আমি মায়াবতী পর্ব-৩০+৩১

0
413

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৩০
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

দুবার কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুললে সোহাগ দেখে সামনে রিজা দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই রিজা আহ্লাদে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করে,”আমরা আসছি ১৫ দিন হয়ে গেছে সোহাগ ভাই। আর তুমি আজ আসলা? এতো দেরি করলে কেন? জানো, আমি তো তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। ”
সোহাগ নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে বলে,”কতোটা অপেক্ষা করে ছিলি বুঝতেই তো পারছি। ১৫ দিন পরে আসছি, তাতেই তুই দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াচ্ছিস না। আরও আগে আসলে তো দরজা খুলতিই না।”
রিজা নিজের ডানহাত দিয়ে কপাল চাপড়ে বলে,”অহ, হ্যাঁ। তাই তো। এসো এসো, ভেতরে এসো।”
সোহাগ ইতস্তত করে এদিক সেদিক তাকায়। রিজা বলে,”ঐ রুমটা মায়া আপুর। তুমি যাও।”
সোহাগ বিরক্ত হয়। মেয়েটা ভদ্রতা বোঝেনা এখনও। কারও বাড়িতে এসে যে এইভাবে ঢুকা যায় না কারো রুমে, সেটা সে বুঝে না। বুঝবেই বা কিভাবে? সারাজীবন গ্রামে থেকে হুট করে শহরে আসলে তো এটাই হবে। বিরক্ত হয়ে বলে,” চাচী কই? ওনাকে ডেকে দে।”
রিজা মায়ার মায়ের রুমে গিয়ে বলে,” মামী, সোহাগ ভাইয়া এসেছে মায়া আপুকে পড়াতে। মায়া আপু তো গোসল করছে। সোহাগ ভাইকে কি মায়া আপুর রুমে বসতে বলবো?”
রিজা হয়তো আরো কিছু বলতো। কিন্তু সেই সুযোগ তাকে দেয়নি সাগরিকা। মাথায় কাপড় দিয়ে বসার রুমে গিয়ে দেখে সোহাগ এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে সোহাগ সালাম দিলে সালামের উত্তর নিয়েই সে সোহাগকে বলে,”দাঁড়িয়ে আছো কেন সোহাগ? বসো। মায়া আসলে কিছুক্ষণ আগেই কলেজ থেকে ফিরেছে। ফ্রেশ হচ্ছে। তুমি বসো। ও এসে পড়বে।”
সোহাগ বসলে সাগরিকা কিচেনের দিকে যায়। রিজা সোহাগের কাছে এসে মুচকি এসে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে যায়। মায়াদের বাড়ির গেস্টরুমটাই এখন তার আর তার মায়ের রুম। ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে নিজের দিকে তাকায় সে। কি ভেবে নিজেকে দেখেই মুচকি হাসে বারবার। চট করে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে এসে মুখে ক্রিম লাগিয়ে কড়া লাল রঙয়ের লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে নেয় সে। টিপের পাতা থেকে ছোট্ট একটা লাল টিপও কপালে পড়ে সে। সামনের চুলগুলো বের করে গালের উপর রাখে। নিজেকে দেখে নিজেই লজ্জায় লুতুপুতু হয় সে। শেষ একবার নিজেকে আয়নায় দেখে রুম থেকে বের হতেই আবার কি মনে হতেই ছুটে রুমে এসে দুহাত ভর্তি করে লাল কাচের চুড়ি পড়ে নেয় সে। আরও একবার আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে সে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায়। সোহাগের সামনে গিয়ে বলে,”সোহাগ ভাই, তুমি কি কিছু খাবে? আমি কি কিছু বানিয়ে আনবো?”
সোহাগ একবার ওর দিকে তাকিয়ে থ হয়ে যায়। এ কোন রিজা কে দেখছে সে? গাঁয়ের সেই আলাভোলা মেয়েটা এই কি সাজ দিয়েছে? আর এই কয়েকদিনেই যেন শরীরের রঙ বদলেছে। গায়ে নতুন জামা, নতুন সাজ একি অবস্থা? কিন্তু রিজার কথায় বেশ লজ্জা পায় সে। ভাগ্যিস কেউ নেই এইখানে। নয়তো শুনলে কি একটা বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে যেতো?
“কি হলো? এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
“হুমম। নাহ,এমনি। মায়াকে ডেকে দে তো। আমি ওকে পড়াতে এসেছি। তুই যা।”
রিজা লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে গিয়ে ভাবে, “ইশশ! কিভাবে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। ভাবতেই তো লজ্জা লাগছে।”
কিন্তু রিজা সেখান থেকে চলে যেতেই সোহাগ বিরবির করে বলে,”গ্রামের চাচাতো বোন হুট করে শহরে আসলে এইরকম উদ্ভট সাজ দিবেই। হাস্যকর। ”
★★★
“তোর বান্ধবী তো দেখছি খুব মুডি। মাঝেমধ্যে এমন ভাব করে যেন আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে। আর মাঝেমধ্যে তো মনে হয় চিনেই না।” মুখ গোমড়া করে বলে কাব্য।
“হঠাৎ আমার বান্ধবীকে নিয়ে হঠাৎ এতো আগ্রহ কেন তোর?” আচার মুখে নিয়ে বলে কবিতা।
“আমি তো শিক্ষক। আমার তো একটা সম্মান আছে তো নাকি?”
“তো কি করেছে আমার বান্ধবী? ”
“ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে দেখি রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখেই ছুটে সামনে রিকশায় উঠলো। কেন? একটা সালাম দিয়ে গেলে কি হতো?”
“আজব! ঐ সময় কত ভীড় থাকে জানিসই তো। হয়তো সামনে রিকশা পেয়েছিল। তাই সেটাতে উঠে গিয়েছিল। আর তোকে আগ বাড়িয়ে সালাম দিতেই হবে কেন? ক্লাসের কত মেয়েই তো অভিযোগ করে তুই নাকি তাদের সালামের জবাব নিস না। তাহলে আমার বান্ধবীর সালামের এতো দাম কেন?”
“আরেহ, ঐসব গায়ে পড়া মেয়ে আমার ভালো লাগে না। আসতে যাইতে সবসময়ই সালাম দিয়ে হাসা লাগবে কেন? আর মেসেঞ্জারে তো স্যার এটার সমস্যা, ওটার সমস্যা নিয়ে পড়েই থাকে। আমি পড়া বোঝাতে গেলে হয় বলে কোনো রেস্টুরেন্টে দেখা করে সলভ করিয়ে দিতে না হলে এক্সট্রা প্রাইভেট পড়াতে। তুইই বল, আমার পক্ষে কি সেটা সম্ভব? ”
“বুঝতে পেরেছি জনাব। আপনার কি চাই।”
“এইই, আমি আবার কি চাই? কি বুঝেছিস তুই?”
“আপনি যা বোঝালেন আরকি। আর শোন, ওর বাসায় আজ থেকে নতুন একটা টিউটর আসবে। এই সময়েই পড়ানোর কথা। সেজন্য হয়তো ঐভাবে ছুটে গিয়েছে।”
“হাউস টিউটর? ছেলে না মেয়ে?”
কবিতা চোখ সরু করে জবাব দেয়,”কেন? তা দিয়ে তোর কি?”
কাব্য থতমত খেয়ে বলে,”আমার? আমার আবার কি? আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম। ”
“ছেলে টিউটর।”
“ওর বাসায় পড়াবে?”
কবিতা বিরক্ত হয়ে বলে,”নাহ,হাউস টিউটর রাস্তায় পড়াবে। ইডিয়ট। তুই না টিচার। আমার তো মানতে কষ্ট হয়।”
“মানতে হবে না তোকে। তা হঠাৎ টিউটর লাগলো যে?”
“আরেহ, ওর বাবার বন্ধুর ছেলে। গ্রামে গিয়ে পরিচয় হয়েছে। তাই ওর বাবা পড়াতে বলেছে। ”
“ওহ। আচ্ছা।”
“কেন? তোর জ্বলছে নাকি?”
“মায়া কি আমার বউ না গার্লফ্রেন্ড যে আমার জ্বলবে?”
“হ্যাঁ, সেটাই। না জ্বললেই ভালো। কিন্তু আমি যে বেগুন পুড়ে যাওয়ার তীব্র গন্ধ পাচ্ছি।”
“আজাইরা কথা বলবি না বলে দিচ্ছি।”
“তুইও আর প্যাচপ্যাচ করিস না আমার সাথে। বিকেলে ওর সাথে দেখা করবো। ওর বাসায় যাবো। কক্সবাজার থেকে কত কি এনেছি ওর জন্য সেগুলো দিতে। ওর ফুপাতো বোন নাকি এসেছে তাকেও দেখতে যাবো। এই ভাইয়া, আমাকে কি একটু ড্রপ করে দিয়ে আসবি? প্লিজ?”
কাব্য প্রতিউত্তরে শুধু বলে,”হুমম। ” কিন্তু বুকের ভিতর একটা খচখচানি থেকেই যায়। কিছুতেই সেটাকে থামাতে পারছে না সে। তার ইচ্ছে করছে মায়াকে সবকিছু বলে দিতে। তার কেন মনে হচ্ছে মায়াকে হারিয়ে ফেলবে সে? উফফ! মন, তুমি এতো উতলা হচ্ছো কেন?
★★★
টপটপ করে পানি পড়ছে মায়ার চুলগুলো থেকে৷গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় যেন আকর্ষণ করছে সোহাগকে। আর চোখদুটো যেন একটা গভীর সমুদ্র। গোসল করে মেয়েটাকে কি স্নিগ্ধ লাগছে। বারবার নিজেকে সংযত করতে চাইছে সে। কিন্তু বেহায়া চোখগুলোর নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই যেন আকর্ষণ বেশি। মায়াকে সে জিজ্ঞেস করে,” ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা কেমন হয়েছে তোমার? রেজাল্ট কেমন এসেছিল?”
“সবগুলোই ভালো হয়েছিল ভাইয়া শুধু ফিজিক্স বাদে। এইজন্যই এখন এইটার উপর জোর দিচ্ছি। ”
“ওহ, ব্যাপার না। এখনও অনেক সময় আছে। সময় নিয়ে পড়াবো। তাহলে বেশ ভালো রেজাল্ট হবে ইনশাআল্লাহ। ”
“ইনশাআল্লাহ।”
সোহাগ লক্ষ্য করে ড্রয়িংরুমে উল্টোপাশের রুমের দরজার সামনে লাগানো পর্দার নিচে রিজার পা দেখা যাচ্ছে। সে মাঝেমধ্যেই বাইরে উঁকি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে নিজেই হাসছে আবার নিজেই লজ্জা পেয়ে চলে যাচ্ছে।সোহাগের ভীষণ অস্বস্তি লাগছিলো। সে জানে রিজা তার কাছে কি চায়। কিন্তু সেটা ইহজন্মে সম্ভব না। প্রথমত সে মায়াকে ভালোবাসে। আর দ্বিতীয়ত তাদের মধ্যে কোনো কিছুরই মিল নেই। দুই পরিবারের মধ্যে কোনো মিলই নেই। কোনো ভাবেই এই বিষয়টা সম্ভব না। শুধুমাত্র মায়ার জন্য সে কিছুই বলতে পারছে না। একটা ধমক পর্যন্ত দিতে পারছে না। চাইলেও বাসাটা থেকে চলে যেতে পারছেনা। তাহলে যে মায়ার সাথে কোনো যোগাযোগই থাকবে না তার। কিন্তু এই নির্বোধ মেয়েটাকেও সহ্য হচ্ছে না তার।কি করবে সে এইবার? কিছুই মাথায় আসছে না তার।
সোহাগ যেহেতু আজ প্রথম এসেছে,তাই সাগরিকা তাকে দুপুরের খাবার না খাইয়ে ছাড়ে না। খাবার খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যখন বের হতে যাচ্ছিলো, তখন সে দেখলো রিজা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসেছে তার দিকে। সে আশা করেছিল মায়া আসবে। কিন্তু মায়ার একটা কল আসায় সে তার রুমের ভিতরে চলে গিয়েছিল। সোহাগ মন খারাপ করে যখন লিফটে উঠে লিফটের দরজা লাগিয়েই দিচ্ছিলো, তখন মায়া ছুটে এসে লিফটে ঢুকে পড়ে। সোহাগ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে মায়া বলে,”আমার বান্ধবী আসছে নিচে। ওকে নিতে নিচে যাচ্ছি ভাইয়া।”
সোহাগ মুচকি হেসে লিফটের দরজা বন্ধ করে লিফট চালু করে দেয়। দুজনের মাঝেই কেউ তেমন কথা বলে না। শুধু একবার সোহাগ বলে,”ভালোভাবে পড়াগুলো শেষ করো মায়া। প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করলে জমে থাকবে না কিছুই।”
মায়া শুধু প্রতিউত্তরে মুচকি হাসে।
★★★
এদিকে কবিতা কাব্যকে জোর করছে যাতে সে তাকে লিফটে করে মায়াদের বাসার সামনে পর্যন্ত দিয়ে আসে। মুখে কাব্য না না বললেও মনে মনে চাইছে মায়াকে দেখে আসতে। তাই একটু জোরাজোরি করতেই সে রাজি হয়ে যায়। লিফটের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পায় লিফটটা নিচের দিকে নামছে। কাব্য কবিতাকে বলে,” তুই তো মোটা হচ্ছিস। সিড়ি দিয়ে উঠলেই তো পারিস।”
“১৩ তলায় তুই উঠতে পারবি?”
কাব্য আর কিছু না বলে সামনের দিকে তাকায়। হঠাৎ গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে থেমে যায় লিফটটা। কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজা খুললে দেখে মায়া আর তার পাশে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটিকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে কাব্য। কবিতা মায়াকে বাইরে বের করে এনে বলে,”কতদিন পর দেখা হলো বান্ধবী। আমাকে তো ভুলেই গেছোস।”
মায়া কিছু বলতেই যাবে কিন্তু তার আগেই সোহাগ বের হয়ে এসে কাব্যকে দেখে বলে,”আসসালামুআলাইকুম বড়ভাই। আপনি এখানে?”
মায়া আর কবিতা অবাক হয়ে যায়। মায়া ভাবে কাব্যকে সোহাগ ভাই কিভাবে চিনে। আর কাব্য হিসাব মিলাতে থাকে এই ছেলে মায়ার সাথে কেন?আর তাকেই বা চিনে কিভাবে?
চলবে…..

কিছুকথা:আমি #আমি_মায়াবতী গল্পের লেখিকা বলছি। আমি কোনো প্রফেশনাল রাইটার নই। শখের বশে অবসরে টুকটাক লিখি। এই গল্পটা যদিও ব্যতিক্রম। এক সম্মানিত লেখিকা আপুর কথায় জেদ করেই গল্পটা শুরু করেছিলাম। নিজেও ভাবিনি যে গল্পটা ৩০ পর্ব পর্যন্ত লিখতে পারবো। আমি জানি গল্পটা নিয়ে অনেকেরই অনেক অভিযোগ আছে। তারমধ্যে একটা হচ্ছে, সাগরিকা এতো ভালো কেন? মূলত গল্পটা সাগরিকারই। সে বেচারি সবকিছু বিসর্জন দিয়ে মায়াকে আপন করে নিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল গগতানুগতিক লেখার বাইরে আলাদাভাবে লিখি। সাগরিকার দিক থেকে গল্পটা শুরু হলে হয়তো শুরুটা মায়ার তার সংসারে আগমন দিয়ে হতো। কিংবা সাবিহার দিক থেকে শুরু হলে হয়তো তার বাবার কুকীর্তি দিয়ে শুরু হতো। আমার মনে হয়েছিল গল্পটা ভিলেনের দিক থেকেই শুরু করি। মায়ার মায়ের কাহিনি দিয়ে। আমি ভেবেছিলাম বড়জোর ৫ পর্বের একটা ছোটগল্প লিখবো। এতোটাও আশা করিনি যে ৩০ পর্ব পর্যন্ত আসতে পারবো। আমি জানিনা আমি মায়াকে আপনাদের কাছে কতোটা তুলে ধরতে পেরেছি। তবে, আমি এইখানে সবার পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কারণ, প্রত্যেকটা মানুষেরই জীবনের গল্প আছে। আমরা সবাই পরিস্থিতির শিকারমাত্র। আমি আপনাদের কাছেই জানতে চাইছি, আমি কি কাব্য আর মায়াকে এইখানেই মিলিয়ে দিব নাকি কাহিনি টেনে নিয়ে যাবো? মতামত আপনাদের।
তবে হ্যাঁ, সেই সম্মানিত আপুকে ধন্যবাদ। আমি তার ফ্যান। তার ছোট্ট একটা ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলাম বলে সে আমাকে শুনিয়েছিল নিজে কিছু পারলে করে দেখাও। নিজের চরকায় তেল দাও। আমি সত্যিই তার প্রতি কৃতজ্ঞ।

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৩১
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। আমাকে কিভাবে চিনো?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে কাব্য।
“ভাইয়া, আমি সোহাগ। আপনার জুনিয়র ছিলাম। হলে আপনিই আমাকে একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ”
“অহ, আচ্ছা। কোন ডিপার্টমেন্টে তুমি?”
“পদার্থবিদ্যা। ভাইয়া।”
“এইবার কোন ইয়ারে? ফাইনাল?”
“জ্বি, ভাইয়া। আমি আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। সেইরাতে আপনি না থাকলে আমি হয়তো শেষই হয়ে যেতাম।”
“বাদ দাও পুরোনো কথা। এখানে কি করছো?”
সোহাগ উত্তর দেওয়ার আগে মায়া বলে,”স্যার, উনি আমার কাজিন। আমাকে প্রাইভেট পড়াতে এসেছিল। ”
“অহ, আচ্ছা।”
“স্যার, আমাদের বাসায় চলুন না। ”
“নাহ, আজ না মায়া। অন্য কোনোদিন। কবিতা, মায়া তো নিচেই এসেছে। তুই চলে যা ওর সাথে। ”
“আচ্ছা, ভাইয়া।”
সোহাগ মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”আসি, মায়া।”
কাব্য সহসাই সোহাগের দিকে তাকায়। ওর চোখে মায়ার জন্য মুগ্ধতা খুঁজে পাচ্ছে সে। বিরক্ত লাগছে তার সোহাগকে। ইচ্ছে করছে ওর নাক ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু চাইলেও সেটা পারছে না।
★★★
“শোনো কবিতা, আল্লাহ যতোদিন যার হায়াত রেখেছে, সে ততোদিনই বাঁচবে এই দুনিয়ায়। আল্লাহ জান কবচ করার জন্য আজরাইলকেই পাঠায়। কোনো মানুষকে না। তোমার মায়ের মৃত্যুতে তোমার কোনো কিছুই করার ছিল না। তুমি নিজেকে কেন দোষী ভাবছো?”
“আন্টি, বাবা আমাকেই দায়ী মনে করেছে মায়ের মৃত্যুর জন্য। আমাকে কোলেও নেয়নি। আদরও করেনি। জন্মের পর আমাকে দেখেও নি। আম্মুই আমাকে নিয়ে এসেছিল।” কাঁদতে কাঁদতে বলে কবিতা।
“তোমার বাবা ভুল ছিল কবিতা। আমরা কেউই কারো মৃত্যুর জন্য দায়ী নই। আমরা দুনিয়ায় আসি নিজেদের হক নিয়েই। আল্লাহ জন্মের আগেই আমাদের রিজিক লিখে রেখেছে। যেমন ধরো, তুমি এই যে খাবারটা খাচ্ছো, সেটা আমি রিজার জন্য প্লেট এ তুলে রেখেছিলাম। রিজা বলেছিল পরে খাবে। কিন্তু মায়া তোমাকে এই খাবারটা দিয়েছে। তুমি যে খাবারটা খাচ্ছো, এইটা তোমার রিজিকে লিখা ছিল। রিজার জন্য হলে, রিজা দুদিন পরেও এই খাবারটাই খেতো। আবার খাবার সময় তুমি মায়াকে যে মাঝেমধ্যে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছো, খাবারের সেই অংশগুলোও মায়ার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে কবিতা। তুমি কক্সবাজার থেকে যে জিনিসগুলো মায়ার জন্য এনেছো, পাশের বাসার ছোট্ট মেয়েটার ভাগ্যেও সেগুলোর কিছু অংশ ছিল। তাই সে আজই আমাদের বাসায় এসেছিল। তুমি এই দুনিয়ায় আসবে, এইটা আল্লাহ চেয়েছিলেন কবিতা। তাই তুমি এসেছো। তুমি যা যা ভোগ করছো, সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছে। তুমি কারো মৃত্যুর জন্য দায়ী নও। না তোমার মায়ের জন্য, না তোমার ভাই-বোনের জন্য। তুমি কোনো কিছুর জন্যই দায়ী নও।” কবিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে সাগরিকা।
“কিন্তু আন্টি, আমার জন্যই নতুন মায়ের জীবনটা এমন হয়ে গিয়েছে। আমার জন্যই দাদী এমন করেছে।”
“সেটা তোমার দাদীর দোষ।তুমি কি তোমার দাদী কে বলেছিলে এইসব করতে?বলোনি। সে ভুল ছিলো। তার অতিরিক্ত ভালোবাসা তোমাদের সবার জীবনকে এইভাবে গুড়িয়ে দিয়েছে। সে শুধু ভুলই করেনি, সে পাপও করেছে। একটা মাসুম বাচ্চাকে এই দুনিয়ার আলো দেখা থেকে বঞ্চিত করেছে। একটা মায়ের মন ভেঙেছে। আল্লাহ তাকে কখনোই ক্ষমা করবে না।”
মায়া বলে,”এইসব ভেবে মন খারাপ করিস না কবিতা। জীবনে এইরকম অনেক সময় আসবে যখন কোনোকিছুই হাতের নাগালের মধ্যে থাকবে না। কিন্তু আমাদেরকেই আমাদের যত্ম নিতে হবে।”
“খেয়ে নাও মা। খাবার সামনে রেখে কান্না করতে হয় না। আল্লাহ নারাজ হন।”
“আম্মা, ফুপি কোথায় গিয়েছে? ”
“তোমার বাবার সাথে কোথায় যেন গিয়েছে। আসতে সময় লাগবে বলেছে।”
“মামী, সাবিহা সাব্বির কখন আসবে?”
“ওদেরও আসতে সময় লাগবে। ওদের স্কুলে অনুষ্ঠান আছে।”
“অহ।”
কবিতা আফসোসের সুরে বলে,”ইশশ! তোর ভাইকে আজ দুটো ভালোবাসার কথা বলতে পারলাম না। কি জ্বালা, কি জ্বালা।”
কবিতার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে সবাই।
★★★
“ভাইয়া, তুই মায়ার কাজিনকে চিনিস নি তাইনা?”
কাব্য মুচকি হেসে বলে, “না, চিনি না আমি। কত ছেলেকেই তো সাহায্য করেছি। র‍্যাগিং এর হাত থেকে বাঁচিয়েছি। হবে হয়তো ওদের মধ্যে থেকে কেউ একজন। ”
কবিতা হাহা করে হাসতে থাকে।
“হাসবি না মূর্খ।”
“হাসবো না তো কি করবো? যখন তুমি চিনোই না, তাহলে শুধু শুধু কেন নাটক করতে গেলে? নাকি আমার বান্ধবীর সামনে নিজের স্মরণশক্তির পরীক্ষা দিলে?” ব্যঙ্গ করে বলে কবিতা।
“আরেহ, বাজে কথা বলিস না। এইরকম কোনো বিষয় না। একজন মানুষ যেখানে আমাকে সালাম দিয়ে এতোটা সম্মান দেখাচ্ছে, তাহলে আমারও তো উচিত তাকে সম্মান দেওয়া। তাইনা?”
“হুমম। তা অবশ্য ঠিক। কাজটা তুই অবশ্য ভালোই করেছিস।”
“হুমম। আমি তো আর বাকিদের মতো মূর্খ না। আমার তো জ্ঞান আছে।”
কবিতা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,”অপমান করবি না বলে দিচ্ছি কিন্তু। ”
“কি আশ্চর্য, আমি কি তোকে বলেছি নাকি? তোর এতো জ্বলছে কেন?
” আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি? আমার দিব্বি? ”
“তুই আর কি এমন জিজ্ঞেস করবি যে দিব্বি লাগবেই?”
“আগে বল সে সত্য বলবি?”
“আচ্ছা, বলবো। প্রশ্নটা তো কর আগে।”
“তুই কি মায়াকে ভালোবাসিস?”
কাব্য থ হয়ে যায় কবিতার কথা শুনে। কি বলবে এইবার সে? এই মেয়েকে একবার বলে দিলে তো আর সিক্রেট থাকবে না কোনোকিছুই। মায়াকে জানিয়েই দিবে।
“ভাইয়া বল না প্লিজ?”
“বাজে কথা বলিস না তো।”
“তুই কিন্তু আমার দিব্বি দিয়েছিস। আর দিব্বি দিলে কি হয় জানিস তো? যার নামে দিব্বি দিবি, সে মরে যাবে।”
“এইসব ছেলেমানুষী চিন্তা ভাবনা বাদ দে।”
“তাহলে তুইও বল।”
কাব্য আর কোনো উপায় না পেয়ে বলে দেয়,”হ্যাঁ, তোর বান্ধবীকে আমি ভালোবাসি। ”
কবিতা আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠে বলে,”সত্যিই? আমি জানতাম এমনটাই হবে। সত্যি করে বল তো, ওর কিডন্যাপ এর দিন তুই কোনো স্টুডেন্ট পড়াতে যাস নি তাইনা? ওর পিছু নিয়েছিলি?”
কাব্য মাথা চুলকে বলে,”হ্যাঁ। ”
“তুই ওকে ফলো করেছিলি, তাই ওর বাড়ির এড্রেস তুই জানতি। তাইনা? ওকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে আসার দিন ওর কাছে জানতেও চাসনি ওর বাসা কোথায়। তাইনা?”
“হুমম। তুই কি এখন ওকে বলে দিবি? বলিস না প্লিজ। আমি বলবো ওকে।”
কবিতা আর কিছু বলতেই যাবে কিন্তু তার আগেই ওদের মা এসে বলে,”কবিতা, বাবা এসেছে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে।”
কবিতা কাব্যকে একটা চিমটি দিয়ে ছুটে আসে ড্রয়িংরুমের দিকে। বাবা, বাবা চেঁচাতে চেঁচাতে এসে দেখে ড্রয়িংরুমে তার নিজের জন্মদাতা বাবা বসে আছে। তাকে দেখেই তার মুখটা কালো হয়ে যায়। কবিতাকে দেখে তার বাবা উঠে তার কাছে এসে বলে,”কেমন আছিস মা?”
কবিতা পিছনে ফিরে দেখে ইতোমধ্যে কাব্য আর মা এসে দাঁড়িয়েছে। কবিতা আর কিছু না বলেই ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। আর এইদিকে তার নিজের বাবা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এইটাই কি তবে তার প্রাপ্য?
★★★
“এই করিডোরে কি করছো মায়া?”
মায়া পিছনে ফিরে দেখে সেখানে কাব্য স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। মায়া তাড়াতাড়ি সালাম দিয়ে বলে,”এমনিই স্যার একটু কাজ ছিল।”
“তোমার সাথেরটা কই?”
“ও একটু ওয়াশরুমে গিয়েছে।ঐ তো আমাকে এইখানে এনেছে।”
“অহহ, তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“এইতো, চলছে ভালোই।”
“ফিজিক্সে অনেক দূর্বল নাকি?”
“আসলে হ্যাঁ, অনেকটাই। স্কুলেই ঘাটতি ছিল ফিজিক্স এ। এখন তাই কভার করতে প্রবলেম হচ্ছে।”
“জীববিজ্ঞানের কি খবর? আমার সাব্জেক্ট? তোমরা ভালো রেজাল্ট না করলে তো এর দায় আমাকেই নিতে হবে।”
“জীববিজ্ঞানের অবস্থা ভালোই স্যার। আপনি ক্লাসে তো ভালোভাবেই বুঝাচ্ছেন। সেটুকুই যথেষ্ট। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টই করেছি এই বিষয়ে।”
“অহ, হ্যাঁ। তারপরও যদি সমস্যা হয়, আমাকে বলো। আমি সাহায্য করে দিবো। আর না হলে আমার কিছু ফ্রেন্ড কোচিং সেন্টার চালাচ্ছে, সেখানে কথা বলে দেখতে পারো।”
মায়া হেসে বলে,”এখন না স্যার। ফিজিক্স একটু আয়ত্তে আসুক। তারপর। বাকি সাবজেক্টগুলো মোটামুটি ভালোই পারি।”
কাব্য আরো কিছু জিজ্ঞেস করতো হয়তো কিন্তু তার আগেই কবিতা এসে পড়ে। কবিতা মায়াকে নিয়ে যাওয়ার সময় পিছন ফিরে ইশারায় কাব্যকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলে কাব্য দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয়। কবিতা রেগে গিয়ে মায়াকে বলে,”জানিস মায়া, আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা হচ্ছে মানুষরুপী গরু। তাদের দিয়ে কোনো কাজই হয় না।”
মায়া কবিতার কথা না বুঝেই হাহা করে হাসে। আর কাব্য অপমানিত হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
★★★
“আমাকে কি তোর পিয়ন মনে হয়? আর আমি কি মাগনা কাজ করমু?” রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কাব্যকে বলে কবিতা।
“আরেহ, বইন। বোঝার চেষ্টা কর। তুই পিয়ন কেন হবি? তুই শুধু দেখবি ঐ সোহাগ বেডায় যেন কোনো সুযোগ না নিতে পারে। আর তোরে মাগনা কাজ করাবো কেন আমি? তোরে প্রাইভেট পড়ার টাকা আমি দিব। আর তোরে রোজ আনা নেওয়ার দায়িত্বও আমার।”
“তোমার ধান্দা বুঝি না আমি, তাইনা? এইগুলো তো তুই তোর জন্য করবি। আমার জন্য কি করবি? মানে বিনিময়ে আমি কি পাবো?”
“তোরে প্রতিদিন একটা করে ডেইরি মিল্ক খাওয়াবো। ”
“শুকনো কথায় চিড়ে ভিজে না রে কাব্য। দামী কিছু বল।”
কাব্য শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বলে,”তুইই বল কি চাস তুই?”
কবিতা একটা বিটকেলে হাসি দিয়ে বলে, “বেশি কিছু না ভাই আমার। শুধু সপ্তাহে দুদিন চাইনিজ খাওয়াবি।”
“দুদিন বেশি হয়ে যায় না? একদিন ভালো হবে না?”
“তুই কি চাস আমি মায়াকে সবকিছু বলে দিই?”
কাব্য মুখ গোমড়া করে বলে, “আচ্ছা, দুইদিন।”
“এইতো, আমার ভালো ভাই।”
“এতো পাম্প দিতে হবে না। তুই এখন মায়াকে কল দিয়ে বল যে তুই ওর সাথে ফিজিক্স পড়তে চাস।”
“এখনই দিতে হবে?”
“হ্যাঁ, এখনই দিতে হবে।”
চলবে….