#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৫
প্রত্যয় ফিরে এলো আধা ঘণ্টা পরেই। সদর দরজা ডিঙিয়ে ঢুকতেই সোফায় আধশোয়া হয়ে মুখের ওপর বই নিয়ে জোরেশোরে অনর্গল পড়তে থাকা মেয়েটাকে দেখল এক নজর। মেয়েটাও কারো উপস্থিতি টের পেয়ে বইটা মুখের কাছ থেকে কিঞ্চিৎ সরিয়ে আঁড়চোখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যাওয়া ছেলেটাকে দেখতে থাকল। নিশ্চয়ই আজও মৃন্ময়ীর কাছ থেকে রিজেক্ট হয়ে এসেছে? অনুমান করে নিল সে। এটা আর নতুন কি?গত কয়েক মাস যাবত অনবরত এটাই চলে আসছে। আজ ক্লাসে একটা পরীক্ষা আছে তাই আবারও পড়ায় মনোযোগ দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাল ঊষা। প্রতিদিন সকালে ড্রইং রুমের এই সোফাটায় আধশোয়া হয়ে না পড়লে ওর কোনো পড়াই মাথায় ঢুকে না। অবশ্য এ ধারণাটা ওর নিজের বানানো। ডাক্তারি না পড়ে যদি রাতারাতি সাইন্টিস্ট হতে পারত তাহলে এই ছাইপাঁশ মেডিসিনের নাম মুখস্থ করতে হতো না ওর দিন রাত, ঘুম টুম সব বাদ দিয়ে। একটা অক্ষর উচ্চারণ করতেই মুখটা তেঁতো হয়ে উঠল। উঠে বসে বইটা রাখল একপাশে। এটা আজ আর ধরবে না। বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেলে মুখ তেঁতো হওয়াটা অস্বাভাবিক না। নিমিষেই বক্ষস্থল চিরে আসা একটা লম্বা নিঃশ্বাসে পরিবেশ টা কেমন ভারি ভারি হলো। পা চালাল ঊষা রান্নাঘরের দিকে। চা বানিয়ে খেয়ে মাথার সকল চিন্তা দূর করতে হবে। আজ মা থাকলে ঘুম না ভাঙতেই চা হাজির হয়ে যেত,এখন যেহেতু মা নেই গত একটা বছর ধরে নিজের কাজ নিজেই করতে হয়। কাউকে বলে বলে কিছু চেয়ে নিতে ভালো লাগে না ওর। এক কাপ চা বানানোর ইচ্ছে নিয়ে রান্নাঘরে আসলেও দু’কাপ বানাল,আরেক কাপ কফি বানাল। চায়ের কাপ নিয়ে প্রথমে এলো বাবার রুমের সামনে। এই মানুষটাও তো একা।
দরজা খোলা দেখে নক করতে হলো না ঊষার। মোশতাক সাহেবের আজকে একটা মিটিং আছে। উনার মেয়র পদের আয়ু ঘনিয়ে এসেছে। ভাইয়ের দুই ছেলেই এখন সম্বল। উনি চান না ক্ষমতা কোনো ভুল মানুষের হাতে পড়ুক। নিজে এতকাল রাজনীতি করেছেন সবসময় চেয়েছেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে। তবুও ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে তিনি থাকতে পারেন নি। মানুষ বলে কথা। কিন্তু জেনেশুনে কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন সেটা সহ্য হবে না উনার। আজকের মিটিংয়ে প্রহর,প্রত্যয় দুই ভাইয়ের থাকা জরুরি। কিন্তু প্রহরকে কল দিতে গিয়ে থামলেন তিনি। উনি এক প্রকার ঠ্যালে প্রহরকে গ্রামে পাঠিয়েছেন কিন্তু এখন একদিন না পেরুতেই আবার চলে আসতে বলবেন এটা অনুচিত ঠেকল। প্রহর নিজ থেকে যেতে চায় নি,নিজেই পাঠালেন। ঊষা বাবার সামনে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি কন্ঠে আদেশের সুর তুলল,
” ধরো বাবা। ”
” কি রে পড়া ছেড়ে চা বানাতে গেলি কেন?কাজের লোকদের বললেই হতো। ”
” এত পড়ে কি হবে বাবা?”
” অনেক বড় ডাক্তার হতে হবে। ”
” বড় ডাক্তার হয়ে কি করব?”
“বড় ডাক্তার হয়ে মানুষ কী করে?মানুষের চিকিৎসা করবি। ”
” যে নিজেই রোগী সে অন্যের চিকিৎসা কী করে করবে বাবা?”
মোশতাক সাহেব বিমূঢ় দৃষ্টে তাকালেন মেয়ের হাসোজ্জল মুখ পানে। কঠিন,গভীর ধাঁচের কথা বলছে অথচ একটুখানি মোটা দুই অধরে মুক্ত ঝরা হাসি। উনার বুঝতে বাকি রইল না তাঁর মেয়ে ঠিক কতখানি স্ট্রং। তিনিও বিরস মুখে হাসি টেনে বললেন,
” পৃথিবীতে সব শূন্যস্থান পূরণ হয় না রে মা। কারো মনের ওপর আমাদের জোরও চলে না। তাই মানিয়ে নিতে শিখলে জীবন সুন্দর। ভ”য়ং”কর সুন্দর। ”
” জানি বাবা। প্রত্যয় ভাইয়ের জন্য কফি বানিয়েছি, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আরেকটু থাকলে বরফ হয়ে যাবে,পরে আমার মুখে মে”রে বসবে। মৃন্ময়ীর ওপর জেদের শিকার আমি হয়ে যাব। আসি,আসি। ”
ঊষা তাড়াহুড়ো করে পা চালিয়ে প্রত্যয়ের রুমে ঢুকল। ইতোমধ্যে সৌষ্ঠবপূর্ণ দেহ বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে প্রত্যয়। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বেড সাইড টেবিলে কফির কাপ টা রেখে ও একটু হেয়ালি করল,
” আজও ব্যর্থ হয়ে ফিরেছে বুঝি ব্যর্থ প্রেমিক?”
প্রত্যয় বালিশ থেকে মুখ তুলে তাকায় তাৎক্ষণিক। চাহনি রোষপূর্ণ। গর্জে উঠল সে,
” চোখের সামনে থেকে যা। ”
ঊষা কেঁপে উঠল মৃদু। বিড়বিড় করল,
” এটা না বললে তো রেসপন্স করতে না,তাই বাধ্য হলাম। কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ”
” তোর কফি তুই গিল। ”
” মৃন্ময়ী বানিয়ে দিলে ঠিকি গিলে নিতে। ”
অত্যন্ত নিচু কন্ঠে কথাটা বলল ঊষা। গটগট করে বেরিয়ে পড়ল। প্রত্যয় সবসময় ওর ওপর রাগ ঝাড়ে। শুনেছে,মানুষ তার রাগ বিশেষ মানুষের ওপর দেখায়। কিন্তু সে তার প্রত্যয় ভাইয়ের বিশেষ কেউ না। প্রত্যয় ভাইয়ের সমগ্র সত্তা জুড়ে কেবল মৃন্ময়ী নামের মেয়েটার বসবাস। রুমে এসে সবকিছু গুছিয়ে একটা থ্রি পিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ওড়না টা গলায় জড়িয়ে সাদা এপ্রোন টা হাতে নিল। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিচে এসে দেখল এক সুদর্শন পুরুষ চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে তীব্র এটিটিউড নিয়ে গাড়িতে এক হাত ঠেকিয়ে অন্য হাতে মোবাইল ধরে রেখেছে। সানগ্লাসের আড়ালে লুকায়িত চক্ষুদ্বয়ের দৃষ্টি মোবাইলের স্ক্রিনে তড়তড় করে বুঝল ঊষা। সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস বিমোচন করে চলে যেতে নিলে কঠোর কণ্ঠে বাঁধা আসে,
” গাড়িতে উঠ। আমি নামিয়ে দেবো ডিএমসির সামনে। ”
ঊষা চকিতে প্রত্যয়ের দিক তাকাল। দৃষ্টি চমকপ্রদ। এ যেন জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্ন। এত বছর ধরে এখানে আছে কিন্তু কখনো কোথায়ও নিয়ে যাবার কথা বলে নি। এক বছর পূর্বেও বেশ আবদার করে বসত। হুটহাট করে বলত চলো না প্রত্যয় ভাই মেলায় যাই,আজ ফুচকা খেতে বের হই,রাতে নিরব রাস্তায় হাঁটাতে নিয়ে যাও। কিন্তু যেদিন থেকে মৃন্ময়ীর আগমন ঘটেছে ও যথাসাধ্য চেষ্টা করে প্রত্যয় এর কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার। প্রচন্ড বেগে তুফান আসলে আসুক হৃদয়মাঝে তবুও প্রত্যয় সুখী হোক। আকস্মিক মন চায় মৃন্ময়ীকে বুঝাতে, বলতে, ‘ আমার প্রত্যয় ভাইকে একটু ভালোবাসো মৃন্ময়ী। তোমাকে না পেয়ে উনি কষ্ট পাচ্ছেন। বুকের ভেতরটা কেমন করে জানো?কেমনে জানবে?জানতে হলে ভালোবেসে দেখো। ভালোবাসা টা যেন ভ”য়ং”ক”র হয়। ”
ক্ষীণ স্বরে বলল,
” আমি যেতে পারব। ”
প্রত্যয় মোবাইলটা পকেটে রেখে গাড়ির দরজা মেলে দুর্বোধ্য হাসল।
” গাড়িতে উঠুন মিস ঊষা। মেয়র সাহেবের মেয়েকে গাড়িতে উঠিয়ে যদি আমার পদোন্নতি হয়!সেই আশা বিফলে যেতে দিবেন না ম্যাম। অধম কে সক্ষম হতে সাহায্য করুন। ”
ঊষা নরম ধাঁচের মেয়ে। চঞ্চলতা ওর মধ্যে বিরাজ করে না। কেউ একটু মায়াময় সুরে ডাকলেই ওর হৃদয়স্থল নড়ে ওঠে। ময়ূরের ন্যায় পেখম মেলে নাচতে ইচ্ছে করে। তবে এ যাত্রায় বিব্রতবোধ করছে ও। বিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করে,
” কি সব বলছ?”
প্রত্যয় আদুরে স্বরে জবাব দিল,
” গাড়িতে উঠ পুষি। সকালে ধ”ম”কেছি তার জন্য সরি। আয় তোকে নামিয়ে দেবো মেডিক্যালে। ”
এতক্ষণে কথার মানে মস্তিষ্ক ধরতে পারল। ঊষার ছুটে গিয়ে বসে যেতে মন চাইছে। পুরোনো অনুভূতি মাথা চারা দিয়ে ওঠে। কিন্তু নিজেকে ধাতস্থ করে নিল। একটু আধটু ত্যাড়ামো করে উচ্চস্বরে বলে উঠল,
” আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। তোমার সাথে গেলে ব্রেকআপ হয়ে যাবে। পরে ডাক্তার বর নাও পেতে পারি। তোমার মতোন রাজনীতিবিদ, ছ্যাঁকাখোর প্রত্যয় ভাই আমার খুব খুব অপছন্দ। ”
কথাগুলো বলে দৌড়ে গেইট পেরিয়ে গেল ও। রিকশা পেয়ে ঝটপট ওঠে বসল। হোক না বাবা মেয়র,সিধেসাধা জীবন ওর অত্যন্ত প্রিয়। কি করবে জাঁকজমকপূর্ণ জীবন নিয়ে? ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার যন্ত্র-ণা নিয়ে তার বাঁচতে হবে চিরকাল। দু চোখ ভরে সেই মানুষ টার সান্নিধ্যে দেখতে হবে অন্য এক অপরূপা রমণী কে। বিষাদ, বিষাদ। এত বিরস কেন চারপাশ?
——————————–
আজ প্রত্যুষে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে মেদিনীতে। সেই সুবাদে স্কুলে যাওয়ায় নিষেধ সাইনবোর্ড টানায় রোকেয়া বেগম। নিশাত বৃষ্টিতে ভিজে কনকনে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে স্কুলে যেতে এক পায়ে খাঁড়া। কিন্তু রোকেয়া কোনোমতেই দিলেন না। এর পেছনে একটা কারণ রয়েছে। যতবারই বৃষ্টিকালে স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে নিশাত মাঝ পথে বোয়াল মাছ ধরে বাড়ি ফিরে এসেছে।
এটা ওর ছোটবেলা থেকে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। মানুষ হেসে বলে বেড়ায় নিশু ছোটবেলায় ভালো করে হাঁটা শিখে নি। হাঁটতে পারে না। মেয়েকে নিয়ে প্রখর চিন্তা রোকেয়ার। সেদিনও বোয়াল মাছ নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। এত বড় মেয়ে রাস্তাঘাটে পিছলে পড়লে মান সম্মান থাকে?গ্রামের মানুষজন যা,একটু একটা মেয়েকে সেজেগুজে বেরুতে দেখলে ফিসফিসের বন্যা বয়ে যায়। এমন হলে মেয়েকে ভালো ঘরে দিতে পারবেন না। বড় হয়েছে, দু’দিন বাদে কলেজে উঠবে গ্রামে এতটুকুই পড়ালেখা ঢের। ভার্সিটিতে পড়ার জন্য নিশাতকে শহরমুখী করার কোনো ইচ্ছে উনার নেই। পাত্র পছন্দ আছে,টেন পাশ টা করলেই রফিক আজমের সমুখে পাত্রের গুণগান টা গাইবেন বলে ঠিক করে রাখলেন।
কিন্তু নিশাতের মনে জল। কারণ শরৎকালে হুটহাট হাজির হওয়ার বর্ষার কারণে শুভ্র কাশবনে দুঃখরা বাসা বেঁধেছে। নুইয়ে পড়েছে কাশফুল। দুলছে না হয়ত মনের সুখে। আজ আর যাওয়া হবে না তার। বাহিরে রোদ ওঠেছে। বিষন্ন মনে ওর অভিলাষ জাগ্রত হয় মিষ্টি পান খাওয়ার। চুলটা খোঁপা করে বিছানা ছাড়ল। বইয়ের ভাঁজ থেকে বিশ টাকার নোট টা বের করে ছুটল মা’য়ের ঘরের দিকে। দরজার আড়াল থেকে উঁকি দিতে দেখেই রোকেয়া কাঁথা সেলাই করছেন। এটাই বুঝি মুখ্যম সুযোগ। মা একবার কাঁথা সেলাইয়ে মনোনিবেশ করলে দিন দুনিয়া ভুলে বশে। এটা ভারী শখের কাজ তাঁর।
টাকা নিয়ে রাস্তায় আসতেই টুনি কে পেয়ে গেল। পায়ে কাঁদা মেখে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলছে। ওকে ডেকে ঘু”””ষ দেওয়ার নাম করে সঙ্গে বাজারে নিয়ে আসে। একটা চকলেট দিয়ে চিঠির কথা বের করা যাবে। কিন্তু বাজারের কাছাকাছি এসেই দম বন্ধ হবার অভিপ্রায় তার। চাহনি নিশ্চল। চোখের পলক পড়ছে না। ধরে আসা গলায় মিনমিন করল,
” না,না এটা করবেন না প্রহর ভাই। ”
#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)