতে দেবদাস হয়েছিলাম।’
‘তাই ই ভাবছি।’
‘মানে?’
‘এইযে আপনি হঠাৎ বিরহে অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেছিলেন।’
‘আজ আপনি একটু বেশি কথা বলছেন।’
‘তাহলে চুপ থাকি।এই চুপ করলাম।’
‘কথা বলতে কখন বারণ করলাম!’
‘আপনি আমাকে আপনি করে সম্বোধন কেন করেন?’
‘একই প্রশ্ন আমারও।’
‘কারণ বয়স এবং সম্পর্ক দুটোতেই আপনি আমার গুরুজন।’
‘আর আমি ছোটদেরকেও সম্মান দিয়ে আপনি ডাকি।’
‘খুবই নড়বড়ে যুক্তি।এই যুগে স্বামী তার স্ত্রীকে আপনি সম্বোধন করছে,ব্যাপারটা খুবই দৃষ্টিকটু দেখায়।’
‘দেখাক। আমি অন্যদের নীতিতে চলি না।’
অনিক শোয়া থেকে উঠে বসলো। কোয়েলিয়া ওর পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসতে সাহায্য করলো। এইটুকু দূর্ঘটনায় লোকটা অনেক কাতর হয়ে গেছে।অনিক বাইরের পানে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ দু’জনে ভেতরে নীরবতার যুদ্ধ চললো।অনিক নীরবতার জাল ছিঁড়ে বললো,
‘শুনুন কোয়েলিয়া.’
‘সিগারেট ধরাবেন! কিন্তু হসপিটাল এটা চলবে না।’
‘উফ, কিছু হলেই সিগারেট ধরাবেন নয়তো বিয়ার খাবেন। আমাকে দেখে মনে হয় টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স বিয়ারে ডুবে থাকি!’
বিরক্তিতে অনিকের ভ্রু কুঁচকে গেল।তা দেখে কোয়েলিয়া হাসলো।বললো,
‘আচ্ছা বলুন কি বলবেন।’
অনিক কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ওভাবেই থাকে। তারপর বলে,
‘শুনুন কোয়েলিয়া, আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আপনাকে ভালোবাসতে ইচ্ছেও করে না।’
‘সত্যি ভালোবাসেন না! আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুন।’
‘উফ আপনি আমার মাথাটা খেতে এসেছেন।এই আপনাকে কে এখানে আসতে বলেছে।’
‘আপনিই তো আমাকে আনতে যাচ্ছিলেন,তাই নিজেই চলে এলাম।’
‘অসম্ভব, আমি আপনাকে আনতে যাচ্ছিলাম না। শুধু নিজের করা অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাইবো বলেই বের হয়েছিলাম।’
অনিক দুহাত বুকে গুজে অন্যদিকে তাকালো। এতক্ষণ অনিককে বিরক্ত করতে ওর খুব ভালো লাগছিল। লোকটা কোনোমতেই ভালোবাসার কথা স্বীকার করবে না।অনিক সেইসব পুরুষদের দলে যারা ভালোবাসবে, তবু স্ত্রীর কাছে দূর্বল হবার ভয়ে স্বীকার করবে না। সবসময় এমন একটা ভাব করবে , চোখের দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে যেন,
‘তুমি আমার মতো স্বামী পেয়ে ধন্য হয়েছো। তোমার কাছে পরাভূত হবার প্রশ্নই আসে না।’
কোয়েলিয়া হাসলো। অনিকের সে হাসি দৃষ্টিগোচর হতেই বললো,
‘আপনি হাসছেন কেন?’
‘কেন?হাসাও বারণ।’
‘উল্টো বুঝছেন কেন! আপনার হাসির ভেতর অন্য কিছু লুকিয়ে আছে।’
‘আচ্ছা!কি লুকিয়ে আছে?’
‘এইযে আপনি ভাবছেন আমি আপনাকে ভালোবাসি। শুনুন ভালো করে কান খুলে শুনুন আমি আপনাকে মোটেও ভালোবাসি না।’
‘এক কথা কতবার বলবেন। এখন বিশ্রাম করুন। আপাতত একসপ্তাহ বেডরেস্ট।’
‘জীবনটাই শেষ আমার।’
‘সবেমাত্র শুরু।’
‘আপনি চুপ করুন,অসহ্য লাগছে আমার।’
‘আপনাকে অসহ্য হতে দেখে ভালো লাগলো।’
‘আশ্চর্য।’
‘অতি আশ্চর্য।’
‘উফ,এ কি মানুষের পাল্লায় পড়লাম।’
কোয়েলিয়া হাসলো। অনিক ওর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ঘোরে চলে গেল। মোহাবিষ্টের ন্যায় শোয়া থেকে উঠে সামনে বসে থাকা কোয়েলিয়ার মুখটা দুহাতে আকড়ে ধরে অধরযুগল আক্রমণ করলো। তারপর ফিসফিস করে বলল,
‘অসহ্য , অসহ্য আপনি।’
কোয়েলিয়া হতবাক হয়ে অনিকের দিকে তাকালো।এই সামনের লোকটা একটা বহুরূপী।যে ক্ষণে ক্ষণে একেকরকম দশায় থাকে।
*
বিকেলে অনিককে গাড়িতে তুলে কোয়েলিয়া বাবা ছেলে দু’জনকেই হতভম্ব করে দিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।অনিক পেছন থেকে জোরে বললো,
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘বাড়িতে।’
দু’জনেই বুঝলেন কোয়েলিয়া মনের ভেতর এখনও রাগ পুষে রেখেছে। মেয়েটা যে এতো জেদী এতদিনে বুঝতেও পারেনি।অনিক গাড়ি থেকে বেরোতে নিলেই আফসার শিকদার বললো,
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘ওকে আনতে।’
‘তুমি এই অবস্থায় যাবে!কক্ষনো না।’
‘হ্যাঁ আমি যাবো। ভুল করেছি তা শুধরে নেবার দায় আমার।’
অনিক গাড়ি থেকে নামার উপক্রম করলে আফসার শিকদার ওকে আটকায়। বুঝলেন বহু বছর পর ছেলের মাথায় আবার ভূত চেপেছে।
‘তুমি ছাড়ো আমাকে।ওভাবে বলার পর কেইবা ফিরে আসবে!’
‘তুমি বসো, আমি দেখছি।’
অনিক তবুও থাকতে চায় না। আফসার শিকদার ওকে ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢোকালেন। এরপর নিজেই সামনের দিকে অগ্রসর হলেন।
‘এই মেয়ে দাঁড়াও।’
কোয়েলিয়া গেটের বাইরে সবেমাত্র পা রেখেছিল, রাশভারী গলার আওয়াজে পেছন ফিরলো। আফসার শিকদারকে দেখে ও যেন নিজের দৃষ্টিকেই বিশ্বাস করতে পারলো না।এই লোক সেদিনের ঘটনার পর ওকে আগ বাড়িয়ে ডাকলো! অন্ততঃ সে যাকে চেনে, সেই আফসার শিকদার ওর সাথে এতো সহজে কথা বলবে না।
আফসার শিকদার কোয়েলিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়।কিন্ত মেয়েটার সাথে কথা বলতে ভদ্রলোকের আত্মসম্মানে ঠেকলো। তবুও একমাত্র সন্তানের ভালোর জন্য ওনাকে এটা করতে হবে। সন্তানের জন্য বাবারা খু’ন পর্যন্ত করেন,সে তুলনায় এটা সামান্য হলেও আফসার শিকদারের মতো রাশভারী মানুষের কাছে অসম্ভব। তবুও সকল দ্বিধা দূরে ঠেলে বললেন,
‘তুমি ফিরে চলো। আমি আমার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।’
কোয়েলিয়া কোন উত্তর দিতে পারলো না। ভেবেছিল ওকে নিতে আসলে বেশ ভালো রকমেরই কথা কাটাকাটি করবে। কিন্তু এই মূহুর্তে ও কিছুই বলতে পারলো না। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শশুরের পরাভাব মেনে নিতে ওর কষ্ট হলো। সদুত্তরের অভাবে ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আফসার শিকদার ফের বলে,
‘নিজের সংসার এভাবে ছেড়ে দিও না।ফিরে চলো। আমার ছেলেটাকে এভাবে ফেলে যেও না। একজন বাবা হিসেবে অনুরোধ করছি।’
কোয়েলিয়া তার শশুরকে কখনো এভাবে দেখেনি।ও বিস্মিত হলো, কিন্তু একটি কথাও কন্ঠনালী ভেদ করে বাইরে এলো না।কলের পুতুলের ন্যায় গাড়ির দিকে গেল।চ্যালেঞ্জে জিতেও মনের ভেতর আনন্দের পরিবর্তে গ্লানি জমা হলো। একজন বাবার বয়সী মানুষ ওর কাছে ক্ষমা চেয়েছে,এটা গ্রহণ করার মতো মানুষের সংখ্যা যে কম। আফসার শিকদার জানলো এই দ্বন্দ্বে কোয়েলিয়া জিতলো। কিন্তু কোয়েলিয়া আর এই বিশ্বসংসার জানলো জিত একজন বাবারই হয়েছে। সন্তানের জন্য বাবারা কখনো হারেনা।
চলবে..
®️ সুমি খানম
#ম্লান_সন্ধ্যায় (১৮)
অনিকের এভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতে খুব বিরক্ত লাগছে।তাও আবার ঘাড় সোজা করে, একটু এদিক ওদিক ফেরালে অসহ্য যন্ত্রণা।সারভাইক্যাল কলারটা শোয়ার সময় ব্যবহার করা নিষেধ, উঠে বসতেও ক্লান্তি লাগছে, দাঁড়ানো তো অসম্ভব প্রায়। অগত্যা উপায়ন্তর না দেখে এভাবে থাকতে হচ্ছে।ফোনটা যে ধরবে তার উপায় নেই। সাফিয়া নিয়ে নিজের কাছে রেখেছে,এসব কার পরামর্শ ও ঠিকই বুঝতে পারলো।বললো,
‘সাফিয়া, ফোনটা একটু দেও তো।’
সাফিয়া তাড়াতাড়ি ফোনটা পিছনে লুকালো। তারপর বললো,
‘না,বাবা। তোমার ফোন ধরা নিষেধ।’
‘কেন মা?’
‘আন্টি বলেছে তুমি অসুস্থ। এখন মোটেও এদিক ওদিক তাকানো যাবে না।’
‘ওহ্,অসহ্য।’
অনিকের রাগ হলো। এভাবে শুয়ে থাকতে কোন মানুষের ভালো লাগে না।ওর মতো মানুষের তো মোটেও নয়।ও উঠে বসার চেষ্টা করলেও ঘাড়ের যন্ত্রনায় ব্যাথাতুর শব্দ করে উঠলো। সাফিয়া উঠে গিয়ে ছোট ছোট হাত দিয়ে বাবার ঘাড়ে আলতো করে ম্যাসাজের চেষ্টা করলো।
‘বাবা, তোমার খারাপ লাগছে। আন্টিকে ডেকে আনি।’
অনিকের মনজুড়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। সন্তানের ছোঁয়া যেকোন পিতার কাছে পরম অনুভূতির বস্তু।তার সেই ছোট্ট সাফিয়া কতটা বেড়ে উঠেছে। ভাবলেই অবাক লাগছে ও একজন বাবা,ওর ছোট্ট একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে। এখন ওর কত দায়িত্ব, অথচো ও নিজের জীবনটাকে এক জায়গায় আটকে রেখেছিল।ও মেয়ের হাত দুটো ধরে বললো,
‘কাওকে ডাকতে হবে না। তুমি আমার পাশে একটু বসো।’
সাফিয়া ওর বাবার বুকের উপর গড়াগড়ি খেলো। বাবাকে পেয়ে এতদিনের লুকিয়ে থাকা বাচ্চামো গুলো জেগে উঠেছে ।ও অনিকের নাক ধরে টেনে বলে,
‘বাবা তোমার নাক কতো লম্বা।কার মতো জানো?’
‘তুমি বলো দেখি।’
সাফিয়া বাবার বুকের ওপর শুয়ে মুখে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলো,তার বাবার নাকটা আসলে কার মতো।
‘পেয়েছি!’
‘কি পেয়েছ?’
‘তোমার নাকটা একদম হ্যারি পটারের মতো।’
‘তুমি হ্যারি পটার দেখেছো!’
‘হ্যাঁ।সিনডোরেলা,স্নো হোয়াইট ও দেখেছি।মিস নাদিয়া আমাকে অনেকগুলো কমিকস কিনে দিয়েছে। আমার এত্তো এত্তো বই আছে।’
‘বাহ্, আমার মা দেখছি অনেক কিছু জেনে ফেলেছে।’
‘আচ্ছা বাবা, একটা কোয়েশ্চন করলে কি তুমি আমাকে বকবে?’
‘মোটেও নয়। আমি আমার ছোট্ট সোনামণিকে বকতে পারি!’
‘তাহলে বলো, তুমি আমার বাবা হলে আম্মুর সাথে যে থাকে সে আমার কি হয়?’
রিফাতের কথা মনে পড়তেই অনিকের চোয়াল শক্ত হলো। কিন্তু মেয়ের সামনে তা প্রকাশ করলো না।বললো,
‘উনি তোমার আঙ্কেল হয়।আর আমি তোমার বাবা,ইওর ফাদার।’
‘দারুন তো!আম্মু আঙ্কেলের সাথে থাকে, তুমি আন্টির সাথে।’
অনিক মেয়ের হাসি মাখা মুখে চুমু খেল।এই মেয়ে বড় হয়ে যখন সব জানবে, তখন জানেনা সবটা কিভাবে নেবে। তবে আপাতত সেসব নিয়ে ও ভাববে না। বর্তমান ওর কাছে মুখ্য বিষয়।
কোয়েলিয়া ভেতরে ঢুকে সাফিয়া কে ওভাবে দেখে বললো,
‘ইরা, বাবার ওপর থেকে নামো।বাবা অসুস্থ, কষ্ট হবে।’
সাফিয়া হন্তদন্ত হয়ে নামতে গেলেও অনিক মেয়েকে ধরে রাখে।ও বললো,
‘আমার সমস্যা হচ্ছে না।’
‘রাতে ও আপনার কাছেই থাকবে। এখন আপনার খাওয়ার সময়।’
‘এখন কি আপনার রুটিনে চলতে হবে?’
‘ধরে নিন তাই।’
‘একদম পারবো না।’
‘তাহলে ওভাবেই বিছানায় শুয়ে থাকুন।’
‘আমি বাচ্চা নই বুঝেছেন, আঘাত এতটাও না যে আপনার পরামর্শে চলতে হবে।’
‘ঠিক আছে।ঔষধটা খেতে হলে খাবার খাওয়াটা জরুরি। বয়স্ক মানুষকে আশা করি বলে দিতে হবে না।’
অনিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘আমি বয়স্ক।’
‘যার ওতোবড় মেয়ে আছে সে নিশ্চয়ই অবোধ বালক নয়।’
‘আপনি কিন্তু বেশি বলে ফেলছেন।’
‘শুনুন আমার সাথে ধমকাধমকি করবেন না। খাবার আনছি চুপচাপ খেয়ে নেবেন।এতো কথা আমার ভালো লাগে না।’
কোয়েলিয়া তিরিক্ষি মেজাজ দেখে অনিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখলো। তারপর বললো,
‘হঠাৎ অন্যরকম লাগছে?’
‘আপনার বাতাস লেগেছে।’
কোয়েলিয়া বাইরে চলে গেল। এতক্ষণে অনিক বুঝলো শেষ কথাটার মানে। কিন্তু রাগলো না, বিরক্ত ও হলো না শুধু হাসলো। সাফিয়া মুখ তুলে ওর বাবাকে হাসতে দেখে বললো,
‘যারা একা একা হাসে তাদের কি বলে জানো!পাগল।বাবা তাহলে কি তুমি!’
অনিক মেয়ের দিকে কড়া চোখে তাকালে সাফিয়া দাঁত বের করে হাসলো।ব্যাস,আর রাগ করে থাকা যায় না।মেয়ের সাথে সাথে ও হেসে ফেললো।
*
বাড়ির আনাচেকানাচে বিকেল নেমে এসেছে।যদিও সূর্যকিরণের খন্ডিত অংশগুলো উত্তুরে হাওয়ায় গাছের মাথায় দোল খাচ্ছে।শীত এলেই ফুলের রাজ্যে জিয়ন কাঠির ছোঁয়া লাগে। ছাদের এ কোণায় তৈরি একটুকরো বাগানে বিভিন্ন রঙের সমাবেশ ঘটেছে। তবে এর ভেতর গোলাপের রাজত্ব লক্ষণীয়। কোয়েলিয়া অসমাপ্ত বইখানা নিয়ে বসেছে। চুলগুলো পিঠে এলানো,সূর্যের আভাতে তা লালচে দেখাচ্ছে, আনমনা মেয়েটার শাড়ির আঁচল নিচে লুটিয়ে রয়েছে।যদিও ও ঠিক পড়ছে না,ও রয়েছে অন্য জগতে।যেখানে ওর ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ওই ত্যাদড় মানুষটা। অনিকের কথা ভাবতে ভাবতে ওর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি দেখা গেল।
গত চারদিনের ব্যবধানে অনিক পুরোপুরি সুস্থ হলেও ঘাড়ে সামান্য ব্যাথা। তবুও সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।কারোর কোন কথা শুনতে সে নারাজ।সেই রাতের এক্সিডেন্টে অবশ্য পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল, কিন্তু আফসার শিকদারের মতো লোকের কাছে এটা তেমন কোন বিষয় নয়।বের হবার সময় কোয়েলিয়া একবার বলেছিল,
‘আপনার যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না।’
‘এখন আপনার সব কথা শুনে চলতে হবে। শুনুন কোয়েলিয়া আমি আপনার কথা মেনে চলতে বাধ্য নই।’
অনিকের কথাটা অবশ্য কোয়েলিয়ার গায়ে লেগেছিল।ও আর আরেকটা কথাও বলেনি। চুপচাপ অনিককে যেতে দেখেছে।যদিও আফসার শিকদার এর জন্য কথা শোনাবে, তবুও এমন ত্যাড়া লোককে সামলানো ওর কাজ নয়।
‘কোন মজার কিছু মনে পড়েছে?’
কোয়েলিয়া চমকে পাশে তাকাতেই সরফরাজকে দেখে বুঝলো,ও কর্মস্থল থেকে সরাসরি এখানে এসেছে। সৌজন্যমূলক হেসে বলল,
‘কখন এলেন?’
‘এসেছি অনেকক্ষণ। মায়ের সাথে সাফিয়া কে দেখে বুঝলাম আপনি কোথায় থাকতে পারেন।’
কোয়েলিয়া হাসলো। সরফরাজ মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বললো,
‘এই বিকেলের সোনালী প্রভায় জড়ানো বাহারি ফুলের পাশে আরেক ফুলের হাসি।কবি হলে এ সৌন্দর্য কবিতায় লিখে সময়টাকে থমকে দিতাম।’
কোয়েলিয়া বিস্মিত হলো। সরফরাজের হুটহাট এধরনের কথা ও কেন যে কেউ ভালো মনে করবে না।ওর কপালে ভাঁজ পড়লো,বললো,
‘আপনার কথা দূর্বোধ্য।’
‘আমি মানুষটাই এমন।মনের কথাগুলো চেপে রাখতে পারিনা। আপনার হাস্যোজ্জ্বল সৌন্দর্য দেখে বাক্যগুলো মাথায় এলো বলে দিলাম।’
‘সবসময় এভাবে বলাটা সমুচিত নয়।’
‘দাড়িয়ে থাকতে আমার ভালো লাগছে না।বসি?’
‘অনুমতি না দিলেও তো বসবেন।’
‘ভুল বলেননি।’
সরফরাজ কোয়েলিয়ার থেকে দূরত্ব রেখে বসলো।কিছু মানুষের কাজ হলো কথার দ্বারা অন্যকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়া। কোয়েলিয়া ধরে নিতে পারে সরফরাজ এরকমই একজন। অন্ততঃ সরফরাজের কিছু বাক্য অন্যদের মনে সন্দেহ আনার জন্য যথেষ্ট। সরফরাজের অসহ্য নীরবতা পছন্দ না।ও কথা শুরু করার জন্য বললো,
‘গডফাদার পড়ছেন? কেমন লাগলো?’
‘এখনো শেষ হয়নি।দুই তৃতীয়াংশে আছি। টুইস্ট থাকার পরও আমি এগোতে পারছি না।’
‘আপনার মন অন্য কিছু ভাবতে ব্যস্ত। বিশ্বের সেরা থ্রিলারটাও আপনার হাতে দিলে এগোতে পারবেন না।’
‘আপনার একজন মনোবিজ্ঞানী হবার দরকার ছিল।’
‘যা নিয়েই পড়তাম না কেন, শেষমেশ ব্যবসাতেই থামতে হতো। ইচ্ছে ছিল রিসার্চ করবো, নতুন কিছু জানবো। কিন্তু দেখুন না,মামা ধরে বসলেন আমাকে ব্যবসা করতেই হবে। এখন অবশ্য বিজনেসকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।’
এ কথার পর কোয়েলিয়ার উত্তর দেবার মতো কিছু খুঁজে পেল না।ও চুপ করে বইয়ের দিকে তাকালো,যদিও একটা লাইনেই ওর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ। মাঝেমাঝে ওর মনে হয় সরফরাজ ওকে কিছু বোঝাতে চাইছে। আবার মনে হয় তা কেন হবে?ও বিবাহিতা,তার ভাইয়ের স্ত্রী।ও নিজেকে বিশেষ কিছু হয়তো ভেবে ফেলছে। দেওর ভাবীর সম্পর্কে এমন রসিকতা থাকতেই পারে। কিন্তু মনের কোণে তাও একটা কিন্তু থেকে যায়।
‘আপনি কি ভাবছেন বলে দিতে পারি?’
‘বলে দিলেও আশ্চর্য হবো না। পূর্বেই জেনেছি আপনি মুখ দেখে মনের কথা বলতে পারেন।’
‘উহু, পুরোপুরি না।আন্দাজ করি। কখনো মেলে কখনো বা ভুল ধারণা হয়ে যায়।তবে আপনি আমার কথাগুলো নিয়ে ভাবছিলেন তাই না।’
কোয়েলিয়া মাথা নাড়ায়। সরফরাজ বলে,
‘প্রথমেই বলেছি, কোন কথা আমি মনে চেপে রেখে অস্বস্তিতে সময় পার করতে পছন্দ করিনা। আমার যখন যেটা মনে হয় বলে ফেলি। এজন্য অবশ্য ঝামেলায় ও পড়েছি।’
সরফরাজ থামলে কোয়েলিয়া পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়।ও যেন কিছু একটা বুঝতে পারছে। ইতস্তত করে বললো,
‘আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন?’
‘আপনি আমার জন্য নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আমার নেত্রযুগল আপনাকে দেখতে চায়।মানে বুঝতে..’
সরফরাজ কথা শেষ করতে পারলো না।তার আগেই টর্নেডোর গতিতে অনিক কোয়েলিয়ার হাত ধরে টেনে তুলল। কঠোর দৃষ্টিতে সরফরাজের দিকে তাকিয়ে ওকে ভস্ম করে দিতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু ওর সেরকম কোন ক্ষমতা নেই।তাই ও কোয়েলিয়াকে একরকম টানতে টানতে সিঁড়ির দিকে গেল। সরফরাজ সেদিকে তাকিয়ে হাসলো।মানুষকে ঈর্ষায় জর্জরিত করতে ওর আনন্দ লাগে।
*
কোয়েলিয়া অনিকের সামনে সটান দাড়িয়ে আছে।সেইযে ওকে টেনে নিজের কক্ষে এনেছে, তারপর একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি কিংবা ওকে কক্ষ ত্যাগ করতেও দেয়নি।নিজে বেশ আয়েশ করে ডিভানে বসে থাকলেও ওকে একচুলও নড়তে দেয়নি। বরঞ্চ সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে ওর সামনে থাকা সাফিয়ার রুবিকস কিউবটা নাড়াচাড়া করছে। সামনে টেবিলের ওপর একটা রিভলবার রাখা। কোয়েলিয়া ঠিক বুঝলো না ওদের ভেতর এই জিনিসটার ব্যবহারের মতো শত্রুতা হয়েছে কিনা।
‘শুনুন..’
অনিক এমনভাবে ওর দিকে তাকালো যে কোয়েলিয়া ঢোক গিললো।এ লোককে ও মোটেও ভয় পায় না, তবে রাগের মাথায় ওর গায়ে হাত তুললে তা ওর জন্য লজ্জার হবে। কিন্তু এভাবেও দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।ও হাত দিয়ে চুলগুলো খোঁপা করতেই যাবে,এর মধ্যে অনিক মেজরের মতো রাশভারী গলায় বললো,
‘একটুও নড়বে না, শ্যুট করে দেব। বহুদিন আমার রিভলবারটা কাজে লাগছে না, তোমাকে দিয়ে শুরু করি।’
কোয়েলিয়া বিস্ময়ে অনিকের দিকে তাকালো।ও অবাক হলো অনিকের তুমি সম্বোধন করায়।ও বললো,
‘আপনি আমাকে কবে থেকে তুমি বলতে শুরু করলে।’
এহেন প্রশ্নে অনিক অস্বস্তিতে পড়ে যায়। নিজের দূর্বলতা ঢেকে বিরক্তি নিয়ে বললো,
‘তো জুনিয়রকে আপনি বলবো!’
‘আগে তো তাই বলতেন।’
‘শাট আপ।’
ও বসা থেকে উঠে কোয়েলিয়ার মাথায় রিভলবার চেপে ধরলো। ঠান্ডা ধাতুর সংস্পর্শে কোয়েলিয়ার কপাল শিরশির করে উঠলে ও ভয়ে চোখ বুজে ফেললো।এ লোকের ভাবভঙ্গি কিলারের ন্যায়।অনিক তা দেখে হাসলো,পরক্ষণে মানসপটে কিছুক্ষণ পূর্বের দৃশ্য ভেসে উঠতেই মুখটা গম্ভীর হলো। বাইরে সরফরাজের গাড়ি দেখেই যা অনুমান করেছিল, কোয়েলিয়াকে ওর কক্ষে না পেয়ে সোজা ছাদে গিয়ে তার সত্যতা নিশ্চিত হলো।ও মৃদু কন্ঠে বললো,
‘ভালোবাসো কাউকে?’
‘না।’
‘সত্যি করে বলো।’
অনিক আরো জোরে অস্ত্রটা চেপে ধরলো। কোয়েলিয়া এবার বেশ ভয় পাচ্ছে।মাতালরা রাগের মাথায় খুন করে,এটা ও সিআইডিতে দেখেছে। নিজের জীবনকে ও অনেক ভালোবাসে। ইচ্ছে আছে অনেক বছর বাঁচার। ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া গলায় জোর এনে বললো,
‘কাউকে ভালোবাসলে আপনার সাথে থাকতাম না। এতদিন পালিয়ে যেতাম। আমি এতটাও খারাপ না যে একজনের সাথে রিলেশনে থেকে আরেকজনকে বিয়ে করবো।’
অনিক রিভলবার সরালে কোয়েলিয়া হাঁফ ছাড়ে। কিছুক্ষণ ঘরময় পায়চারী করে ফের অনিক ওর কাছে এসে দাঁড়ায়।হুট করে অনিক ওকে চমকে দিয়ে দুহাতে ওর মুখ আঁকড়ে ধরে। চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস ফেলে গম্ভীর সুরে বললো,
‘শোনো কোয়েলিয়া, আমি কখনো রোমান্টিক উপন্যাস পড়িনি।তাই সাহিত্যিকদের মতো কথাবার্তা আর হিরোদের মতো ভালোবাসা আমার থেকে আশা কোরো না। আমি আমার মতো। তোমাকে নিয়ে কাব্য রচনা করা কিংবা তোমার সৌন্দর্য বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। কারণ আমি এসব পারিনা, আমি যা বলি সোজাসুজি, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা আমার অপছন্দ এবং সেইসব মানুষদের ও যারা এটা করে।থাকতে চাইলে এই নীরস লোকের সাথে কাটাতে হবে।নয়তো তোমার জন্য আরেকটি রাস্তা খোলা আছে। কিন্তু সেটা এখন বলবো না।’
অনিক রহস্যময় হেসে ওকে ছেড়ে দিলো। কোয়েলিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বের হয়।এই লোক আর কতোরকম রূপে আত্মপ্রকাশ করবে তা এখনো ওর অজানা।
*
‘এইযে বৌ, তোমার খোঁজে আইছিলাম। মারাত্মক একখান ঘটনা ঘইটে গেছে।’
কোয়েলিয়া প্রশ্নাতুর চোখে রুবিনার দিকে তাকালো। রুবিনা ফিসফিস করে বলল,
‘সাফিয়ার আম্মা,বিভায় আসছে।’
কোয়েলিয়া অবাক হলো। এখন কি সিরিয়ালের মতো স্বামীর প্রথম স্ত্রী এসে ঝামেলা করবে! তারপর দুজনে মিলে প্রতিযোগিতা চলবে এক স্বামী নিয়ে।ধ্যাৎ কি ভাবছে এসব। নিজের শঙ্কা আড়ালে রেখে বললো,
‘সাফিয়া কোথায়?ও জানে?’
‘সাফিয়া ঘুমায়।বড় ম্যাডাম হেরে জানাইতে মানা করসে। ছোট স্যার জানলি এক্কেরে গুলি কইরে দিবার পারে।’
‘গুলি করবে কেন?’
‘হেতি স্যারের বন্ধুর লগে ভাইগে গেসিলো।স্যারতো রাগে উকিলির সামনে একবার গুলি করতি গেসোলো, ভাগ্য ভালো সবাই মিলা বন্দুক কাইড়ে নিসিলো।’
কোয়েলিয়া কৌতুহল নিয়ে নিচে নামতেই নিজের স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রীকে দেখতে পেল। আফসার শিকদারের কথামত তো তাই ই হবে,যেহেতু অনিক আর বিভার ডিভোর্স হয়ে গেছে।বিভা অনিন্দ্য সুন্দরী। এমনকি ওর চোখের নিচে পড়া কালো দাগ কিংবা শরীরের হালকা মেদ ওর সৌন্দর্য কমাতে পারেনি। সালোয়ার কামিজ গায়ে,জার্নির দরুন অনেকটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে।এক হাতে হ্যান্ডব্যাগ অন্যহাতে জ্যাকেট। কোয়েলিয়া দেখলো ওকে, অনিকের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক হলে হয়তো ও বিভার সৌন্দর্যকে ঈর্ষা করতো। কিন্তু এখন ও সেটা মনে আনতে পারলো না।
‘তুমি কোয়েলিয়া! অনিকের দ্বিতীয় স্ত্রী।’
কোয়েলিয়া নিরুত্তর থাকলো। একরকম অচেনা একজনের কথার জবাব না দেওয়া সর্বাপেক্ষা শ্রেয়।বিভা ফের বললো,
‘তোমাকে ঈর্ষা করার উপযুক্ত মনে হচ্ছে না।এরা তোমাকে পছন্দ করলো?অনিক তোমাকে পছন্দ করে?’
কোয়েলিয়া তবুও মুখ খুললো না।বিভা রেগে গেল। কাওকে রাগানোর ভালো উপায়,প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া।
‘এতদিন অনিক মেয়েকে আনার ব্যাপারে কোন স্টেপ নেয়নি।যেই তোমাকে বিয়ে করলো, ওমনি আমার কাছ থেকে আমার সন্তানকে কেড়ে আনলো।কি আছে তোমার ভেতরে? আমার তোমাকে বিশেষ কেউ মনে হচ্ছে না।’
বিভার কন্ঠ উত্তেজিত শোনায়। কোয়েলিয়ার নির্বাক মুখাবয়ব ওর অসহ্য ঠেকছে। অধৈর্য গলায় বলে,
‘যোগ্যতার বিচারে তুমি অনেক নিচে। তবুও এতো কিসের দাম্ভিকতা!’
‘অনিক আহসানের ওয়াইফের দাম্ভিকতা কি বেমানান মিসেস রিফাত।’
দু’জনে অনিকের উপস্থিতিতে চমকে গেল। কোয়েলিয়ার রুবিনার কথা মনে পড়লো।অনিক যেরকম রাগী,তাতে কিছু একটা ঘটবে না,তা বলা মুশকিল।
বিভা হেসে বলল,
‘তাহলে আমার প্রাক্তন স্বামীর দর্শন মিললো।বেশ ভালো দেখাচ্ছে।মদ ছেড়ে দিয়েছ নাকি! শুনলাম স্ত্রীর বিরহে এক্সিডেন্ট করেছো?’
অনিকের কঠিন মুখ দেখে কোয়েলিয়া রুবিনার কাছে গিয়ে নাজমাকে ডাকতে বললো। অনিকের রাগকে ও মোটেও ভরসা করতে পারেনা।
অনিক বিরক্তি নিয়ে বললো,
‘এখানে হঠাৎ আগমন কেন?নাকি আমার শান্তিময় জীবন আপনার সহ্য হচ্ছে না।’
‘কথাটা আমার বলা উচিত ছিল।বাবা-ছেলে মিলে আমার মেয়েকে কেন চুরি করে এনেছো? কেন আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছো না?’
বিভার চেঁচিয়ে বলাটা অনিকের রাগ বাড়ালো।ও শাসালো,
‘মিসেস রিফাত,এই বাড়িতে আপনার ঢোকার কোন অধিকার নেই আর চেঁচিয়ে কথা বলা তো মোটেও নয়।’
‘এখানে অধিকার দেখানোর ইচ্ছে আমার নেই। আমার মেয়েকে আমি নিতে এসেছি।’
‘মেয়ে আপনার একা না।কোর্ট কিন্তু বলেছিল মাঝেমাঝে মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে পারবো। এতবছর আমি কোনোরকম চেষ্টা করিনি। কিন্তু যখন আমার মেয়ে আপনাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছে,তার শৈশব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে,তখন তো আমি আপনাদের কাছে রাখতে পারিনা।’
‘তোমার ফ্রড বাবা বুঝি এগুলো এসে বলেছে।চুপি চুপি চোরের মতো এখানে নিয়ে এসেছে। আমি জানতে পর্যন্ত পারিনি।কি ভেবেছিলে আমি চুপ করে বসে থাকবো।’
‘একদম আমার বাবাকে তুলে কথা বলবেন না।’
‘কেন বলবো না!রিফাতকে ফোর্স করে একরকম মেয়েকে নিয়ে এসেছে। আমি অসুস্থতার কারণে জানতেও পারিনি। আমার মেয়েকে এক্ষুনি দেও।’
‘সোজা এখান থেকে বের হয়ে যান।অন্যথায় খারাপ কিছু হয়ে যাবে। আমার মেয়েকে অন্যের কাছে রাখার পর কিভাবে ভাবেন, আমি আবার আপনার কাছে পাঠাব।’
‘আমার অসুস্থতার জন্য আমি ওকে মিস নাদিয়ার কাছে রেখেছিলাম।যাতে ওর পড়াশোনার ক্ষতি না হয়।’
‘আচ্ছা, আপনার বাকি দুই সন্তানকে রাখেননি কেন?’
‘কারণ সাফিয়া রিফাতকে পছন্দ করেনা, এমনকি বাকি দুজনকে ও না।’
‘আমার কাছে এখন সব স্পষ্ট। আমি আমার মেয়েকে দিচ্ছি না। ভালো হবে এখান থেকে চলে গেলে।’
‘আমার মেয়েকে না নিয়ে একপাও নড়বো না।যা খুশি করতে পারো।’
বিভাকে সন্তানহারা বাঘিনীর ন্যায় ক্ষিপ্ত দেখায়।অনিক ও কম যায় না। রাগে ওর মুখ লালচে হয়ে গেছে। কোয়েলিয়া এদের লক্ষ্য করে মনে মনে প্রমাদ গুনলো।
চলবে…
®️ সুমি খানম