রাজনীতির রংমহল পর্ব-২৪

0
686

#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_২৪


রাত আট টা।নিজের ঘরে দরজা চাপিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে শামসুল সরদার।সোনালী বেগম চা হাতে ধীর পায়ে রুমে ঢুকলো।চোখ দুটো ফুলে আছে ভীষণ। টেবিলের উপর চায়ের কাপ রেখে ধরানো গলায় স্বামীর উদ্দেশ্যে বললো-

আমার আর্শিটা আপনার কাছে খুব বেশী বোঝা হয়ে গেছিলো।তাই না?এবার তো শান্তি আপনার আর আপনার ছেলের।

শামসুল সরদার ঘাড় ঘুড়িয়ে স্ত্রীয়ের দিকে চাইলেন।পুরো বাড়িটা খালি খালি লাগছে।এইতো কাল রাতেও এমন সময় আর্শি বাড়িতে ছিল।আর আজ?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-

তোমার মেয়েকে সামলাতে পারো নি তুমি।তাই এই অল্প বয়সেই মান সম্মান রক্ষার জন্য এমন নিষ্ঠুর হতে হলো আমায়।
থেমে,
কেন?রাহুলকে তোমার পছন্দ হয় নি?না হলে বিয়ের সময়েই বাধা দিতে।

ছলছল চোখে সোনালী বেগম বললেন-

সেটাই তো।রাহুল বাবা না থাকলে আমি কখনোই এই বিয়ে হতে দিতাম না।ভাগ্যিস ছেলেটা বিয়ে করে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেছে।না জানি,আর্শিকে আরো কত নিচু ছেলে এনে বিয়ে দিতেন আপনি আর আপনার ছেলে।

সামান্য ক্ষোভ প্রকাশ করলেন শামসুল।নাকের পাটাতন ফুলিয়ে স্ত্রীয়ের উদ্দেশ্যে কাঠকাঠ কন্ঠে বলল-

আর্শি আমার ও মেয়ে সোনালী।

আলতো চিৎকার দিয়ে উঠলো সোণালি।বললো-

নাহ,আপনার মেয়ে হলে কখনোই এমন টা করতে পারতেন না।নিজের আদরের ছেলের কথায় আমার মেয়েটাকে ওই জানোয়ার টার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন।একবার ও খোজ নেওয়ার চেষ্টা করেন নি।মেয়েটা আমার বখে গেছে।ভুল করে এই সব সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে।আমি খেয়াল রাখতে পারে নি।শুধুমাত্র এই দোষ টার জন্যই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম।আপনারা কি নিজের মেয়ের জন্য খারাপ কিছু করবেন?কিন্তু ভুল ছিলাম আমি।ভুলে গেছিলাম,সোভাম আর্শির আপন নয় সৎ ভাই।

আপনার ছেলে বড় হয়েছে।এমপি পদে দাড়াচ্ছে,রাজনীতি করছে,হারছে,সব জায়গায় নিজের দাপট খাটাচ্ছে।আমি এমনকি আমরা যে ওর বড় চাচী,মা হই তা মনে হয় না।সারাক্ষণ ধমকের উপর রাখে আমাদের।ওর হামকি-ধামকিতে সারাক্ষণ আমরা তটস্থ হয়ে থাকি।আর থাকবোই না কেন?আপনি তো দেখেও না দেখার ভান ধরে কিছু বলেন না আপনার ছেলেকে।আজ ছোট্ট বয়সে শিকদার বাড়ির ছেলের সাথে প্রেম করার জন্য আপনার মানসম্মান গেছে।আমার মেয়েটাকে এই বয়সে বিয়ে দিয়ে দিলেন।একদিন আপনার ছেলের জন্য এর থেকেও বেশী অপমানিত হবেন।সেদিন দেখবো কি শাস্তি দেন আপনার ছেলেকে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরের কথাগুলো শুনতেই ফুসলে উঠলো সোভাম।গায়ের প্রতিটা শিরা -উপশিরা দাউদাউ করে জ্বলছে।দাতে দাত চেপে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো-

আপনি আব্বুকে আমার বিরুদ্ধে কান পড়া দিচ্ছেন?আপনার সাহস তো কম নয়।

বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন শামসুল সরদার।বিছানা থেকে অবিশ্বাসের সুরে উঠে বসলো।সোনালী বেগম ক্রুর হাসলেন।স্বামীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলেন আজ দেখুন আপনার আদরের ছেলের শিক্ষা।ত্রস্ত কন্ঠে বললেন-

মুখ সামলে কথা বলো।আমি তোমার মা হই।

পুনরায় ক্ষেপে সোভাম।দাতে দাত পিষিয়ে বললো-

আমার বিরুদ্ধে সারারাত ভর কুটনিগিরি করতে লজ্জা করে না অভদ্র,অসভ্য মহিলা।

পরপর দু গালে দুটো ঠাস করে থাপ্পড় মারলেন শামসুল সরদার। অবাকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সোভাম।সোনালী বেগম সাময়িক ভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।রাগে চোয়াল শক্ত করে শামসুল বললেন-

এই থাপ্পড় গুলো তোমাকে আরো অনেক আগেই আমার মারা উচিত ছিলো। প্রথম সন্তান হিসেবে ঠিক যতটা আদরে রেখেছি ধীরে ধীরে ততটাই পস্তাচ্ছি।

হন হন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সোভাম।কোনোরুপ সাড়া শব্দ না দাতে দাত চেপে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে সামনে যা পড়েছে সবকিছু ভেঙেচুড়ে তছনছ করে দিয়ে গেছে সে।

★★★★
রাত নয়টা। সবেমাত্র বাস থেমেছে সাভার রেডিও কলানির সামনে।রাহুল পাশে তাকিয়ে দেখলো আর্শি এখনো ঘুমে।উপরের বড় ব্যাগটা টেনে নিয়ে বাস থেকে নামলো।ওভার ব্রিজের পাশে রেখে পুনরায় বাসে উঠলো।আর্শিকে কোলে নিয়ে ব্রিজের পাশে আসতেই কিছুটা দূরে একটা রিক্সা দেখলো।হাত দিয়ে ইশারায় ডেকে ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে রাখতে বললো।তারপর আর্শিকে আলতো করে পাশে বসিয়ে এক হাত দিয়ে আগলে রাখলো।ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে ছোট্ট করে বললো-

সোসাইটি গেট,০১ নম্বর বাড়িটার গেটের সামনে নামাবেন।

ড্রাইভার মাথা হেলিয়ে চলতে শুরু করলো।দশ মিনিটের মাথায় কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌছাতেই আলতো হাতে স্পর্শীকে গাড়িতে হেলান দিয়ে রাখল।ব্যাগ হাতে গেটের সামনে রেখে জোরে ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে বিপাশা ছুটে এলো।মায়ের হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে রিক্সা থেকে আর্শিকে কোলে নিলো।ব্যাগ হাতে ছেলেকে দেখে খুশী হলেও পরবর্তীতে কোনো লাল শাড়ি পরিহিতা মেয়ে দেখে অবাক হয়ে গেল বিপাশা।

কে ও?

রাহুল মাকে পাশ কাটিয়ে রুমের দিকে চলে গেল।যাওয়ার আগে ছোট্ট করে বললো-

রুমে আসো বলছি।

সব টা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে বিপাশা।ছেলের উদ্দেশ্যে বললো-

এরকম হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার কি ছিলো বাবা?

রাহুল একবার বিছানায় শোয়া আর্শির দিকে তাকালো।তারপর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো-

মা,তুমি তো সোভাম কে কিছুটা হলেও চেনো। ভীষণ উগ্র আর বদমেজাজি। আর আর্শি ওরই বিপক্ষে থাকা এমপির ভাইয়ের সাথে সম্পর্কে ছিলো। এই জন্যই এক প্রকার আংকেলের ব্রেন ওয়াশ করে একটা অসভ্য, বিবাহিত ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছি লো।সময় মতো তো ভাঙতে পেরেছি বিয়ে।কিন্তু তারপর?আমি হান্ড্রেড পারসোন শিউর ছিলাম সোভাম আবারো ওর বিয়ের জন্য জোর করতো।মেয়েটা ভীষণ ভীতু মা।হয়তো আরো কোনো বদ লোক এনে বিয়ে পড়িয়ে দিতো।আর তাছাড়াও ওই সময় হুট করে কি হয়ে গেল বুঝলাম না।নিজে থেকেই আংকেলকে প্রস্তাব দিলাম।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিপাশা।আর্শির মুখের দিকে তাকাতেই আতকে উঠলেন।ইশ কি মায়াবি চেহারা টা।একদম বাচ্চাদের মতো ইনোসেন্ট হয়ে ঘুমিয়ে আছে।মুহুর্তেই কিছু মনে পড়তে আতকে উঠে রাহুলকে বললেন-

কিন্তু রাহুল, আর্শি তো স্পর্শীর দেবর কে পছন্দ করে।ওদের সম্পর্ক ও ছিলো।তাহলে তুই হুট করে বিয়ে করতে গেলি কেন?মেয়েটা যদি না মানে।কান্নাকাটি করে।তখন?

হেসে দিল রাহুল।মুহুর্তে দাতে দাত চেপে বললো-

সেটাই তো মা।আসল কথা তো এটাই।আর্শিকে স্পর্শীর দেবর পছন্দ করে।ভালোবাসে।তাই আমি ওকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছি।যেমন টা ওই পরশ শিকদার আমাকে পোড়াচ্ছে।হুট করে আমার স্পর্শীর জীবনে এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল আমার প্রাণ পাখিটাকে।ও না আসলে আমি আরো কিছু দিন সময় পেতাম স্পর্শীকে বোঝানোর।হয়তো বুঝতোও।কিন্তু পারলাম কই?ওই পরশ শিকদার তো আমাকে পুড়িয়ে নিয়ে গেল ওকে।প্রতিনিয়ত পুড়ছি আমি। এবার ঠিক সেভাবেই ওর ভাইকে পোড়াবো আমি।কষ্টে কষ্টে জর্জরিত করে ওকে আর ওর ভাইকে বুঝিয়ে দেব”অনেক দিন ধরে পোষা পাখি হুট করে শিকারী হয়ে ধরে নিলে ঠিক কতটা কষ্ট হয়।”

ধমক মারলেন বিপাশা।রেগে বললেন-

একদম চুপ।তোকে না কতবার বলেছি স্পর্শীর কথা মাথায় ও আনবি না।

তেতে উঠলো রাহুল।চেচিয়ে বললো-

চুপ করো।এই ধমক টা তুমি স্পর্শীকে মারতে পারতে।ওকে বলতে পারতে থেকে যা আমার ছেলেটার কাছে।কিন্তু বলো নি তুমি।আমাকে ধমক দিতে একদম আসবে না।আমার মাথা অলরেডি গরম আছে।একা ছেড়ে দাও।

★★★★
রাত দশ টা।ভাই ভাবিকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার পরপরই পার্টি অফিসে ছুটেছে পাভেল।একের পর এক কাজের ব্যাস্ততায় এই সবে মাত্র বাড়িতে ফিরেছে।আজকে দলের ছেলেরা মারামারি করেছে একজায়গায়।সেখান থেকেই বহুত কষ্টে সবাইকে ম্যানেজ করে ছাড়িয়ে এনেছে। ভাই থাকলে হয়তো এতোটা কষ্ট হতো না তার।তাই ভাই তো পুরো বাঘ।সারাক্ষণ গম্ভীর মুডে কম কথাবার্তা বলা লোকটা হুট করে একটা গর্জন ছাড়লেই সবাই জড়োসড়ো হয়ে যায়।সেখানে অনেক চেচামেচি চিৎকার করতে হয়েছে পাভেলকে।রুমে ঢুকে টানা আধঘন্টা ধরে গোসল করলো। এরইমধ্যে খাওয়ার জন্য হাক আসতেই নিচে গেল সে।খেতে খেতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল।রুমে ঢুকেই দ্রুত ফোন নিয়ে বসলো। কাল ফোন কাটার পর থেকে আর আর্শির একটা ফোন ও আসে নি।অদ্ভুত!এই প্রথমবার নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে পাভেল ফোন করলো আর্শির নম্বরে। কিন্তু ফোন বন্ধ।বেশ অনেকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়ার পর মস্তিষ্ক নিজেকে বোঝালো-

আর্শির সামনে পরিক্ষা।হয়তো সারাক্ষণ ফোন টিপতো বলেই ফ্যামিলি থেকে কেউ ফোন নিয়ে গেছে।হতেই পারে। একদম স্বাভাবিক এটা।আগে ভালো করে পরিক্ষা টা শেষ করুক।তারপর কথা বলা যাবে।

এসব ভাবতেই এপিঠ- ওপিঠ করতে করতে একসময়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

★★★★
জাফলং (Jaflong) প্রকৃতির কন্যা হিসাবে পরিচিত। সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে জাফলং সবার পছন্দ। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা প্রকৃতির দানে রুপের পসরা সাজিয়ে আছে জাফলং। পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানির ধারা, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, উঁচু উঁচু পাহাড়ে সাদা মেঘের খেলা জাফলংকে করেছে অনন্য। একেক ঋতুতে জাফলং একেক রকম রুপের প্রকাশ ঘটায়, যা পর্যটকদেরকে ভ্রমণের জন্য সারাবছরই আগ্রহী করে রাখে।

জফলং যদি থাকতেই হয় তাহলে মামার বাজার এলাকায় জাফলং ইন হোটেল ও হোটেল প্যারিস সহ আরো কিছু রেস্ট হাউজ আছে। এছাড়া জাফলংয়ের কাছে সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ ভিউ সহ জৈন্তিয়া হিল রিসোর্টে যোগাযোগ করতে পারেন। আর সরকারী রেস্ট হাউজে থাকতে পূর্ব অনুমতির প্রয়োজন হয়।পাভেল আগে থেকেই জৈন্তিয়া হিল রিসোর্টে ২টা রুম বুক করে রেখেছিলো।একটা ড্রাইভার ও অন্যটা তাদের।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক আগেই তারা এখানে এসেছে।গোসল সেরে হালকা কিছু খেয়ে যে যার মতো শুতে চলে গিয়েছে।যেহেতু অনেক রাত হয়ে গেছে সেহেতু আজকে আর কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্লান নেই।

রুমের লাইট নেভানো থাকলেও বারান্দা থেকে আসা আশে-পাশের চড়া আলোয় ঘর অনেকটা আলোকিত হয়ে গেছে।জার্নিতে ক্লান্ত থাকায় আসার পরেই ঘুমের ঘোরে চলে গেছে স্পর্শী।কিন্তু পরশের জ্বালায় এক দন্ড ও ঘুমাতে পারছে না।একট দূরে সরে ঘুমালেই দুহাত দিয়ে কোমড় পেচিয়ে ধরে টেনে বুকের কাছে এনে ধরে। দাতে কিড়মিড় করে বলে-

খবরদার স্পর্শীয়া,একদম দূরে শোবে না।আমাকে জড়িয়ে ধরে শোও।আর এক বার যদি দেখেছি না দূরে গেছো,কোমড় একদম ভেঙে ফেলবো।

বিরক্ত হয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো স্পর্শী।পরশের দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো-

কেন?যখন নিজের রাজনৈতিক কাজে যান তখন তো আমাকে চেনেন’ই না।ধমকি-ধামকি মেরে ফোন কেটে দেন।আর রাত হলেও যত আহ্লাদ -ভালো বাসা বাড়ে তাই না?

জিভে কামড় মেরে তাকিয়ে রইল পরশ।তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো-

ছিঃ স্পর্শীয়া।এভাবে কথায় কথায় খোটা দিচ্ছো কেন?নেহাত নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না নইলে তোমার এই খোটার ধার ও ধারতাম না আমি।

বলেই ওদিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো।দম ছাড়লো স্পর্শী।মনে মনে ভাবলো-

যাক, আপাতত রাতটা রাগ করে ঘুমিয়ে থাকুক।সকাল হলে ভাঙাবো।

ভেবে এপাশ ঘুরে শুতেই একটানে পরশের বুকের সাথে ধাক্কা খেল।কানের কাছে মুখ এনে পরশ বললো-

আপাতত তোমাকে ছাড়ছি না পাখি। এভাবেই শুয়ে থাকো।দূরে গেলে ঘুমের মধ্যে আমার মনে হয় এই বুঝি তুমি ছেড়ে চলে গেছো।

চলবে?