আমি মায়াবতী পর্ব-২৪+২৫

0
365

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_২৪
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

দুনিয়াতে সবচেয়ে মিষ্টি সম্পর্ক হচ্ছে ভাই-বোনের সম্পর্ক। সেটা আজ মায়া নিজে ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে। তারা প্রায় ১ দিন ধরে এখানে এসেছে। কিন্তু তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে এভাবে কেউ আবেগ আপ্লূত হয়ে কান্না করেনি। যে মহিলাটি তার বাবাকে জড়িয়ে কান্না করছে, সে তার বাবার বোন। তার একমাত্র ফুপি। সে বারবার প্রশ্ন করছে,”মিয়াভাই, আমি তো চুড়ি চাইনাই তোমার কাছে সেদিন। তুমি তাও কিসের জন্য চুড়ি আনতে গেছিলা। কও তো আমারে? আর আজ ২৬ বছর পর বাড়ি আইলা। সেইদিন আব্বায় তোমারে মারলো আর কইলো আর যেন না আসো বাড়ি। তুমি রাগ কইরা নিজের বোঁচকা নিয়ে নদীর দিকে গেলা। আমি পিছে পিছে গেলে কইলা আমার জন্য চুড়ি নিয়া আইবা। কই? আনোনাই চুড়ি মিয়াভাই? মিয়াভাই আমার কথা তোমার মনে পড়ে নাই? আমি কতদিন তোমার জন্য নদীর পাড়ে খারায়া রইলাম। আব্বায় কত তালাশ করলো তোমারে। তোমারে পাইলো না। কই আছিলা তুমি মিয়াভাই?”
মায়া অবাক হয়ে দেখলো তার বাবা আজ কান্না করছে তার আদরের ছোটো বোন কে জড়িয়ে। যেন এর অপেক্ষাতেই সে ছিল। কোনো একজন আপন মানুষ এসে বলবে, এতোদিন কই ছিলে তুমি? আমার কথা মনে পড়ে নাই? মায়া নিজের বাবার সাথে এখনও সম্পুর্ণ ভাবে মিশে উঠতে পারেনি। হয়তো শৈশব বা কৈশোর কোনোটাতেই বাবাকে কাছে পায়নি বলে। তাই আজও তার সাথে কথা বলতে গেলে কিছুটা জড়তা আসে। সেই বাবা আজ তার সামনে কতটা অসহায় ভাবে আছে। মায়ার বাবার জন্য ভীষণ করুনা হলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে সৃষ্টিকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,”আমাদের জীবনটা এমন করে কেন বানালে গো? আমাদের আর কত প্রজন্ম এই মানষিক কষ্ট সহ্য করবে?”
★★★
মায়ার ফুপি এসেই রান্নাঘরে ঢুকে গেছে। এমনিতে এই পরিবারে তার কোনো মূল্য নেই। ভাইয়ের বউদের কাছে সে ন্যূনতম পাত্তাও পায়না। ভায়েরা চাইলেও কিছু করতে পারে না। তারা তো বউদের গোলাম বলতে গেলে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা। আজকে তার ২ ভাইয়ের বউই তাকে মূল্য দিচ্ছে। আর দিবে নাই বা কেন? আজকের সব বাজার তো তার মিয়াভাই করেছে। তার মাও তার সাথে সাথে হাত লাগাচ্ছে। এখানে এসে মায়ের সাথে একবারও কথা বলেনি সে। কিছুক্ষণ পরপর তার বাবা এসে বলছে রান্নাবান্না কতদূর। বাচ্চারা অপেক্ষা করে আছে খাবারের জন্য। হঠাৎ রিজভী এসে বললো,”রিতু।”
“হ্যা মিয়াভাই?”
“একটু বাইরে আয় তো। তোর সাথে একটু কথা ছিল।”
“ভাই আমার তো কাজ আছে। মা তো একা সব করতে পারবে না। ”
“আরেহ, আয় না একটু।”
রিতু বের হয়ে আসে রিজভীর সাথে। রিজভী সাগরিকাকে বলে রান্নাঘরে যেতে। যাতে শাশুড়ীকে একটু সাহায্য করতে পারে সে। সাগরিকা বের হয়ে গেলে রিজভী রিতুকে জিজ্ঞেস করলো,”তোর স্বামী মারা গেছে কত বছর হলো?”
রিতুর চোখে পানি এসে গেল। মাথা নিচু করে বললো,”১৪বছর মিয়াভাই।”
রিজভী কঠিন মুখে প্রশ্ন করে,”তোরে বিয়ে দিছে কবে?”
“যখন আমার বয়স ১৩ বছর তখন।”
“তোর মেয়ের বয়স কত?”
“১৫ বছর।”
রিজভী ধপ করে বসে পড়লো মাথায় হাত দিয়ে। নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। সে কেন আরো আগে আসেনি।
“তোর সংসার চলে কিভাবে?”
“কিভাবে আর চলবে মিয়াভাই? পরের বাড়ি কাজ করে। স্বামী মরার পর তো শ্বশুর বাড়ি কি আর থাকে? এখানেতো আর আমার কোনো অধিকার নেই। বাবার বাড়িতে তো মেয়েদের বিয়ের পর আর কোনো অধিকার থাকে না। তাই শ্বশুরবাড়িই থাকি। নিজের ভাসুর আর দেবরের বউদের গোলামি খাটি। তাদের ছেলেমেয়েদের ২৪ ঘন্টার কাজের বুয়া আমি আর আমার মেয়ে।”
“তোকে এতো কমবয়সে বিয়ে কে দিয়েছিল?”
“কে আবার? আমার মা। আমার জন্মদায়িনী মা। টাকার লোভে আমাকে বড় বাড়ির বউ করে পাঠালো। এখন সেই বড় বাড়ির বড় বড় কাজগুলোতো আমাকেই করতে হয়। মায়ের সাথে কথা বলিনা বেশি জানো তো? আমাকে এই বাড়িতে রাখলে কি এমন হতো বলতো মিয়াভাই? তার তো কত দাপট ছিল। তোমাকে বাড়িছাড়া করলো, বাপের কথার উপরে আমাকে বিয়ে দিল। এখন কই গেল সব দাপট? এখন তো ছেলের বউদের মুখের উপর কোনো কথাই বলতে পারে না। অবশ্য এখন তাকে তো আর দোষ দিয়ে লাভ নেই। সে তো এখন ছেলে -বৌয়ের সংসারের আশ্রিতা মাত্র। তাও আবার পেটভাতায়। বুড়ো-বুড়ি দুজন দুই ছেলের সাথে খায়। বুড়িটার গতরে এখনও জোর আছে, তাই তার কিছুটা কদর ও আছে। বুড়ো বাপটার তো কোনো শক্তিই নেই এখন আর। তার না আছে কোনো দাপট না আছে কদর।” বলেই একটু মুচকি হাসলো রিতু।
“তুই রান্নাঘরে যা রিতু। আর শোন, তোর ভাবিকে পাঠিয়ে দিস।”
রিতু চলে গেলে রিজভী রুম অন্ধকার করে একা ঘরে শুয়ে পড়ে। তার মাথাটা ভীষণ ধরেছে। এইসময় তার পাশে তার সাগরিকাকে চাই। সে অনুভব করতে পারে কেউ একজন দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে। ধীরে ধীরে তার শিয়রে এসে দাঁড়ায়। রিজভী অপেক্ষা করে কখন একটা হাত তার কপাল স্পর্শ করবে। রিজভীর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সত্যি সত্যিই একটা হাত তার কপাল এসে ছোয়। রিজভী চোখ না খুলেই বলে,”সাগরিকা।”
“হুমম। ”
“তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো, তুমি কি দিবে?”
“কি চাই আপনার সাহেব?”
“আমার বোনকে কি আমাদের বাসায় রাখতে অনুমতি দিবে? ওর মেয়েকে? আমার বাবাকে? আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে চাই। এতদিন দূরে থেকে আমি শুধু আমার ইগোকেই দেখেছি। আমার অভিমানের মূল্য দিয়েছি। আমি কল্পনাতেও ভাবিনি যে আমার বোনের সাথেও ছোট মা এমন করবে। রাখতে দিবে তুমি ওকে আমাদের বাসায়?”
সাগরিকা রিজভীর কপাল থেকে হাত নামিয়ে নেয়। রিজভীর মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়। সাগরিকা কি না করবে তাকে? কিন্তু সাগরিকা বলে,”আমার খুব স্বপ্ন ছিল একটা পরিপূর্ণ সংসারে বউ হয়ে যাবো। শ্বশুর শাশুড়ী, ননদ, দেবর, ভাসুর, জা দের নিয়ে থাকবো। কিন্তু তোমাকে ভালোবেসে কোনো কিছুই পূরণ হয়নি। তবে, এইবার মনে হচ্ছে হবে। আমরা অবশ্যই ওদেরকে নিয়ে যাবো। রিজা কে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব।”
“আমার নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে। দেখেছো?”
“হুমম। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে তোমার বোন। তাইনা?”
“হুমম। অনেক ভালোবাসে। এই বাড়িতে একজন মানুষই ছিল যে আমাকে ভালোবাসতো। এখনো ভালোবাসে। আমি ঠিক করেছি ওকে আবার বিয়ে দিব। কতই বা বয়স এখন ওর? সারাজীবন কি আর একা একা থাকতে পারবে ও?”
সাগরিকা হাসলো। হেসে বললো,”তোমাদের পুরুষদের কাছে বউ মরে গেলে দ্বিতীয় বিয়ে করা যতোটা সহজ, মেয়েদের কাছে তার থেকেও অনেক কঠিন। ও সহজে রাজি হবে না। তাছাড়া রিজা এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। ও বিষয়টা কিভাবে নিবে ভেবেছো?ওর একটা সুস্থ পরিবেশে বেড়ে উঠা হবে না। বাবা তো নেই। মা থাকতেই নাই হয়ে যাবে। তবে, আমিও খুব করে চাইবো, যাতে রিতু তার জীবন আবার নতুন করে শুরু করতে পারে।”
সাগরিকা চলে গেলে রিজভী আবার অন্ধকার রুমে শুয়ে পড়ে। জীবনটা আবার কেমন অগোছালো লাগছে তার। সে তো নিজের জীবনটা সুন্দরভাবেই গুছিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এদিকে তার বাবা আর বোন কি কষ্টেই না দিন কাটাচ্ছে। নিজেকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হচ্ছে তার। সবাই তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু সেও তো তার কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। সেও তো সবাইকে সবার মতো করে দূরে সরিয়েই রেখেছে। তাহলে তার আর তাদের মধ্যে পার্থক্য কি আছে?
★★★
“মায়া আপু, তোমার চুলগুলো তো খুব সুন্দর৷ তুমি কি তোমার চুলের অনেক বেশি যত্ন করো?” রিনরিনে গলায় বলে রিজা।
“আরেহ, নাহ। আমার চুল এমনিতেই এইরকম।”
সাবিহা রিজাকে প্রশ্ন করে, “তোমাদের বাড়ি কোথায় রিজা আপু? সবাই তো সকাল সকাল আমাদের দেখতে আসলো। তোমরা এতো দেরি করলে কেন? তুমি দুপুরে আসলে দেখতে আমরা কি মজা করে গোসল করেছি পুকুরে। ”
“আমাদের বাড়ি এই গ্রামের পরের গ্রামের পরের গ্রাম। ”
“তাহলে এতো দেরি হলো কেন তোমাদের?”
“আমরা তো হেটে এসেছি। তাই আমাদের দেরি হয়েছে। ”
“তোমরা হেটে আসলে কেন?”
সাবিহার করা প্রশ্নের জবাব রিজা দেয় না। সে চুপ করে থাকে। কি জবাব দিবে সে?সে কি বলবে, তার মায়ের কাছে টাকা নেই তাই তার মা আর সে হেঁটে হেঁটেই এসেছে। প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য মায়া বলে,” জানো রিজা, আমরা এই প্রথম গ্রামে আসলাম। এর আগে আমরা কখনোই গ্রামে আসিনি। তুমি কি আমাদের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাতে পারবে?”
“আচ্ছা, দেখাবো। অবশ্যই দেখাবো। কালকেই আমরা ঘুরতে বের হবো।”
“কিন্তু তোমার স্কুল মিস হবে না? তুমি স্কুলে যাবে না?”
মায়ার করা এমন প্রশ্নেও রিজা চুপ করে থাকে। কি বলবে সে? তার কি এই নতুন পরিচয় হওয়া মেয়েদেরকে বলা উচিত হবে, সে স্কুলে যায় শুধু পরীক্ষা দিতে? তার বড় কাকার মেয়ের ব্যবহার করা পুরোনো জামা কাপড় পড়েই সে বড় হচ্ছে। তাদের নিদারুণ নিষ্ঠুর দুঃখ কষ্টের কথা কি তাদের বলা উচিত হবে? তারা তো এখানে এসেছে আনন্দ করতে। সেখানে এইসব অর্থহীন কথা বলে তার কি উচিত হবে তাদের আনন্দ মাটি করা? আর বললেই বা কি হবে? এই নতুন পরিচয় হওয়া মেয়েরা কি পারবে, তার ভাগ্যকে একচুল পরিমাণ পরিবর্তন করতে?
★★★
“মামা কল দিয়েছিল কবিতা। তোকে যেতে বলেছে। তুই কি যাবি? তোর কিন্তু যাওয়া উচিত হবে।”
“কেন যাবো আমি? ঐটা কি আমার নানাবাড়ি? মানুষ গরমের ছুটিতে নানা বাড়ি যায়। আর আমি যাব আমার দাদাবাড়ি? আমার কি লজ্জা শরম নেই? যেখানে আমার কোনো মূল্য নেই সেখানে আমি কেন যাবো?”
“তোর বাবা তোকে যেতে বলেছে।”
“তোর বাবাই আমার বাবা। আমার একটাই বাবা। কেন? এখন কি আমাকে তোর বাবার ভাগ দিতে কষ্ট হচ্ছে?হলেও আমার কিছু করার নেই। যেটা দিয়েছিস সেটা এখন আমার। বুঝলি?”
“আমার বাবা তোর বাবা। মেনে নিচ্ছি। তোকে দিতে আমার কিছুই সমস্যা হবে না। কিন্তু তোর বাবাও তো তোরই বাবা।”
কবিতা মুখ শক্ত করে জবাব দেয়,”আমার একটাই বাবা।”
কাব্য এবার বলে,”আরিয়ান, আয়রা আর কায়রা তোকে যেতে বলেছে। আর আরিয়ান বেচারা কিছুদিন আগেই তো ডেঙ্গুতে ভুগলো। তোর পরীক্ষা থাকায় তো তুই দেখতেও যেতে পারিস নি। এখন না হয় যা। দু একদিনের ব্যাপারই তো। তারপর না হয় চলে আসবি।”
কথাটা বলেই কাব্য চলে গেলে কবিতার ভীষণ রাগ হলো তার ভাইয়ের উপর। কেন সবসময়ই তার দূর্বল জায়গায় আঘাত করতে হবে? এইরকম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল না করলেই কি নয়?

চলবে….

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_২৫
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“তোকে কখন থেকে কল দিচ্ছি মায়া। ফোন ধরছিলি না কেন?”
“রিল্যাক্স কবিতা। অল্পতেই এতো হাইপার কেন হোস? একটু রয়ে সয়ে কথা বল।”
“আজাইরা কথা বলিস না তো। ফোন ধরছিলি না কেন তাই বল?”
“কবিতা, এইটা গ্রাম। তুই জানিস না, এইখানকার নিয়ম কি রকম। আমার হাতে মোবাইল দেখে এখানকার সবাই অবাক হয়ে গেছে। এখানে নাকি মেয়েদের হাতে মোবাইল দিতে হয়না। তাহলে নাকি মেয়েরা খারাপ হয়ে যায়। বুঝলি?” বলেই হাহা করে হেসে উঠলো মায়া। মায়ার কথা শুনে অবাক হয়ে কবিতা বলে,”মানে কি এইসবের? খারাপ কেন হবে?”
“আরেহ, এ তো গেল মোবাইলের ব্যাপারে। কোনো মেয়ে যদি ফেইসবুক চালায়, তাহলে নাকি সে অবশ্যই খারাপ হয়ে গেছে। তার সাথে আর অন্য মেয়েদের মিশা বারণ। ”
“সিরিয়াসলি? এইটা কোনো কথা? কই গিয়ে পড়লি তুই?”
“আর বলিস না। যতোসব আজগুবি নিয়ম।”
“কতদিন থাকবি তুই ঐ পাগলের গ্রামে?”
“জানিনা। তবে, এই কয়েকটা বিষয় ছাড়া বাকি সবকিছুই ঠিক আছে। গ্রামের মানুষ কি রকম বুঝলিই তো। এখানে এসে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে সাবিহা। অথচ ও কিন্তু এখানে আসতেই চায়নি। আম্মা ওকে মজা করে বলেছে কালকেই চলে যাবো। কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।”
“কি কি করলি আজকে তাই বল।”
“অনেক মজা করেছি। আমার একটা ফুপাতো বোনও আছে। ওর নাম রিজা। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে।”
“আর তোর কাকাতো ভাই-বোনেরা নেই?”
“আছে। কিন্তু ওরা অনেক ছোট সবাই। আর একজন আছে। পাশের বাড়ির একটা মেয়ে ওর নাম মরিয়ম। জানিস ওকে সবাই এখানে কি নামে ডাকে?”
“কি নামে?”
“মইরম।”
কবিতা হাহা করে হাসতে থাকে মায়ার কথা শুনে। হাসতে হাসতেই বলে,”ও যদি শহরে থাকতো, আমরা ওকে ডাকতাম মারিয়াম বলে। তাইনা?”
“মনে হয় তাই ডাকতাম।”
“এখন কি করছিস?”
“ফুপি মুড়ি মাখিয়েছে। তাই খাচ্ছিলাম আর সবার সাথে গল্প করছিলাম। তুই ফোন দিলি তাই আসলাম।”
“ওহ। তাহলে তো বিরক্ত করলাম তোকে।”
“আজাইরা কথা কইস না তো। এমনিতেই কারেন্ট নাই। সন্ধ্যার পর গেছে তো গেছেই। আসার আর খবর নাই।”
“তাহলে আছিস কিভাবে? গরম লাগছে না?”
“নাহ। ততোটা গরম নেই এখানে। শহরে তো একটু সময়ের জন্য কারেন্ট গেলে জান বের হয়ে যায়। এখানে ততোটা গরম না থাকলেও আমরা কেউই এই অন্ধকার সহ্য করতে পারছিনা। কেমন একটা যে অন্ধকার এখানে। তবে, হারিকেন আছে।”
“তাহলে তো ভালোমন্দ সব অভিজ্ঞতাই হচ্ছে।”
“হুমম। তা বলতে পারিস।”
“মায়া।”
“হ্যাঁ, বল।”
“তোকে একটা কথা বলার ছিল।”
“বাহ। সূর্য কোনদিকে উঠেছে আজ? তুই আবার পার্মিশন নিচ্ছিস যে?”
“আরেহ, সিরিয়াস ম্যাটার।”
“আচ্ছা, বল।”
“আজ কাব্য ভাইয়া বলেছে আমাকে আমার নিজের বাড়িতে বেড়াতে যেতে।”
“তো? যা না। তোর ভাই-বোনদের দেখে আয়। ”
“বিষয়টি অতো সহজ না।”
“কেন?”
“তুই কি আমার কথা শুনিসনি?”
“কি কথা?”
“কাব্য ভাইয়া আমাকে বেড়াতে যেতে বলেছে। আমার নিজের বাড়িতে আমি বেড়াতে যাবো। এইটা কি আমার জন্য লজ্জাজনক না? আর তাছাড়া… ”
মায়া কিছু সময় চুপ করে রইলো। সে বুঝতে পারলো কবিতার কেমন অনুভব হচ্ছে। কিন্তু মুখে শুধু বললো,”আর তাছাড়া কি?”
“আরিয়ানের নানা বাড়ি থেকে মানুষ আসে। আমার দিকে কিভাবে যেন তাকায়। যেন আমি কোনো ভিনদেশের অতিথি। ওদের জন্য আমার ভালো লাগে না। আর আরিয়ানের এক খালাতো ভাই আছে, আমাকে ভীষণ বিরক্ত করে। আমার সহ্য হয় না।”
“শোন, আমার আম্মা কি বলেছে জানিস? আম্মা বলেছে আমরা কোনো বয়ামে যখন কোনো কিছু রাখি, তখন বারবার বয়ামটা ঝাঁকি দিয়ে নিই। যাতে আমরা নিজেদের জায়গা নিজেরা তৈরি করে নিতে পারি। আর তুই যেখানে যাচ্ছিস, সেটা তোর বাড়ি। তোর বাবার বাড়ি। তোর মায়ের বাড়ি। তোর মা ঐ বাড়ির বউ ছিল। তার একমাত্র অংশ তুই। ঐ বাড়িতে আরিয়ানদের যতোটা অধিকার আছে, তোরও ততোটাই অধিকার আছে।”
“হুমম। বুঝেছি।”
“যাচ্ছিস তাহলে?”
“দেখি। ”
“জানিস আমাদের এলাকার একজন মুরুব্বি এসেছেন। উনি আমাদের বাড়িতেই আছেন। উনার কথা বলতে সমস্যা হয় মনে হয়। উনি কখনোই কখনো বলে না। বলে কখনু।”
“মানে? কি সব হাবিজাবি বলছিস?”
“আরেহ, ও কার আর উ কারের পার্থক্য বুঝে না। আমরা বলি শোনো। উনি বলে শুনু। সাবিহা ওনার মতো করেই কথা বলছে। উনার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। উনার মতো করে কথা বলেই।”
কবিতা এবার হাহা করে হেসে উঠে।
“ওকে। যা এখন। মজা কর।”
“ওকে। গুড নাইট।”
“গুড নাইট মায়া।”
মায়া কবিতার ফোন রেখে আবার বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে। সে সেখান থেকে চলে যেতেই একটা ছায়ামূর্তিও চলে যায়। যেটা ও লক্ষ্য করতে পারে না। মায়া বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখে সাবিহা এখনও ঐ দাদাটার সাথে কথা বলছে। দাদাটা কি যেন বলছে আর সাবিহা খিলখিল করে হাসছে। সে শুনতে পেল দাদাটা বলছে,”মুক্তিযুদ্ধর সময় আমি বিয়া করছিলাম। বুঝছাও নি? আয় হায়, কি যে জামেলা? বাপে কইলু আইজকেই বিয়া অইবু। আমি কি কই তার কোনো মূল্য নাই। বিয়া অইবু আমার। আর কাম কাজ সব তাগুর। বুঝছাও নি?”
সাবিহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”তারপুর কি অইলু? বিয়া করছেন?”
“হু। না কইরা উপায় আছেনি? বাপেরে মেলা ডরাইতুম। তুমার দাদায় জানে। বিয়া করলুম তার ১ মাস পরেই বউ থুইয়া গেলাম কত কত জায়গায়। যুদ্ধু শেষ কইরা আইসা দেহি আমার বউ বাড়িত নাই। শ্বশুর বাড়িত গেছে গা। আমি যাইয়া দেহি, আমার একটা ছাওয়াল অইছে। বুঝছাও নি কামকাজ?আমি তো কই কি থিকা কি অইয়া গেল? বউ তো শরমে আমার কাছেই আইলু না সাতদিন। কি যে শরমের কতা। কি আর কমু তুমারে নাতনি।”
মায়ার বেশ ভালো লাগছিল এদের গল্প শুনতে। হঠাৎ আকাশের দিকে নজর পড়লো তার। ছোট ছোট তারারা কিভাবে ঝিকিমিকি করে জ্বলছে আর নিভছে। কি মায়াময় একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মায়ের কথা মনে পড়লো মায়ার। তাদের মফস্বল শহরে কারেন্ট চলে গেলে মাঝে মাঝে সে আর তার মা ছাদে উঠে সময় কাটাতো। সে এভাবেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতো, আকাশের সবকিছুই মায়া বুঝলে তো মা? তা না হলে সবকিছু শুধু দেখা যাবে কেন? কেন তবে একটা বারের জন্যও হাত দিয়ে ধরা ছোঁয়া যাবে না?
মা হেসে বলতো, তুমিও তো মায়া। আমার মায়াবতী মা।
মায়া চোখে কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করতো,#আমি_মায়াবতী?
মাও হেসে জবাব দিত, হ্যাঁ তো।
মাঝে মাঝে আকাশ থেকে কোনো তারা খসে পড়লে মায়ার মা মায়াকে বলতো, একটা উইশ করো মায়া। যেকোনো একটা উইশ করো। মায়ার মা জানতে পারেনি কখনো, মায়া সবসময় একটা জিনিসই চাইতো। সেটা হচ্ছে, একটা পরিপূর্ণ পরিবার।
মায়া কি কখনো ভেবেছিল, তার উইশটা পূর্ণ হবে। কিন্তু সেখানে তার মা থাকবে না। তবে কি সে এই উইশটা করতো কখনো আল্লাহর কাছে? হয়তো কখনোই করতো না। মায়া হঠাৎ খেয়াল করে আজও একটা তারা খসে পড়ছে। মায়া আনমনেই বলে উঠে,”আমার মাকে জান্নাতবাসী করো আল্লাহ। তার সব পাপ ক্ষমা করে দিও তুমি।”
★★★
রাত দশটা। কাব্য নিজের বন্ধুদের সাথে প্ল্যান করছিল গরমের ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায়। হঠাৎ একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। কাব্য ভাবে এতো রাতে কে কল দিবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কলটা রিসিভ করে সে।
” হ্যালো, কে বলছেন?”
“আমি… আমি…আসলে…”
একটা নারীকন্ঠের কথায় কাব্য বলে,
“আমি টা কে?”
“আমি…আমি মায়া।”
কাব্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”মায়া? কবিতার বান্ধবী মায়া?”
মায়া রিনরিনে গলায় বলে,”হ্যাঁ, আমি মায়া।”
“এতো রাতে কল দিয়েছো? কোনো সমস্যা হয়েছে? আমি তো জানি তুমি গ্রামে গিয়েছো। তুমি ঠিক আছো তো ?” উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে কাব্য।
“আমি ঠিক আছি। ”
“তাহলে এতো রাতে কল দিলে যে?”
“আসলে আমি কবিতাকে নিয়ে কথা বলতে কল দিয়েছিলাম।”
“কেন? আবার কারো প্রেমে পড়েছে নাকি? নাকি আবার আমার বন্ধু কে প্রোপোজ করার কথা ভাবছে?”
মায়া হেসে বলে,”না। সেইসব বিষয়ে না।”
“তাহলে?”
“ওকে তো আপনারা ওর বাড়িতে যেতে বলেছেন। কিন্তু সেখানে যেতে ও নিরাপদবোধ করছে না।”
কাব্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “নিরাপদবোধ করছেনা মানে কি?”
“মানে হচ্ছে আরিয়ানের নানাবাড়ির মানুষ ওকে ভালো চোখে দেখেনা। তাছাড়া…”
“তাছাড়া কি?”
“তাছাড়া আরিয়ানের খালাতো ভাইয়ের ব্যবহার খারাপ। ও নিরাপদবোধ করে না। আসলে আমি বলতে চাইছি…”
“বুঝেছি মায়া। যা করার আমি করবো।”
“আচ্ছা। আচ্ছা আমি এখন রাখি।”
“এইটা কোনো কথা? যাকে ফোন দিলে তার খবর নিলে না?”
“না মানে আমি অবশ্যই নিতাম। কিন্তু আপনি….”
“আমি? আমি কি?”
“ভালো আছেন স্যার?” কথা ঘুরানোর জন্য বলে মায়া।
মুচকি হেসে কাব্য বলে,”ভালো আছি মায়া। আশা করি তুমিও ভালো আছো।”
“হুমম। ”
কিছুক্ষণ দুজনের মাঝে নিরবতা বিরাজ করে। কাব্যই বলে,”শুভরাত্রি , মায়া।”
মায়া শুধু হুমম বলে কল কেটে দেয়।
কাব্যর দুইরকম অনুভূতি হচ্ছে। আরিয়ানের খালাতো ভাইকে ইচ্ছে করছে ধরে খুন করতে। আবার মায়ার মায়াবী কন্ঠের হাতছানি তাকে সুন্দর একটা মুহুর্তের কথা ভাবতে বাধ্য করছে। কাব্যর ভাবতে ভালো লাগছে। আচ্ছা, সে কি তবে প্রেমে পড়েই গেলো? কিন্তু মায়া তার ছাত্রী। কাব্যর মুখ থেকে আনমনেই বের হয়ে আসে,”উফফ মায়া, তুমি কি আর কোনো কলেজ খুঁজে পাওনি ভর্তি হওয়ার জন্য? তোমাকে আমার কলেজেই কেন ভর্তি হতে হলো?”

চলবে….