ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-৮৮+৮৯

0
1091

#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো

(৮৮)
রোজী লাবিবাকে ছোট্ট করে একটা টেক্সট পাঠালো।
‘ বাবু তোকে ডাকছে। ‘
বাবু ডাকছে না ডাকছে বাবুর আম্মু। নিশ্চয় মামুনী এসে কথা শুনিয়ে গেছে। নয়তো এক গাদা খাবার দিয়ে গেছে। লাবিবা এখন যেতে পারবেনা। এমনিতেই তার পেট ভরপুর। তানভীর মোগলাই এনেছিলো। এক বসাতে সাবাড় করেছে। এখন একটু পেটটা ফুলো ফুলো লাগছে। একটা ইসোনিক্স খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। লাবিবা পড়া শেষ করে নয়টায় বের হলো । বারান্দায় রেলিং টপকাতে টপকাতে ঘরের ভেতর থেকে হাসির আওয়াজ কানে এলো।

রোজী পেটে হাত রেখে খিলখিল করে হাসছে। তামিম বারবার নিষেধ করছে।
‘ রোজ হাসি বন্ধ করো। এতো হাসার কি হলো?’
রোজী হাসি কন্ট্রোল করলো। বললো,
‘ বাচ্চা আসতে আসতেই এতোকিছু কিনে আনলেন। তাও আবার বছর এক দুয়ের বাচ্চার জামাকাপড়। এই এক বছর কি আমি বাচ্চাকে জামাকাপড় ছাড়া রাখবো?’
‘ ধুর আমি কি বুঝি নাকি? একমাসের বাচ্চার যে জামা একবছরের বাচ্চার সেই জামা। একটু বড় ছোট। একই তো হলো। ‘
‘ তো আমাকে নিয়ে যাবেন তো। ‘
‘ বুড়ো বয়সে বাচ্চার বাপ হচ্ছি। বাচ্চা নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে পারবোনা। ‘
‘ আপনি কবে বুড়ো হলেন? সব সময় নিজেকে বুড়ো বলবেন না। ‘
তামিম হাত থেকে বেবি কেরিয়ার আর প্যাকেট গুলো রেখে বিছানায় গিয়ে আধশোয়া হলো। মাথার নিচে দুই হাত রেখে উপরে তাকিয়ে রইলো। রোজী একটা একটা করে বের করা জামা প্যাকেটে ভরলো। তামিম জিজ্ঞেস করলো, ‘ আমি বুড়া বললে এতো রেগে যাবে না রোজ। এটা তোমার বেড লাক ভেবে নিতে পারো। মানুষ সব দিক থেকেই সমান সমান হবে এটার কোনো সিউরিটি নেই। ‘
রোজী আলমারিতে প্যাকেট গুলো রেখে দিলো। তামিমের বুকের উপর সটানে সুয়ে পড়লো। তামিম না না করে উঠলো। ‘ রোজ। পেটে চাপ পড়বে। উঠো। ‘
রোজী মুচকি হাসলো। সে কমর্ফোর্টলি শুয়েছে। তামিমের শার্টের কলার চেপে ধরলো। তামিম রোজীর মুখের দিকে তাকালো। রোজীর হাভ ভাব বুঝার চেষ্টা করলো।
‘ আপনি বুড়ো নাকি ছুড়ো সেটা আমি ভালো ভাবেই জানি। মুখস্ত বিদ্যার মতো বার বার আওড়াতে হবে না।’
‘ আচ্ছা। ‘
‘ তিনটা বাবু নিবো আমরা।’
‘ একটাই থাক। ‘
‘ না। বাচ্চা যত বেশি ভালোবাসা ততো বেশি। এইযে সব সময় বুড়ো বুড়ো করেন সাদা দাড়ি নিয়ে বাচ্চা কোলে রোদ পোহাবেন। এটাই আপনার শাস্তি। ‘
তামিম হাসলো। দুহাতে রোজীকে জড়িয়ে ধরলো।
‘ ম্যাম আপনার শাস্তি মঞ্জুর করা হলো। ‘

লাবিবা বেসিনে কুলকুচি করলো। রাত এগারোটা বাজতে লাগলো এখনো তানভীর এলোনা কেনো? লাবিবার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে তানভীরকে দড়ি দিয়ে ঘরে বেঁধে রাখতে। নিশ্চিত এখন বন্ধুদের সাথে হয় কার্ড খেলছে নয়তো দাবা খেলছে। বার বার তামিম রোজীর কথপোকথন কানে আসছে। লাবিবা ভেতরে যায়নি। তামিম রোজী একসাথে থাকায় কিছুক্ষন দাড়িয়েই চলে এসেছে। নিয়ে এসেছে একরাশ হতাশা । লাবিবা নিজেও জানে তার এখন এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় না। কিন্তু মাথায় যেনো জেকে বসেছে। যবে থেকে রোজী কনসিভ করেছে তবে থেকেই এই বাচ্চা নেবার চিন্তা মাথায় ঢুকেছে। এর আগে কখনো ভুলেও সপ্ন দেখেনি সে একদিন মা হবে। তার কোলে ছোট একটা বাবু থাকবে। মায়ের সাথে সে যেমন লেপ্টে থেকেছে সেভাবে লেপ্টে থাকবে। তার মতোই এটা খেতে চাইবে ঐটা খেতে চাইবে। যখন মা বলে ডাকবে কেমন সুখ লাগবে? লাবিবা ঝটপট এক মগ পানি নিয়ে মাথায় ঢেলে দিলো। মাথার উপর তালুতে দুবার চাপড়ালো।
‘ ঠান্ডা হ বাবা ঠান্ডা। এসব চিন্তা করে মাথা গরম হস না। সব ঠান্ডা। ‘
টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছে রুমে এলো। তানভীর কখন ফিরবে জানা নেই। লাবিবা এখন ঘুমোবে। কাধে ভেজা টি শার্ট নিয়েই শুয়ে পড়লো। আধঘন্টা তদ্রাভাবে কাটার পর হুট করে লাবিবা বিছানা ছাড়লো। আলমারি খুলে শাড়ির পার্টে হাত বাড়ালো। বেছে বেছে মেরুন পাড়ের অরেঞ্জ কালার বেনারসী শাড়ি বের করলো। থ্রি কোয়ার্টার হাতার ব্লাউজ। পুরোটাই ব্যাকলেস। খুব যত্ন নিয়ে ভাঁজের উপর ভাজ ফেলে শাড়িটা গায়ে চাপালো। চোখে মোটা করে কাজল টানলো আর ঠোঁটে অরেঞ্জ কালার গাঢ় লিপস্টিক। চুল গুলো ঝটপট কোনভাবে কার্ল করে পিঠে ছড়িয়ে দিলো। লাইট অফ করে রেড় ড্রীম লাইট দিতেই রুমটা কেমন মোহনীয় হয়ে উঠলো। লাবিবা বিছানার উপর পা দুটো ভাঁজ করে করে হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বসলো। ভীষন কান্না পাচ্ছে তার। কেনো পাচ্ছে জানা নেই। চোখে ঘুম নেই। পড়া নেই। রাতে খাওয়াও নেই। চুপচাপ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে রইলো।

ঘড়িতে একটা তিপ্পান্ন। তানভীর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই দাড়িয়ে পড়লো। বিছানায় বসা মোহনীয় নারীমূর্তির দিকে স্তব্দ হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। ঝটপট লাইট অন করলো। লাবিবা তখন তানভীরের দিকেই তাকিয়ে। চোখ থেকে অশ্রুদানা গড়িয়ে চিক চিক করছে। তানভীর ফোনের স্কিনে সময় দেখে নিলো।নিজেই নিজেকে গালি দিলো।
‘ শীট! স্টুপিড ম্যান। ‘
ঘামে ভেজা শার্টের হাতার বোতাম দুটো খুলেই লাবিবার সামনে বসলো। হাঁটুর ভাজ থেকে চাদমুখ খানা তুলে নিলো আঁজলা ভরে।
‘ কাঁদছো কেন? জান? ‘
অভিমানে লাবিবা উত্তর দিলো না। তানভীর শুকনো ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো লাবিবার তুলতুলে গালে।
‘ ঘুমাও নি তুমি। আমাকে একটা কল দিলেই তো চলে আসতাম। বলবেনা তুমি আমাকে?’
লাবিবার মুখটা আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো।
‘ বউ কথা কও। এই বউ। আমার সুন্দরী বউ। আমার কমলাবানু। ‘
তানভীরের আহ্লাদে লাবিবা মনে মনে হাসলো। এতোক্ষন কষ্ট লাগছিলো। তানভীরকে পেয়ে সব কষ্ট উবে গেছে। বুকের মাঝে এখনি টেনে নিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু লাবিবা নিবে না। সে অভিমান করেছে। তানভীর লাবিবাকে মানানোর চেষ্টা করছে। কাজ হচ্ছেনা। তানভীর লাবিবাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো।
‘ জাস্ট পাঁচ মিনিট। শাওয়ার নিয়ে আসছি। আরেকটু অপেক্ষা করো। ‘
তানভীর যেতে নিলেই লাবিবা শার্ট টেনে ধরলো।
‘ গরমে ঘেমে গেছি। বাজে স্মেল পাবে। ছাড়ো। ‘
লাবিবা ছাড়লো না । তানভীর বুঝলো অভিমানের পাল্লা ভারী। আত্মসমর্পণ করলো।
‘ ক্লাবে গেলে দলের ছেলেদের পাল্লায় পড়তে হয়। বুঝোই তো কতো কাজ থাকে। তাঁদের সাথে আগের মতোই সময় দেবার চেষ্টা করি। যেনো কেউ না অভিযোগ দিতে পারে বিয়ে করে পাল্টে গেছি। তবে এখন থেকে বারোটার আগে ফিরবো প্রমিজ। ‘
লাবিবা শার্ট ছেড়ে দিলো। হাত টেনে নিয়ে সামনে বসালো। তানভীর হাঁসফাঁস করলো।
‘ জান কথা বলো। ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি হ্যা?’
লাবিবা এগিয়ে এসে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। একটা একটা করে সবগুলোই খুলে ফেললো। গা থেকে আগলা করে খাটের পাশে ফেলে দিলো। দু বাহু গলিয়ে পিঠ আকড়ে ধরলো। বলিষ্ট কাঁধে ঘাড় সহ মাথা ছেড়ে দিলো। ভ্যানিটিতে পড়েছে তাদের প্রতিবম্ব। লাবিবা এক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। ঘামে চিক চিক করছে তানভীরের পেশী। লাবিবা দুহাতে ঢাকার চেষ্টা করলো। ছোট্ট হাত জোড়া পারলে তো! গলায় নাক ঢুবিয়ে শ্বাস টানলো। আধো আধো ভাংগা ভাংগা গলায় বললো, ‘ আপনার শরীরের ঘামের গন্ধ আমার নেওয়া সর্বোচ্চ নেশালো সুগন্ধ। ‘
আরেকটু চেপে ধরে পর পর দুবার পেশিতে ঠোঁট ছুয়ালো। কানের লতিতে ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই তানভীর কোমড় চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো। লাবিবার উষ্ণ নিঃশ্বাসে তানভীর খেই হারালো। পিঠে ছড়ানো চুল গুলো মুঠোয় নিয়ে হাতে পেঁচিয়ে ধরল। কম্পমান অরেঞ্জ কালার ঠোটঁজোড়া নিজের শুষ্ক ঠোঁটের ভাজে নিয়ে নিলো। ভাঁজে ভাঁজে শাড়ি গলিয়ে স্পর্শ করলো। ঠোঁট ছেড়ে থুতনিতে কামড়ে ধরে বললো, ‘আবার ম্যাট লাগিয়েছো? উঠেনা কেনো?’
‘ আপনি পারেন না উঠাতে তাই উঠেনা। ‘
তানভীর চোখে রাগ দেখালো। অথৈ সাগরে আবারো ঢুব দিলো। তানভীর তখন আর নিজের মাঝে নেই।
লাবিবা ফিসফিসিয়ে ডাকলো,
‘ খান সাহেব? ‘
‘ জান।’
‘ আমার বাবুর আব্বু?’
‘ হু। ‘
‘ আমার সাথে পড়ুন। ‘
‘ হু?’
‘ বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শায়তানা, ওয়া জান্নিবিশ শায়তানা মা রাজাকতানা।’
তানভীর ঘোরের মাঝেই নিচু স্বরে পড়ল, ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শায়তানা, ওয়া জান্নিবিশ শায়তানা মা রাজাকতানা।’

ইংলিশ কমোটে ফ্ল্যাশের সাথে চলে গেলো তানভীরের খাওয়ানো পিলটা।এতোবড় একটা কাজ দুরু দুরু বুকে কাজটা করে মিররে নিজেকে দেখলো লাবিবা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। পানির ঝাপটা দিলো চোখে মুখে। বাচ্চার জন্য তিন-চার বছর অপেক্ষা করা যায় না। বিয়ের পর বেশি দিন হলে কারো কারো তো আজকাল বাচ্চাও হয়না। এসব কিভাবে বোঝাবে লাবিবা তানভীর কে জানেনা। তানভীর যখন এই দুঃসাহসের কথা জানতে পারবে তখন কি হবে? লাবিবা কিচ্ছু জানেনা।

চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৮৯)
নির্দিষ্ট দিনে এডমিট নিতে চলে এসেছে স্টুডেন্টরা। ডিপার্টমেন্ট থেকে বলে দেওয়া হয়েছিলো এক্সামের দুদিন আগে একদিনেই সবার এডমিট দেওয়া হবে। অফিস রুমের সামনে লম্বা লাইন পড়েছে। নিতু ম্যাম সবাইকে ক্লাসরুমে গিয়ে বসতে বললো। সেখানেই এডমিট দেওয়া হবে।লাবিবা উর্মিলাদের সাথে গিয়ে মাঝখানের একটা ডেস্কে বসলো। অনেক দিন বাদে দেখা হওয়ায় একজন আরেকজনের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে।লাবিবা খেয়াল করলো তাকে নিয়েও গুঞ্জন হচ্ছে। আড়চোখে অনেকেই তাকাচ্ছে। লাবিবা হাতের কার্ডটা মুখের উপর ধরে নিঃশব্দে হেসে নিলো। আগে অস্বস্তি হলেও এখন বেশ মজা পায়। কলেজের যে মাথা সেই তার ব্যক্তিগত পুরুষ। অনেক নারীর হৃদয় কাঁপানো হ্যান্ডসাম, দৃষ্ঠব্য, বলবান পুরুষটির মাঝে একান্তই তার বিচরণ। দিনকে দিন লাবিবা কলেজের অনেকের হিংসার পাত্রী হয়ে উঠছে। কেউ কেউ এখন ভেবে চিন্তে ব্যবহার করে। তাতে লাবিবার কি? এই কলেজে তার সময় প্রায় শেষ বললেই চলে। ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর রা ক্লাস রুমে এলেন। এডমিটের সাথে নিতীবাক্য, উপদেশ ও দিবেন। যেহেতু এটাই তাদের লাস্ট ইয়ার। নাকিবটা পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে ঝটপট উর্মিলার চেয়ারে বসে ঠেলতে লাগলো। উর্মিলা চেতে গেলো,
‘ হারামী আমাকে ঠেলতেছিস কেন? তুই চেয়ার এনে বস। ‘
‘ পেচাল পারিস না। বসতে দে। ‘
‘ আমার চেয়ার থেকে উঠ। ‘
‘ ছ্যান ছ্যান করিস কেন? এক্সটা চেয়ার থাকলে কি এখানে এসে বসতাম? আমি মনে হয় তোর চেয়ারে বসতে মরে যাচ্ছিলাম। ‘
উর্মিলা দেখলো আসলেই সব ফিল আপ। তবুও তার তেজ কমলো না। ঠেলতে ঠেলতে বললো,
‘ লাব্বুর চেয়ারে গিয়ে বস। ‘
‘ বসা যাবে না। ঐ ছেমড়ির জামাই আছে কলেজে।’
‘ দ্বারা আমার জামাইরে কল দেই। ‘
নাকিব চোখ গরম করে তাকালো উর্মিলার দিকে। চেয়ার ছেড়ে দিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো ফ্লোরে। উর্মিলা থতমত খেয়ে গেলো। এই ছেলে যে এমন কাজ করবে কে জানতো? স্যারদের নজরেও পড়েছে। সামনের স্টুডেন্টরাও পেছন ঘুরে তাকিয়েছে। লাবিবা লাফ দিয়ে নাকিবের হাত ধরে টানতে লাগলো।
‘ দোস্ত উঠ। দেখ সবাই দেখছে। ‘
উর্মিলাও নাকিবের আরেক হাত পাকড়াও করলো।
‘ নাকিবের বাচ্চা উঠ। সারকাস দেখাবি নাকি। ‘
সেই মুহূর্তে প্রিন্সিপাল,ভাইস প্রিন্সিপাল, ছাত্রলীগের লিডার, প্রিন্সিপালের পিয়ন ক্লাস রুমে উপস্থিত হলো। লাবিবা তানভীরকে দেখেই হাত ছেড়ে দিলো। ভদ্র হয়ে চেয়ারে বসলো। উর্মিলা হা করে তানভীরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘ কি হচ্ছে এখানে?’
তানভীরের প্রশ্নে নাকিব অভিযোগ জানালো, ‘ স্যার আমার ডেস্ক নাই। ‘
তানভীরের ইশারায় জাহাঙ্গীর স্যার ডিপার্টমেন্টের মামাকে বললো ডেস্কের ব্যবস্থা করতে। পেছন দিকে আরো দুজন স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে আছে। লাবিবা চাপা ধমকালো, ‘ উঠ বলছি। ‘
নাকিব উঠে দাঁড়ালো। পেছনে ডেস্কের ব্যবস্থা করা অব্দি দুই বান্ধবীর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলো। সবার বসার ব্যবস্থা হতেই নিতু ম্যাম সবার উদ্দ্যেশে কিছু নিতীবাক্য বললো। এক্সামের জন্য কিছু উপদেশ দিলো। একে একে অনান্য প্রফেসর রাও তাদের বক্তব্য রাখলো। তানভীরকে কিছু বলতে বলাতে তানভীর বললো,
‘ স্টুডেন্টদের হাতে আগে এডমিট পৌঁছে দিন। ‘
এডমিট পৌঁছে দেবার পর তানভীর স্টুডেন্টদের মাঝে চলে এলো। পায়চারি করতে করতে কন্ঠে সিরিয়াসনেস এনে উপদেশ দিতে লাগলো। লাবিবা সহ সব স্টুডেন্ট তানভীরকে শুনতে লাগলো। লাবিবা তানভীর যেদিকে যায় ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেদিকেই দেখতে লাগলো। আদৌ তানভীরের কোনো কথা তার কানে পৌঁছেছে কিনা তাতে সন্দেহ। তানভীরের এই সিরিয়াসনেসের মধ্যেও লাবিবা তার উইকনেস আবিষ্কার করে ফেললো। এতোটাই গভীরে সে আছে যে তার হাত লেগে ডেস্ক থেকে কোর্ট ফাইল নিচে পড়ে গেলো। নিস্তব্দ রুমে তখন শুধুমাত্র তানভীরের কন্ঠ। আচমকা ফাইল পড়ার শব্দটা সবার ই কানে লাগলো। লাবিবা একবার স্টুডেন্টদের দিকে তাকিয়েই তানভীরের দিকে তাকালো। মুহুর্তেই চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে উবু হলো ফাইলটা তোলার জন্য। তানভীরের চোখ সেদিকে গেলো। বড় বড় পা ফেলে সেকেন্ডেই পাশে এসে দাঁড়িয়ে ডেস্কের কোনায় হাত রাখলো। লাবিবা উঠার সময় মাথায় বারি লাগলো সেই হাতেই। সোজা হয়ে বসেই তানভীরের চোখে চোখ রাখলো। তাকালো তানভীরের হাতের দিকেও। হাতটা না থাকলেই কাঠে মাথায় আঘাত লাগতো। তানভীর নরমালি তার বক্তব্য সেখানেই দাঁড়িয়ে শেষ করলো যেনো কিছুই হয়নি। ঘটনায় লাবিবাও ঘাবড়ে গিয়েছিলো আর দুষ্টু ক্লাসমেটদের ও নজরে থাকে আজকাল তানভীর লাবিবা। তাদেরই ফ্রেন্ড যে তানভীর খানের ওয়াইফ এটাও তাদের নিকট একটা সপ্নের মতোই। বিচ্চু ছেলে গুলো মুখ টিপে হাসতে লাগলো। লাবিবা সেদিকে পাত্তা দিলো না। বক্তব্য শেষে দোয়া ধরা হলো। আফজাল স্যার হুজুর মানুষ। তিনি লম্বা দোয়া টানলেন। ক্লাসরুম থেকে বের হতেই তানভীর লাবিবাকে বললো ড্রাইভার এসেছে তার সাথে এখনি বাসায় চলে যেতে। লাবিবা তাই করলো। যাওয়ার পথে উর্মিলা নাকিবকে নামিয়ে দিয়ে গেলো।

সাবিনা খান বাড়িতে আছেন। এই প্রথম মেয়ে ফাইনাল দিবে তাও শ্বশুড়বাড়ি থেকে। নিজের বাড়িতে টিকতে পারেননি টেনশনে। সাবিনা ভাত মাখিয়ে লাবিবার মুখে তুলে খাইয়ে দিলো ঠেসে ঠুসে। লাবিবা বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। তানভীর আগেই বেরিয়ে গেছে হলের উদ্দেশ্য। তার দায়িত্ব পালন করতে। ইসমাইল এসে অপেক্ষা করছে লাবিবাকে নিয়ে যাবে। ফিরোজ বললো গাড়ি নিয়ে যেতে। ইসমাইল বললো,
‘ রাস্তায় আজ জ্যাম থাকবে। মটর সাইকেল গাড়ির মাঝে ঢুকিয়ে নেওয়া যাবে। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে। ‘
ফিরোজ খান সায় দিলো তাতে। সোহানা টেনে টুনে লাবিবাকে তুললো বই থেকে।এখন পড়া যাবে না। যা পড়েছে তাতেই হবে। ব্রেইনটাকে একটু রিলাক্স দেওয়া উচিত। বাবার পেছনে চড়ে লাবিবা ছুটলো পরিক্ষা দিতে। বাকি পরীক্ষাগুলোতে ইসমাইলই নিয়ে গেলো নিয়ে এলো লাবিবাকে। তানভীরের ইচ্ছা থাকলেও লাবিবার থেকে দূরে দূরে থাকলো। কাছাকাছি গেলেই কথা উঠতে পারে। বউ বলে বউয়ের হলে সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আরো অনেক কথা উঠতে পারে। তবে গার্ডে থাকা স্যারদের তানভীর পার্সোনালি বলে দিয়েছেন যেনো কোনো প্রব্লেম না হয়। আর বাকি আছে দুটো পরিক্ষা। তানভীর দেখলো লাবিবা কেমন একগুঁয়ে হয়ে গেছে। রিলাক্স তো অবশ্যই দরকার। তানভীর বললো,
‘ বাইরে যাবে?’
‘ কোথায়?’
‘ কাছাকাছি। দুঘন্টায় চলে আসবো। ‘
‘ আমি সেজেগুজে আসছি। ‘
‘ রানী সাহেবা না। একদম না। অলরেডি তিনটা বাজে। লেট হয়ে যাবে।’
লাবিবা শুনলো না। তানভীরের সাথে বের হলে আজকাল তার সাজগোজ করতেই হবে। কেউ যেনো ক্ষুনাক্ষরেও না বলতে পারে তানভীর আরো সুন্দরী মেয়ে ডিজার্ভ করে। লাবিবার থেকে পার্ফেক্ট তার খান সাহেবের জন্য কেউ যেনো না হতে পারে। লাবিবার কনফিডেন্স এর অভাব আছে তা সে জানে। কিন্তু অন্য কাউকে জানানো যাবে না। লাবিবা আইরন করা সাদা শার্ট টা ঝটপট তানভীরকে পড়ে ফেলতে বললো। নিজে পড়লো ঘের দেওয়া সাদা গাউন। হিযাবের উপর ছোট্ট একটা ক্রাউন ও পড়লো। তানভীর লাবিবাকে দেখে মুচকি হাসলো।

আধঘন্টা ড্রাইভ করে তানভীর ফৌজদারি পার্কিং করলো। রাস্তার পাশেই নদী। তারপর বালির পর বালি। গত বছরই এখানে বালি ফেলা হয়েছে। ভবিষ্যত এ এয়ারপোর্ট তৈরী হবে। আজ খুব হাওয়া দিচ্ছে। তানভীরের গায়ে সাদা কোর্ট। লাবিবাকে বললো,
‘ তোমার লাগবে?’
লাবিবা মাথা নাড়ালো। তার লাগবে না। এই হাওয়া তো সে দারুন উপভোগ করছে। গা শিরশির করে কেমন কাটা দিয়ে উঠছে। পাইলিং এর পাশে সারি সারি স্ট্রীট ফুড়ের দোকান। তানভীর লাবিবার হাজ্যজ্জল মুখখানা দেখতে লাগলো।
জানতে চাইলো, ‘ খুশি?’
‘ উমমম ঝাল মুড়ি খাওয়ালে। ‘
‘ ড্রেসে নিশ্চিত দাগ ফেলবে। পরে উঠবেনা ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে।’
‘ আমি মোটেও কাঁদি না। ‘
‘ আমি তা জানি। ‘
লাবিবা দু হাতে গাউন ধরে হাঁটতে লাগলো। আঙুলে দেখালো, ‘ যাবেন ঐ খানে?’
‘ বালিতে হাঁটতে পারবেনা। ‘
‘ তাহলে পাপড় খাওয়ান। ঐ যে বিক্রি করছে বড় বড় প্রতি পিস দশটাকা। ‘
‘ পেট খারাপ করবে। ঐসব খাওয়া যাবে না। ‘
‘ আপনার সব কিছুতেই বাঁধা। ‘ লাবিবা তানভীরের হাত জড়িয়ে হাটলো। লাবিবা আছে নিজের খেয়ালে। মাথাটা পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পরিক্ষার টেনশন রেখে সে যতক্ষন এখানে আছে রিলাক্স করবে। লাবিবা এর মধ্যেই খেয়াল করে মাঝে মাঝেই একটা বাক্য কানে আসছে, ‘ স্যার আসসালামুয়ালাইকুম। ‘ আবার কেউ বলছে, ‘ ভাই আসসালামুয়ালাইকুম। ‘
কিছুক্ষনের মধ্যেই আশে পাশে বেশ কয়েকজনকে দেখতে পায় লাবিবা। মনে হচ্ছে তারা যেনো বডিগার্ড হয়ে আসছে। ঘাড় উঁচিয়ে তানভীরের দিকে তাকাতেই তানভীর বলে, ‘ ইটস ওকে। ‘ লাবিবা বিড় বিড় করে।
‘ যেখানে যাই সেখানেই আপনার লোক। চলুন আমরা দূরের কোনো শহরে পাড়ি জমাই। সালাম নিতে নিতে মুখে ফেনাও তুলতে হবে না। আবার বউকে নিয়ে বিপাকেও পড়তে হবে না। ‘
তানভীর হাসলো। জ্বালানোর জন্য বললো,
‘ হাতটা ছেড়ে হাটো না। ‘
লাবিবা সাথে সাথে পা থামিয়ে দিলো। রাগ ঝাড়লো,
‘ খান সাহেব আমি হাত না ধরে হাঁটতে পারিনা আপনি জানেন না? চলুন এই লোকালয়ে আর থাকবোই না। ‘
হাত টেনে ব্রিজ পাড় হলো। শেষ মাথাতেই বসেছে পাপড় ওয়ালা। লাবিবা দুটো পাপড় নিয়ে ভেঙে খেতে লাগলো। তানভীরের কথা শুনলোনা। তানভীর শাষালো,’ রাণী সাহেবা তুমি কিন্তু আজকাল বড্ড অবাধ্য হয়ে গেছো। ‘
‘ লাভ কি? কোনো লাভই ই তো হলো না। ‘
‘কি চাও?’
‘ হাফ ডজন বাচ্চা। ‘
তানভীর কি করবে ভেবে পেলো না। আশে পাশে মানুষের আনাগোনা। হাত টেনে বালুর ভেতর যেতে লাগলো। পাপড় ওয়ালা চেচাঁলো,
‘ টাকা দিয়ে যান আফা। ‘
লাবিবা আঙুল তাক করে তানভীরকে দেখিয়ে দিলো। পাপড় ওয়ালা তানভীরকে খেয়াল করেনি। সে খেয়াল করেছে লাবিবাকে। লাবিবাকে সাত আসমান থেকে নেমে আসা পরীর মতো লাগছে। পাপড় ওয়ালা হা করে লাবিবাকেই এতোক্ষন দেখেছে। তানভীরকে দেখে সালাম দিয়ে উঠলো। তানভীর বললো,
‘ পরে দিচ্ছি তোকে টাকা। ‘ পাপড় ওয়ালা মাথা নাড়ালো, ‘ লাগবেনা স্যার। মেডাম খেলে আরো পাপড় নিতে বলেন। ‘
ততোক্ষনে অনেকদূর হেঁটে গিয়েছে লাবিবা। লাবিবা বললো, ‘ ইশশ হাঁটতে পারছিনা। হাই হিল পড়ে বালুর মাঝে হাটা যাচ্ছেনা। ‘ তানভীর হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো। পা থেকে জুতো জোড়া খুলে হাতে নিলো। শেষ বিকেলের রোদ পড়েছে বালুতে। চিকচিক করছে। নরম চিকচিকে বালুতে তার রাণীর খোলা পা জোড়া দেখে মৃদু হাসলো। এই বউটার সব কিছুতেই যেনো তানভীর শান্তি খোঁজে পায়। সে উঠে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো,
‘ এক জোড়া বাচ্চা কমে গেলো কেনো?’
‘ ইসসস! আমি এতো পারবোনা। ‘
‘ কেনো পারবেনা? ‘
‘ সারাদিন যদি বাচ্চাই পালবো। আপনার পেছনে দৌড়াতে হবে না? আপনিতো আবার যখন তখন ভুলে যান বউয়ের কথা। ‘
তানভীরকে রেখেই গাউনটা মুঠোয় উপরে তুলে লাবিবা বালির উপর দৌড় দিলো। নরম বালিগুলো পায়ের আঘাতে ছিটে পড়লো তানভীরের প্যান্টে। তানভীর গা থেকে কোর্ট খুলে বাহুতে নিলো। একবাহুতে কোর্ট অপর বাহুর আঙুলে লাবিবার এর জুতো নিয়ে চললো পিছু পিছু। একবার বলতে ইচ্ছে করছিলো, উল্টোপাল্টা চিন্তা রেখে ক্যারিয়ারে মন দাও। এখন বাচ্চা নেবার সময় নয়। কেনো জানিনা তানভীরের মন চায় বৌ যা চায় তাই তাকে দিতে। বৌয়ের হাসিমুখটাই যেনো তার সবকিছু। কিন্তু গা ছেড়ে দিলে চলবেনা। লাবিবার মাঝে পরিবর্তনটা চোখের সামনে ভাসছে। যে মেয়ে আগে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতো সে এখন তানভীরকে ছাড়া কিছুই বুঝে না‌। পৃথিবীর সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে তানভীরকে পেয়ে। নিজেকে নিয়ে একটুও ভাবনা নেই । বাবা মাকে নিয়েও নেই। পুরো একটা সপ্নে রাজ্যে বসবাস করছে। যেখানে তানভীরই তার সব। লাবিবার হয়ে শক্ত খুটি তানভীরকেই ধরতে হবে। তার আগে বের করতে হবে উল্টো পাল্টা চিন্তা। কিন্তু লাবিবা যে সেই চিন্তায় ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরছে সেটা সে জানে না। দুই মাস থেকে ট্রাই করছে। কোনো কিছুই হচ্ছেনা। বেশিদিন পিল নিলে হয় এরকম সমস্যা। উর্মিলা বলেছে আরেকমাস দেখ। এরপর তোকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবো। ডক্টরের কাছে গেলেই তো খাবে ধরাটা। আল্লাহ আল্লাহ করছে এর পরের বার ই যেনো সিরিয়াল ব্রেক হয়।

তানভীরের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছে তাদের মতোন ই যুগল। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পায় তারা আর কেউ নয় সব কলেজের ই ছেলে মেয়ে। তানভীর অবশ্য তাদের জনে জনে চিনেনা। কিন্তু বয়স অনুপাত করে বোঝা যায়। যতো গভীরে যাচ্ছে তারা ততো যুগল বের হচ্ছে। তানভীরকে দেখে তারাই যেনো মুখ লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আর যাই হোক তানভীর সম্পর্কে তাদের ভালো ধারণা আছে। পুকুর পাড়ের ঘটনা সবাই দেখেছে সচক্ষে। এদিকে তানভীর ভেতরে ভেতরে একটু সাই ফিল করছে। যাদের এখন প্রেম করে বেড়ানোর কথা তাদের স্যার হয়ে সেই প্রেম করে বেড়াচ্ছে। লাবিবা অনেক দূর চলে গেছে। পেছন ফিরে দেখলো তানভীর কাঠিন্য মুখে দাঁড়িয়ে আছে। লাবিবা দৌড়ে তানভীরের কাছে আসলো। হাতে এখনো অর্ধেক পাপড় আছে। একটু ভেঙে জোর করে মুখে ঢুকিয়ে দিলো।
‘ হা করুন। হা। ‘
‘ ডিসেন্টি হবে এসব খেলে। ‘
‘ মেট্রো খাইয়ে দিবো। পেট হয়ে যাবে একদম কষা। ‘
তানভীর বললো, ‘ বাসায় চলো। ‘
‘ সন্ধ্যা হোক। তারপর যাবো। ‘
‘ আমি থাকছিনা আর। ‘
‘ কেনো?’
‘ স্টুডেন্টদের সামনে আন ইজি লাগছে। ‘
‘ কেনো?’
‘ প্রেম করার বয়স এটা?’
‘ সমস্যা কি? ‘
‘ তুমি আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে। দেখো ওরাও সাইড কেটে চলে যাচ্ছে। কি একটা অবস্থা!’
‘ ভালো কাজ করেছে। যা সব চলে যা। আপনার প্রেম করার বয়স না হলেও আমার তো বয়স এটা। আমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। ইয়াহু আল্লাহ!’
লাবিবা এক হাতে গলা জড়িয়ে ধাক্কা দিয়ে তানভীরকে বালুর উপর ফেলে দেয়। লাবিবাকে নিয়েই তানভীর একটা গড়ান খায়।

চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা