ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো পর্ব-১০৪

0
1104

#ভালোবাসার কাব্য গাঁথবো

১০৪. (প্রথমাংশ)
লাবিবার ওয়াটার ব্রেক হচ্ছে রাত থেকে। ভোরেই তাকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে। বেবী হুট করে নড়াচড়াও কম করছে। ডক্টর নরমাল ডেলিভারির অপেক্ষা করতে নিষেধ জানিয়েছেন। আলট্রাতে দেখা গিয়েছে একটা বেবী উল্টো হয়ে আছে। তানভীরের মুখটার দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। টেনশনে তার হাত-পা কাঁপছে। তামিম তানভীরকে বকা ঝকা করলো কিছুক্ষণ। তার সাহসী ভাইটার এমন ভীতু রুপ দেখতে বিচ্ছিরি লাগছে। এমতাবস্থায় লাবিবাও তানভীরকে দেখে অবাক না হয়ে পারছেনা। তার মজা লাগছে। মুখ টিপে হাসছে। তানভীর নিষেধ করে, ‘প্লিজ হেসো না।’
‘ আপনি নাকি আমাকে দশ ছেলের মা বানাবেন? দুইজনকে আনতেই এই অবস্থা? ‘
তানভীর মাথা নাড়ে। ‘ দুইটাই আমার জীবনে জোছনা ছড়াবে। আর লাগবে না। ‘
লাবিবা খিলখিল করে হেসে উঠে। প্রচন্ড টেনশনে তানভীর আরো এলোমেলো হয়ে যায়। মুক্তোর মতো এই প্রাণবন্ত হাসি তার হৃদয় এফোড় ওফোড় করে। বাহু টেনে কপালে চুমু দিয়ে একহাতে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখে।

সোহানার কোলে ছেলে বাচ্চা। ফিরোজের কোলে মেয়ে। তানভীর কাঁপা হাতে ছেলেকে টাওয়ালে ভালো করে মুড়ে কোলে নেয়। পশ্চিম দিক হয়ে ছেলের কানে আজান দেয় । বেঞ্চে বসে সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখে। মাথার উপর নিতু ইসলাম,রুমালী বলাবলি করছে একদম তানভীরের মতোই দেখতে। অথচ তানভীর নির্দিষ্ট কোনো আকৃতি খোঁজে পাচ্ছেনা। নিজেকে পাশে রেখে মনে হচ্ছে সে লাবিবাকে দেখছে। তানভীর চট করে ছেলের নাম ঠিক করে ফেলে। চামড়া ওঠা কোমল বদনে ঠোঁটের স্পর্শ দেয়। মোটেও তাকে কোলে রাখতে ইচ্ছে করছেনা। লাবিবাকে যেমন বুকের ভেতর পিষে ফেলে তেমনি ছেলে বুকের মধ্যে তুলে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। ছেলের দিকে ঝুঁকে আসে। কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘ পাপার ছেলে পাপার থেকেও এগিয়ে যাও। আমার অস্তিত্ব তেজিয়ান বলবান চরিত্রবান পুরুষ হয়ে নিজ রাজ্যে বিরাজ করো। পরিবারের প্রতি কোমল হও। ‘

ইসমাইলের কোলে ছেলেকে দিতেই ইসমাইলের হাত কাঁপে। আবেগ মিশ্রিত গলায় ঘুমন্ত নাতিকে ডাকে,
‘ নানুভাই। ও আমার নানুভাই। ঘুমে চোখ ই খুলতে পারছেনা। ‘
তানভীর উঠে গিয়ে দেখে তার মেয়েকে নিয়ে খুশির বাঁধ ভেঙেছে। সাবিনার কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। একদম বুকে চেপে ধরে। ছেলে ঘুমোলেও মেয়ে তার টুকুর টুকুর করে তাকিয়ে আছে। তানভীর ডাকলো, ‘ পাপা। ‘ মনে হলো তানভীরের দিকেই চোখ ঘুরিয়ে নিলো। তানভীর প্রাণবন্ত হাসলো। মেয়েকে নিয়েই লাবিবাকে কেবিনে দেওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। আনমনেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, ‘ রাণী সাহেবা জীবন এতো সুখ সুখ লাগে কেনো?’

লাবিবার রাগ মাথায় চড়ে নাচে। তার রাগের যথেষ্ট কারণ আছে। হসপিটালে সে থাকলো প্রায় দশদিন। যেখানে থাকতে হয় চারদিন। এতো অসুস্থ সে তানভীররের দেখা নেই। অথচ প্রতিদিন সে শুনে তানভীর এসেছিলো। যখনি ঘুমায় তখনই কি তাকে আসতে হয়? দেখা দেওয়ায় ইচ্ছেই করে না তার। ওকে। সে যেহেতু দেখা দেয়না আজ এইযে সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছে সেও দেখাবেনা। লাবিবা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। বাসা থেকে নিয়ে আসা জিনিস পত্র আর বাচ্চার জন্য জিনিস গুলো একে একে ড্রাইভার নিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পরেই তাকে নিয়ে বাড়ি ফেরা হবে। লাবিবা সাবিনাকে ডাকলো, ‘ আম্মু রওনা দেবার আগে বাবুদের ফিডিং করিয়ে নিলে হতোনা?’
‘ তাইতো। পথে খিদে লাগলেই তো কান্নাকাটি শুরু করবে। তুই এখনি খাওয়া। ‘
লাবিবা ছেলে মেয়ের ন্যাড়া মাথায় আঙুল ছোয়ালো। দুই দিন আগে তাকে ছাড়াই বাচ্চা দুটো বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছে। আকিকা করণ করা হয়েছে তাঁদের। নাম গুলো লাবিবার পছন্দ হয়নি। তিন অক্ষরের নাম ছোট বাচ্চার কেনো রাখবে। বাচ্চা ছোট তাই নাম ও হবে ছোট। লাবিব কে কেটে জোতসই ছোট না করতে পারলেও তয়্যিবা কে তয়্যি করতে পেরেছে। একজনের টা ছোট করেছে এতেই শান্তি। তার ছোট করা নাম একমাত্র সেই ডাকবে। আর কেউ ডাকতে পারবেনা।
সাবিনা কেবিন থেকে বের হওয়া মাত্রই তানভীর লাবিবার চিবুক ধরে তার দিকে ফেরানোর চেষ্টা করলো। লাবিবা ফিরলোনা। তানভীর অন্য পাশে এসে বসলো। লাবিবা আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এতো অভিমান তানভীরের ভালো লাগছে না। আবার উঠে এবার লাবিবার পাশে একটুখানি জায়গা ঘেসেই বসলো। অভিমানী গাল দুটোতে পর পর ঠোঁট চেপে ধরলো। সিক্ত হলো লাবিবার আখি দ্বয়। তানভীর মোটেও আমলে নিলোনা। দরজায় চোখ বুলিয়ে পর পর পর শ খানেক চুমু খেয়ে ক্ষান্ত হলো। লাবিবা অবাক। তানভীরকে ছাড়িয়ে বললো,
‘ কি করছেন? এটা হসপিটাল। বাড়ি না। ‘
‘ তাহলে দুটো চুমু দাও। আর হসপিটালে চুমু খাবো না।’
‘ এটা আবার কেমন কথা?’
তানভীর নিঃশব্দে হাসে। তার বউয়ের রাগ পড়ে গেছে যে। অভিমান ও হাওয়া। ত্যয়িবাকে নিলো সোহানা আর লাবিবকে কোলে নিলো সাবিনা। তারা অন্য গাড়িতে উঠলো । লাবিবাকে নিয়ে যাবে তানভীর। পেছন সিট লাবিবার পুরোটাই লাগবে। শোয়া আধশোয়া হয়েও যেনো বসতে পারে। তিন তলা থেকে গাড়ি অব্দি তাকে নিয়ে আসলো তানভীর কোলে করে। লাবিবা তানভীরের গলা জড়িয়ে ছিলো। মেয়েরা দৃষ্টপৃষ্ট বলবান ছেলের জন্য এমনি এমনি পাগলামি করেনা। প্রয়োজনে, প্রব্লেমে ভরসায় নিশ্চিন্ত থাকা যায়। ভারী শরীরটাকে এক চুটকিতে কোলে নিয়ে যেভাবে নিচে নেমে এলো ততোক্ষনে লাবিবা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালো। তানভীর খানকে পেয়ে তার জীবন ধন্য।

পরিবারের আদরে যত্নে চারটি বাচ্চা একসঙ্গে বড় হতে লাগলো। ইসমাইল নাতি নাতনি ছাড়া থাকতেই পারেনা। সকাল থেকে দেখা গেলো কাজ বাদে খান বাড়িতেই নাতি নাতনি নিয়ে হৈ হুল্লোড় করছে আর ঘুমের সময়টুকু কাটে তার রানী মহলে। লাবিবার কলেজের চাকরীটা কনফার্ম হয়েছে। স্টুডেন্টদের সে ফাস্ট ইয়ার আর সেকেন্ড ইয়ার মিলে ডেইলি দুটো করে ক্লাস নিবে।
বাচ্চা দুটোকে সাবিনা এবং সোহানার কাছে রেখে সে কলেজে যায় ক্লাস নিতে। নিউ মাম্মা জন্য তাকে ক্লাস টাইম ব্যতীত কলেজে টাইম দিতে হয়না। ক্লাস নিয়েই বাড়ি ফিরে আসে। লেডিস ক্লাবেও সে একটু একটু করে সময় দিতে শুরু করেছে। তানভীর কাজ সেরে যতটুকু পাচ্ছে বাচ্চাদের সময় দিচ্ছে। ভোর বেলা সে বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে বেরিয়ে যায় হাঁটতে। লাবিব ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটতে শিখেছে। তানভীর তাকে হাঁটতে ছেড়ে দেয় ভাই বোনের সাথে। কিন্তু তয়্যিবাকে রাখে কোলে। মেয়েটাকে হাঁটতে ছাড়লে যদি উল্টে পড়ে ব্যাথা পায় হটাৎ করে? তানভীরের বুকটা হু হু করে উঠে। মানুষ বাবা মেয়ের টান সম্পর্কে ধারণা করে মাত্র। কিন্তু যে বাবা হয়েছে সেই বোধহয় জানে তার মেয়ে তার কাছে কি। তানভীর খোলা পার্কের এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়।
বাচ্চাদের মধ্যে কমপিটিশন হচ্ছে। কে আগে তানভীরের কাছে আসবে? তাফিফ, ফারাহ, নাকি লাবিব? লাবিব মাত্রই হাঁটতে শিখেছে।‌ ফারাহ তার একটু বড়ো। সে ঘুড্ডির মতো দৌড় দেয়। তাফিফের কাছে তারা কিছুইনা। এক দৌড়ে তানভীরের পা জড়িয়ে ধরলে তানভীর পিঠে চাপড় দেয়, ‘ অলওয়েজ উইন হ ব্যাটা। ‘
তাফিফের উপর দিয়ে ফারাহ এসে জাপটে ধরে। তানভীর ফারাহের গালে চুমু দেয়। কি সুন্দর গোলাপী গাল দুটো টসটসা। ফারার গালে চুমু একদমি পছন্দ না। কিন্তু সে তানভীরকে কিছুই বলেনা। টচ করে হাত দিয়ে মুছে দেয় যেনো কত লালা লেগেছে গালে। ভীষন কিউট লাগে। তানভীর এক গাল হাসে। আদর করে ডাকে,
‘ আমার সোনা মা। ‘ লাবিবের কান্নার আওয়াজ আসে কানে। তানভীর বসে ছিলো বাচ্চাদের জড়িয়ে। তয়্যিবাকে কোল থেকে নামিয়ে ঘাসে বসিয়েই ছুটে যায়। পা উপরে তুলে চিৎ খেয়ে পড়ে আছে লাবিব। হাটতে গিয়েই তার এই চিৎপটাং। তানভীর এক টানে কোলে তুলে নেয়। লাবিব হাউমাউ করে কান্না জুড়েছে। তানভীর কান্না থামাতে নাচাতে থাকে। বুকে জড়িয়ে নিয়ে এইটা ওইটা বলে। গাছ থেকে পাতা ছিড়ে হাতে দেয়। সেটা ফেলে দিলে ফুল ছিড়ে হাতে দেয়। তাতেও কান্না থামে না। তানভীর দেখার চেষ্টা করে কোথাও ব্যাথা ট্যাথা লেগেছে কিনা। কিন্তু অল ওকে। তাফিফ,ফারাহ,তয়্যিবা দৌড়ে আসে। তাফিফ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ‘ জুনিয়ল কান্না কলেনা। এইতো আমি ভাইয়া। ‘ ফারাহ দু হাতে চোখ মুছিয়ে দেয়। বড়দের মতো সেও কান্না থামানোর চেষ্টা করে, ‘ ওওওও কাদেনা কাদেনা। ‘ তয়্যিবা ভাইয়ের কান্না দেখে সেও ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়। অদ্ভুত ভাবে তয়্যিবার কান্না দেখে লাবিবের কান্না থেমে যায়। তানভীর এমন দৃশ্যে সুখ অনুভব করে। লাবিবের কপালে চুমু দিয়ে বলে,
‘ অলওয়েজ বি স্ট্রং পাপা। ‘ তাফিফ বলে,
‘ আমিও টং চাচ্চু। হরলিক্স খাই তাই। মাম্মা বলেছে আমাল অনেক বুদ্ধি। ইংলিশ হচ্চে আই এম ভেলি ইনটেলিজেন। ‘
তানভীর তয়্যিবাকে কোলে নিয়ে হাতের আঙ্গুলে তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে এগুয়। উৎসাহ দিয়ে বলে,
‘ ইয়েস আমার ব্যাটা অনেক ইন্টেলিজেন্ট। চাচ্চু বড় হয়ে কি হবে ?’
‘ উমমমম পাইলট হবে। হেলিকপটার চালাবো। বুম বুম করে। অনেক বড় বড় হেলিকপটার। ‘
‘ আচ্ছা। আর কি চালাবে?’
‘ বিমান চালাবো বিমান। অনেক বড় বড় বিমান। ‘
‘ কাকে বসাবে?’
‘ আমি বসবে মাম্মা বসবে,তয়্যুকে বসবে, গ্ৰ্যানি বসবে, ফালা বসবে। ‘
‘ দাদু পাপা চাচ্চু বসবেনা? ‘
‘ উমমম নাহ। আর কেউ বসবেনা। আমাল কোলে তয়্যু বসবে। আল কেউ বসবেনা। ‘
তাফিফ আকাশে হাত মেলে লাফায়। তানভীর কথা বলতে বলতে বাড়ি পৌঁছায়। তাফিফ ‘ র ‘ উচ্চারণ করতে পারেনা। যতবার ই ক্লিয়ার করানো হয় সেই এক দুইবার ভালোভাবে উচ্চারণ করে আবার ভুল করে। ফারাহ টুক টাক ভালোই কথা বলতে শিখেছে। তার উচ্চারণে ভুল হবেনা সেটা বোঝা গেছে। তয়্যিবা – লাবিব পাপা, মা, মামা, দাদা, নাননান ডাকটাই ডাকে। অন্য কিছু এখনো ডাকে না।

বাসায় ফিরে দেখে লাবিবা রান্না করছে। তার রান্না এখন ডিম সেদ্ধ আর নরম ভাত। বাচ্চাদের চটকে চটকে খাওয়াবে। তানভীর বাচ্চাদের ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে কিচেনে একবার উঁকি দেয়। বউটাকে সে ঘরে গিয়ে একচোট মিস করেছে। দরজায় এসে দাঁড়ায়। বউ তার কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুঁজে চুলোর সামনে দাঁড়িয়েছে। সিজন পরিবর্তনে ঠান্ডা লেগেছে। সিজারিয়ানদের এই এক সমস্যা। একটু কিছু হলেই ঠান্ডা লেগে যায়। সারাবছর লাবিবার ঠান্ডার, এলার্জির মেডিসিন চলে। আলসেমি করে হয়তো মেডিসিন নেয়নি। তানভীর ও এদিকাটায় নজর দেয়নি। সেজন্যই এই অবস্থা। তানভীর ভয়ে ভয়ে থাকে সব সময়। তার বাচ্চা দুটোও সিজারিয়ান। না জানি একটু উনিশ বিশ হলেই ঠান্ডা লেগে যাবে বলা যায়না। রোজী বের হয়ে গেলেই তানভীর কিচেনে ঢুকে যায়। পেছন থেকে লাবিবাকে লাগছে বেশ। ঘাড়ের উপর মোটা খোঁপা, হাই নেক ব্লাক ব্লাউজে অর্ধখোলা পিঠ,ভাড়ি কোমড় গোলাপী শিপন শাড়ী সে এক অপরূপা। প্রেগেন্সি পর লাবিবার স্বাস্থ্য খুব একটা কমেনি। ডায়েট ও করতে পারছেনা। বাচ্চা দুটোকে ফিডিং করতে হয়। লাবিবা নিজেই নিজেকে পছন্দ করছেনা। অপরদিকে তানভীর তার এই রুপে সকাল সন্ধ্যা জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। তানভীরের চোখে লাবিবা মানেই একটা মিষ্টি । মিষ্টির ভেতর বিভিন্ন আইটেম আছে আছে যার যার নিজস্ব টেস্ট। বছর দুয়েক আগে যদি লাবিবা মুক্তাগাছার মণ্ডা হতো এখন সে কুমিল্লার রসগোল্লা । তানভীর নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে যায়। রোজী ফিরে এসেছে কিচেনে। জিজ্ঞেস করে,
‘ কিছু লাগবে ভাইয়া?’
তানভীর মাথা নাড়ে। তার বউ লাগবে। কিন্তু সে বলতে পারবেনা। সময় অনুযায়ী সে এখন বললেও বউ পাবেনা। লাবিবা ঘাড় ঘুরিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলে তানভীর এক অদ্ভুত কাজ করে বসে। লাবিবার খোঁপা খুলে দিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। হাঁটু অব্দি চুল গুলো ঝড়ঝড়িয়ে পিঠ সম ছড়িয়ে যায়। লাবিবা চিল্লায়
‘ এই আপনি কি করলেন? আমি ডিম ধরেছি এখন চুল বাধঁবো কি করে?’
লাবিবার লাফানো দেখে রোজী হাসতে হাসতে বলে,
‘ একটু সবুর কর। আমি হাত ধুয়ে বেঁধে দিচ্ছি। ‘
‘ কতবার বলছি চুল কাটি তোমার দেবর দিচ্ছেইনা। কি একটা ঝামেলা! শয়তানি করতে পারবে তাই কাটতে দেয়না।‌’
‘ হয়েছে আর লাফাস না। পাগলের যতো পাগলামি। তোকে লাগবে সাহেবের বুঝিস না ?’
‘ যাবো না। ‘ বলে লাবিবা গাল ফুলায়।

চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

১০৪ (দ্বিতীয়াংশ)
স্টুডেন্টরা সবাই লাবিবার নেওটা।‌ যতক্ষন সে লেকচার দিবে ততোক্ষন ক্লাসে পায়ে খচখচানির শব্দ পর্যন্ত কানে আসবেনা। অনান্য ক্লাসে তারা হৈ হুল্লোড় করবেই করবে। কলেজের গেইট থেকে শুনা যায় তাদের আওয়াজ। এই ব্যাপারে অনান্য স্যার- ম্যামরা লাবিবার প্রশংসা করে। কারণ জানতে চায়। লাবিবা কি এমন করেছে যার জন্য স্টুডেন্টরা তাকে এতো সম্মান করে।
লাবিবা প্রতুত্যরে হাসে। লাবিবা সম্মান পাওয়ার মতো কাজ করেছে বিধায় সে সম্মান পায়। মহিলা ক্লাবের কর্ণধার সে। দুঃস্থ মহিলাদের বিপদে আপদে আশ্রয়স্থল। ফিরোজ খানে পুত্রবধূ সবাই একনামে তাকে চেনে। এখানে অধিকাংশ স্টুডেন্টরা আশেপাশের গ্ৰাম থেকে এসেছে। তারা জানে তাদের এলাকায় লাবিবার সাহায্যের হাত কতটুকু পৌঁছেছে। তার থেকে বড় হচ্ছে ব্যবহার। অমায়িক ব্যবহার এবং মিষ্টি শাসনে স্টুডেন্টদের সে আগামীর পথ কিভাবে হাঁটতে হবে তাই শেখায়। তার উপর ইনজয় করে ক্লাসে ছেলে ভক্তদের। কেমন মুগ্ধ হয়ে শোনে লাবিবাকে। তার স্মার্টনেস, সফটনেস, কিউটনেস সবাইকে মুগ্ধ করে রাখে। লাবিবা যখন তানভীরকে তার স্টুডেন্টদের কথা জানায় তানভীর মোটেও রিয়েক্ট করে না। শুধু বলে ক্লাস ব্যাতিত তাদের সাথে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। কিছু না বুঝলে ক্লাসেই বোঝানোর চেষ্টা করবে। বাড়তি টাইম দেবার প্রয়োজন নেই। লাবিবা তানভীরকে জ্বালানোর জন্য বিষয়টা শেয়ার করেছে। বিনিময়ে হাজবেন্ড এর জেলাসি রুপ না দেখতে পেয়ে বড় ভাইয়ের শাসনরুপ ব্যবহার পেয়েছে। আশানুরূপ ফল না পেয়ে লাবিবা একটু মনটা খারাপ ই করে। কিন্তু এটা যে তার কোন লেভেলের ভূল ছিলো সেটা পরে বুঝতে পেরেছে। প্রথমে হাতে ধরিয়ে দিলো বুটিকসের সুতি শাড়ি। তারপর ফুল স্লিভ ব্লাউজ। তাতেও যেনো হলোনা। এখন তাকে কলেজে পড়তে হয় বোরখা। অতি গরমের মাঝেও তাকে এই অত্যাচার সহ্য করতে হয়। বাচ্চা হবার পর শরীরের গরম এমনিতেই বেড়ে গিয়েছে। তানভীরের সাথে ঘ্যান ঘ্যান করেও লাভ হয়নি। অগত্যা মেনে নিয়েছে।

কলেজ থেকে ফিরেই দেখে লাবিব, তয়্যিবা, ইসমাইল,সাবিনা সবাই রেডি। গ্ৰামে যাবে একসাথে। অন্তুর বার্থডে পার্টিতে এটেন্ড করতে হবে। গতবছর লাবিবা যেতে পারেনি। বাপরে! অন্তুর সে কি রাগ! তবে এ বছর তার খুশির সীমা নেই। ভাগিনা ভাগিনিকে সাথে নিয়ে কেক কাটবে। গ্ৰামে পৌঁছে লাবিবাদের বাড়িতেই সবাই উঠে। সাবিনা আগের দিন এক মহিলাকে দিয়ে ঘর বাড়ি ঝাড় দিইয়ে গিয়েছে। জায়গার জিনিস জায়গাতেই গুছিয়ে রেখেছে। নাতি নাতনী তার এক জায়গায় বসে থাকার নয়। প্রচন্ড দুষ্টু হয়েছে দুটোয়। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছে। উঠোনে ছ্যাপছ্যাপা পানি। ছাদেও পানি জমেছে। পাইপের মুখ খুলে দেয়। লাবিবা বোরখাটা খোলে ফ্রেশ হয়ে একটা সুতি শাড়ি পড়ে নেয়। কবির এসেছে লাবিবাকে নিতে। তয়্যিবাকে ইসমাইলের থেকে কোলে তুলে নেয়। মামা মামা বলে আদরে ভাসিয়ে দেয়। তাড়া দেয় বের হবার জন্য। লাবিবা কবিরকে দেখে মুচকি হাসি দেয়। কবির বলে,
‘ কাকীকে ডাক। তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। ‘
লাবিবা ছাদ থেকে সাবিনাকে ডেকে আনে। কবিরের কোলে তয়্যিবাকে পেয়ে লাবিবকে খোঁজে।
‘ আব্বু লাবিব কোথায় গেলো?’
ইসমাইলের টনক নড়ে। সোফায় বসিয়েছিলো লাবিবকে। ‘ এখানেই তো বসে ছিলো। লাবিব,লাবিব নানুভাই কোথায় গেলো আমার। ‘
ইসমাইলের আহ্লাদী ডাকের কোনো সাড়া নেই। লাবিবা কিচেনে ছুটে। ইসমাইল ঘর গুলো তে দেখে। না পেয়ে লাবিবা বাইরে ছুটে আসে। বারান্দাতে নেই। উঠোনে নজর দিতেই দেখে লাবিব মাটির স্তুপের উপর বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে লাবিবার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘ পাপা হুয়াট য়্যু ডুয়িং হেয়ার? মাম্মা কল য়্যুউ না?’
লাবিবাকে তার দিকে আসতে দেখে উঠে অন্যদিকে দৌড় দেয়। কয়েক পা ফেলতেই পিছলে পড়ে যায়। ঐ পিছলা জায়গাতে আবার উঠে দাঁড়ায় আবার পড়ে যায়। আবার উঠে কয়েকপা ফেলতেই আবার পড়ে খিলখিল করে হেসে উঠে। যেনো সে একটা মজার খেলা খেলছে। পুরো শরীরে শার্ট প্যান্ট কাঁদায় মাখো মাখো হয়ে যায়। লাবিবা চেঁচিয়ে উঠে। তার আগেই কবির গিয়ে লাবিবকে সেফ করে। লাবিবা অভিযোগ জানায়, ‘ আব্বু দেখো তোমার নাতি কি করেছে। নতুন ড্রেসটা একদম নষ্ট করে ফেলেছে। একটু ছাড়তে দেরি তার ছুটাছুটি খেলতে দেড়ি নেই। এই ছেলে এখনি এমন ফিউচারে একে নিয়ে কি করবো আল্লাহই জানে। ‘
বক বক করতে করতে গাড়িতে গিয়ে বসে। সাবিনা লাবিবকে ধুয়ে দিয়ে জামা কাপড় পড়িয়ে দেয়।

অন্তু তয়্যিবাকে নেওয়ার জন্য এতো চেষ্টা করে, তয়্যিবা কিছুতেই তার কোলে যায় না। কবিরের কোল থেকেও নামেনা। শার্ট খামচে ধরে আছে। কবির হাসতে হাসতে বলে, ‘ মামা আমাকে পছন্দ করেছে ‘ । অন্তু রেগে মেগে লাবিবকে টুপ করে কোলে তুলে নিয়ে কেকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। লাবিব কাঁদতে যাবে তখনি হাতে চিপসের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
‘একদম কান্নাকাটি করা যাবেনা। আমরা মুস্কিল আসান করতে জানি। মামা ভাগিনা যেখানে আপদ নাই সেখানে। তুই কেনো কান্না কাটি করে মুস্কিল করতে চাস? ‘
লাবিব দু হাতের থাবায় চিপস কে প্যাকেটের উপর দিয়েই গুড়ো গুড়ো করে ফেলে। ঐটা আর খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না।‌ অন্তুকে সবাই উইশ করে কেক কাটে। একে একে সবাই গিফট দেয়। ইসমাইল ভাতিজাকে একটা রেসিং কার গিফট করে। মাস ছয়েক আগে মার্কেটে এই কার দেখে বাবার সাথে অনেক কান্নাকাটি করেছে। তাকে কিনে দেয়নি বলে সে কি রাগ! হটাৎ করে এমন একটা গিফট পেয়ে অন্তু খুশিতে লাফাতে শুরু করে। নিজে না বসে প্রথমে লাবিবকেই বসায়। পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়ায়।

রাতে তানভীর বাসায় ফিরে খুব একাকিত্ব বোধ করে। বউ ছাড়া তার একদমই রাত কাটে না। বউকে কম করে হলেও আদর না করলে ঘুম আসেনা। এখন তো ছেলে আর মেয়ে আছে। তানভীর বিছানায় হাঁস ফাঁস করে। লাবিবাকে কল করে। কল রিসিভ হয়না। সময় মধ্যরাত। ঘড়িতে বাজছে একটা। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কথাটা মাথায় আসতেই তানভীরের মাথায় আগুন ধরে যায়। বেয়াদব বউ! নিষ্টুর! স্বার্থপর! কিভাবে ঘুমায় তাকে ছাড়া? সারাদিন তো তানভীর ও কম পরিশ্রম করেনা। কই সে তো বিছানায় শুলেই ঘুমোয় না? লাবিবা বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়ে। এতে তানভীরের বেশ অসুবিধা। এমনো হয় লাবিবা ঘুমে চোখ টানছে আর তানভীর তাকে আদর করছে জোর করে। কি একটা মুসিবতের ব্যাপার না? তানভীর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বাচ্চাদের সে রাতে এমনিতেও দেখেনা। তাঁদের আলাদা বেড। সারাদিন এতো এতো দুষ্টুমি করে যে সারারাত বিভোরে ঘুমায়। মাঝে মাঝে ক্ষুধা লাগলে লাবিবা ফিডিং করিয়ে আসে। কিন্তু সে তো লাবিবাকে বিছানায় থাকা ইমপসিবল ব্যাপার না? রাগে গজগজ করতে করতে সে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে যায়। ছাদ থেকে নামছিলো তামিম। দুইভাই এ মুখোমুখি হয়ে যায়। তামিম জিজ্ঞেস করলো,
‘ ঘুমাসনি এখনো? ‘
তানভীর তামিমের হাতে সিগারেটের দিকে তাকিয়ে আছে। তামিম আধখাওয়া সিগারেট টা ফেলে দেয়। পায়ের নিচে পিষে ফেলে। তানভীর জিজ্ঞেস করে,
‘ ভাবী কোথায়?’
‘ ঘুমায়। ‘
‘ আর তুমি ছাদে এসে দুঃখ বিলাস করো। ‘
তামিম হাসে। ‘ আরে না। একটু সিগারেটের নেশা হলো তাই এলাম। তুই কেনো?’
‘ আমারও নেশা উঠেছে। ধরো একটা ড্রাগস রেগুলার নিতে নিতে যখন ব্লাডের সাথে মিশে যায় তখন হঠাৎ করে যদি সেই ড্রাগস এডিক্টেড পার্সন না পায় তখন শরীরে মনে কি পরিমান বিরুপ প্রভাব পড়ে তুমি ধারণা করতে পারবেনা ভাইয়া। আমার তৃষ্ণা পাচ্ছে। এই ড্রাগস না নেওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি হচ্ছেনা। ‘
তানভীরের কথায় তামিম হকচকিয়ে যায়। অবিশ্বাসের সু্রে বলে, ‘ তুই কি সিরিয়াস? ড্রাগস নিচ্ছিস?’
‘ হ্যা। ‘
‘ হুয়াট? কিভাবে পসিবল? এতো বড় অকারেন্স তুই কিভাবে ঘটাতে পারিস? লাবিবা কি করে? সে জানে না? তোকে আটকাতে পারেনা?’
তানভীর তপ্ত শ্বাস ফেলে।
‘ সেও এডিক্টেড ভাইয়া । কিন্তু আমার থেকে বোধহয় কম। স্বার্থপর মানুষ তো তাই। ‘
‘ তানভীর লাবিবার কথা নাই বলি তুই নিজেকে এসবে কেনো ডুবালি? তোদের ছোট ছোট বাচ্চা আছে দুইটা তাঁদের কথা একবার ভাবলি না? তোর ভাবীর সময় কি হলো নিজ চোখে দেখেছিস। তার পরেও কেনো সাবধান হলিনা? পাপা জানলে এই বয়সে কিভাবে নিবে একবার ভাবতে পেরেছিস? ইসমাইল আঙ্কেলকেই বা কি জবাব দিবি?’
‘ উনারা কিভাবে জানবেন? তুমি তাদের বলবেই না। ‘
তামিমের মাথা খারাপ হয়ে যায়। তানভীর ভেতরে ভেতরে একটা পৈশাচিক আনন্দ পায়। মাঝরাতে তামিমকে টেনশনে ফেলে দিয়ে সে বেশ মজা লুটছে। হুট করেই তামিমের হাত চেপে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। মেজাজ তুঙ্গে তুলে বলে,
‘ এই নারী জাতি মানুষ গুলো খুব খারাপ ভাইয়া। তুমি ছাদে দুঃখ বিলাস করছো আর ভাবী কিভাবে নাক ডেকে ঘুমোয়? এর ঘুম ছুটাচ্ছি আমি। ‘
তানভীরের আচরণ তামিমের একদমই অন্যরকম লাগে। সে ভাবে তার ভাই ড্রাগস না নিতে পেরে পাগলামো শুরু করে দিয়েছে। তানভীরকে আটকাতে চেয়েও পারেনা।

দুই ছেলে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে তাদের বিছানাতেই বসে ঘুমিয়ে পড়েছে রোজী। তানভীর এসে ডাইরেক্ট রোজীকে ডাকে। রোজী চোখ মেলে তাকিয়ে দুই ভাইকে একসাথে দাঁড়ানো দেখে হকচকিয়ে যায়। তানভীরের মুখ দেখেই বুঝে বেচারা রেগে আছে। রোজী অসহায় দৃষ্টি ফেলে, ‘ কি হয়েছে?’
‘ তোমার হাজব্যান্ড এতো রাতে কেনো ছাদে বসে সিগারেটে দুঃখ বিলাস করবে? বাই এনি চান্স তুমি তাকে বলোনিতো আমি ঘুমাই আর তুমি ছাদে গিয়ে তোমার এক্সকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে এসো?’
তামিম তানভীরকে থামায়। টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে,
‘ চল তোর রুমে চল। মাথা ঠিক নেই তোর। ‘
‘ আরে ছাড়ো। আমি চলেই যাচ্ছি। ভাবীর কাছে তুমি যেতেই পারো কিন্তু খরবদার ব্রাশ না করে বাচ্চাদের কাছে যাবেনা। আর ভাবী তোমাকে বলছি। স্বার্থপরতা একটু কম করে করবে হ্যা? এসব দুঃখ বিলাস আমি দেখতে পারবোনা। ‘
তানভীর চলে যায়। তামিম ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। রোজী এতোক্ষনে অবাকের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসে। তামিমকে জিজ্ঞেস করে, ‘ এসবের মানে কি? ভাইয়ার কি হয়েছে?’
‘ তোমার দেবর ড্রাগস নিতে না পেরে পাগলামি করছে। কি করবো আমি এবার? আবারো এই ড্রাগস!’
‘ কি বলেন? ভাইয়া আর ড্রাগস? কখনোই না। থাকেন আমি দেখছি ভাইয়ার কি হলো । ‘
রোজী দৌড়ে যায়। তানভীর ঘরে এসে বসেছে। রোজী অনুমতি নেয়, ‘ আসবো ভাইয়া?’
‘ তোমাকে না ভাইয়ার সেবায় নিয়োজিত করে আসলাম? এখানে কেনো তবে?’
রোজী তানভীরের কাছে এসে দাঁড়ায়। খালি বিছানাটার দিকে এক পলক চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ তুমি নাকি ড্রাগস নিচ্ছো? কথাটা কি সত্যি? আজ নিতে না পেরে কষ্ট পাচ্ছো। আমার জানা শোনা আছে। উপায় বলে দিতে পারবো। কোনটা নিচ্ছো তুমি? ইয়াবা, ফেনসিডিল, কোকেন, গাঁজা? কোনটা?’
তানভীর রোজীর এই সাহায্যকারী মনোভাবে হাসে। রোজী চেহারা দেখে কনফিউজড হয়ে যায়। তানভীরকে মোটেও ঐরকম কিছু লাগছেনা। তানভীর কপালে পড়া চুল গুলো পেছনের দিকে টানে। জিহ্বায় ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। ঠোঁটে হাসি রেখেই বলে, ‘ আমার ড্রাগসের একটা সুন্দর নাম আছে ভাবী। ঐসব বাজে নাম না। ‘
‘ আমি কি চিনি? নাকি নতুন?’
‘ পুরাতন হলেও নতুনের মতো। স্বাদ যেনো বাড়তেই থাকে। বারো বছর আগেই লঞ্জ হয়েছে। নাম তার লাবিবা। ‘
রোজী হাসতে হাসতে শেষ।‌ খানিকটা লজ্জাও পায়। তখনি এই ঘর ছাড়ে। যাওয়ার আগে বলে যায়,
‘ ঘুমাও ভাইয়া। ‘

তামিম রোজীকে দেখেই বাহু ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরায়। জিজ্ঞেস করে, ‘ কি বললো তানভীর? সামলিয়েছে নিজেকে? আমি যাচ্ছি তার কাছে হ্যা?’
‘ কোথাও যাবেন না আপনি? আমি বাচ্চাদের কাছে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছি আপনি সুযোগ বুঝে ছাদে গিয়ে সিগারেট ফুকবেন। তারপর এক্সের কথা ভাববেন তাইনা? কালকেই আমি বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি। আপনার কাছে আর আমি আসবোনা। ‘
‘ কি সব বলছো? তানভীরের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একটাও সত্য না। ‘
‘ তাহলে কোনটা সত্য?’
‘ আমিতো জাস্ট সিগারেট খেতে ছাদে গিয়েছিলাম। কি থেকে কি! ‘
‘ সিগারেট কেনো খেতে হবে আপনাকে? আমি পুরাতন হয়ে গেছি না?দু বাচ্চা জন্ম দিয়ে মোটা হয়ে গেছি। আর ভালো লাগছেনা তাইনা?’
‘ দেখো আজেবাজে কথা বলবেনা। তানভীরটা আজকে কি অবস্থায় আছে টেনশনে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। তুমি এক্সটা মাথা খারাপ করবেনা। ‘
রোজী হুট করেই কান্না জুড়লো। তামিম পড়লো মহা ফ্যাসাদে। ‘ আরে কাঁদছো কেনো?’
‘ আপনি আর আমাকে ভালোবাসেন না। ‘
‘ বাসিতো। কখন বললাম এই কথা?’
‘ আপনার ছোট ভাই বউ না পেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছে আর আপনি বউ থাকতেও ইগনোর করে চলেন। এই আপনার ভালোবাসা? ‘
তামিম এতোক্ষনে বুঝলো ব্যাপারটা। ধপ করে গা ছেড়ে দিলো বিছানায়। টেনশন মাথা থেকে চিনচিন করে বেরিয়ে গেলো। মনে মনে তানভীরকে বিশ্রি গালি দিতেও ভুললোনা। পকেট থেকে ফোন বের করে কবিরকে কল দিলো। কবির অন ডিউটিতে আছে।
রিসিভ করে হ্যালো বলতেই তামিম হুকুম করলো,
‘ সকাল সকাল তোমার বোনকে এ বাড়িতে পাঠিয়ে দিবে। একদিনেই তোমার বন্ধু পাগল হয়ে গিয়েছে।‌’
তানভীর স্টোর রুমের তালা খুলে ভেতরে এলো। লাইট জ্বালাতেই ইউজড সব ফার্ণিচারের স্তুপ সামনে পড়লো। স্টোর রুম হলেও কোনো ধুলো ময়লা নেই। রেগুলার নিয়ম করে জবেদা এসে পরিষ্কার করে যায়। উত্তরে একটাই বড় জানালা। খুলে দিতেই বাহিরের ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ঢুকলো। পুরোনো সব জিনিস ঘেঁটে তানভীর রং তুলির বের করে নিয়ে এলো।‌ লাইব্রেরী থেকে আর্ট পেপার এনে সেট করলো। কলেজ লাইফে টুকটাক আর্ট করা হয়েছে। লাস্ট ছুয়েছিলো সুইজারল্যান্ড এ। সেখানকার প্রকৃতি আর ছবি আঁকা প্রকৃতি একদমি আলাদা করার উপায় নেই। নৈশ্বর্গিক এক সৌন্দর্য। রং গুলো তুলিতে ছোয়ালো। আর্ট পেপারে অনভ্যস্ত হাতে তুলি ছোয়ালো। চেষ্টা তার প্রিয় মুখটার আকৃতি দেবার। যে মুখ তার হৃদয়ে প্রশান্তি বিরাজ করে। চোখের তৃষ্ণা মেটায়। শরীরে উত্তাপ ছড়ায়। সপ্নে একেক রুপে এসে ছুঁয়ে যায়। যাকে দেখার,কাছে পাবার জন্য এই মুহূর্তে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ভোর ছয়টার দিকে লাবিবা বিছানার বেডশিট, বালিশ, কোল বালিশ, কাঁথা সবকিছুই তুলে ঝুড়িতে রাখছে। পাশেই ইসমাইল কোলে নিয়ে আছে লাবিবকে। আর সাবিনার কোলে তয়্যিবা। লাবিব চুপচাপ থাকলেও তয়্যিবা গলা ফাটিয়ে কান্না করছে। একেতো তার ঘুম হয়নি, তার উপর ক্ষিধে পেয়েছে। সাবিনা তাকে চুপ করানোর চেষ্টা করছে। লাবিবা কোমড়ে উড়না পেঁচিয়ে নতুন বেড শিট পাতছে আর রাগে ফুঁসছে। সাবিনা বলে,
‘ আমি করছি। ওকে ধর তুই। ক্ষিধে পেয়েছে খুব। নাআআ আমার নানুমনি কাদেনা। ‘
লাবিবা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। চোখে মুখে কি রাগ!
‘ ওর ভাইকে বলো খাওয়াতে। কেমন পাজি ছেলে হয়েছে চিন্তা করেছো? হাত পা না শক্ত হয়েছে ওমনিতেই ওর কেলমা দেখানো শুরু! নিজ হাতে ড্রাইপার খুলে তারপর হিসু করেছে। নিজেতো ভিজেছে ভিজেছেই। বোনটাকে সহ ভিজিয়েছে। ‘
‘ ছেলে হলে একটু দুষ্টুমি বেশিই করে। চিৎকার করিস নাতো। মেয়েকে কোলে নিয়ে আগে খাওয়া। ‘
‘ ইসসস! এদের হিসু সু সু হয়েছে না? আগে গোছল করাবো তারপর খাওয়া। কিভাবে কোলে নিয়ে আছো? ওদের গোছল করাও তারপর তোমরাও গোছল করো। ‘
ইসমাইল ধমকে উঠে, ‘ কি সব বলছো? এতো সকালে গোছল! বাচ্চা দুটো মরে যাবে তো। ‘
লাবিবা দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে, ‘ আব্বু আমার তো চারটা বাচ্চা। চারজনই সু সু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারজনকেই এখন গোছল করতে হবে। একজন ও মরবে না। তোমার না ইশরাকের নামাজ আছে? ‘
লাবিবা ছেলে মেয়ে দুটোকেই সত্যি সত্যি এই ভোর বেলা গোছল করালো। ঠান্ডায় কাঁপা কাঁপা অবস্থা। সাবিনা দুজনকেই নিয়ে ছাদে মাদুর বিছিয়ে শুইয়ে দিলো। সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে পড়ছে। কিন্তু বাহিনী দুটো শুয়ে থাকার মানুষ হলে তো? সাবিনা নিচে গিয়েছে ঝটপট আরেকটা বালিশ নিয়ে আসতে। লাবিবা গোছলে আছে। এই সময়েই দুই ভাই বোন উঠে দাঁড়িয়ে ছাদে চক্কর কাটছে। টবে লাগানো ক্যাকটাস গাছ। বড় বড় ক্যাকটাসে ফুল ফুটেছে। তয়্যিবার হাত পড়েছে ফুলের উপর। থাবা দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ফুল গাছেই ছিড়ে ফিলেছে। তয়্যিবার দেখাদেখি লাবিব ও গিয়ে ধরেছে ক্যাকটাস। তবে ফুল নয় ধরেছে গাছের গোড়া। এটা সে তুলবে। যেইনা চাপ দিয়ে উপরে টান দিয়েছে ওমনিই হাতে কাঁটা ফুটেছে। হাউ হাউ করে শুরু তার চিৎকার। সাবিনা সিড়ি থেকে দৌড়ে এসে দেখে লাবিবার স্বাদের ক্যাকটাস আর বেঁচে নেই। একমাত্র ছেলের হাত থেকেও রক্ত বেরিয়ে আসছে। ভাইয়ের কান্না দেখে তয়্যিবাও চিৎকার জুড়েছে। সাবিনার পাগল অবস্থা। দুই কোলে দুইটাকে নিয়ে নিচে দৌড় দিয়েছে। ইসমাইল নামাজে সালাম ফিরিয়েই দৌড়ে এসেছে। ব্যান্ডেজ এনে হাত লাবিবারে হাতে ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। ইসমাইল করেছে যে হাতে লেগেছে সেই হাতে ব্যান্ডেজ। লাবিবা এসে ভালো হাতটাও ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। যাক এবারে আর কিছু ধরতে পারবেনা। থাকুক ব্যান্ডেজ হাতে। তয়্যিবাও হাত এগিয়ে দিয়েছে। সেও ভাইয়ের মতো ব্যান্ডেজ করবে। ইসমাইল বলেছে, ‘ নানুভাই তোমার হাতে তো ব্যাথা লাগেনি। ভাইয়ের হাতে লেগেছে। তোমাকে ব্যান্ডেজ করতে হবে না। ‘
যেই বলেছে ওমনিই তয়্যিবার চিৎকার শুরু। সেও ব্যান্ডেজ করবে। বাড়ি ঘর চিৎকার করে এক করে ফেলছে। লাবিব ও ব্যাথায় কাঁদছে তবে তয়্যিবার থেকে নিচু স্বরে।কবির এসব দেখে কানে হাত চাপে। লাবিবাকে তানভীরের কথা জানিয়ে যখন দেখে তয়্যিবার কান্না থামার নয় তখন সে নিজেই ভাগনীর দুই হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়। লাবিবা এসব দেখে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। তানভীরকে কল দেয়।
তানভীর এখনো তার প্রেয়সীর মুখটায় ফিনিশিং দিতে পারেনি। তুলিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। লাবিবার নাম্বার দেখে রিসিভ করতেই লাবিবা আহাজারি করতে থাকে। তানভীর ঘাবড়ে গিয়ে বলে, ‘ রাণী সাহেবা কি হয়েছে?’
‘ আপনার বাচ্চা আমাকে পেটে থাকতেও শান্তি দেয়নি। বের হয়েও দেয়নি। এখন যতো বড় হচ্ছে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। ‘
‘ ও প্লিজ কান্নাকাটি করোনা। কি হয়েছে?’
‘ ড্রাইপার খুলে দুটোয় মুতের উপর ঘুমিয়েছে। ছাদে দুটোয় মিলে আমার ক্যাকটাস কে মার্ডার করে হাত রক্তাক্ত করে বসে আছে। ওহ আমার ছেলেটা ব্যাথায় কাঁদছে। ‘
‘ আসছি আমি। ‘
তানভীর জবেদাকে গলা ফাটিয়ে ডাকে ঝটপট একটা স্ট্রং কফি দিতে। ম্যাচিং না করে কোন মতে ড্রেস চুজ করে পড়ে নেয়। জবেদার হাত থেকে কফি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ড্রাইভ করতে করতে খাওয়া যাবে।
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা