আমি মায়াবতী পর্ব-২৬+২৭

0
371

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_২৬
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“রিতু।”
“বলো, মিয়াভাই।”
“আমার সাথে যাবি ঢাকার শহরে? আমাদের সাথে থাকবি। রিজাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিব। ”
আনন্দে চিকচিক করে উঠে রিতুর চোখ। কৃতজ্ঞতায় ঢলে পড়ে রিতু বলে,”আমারে না নেও মিয়াভাই, আমার মাইয়াডারে নিও। এইহানে থাইকা ওর ভবিষ্যত শেষ হইয়া যাইবো।”
“শুধু ওকে না। তোকেও নিয়ে যাবো আমাদের সাথে। আব্বাকেও নিবো।”
“আব্বা যাইবো না মিয়াভাই। ”
“কেন যাবে না?”
“আমি জানি না মিয়াভাই যে কেন যাবে না। হয়তো তোমার প্রতি দায়িত্ব পালন করেনি, তাই হয়তো যাবে না। তাছাড়া, আরো অনেক কারণ আছে। বাবা চাইলেও যেতে পারবে না।”
“কেন?কেন যেতে পারবে না?”
“অনেক কারণ আছে মিয়াভাই। তুমি বাবারে জিগাইও।”
“হুমম।”
“মিয়াভাই।”
“বল।”
“ভাবিরে জিগাইছিলা?”
“কোন ব্যাপারে?”
“এই যে আমারে নিতে চাও। ভাবির অনুমতি নিছো?”
রিজভী হেসে বলে, “সাগরিকার কথা বলছিস? ওর কোনো অসুবিধা নেই তোদের নিয়ে। কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। বিষয়টা তোকে নিয়ে।”
“কি মিয়াভাই?”
“তুই আর কতোদিন এইভাবে থাকবি?জীবন টা তো আর থেমে থাকবে না। একা একা কিভাবে থাকবি তুই?”
রিতু খিলখিল করে হেসে উঠে। ওর হাসি যেন থামতেই চায় না। রিজভীর মনে পড়ে বহু বছর আগে ছোট্ট রিতুকে কোনো কিছু দিলে এইভাবেই খিলখিল করে হাসতো। ওর হাসিতে রিজভীর কষ্টগুলো দূর হয়ে যেতো। সৎ মায়ের দেওয়া কষ্টগুলো ভুলে যেতো। রিতু হাসি থামিয়ে বলে,”মিয়াভাই, বাবা যদি আমার মায়েরে বিয়ে না করতো, তাহলে কিন্তু তোমার এই অবস্থা হতো না। তুমি মায়ের আদর না পেলেও সৎ মায়ের অত্যাচার তো ভোগ করতে না। তাইনা?”
রিজভী মাথা নিচু করে থাকে। রিতু আবার বলে,”পুরুষ মানুষের কাছে বিষয়টা খুব সোজা। কিন্তু মাইয়া মানুষের কাছে এতো সোজা না। আমার মাইয়াডা না থাকলে মিয়াভাই একটা কথা ছিল। ওর জীবনডা শেষ হইয়া যাইবো।”
প্রতিউত্তরে রিজভী কিছুই বলতে পারে না। প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য বলে,”বাচ্চারা কই গেছে?”
“নদীর পাড়ে গেছে। নৌকায় ঘুরবে।”
“কি বলিস? একা গেছে?”
“নাহ। মেজো ভাইও গেছে।”
” অহ। আমিও যাই তাহলে। বহুদিন সেদিকে যাওয়া হয়নি। ঘুরে আসি।”
“ঘুরতে যাচ্ছো? নাকি বাচ্চাদের পাহারা দিতে যাচ্ছো?” বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে।
রিজভীও হেসে ফেলে। তার বোন তার চালাকি ধরে ফেলেছে যে।
★★★
“আমি তোমার সাথে রাগ করেছি কবিতা আপু।” গাল ফুলিয়ে বলে আয়রা।
“আমিও করেছি।” আয়রার হ্যাঁ তে হ্যাঁ বলে কায়রা।
“কেন? আমি কি করেছি?”
“তুমি আরো আগে কেন আসোনি?”
“আরেহ বাবা। আমার তো কলেজ ছিলো। কলেজ বন্ধ না দিলে আমি কিভাবে আসতাম?”
“আমাদের বাসা থেকে তো তোমার কলেজ কাছেই। আমাদের বাসায় এসে কেন তুমি কলেজ করো না?”
কবিতা আনমনে বলে,” সব জায়গা সবার জন্য নয়। বুঝলে?”
“কিন্তু এইটাই তো তোমার বাড়ি আপু।” কায়রা অস্থির হয়ে বলে।
কবিতা কিছু বলার আগেই আয়রার খালাতো বোন এসে হেয়ালি করে বলে,”হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। সবার জন্য সব জায়গা নয়। যেহেতু সবার জন্য সব জায়গা নয়, তাই কারো উচিত না হুট করেই অন্যের বাড়িতে এসে বসা। আমি হলে তো জীবনেও আসতাম না। মানুষ যে কিভাবে আসে, কে জানে।”
কবিতার চোখে পানি চলে আসলো অপমানে। সে কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারলো না। সে তো এখানে ইচ্ছে করে আসেনি। তাকে তো আনা হয়েছে। তবে কেন তাকে এতো কথা সহ্য করতে হবে?
সে মাথা নিচু করে থাকে। আয়রার খালামনি এসে বলে,” তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়ো কবিতা? অহ মনে পড়েছে। কলেজে পড়ো। তা, তোমার বাবা মা তোমার বিয়ের কথা বলেনা? মানে, যারা তোমাকে পালে?”
কবিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”মানে?”
“না মানে বলছিলাম যে এই যে তোমাকে প্রতি ছুটিতেই এখানে পাঠিয়ে দেয়। তোমার দায়িত্ব কি তারা নিতে পারে না এই কয়েকদিনের জন্য? তোমাকে তো তারা দত্তক নিয়েছে। তাহলে এইখানের কোনোকিছুই তো আর তোমার নেই। তাহলে তোমাকে এখানে পাঠায় যে?”
কবিতার ইচ্ছে হলো এখনই এই বাসা থেকে চলে যেতে। আয়রা আর কায়রা ছোট হলেও আরিয়ান কিছু বড়। তার খালামনি কি বলছে সেটা সে বুঝতে পারছে। সে তৎক্ষনাৎ জবাব দেয়,”তুমি এইসব কি বলছো খালামনি? এইটা তো আপুরও বাড়ি। আপু এখানে আসলে কি হবে?”
“আরিয়ান, বড়দের মাঝখানে কথা বলতে হয়না। জানোনা?কেন কথা বলছো মুখে মুখে?”
“বড়রা ছোটদের কে ভালোবাসলে তো ছোটরা বড়দেরকে সম্মান করবে। তাইনা?” কথাটা বলতে বলতে রুমে ঢুকে কাব্য। সে এসেই সোফার উপর এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে বসে। তারপর সরাসরি আরিয়ানের খালামনিকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমার বোনকে না হয় আমরা কিছুদিন খাওয়াতে পড়াতে পারিনা বলে এইখানে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু আপনারা তো আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো অবস্থানে আছেন। আপনারা তবে কেন এইখানে এসে পড়ে থাকেন? আর আপনার মেয়ে তো শুনেছি এইখানেই থাকছে বিগত কয়েক মাস ধরে। তবে কি আমি ভেবে নিবো, আপনাদের ও অবস্থা খারাপ? তাই এইখানে থাকেন।”
“শোনো কাব্য, আমি কিন্তু তোমার গুরুজন হই। আমার সাথে এইভাবে কথা বলার অধিকার তোমার নেই। ” চিবিয়ে চিবিয়ে বলে আরিয়ানের খালামনি।
“আমার বোনের সাথেও আপনার এইভাবে কথা বলার অধিকার নেই। আপনি এখানে কেন এসেছেন? ”
“আমার বোনকে দেখতে এসেছি। আমার কি আমার বোনের সংসারে আসার কোনো অধিকার নেই?”
“অবশ্যই আছে। অবশ্যই আপনি আপনার বোনকে দেখতে আসতে পারেন। আপনি আপনার বোনকে দেখতে আসতে পারলে আমার বোন কেন তার ভাই-বোনদের দেখতে আসতে পারবে না?”
“ওর ব্যাপার টা আলাদা কাব্য ভাইয়া। ওকে তো তোমার বাবা মা দত্তক নিয়েছে। এখন তো আর এই পরিবারে ওর কোনো অধিকার নেই।” দায়সারা ভাবে কথাটা বলে আরিয়ানের খালাতো বোন নেহা।
কাব্য ওর কথা শুনে মজা পেয়েছে এমন ভাব করে বলে,”ওহ তাই? আমি তো জানতামই না। ওকে, চলো কিছুক্ষণের জন্য মেনে নিচ্ছি যে এই বাড়িতে ওর মেয়ে হিসেবে কোনো অধিকার নেই। কারণ, আমার বাবা মা ওকে দত্তক নিয়েছে। কিন্তু তারপরও কি সব অধিকার শেষ? আমি যদি এই পরিবারে আসতে পারি, তাহলে ও পারবে। কারণ এটা আমার মামাবাড়ি। আর সেই হিসেবে ওর ও তো মামাবাড়ি। তাইনা?”
কাব্যর কথা শুনে নেহা সেখানে থেকে গটগট করে হেটে চলে যায়। এবার কাব্য আরিয়ানের খালার দিকে তাকিয়ে বলে,”ক্লিয়ার? আপনারা এসেছেন বোনের বাড়িতে। আর আমরা এসেছি মামার বাড়িতে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে জানেন তো, মামার বাড়ি রসের হাড়ি। কোথাও কিন্তু লেখা নেই, খালার বাড়ি রসের হাড়ি কিংবা বোনের বাড়ি রসের হাড়ি। “বলেই হো হো করে হাসতে থাকে।
আরিয়ানের খালামনি মুখ কালো করে বসে থাকে। কবিতা মাথা নিচু করে ছিল। তার ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও চলে যেতে। তার নিজের বাবার বাড়ি আজ তার মামার বাড়ি। মুখে যতোই বলুক বাবাকে সে ভালোবাসেনা, পছন্দ করে না। কিন্তু তাকে মামা বলে সম্বোধন করতে হবে এইটা তো সে মেনে নিতে পারবে না।
” কি হচ্ছে এখানে?” রাশভারী গলায় কথাটা বলে কবিতার বাবা আনোয়ার।
কবিতাসহ সবার দৃষ্টি তখন তার দিকেই যায়। কাব্য কিছু বলতেই যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই আরিয়ান তাকে গিয়ে বলে,”বাবা, বাবা, জানো খালামনি কি করেছে? খালামনি আর নেহা আপু কবিতা আপুকে অপমান করেছে। বলেছে এখানে নাকি আপুর কোনো অধিকার নেই। আপু এখানে এসে নাকি ঠিক কাজ করেনি।”
আনোয়ার সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকায় শালিকার দিকে। সরাসরি তার কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, “আরিয়ানের কথাটা কি ঠিক? তুমি আমার মেয়েকে এইসব বলেছো?”
আরিয়ানের খালামনি কিছুটা ভয় পাওয়া গলায় বললো,”আমি আসলে ঐভাবে বলিনি। আসলে দুলাভাই হয়েছে কি আমি আসলে ওকে আসলে….”
কথাটা শেষ করতে পারলো না সে। তার আগেই কবিতার বাবা বললো,”আমি জিজ্ঞেস করেছি আরিয়ান যা বলেছে সেগুলো কি তুমি বলেছো?”
মাথা নিচু করে থাকে সে। কবিতার দিকে তাকিয়ে আনোয়ার সাহেব বলে,”তোমাকে এইসব বলেছে? ”
কবিতাও মাথা নিচু করে থাকে।
আনোয়ার সাহেব চিৎকার করে ডাকে, “আনিকা, কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি এইখানে এসো।”
বাবার চিৎকারে ভয় পেয়ে আয়রা আর কায়রা কবিতার পিছনে গিয়ে লুকায়। তাদের মা আনিকা হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে বলে,”চেঁচামেচি করছো কেন? আমি তো রান্নাঘরে রান্না করছিলাম। চুলায় মাছ দিয়ে এসেছি। পুড়ে যাবে তো।”
আনোয়ার সাহেব তার কাছে গিয়ে তার সজোরে এক থাপ্পড় মেরে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় আনিকা সহ সবাই পুরো থমকে যায়। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় আনিকা নিজেই। কেন তাকে থাপ্পড় দেওয়া হলো, কি দোষ তার সে কিছুই জানে না। আয়রা আর কায়রা কান্না করে দিয়েছে। কাব্য সহ সবাই স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
আনিকা রিনরিনে গলায় বলে,”আমাকে মারলে কেন? আমি কি করেছি?”
“কিছুই করোনি তাইনা? কিছুই করোনি তুমি? আমার মেয়েটা বছরে কতদিন আসে তোমার বাসায় যে সেই কয়টা দিন তাকে সহ্য করতে পারো না? নিজের বোনদেরকেও সেই কয়েকদিন ডেকে এনে আমার মেয়েটাকে কষ্ট দিতেই হবে?”
“কি বলছো তুমি এইসব? আমি কেন এইসব করবো? কি হয়েছে এইখানে? আমি তো কিছুই জানি না।”
“জানোনা? জানোনা তুমি? তাহলে তোমার বোন কোন সাহসে আমার মেয়েকে এইখানে আসার জন্য কথা শোনালো? কেন বললো যে এইখানে তার কোনো অধিকার নেই? তুমি সাহস না দিলে এতো সাহস পায় কই সে?”
আনিকা তার বোনের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। তার বোন মাথা নিচু করে আছে। তার মানে কথা সত্য। আনিকা কিছু বলতেই যাবে কিন্তু তার আগেই আনোয়ার সাহেব বলে, “এইখানে এসে তো সোনার থালায় বাড়া ভাত পেয়েছো। তাই কষ্ট কাকে বলে বুঝোনি। কবিতার মা আমার এই বাড়ির জন্য, সংসারের জন্য কি কি করেছে তোমার কোনো ধারণা আছে? এই যে বাড়িটা দেখছো, এই বাড়ির অর্ধেকটা আমার নামে আর অর্ধেকটা কবিতার মায়ের নামে। কারণ আমরা দুজনে মিলে এই বাড়ি বানিয়েছি। কিন্তু অভাগীর কপালটা খারাপ। তাই ওর জায়গায় আজ তুমি এসে এইখানে রাজত্ব করছো। কবিতার মায়ের সবটুকুই তো কবিতার। আর আজ কবিতাকেই কিনা শুনতে হবে যে এই বাড়িতে কবিতার কোনো অধিকারই নেই? এতো সহজ? আর বাকি রইলো তোমার বাপের বাড়ির মানুষ। কি ছিলে তোমরা মনে নেই তোমার? ছোট্ট একটা ঘরে গাদাগাদি করে কতগুলো ভাই-বোন, বাবা, মা থাকতে। নেহাৎ আমার মা তোমাকে এই বাড়িতে এনেছিল কবিতার দেখাশোনার জন্য। না হলে আজও সেখানেই থাকতে। তোমার বাবার বাড়ির লোকের আজ এটা লাগবে কাল ওটা লাগবে, বায়না তো শেষই হচ্ছিলো না। বছরে ১২ মাসের ১০ মাসই তোমার বাপের বাড়ির মানুষ দিয়ে আমার বাড়ি ভরা থাকে। আর আমার মেয়েটা তার নিজের বাড়িতে দুই দিনের জন্য এসেও থাকতে পারবে না? এতো সাহস আসে কই থেকে তোমাদের যে আমার মেয়েকে কথা শোনাও?”
আনিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিজের স্বামীর দিকে। এই মানুষটা তার স্বামী। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। রান্নাঘর থেকে পোড়া গন্ধ আসছে। সে ধীরে ধীরে রান্নাঘরে গিয়ে চুলা বন্ধ করে দিয়ে এসে নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি ঠিকই বলেছো। আমি ঠিকই এই বাড়িতে এসে সোনার থালায় ভাত পেয়েছি। কিন্তু জানো তো, সেই সোনার থালায় ভাত আমি একটা দিনও নিজে বেড়ে খেতে পারিনি। আমি তো তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি। একটা কুমারী মেয়ে কি কখনো ইচ্ছে করে এক বাচ্চার বাবা কে বিয়ে করে? আমার পরিবারের অবস্থা খারাপ বলেই আমার বাবা মা বিয়ে দিয়েছে। বলতে পারো আমাকে অনেকটা বিক্রিই করে দিয়েছে। আমি তো সবকিছু মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু কবিতার দাদি তো আমাকে ভালোভাবে সংসার করতে দেয়নি। সেটা আপনিও জানেন। আমি তো কবিতাকে আমার মেয়ে বলে মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ সেটা বুঝেনি। সবাই আমাকে দোষারোপ করেছে পান থেকে চুন খসলেই। তারপর যখন আরিয়ানের জন্ম হয়, কবিতার দাদির আক্রোশ আরো বেড়ে যায়। কি কি হয়েছে আপনি তো জানেনই। বাধ্য হয়েই তো কবিতাকে বড় আপা দত্তক নিলো। তারপর তো আমরা কবিতাকে আনতে চেয়েছিলাম কিন্তু তখন আমার বাবা মা আমাকে উল্টোপাল্টা বুঝালো। আমি কি আসলেই কি সংসারে নিজের মতো থাকতে পেরেছি? তুমিই বলো তো।আমি যদি কবিতাকে ভালোই না বাসতাম, তবে আমি আজও আপনাকে কবিতার বাবা বলে ডাকতাম না। আমি নিজেকে কবিতার মা বলে দাবি করতাম না। আচ্ছা, আমি তো আপনার সংসারের জন্য সব ছেড়েছি। আপনি কি বিনিময়ে আমাকে একটু ভালোবেসেছেন?

চলবে…..

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_২৭
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“মারিয়াম আপু, শাপলা ফুল ফুটেনি কেন? সকালে তো ফুটে ছিল।এখন ফুটেনি কেন?”
“সাব্বির, অহন তো বিকেল। রাইতে ফুটবো। আবার সকালে বেশি আলোতে মুখ লুকাইব।”
“হোয়াট? কি বলো এইসব মারিয়াম?মুখ লুকাইবো মানে কি?”
“মানে হলো বুইজা যাইবো।”
সাব্বির গোলগোল চোখ করে বলে,”বুইজা কি?”
ওদের কথা শুনে মায়া হাসে। হাসতে হাসতে বলে,”সাবিহা, একটা গান শুনেছিলি?”
“কোন গান?”
“শালুক ফুলের লাজ নাই, রাইতে শালুক ফুটে লো, রাইতে শালুক ফুটে। মনে নেই?”
“হ্যাঁ, মনে আছে তো।”
“হুমম। সেটাই। শালুক ফুলের লাজ নাই, তাই রাতের বেলা ফুটে৷ আর সকালের সূর্য যখন বেশি তাপ ছড়ায়, তখন নিজেকে আবার খোলসে আবৃত করে ফেলে। বুঝলি?”
“হুমম। ”
সাব্বির কাঁদোকাঁদো গলায় বলে,”আমি চেয়েছিলাম শাপলা ফুল বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু এখন তো ফুটে নি। কালকে সকালে তো আর এইখানে আসা যাবে না।আমাকে তো আর কেউ নিয়ে আসবে না।”
মরিয়ম সাব্বিরকে বলে,”কাইন্দো না সাব্বির। আমরা লইয়া যামু ফুল। গরুর চারের পানিতে ভিজায়ে রাখুমনি। তাইলে সকালে দেখবা ফুইটা রইছে।”
সাবিহা জিজ্ঞেস করে,”গরুর চার কি?”
“আরে, ঐ যে দেখলানা, গরুরে যেইহানে আমি ভুষি গুলায়ে খাওয়াইলাম। ঐহানে পানি দিয়া চুবাইয়া রাখুমনে শাপলার ডাট। তাইলে পানি পাইয়া ফুইটা উঠবোনে।”
“ইয়াক থু। জীবনেও না। ঐখানে গরু খাবার খায়।ঐখানে না। অন্য কোথাও।”
“বাচ্চারা। নাড়াচাড়া কইরো না। নৌকা ঢুলতাছে কিন্তু। বেশি ঢুলাইলে কিন্তু পানি উডবো। তহন কিন্তু ডুইবা যাইবো নৌকা।”
মায়ারা সবাই নৌকাতে ঘুরছে। তারা চেয়েছিল নদীতে ঘুরতে। কিন্তু তার মেজো কাকা নদীতে নামেনি। ওরা কেউই ভালোভাবে সাঁতার জানে না। তাই নদীর পাশের খালটাতেই নামিয়েছে নৌকা। সেখানে ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের পানির ফুল ফুটে আছে। মায়ারা অবাক হয়ে একটা একটা করে দেখছে। নৌকার এক মাথায় কাকা নৌকা চালাচ্ছে। আরেকপাশে মরিয়মের ভাই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। সে চেয়েছিল সে সবাইকে নৌকায় ঘুরাবে।যাতে সবাই বুঝতে পারে সে এই কাজে দক্ষ। কিন্তু মায়ার কাকা রিস্ক নিতে চায়নি। তাই নিজেই চালাচ্ছে নৌকা।
“মরিয়ম, আমি শুনেছিলাম নদীর পাড়ে কাশফুল থাকে। কই কাশফুল? আমি তো দেখছিনা। এই বিলেও তো নেই। নদীর ঐখানেও তো দেখলাম না।”
সাবিহার কথা শুনে কাকা হাহা করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে বলে, ” কাশফুল তো ফুটবো শরৎ
কালে। এখন তো না।”
সাবিহা অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করে,”মায়া আপু, শরতকাল আসতে আর কত দেরি? শরতকাল কবে আসবে?”
মরিয়ম বলে,”শোনো, ঐযে দূরের বাঁশঝাড় দেখতাছো, ঐদিক থিকা দূর্গা পূজার ঢাক ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইবো, তহন ভালোমতো কাশফুল ফুটবো৷ তহন আইসো গেরামে। তাইলে দেখবার পারবা।”
সাবিহা আর মায়া, দুজনেরই মন খারাপ হয়ে যায়। সেই সময় কি আর তারা এখানে আসতে পারবে? বাবা কি তাদের নিয়ে আসবে এখানে?
★★★
“তোমার মা আমাকে আমার পরিবার থেকে বলতে গেলে অনেকটা কিনেই এনেছিল। বিনিময়ে আমার বাবা মা আর তাদের সন্তানদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল। বিয়ে হয়ে এই পরিবারে আসার পর আমার সময় লেগেছিল তোমাদের সবাইকে মেনে নিতে। সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছিল কবিতাকে মেনে নিতে। একটা কুমারী মেয়ে, যার নিজের বিয়ে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন ছিল, সে বিয়ে করে এসে পড়লো এক বাচ্চার বাপের ঘাড়ে। কি মনে হয়, তার পক্ষে এটা মেনে নেওয়া এতো সহজ? তুমি কি দেখোনি, আমি আমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতাম না? তারা আমাকে আপনার মায়ের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। আমি তো একসময় কবিতাকে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি? তুমি কি আমাকে মেনে নিতে পেরেছিলে? রাতের পর রাত আমার থেকে দূরে থেকেছো। কখনো ঘুম ভেঙে গেলে উঠে দেখতাম তুমি তোমার প্রথম স্ত্রীর ছবি বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছো। আমার কি অধিকার ছিল না, তোমার ভালোবাসা পাওয়ার? আর তোমার মা,সে তো সবসময়ই চাইতো আমি যেন একটা কাঠের পুতুলের মতো থাকি। আমি যেন সবসময়ই হাসিমুখে থাকি সবার সামনে। আর আমার ভিতরটা যেমনই থাকুক না কেন, আমাকে সবার সামনে হাসিখুশি থাকতেই হবে। নিজের স্বামীর থেকে ভালোবাসা পাচ্ছি না, নিজের বাবা মায়ের উপরে ক্ষোভ থেকে তাদের সাথে কথা না বলা, বিবাহিত জীবনের শুরুতেই একটা বাচ্চা, সারাক্ষণ শাশুড়ীর আদেশ মতো হাসিখুশি থাকা অথচ ভিতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আমি কাকে বলতাম আমার কথা? আমার নিজের মনের কথা? আমার তো কেউই ছিল না। সবকিছুই হয়তো স্বাভাবিক থাকতো, যদি তুমি আমাকে একটুর জন্য হলেও ভালোবাসতে। ”
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে দম নেয় আনিকা। অনেক দিনের জমা ক্ষোভ আজ ঝাড়লো সে। বেশ হালকা লাগছে তার নিজের। তবে, শেষ হয়নি। তার ইচ্ছে হলো তার উপর হওয়া এতোদিনের অত্যাচারের সব কথা জানানো। সে আবার বলে,”কবিতাকে আমি ভালোবাসতাম। কারণ, আমার জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো আমি ওকেই বলতাম। যদিও বাচ্চা মেয়েটা কিছুই বুঝতো না। তবুও ওকে বলতাম। তুমি কিছুই জানো না। কিছুই না। আমি যখন প্রথম কনসিভ করলাম, তোমার মা আমাকে এবোর্শন করিয়ে এনেছিল। তুমি কি সেটা জানো? জানো না। আমি তোমাকে বলার আগে তোমার মাকে বলেছিলাম। সেটাই ছিল আমার ভুল। উনি আমাকে ডাক্তার এর কাছে আল্ট্রা করানোর নামে এবোর্শন করিয়ে এনেছে। তোমাকে বলতে পারিনি। বলেছিলাম আমার স্বার্থপর বাবা মাকে। তারা কি বললো জানো? তারা বললো আমাকে নাকি মা হওয়া যাবে না। সেই চুক্তিতেই নাকি বিয়ে হয়েছে। সেইজন্যই নাকি আমার মা বাবাকে টাকা দেওয়া হয়েছে। আমার ভাইবোনের দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে। এবার বলো তো, এই সংসারে আমার আপনটা কে? আমার সবকিছুই আমি হারিয়েছি কারণ কবিতার মা মারা গিয়েছিল। যদি কবিতার জন্ম না হতো, তবে কবিতার মা মরতো না। আর না আমাকে এই জাহান্নামে আসতে হতো। আর তুমি মেয়েকে আজ এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছো কেন? আমি তো তবু তোমার মেয়েকে ভালোবেসেছি ছোট বেলা থেকেই। কিন্তু তুমি? তুমি তো তোমার মাসুম বাচ্চাকে তোমার স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে ভেবে কখনো মেনেই নাও নি। কোলেও নাও নি। তোমাকে স্বাভাবিক জীবনে আনার জন্যই আমাকে কিনে আনা হয়েছিল। এখন বলো, আমাকে এই সংসারে ভালো কে বাসে? যেখানে আমাকে আমার বাবা মা বিক্রি করে দিয়েছিল। তুমি ভালোবাসোনি। তোমার মা আমাকে মা হওয়ার অনুমতি দেয়নি। এবার বলো তো, এই সংসারে আমার অবস্থান টা কোথায়?”
কবিতা হকচকিয়ে উঠলো। কি শুনছে সে এইসব? তার বাবা ভাবে যে সে তার মায়ের মৃত্যুর কারণ? তার দাদী এতোটা ভয়ানক? একটা মেয়েকে মা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত করতে পারে কিভাবে? সে সোফার হাতল ধরে সোফায় বসে পড়ে। কাব্য এসে তাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে। কবিতার বাবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আনিকা আবারও বলে,”কি যেন বলছিলে তুমি? আমি আমার ভাইবোনকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসি? নাহ। আমি নিয়ে আসি না। আমি তাদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলি না। কেন বলবো? ওরা আমার জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আমি কেন ওদেরকে এই সংসারে আসতে বলবো? ওদের এখানে আসার অনুমতি তো দিয়ে গেছে আপনার মা। মনে পড়ে, মৃত্যুর আগে সে আপনাকে বলে গেছে আমার ভাই বোনদের দেখাশোনা করতে? মনে পড়ে?আপনি কি জানেন হুট করেই কি এমন হলো যে আপনার হঠাৎ বড়লোক হওয়া মা, যে কি না দুটো পয়সা হওয়ার পর আর আমাদের মতো গরীবদের রাস্তার লোক মনে করতো, সে হঠাৎ করেই কেন আমার বাবা মাকে এতো মাথায় তুললো? জানতে চান আপনি?”
আনোয়ার সাহেব অস্ফুটস্বরে বললো,”কেন? কি হয়েছিল?”
“আরিয়ান জন্মের পর বিষয়টা ঘটেছিল।এই যে আমার এই বোনটাকে দেখছো, সে কই থেকে যেন শুনেছিল মা বাবার অনুমতি ছাড়া ভ্রুণ হত্যা করলে জেল খাটতে হবে। আমার স্বার্থপর বাবা মা তোমার মাকে পুলিশের ভয় দেখিয়েছিল। যার কারণে তোমার মা বাধ্য হয়েছিল আমার বাবা মাকে মেনে নিতে। কবিতাকে বড় আপার কাছে দিয়ে দিয়েছিল তোমার মা। কারণ হিসেবে সে বলেছিল আমি নাকি ভালো মা নই। তুমিও তোমার মেয়ের প্রতি কোনো ভালোবাসা দেখাওনি। কিন্তু কিছুদিন পর মেয়ের প্রতি ভালোবাসা উথলে উঠেছিল। তাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলে। কিন্তু না কবিতা আসতে চেয়েছিল আর না বড় আপা তোমাকে ওকে দিতে চেয়েছিল। কিছুই করতে পারোনি। আমি কবিতাকে এখানে আনতে চাইনি। আমি চাইনা ও কখনোই এইখানে পার্মানেন্টলি থাকুক। এইখানে থাকলে তুমি ওকে আবার ভালোবাসতে পারবে না। আবার কবিতার মায়ের মৃত্যুর জন্য ওকেই দায়ী ভাবতেন। কি? ভাবতেন না? আপনার উচিত ছিল আমাকে আর কবিতাকে একসাথে ভালোবাসা। তাহলে হয়তো আজ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। কবিতা অন্যের ঘরে থাকতো না। আমার মা, বাবা, ভাই-বোনদের আমার কাছে খারাপ মনে হতো না। আপনার ভালোবাসা পেলে হয়তো আমি আমার দুঃখ ভুলতে পারতাম। আপনাদের দুজনকে ভালোবাসতে পারতাম। একটা ছোট্ট সংসার গড়তে পারতাম। আমার প্রথম বাচ্চাটাও হয়তো বেঁচে থাকতো। মেয়েদের কাছে মাতৃত্ব কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তুমি সেটা জানোনা। তুমি যদি জানতে, তাহলে বুঝতে পারতে কবিতার মা চাইলে নিজে সেদিন বাঁচতে পারতো। কিন্তু সে চেয়েছিল তার সন্তান বাঁচুক। দুনিয়ার আলো দেখুক। তার একটা অংশ পৃথিবীতে থাকুক। আপনার উচিত ছিল কবিতাকে আগলে ধরে বাঁচা। অথচ আপনি তাকে কোলেও নেননি। আপনি কি বুঝতে পারছেন, আজকের এই সবকিছুর জন্য আপনিই দায়ী?”
আনোয়ার সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, আনিকা তাকে আপনি আপনি করে বলছে৷ তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হলে, কথা কাটাকাটি হলে সে তাকে আপনি আপনি বলে। সে কি এতোটাই পর তার?
কবিতা আস্তে আস্তে উঠে এসে তার বাবার সামনে দাঁড়ায়। তার কাঁধে হাত রেখে বলে,”আমি জানি যে আমার জন্মের সময় ডাক্তাররা চাইলে আমার মা বা আমাকে বাঁচাতে পারতো। আমার মা আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিল। মা কে এতোটাই ভালোবাসতে যে আমার অস্তিত্বের কোনো মূল্য ছিল না তোমার কাছে। কিন্তু আমি তো আমার মায়েরই অংশ। ” কবিতা আনিকার দিকে তাকিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “তোমাকে ভালোবাসি মা। তুমি আমাকে ফুপির কাছে দিয়ে আমার সবচাইতে বড় উপকার করেছো। আমি কারো কাছে খুনি হয়ে থাকতে চাইনা। আমি তোমাকে, আমার ভাই-বোনদের ভালোবাসি। আমি আমার মৃত ছোট্ট ভাই অথবা বোনটাকেও ভালোবাসবো। জীবনের কোনো এক পর্যায়ে হয়তো আমি তাকে খুঁজে পাবো। কিয়ামতে কিংবা হাশরের মাঠে। তখন আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো। দুর্ভাগা ভাই-বোনেরা আমার, আমার জন্যই এই পৃথিবীতে আসতে পারলোনা। মা, তুমিও কি আমাকে তোমার সন্তানের খুনী ভাবো?”

চলবে….