প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব-০৭

0
731

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৭

ঘাড়ে হাত চেপে নিচে বসে পড়ল নিশাত। সমস্ত পরিবেশ থমথমে। রোকেয়ার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। মেঝো কাকির হাত থেকে লাঠি পড়ে গেল। দিকবিদিকশুন্য হয়ে নিশাতকে ঝাপটে ধরলেন তিনি। ব্যগ্র কণ্ঠে অনবরত কান্না মিশ্রিত বাক্যগুলো আওড়াতে লাগলেন,

‘ ব্যথা পাইছস মা?কেন আসতে গেলি ওই অ”সভ্য মাইয়ারে বাঁচাইতে? কাকি দেখি নাই রে,ক্ষমা করে দে নিশু। ‘

রোকেয়া নিষ্পলক, স্থির চেয়ে আছেন। তাঁর যেন হুঁশ নেই। নিশাত ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে এনে আখিঁদ্বয়ের সমুখে ধরে। অচিরেই চক্ষুগোচর হয় গাঢ় লাল বর্ণের রক্ত। সাথে সাথে দুই চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়ে। একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে কাকির কোলে। রোকেয়ার অকস্মাৎ মনে হলো তাঁর মেয়ে রক্ত দেখতে পারে না। দেখলেই বেহুঁশ হয়ে যায়। রক্তে ফোবিয়া আছে নিশাতের।

পিংকির মেজো বোন ইলমি দৌড়ে গিয়ে বাহিরের টিউবওয়েল থেকে বালতি ভরে পানি নিয়ে আসল। রোকেয়া জানেন পানি দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরলেও নিশাতের দেহের কাঁপুনি কমবে না। দ্রুত পায়ে ঘরের ভেতর ছুটে এলেন তিনি। মোবাইল খুঁজে ফোন লাগায় সৌরভের উদ্দেশ্যে। সৌরভ ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

‘ হ্যাঁ মা বলো। ‘
রোকেয়া জিহ্বা দিয়ে শুকনো ওষ্ঠ যুগল ভিজালেন। কাতর স্বরে বললেন,
‘ বাজারের ডাক্তার নিয়ে আয়। নিশু রক্ত দেখে বেহুঁশ হয়ে গেছে। ‘
সৌরভ আঁতকে উঠল,
‘ কি বলছো?রক্ত কোথায় দেখল?কার কি হয়েছে? ‘
‘ তোর কাকি পিংকিরে মা”রছিল। লাঠি নিয়া পিংকিরে মা”রতে গেছিল ভুল কইরা নিশুর ওপরে পইড়া গিয়া ওর ঘাড় কাইটা গেছে। ‘

সৌরভ দু’টো ঝাটকা সামলে নিতে ব্যপক সময় লাগাল। কলটা ডিসকানেকটেড হলো ততক্ষণে। বক্ষস্থলের অসহনীয় ব্যথায় ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কাকি পিংকিকে কেন মা র ল?না জানি কি অঘটন ঘটিয়েছে মেয়েটা!

রোকেয়া পুনশ্চঃ কল লাগালেন সৌরভকে। অপরপাশ থেকে চিন্তিত কণ্ঠস্বর কর্ণকুহর হলো,
‘ আম্মা বাজারে ডাক্তার নেই। এখন যদি নিশু কে উপজেলা নিয়ে যাই আব্বা জেনে ফেলবেন। পরে আরও অশান্তি হবে। ‘
‘ তাহলে এখন?’

রফিক আজম মেয়েদের গায়ে হাত উঠানো পছন্দ করেন না। তাছাড়া মেয়ে উনার প্রাণভোমরা তা সবার জানা। সেই শৈশবকাল থেকে মেয়ের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগতে দেন নি উনি। বাজার পথ ব্যবহার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে এক কান, দুই কান করে রফিক আজমের কান অবধি পৌঁছাবে ব্যাপার টা। ব্যবসায়িক কাজে শহরে গিয়েছেন তিনি ও পিংকির বাবা। থাকবেন চার পাঁচেক দিন। রবিন কাকা স্কুলের কিছু কাজে থাকায় বাড়িতে আসেন নি এখনও। সৌরভ ভেবে বলল,
‘ আম্মা আলতা ফুপুরে খবর দিলে কেমন হয়?’

তৎক্ষনাৎ রোকেয়ার কণ্ঠ ভেদ করে ভয়মিশ্রিত একটা বাক্য উন্মুক্ত হয়,’ কি বলছিস?তোর আব্বা এটা জানলে আমাকে তালাক দিবে। ‘

বক্ষস্থলের যন্ত্রণা সমেত ঠোঁটে মৃদু হাসি ফোটে সৌরভের। গলা খাদে নামিয়ে বলে,’ তুমি কিন্তু এর আগেও অনেক বার ফুপুকে লুকিয়ে বাড়িতে এনেছ আম্মা। ফুপুর প্রতি তোমাদের ভালোবাসা আমার অজানা নয়। ‘
‘ কিন্তু—
‘ ফুপু ছাড়া এখন অন্য উপায় দেখছি না। এক কাজ করো নিশুকে স্মরণিকা নিবাসে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। ফুপুর কাছে কিছু সময় থাকলে সুস্থ হয়ে যাবে ও। বাবা কিছু জানবেন না। ‘
‘ আমি কিভাবে পাঠাব?মেয়েটার খিঁচুনি শুরু হয়ে যাবে। ‘
‘ আমি ওই বাড়ি যাই না আম্মা। ‘
‘ রবিন ফিরতে এখনও অনেক দেরি। আমি দেখি আলতাকে ফোন করে। ‘
ঝটপট কলটা কেটে স্মরণিকা নিবাসে ফোন দিলেন রোকেয়া। ভাগ্য সহায় বলে সঠিক মানুষ টাই কলটা রিসিভ করেছে নয়ত ভেজাল লেগে যেত। এ মুহূর্তে চাইছেন না কেউ জানুক উনি ফোন দিয়েছেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন,

‘ একটু এ বাড়ুি আসবি আলতা?তোর ভাইঝি আবারও রক্ত দেখে বেহুঁশ হয়ে গেছে। ‘

আলতার কণ্ঠ রোধ হয়ে এল যেন। বহু কষ্টে আওড়ালেন,
‘ আবার?মেয়েটার রক্তে এত ভয় কেন!সৌরভ কে বলো আগের বার যে ইনজেকশন টা আনিয়েছিলাম সেটা আনতে। আমি এক্ষুণি আসছি। চিন্তা করো না। ‘

পেশায় ডাক্তার আলতা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরিরত আছেন। আজ রাত্রিতে ডিউটি নেই বলে যেতে হয় নি। সকালের শিফটে ছিল ডিউটি। সেটা সেড়ে এসেছেন। শিমুল নিজ কক্ষে বসে ধীরস্থ গতিতে কিছু লিখছিল। মায়ের ডাকে ভাঁটা পড়ে তাতে। ডায়েরি টা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। আলতা বেগম মেয়ের আতঙ্ক মিশ্রিত চেহারা দেখে খনিকের নিমিত্তে থমকে দাঁড়ান। সময় অভাব বলে আমলে নিলেন না। বরং তাড়া দিয়ে বলে উঠলেন,

‘ তাড়াতাড়ি আয়,তোর মামাদের ওইখানে যাব। নিশু বেহুঁশ হয়ে গেছে। ‘
শিমুলের মুখশ্রী পান্ডুর বর্ণ ধারণ করে। পা চালিয়ে প্রশ্ন করে, ‘ কিন্তু মামারা?’
‘ তোর মামী বলেছে পুরুষ লোক কেউ বাড়িতে নেই। এই ফাঁকে ওকে চেকআপ করে চলে আসা যাবে। তাছাড়া তোর বাবা,ভাইও বাড়িতে নেই। আর দেরি করিস না। চল। ‘

পিছনের পুকুর পাড়ের পথ দিয়ে শিমুলকে নিয়ে ছুটে আসেন আলতা। দুই বাড়ির দূরত্ব খুব একটা না। সম্মুখের রাস্তা ধরে আসলে গ্রামের অনেকের চোখেই বিঁধত। এতে রফিক আজম জেনেও যেত। তাই পূর্বেও যতবার ভাবীদের ভালোবাসার টানে এসেছে ক্ষেতের আইল ধরেই পায়ে কাঁদা মেখে আসতে হয়েছে। পুুকুর পাড়ে ওঠে বাড়ির বাহিরের টিউবওয়েল থেকে পা ধুয়ে নিলেন। শিমুল কে নিয়ে পা রাখলেন ভিতর ঘরে। তাঁরই অপেক্ষায় সময় গুণছিল রোকেয়া ও সৌরভ। দেখামাত্র এগিয়ে এলো। শিমুল ফ্যাকাশে মুখে, ঠান্ডা দৃষ্টিতে সৌরভের দিকে তাকাল। গত একটা মাস যাবত সামনাসামনি মানুষ টাকে দেখার সুযোগ হচ্ছে না ওর। কিন্তু সৌরভ ভুল করেও চক্ষু মেলে ওর পানে চাইল না। সরাসরি দৃষ্টি তাক করল ফুপুর দিকে। এত অবজ্ঞা! হৃদয়স্থল মোচড় দিয়ে উঠল শিমুলের। কিশোরী মনটা মুহূর্তে মুষড়ে পড়ল। চলল মায়ের পিছু পিছু নত মস্তকে।

নিশাতের হুঁশ ফিরেছে তবে শরীর কাঁপছে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। রক্ত দেখলেই মেয়েটার এমতাবস্থা হয়। আলতা বেগম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে সৌরভের আনা ইনজেকশন টা দিলেন। ঈষৎ ব্যথায় চোখ, মুখ,নাক কুঁচকে এলো ওর। অক্ষি কোলের কার্ণিশ ছুঁয়ে দুই ফোঁটা রোদনে অল্পখানি ভিজল সাদা কভারের বালিশ। মিনিট দশেক পর দেহের কাঁপুনি কমে গেল। কিঞ্চিৎ শীতল হলো পরিস্থিতি। ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন তিনি গলার কাছের একটুখানি কাটা স্থানে। বিছানার অপর পাশে পিংকির ফরসা হাতে মা”””রের দাগ দেখে অধর যুগল একত্রিত করে আবার আলগা করলেন। ফোঁস করে বেরিয়ে এলো নিঃশ্বাস, হতাশামিশ্রিত তপ্ত নিঃশ্বাস। তাহমিমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ মে””রেছেন কেন মেয়েটাকে?’
পিংকির মা তাহমিমা বিছানায় দুর্বল শরীরে পড়ে থাকা নিশাতের দিক এক পলক তাকালেন। বললেন,
‘ বাহিরে আয়,সব বলছি। ‘

উনার পিছু পিছু রোকেয়া,সৌরভ, আলতা বেরিয়ে আসল। কতকগুলো চিঠি বের করে আলতার সামলে রাখলেন তাহমিমা।
চেহারায় আঁধার নেমে আসে সৌরভের চিঠিগুলো দেখেই। আলতা ভ্রু কুটি করে একখানা চিঠি হাতে নিলেন। নির্জীব দৃষ্টে কাগজের ভাঁজ খুলে মনে মনে পড়লেন,

“ আজ মনে হচ্ছে সব সীমানা লঙ্ঘন করে ফেলেছি পিংকি। এই সীমানা যে আমি কখনও পার করতে চাই নি। তবুও কেমন করে হয়ে গেল। এতে কি দোষ টা আমার? না কি আমার মনের? আমি তো কিশোর নই,নই আবেগের জোয়ারে ভেসে যাওয়া কোনো দুর্বল যুবক। তবে আমার দ্বারা ভুল কেন হলো বল তো?আদৌ কি এটা ভুল?তুই আজ থেকে আর কাছে আসবি না,একদম না। দূরে দূরে থাকবি। দেখি ততদিনে আমি নিজেকে সামলে উঠতে পারি কি না। যদি না পারি তাহলে বাড়িতে যে কঠিন ভয়াবহ ঝড় আসবে। সেই ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে অনেককিছু। ”

চিঠিটা আগের ন্যায় ভাঁজ করে বললেন, ‘ এতে পিংকির কি দো”ষ? চিঠিতে কারো নাম নেই। পিংকির তরফ থেকে প্রেমঘটিত কিছু আছে বলেও মনে হয় না। তাহলে ওকে কেন মা””রবে ভাবি? মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার ফুলের মতে ভাইঝি গুলোর ওপর তোমরা কেউ হাত তুলবে না আর। ‘

তাহমিমা কটাক্ষ করে বলল,’ প্রেম হতে কতক্ষণ বল?প্রেম না থাকলে এগুলো ও যত্ন করে ড্রয়ারে কেন লুকিয়ে রাখত?ওর মনেও কিছু চলছে। আবেগী বয়স কখন কি করে বসে! ভরসা নেই। রবিন আর নিরু যা করেছে এমন আর হোক চাই না। ও কিছুতেই চিঠির মালিকের নাম নিচ্ছে না। কখন আবার অঘটন ঘটিয়ে বসে ঠিক নেই। তোর ভাই এলেই আমি ওর বিয়ের কথা তুলব। বিয়ে দিয়ে দেবো। কলংক গায়ে মাখার আগে বিদায় করে দেওয়া ভালো। ‘

অতীত কভু পিছু ছাড়ে না। মুখ ফসকে হোক কিংবা অনিচ্ছায় অতীতে টান দিলই তাহমিমা। আলতা রোকেয়ার দিক তাকায়। অনুরোধ সূচক কণ্ঠস্বর, ‘ ভাবি আমি মেয়ে দুটোকে আজ আমার বাড়িতে রাখতে চাইছি। শিমুলের সাথে থাকলে ভালো লাগবে দু’জনের। রবিন ওদের খোঁজ করবে না। ওর নিজেরই খোঁজ থাকে না। ওদের শিমুলের সঙ্গে সামনের গেইট দিয়ে পাঠিয়ে দিও। আমি গেলাম। ‘
যাওয়ার পূর্বে আঁড়চোখে একবার ক্লান্ত ভঙ্গিতে চাইল সৌরভের মুখ পানে। বড্ড চিন্তার ছাপ সমস্ত চেহারায়। ফুপুর চাহনিতে থতমত খেল সে।

সায়াহ্নকাল। অম্বর আরক্তিম। স্নিগ্ধ বাতাসে শরতের গন্ধ বইছে। অদূর হতে সমীরণে হৈ হৈ করে মিশেছে তাল মিলিয়ে শেফালির ঘ্রাণ। গ্রামের কাঁচা সড়কপথ টা জনমানবহীন। তিনটে মানুষ ছাড়া কারো পদচিহ্ন পর্যন্ত নেই। কমজোর দেহে হাঁটছে নিশাত। হাঁটার তালে তালে দুলছে বিনুনি। গায়ের হলুদাভ ওড়নাটা গলায় পেঁচিয়ে রেখেছে। আজ প্রকাশ্যে ভাই ও মায়ের কাছ থেকে শিমুলদের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেয়ে আনন্দে টগবগ করছে ভেতরটা। কথাবার্তা হীন পিংকিও এগিয়ে চলছে ওদের সঙ্গে। ফুপুর জন্য অসীম টান নিশাতের। সেই টানের বশে এতটাই ব্যকুল হলো ভুলেই বসল সেই বাড়িতে প্রহর ভাইয়ের বসবাস। বাড়ির গেইটের কাছে আসতেই কথাটা মস্তিষ্কে হানা দেয়। ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। গেলে মা সন্দেহ করবে,ফুপু রাগ করবে। অতএব,চলল নিশ্চুপে। অন্দরমহলে ঢুকে প্রথমত হাঁপ ছাড়ে প্রহরকে দেখতে না পেয়ে। তবে কি চলে গেল ঢাকা?গেলে অবশ্যই আজ রাতটা সেরা রাত হবে। ভাবনা ভেবে নিঃশ্বাস টাও ফেলতে পারল না তার আগেই শ্রবণ গ্রন্থিতে এলো,

‘ খিঁচুনির রাণী এখানে আসলি কেন?তোর খিঁচুনি আমাদের মধ্যে ট্রান্সফার করার জন্য? এত গুণ নিয়ে জন্মেছিস তুই!কিন্তু এই গুণগুলো পুরাই ফালতু। ‘

পাঞ্জাবির ওপরের বোতাম টা খুলে সোফায় বসল প্রহর। সারাদিন মিটিং মিটিং করে অবস্থা বেহাল। মেজাজও চটে আছে। তার মধ্যে আগুনের কাজ করছে নিশাতের চেহারাটা। ভয়ের আভাস স্পষ্টত। শিমুলের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলল, ‘ এই ভীতুর ডিম টাকে আমার সামনে থেকে সরা। নয়তো থা প্পড় দিয়ে ফাটিয়ে ফেলব। ‘

শিমুলের মিনমিনে স্বর,’ তুমি ওকে সবসময় থাপ্পড় দাও ভাইয়া। ‘
সঙ্গেই সঙ্গেই বোনের সাহসী প্রশ্নে নিশাতের দিক চেয়ে নির্লিপ্ত উত্তর দিল প্রহর,

‘ আমার থা প্পড়েই ভালোবাসা। ‘

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)