#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_৩৭
★★★
(আজ থেকে বর্তমান শুরু)
সকাল সাড়ে আটটা।ধীর পায়ে জেলারের হাটার গতির সাথে তাল মেলাতে মেলাতে নির্দিষ্ট লকাবের সামনে এলো স্পর্শী।ভেতরে ফ্লোরের উপর বিছানো ছোট্ট পাটি’র উপর পরশ শিকদার পা ভাজ করে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে আছে।হাবিল তীব্র শেখ কে দেখা মাত্রই উঠে দাড়িয়েছিলো।এখনো সেভাবেই আছে।জেলারের থেকে আদেশ পেতেই দ্রুত চাবি বের করে লকাবের দরজা খুলে দিলো।পরশ আড়চোখে একবার স্পর্শীর দিকে তাকালো।স্পর্শী তার দিকেই এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে।মুহূর্তে’ই চোখ সরিয়ে নিলো অন্যদিকে।আলতো হাসলো স্পর্শী।শান্ত কন্ঠে বললো-
কি হলো নেতামশাই?বাইরে আসবেন না।নাকি আমাকে ভেতরে ঢোকাতে চাইছেন?
পরশ একবার স্পর্শীর দিকে তাকালো।পরক্ষণেই জেলারের দিকে তাকাতেই পুনরায় চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।আড় চোখে তীব্র শেখ এখনো স্পর্শী কে দেখছে।গা জ্বলে যাচ্ছে পরশের।দাতে দাত চেপে তীব্র শেখ কে বললো-
জেলার সাহেব,আপনি কি কিছু বলবেন?না বললে প্লিজ আমাদের একটু প্রাইভেসি দিন।আমি আমার ওয়াইফের সাথে কথা বলবো।
থতমত খেয়ে গেল জেলার।আমতা আমতা করে বললো-
হ্যা হ্যা,প্লিজ কন্টিনিউ(বলেই নিজের ডেস্কের দিকে চলে গেল।
পরশ সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।কটমট চোখে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলল-
তোমাকে না বলেছিলাম এই জেলারের থেকে দূরে থাকবে।ওর নজর ভালো না।সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে।আমার একটুও সহ্য হয় না।কসম স্পর্শীয়া,আমার সহ্যের বাধ ভাঙলে কিন্তু একদম ওটাকে খুন করে দিব।
চোখ রাঙালো স্পর্শী।ত্যাড়া কন্ঠে বললো-
হ্যা,তিন তিনটা খুন করে তো আপনার হাত এত্তো বড় লম্বা হয়ে গেছে।এখন যাকে দেখবেন তাকেই খুন করতে ইচ্ছে হবে।
পরশ স্পর্শীর গা জ্বালানো কথা একদম গায়ে মাখলো না।চোখ সরিয়ে হাতের দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল।কোনো টিফিন বক্স নেই।গত আটাশ দিন ধরে দেখাও করেনি।পরক্ষণে আজকের দিনের কথা মনে হতেই বললো-
আজ তো শুক্রবার নয়।তাহলে আজকে কি করে দেখা করতে দিলো তোমায়?আর গত একুশ দিন ধরে তুমি দেখা করতে আসো নি কেন?গত শুক্রবারে ও আসো নি।অপেক্ষা করছিলাম আমি।
সামান্য খারাপ লাগলো স্পর্শীয়ার।দুহাত দিয়ে পরশের গাল আলতো করে ধরে বললো-
আমার এক ক্লাইন্টের কেস নিয়ে খুব বিজি ছিলাম নেতামশাই।আর গত শুক্রবার তো আব্বুর আশার কথা ছিল।ব্যাস্ত ছিলাম বলে দেখাও করতে পারি নি।কেন?উনি আসে নি আপনার কাছে?
পরশ মাথা নেড়ে বললো-
হ্যা,এসেছিলো।
স্পর্শী মাথা নাড়ালো।পরক্ষণেই কিছু মনে আসতেই তড়িঘড়ি করে বললো-
আব্বু কি টিফিন এনেছিলো?
পরশ ত্রস্ত হেসে বললো-
নাহ, হয়তো মনে ছিল না।
ভীষণ খারাপ লাগলো স্পর্শীর।পরশের গাল দুটো আকড়ে ধরে বললো-
আপনি না খেয়ে অপেক্ষা করছিলেন বুঝি?সে বেলায় তো না খেয়ে থাকতে হয়েছিলো তাই না।
পরশ আলতো হাসলো।মাথা নাড়িয়ে লজ্জালু হেসে বললো-
গত তিন শুক্রবারেই না ওয়েট করেছিলাম।বাদ দাও,এটা কিসের ফাইল?(স্পর্শীর হাতের মোটা একটা ফাইল দেখিয়ে বলল)
স্পর্শী আলতো হেসে বললো-
এক ক্লাইন্টের।আচ্ছা বাদ দিন নেতামশাই।উঠুন।
বলেই টেনে লকাপের বাইরে বের করে আনলো স্পর্শীয়া।জেলারের ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।জেলসুপারের কাছে গিয়ে আলতো হেসে কিছু বলতেই একটা ফাইল বের করলো সে।তারপর পরশের কাছে এগিয়ে এসে বললো-
এদিকে আসুন।এখানে একটা সই করুন।দ্রুত।
পরশ ভ্রু কুচকে থমথমে মুখে চেয়ে রইলো স্পর্শীর দিকে।এই যে সে হেসে হেসে কথা বলছে এটা তার একদমই সহ্য হচ্ছে না।এখানে যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ ওই জেলার আড়চোখে তাকিয়ে থাকবে স্পর্শীয়ার দিকে।এটা পরশ কিছুতেই দেখতে পারবে না।কোনো রুপ প্রশ্ন না করেই দ্রুত হাতে জেলারের দিকে তাকিয়ে সই করে দিলো পরশ।
কিছুটা দূরে যেতেই পরশ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।স্পর্শীকে টেনে কিছুটা নিজের দিকে দাড়া করলো।কঠিন কন্ঠে বললো-
ওর সাথে হেসে হেসে কথা না বললে তোমার পেটের ভাত হজম হয় না?
কথা টা বেশ উচ্চস্বরে বলায় চোখ বড় বড় করে ফেললো স্পর্শী।আশেপাশে কেউ শুনতে পেয়েছে কি না তা দেখতে আড়চোখে চারপাশে বারকয়েক তাকালো।নাহ কেউ নেই।পরশের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো-
নেতামশাই,আমি জানি জেলসুপার তীব্র শেখ আমার দিকে অন্য নজরে চায়।উনি আমাকে পছন্দ করে।এটাকে আমি ভালো বলছি না কেননা আমি বিবাহিত,আমার হাসবেন্ড আছে তা স্বত্তেও উনি এমন নজরে তাকায়।কিন্তু তাই বলে আমি ওনাকে কিছু বলতে পারছি না।এতো কিছুর পরেও আপনার জন্য আমাকে ওনার সাথে সু সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে।এই যে আপনার সাথে আমি প্রতি শুক্রবার দেখা করি।কোনো পাহারাদার ছাড়াই উনি আপনাকে আমার কাছে ছেড়ে দেয়।অন্য আসামীদের ক্ষেত্রে দেখেছেন সেটা?
অন্য আসামীদের অভিবাবক দের সাথে দেখা জেলের মধ্যে নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসে করতে হয়।আর আপনার সাথে প্রায়ই এখানের পেছনের মাঠ পর্যন্ত আসতে পারি আমি তাও পাহারাদার ছাড়া।যদিও এর চারপাশে উচু দেয়াল,চব্বিশ ঘন্টা টহল দেওয়া পুলিশ থাকে তাও কিন্তু সবাইকে এই সূযোগ দেয় না।ওনার সাথে ভালো সম্পর্ক আছে বলেই আলাদা ভাবে কথা বলার সুযোগ পাই আমি।
পরশ হাসলো।পরক্ষণেই দাতে দাত চেপে বললো-
তা এখন এই দিকে আসার অনুমতি উনি কিসের জন্য দিয়েছেন?এটাতো পেছনের মাঠে যাওয়ার পথ নয়।এখান থেকে তো সোজা বাইরে যাওয়ার গেট পড়ে।
চোখ দুটো ছোট ছোট করে স্পর্শী পরশের দিকে তাকালো।কন্ঠে ঝাঝ এনে বললো-
আপনি ঠিক কি মিন করতে চাইছেন নেতামশাই?
পরশ সাময়িক ভাবে থমকালো।সে কি কোনো খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছে?আচ্ছা স্পর্শীয়া কি রাগ করবে?নিজেকে সামলে তটস্থ হয়ে শান্ত কন্ঠে বললো-
আমি এমন কিছুই মিন করতে চাইছি না পাখি।আমার ওই লোকটাকে সহ্য হয় না ব্যাস।তুমি তো একজন উকিল।হতেও পারে তোমার উপর ভরসা করে ছেড়েছেন আমায়।আচ্ছা,তুমি সম্পুর্ন গাইড নিয়ে আমাকে নিয়ে এলে।এখন যদি আমি এখান থেকে পালাই তাহলে তো তোমার চাকরী শেষ। সাথে কেস ও পড়বে তোমার উপর। আর ওই জেলারের ও চাকরী নিয়ে টানাটানি পড়বে।তাই না।
হাটতে হাটতে স্পর্শী জবাব দিলো-
আপনি ভীষণ বাচ্চামো করছেন নেতামশাই।মুখটাকে একটূ বন্ধ রাখুন।আর চুপচাপ আমার সাথে আসুন।
বলতে বলতেই গেট পেরোলো স্পর্শীয়া।প্রায় প্রত্যেকটা ছোট-বড় গেটের সামনে দায়িত্ব রত পুলিশ রয়েছে।কথা বলতে বলতেই প্রত্যেক জায়গায় জেলারের দেওয়া সেল মারা একটা কাগজ তাদের কে দেখিয়ে যাচ্ছে স্পর্শী।আর তারা কোনোরুপ বাক্যব্যয় না করেই আসামীর পোশাক পরিহিত পরশ কে স্পর্শীর সাথে যেতে দিচ্ছে।
গেটের বাইরে আসতেই পরশ দাঁড়িয়ে পরলো।ভ্রু কুচকে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।তারপর অবাকের সুরে বলল-
আশ্চর্য!কি হচ্ছে এসব?কারাগারের বাইরে অবধি চলে এসেছি অথচ কেউ বাধা দিল না কেন আমায়?
স্পর্শী কাধ ঝাড়া দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো-
কেন বাধা দিবে আপনাকে।কারন আপনার তো সাজা শেষ।
পরক্ষণেই হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো “সারপ্রাইজ ”
বাকহারা হয়ে গেল পরশ। কিছুক্ষণের জন্য থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো।মাথায় কিছুই ঢুকছে না।যেন অনুভূতিরা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।স্নায়ুতন্ত্র তার নির্দিষ্ট কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।অনেকক্ষণ পর আলতো কন্ঠে বললো-
তুমি কি আমার সাথে মজা করছো সোনা।আমার তো এখনো আট বছর সাজা বাকি রয়েছে।মুক্তি পাবো কি করে?
স্পর্শী হাসলো।প্রাণখোলা সেই হাসি।এ যেন অনেকদিন পর মন খুলে হাসলো।প্রাপ্তির খাতায় এই প্রথম যেন শূন্যতার অনুপস্থিতি। পরশের মাথা টা নিচু করে কপালে কপাল ঠেকালো।ধীর কন্ঠে বললো-
টানা আড়াই বছরের ফল এটা নেতামশাই।কম ছোটাছুটি করি নি এই দিনটার জন্য।গত এক মাসে দাড়ানোর সময় টুকুও পাই নি।এই জন্যই তো আপনার সাথে দেখা করতে পারি নি।
থেমে
এখন থেকে আর শুধু শুক্রবার নয়।প্রতিদিন,প্রতিটা ঘন্টা, প্রতিটা সেকেন্ড আপনি আপনার পরিবারের সাথে থাকবেন।একদম আগের মতো।
পরশ যেন কথার খৈ হারিয়ে ফেলছে।ধীর কন্ঠে স্পর্শীকে ঝাকিয়ে বলল-
কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?আর তুমি আমাকে এ ব্যাপারে আগেই কিছু জানাও নি কেন?
স্পর্শী কিছুক্ষণ নিরব রইলো।দুরেই একটা চায়ের বন্ধ দোকান দেখা যাচ্ছে।তবে সামনেই বসার একটা বেঞ্চ রয়েছে।ধীর পায়ে পরশকে নিয়ে সেখানে বসলো।কাধে মাথা রেখে বললো-
আপনাকে সরকার মুক্তি দিয়েছে।প্যারোল পদ্ধতিতে।প্যারোল হচ্ছে অপরাধীর চারিত্রিক সংশোধনের একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা।কোনো অপরাধী আদালত কর্তৃক শাস্তি ভোগের একটা সময় বিশেষ করে শাস্তির এক তৃতীয়াংশ সময় পার হবার পর শর্তাধীনে তাকে মুক্তি দেওয়ার যে আইনগত ব্যাবস্থা টা নেওয়া হয়,ওটাকেই আইনের ভাষায় প্যারোল বলা হয়।এই প্যারোল যে কেউ পায় না।এটার জন্য ও শর্ত প্রয়োজন হয়। কোনো অপরাধী যদি নিজের করা অপরাধের জন্য অনুশোচনা করে এবং সেই অনুশোচনা অনু্যায়ী সদি তার ব্যাক্তিত্বে ইতিবাচক পরিবর্তন পুলিশ কর্মকর্তারা লক্ষ করে তখনই তাকে প্যারোলের আওতায় আনা হয়।
মানুষ মাত্রই ভুল করে, এবং সেই সুযোগ পেলে ভুল সংশোধনের জন্য চেষ্টাও করে।এই কথাটাকে যৌক্তিক মেনেই আদালত এই পদ্ধতি টা প্রণয়ন করে।আপনার শাস্তি ১২ বছর।অলরেডি ৪ বছর শেষ। তাই এই আবেদন টা করতে পেরেছি।আর তাছাড়াও এর আগে আপনার ব্যাপারে আইনী কোন মামলা পায় নি এবং জেলে থাকাকালীনো কোনো ত্রুটি বা বিশৃঙখলা খুজে পায় নি তাই মুক্তি পেয়েছেন। আর প্রত্যেক কারাগার থেকেই নির্দিষ্ট একটা সময়ে সকল আসামীর চারিত্রিক একটা সমীকরণ উপর মহলে যায়।আপনার মুক্তির ক্ষেত্রে সেটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আর আমি ভাবিনি যে এই কাজে সফল হবো।আপনাকে আমি আশাহত করতে চাই নি নেতামশাই।তাই বলি নি।শুধু শুধু মুক্তির আশা দেখিয়ে যদি সফল না হতাম তাহলে?তাই কাউকেই বলি নি
শেষের কথা গুলো ছলছল চোখে বললো স্পর্শীয়া।পরশ প্রাণখুলে হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো স্পর্শীকে। এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এই বুঝি পেছনে পুলিশরা দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে?
#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_৩৮
★★
নিরব হয়ে দুহাত দিয়ে পরশের বাহু আঁকড়ে ধরে তার কাধে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে স্পর্শী। দুরেই একটা ছোট্ট পরটার হোটেল।আলতো ভাবে পরশকে ছাড়িয়ে উঠলো সে।তারপর দোকানের দিকে ইশারা করে বললো-
আমার ও অনেক খিদে পেয়েছে নেতামশাই।চলুন,কিছু খেয়ে নেই।
পরশ কোনো বাক্যব্যয় করলো না।ধীর পায়ে স্পর্শীর সাথে পা মেলালো।এ যেন সে কোনো ঘোরের মধ্যে আছে।আদোও সে যে মুক্ত তা বিশ্বাস হচ্ছে না।হোটেলের মধ্যে ঢুকেই সেখানকার কিশোর ছেলেটার কাছে স্পর্শী বললো-
ছয়টা পরোটা,ভাজি আর দুটো ডিম দিয়ে যাও এই টেবিলে।
বেশ কিছুক্ষণ পর তাদের বলা খাবারগুলো নিয়ে এলো টেবিলে।তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিল পরশ।স্পর্শীও যেন আজ বহুবছর পর তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে।খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আলতো হাতে পরশের দাড়ি ধরে হেসে দিলো স্পর্শী।বললো-
ইশশ!একদম দাড়ি,গোফ,চুলে দাদা শ্বশুর-দাদা শ্বশুর লাগছে।তা বুড়ো মশাই,আপনার নাতি গুলো কোথায়?
পরশ হাসলো।সত্যিই চুল, দাড়ি-গোঁফ বড় হয়ে গেছে।চেয়ারের ফাঁক দিয়ে হাতটা কে গলিয়ে স্পর্শীর কোমড় চেপে ধরলো।শিউরে উঠলো স্পর্শী।পরশ তাকে আরেকটু কাছে নিয়ে নিচু স্বরে বললো-
আগে তো বাসায় যাই।তারপর না হয় প্রমাণ দেব আমি আদোও বুড়ো নাকি জোয়ান’ই আছি।
থরথর করে স্পর্শীর পুরো শরীর এক পরিচিত অনুভূতিতে দগ্ধ হয়ে কেপে উঠলো।এপাশ-ওপাশে তাকিয়ে আলতো স্বরে পরশকে বললো-
নেতামশাই,চলুন তো এখন।আগে সেলুনে যাব।তারপর বাসায় যাওয়া যাবে।
পরশ ছেড়ে দিলো।তারপর একটা রিক্সা নিয়ে চললো সামনের সেলুনে।পরশের দাড়ি কাটছে সেলুনের ছেলেটা।স্পর্শী পাশেই আয়নার দিকে তাকিয়ে পরশকে দেখছে।হঠাৎ ই উত্তেজিত কন্ঠে বললো-
এই না না।একদম ক্লিন সেইভ করবেন না।সামান্য দাড়ি রাখবেন।
দোকানদার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।পরশকে রেখেই পাশের বিরিয়ানির দোকানে গেল স্পর্শী।মাস প্রায় শেষের দিকে।বাসায় তেমন কোনো বাজার’ই নেই।এখন গিয়ে কে রান্না করবে?ভেবেই দু প্যাকেট বিরিয়ানি কিনে পুনরায় সেলুনে চলে এলো।তারপর পরশকে নিয়ে বাস ধরে ধরে চলে এলো বাসার সামনে।চারতলা বিল্ডিং।এর তিনতলাতেই স্পর্শী থাকে।পরশকে নিয়ে তিন তলায় উঠে ফ্লাটের সামনে এলো।চাবি দিয়ে খুলতেই দৃশ্যমান হলো সামনের অফিস রুমটা।ভারী ভারী মোটা বইয়ে ভর্তি আশেপাশের টেবিল।বেশ সাজানো -গোছানো অফিস পেরোতেই ভেতরের রুমে ঢুকলো স্পর্শীয়া।পেছনে পরশ ও গেলো।ভেতরে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলো।অফিস রুমে ঠিক যতটা আভিজাত্যপূর্ণ ভেতরের রুমটা ঠিক ততটাই সাদামাটা।রুমের এক কোনায় একটা পাটি বিছানো।তার উপরে পাতলা একটা চাদর আর বালিশ। কিছুটা দুরেই একটা র্যাক।আর তার পাশেই একটা টেবিল।
পরশ ভ্রু কুচকে স্পর্শীর দিকে তাকাতেই পাত্তা দিলো না সে।টাওয়াল হাতে ধরিয়ে ঠেলে বাথ্রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো-
যান তো।সেলুন থেকে এসেছেন দ্রুত গোসল করে নিন।
গতকালকেই পরশের মুক্তির আবেদন টি স্পর্শীর হাতে এসেছে।দেখামাত্রই মার্কেটে গিয়ে দুটো শার্ট,প্যান্ট নিয়ে এসেছে।গোসল করে বের হতেই সেগুলো ধরিয়ে দিয়ে নিজে গোসল করতে গেল।
মাথা মুছতে মুছতে স্পর্শী বাইরে বের হতেই পরশের থমথমে মুখের সামনে পড়লো।ভ্রু কুচকে তাকাতেই পরশ গম্ভীর কন্ঠে বললো-
এসব কি?
স্পর্শী কিছুটা বুঝলো।পরক্ষণেই অস্বীকার করে বললো-
কোথায় কি?
পরশ কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই থমথমে কন্ঠে বললো-
রুমে খাট নেই কেনো?কোনো আসবাব নেই কেন?রান্নাঘরে কোনো বাজার নেই কেনো?শুধুমাত্র দুটো ডিম আর আলু,ডাল পড়ে আছে।
স্পর্শী থমকালো।ভীষণ অসস্তিতে পড়লো৷ইনিয়ে-বিনিয়ে আলতো হেয়ালী করে বললো-
এ মা,রুমে আসতে পারেন নি,এর মধ্যেই গোয়েন্দা গিরি শুরু হয়ে গেল।চলুন এখানে বসুন।আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।একটু ঘূমাবো।
পরশকে একপ্রকার টেনে পাটির উপর শোয়ালো।তারপর আলতো ভাবে বুকের উপর মাথা দিয়ে ঝাপটে ধরলো স্পর্শীয়া।পরশ নিজেও জড়িয়ে ধরলো স্পর্শীকে।বেশ কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর পরশ বললো-
এরকম পাগলামী করার কি কোনো দরকার ছিলো পাখি?তুমি তো অবুজ নও।তাও এসব ছেলেমানুষী কেন?
আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলো স্পর্শী।এই যে নগ্ন বুকটায় আজ কত বছর পর নাক ঘষছে সে।এই পুরুষালী গন্ধ টা তো অক্সিজেনের থেকেও বেশী দরকার ছিলো তার কাছে।তাও আজ এতোবছর ধরে দুরত্বে ছিলো। ঠোট ভেঙে এলো স্পর্শীর।নিচু কন্ঠে ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল-
আমি পারতাম না নেতামশাই।কিভাবে পারতাম?আপনি ওই চার দেয়ালের মধ্যে ছোট্ট একটা পাটির উপর সারা শীত -গরম মিলিয়ে চার বছর কাটিয়েছেন।আপনাকে রেখে ওই নরম বিছানায় কিছুতেই আমার ঘুম আসতো না।ভালো-মন্দ কিছু খেতে গেলেই আপনার কথা মনে আসতো।দু-বেলা ওই আধপোড়া রুটি,এক বেলার ওই অসহ্য গরম ভাতের সাথে বিদঘুটে তরকারি কিভাবে খাচ্ছেন আপনি।আমার গলা দিয়ে কোনো ভালো খাবার একদম নামতো না নেতামশাই।প্লিজ এ বিষয়ে কোনো কথা বলবেন না।আমার সহ্য হয় না।ভীষণ কান্না পায়।আমি এতটাও বুঝদার হতে চাই না।চাই না।
কান্নার বেগ বেড়ে গেল স্পর্শীর।যেন বহুদিনের কষ্টকে উগড়ে দিচ্ছে পরশের সামনে।পরশ উত্তেজিত হয়ে গেলো।জোরে বুকের সাথে ঝাপটে ধরলো।বললো-
এভাবে কাদে না পাখি।আমি তো চলে এসেছি।প্লিজ থামো।
স্পর্শী থামলো না।হঠাৎ ই সেই কান্নাভেজা ঠোট দুটো আকড়ে ধরলো পরশ।হতভম্ব হয়ে গোল গোল হয়ে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।নিজেকে ছাড়াতে গেলেই আরো গভীরভাবে আকড়ে ধরলো পরশ।যেন আজ বহু বছরের তৃষ্ণা একসাথে মেটাচ্ছে।পরিচিত এই অনুভূতির থেকে অনেকদিন দুরত্বে রয়েছে দুজন।আজ সেই দুরত্ব ঘুচতেই মেতে উঠেছে অজানা সুধার ছোয়া নিতে।
পরশের বুকের উপর শুয়ে আছে স্পর্শী।পুরুষালী এই প্রশস্ত বুকটায় আজ বহুদিন পর আঙুল দিয়ে আঁকি বুকি করে সে।অনেকক্ষণ পর বললো-
আজকে সন্ধ্যায়’ই আমরা বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো।ওকে।আর এই ঢাকায় আসবো না।
পরশ অবাক হলো।বললো-
তাহলে তোমার ওকালতি কে করবে?
ব্যাস্ত কন্ঠেই স্পর্শী বললো-
সব বাদ।এইসব পেশায় আর নিজেকে জড়াবো না।এতোদিন ও তো থাকতাম না।শুধু আপনাকে ছাড়ানোর জন্য পড়ে রয়েছি।জানেন নেতামশাই,ভেবেছিলাম অন্য সবার মতো নয়।আমি নিজে সত্যের প্রতিষ্ঠা করবো।কিন্তু বিশ্বাস করুন এই ওকালতিতে সত্যের ভিত অনেক দুর্বল।আমি সত্যের উপর বিশ্বাস করেই এই পেশায় নেমেছিলাম।কিন্তু না, জীবনের প্রথম কেস টাতেই হারলাম।আমি আর এসব চাকরী-বাকরী কিচ্ছু করবো না।শখ মিটেছে আমার।এবার শুধুমাত্র সংসার করবো।শশুর -শাশুড়ীর সেবা করবো আর স্বামীকে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকবো।এসব পুলিশ-কেস,জেল-জরিমানা এসবে আর আমি নেই।
পরশ আলতো হাসলো।বললো-
মা কেমন আছে?ওদের কিছু জানিয়েছো?
নিমিষেই মুখে বিষাদ ছেয়ে গেল স্পর্শীর।বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল-
আমার কারো সাথে দেখা বা কথা হয় না নেতামশাই।সেই যে বাড়ি ছাড়লাম আর পিরোজপুরে পা রাখিনি।কিভাবেই বা রাখবো?মায়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না।বাবাও চুপচাপ থাকে। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছি আপনাকে না নিয়ে ও বাড়িতে আর ফিরবো না।তবে বাবা আর প্রেমার সাথে মাঝেমধ্যে কথা হয়।এই আপনি শুনেছেন না প্রেমা এইচএসসি তে গোল্ডেন পেয়েছে।
পরশ হাসলো। বললো-
হ্যা, আব্বু বলেছে।
দুজনের চোখে কোনো ঘুম নেই।একে একে মনের সকল কথাকে উগড়ে দিচ্ছে স্পর্শী।আর পরশ মুগ্ধ হয়ে তার তোতাপাখির কথা শ্রবণ করছে।
চলবে?