রাজনীতির রংমহল পর্ব-৪০+৪১

0
684

#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_৪০

ডুবন্ত বাস।চারদিকে মানুষের এলোমেলো পদচারণা।পরশ দ্রুতবেগে পাশের জানালার কাচ ভাঙলো।বেরিয়ে যেতেই স্পর্শীর কথা মনে হলো।পুনরায় বাসের ভেতর স্পর্শীকে খুজতে লাগলো।এক সময় মনে হলো সে ডুবন্ত বাসের মধ্যেও শ্বাস নিতে পারছে।পাত্তা দিলো না।চারদিকে স্পর্শীকে খুজতে লাগলো।হঠাৎ ‘ই কানে বাজলো প্রাণখোলা হাসির শব্দ।এই হাসির রিনিঝিনি সুর বাসের বাইরে থেকে আসছে।দ্রুত বাসের দরজা দিয়ে বাইরে বের হতেই দেখলো স্পর্শী রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পরশের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

অবাক হয়ে গেল পরশ।সেই সাথে যেন প্রাণ ফিরে পেল। দ্রুত ছুটে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিজের বুকের সাথে।এরইমধ্যে মাতাল করা কন্ঠের আওয়াজ কানে এলো।

-নেতামশাই,কি করছেন?আরে বাবা চ্যাপ্টা হয়ে যাবো তো।এতো জোরে কি কেউ জড়িয়ে ধরে।ছাড়ুন।

ঘুম ঘুম কন্ঠে জড়িয়ে যাওয়া গলায় স্পর্শী বললো।ধড়াস করে চোখ খুলে সামনে তাকালো পরশ।স্পর্শী তার বুকের ওপর এখনো শুয়ে হাসছে।দ্রুত তাকে ছেড়ে দিয়ে ধড়ফড় করে বসলো।আশে পাশে বারকয়েক তাকিয়ে জায়গাটা দেখে নিলো।এখানে না আছে কোনো বাস, আর নাতো রাস্তা।তাহলে কি সে এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলো?

দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো।হার্টবিট এখনো অস্বাভাবিক ভাবে চলছে।যতই দৃশ্যগুলো স্বপ্ন হোক, কিন্তু পরশ সেটাকে একদম মানতে পারছে না।পুনরায় দুহাত দিয়ে স্পর্শীকে জড়িয়ে ধরলো।দ্রুত শ্বাস নিয়ে বললো-

আমরা লঞ্চে যাব,ওকে পাখি।একদম বাসের কথা মনেই আনবে না।

স্পর্শী থমকালো।পরশকে এতোটা উত্তেজিত দেখে আগেই বুঝেছিলো সে কোনো খারাপ স্বপ্নে দেখেছে।কোনো রুপ বাকবিতন্ডায় না জড়িয়েই মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।

★★★
বিকাল সাড়ে তিনটা।ঘুম থেকে উঠেই দুজন মিলে বিরিয়ানি খেয়ে নিয়েছে।এরপর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে পা ফেললো পিরোজপুরের উদ্দেশ্যে। বাসে করে সদরঘাট আসতেই স্পর্শী আবারো দুটো বিরিয়ানির প্যাকেট নিলো।ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো লঞ্চের কাছে।

বিকেল সাড়ে চারটা।ইতোমধ্যে লঞ্চ চলতে শুরু করেছে।কেবিনের মধ্যে শুয়ে আছে পরশ।ধীর পায়ে তাকে পাশ কাটিয়ে স্পর্শী চলে এলো কেবিনের বাইরে।সামনের ঢালু জায়গাটায় শত শত লোক কাথা বিছিয়ে বসে আছে।তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে এলো লঞ্চের কার্ণিশে।দমকা বাতাসে গায়ের জামাকাপড় গুলো এদিক-সেদিক উড়ছে।আশে-পাশে ছোট ছোট নৌকাগুলোকে বেশ দারুন লাগছে দেখতে।এই ঠান্ডা বাতাসের সাথে প্রাণ খোলা দম নিয়ে আলতো হেসে উঠলো স্পর্শী।বহুদিন পর সে এমন প্রাণ খোলা হাসি হেসেছে।

হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ একজন আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো তাকে।স্পর্শী পিছু ফিরলো না।এই পুরুষালি গন্ধ টা তার বহু বছরের চেনা।এত দুরত্ব থাকার পরেও রাত হলে তার ব্যাবহার করা ঘামে জর্জরিত শার্ট টা বুকে নিয়ে শুয়েছে স্পর্শী।প্রতিটা ক্ষণ,প্রতিটা মুহুর্ত এই শ্যামপুরুষের অস্তিত্ব কে নিজের সাথে পরিচিত করেছে।সে কি করে ভুলবে এই গন্ধ?

পরশ আলতো হাসলো।মাথা নিচু করে সবার চোখের আড়ালে ঠোট ছুইয়ে দিলো স্পর্শীর কাধে।হিমশীতল বাতাসের ঝটকার মধ্যে এই চুমুটা স্পর্শীকে বরফশীতল করে দিলো।কেপে উঠলো সে।কিছুক্ষণ ওভাবেই জমে রইলো।বেশ কিছু মুহুর্ত পার হবার পর মুখ খুলে বললো-

নেতামশাই?

পরশ আধো কন্ঠে বললো-

হু,

-চলুন না ছাদে যাই।

দুজনের মধ্যেই কিছুক্ষণ নিরবতা কাজ করলো।শেষে পরশ বললো-

ভয় পাবে না তো?ছাদে অনেক বাতাস।

আলতো হাসলো স্পর্শী।লোমশ হাতটা দুহাত দিয়ে ধরে নিজের সামনে নিলো।পাতলা ঠোট দুটো আলতো ছুইয়ে বললো-

আপনি আছেন তো।

★★★

চারতলা লঞ্চ।চারদিকে শত শত যানবাহন চলছে।দূরত্বের সেই জলজ বাহন গুলোকে নৌকাসমতুল্য লাগছে স্পর্শীর কাছে।আচমকা হাতের ফোনটা সামনের একটা কিশোর ছেলেকে দিয়ে বললো –

একটা ছবি তোলো তো ভাইয়া।

ছেলেটা মুচকি হেসে ফোন নিলো।স্পর্শী পুনরায় লঞ্চের কার্ণিশে চলে এলো।পরশের হাতটাকে দুহাত দিয়ে পেচিয়ে বললো-

আজকের এই মুহুর্তে আপনি আমার জ্যাক হয়ে যান।আর আমি হই রোজ।চলুন না নেতামশাই এই ক্ষুদে লঞ্চ টাকে টাইটানিক বানিয়ে দিই।

তারপর কোনো কিছু না বলেই নিজের হাত দুটোকে দুদিকে মেলে দিলো স্পর্শী।পরশ আলতো হাসলো।আশে-পাশে প্রচুর জোয়ান ছেলে।অন্যসময় বাধ সাধলেও আজকে নিশ্চুপ রইলো।প্রিয়তমার এই হাসি হাসি মুখটাকে কিছুতেই বিলীন হতে দিতে চাইলো না।অধর মেলে নিজেও দুহাত ছড়িয়ে দিলো দুদিকে।সাথে সাথেই ফোনের স্ক্রিনে কয়েকবার ক্লিক পড়লো।

★★★★

ভোর চারটা।এখনো ফজরের আযান দেওয়া হয় নি।লঞ্চ থেকে নিজের চিরপরিচিত এলাকার মাটিতে পা রাখতেই ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে পড়লো পরশ।বহুবছর পর আজ সে তার পরিচিত এলাকায়।দুহাতে ব্যাগ নিয়ে স্পর্শীকে সামনে হেটে এলো বাজারের মধ্যে।এখনো চারদিকে অনেক অন্ধকার।এই সময়ে গাড়ি পাওয়া যাবে না বুঝেই দুজন মিলে পা বাড়ালো শিকদার মঞ্জিলের দিকে।টানা পনেরো মিনিট হাটার পরে নিজের পরিচিত বাড়িটার সামনে পৌছালো পরশ।মুহুর্তে ‘ই চোখ পড়লো গেটের বাম পাশের পারিবারিক গোরস্থানের দিকে।বুকটা খা খা করে উঠলো।

ইচ্ছে করলো ছুটে ওদিকটায় যেতে।এরইমধ্যে স্পর্শীর ক্লান্ত ঘুম-ঘুম চাহনি টা নজরে এলো।গেটের ভেতর থেকে তালা মারা।এদিকে ফোনের৷ চার্জ ও শেষ। আজ এতোদিন পর নেতামশাইকে কাছে পাবে, এই উত্তেজনায় ফোনে চার্জ দেওয়ার কথাই ভুলে গিয়েছিলো স্পর্শী।কিন্তু হার মানলো না।নিজের সেই পরিচিত ত্যাড়া প্রকৃতিতে মুহুর্তেই ফিরে এলো।হাতের যাবতীয় জিনিস পত্র নিচে রেখে পরশের দিকে তাকিয়ে দাত কেলিয়ে হাসলো।

তারপর চারদিকে তাকিয়ে একটা ইটের অর্ধ টুকরো হাতে নিলো।লোহার রডের ভেতর হাত গলিয়ে গায়ের সমস্ত জোড় দিয়ে চারবার বাড়ি মারলো তালার উপরে।নিঝুম ভোরবেলায় শব্দগুলো যেন ভয়ংকর আওয়াজ তুললো।

পরশ উত্তেজিত হয়ে জিভ কেটে স্পর্শীকে বলল-

এই এই ছাড়ো।কি করছো এসব।স্পর্শীয়া ছাড়ো।

স্পর্শী শুনলো না।পুনরায় ভাঙা তালাটাকে খুলতে খুলতে দাত কেলিয়ে পরশকে বললো-

শ্বশুর বাড়িতে প্রথম বারের জন্য ডাকাতি করতে নেমেছি।তালা না ভাঙলে কি ডাকাত ডাকাত ফিলিংস আসবে নেতামশাই?

পরক্ষণেই হেসে বাচ্চামো কন্ঠে বললো-

একটা জিনিস খেয়াল করেছেন নেতামশাই?আমরাই হলাম প্রথম ডাকাত।যারা ব্যাগপত্র সাথে নিয়ে ডাকাতি করতে নেমেছি।ব্যাপার’টা কি দারুন,তাই না?

চলবে?

#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_৪১

সকাল বারোটা।রৌদ্রজ্জ্বল এই দিনে শিকদার বাড়ির মেহমান খানা জনে জনে ভর্তি।দফায় দফায় লোক আসছে,হাসি-তামাশা করছে,কেউ কেউ দোয়া করছে আর নাস্তা খেয়ে চলে যাচ্ছে।বিভিন্ন রাজনৈতিক বড় বড় নেতারা পরশকে মুক্তির শুভেচ্ছা জানাতে একে একে আসছে।হাপিয়ে উঠেছে স্পর্শী।রুমের এ কোনা থেকে ও কোনায় যাচ্ছে তো আবার এসে খাটে বসছে।এক হাত দিয়ে অন্য হাতের আঙুল গুলো মুচড়ে পুনরায় নিচে উকি দিলো।এখনো কয়েক জন বসে আছে নিচে।মেজাজ বিগড়ে গেল তার।

আজ এতোদিন ধরে এত কষ্ট করে তার জামাই টাকে ছাড়িয়ে আনলো অথচ এরা তাকে ধারে কাছে ঘেষঁতেই দিচ্ছে না।পরশ কে নিয়েই মেতে উঠেছে সকলে।স্পর্শী যেন বাতিলের খাতায়।এই যে এখন স্পর্শির মন চাইছে তার নেতামশাই কে নিয়ে নাক টেনে একটা ঘুম দিবে।এটা কি তারা মোটেও বুঝতে পারছে না।ধুর!মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করে থমথম পায়ে ছাদের দিকে গেল।সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই প্রেমার দেখা পায়।এক কানে ফোন চেপে ধরে আরেক হাত দিয়ে ছাদের আমগাছ টার পাতা ছিড়ছে।মাঝে-মধ্যে টোল পড়া গালটা হাসি দিয়ে প্রেমিককে পাগল করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।আলতো পায়ে প্রেমার পাশে দাড়ালো স্পর্শি।

তার অস্তিত্ব পেতেই চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললো প্রেমা।কান থেকে ফোন নামিয়ে বুকের উপর বার কয়েক ফু দিলো প্রেমা।ভয়জড়ানো কন্ঠে বললো-

বাব্বাহ,তুমি।আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।আরেকটু হলেই হার্ট-ফেইল করতাম।

ভ্রু কুচকে ফেললো স্পর্শী।সন্দেহজনক চোখে তাকিয়ে হেয়ালি করে বললো-

কেন গো?তুমি কি প্রিতম কে ভেবেছিলে নাকি?

মাথানিচু করে ফেললো প্রেমা।আলতো হেসে বললো-

হ্যা,সেরকমই।ওই উনি বলছিলেন এক্ষুনি এদিকে আসবে।এরইমধ্যে পেছনে তোমার উপস্থিতি পেতেই ভয় পেয়ে গেছিলাম।

ঠোট কামড়ে হাসলো স্পর্শী।তারপর ইয়ার্কির সুরে বললো-

এক্ষুনি এতো আসা-যাওয়ার ব্যাবস্থা করো না।পরে দেখবে চুমু -টুমু দেওয়ার আর ইন্টারেস্ট থাকবে না।পুরানো লাগবে।

থেমে,

এই দেখো,তোমার ভাইকে ছাড়িয়ে আনলাম আমি।অথচ জনাব বসে আছেন তার পলিটিশিয়ান বন্ধু-বান্ধবদের সাথে।অন্তত একবার তো আসতেই পারতো রুমে।

ফিক করে হেসে দিলো প্রেমা।ইয়ার্কির সুরে বললো-

তো কি করবে?তোমাদের তো অলরেডি বিয়ের চার বছর শেষ। এখনো কি নতুন আছো নাকি?এখন তো একটু আদর কম পাবেই। ধীরে ধীরে আরো কমবে।

চোখ দুটো ছোট ছোট করে ফেললো স্পর্শী।সামনের ছোট চুল গুলো এক ঝটকায় পেছনে নিয়ে বললো-

এক্সকিউজ মি মিস ননদিনী। তোমার ওই আনরোমান্টিক ভাইয়ের সাথে মাত্র পাঁচ দিনের সংসার করেছি আমি।বুঝেছো?
থেমে,

সে যাই হোক,নিচে গিয়ে তোমার ভাইকে বলবে”ভাবির ভালো লাগছে না।ওকে”

প্রেমা আলতো হেসে সিড়িতে নামলো।এরইমধ্যে নিচ থেকে পরশ উপরে উঠলো।প্রেমাকে দেখতেই ঠোট এলিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

তোর ভাবি কোথায় বুনু?

পেছনে তাকিয়ে হাসলো প্রেমা।তারপর বললো-

ছাদের ও কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।ওর নাকি একটুও ভালো লাগছে না।বোরিং লাগছে।ভাইয়া,তুমি বরং ভাবিকে আবার একটা বিয়ে দিয়ে দাও।

বলেও হেসে নিচে চলে গেল।

দ্রুতপায়ে উপরে উঠলো পরশ।স্পর্শী বাম ভ্রু কুচকে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।পরশ পাশে গিয়ে দাড়াতেই অন্যদিকে তাকালো।

–প্রেমা অনেকটা চেঞ্জ হয়ে গেছে।তাই না?

প্রশ্নটা শুনেই পরশের দিকে তাকালো স্পর্শী।তারপর মাথা ঝুলিয়ে বললো-

হ্যা,অনেক চেঞ্জ। আগে কেমন গোমড়া হয়ে থাকতো।আর এখন ভালোই চঞ্চল হয়েছে।যা বুঝলাম,প্রিতমের কপালে দুঃখ আছে।বেশ নাকানি-চুবানি খাওয়াবে আমার ননদিনী।

দুহাত দিয়ে পেচিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো পরশ।স্পর্শী কোনো সাড়া দিলো না।পুনরায় তার পিঠে নাক ঘষেঁ পরশ বললো-

হ্যা,একদম।তোমার মতোই।

মুহুর্তেই ছিটকে দূরে সরে গেল স্পর্শী।ভ্রু কুচকে বললো-

আমার মতো মানে?আমি আপনাকে নাকানিচুবানি খাওয়াই?
থেমে,

ওহহো।এখন তো বলবেন’ই।শীত গেলে তো গায়ের কাঁথা পায়ের তলায় থাকে।এখন তো আমি খারাপ,পুরানো কতকিছু হয়ে গেছি।

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল পরশ।পুনরায় স্পর্শিকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই ছিটকে দাড়ালো স্পর্শী।অভিমানী গলায় বললো-

ছাড়ুন।এখন একদম প্রেম উপচে পড়ছে।আর এতোক্ষন তো ভালোই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন।তখন আমার কথা মনে হয় নি?যান এখান থেকে।

পরশ মানলো না।জোর করে জড়িয়ে ধরে পড়ে থাকলো।মুখ ডুবিয়ে দিলো স্পর্শীর ঘাড়ে।মুহুর্তেই জমে গেল স্পর্শী।সারা শরীর যেন ঝিম ধরে গেল তার।বহু বছরের দূরত্ব ঘুচিয়ে নিলো দুজনে।পরশের বুকের মধ্যে মাথা দিয়ে ছোট্ট বিড়াল ছানার মতো পড়ে রইলো।আধো গলায় বললো-

আগামী এক ঘন্টা আমার।আগুন লাগলেও যেতে দিব না।আমি এভাবেই জড়িয়ে ধরে থাকবো।ওকে নেতামশাই।

শব্দহীন হাসলো পরশ।মাথা নাড়িয়ে আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলো স্পর্শীকে।






বিকাল চারটা।ড্রয়িংরুমে বসে আছে সবাই।প্রেমা ফোন স্ক্রল করছে।স্পর্শী শিঙারা বানিয়ে আনতেই চঞ্চল চিত্তে ঝাপিয়ে পড়লো তার উপর।এরইমধ্যে মহীউদ্দীন শিকদার ফোন হাতে এগিয়ে এলেন ড্রয়িংরুমে।সোফায় বসে পরশের উদ্দেশ্যে বললো-

দেখো তো কি কান্ড।এবারে কি করবো আমি?

ভ্রু কুচকে ফেললো পরশ।বললো-

কি হয়েছে আব্বু?

মহীউদ্দীন শিকদার দম নিলেন।বললেন-

ওই প্রিতমের বাবা আবারো ফোন দিয়েছে।তুমি যে ছাড়া পেয়েছো সেটাও জেনেছে।এখন ওরা তাড়াতাড়ি ‘ই বিয়েটা সারতে চাইছে।বলছে কালকে এসে আংটি পড়িয়ে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে যাবে।এবার আমি কি বলি বলো তো?

নিজের বিয়ের কথা শুনতেই মিইয়ে গেল প্রেমা।দুহাত ভরে চার টা শিঙারা হাতে নিয়ে আস্তে করে কেটে পড়লো সেখান থেকে।মুখ তার খুশিতে উপচে পড়ছে।পরশ পুরোটাই খেয়াল করলো।বাবার উদ্দেশ্যে বললো-

ওনাদেরকে আসতে বলো।আমি আছি তো।সামলে নেব সবকিছু।

সারা সন্ধ্যা লিস্ট করে সে অনুযায়ী বাজার আনালো স্পর্শী আর পিয়াশা।সকালেই ও বাড়ি থেকে আসবে সবাই।সমস্ত যোগান নিয়েই সব কিছু সামলে রুমে ঢুকলো স্পর্শী।পরশ চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে।স্পর্শী আলতো করে দরজা আটকে শুয়ে পড়লো তার পাশে।পরশ ঘুমিয়ে আছে ভেবেই মাথা ভর্তি দুষ্টুমিরা হাজির হলো।হাটু গেড়ে পরশের বুকের উপর বসে অনর্গল চুমু দিতে লাগলো যতক্ষণ না পরশের ঘুম ভাঙে।

অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারলো না পরশ।ভেবেছিলো শেষ অবধি স্পর্শী কি করে সেটা দেখবে?কিন্তু এরইমধ্যে পেট ফাটানো হাসিতে মেতে উঠলো।

বিরক্ত হয়ে পরশের গায়ের উপর থেকে স্পর্শী উঠলো।পরক্ষণেই ফোস করে বললো-

আর কতক্ষণ চুপ করে থাকা যেত না।মেয়েদের মতো এতো লাফাচ্ছেন কেন?আনরোমান্টিক বুড়ো।আমার রোমান্টিকতার বারোটা বাজিয়ে দিলো।ধুর!সবে মাত্র আড়াই মিনিট হয়েছে।মুড টাই নষ্ট হয়ে গেল।

বলেই পাশে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো স্পর্শী।পরশ কাত হয়ে স্পর্শীকে জড়িয়ে ধরলো।কানের কাছে মুখ নিয়ে আলতো করে বললো-

তাই?তোমার মুড শেষ। কিন্তু আমার মুড টো সবে ঠিক হয়েছে।এই মুহুর্তে আমি রোমান্টিক মুডে চলে এসেছি।মিসেস শিকদার,আপনি বরং কালকে নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন।আজকের রাত টা আমার লাগবে।কোনো বাহানায় কাজ হবে না।

বলেই কানের লতি ছুয়ে দিলো।চোখ বন্ধ করে নিলো স্পর্শীয়া।ধীরেধীরে মেতে উঠলো এক পরিচিত সুখানুভূতি তে।আলতো করে চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়লো সুখের অশ্রু।চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললো-

খোদা,আমার আর কোনো পরিক্ষা নিও না।এর থেকে জানটা নিয়ে নিও।আমি আর পারবো না সহ্য করতে।

ভোরের আলো ফুটতেই চোখ খুললো স্পর্শী।এতোক্ষণ না ঘুমালেও আবেশে চোখ বুঝে ছিলো। আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই পুনরায় ঝাপটে ধরলো পরশ।স্পর্শীর গলায় নাক ঘঁষতে ঘঁষতে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো-

গুড মর্নিং পাখি।

স্পর্শী আলতো হাসলো।তারপর পরশের কন্ঠনালি তে ঠোঁট ছুইয়ে বললো-

গুড মর্নিং।

ওভাবেই প্রায় পাচ মিনিট দুজন দুজনার শরীরের সাথে লেপ্টে রইলো।কিছুক্ষণ পর স্পর্শী উঠতে গেলেই পরশ বাধা দেয়।আধো কন্ঠে বলে-

উহুম,এখন না।আরেকটু ঘুমাই প্লিজ।

স্পর্শী নড়েচড়ে উঠে পরশ কে ছাড়ানোর প্রয়াস করে বললো-

ধ্যাত!ছাড়ুন তো।আপনার ঘুম পেলে ঘুমিয়ে থাকুন।আমায় বাধা দিচ্ছেন কেন?অনেক কাজ আছে আমার।ছাড়ুন তোওও।

–উহুম একদম না।তুমি গেলে আর ঘুম হবে না।আরেকটু থাকো প্লিজ।আমি ঘুমিয়ে গেলে উঠে যেও।ওকে সোনা।

স্পর্শী আর কিচ্ছু বললো না।হাল ছেড়ে পরশের বুকের মধ্যে ওভাবেই মিইয়ে রইলো।

সকাল আট টা।রান্নাঘরে বসে সমস্ত ফল থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল নাস্তা সুন্দর করে সাজাচ্ছে স্পর্শী।এই তো মাত্রই ও বাড়ি থেকে পাঁচজন লোক এসেছে।প্রিতমের মা,বোন আর ফুপি এবং ছেলেদের মধ্যে প্রিতম আর ওর বাবা এসেছে।তাদের সামনের সোফায় বেশ দাম্ভিকতার সাথে বসে আছে পরশ।পাশেই আলতাফ শিকদার এবং মহীউদ্দীন শিকদার। সোফার পেছনে পরশের কাকি এবং পিয়াশা দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করছেন।এরইমধ্যে নাস্তা হাতে ড্রয়িংরুমে গেলো স্পর্শী।পরনে টপ্স এবং জিন্স।আর মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকা।

মুখে হাসি ফুটিয়ে নাস্তাগুলো রেখে প্রেমাকে আনতে গেল স্পর্শী।তাকে আগে থেকেই শাড়ি পড়িয়ে রেখে এসেছে সে।একপাশ থেকে আগলে ধরে পরশের পাশে বসালো।মেয়ে তাদের আগে থেকেই পছন্দ।তাই কোনোরুপ বাকবিতন্ডা না করেই আংটি পড়িয়ে দিলেন প্রিতমের মা।আংটি পড়ানো মাত্রই প্রেমা লজ্জায় হাসফাস করতে লাগলো।স্পর্শী বুঝতে পেরেই সেখান থেকে রুমে দিয়ে আসলো তাকে।

প্রেমাকে রুমে দিয়ে নিচে নামতেই ভ্রু কুচকে এলো স্পর্শীর।প্রিতমের ছোট বোন কতক্ষণ পর পর পরশের দিকে তাকাচ্ছে।মুখে লজ্জালু হাসি।পাত্তা দিলো না স্পর্শী।তার হ্যান্ডসাম বর টাকে তো যে কোনো মেয়ে দেখলেই ফিদা হয়ে যাবে।এটা নরমাল ব্যাপার।তাই ঘটনা টাকে বাতিলের খাতায় ফেলে পরশের পাশে দাড়ালো।কিন্তু সময় গড়াতেই অস্থির হয়ে পড়লো স্পর্শী।হুট করেই এই চাহনি টাকে সহ্য করতে পারছে না সে।ইশারা করে সবার অগোচরে পরশকে বললো রুমে যেতে।প্রথমে অবাক হলেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে ভেবেই পরশ সেখান থেকে উঠে রুমের উদ্দেশ্যে ঢুকলো।

আলতাফ শিকদার প্রিতম ও তার বাবাকে নিয়ে বাড়ির আসপাশ ঘুরতে গেলেন।সঙ্গে মহীউদ্দীন শিকদার ও গেলেন।ড্রয়িংরুম জুড়ে পিনপিনে নিরবতা।ওপাশের সোফায় প্রিতমের মা, বোন আর ফুফি।আর এপাশে পিয়াশা এবং পরশের চাচি বসা।তাদের খাওয়া শেষে ই নাস্তার ট্রে নিয়ে রান্নাঘরে গেল স্পর্শী।

“ভাবি,তা ছেলেটাতো এতোদিন পরে ছাড়া পেলো।শ্বশুরবাড়ির শত্রুতার মুখে পড়ে কি কষ্টটাই না করলো।তা এবার ওইসব বাদ দিয়ে বিয়ে দিয়ে দিন।দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।আর ওইসব শত্রুতার মধ্যে ঢুকবেন না।কি লক্ষী ছেলে।

নাস্তার ট্রে রেখে ড্রয়িং রুমে আসতেই পুরো কথাটা স্পষ্ট কানে গেলো স্পর্শীর।তাদের কে আপ্যায়ন করার জন্যই পুরো টা সময় ব্যস্ত ছিলো সে।এই রান্নাঘর তো এই প্রেমার ঘর। এমন অবস্থায় তার সাথে কেউ পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় পায় নি।মুখে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি ফুটলো স্পর্শীর।পিয়াশা অসস্তিতে পড়লেন। একসময় রাগ/অভিমানের বশবর্তী হয়েই প্রিতমের মা কে বলেছিলেন ” বড় ছেলের শশুর বাড়ির শত্রুতার জন্য ছেলে জেলে।তার মেয়ে এবং ছোট ছেলের ও এই অবস্থা।স্পর্শীর কথা জানতে চাওয়ায় বলেছিলেন”সে মেয়ে নিজের লেখাপড়া নিয়ে ব্যাস্ত।তার রেশ ধরেই প্রিতমের মা বলেছিলেন ছেলেকে আর ও সম্পর্কে না জড়াতে।কিন্তু হুট করে সবার সামনে এমন প্রস্তাব রাখবে সেতা সে ক্ষুনাক্ষরেও বুঝতে পারে নি।

পরশের চাচি স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে পুনরায় পিয়াসার দিকে চাইলেন।চাঞ্চল্য চিত্ত এই নারী এখন স্পর্শীর থেকে ঘটানো একটা বিস্ফোরণের আশা রেখেই চুপ করে রইলেন।কিন্তু উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্পর্শী ধীর পায়ে প্রিতমের মায়ের কাছে বসলো।আলতো হেসে বলল-

হ্যা,আন্টি।এবারে সত্যিই ওনার একটা বিয়ে দেওয়া উচিত।ভালো একটা মেয়েও খুজছি।খুঁজে পেলেই বিয়েটা দিয়ে দিবো।কি বলেন?

প্রিতমের মা যেন আহ্লাদে মেতে উঠলেন।ইনিয়েবিনিয়ে বলে উঠলেন-

আমার তানিয়ার তো ছোট বয়সেই বিয়ে দিলাম।এই তো একুশ বছর বয়স মাত্র।ছেলেটা তো নেশাখোর ছিল।তাই এ বছরই ডিভোর্স টা করালাম।

থেমে,

আমার মেয়েটা অনেক লক্ষী।পরশ বাবার সাথে খারাপ মানাবে না ওকে।ভালোই হবে, সম্পর্ক টা আরো গভীর হবে।ঠিক বলি নি ভাবি?

চলবে?