প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব-১০+১১

0
698

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____১০

কম্পনরত হাতে কুঁচিগুলো মুঠোয় বন্দী রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে নিশাত। ধুপধাপ বাজ পড়ছে বক্ষস্থলে। শরমে মরমে ম-র ম”র অবস্থা। স্বপ্ন, বাস্তব সব এক ঠেকল তার কাছে। আর এখন! এখন শাড়িই রক্ষা করতে পারছে না। পেটিকোট এই পড়ল বলে। প্রহর ভাই চলে গেলে সে শাড়ি টাই একটানে খুলে ফেলবে৷ এত বেই-জ্জতির পর এই শাড়ি তার কোমল গায়ে রাখলে ফোস্কা পড়বে,সমস্ত অঙ্গ ঝ’লসে যাবে। কোনো ফটো মটো লাগবে না ওর।

‘ যা পেটিকোটের ফিতে টাইট করে বেঁধে আয়। ‘
প্রহরের কথা শুনে পিলে চমকে উঠল ওর। আমতা আমতা করে বলল,’ জি?’
রাজ্যের বিরক্তি প্রহরের চোখে মুখে। বেশ অধৈর্য্য ধাঁচের মানুষ সে। বড্ড বেহিসেবী। ধ”মকের সুরে বলল,
‘ মামু ডাক্তার দেখায় না তোকে? কানের চিকিৎসা টা এখনও করায় নি? আহারে! এখনও হাটকা মে রে থাকে?’

ছোটবেলা থেকে নিশাত কানে একটু আধটু কম শুনে। এর কৃতিত্ব অবশ্য প্রহর ভাইয়ের। জীবনের প্রথম থা”প্পড় কি কষিয়েই না পড়েছিল ওর গালে। পাঁচ আঙুল বসে গিয়েছিল। ঘন্টা খানেক ভোঁ ভোঁ শব্দ করেছিল। কোন অপ/রাধে? প্রহর ভাইয়ের দেওয়া চকলেট পাশের বাড়ির এক ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য। সেটাও ক্লাস ফাইভের কথা। সেই থা/প্পড়ে টানা এক সপ্তাহ জ্বরে পুড়ে ম-রে যাওয়ার উপক্রম ছিল তার। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হতো। চারদিকে গোল গোল করে প্রহর ভাই ঘুরে বেড়াত। এই বুঝি কাছে এসে চোখ রাঙিয়ে শাসন করত,

‘ তোর সাহস কি করে হলো আমার চকলেট অন্য কাউকে খাওয়ানোর। তোর দাঁত, হাত সব ভেঙে ফেলব আমি। গুঁড়ো গুঁড়ো করে পাউডার দুধ বানিয়ে গ্রামের পঁচা ডোবায় ভাসিয়ে দেবো। গন্ধা হয়ে থাকবি তুই। গন্ধা নিশু। ‘

প্রহর ভাইয়ের প্রতি তার এত ভীতি এমনি এমনি জন্মায় নি। ছোট ছোট থেকে বিরাট বিরাট ভ”য়ংকর কান্ডকারখানার কারণেই জন্মিয়েছে।

হলদেটে নাকের ডগা লালাভ ধারণ করেছে। টেনে টেনে বলার চেষ্টা করে নিশাত,

‘ আ,,,,আমি শাড়ি খুলে ফেলব। ‘
‘ খোল,ধরে রেখেছে কে?’— নির্বিকার অভিব্যক্তি প্রহরের।
‘ আপনি?’
‘ আমি ধরে রেখেছি? আমি কি তোর শাড়ি ধরার দায়িত্ব নিয়েছি রে? এইটুকু একটা মেয়ের শাড়ি ধরলে আমার মান সম্মান থাকবে? তোর শাড়ি আমি বন্দী রুমেও ধরব না। তোর জামাই লটকে থাকুক তোর শাড়ির আঁচলে। ‘

নিশাত দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কুঁচিগুলো খুলে পেটিকোটের ফিতেটা বাঁধল শক্ত করে। বুকটা কেমন দরাম দরাম করছে। নিজ হাতে এলোমেলো কয়েকটা কুঁচি দিয়ে বেরিয়ে এলো। প্রহর তখনও কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে হাসল,যেন জোকার দেখছে। এমতাবস্থায় থতমত খেয়ে গেল ও। এগিয়ে এসে খুব কাছে দাঁড়াল, খুব খুব সান্নিধ্যে। একটানে ছাড়িয়ে দেয় সব কুঁচি। নিশাতের চেহারার হাল তখন বোকা বোকা। হতভম্ব, হতবাক।

নিজের মতো কুঁচি করে নাভির নিকটস্থে ধরল প্রহর ভাই। গম্ভীর গলায় বলল, ‘ গুঁজতে পারবি?’
মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে ঘূর্ণিঝড় বইছে নিশাতের। সেই ঝড়ে অবশ কায়া। কণ্ঠনালি কাঁপছে। কুঁচি গুলো হাতে নিতে নিতে ভুল একটা উত্তর দিয়ে বসে হৃদয়স্থের উন্মাদনায়,’ পা,,,দব। ‘

ভুলভাল উচ্চারণে লজ্জায় মিইয়ে গেল নিশাত নিমিষেই । কেন? বার বার কেন? কেন প্রহর ভাইয়ের সামনেই দুনিয়ার সব লজ্জায় পড়তে হয় ওকে? শরমে চোখের মণিকোঠায় জল জমল। উল্টো ঘুরে কুঁচিগুলো গুঁজে ফেলল। প্রহর কড়া সুরে আদেশ করল,

‘ একদম পাদবি না আমাদের বাড়িতে। বায়ু নির্গমন করলে বাহিরে গিয়ে করে আসবি। তোদের বাড়ি না এটা। আমি নিশ্চিত তুই পাদলে অনেক গন্ধ, এই পাদের গন্ধ দামি রুম ফ্রেশনারও দূর করতে পারবে না৷ বাপের বাড়ি গিয়ে পাদিস। ‘

নিশাতের বলতে ইচ্ছে করল, ‘ আপনি বায়ু নির্গমন করেন না প্রহর ভাই? বেয়াদব, ছ্যাঁচড়া লোক। এত শয়তান হয় কেউ? সুযোগ বুঝে অপমান করছেন। আমার ফুপুর বাড়িতে আমি হাজার বার পাদব। দরকার হলে আপনার মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেবো সমস্ত বায়ু। ‘

কিন্তু বলার সাহস কই? এই লোক ওকে আছাড় মে রে খতম করে দিবে। শরীরে তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে, সবগুলো লোম দাঁড়িয়ে পড়েছে। লজ্জায় ও অজানা অনুভূতিতে বুঁদ হয়ে স্থির থাকা সম্ভবপর হলো না তার। বড় বড় পা ফেলে শিমুলের বিছানায় শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে মুখ লুকিয়ে ফেলল। অনুভব করল প্রহর ভাই ওর শিথানের নিকটে এসে দাঁড়ানো। কি অদ্ভুত! ব্যথা হচ্ছে ওর বুকে। দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। ব্যথায় জড়তা-সংকোচ নিয়ে বলল,

‘ আমি,,,আমি ঘুমাব প্রহর ভাই। ‘

অপর পাশ থেকে একটাও শব্দ এলো না কর্ণকুহরে। শুধু পায়ে শাড়ি টেনে দেওয়া বুঝতে পারল। কম্বল ঠিকঠাক না দেওয়ায় শাড়ি উপরে উঠে গিয়ে উদোম পা বেরিয়ে ছিল। ফের! ফের আরেকটা লজ্জা যোগ হলো।

মিনিট দুয়েক পর মুখের উপর থেকে কম্বল সরালো নিশাত। দেখল সম্পূর্ণ রুম খালি,প্রহর ভাই নেই। জানে পানি এলো। বিড়বিড় করল,’ আপনি গ্রাম থেকে চলে যান প্রহর ভাই, নয়ত আমি বাঁচব না, একদম বাঁচব না। ‘

সেই রাতে আর ছবি তোলা হলো না ওর। এমনিতেই ঘুম পায়। ভয়ে আরো পেল। বিড়বিড় করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল টেরই পেল না। ঘুমোলে অবশ্য কারোই হুঁশ থাকে না।

ঊষা আজ ভোরে উঠেই তান্ডব শুরু করে। ছাদের উপর ফুলে ফুলে ভরা গাছগুলো ভেঙে ফেলতে আরম্ভ করল। টবসহ হাতে তুলে মেঝেতে আছাড় মা র তে লাগল। বাড়ির চুপচাপ স্বভাবের বুঝদার মেয়েটা যখন এহেন কান্ডে লিপ্ত হয়,তুফান সৃষ্ট করে তার মানে নিশ্চয়ই অত্যন্ত জটিল, মা’রা’ত্মক ব্যাপার ঘটেছে। মোশতাক সাহেব বুঝলেন বোধহয় কারণ টা। ভাংচুরের আওয়াজ শ্রবণ হলেও তিনি নিরলস বসে রইলেন। পেপার টায় গভীর দৃষ্টি তাক করলেন। আজ সামনের ইলেকশন রিলেটেড একটা গরম গরম মসলাদার নিউজ ছাপার কথা। কাজের বুয়া চা দিতে এসে মুখ হা করে কিয়ৎপরিমাণ সময় তাকিয়ে থাকলেন। টেবিলের ওপর চায়ের কাপ টা রেখে বললেন,

‘ স্যার,মাথার ওপর ত,,তুফান আইছে। আপারে থামাইবেন না?’
‘ প্রত্যয় ওঠেছে?’

কাজের বুয়া চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। তেঁতো স্বরে জবাবে জানালেন,
‘ না। শেষ রাইতে ডাইভার মুখলেস রুম পর্যন্ত দিয়া আইল। হুঁশই আছিল না ম দ খাইয়া। হাত দিয়া খু ন বাহির হইতাছিল। আপা সোফায় বইসা পড়তাছিল। এইসব দেইখা দৌঁইড়া গিয়া ব্যান্ডেজ কইরা দিল,একদম ফকফকা ব্যান্ডেজ। ‘

কথাগুলো বলে কাজের বুয়া আবারও হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘ দেইখেন আপা অনেক বড় ডাক্তারনী হইব স্যার। আপনার মাথা উজ্জ্বল করব। ‘

মোশতাক সাহেব হতভম্ব হয়ে পড়লেন। সঠিক কারেকশন করে দিলেন বুয়াকে,’ ওটা মাথা না বুয়া,মুখ উজ্জ্বল হবে। ‘
বুয়া জিহ্ব কাটলেন,’ স্যলি স্যার,একটু অশিক্ষিত তো তাই ভুল কইয়া ফেলসি। তবে আমি টু পাশ। ‘

হতাশা মিশ্রিত নিঃশ্বাস বিমোচন করলেন তিনি। বললেন,
‘ আমার মেয়েটার রাগের জন্য ছেলেটা দায়ী। সে কি জানে না ম দ জিনিসটাই অপছন্দ করে ঊষা। অথচ ও কিনা খেয়ে বাড়িতেই আসল। এখন সে-ই সামলাবে। বুয়া যাও ওর রুমের সামনে ঢাকঢোল পিটানোর ব্যবস্থা করো। উঠলে সোজা ছাদে পাঠাবে। না যেতে চাইলে বলবে ঊষা ছাদে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। দেখবে সুড়সুড় করে চলে গেছে। ‘

‘ দুই নাম্বার স্যার আপারে খুব আদর করে তাই না?’

বুয়া প্রত্যয়কে দুই নাম্বার স্যার ডাকে, তাঁর কাছে এক নাম্বার স্যার হলো প্রথম স্যার অর্থাৎ প্রহর। প্রহরকে ‘ প্রথম স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। মোশতাক সাহেব জবাব না দিয়ে পুনঃশ্চ পেপারে মুখ গুঁজলেন। অনেক দায়িত্ব ওনার,অনেক বুদ্ধির প্রয়োজন। প্রহরকে একটা ফোন করতে হবে। নয়ত জল এতই গড়াবে সব ওনাদের হাতের বাহিরে চলে যাবে। কঠিন রাস্তা সোজা হবে যদি প্রহর চায় তবেই। প্রহরকে তিনি রাজনীতির জন্য অনেক কিছু ত্যাগ এবং অনেক জিনিস কিভাবে হাসিল করে নিতে হয় শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন বললে ভুল হবে। ছেলেটা পূর্বে থেকেই বুদ্ধিমান, মেধাবী, চরম লেভেলের ত্যাড়া। আর এসব ত্যাড়া মানুষই রাজনৈতিক প্লটে পারফেক্ট বলে মনে করেন উনি।

প্রত্যয় ছুটে ছাদে এলো। ঊষা কাঁদছে। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে বিরতিহীন। ছাদের অবস্থা দেখে বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। কি রা গ! গত রাতে মৃন্ময়ীর কথাগুলো মানতে না পেরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। গিলেছে তিন,চার প্যাক। ম দের প্রতি এই মেয়েটার এতো ঘৃ ণা কেন! কে বলবে এই মেয়ে বিশাল ঘরের মেয়ে! চলাফেরায় সামান্য অহংকার অব্দি নেই। মাটির টব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে সমগ্র মেঝেতে। মেয়েটা ওর প্রিয় ক্যাকটাস টাও ভেঙে ফেলল।

খালি পায়েই চলে এসেছে প্রত্যয়। সাবধানে পা ফেলে ঊষার পেছনে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। বাম কাঁধের দিকে দুই অধর বাড়িয়ে নিচু স্বরে শ্রবণ গ্রন্থিতে প্রবেশ করালো একটা ডাক,’ ভোরের পাখি! ‘

অবাক কান্ড! মুহূর্তেই ঊষার নেত্রজল শুকিয়ে গেল যেন। কান্না পাচ্ছে না একদম। বরঞ্চ ভিতর টা কেমন যেন করছে। অঘোষিত আনন্দোলন,উত্তেজনা চলছে। ঘাড় না বাঁকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

‘ সরো প্রত্যয় ভাই,পঁচা গন্ধ বের হচ্ছে। গা গুলিয়ে বমি আসছে আমার। দূরে দাঁড়াও। ‘
‘ কোথায় আকাম করে এলি বল তো?’
‘ তোমার মতো পথে ঘাটে প্রেমিকার বিরহে ম দ খেয়ে ঘুরে বেড়াই না আমি, আমার প্রেমিক বড্ড ভালো। এসব আকামে সে নেই। ‘

প্রত্যয় হাসল,নিঃশব্দে। ঊষা ফিরে তাকাতেই বুক টা ধ্বক করে উঠল। শ্যাম বর্ণ বুক রোমশপূর্ণ। পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। মুখটা ফোলা ফোলা। ঘন ভ্রুদ্বয় যেন আর্ট করা। এই নিখুঁত লোকটা কেন অন্য কাউকে ভালোবাসে? কি করে পারবে ঊষা ওই রোমশ বুকে মৃন্ময়ীকে দেখতে? ও কল্পনাই করতে পারে না। প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করবে ওর বড় কোনো অসুখ হোক,সেই অসুখে প্রত্যয়ের বুকে মৃন্ময়ী কে দেখার আগে দু আখিঁদ্বয় মুদে যাক, নিঃশ্বাস বিলীন হয়ে যাক চিরতরে। প্রত্যয় অসহায় ভঙ্গিতে বলে উঠল,

‘ আর কিছু ভাঙিস না ভোরের পাখি। আমি যদি ম দ খেয়েছি আর,তুই আমাকে জুতা পেটা করিস। ‘

‘ কেন খেয়েছ? কি কারণে? নিশ্চয়ই মৃন্ময়ী আবার কষ্ট দিয়েছে? ‘

প্রত্যয় মলিন মুখে চলে গেল। ‘ নি-ষ্ঠুর,শাঁ”কচু”ন্নি মৃন্ময়ী ‘ বলে কতক্ষণ গালমন্দ করল ঊষা। হাঁটু মুড়ে বসল ছাদে। অধরযুগলে দুই হাত চেপে রোদনের শব্দ আটকানোর প্রয়াসে মগ্ন হলো। সিদ্ধান্ত নিল মৃন্ময়ীর সাথে এবার সরাসরি কথা বলেই ছাড়বে। প্রত্যয় ভাইয়ের জীবনে শুধু মৃন্ময়ী থাকবে। ও চলে যাবে মেডিক্যাল হোস্টেলে।

পিংকির বিয়ে। তিন দিন পর ডেট ফিক্স করা হয়েছে। রফিক আজম নিজে পাত্র পছন্দ করেছেন। সৌরভকে বললেন বোনের বিয়ের দায়িত্বে যেন হেরফের না হয়। বাড়িতে এসে সবটা শুনেছেন তিনি। এবার যদি বাড়ির কোনো সদস্য অঘটন ঘটায় তাহলে গ্রামের বটতলায় ফাঁ সি দিয়ে ম/রতে হবে তাঁর। পিংকিকে তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। শুধু ছেলেকে আলাদাভাবে ডেকে বললেন,’ ঘরের কীর্তি বাহিরে গেলে আমার ম’ র’তে হবে। ছেলে হিসেবে তুমি কি তোমার বাবাকে মা র তে চাও নাকি বাঁচাতে? ‘

সৌরভ বাবার পা জোড়া জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে পারল না সে। তবুও কান্নার দল বুঝি তাকে ছাড়তে রাজি হলো না। চোখ ভরে উঠল। বিমর্ষ গলায় সীমাহীন আর্তনাদ মিশ্রিত বাক্য,

‘ আমি ম/রে যাব বাবা। ‘
রফিক আজম ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। কণ্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বললেন,
‘ ছেলে মানুষের এসব বলতে নেই । শক্ত হও,পিংকিকে একজন ভাই হিসেবে সুন্দর করে বিদায় দেওয়ার প্রস্তুতি নাও। রবিনের মতো দ্বিতীয় কাউকে দেখতে হলে আমি এ বাড়ি ছেড়ে দেবো। ‘
সৌরভ চট করে নিজেকে সামলে নিল। নত মস্তকে রোবটের মতো করে অনুভূতিহীন হয়ে বলল,
‘ আমি সব দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করব বাবা। ‘

#চলবে~
( ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। 🖤)

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____১১

নিশাত খেয়াল করল গত দু’দিন ধরে ওর ভাই একদম ভালো নেই। আগের মতো ঠিকঠাক, হাসিমুখে কথা বলে না। কেমন যেন পাথুরে,কাঠিন্য ভাবমূর্তি চেহারায়। দু’দিনে শুধু মধ্যাহ্নে দু বেলা ভাত খেতে দেখেছে। তাও অর্ধেক খেয়ে প্লেট ঠেলে উঠে গিয়েছে। অকস্মাৎ ভাইয়ের এই আমূল পরিবর্তন ছোট্ট নিশাতের বুক ভারী করে তুলল। বার কয়েক কথা বলার মুখ্যম সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে কিন্তু পেল কই! বিয়ে বাড়ি,হৈ চৈ অবস্থা। কানভর্তি কলরব। তিনদিনের মধ্যে ভালোমতো একটা আয়োজন করে বিয়েশাদি চাট্টেখানি কথা নয়। কিন্তু তাড়াহুড়ায় বিয়ের ব্যাপারটা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। বাবা আসার পর চাচা,চাচি,বাবা মিলে বদ্ধ ঘরে ঘন্টা দেড়েক কিসের যেন আলোচনায় মত্ত ছিলেন। অতঃপর এর একদিন অতিবাহিত হতেই পিংকি কে দেখতে পাত্রপক্ষ হাজির। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছিল পিংকি। সারাদিন অভুক্ত ছিল,চাচীর পায়ে পড়ে বিয়ে করবে না বলে আহাজারি করছিল বারংবার,অনবরত।

নিশাতের বেশ খারাপ লাগছিল। সামান্য চিঠিকে কেন্দ্র করে কেউ বিয়ে দিয়ে দেয়? প্রেমের ব্যাপারে এত স্ট্রিক্ট কেন বাবা,চাচা সবাই? ফুপির সাথে বাবার মনোমালিন্যের কারণ টা ও জানে না। বুঝ হওয়ার পর থেকেই জানল ফুপিকে এই বাড়িতে আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাঁর প্রেমের বিয়েই বলে কি? নাকি অন্য কারণ? পিংকির বড় আপা নিশাতকে হলদে একটা জামদানি পড়িয়ে দিল। বলল,“ তোকে খুব সুন্দর লাগছে রে নিশু। শাড়িতে বড় বড় লাগছে, ছোট্ট পিচ্চি টাকে। ”
তৎক্ষনাৎ নিশাতের কণ্ঠ গলিয়ে ধা-রালো কয়েকটা প্রশ্ন বের হলো,“ আমি ছোট হলে পিংকি কি আপা? ওকে কেন এত জলদি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ?”

নাহিন আপা নিঃশ্বাস ফেললেন শব্দ করে,অতি দীর্ঘ সেই নিঃশ্বাস। ধরে আসা গলায় আওড়ালেন, “ বড়োরা যেই সিদ্ধান্ত নিবে তাই মানতে হবে নিশু। পিংকির ভাগ্যে এ বয়সে বিয়ে নির্ধারিত বলেই হচ্ছে।”

নিশাতের অক্ষিকোটরে জল জমল সেকেন্ডেই। অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে ভাগ্যের দোষ দিলেন আপা। পিংকির রুমে এসে দেখে আজ আর মুখে মলিন ভাব টা নেই ওর। বিনা দ্বিধায় সাজতে বসে গেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে নিচে আসল ও। সৌরভ ভাই কোনো ত্রুটি রাখছে না স্টেজ সাজাতে। নিশাত তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। ডাকল ভেজা ভেজা গলায়, “ ভাইয়া!”

পশ্চাতে ঘাড় বাঁকাল সৌরভ। বোনের দিকে তাকিয়ে চক্ষুদ্বয় আটকে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,“ তুই তো আজ বাথরুমের ঘুমন্ত পরী থেকে হলদে পরী হয়ে গেলি নিশু৷ ”

“ আমার থেকেও দ্বিগুণ সুন্দর লাগছে পিংকি কে। ”

সাবলীল, স্থির, নরম কণ্ঠ শুনে সৌরভ চমকে গেল। আকস্মিক মনে হলো তার বোকা বোনের বুদ্ধি খুলছে। ফুলের মালাটা ডেকোরেশনের লোকের দিকে এগিয়ে দিয়ে কপট, মেকি হেসে বলল, “ পিংকি কেও দেখে বলব তোর থেকে বেশি সুন্দর লাগছে কিনা। ”

নিশাতের কাজলেমাখা নেত্র ভেদ করে অশ্রু কণারা গাল স্পর্শ করে সোজা গলা বেয়ে নামছে। চোখের নিচ কাজল লেপ্টে ঈষৎ কালো হয়ে গেল। ক্রন্দন মিশ্রিত অথচ নিম্নস্বরে বলল,“ আমি সব জানি ভাইয়া। গত রাতে দেখেছি তুমি পিংকির হাত ধরে কাঁদছিলে ছাদে। দরকার হলে আমি বাবার পায়ে পড়ে বলব পিংকিকে যেন বিয়ে না দেয়। ”

সৌরভ বাকরুদ্ধ। অবয়বে আঁধার জুড়ে বসল। চারদিকে মানুষের আনাগোনা। গ্রামের লোকজন এদিক সেদিক কান পাততে অত্যন্ত পটু। সতর্ক চাহনি মেলে নিশাতের হাত ধরে পুকুর পাড়ে নিয়ে আসল। ঊর্ধ্বশ্বাসে অনুরোধ করল,
” তুই বাবাকে কিছু বলবি না। আমি আমার মনকে পিংকির প্রতি ঝুঁকে যাওয়াতে আটকাতে পারি নি,এটা আমার ব্যর্থতা। ”

“ তাই বলে মেনে নিবে?”

নিশাতের কান্নার বেগ বাড়ল। সৌরভ বোনকে বুকের মাঝে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার হৃদয় চিরে রক্ত ঝড়ছে গোপনে,অতিশয় সাবধানে। সত্যটা গলায় এসে আঁটকে যাচ্ছে, দলা পাকিয়ে যাচ্ছে প্রত্যেক টা শব্দাংশ। বাচ্চাদের মতো এ বয়সে এসেও ভেতরে ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে সে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দগুলো গুছিয়ে দৃঢ় গলায় বলে,

” পিংকি গত রাতে কি বলেছে জানিস? ও এখন নিজেই রাজি। হবু বরকে খুব পছন্দ হয়েছে ওর। অতঃপর আমি বুঝলাম ওর দিক থেকে আমার জন্য যেটা ছিল সেটা নিতান্তই তুচ্ছ একটা আবেগ। ভালোই হলো সেই মিথ্যা আবেগের বশীভূত প্রেম আমি বহুকাল বহন করব না নিশু। নয়ত পরে সামলে উঠতে পারতাম না। ”

আবেগ! পিংকি আবেগে ভাইয়ার মোহে আচ্ছন্ন হয়েছিল? তবে কি এটা সত্যি মোহ কেটে যায়? নিশাত ভাইকে জাপটে ধরার চেষ্টা করল। ওর ছোট ছোট হাত সৌরভের বলিষ্ঠ দেহ আঁকড়ে ধরতে পারল না। কোমল দেহী অধিকারীণি, দুর্বল চিত্তের নিশাত ভাইয়ের যন্ত্রণা নিরবে অনুভব করতে পারছে সেটাই বা কম কি!

পুরো গায়ে হলুদে সৌরভের দেখা কোথাও মিলল না। মা,চাচি হাজার বার জিজ্ঞেস করলেও নিশাত উত্তর দিতে অক্ষম। প্রিয়তমার অন্যের জন্য গায়ে হলুদ মাখা সইতে পারবে না ওর ভাই। বাহ্যিক দিক থেকে নিজেকে কঠিন দেখালেও অন্দরমহলে কতটা দুর্বলতা লুকিয়ে রেখেছে তা অল্পস্বল্প আঁচ করে ফেলেছে সে। পিংকির প্রতি ক্রুদ্ধতা জন্মালো। আগের দিনগুলো থেকে আরো বেশি ঘৃ’ণা করতে আরম্ভ করে। ওর ভাইয়ের হৃদয় পুড়ছে আর এই মেয়ে হেসে হেসে কথা বলছে হবু বরের সঙ্গে ভিডিও কলে। নি ষ্ঠুর মানবী!
—————————

বরযাত্রী আসার আগে নিশাত পিংকির রুমে গেল। কেউ নেই। সবাই নিচে। এক গাট্টি বাচ্চাকাচ্চা ছিল ওদেরও রুম থেকে বের করে দিল সে। বাচ্চাগুলো যেতে চাইছিল না। বার কতক কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে,” আমলা নতুন বউয়েল লগে থাকমু। যামু না। ”
ঠেলে ওদের বের করে দিতেই পিংকি লেহেঙ্গা দু হাতে ধরে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায়। হতবিহ্বল চোখে তাকায়। চাহনি দ্বিধান্বিত। ভীরু ভীরু কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” ওদের বের করলি কেন নিশু?”
” তুই এখুনি আমার ভাইয়ের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবি। ”

নিশাতের তেজী কণ্ঠস্বর। আগুন ঝরছে কণ্ঠে। মুখের আদলে বিশেষ পরিবর্তন। রক্তিম লাল হয়ে উঠেছে হলদেটে মুখশ্রী খানা। পিংকির গলা শুষ্ক হয়ে গেল মুহুর্তেই। ভয়া/তুর কণ্ঠ, ” কে,,,কেন?”

” আমার ভাইয়ের ভালোবাসা নিয়ে নাটক মা/রিয়েছিস, আবার বলছিস কেন? চ-ড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেবো। পারলে বুড়ি নানী হয়ে যাইস বিয়ে বসতে। তখন দেখবি তোর লাড্ডু মার্কা বরও তোকে নানী ডেকে রিজেক্ট করে যাবে। ”

পিংকি থতমত খেয়ে গেল। হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। বিমর্ষ মুখে বলতে চাইল, ” তুই সব জেনে গেছিস?”
নিশাত দ্বিগুণ রা গান্বিত স্বরে বলে উঠল, ” নিচে চল। ”

সিঁড়ির গোড়ায় আসতেই সৌরভ গামছা হাতে এদিকে ছুটে এলো। মেহমান সামাল দিতে দিতে হাঁপিয়ে ওঠেছে প্রায়। পিংকির বধূ বেশী রূপ টা এক পলক অবলোকন করতেই তার বুকটা দুমড়েমুচড়ে গেল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিশাতের দিক।
” ওকে এখানে নিয়ে এসেছিস কেন? ”
” ও তোমার পা ধরে ক্ষমা চাইবে। ”
” কি?”
কিঞ্চিৎ চিল্লায় সৌরভ। ধমকায়,” তুই পা গল হয়েছিস? বিয়ে বাড়ি এটা। আর কিসব বলছিস? বোকা মেয়ে। সাধে কি আর তোকে বোকা বলি আমরা?”

রোদনভরা চাউনি মেলে ধরল নিশাত। অল্পস্বল্প কাঁপল গলা,” ও তোমার কাছে ক্ষমা না চাইলে আমি স্বস্তি পাব না ভাইয়া। এরকম ফা জিল মেয়ে কেন আমার ভাইকে কাঁদাবে? ”

সৌরভ অন্যত্র তাকিয়ে পিংকির উদ্দেশ্য আদেশমূলক বাক্য ছুঁড়ে দিল,” তুই উপরে যা পিংকি। ”

পিংকি জিতে গেল এমন ভাব। হাসল ঠোঁট বাঁকিয়ে। চলে যেতে নিলে নিশাত শক্ত করে ওর হাত টা চেপে ধরল। ব্যথাসূচক ধ্বনি কণ্ঠ ভেদ করে বাহিরে আসল নিমিষেই। নিজের লম্বা লম্বা নখ মেয়েটার শ্বেত বর্ণ কব্জিতে দাবিয়ে রেখেছে নিশাত। সৌরভ ফিরে তাকাল। সূক্ষ্ম চোখে চাইল হাতের দিক। আঁতকে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে,

” ছাড় ওকে নিশু। ”
নিশাতের নিরলস,সাদামাটা কথা,” ক্ষমা চা। নয়ত এখুনি বাহিরে গিয়ে চেঁচিয়ে তোর মান সম্মানের ফালুদা বানাব আমি। ”

পিংকি ভড়কালো। আইল্যাশ খুলে গেছে তার। নিশাতের থেকে ছাড় পেল না। অগত্যা তরতর করে বলল,
” ক্ষমা করে দিন সৌরভ ভাই। আমি আবেগে বুঝতে পারি নি কিছু। ”

সৌরভ শব্দহীন পায়ে প্রস্থান করে। এখানে কিছু বলার নেই তার। পিংকির প্রতি ক্ষোভ, অভিমানের দেয়াল পিংকি হাজার বছর ধরে ক্ষমা চেয়েও ভাঙতে পারবে না।

নিশাত পিংকিকে ছেড়ে দিয়ে দুই হাত ঝাড়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল, ” জীবাণু ধরে ফেলেছি। এখন যেই ব্যাডায় মুগ্ধ হইছস,আবেগ শেষ হয়ে গেলে আবার ফিরে আসিস না। ”
___________________________

বরযাত্রী এসে হাজির গেইটে। নিশাত সবাইকে ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়ল একদম মধ্যে। নিমিষেই সকলের মধ্যমণি হয়ে গেল। সামনে চাইতেই চক্ষু ছানাবড়া ওর। বড় বড় বৃহদাকার ধারণ করল চোখ দু’টো । মাথা ভনভন শুরু হলো। মনে হলো,একটা ফ্যান ভটভট শব্দে তার মাথার ওপর ঘুরছে। হৃদয়ের উন্মাদনা টিপে ধরে কণ্ঠস্বর। আদৌ পিংকির বিয়ে হবে? বাবা কেমন ব্যবহার করবে? বরের সাথে প্রহর ভাই? শুভ্র পাঞ্জাবি, কালো সানগ্লাস, মাথার এলোমেলো চুল সব কেমন ঘা য়েল করছে হৃৎপিন্ডে।

নিশাত আর সহ্য করতে পারল না,পরিচয় দিল অধৈর্যশীলতার। টুপ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। সবাই বলতে লাগল ঘুমিয়ে গেল নাকি? একেকজন অবাকতা প্রকাশ করছে,” মেয়েটা বোনের বিয়ের গেটেও ঘুমিয়ে গেল? এরকম ঘুমপাগল,বেআক্কল মেয়ে গেইট ধরতে আসে কেন?”

#চলবে~
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)