প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
871

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব______২৬

নিশাতের অবস্থা বেগতিক, উৎকট। বেসামাল হৃৎস্পন্দন। চেহারার রং প্রায় উড়ু উড়ু প্রহরের উচ্চারিত বাক্যখানা কর্ণগোচর হতেই। ইতমধ্যে ঘোরতর বিষমে হলদেটে রঙ উবে গিয়ে সমস্ত মুখ রক্তশূণ্য, মলিন। চিকন, কমজোর হাতে প্রহরের পেটের অর্ধাংশ ধরে রাখা স্থানে শক্ত করে ধরল। দেহ এগিয়ে গেল কিছুটা। দেখতে ছোট বাইকে দূরত্ব রাখার মতোন জায়গা ছিল না, যতটুকু ছিল সেটাও বিলীন হয়ে গেল সম্পূর্ণ। ভয়ের দমকে মেয়েটা প্রহরের কানের অতি সান্নিধ্যে উচ্চারণ করে,
” আপনি এসব আব্বুকে দেখাবেন?”
প্রহর রিস্ক নামক শব্দটা সমেত ওর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল কিঞ্চিৎ। হেলমেট তার দৃষ্টিতে আবরণী পর্দা হিসেবে কাজ করছে। নিশাত বুঝল না,দেখল না সেই দৃষ্টি। শুনল কেবল জবাবে নিরলস প্রশ্ন,
” কোনসব?”
বলতেও গলা আঁটকে আঁটকে আসছে নিশাতের। কি করে বলবে অমন ‘অস””ভ্য, আজগুবি’ শব্দ! সকরুণভাবে আওড়ালো,
” একটু আগে যেসব বললেন?”
প্রহর সমুখে চেয়েই নির্লিপ্ত কণ্ঠে টেনে বলল,”ওহ! চুমুউ?”
কথাটা শ্রবণগ্রন্থিতে আসতেই এলোমেলো হলো শরমে অন্তঃপুর। নিশাত চওড়া পিঠে থুতুনি ঠেকিয়ে মিনমিন করে, ” হ্যাঁ ওটাই। ”
” বলতে লজ্জা, করতে লজ্জা লাগে নি? তুই আমার হাতই ছাড়ছিলি না। হাতের উপরের জায়গায় ঠোঁট দুইটা চেপে রাখছিলি। বহু কষ্টে ছাড়িয়ে আনছি। তোর ভাই দেখলে আমাকে শূ””লে চড়ানোর বন্দোবস্ত করত,মান সম্মানের ফালুদা হয়ে যেত আমার। আর মামুজান অনেক অবিচার করেছে আমার সাথে,এমন সুযোগ লুফে নেওয়া উচিত। ”
নিশাত অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে,” আমি এমন করি নি। আপনি মিথ্যা বলছেন। ”
তার দৃঢ় বিশ্বাস সে এমনটা করতেই পারে না। প্রহরের নিকটস্থেই ওর সারা কায়া শিউরে ওঠে। অতএব, চুমুর ন্যায় কান্ড ঘটবে না কখনো। তড়াক করে ব্রেক কষল প্রহর। বাইক থামিয়ে বলল, ” নাম। ”
ঝাঁঝালো,কঠিন স্বর। নিশাতের গায়ে অতি সন্তপর্ণে শিহরণ বয়ে গেল অচিরেই। নেমে দাঁড়াল। প্রহরও নামল। হেলমেটটা খুলল না। পকেট থেকে মোবাইল ও একটা ওয়ান টাইম মাস্ক বের করে করে। মাস্কটা দেখিয়ে বলে উঠল,
” জলদি এটা পড়। আর স্কার্ফটা দিয়ে ভালো করে মুখ ঢেকে নে। ”
নিঃশব্দে ভারী স্বরের আদেশ পালনে মত্ত হয় নিশাত। গোলগাল চেহারাটা অতিশয় ভালোভাবে ঢেকে নিল। অবিন্যস্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আশেপাশে। ওরা এসে থেমেছে পাশের গ্রামের সীমানায়। হকচকিয়ে গেল সে। কখন মহানন্দ গ্রাম পেছনে ফেলে এখানে এসে থমকালো লক্ষ্যই করে নি। কণ্ঠে বিস্ময়ের ছোঁয়া,
” বাড়িতে যাব না? ”
প্রহর মোবাইলে ব্যস্ত নজর নিবদ্ধ রেখে জানায়,
” যাবি না। ”
” আব্বা,আম্মা,সৌরভ ভাই চিন্তা করবেন। ”
” করুক। “- সিধেসাধা জবাব প্রহরের।
এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর উচ্চবাচ্য করার সাহস সঞ্চার করতে পারল না নিশাত। অপারগ সে। ভিতরে ভিতরে টেনশন ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ওর জীবনের সাথে জড়িত একেকজন মানুষ যেন এটম বো—মা। মা’কে সে ভয় পায়,আব্বার গম্ভীর ভাব না চাইতেও বুকের ভেতরে কম্পন ছড়িয়ে দেয়,সৌরভের আদর যেমন সুন্দর ক্রোধান্বিত হাল তার চেয়ে বিভ–ৎস। আর প্রহর! প্রহর ভাই তো ওর ক্ষুদ্র জীবনের জটিল প্রহেলিকা।
প্রহর মোবাইলটা আগের স্থানে রেখে বলে,” তুই অবিশ্বাস করেছিস আমাকে। তোকে এখন দেখানো যাবে না। আগে সেখানে যাই,তারপর একটা বিহিত করব। বাইকে উঠ। ”

মাইলের পর মাইল পারি দিয়ে বাইক এসে থামল দুচালা এক বাড়ির উঠোনে। বাড়ির একপাশে প্যান্ডেল বাঁধানো। মাংস,মশলার ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে সমগ্র বাড়িতে। খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে লোকজন বাড়ির পথে ছুটছে। নিশাত বুঝল তারা কোনো বিয়ে বাড়িতে এসেছে। বাড়ির উঠোনে ঢোকার মুখে খুব বেশি অসাধারণ নয়,সাধারণ একটা গেইট তার ক্লান্ত আঁখিদ্বয়ে বিঁধেছে। উঠোনে দাঁড়িয়েই প্রহর অবশেষে মাথা থেকে কালো হেলমেটটা খুলল। ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হুকুম করে, ” ধর। ”

নিশাত ঝটপট, বাক্যহীন হাতের আঁজলায় তুলে নিল হেলমেটটা৷ প্রচন্ড ভার। পেটের কাছে ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখল। ধরন এমন যেন জিনিসটা অতি মূল্যবান,আগলে রাখতে হবে সযত্নে। চোখে এসে আটকালো প্রহরের চুলে ব্যাকব্রাশ করার মোহনীয় দৃশ্য। এটা ভীষণ মাদকতার ন্যায় কাজ করে ওর মনে। একটু একটু করে অভিলাষ জাগায় সেই চুলে পাঁচটা আঙ্গুল ডুবিয়ে দেবার, ট্রিম করা দাঁড়িতে আলতো করে স্পর্শ করবার। ও প্রহরের শ্যামল সৌন্দর্যে এতটাই ডুবে গিয়েছে টেরই পেল না পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। ধ্যানমগ্ন নিঃশেষ হলো ভারিক্কি একটা সুরে।

” আমি ভাবছি তুমি আসবা না বাবা। ”
পাশ ফিরে তাকায় নিশাত তড়িৎ গতিতে। তার বাবার বয়সী এক লোক এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে আকাশী রঙের একটা পাঞ্জাবি, মুখে প্রসন্নতার হাসি লেগে আছে। প্রহর নম্র গলায় বলল,
” কি বলেন! আপনি কল দিয়েছেন,আমি আসব না? একটু দেরি হয়ে গেল এই আরকি। বিয়ে পড়ানো শেষ? ”
” বিয়েটা পড়ানো শেষ বাবা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার পথে,ঘরে এসো খাবারের ব্যবস্থা ওখানেই করি। ”
” সমস্যা নেই। আমরা প্যান্ডেলেই খেতে পারব। ”
লোকটা নিশাতের দিকে তাকাল। প্রশ্নাত্মক চাহনি।
” ও?”
নিশাত জড়ীভূত হয়ে গেল। অপরিচিত মানুষের সামনে ঈষৎ অপ্রস্তুত সে। তার ওপর প্রশ্নের তীর ওর দিকে ছুড়ে মারা হয়েছে। প্রহর ওর হাত থেকে হেলমেটটা বাইকের ওপর রেখে বলে,
” অ–হংকারী রফিক মামুজানের মেয়ে। ”
লোকটা বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কণ্ঠে প্রবল উৎকণ্ঠা,
” কি বলো! ও রফিকের মেয়ে?”
পরক্ষণেই নিশাতের পানে হাসিভরা চোখে চাইল। বলল,
” আমি তোমার ও প্রহরের বাবার বন্ধু। হয়তো শুনো নি আমার কথা। যোগাযোগ নেই তো। ”
শেষোক্ত কথাতে মন ভাঙ্গার আভাস,বিষাদ খুঁজে পায় নিশাত। মানুষটার গলাটা কেঁপে উঠল যেন। হতবাক নেত্রে তাকায় লোকটার নিষ্প্রভ চেহারায়। এ গ্রামে বাবার বন্ধু আছে, কখনো শুনে নি ও। তাছাড়া লোকটাও বলল যোগাযোগ নেই। সবথেকে আশ্চর্যজনক কথা হলো ফুপা আর আব্বা বন্ধু ছিল এ বিস্ময়কর সত্যিটা সে আজ জানতে পেরেছে। কত কথা লুকিয়ে আছে ওর অগোচরে! জিজ্ঞেস করলেও সবাই ধম”””কায় কিংবা মুখে কুলুপ এঁটে রাখে। যত কথা লুকায়িত সব বাড়ির বড়দের মধ্যে।

নিশাত সরব করে সালাম দেয়। লোকটা বিনিময়ে জবাব দেয়। আদুরে ভঙ্গিতে শুধায়,
” ঘরে এসো মা। হাত মুখ ধুইয়ে বিশ্রাম নিয়ে তারপর খাবে।”

বিয়ে বাড়ি। হৈ হুল্লোড়ে জমজমাট সমগ্র বাড়ি। গুটি কয়েক মানুষজন আড়চোখে ওদের দিকে তাকাচ্ছে বারংবার। কেউ কেউ প্রকাশ্যে চেয়ে আছে পলকহীন, অনিমেষনেত্রে। নিশাত ভালোভাবে চেয়ে অনুধাবন করে,ওর থেকেও প্রহরের দিক কিছু কিছু লুব্ধনেত্র নিবদ্ধ। ধীরগতিতে, চুপি চুপি পা ফেলে হৃদপুষ্ট দেহের সন্নিকটে এসে দাঁড়ায় ও। প্রহর তখনও সেই লোকের সাথে নানান বাক্যে মগ্ন। নিশাত চোখের কোণা দিয়ে প্রফুল্ল চিত্তে প্যান্ডেলের পাশে জড়োসড়ো হওয়া মেয়েগুলোকে দেখে নেয়। অকস্মাৎ হাতে স্পর্শ অনুভব করায় চমকে ওঠে ও। হিম শীতল স্রোত নেমে যায় শিরদাঁড়া বরাবর। শক্ত একটা হাত ওর হাতটা করপুটে বন্দী করে নিয়েছে, হাতের মালিকের নজর সমুখেই আঁটকে। বিমূঢ় দৃষ্টে দু হাতের সন্ধিতে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল ও। তক্ষুনি শোনা গেল,

” কী দেখছিস?”
নিশাত দ্রুতপদে বলে উঠল,” কিছু না। ”
প্রহর ওর হাতটা আরেকটু টেনে ধরল। সন্দিগ্ধ নজর মেলে জিজ্ঞেস করল, ” গলা কাঁপছে কেন?”
হড়বড়িয়ে বলে নিশাত,” কই?”
নিরুত্তর প্রহর। ওর হাতটা ধরে লোকটার পেছন পেছন ঘরে আসে। লোকটা একজন মধ্য বয়স্ক মহিলাকে ঢাকলেন। মাথায় ঘোমটা দিতে দিতে ছুটে আসলেন উনি। ওদের দেখিয়ে মহিলাটাকে বললেন,
” রফিকের মেয়ে ও। প্রহর স্কুল থেকে নিয়ে আসল। ”
মহিলাটা নিশাতের দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট, আহ্লাদী কণ্ঠে বলে,
” তোমার বন্ধুর মেয়ে অনেক সুন্দর। মাশাআল্লাহ। ”
” ওদের ফ্রেশ হবার ব্যবস্থা করো। আর ওকে এক সেট ড্রেস দাও,স্কুলের জামাটা ঘামে ভিজে আছে। ”

নিশাত সংকোচ নিয়ে প্রহরের মুখের ওপর দৃষ্টি ফেলল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রহর মুখ খুলে,
” জামা লাগবে না হাবিব কাকা। একটু পর আমরা চলে যাব। আপাতত ওর হাত মুখ ধোঁয়ার ব্যবস্থা করে দিন। ”
” আচ্ছা বাবা। ”
অচেনা জায়গায় এসে অল্পক্ষণের জন্য জামা পাল্টানোর বিষয়টায় ইতস্তত অনুভব করছিল নিশাত। প্রহর ওর চোখের ভাষা বুঝতে সময় লাগাল না। হায়! এমন করে যদি চক্ষু আরশিতে প্রেমের বাক্যটা ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলতে পারত ও! তাহলেই বোধহয় বিনা বিলম্বে, সহজে,কষ্টবিহীন দ্রুত পড়ে ফেলতে পারত প্রহর। কণ্ঠনালি গলিয়ে ভালোবাসি এই শ্রুতিমধুর শব্দের মুক্তি দেওয়ার ন্যায় দুঃসহ কাজ করতে হবে না।

হাবিব সাহেবের এক ছেলে,এক মেয়ে। ছেলে পুলিশের চাকুরীতে আছে। মেয়েটার আজ বিয়ে। এই বাড়ির প্রতিটা মানুষের আচরণ খুবই অমায়িক। বিশেষ করে প্রহরের প্রতি। পারছে না তাকে মাথায় তুলে রাখছে। ঘরের ভেতরের টেবিলে ওদের জন্য হরেক রকমের খাবার সাজিয়ে দেয়। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দু পরিবারের হালচাল জানতে চান হাবিব। উনার ছেলে এসে প্রহরকে জড়িয়ে ধরে। চাকরি কেমন চলছে জানায়। এক সময়ে হাবিব চাচার বউ জানালেন উনাদের আর্থিক অবস্থা ছিল প্রচন্ড শোচনীয়। বেকার ছেলে,বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ডুবে যায়। অনেক জায়গায় ছেলের চাকরির জন্য আবেদন করলেও হচ্ছিল না। হয় মোটা অংকের টাকা ঢালতে হবে, নয় লাগবে সুপারিশ। তন্মধ্যে এ গ্রামে একবার প্রহর আসলে হাবিব সাহেব প্রহরের সামনে উপস্থিত হয়। প্রহর আগে থেকে চিনত উনাকে। দূরাবস্থার কথা শুনে নিজ দায়িত্বে ক্ষমতা খাটিয়ে নির্জীব, ভাঙ্গাচোরা সংসারটাকে জোরা লাগিয়ে সতেজ করে তুলে। ক্ষমতার অপব্যবহার ভালো নয়,তবে সেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যদি কারো লাভ হয় ক্ষতি কী!

খাওয়া শেষে বাড়ির সকলে ছুটে গেলেন মেয়ে বিদায় দিতে। এক দু’জন মেয়ে উঁকিঝুকি দিয়ে বার বার প্রহরকে দেখছিল। ছোট আকৃতির একটা কক্ষ। চারটে দেয়ালের মধ্যে স্রেফ দুটো মানব-মানবীর শ্বাস প্রশ্বাসের ক্রিয়া চলছে। নিশাত বসা ছিল এক কোণায় পাতা চেয়ারে। প্রহর পা দু’টো বিছানায় তুলে গলা উঁচাল,

” নিশু দরজাটা লাগিয়ে আয়। ”
” হ্যাঁ? ”
” দরজাটা লাগিয়ে আয় গাধী।”
অপমানে কান ঝা ঝা করে উঠে নিশাতের। ভালো করে বললে কী হতো! দুয়ারে মেয়েদের দেখে ওর ভেতর জ্বলে উঠল। ‘ শ্যামলা পুরুষ দেখেই এ হাল। ফর্সা হলে আপনারে আমি কই লুকাইতাম প্রহর ভাই? নাকি শ্যামলা রূপটাই মাইয়াদের টানে?’ মনের অন্তরিক্ষে উদ্ভট, অদ্ভুত ভাবনা উড়ে বেড়াচ্ছে দ্বিধাহীন। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা সশব্দে লাগিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস বিমোচনে লেগে গেল।

” আরেকজনের কষ্টের কামাইয়ের বানানো বাড়ির দরজাটা ভাঙার মতলব করেছিস নাকি তুই? তুই বড়লোকের বেটি বলে কি সবাই বড়লোক? ”

রাগমিশ্রিত,ঝাঁঝের কণ্ঠ শুনে বাকহারা নিশাত। পিলে চমকে উঠল। সত্যিই তো! এত জোরে কেন লাগাতে গেল সে! মাথা নুইয়ে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

” বাড়ি কখন যাব?”
” দরজা কি বাড়ি যাওয়ার জন্য বন্ধ করিয়েছি? তুই এদিকে আয় বেক্কল। ”
নিশাত ভীরু ভীরু পদলি ফেলে বিছানার কাছাকাছি আসল। প্রহর মোবাইলে বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিতে গিয়ে থামল। মেঝেতে স্পর্শ পা দেখিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বলল,

” পা উঠিয়ে বিছানায় বস। তোর সাথে ঠিক নেই। যা দেখাব, দেখেই তুই আমার মোবাইল হাত থেকে ফেলে দিবি তাতে সন্দেহ নেই। মোবাইল ভাঙার জরিমানা চাইতে গেলে দেখা যাবে শ্রদ্ধেয় মামুজান ফের আমার নামে মা-মলা ঠুকবেন। ”

নিশাত হতভম্ব। কণ্ঠনালি হতে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো বিস্ময়াবিষ্ট প্রশ্ন, ” মাম-লা?”

প্রহর আফসোসের সুরে বলে ওঠে, ” পৃথিবীতে বোধহয় তোর বাপের মতো এক পিসই আছে। তার ফুলের মতো সৌরভ ছড়ানো ছেলের গায়ে টোকা দিয়েছিলাম বলে আপন, নিরীহ ভাগিনার নামে মামলা দিয়েছে। মা-রামা-রির মতো একটা তুচ্ছ কান্ডে রক্তের ভাগিনার নামে কেউ মামলা করে বল? মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানিস? তোকে পয়দা করা মামুজানটাও তোর মতো বেক্কল। ”

বিড়ম্বনার শিকার হলো নিশাতের হৃৎপিণ্ড। কস্মিনকালেও ভাবে নি তার আব্বা এমন কিছু করতে পারে। এত ক্ষোভ কেন আব্বার প্রহর ভাইদের প্রতি? এত নির্দয় কেউ হয়? আপন বোনের ছেলেদের সাথে এমন করে? মুহূর্তেই অনুভূত হচ্ছে প্রহর ভাই যত খোটা,কথা শুনায় সব যুক্তিযুক্ত,জায়েজ।

” নে ধর। দেখ তোর কু-কর্ম। রাস্তায় যখন বললি বিশ্বাস করিস না,ইচ্ছে করেছে পিঠের ছাল তুলে ফেলি। পরে চিন্তা করলাম এতে আমারই লস। মলম পট্টি তো আমার টাকা খরচ করেই করতে হবে। ”

মোবাইলটা বিছানার ওপর রেখে বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে নেয় প্রহর। নিশাত অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোবাইলটা হাতে নিল। নিমিষেই চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে আরম্ভ করল সে। আপাদমস্তকে তীব্র উন্মাতাল শুরু হলো। কঠিন হয়ে দাঁড়াল নিজেকে সামলানো। প্রহরের হাতটা জড়িয়ে ধরে হাতের পৃষ্ঠে ঠোঁট ডুবিয়ে চুমু খাচ্ছে ও। দাঁতে দাঁত চেপে প্রহর সেটা ফ্রন্ট ক্যামেরায় বন্দী করে নেয়। এটা যে ও সজ্ঞানে করে নি তা নিশ্চিত। অপার লজ্জায় নেতিয়ে পড়ছে, মাথা ঘুরছে তার। শয়নে-স্বপনে-জাগরণে-মনে মনে বহুবার তার বেতাল মন প্রহরকে চুমু খেয়েছে। তাই বলে এখন বাস্তবে! মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে বলল,

” এটা,,,এটা কখন হয়েছে?”
” যখন তুই আমাকে চুম্মা চুম্মি করছিলি। ”
করুণ, কোমল গলায় ডাকল নিশাত,” প্রহর ভাই ”
প্রহর ধপ করে উঠে বসল। অভয় দিয়ে বলে,
” চোখ বন্ধ করছিস কেন? বেহুশ হবি নাকি ঘুমাবি?”
সঙ্গে সঙ্গে পরনের শার্টটা দুদিকে টেনে ধরে বুকের দিক ইশারা করে পুনরায় বলে,
” সরকারি বুকে মুখ লুকিয়ে লজ্জা সব গায়েব করে ফেল। একটু ঠিক হতে হবে। কারণ তারপর আমি আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলব। ”
নিশাত লজ্জাবনত, অধোমুখে অনুরোধ করে,
” আপনি এটা ডিলিট করে দিন। ”
ক্ষেপে যায় প্রহর। ওর দুই বেনুনি টেনে ধরে,” করব না। ”
মৃদু ব্যথায় ককিয়ে ওঠে নিশাত। প্রহর বেনুনি ছেড়ে দিয়ে বলল,” এটা আমি সারাজীবন রেখে দেবো। আমৃত্যু এটা আমার কাছেই থাকবে। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ে চুমু খেয়েছে বলে কথা। প্রথম সবকিছুই সুন্দর জানিস না? জানবি কেমনে? তুই পারিস খালি আমাকে ধ্বংস করতে। বুঝদার হলে এতকিছুর বোঝা বইতে হতো না আমার। আরো কাছে আয়। ”
হাঁটুতে ভর দিয়ে খানিকটা কাছে গেল নিশাত। অভ্যন্তরে হরমোনের প্রবল সাড়ায় অতিষ্ঠ সে। নিমিষেই অঙ্গ প্রত্যঙ্গে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে পড়ল মোহনীয় কণ্ঠের জাদু,

” যোজন যোজন দূরত্ব হতে পারে দেহের,মনের না।
ভিন্ন দুটি মানব মনে একই প্রেমের সুর বাজলে,তাল মিললে, সেই প্রেমের উষ্ণতায় পুড়তে দুটি হৃদয়কে বাঁধা দেওয়ার শক্তি কোনো তৃতীয়ব্যক্তির নেই, তিলবতী। ”

#চলবে,,,

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব______২৭

নিশাতের নরম, শীতল গালে সপাৎ করে এক থা””প্পড় পড়ল। অচিরেই তপ্ততায়,জ্বলনে নড়েচড়ে উঠল মেয়েটা। নিঃসংকোচে ফোঁটা ফোঁটা জলবিন্দু কপোল ছুঁয়ে অবিরাম নিচে গড়াতে শুরু করল। লালচে,টলমল অশ্রুসিক্ত চক্ষুজোড়া নিক্ষেপ করল চোখ পাকিয়ে নিষ্পলক চেয়ে থাকা তেজী এক পুরুষের পানে। কী কারণে,কেন চ-ড় খেল নিশাত ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। প্রশ্ন করতেও কলিজা ছোট হয়ে যাচ্ছে যেন। উপায় না পেয়ে চুপটি করে বসে বসে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল কোনো প্রকার শব্দহীন, অনবরত। সেকেন্ডের কাটা পার হলো বোধহয়,বজ্রপাতের মতো ওর কর্ণকুহরে হামলা করল তেজী পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
‘ গর্দভ আমি তোকে থা”””প্পড় দিয়েছি কেন জিজ্ঞেস করবি না? না জিজ্ঞেস করে কেঁদে যাচ্ছিস কেন?’
প্রহরের রাগত্ব স্বরে অনিচ্ছায় নিচু কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘ মে”””রেছেন কেন?’
‘ তুই আমাকে আগে কী ডাকতি?’
‘ কী ডাকতাম? ‘
নিশাত হতবাক, কণ্ঠ ভেজা। প্রহর বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে হাত পেতে দিয়ে আদেশ করল,
‘ হাত দে। ‘
হাতের দিক এক নজর তাকাল নিশাত। ব্যকুল তার অভ্যন্তর। ওই হাত ছুঁবে কি ছুঁবে না তা নিয়ে মনে অসংখ্য দ্বিধাদ্বন্দ্ব,প্রবল উত্তেজনা। প্রহর বিরক্ত হয়ে তেঁতে উঠল,
‘ হাতটা ব্যথা করিয়েই শান্তি পাবি?’
তড়িঘড়ি করে বা হাতটা প্রহরের হাতের করপুটে রাখল ও। নিমিষেই তোলপাড় সমগ্র সত্তায়। বিদ্যুৎ গতিতে শিহরণ খেলে যেতে লাগল সারা দেহে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। নিজেকে আবিষ্কার করল সুঠাম দেহের সন্নিকটে,শ্যাম মুখখানির অত্যন্ত কাছাকাছি।

প্রহর হাতটা কঠিনভাবে মুঠোয় পুড়ে রাখল। অল্প একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল,
‘ তুই আমাকে আগে ” আপনি” করে ডাকতি?’
এহেন প্রশ্নে নিশাত থ হয়ে গেল। চোখের জল পড়া বন্ধ হয়ে গেল নিমিষেই। পরক্ষণেই ফটাফট উত্তর দিল,
‘ না। ‘
‘ কী বলে ডাকতি?’
মেয়েটা কিছুটা লজ্জা, কিছুটা সংকোচ, কিছুটা কাঁপুনি সমেত বলল,
‘ তুমি করে। ‘
প্রহর তিরস্কার সুরে উচ্চারিত করে,
‘ তাহলে ডাক বদলে গেল কেন? তুই কী এখন তুমি করে বলতে লজ্জা পাস? কাহিনী তো এমনই মনে হচ্ছে আমার। নাকি অনেক বছর গ্রামে আসি নি বলে আগে কী ডাকতি ভুলে গেলি?’
তিন তিনটে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে নিশাত ঘাবড়ে গেল। শেষের প্রশ্নটার উত্তরটা ও পারে। উত্তরটা হলো- প্রহরের সাথে যোগাযোগ না থাকায় পূর্বের মতোন সেই তুমি ডাকটা ডাকতে ভারী লজ্জা লাগে। এখন এটা মুখে বললে প্রহর যে আরো একবার ওর গাল লাল করে ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উপায় এখন মৌনতা। মৌনমুখে সময় পার করতে উদ্যত হলো ও। প্রহর কঠিন গলায় বলল,

‘ গ্রামে আসার পরই আমি এই ব্যাপারটা নোটিশ করেছি। রাস্তাঘাটে থা””প্পড় দিলে তোর মান সম্মান থাকবে না,তাই থাপ্প–ড়টা চার দেয়ালের মাঝেই মা-রলাম। যত হোক তোর সম্মান মানে আমার সম্মান, তোর বেইজ্জতি মানে আমার কলিজা ক্ষত হওয়া। যা করব আমি করব,অন্য কেউ তোকে ছুঁতেও পারবে না। আমারটা আমিই সামলাব, আমিই শাসাবো, আমিই মা-রব,আদরও আমিই করব। অন্য কোনো ব্যক্তির জায়গা নেই তোর আমার মাঝে। একদম খু”””ন করে গায়েব করে ফেলব।’

নিশাত নির্বাক,স্তব্ধ। বুকটা ধপধপ করছে ওর। প্রহরের ঝাঁঝালো চাহনি হতে দৃষ্টি সরালো। তার সদ্য সচেতন হওয়া,প্রেমের উষ্ণতায় পুড়ে ছাড়খাড় হতে থাকা চিত্ত একটু একটু করে প্রহরের উচ্চারিত একেকটা কথা ঠাহর করতে মত্ত হয়ে পড়ল। বুঝল কিছু কিছু। তবে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে অসফল হলো। প্রহর ভাই কি ওকে পছন্দ করে! করলে তনুজাকে কেন বিয়ে করতে যাচ্ছে! হয়ত ওকে মামাতো বোন হিসেবে এভাবে ট্রিট করছে। সবসময়ই এমন করে আসছে,এ আর নতুন কী! মা**রছে,শাসাচ্ছে,মন চাইলে একটু আধটু যত্ন দেখায়। এই মানুষটা এমন কেন? ওর জন্য সঠিক একটা কিছু বুঝবার কোনো পথ কেন রাখছে না!

‘ ওঠ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়িতে ফিরতে হবে। ‘

নিশাত মনের উতালপাতাল ভাবনা নিয়ে প্রহরের হাতে হাত রেখেই ওঠে দাঁড়ায়। প্রহর অন্য হাতে পকেট হাতড়ে একটা ক্ষুদ্র নীল বক্স বের করে সামনে ধরল। চিনতে সামান্যও মাথা খাটাতে হলো না ওর। এটা একটা আংটির বক্স। বক্সটা প্রহর ওর হাতের আঁজলায় রেখে বলল,

‘ এটা আমার বহু বছরের জমানো প্রেম। এখন তোর কাছে আমানত রইল। ভুল করেও খুলবি না। শুধু জানবি এই আমানত তুই আগলে রাখলেই সঠিক সময়ে সুন্দর একটা সারপ্রাইজ পাবি। হতে পারে তোর অতিরিক্ত কাঙ্ক্ষিত কোনো জিনিস, যার জন্য তুই ভিতরে ভিতরে অস্থির। ‘

একরাশ বিস্ময়ে জড়িয়ে পড়ল নিশাত। বক্সটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। প্রহর ধীর স্থির ভঙ্গিতে, গাঢ় স্বরে বলল,

‘ শোন তিলবতী। আমি একটু অন্যরকম,একটু না পুরোই। অগোছালো, নির্বিকার স্বভাব ছাড়তে পারব না। তোর সাথে এমন আচরণ করেই শান্তি পাই আমি। বাকি সবার মতো যত্ন আমি প্রকাশ্যে করতে পারব না। তোর জন্য অপ্রকাশ্যেই অনেক কিছু করতে অভ্যস্ত আমি। ‘

নিশাত অপ্রতিভ হলো। সামলাতে ব্যর্থ সে গভীর স্বরের একেকটা বাক্য। তড়বড় করে ডাকল,
‘ প্রহর ভাই! ‘
সঙ্গে সঙ্গে ভরাট স্বর ভাসল,
‘ তোর সামনেই আছি। বল। ‘
বুনন করা প্রশ্নটা গুলিয়ে ফেলল সে। প্রচন্ড অস্বস্তি ঘিরে ধরল ওর মনকে। নতজানু হয়ে প্রহরকে বলল,
‘ তোমার ব্যবহারে আমি কষ্ট পাই না। ‘
প্রহরের চক্ষুদ্বয় বড় বড় আকার ধারণ করল। প্রশ্নবিদ্ধ, তুখোড় দৃষ্টিতে চাইল। প্রশ্নসূচক বাক্য মুক্ত হলো কণ্ঠ হতে,
‘ তুই সত্যিই আমার ব্যবহারে কষ্ট পাস না?’
নিশাত ক্ষীণ স্বরে জবাবে জানায়, ‘ না। ‘

‘ তোর হাবভাব ভালো না নিশু। আমার ধম-কিয়ে ধম-কিয়ে কথা বলায় তোর চোখে পানি চলে আসে তা কি আমি লক্ষ্য করি না? কিন্তু ইদানিং তুই অন্যরকম বুলি আওড়াচ্ছিস। শুনলাম তোর নাকি বমি বমি পাচ্ছে? কৃমির ওষুধ খাস না ক’মাস হবে? চল,এক্ষুণি তোকে ওষুধ কিনে দেবো। ‘

নিশাতের কলিজা মুচড়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রথমেই মাথায় এলো শিমুলের নামটা। শরমে অবস্থা কাহিল। যদি সম্পূর্ণ ঘটনা শিমুল প্রহরকে বলে দিয়ে থাকে,তাহলে ও খতম। কিন্তু মনে হয় না বলেছে। অস্থিরতায় মেতে উঠল অন্তঃপুর। প্রহরের পিছু পিছু বাহিরে এলো। বাহিরে আসতেই দেখতে পেল বাবার সেই বন্ধুকে। মেয়ের বিদায় লগ্ন সমাপ্ত করে সবে দুয়ারে এসে থামলেন। প্রহর উনাকে দেখা মাত্রই বলল,

‘ আসি চাচা। চিঠিটা?’
‘ ওহ হ্যাঁ! একটু দাঁড়াও বাবা। আমি গুছিয়ে রেখেছি। ‘

হাবিব সাহেব ত্রস্ত পায়ে গেলেন,ফিরেও আসলেন দ্রুত পদলি ফেলে। পার্থক্য কেবল হাতে একটা চিঠি। বহু পুরোনো বোধহয়। খামে কেমন নীলচে রং লেপ্টে আছে। প্রহর চিঠিটা হাতে নিয়ে বলে,’ আসি। ‘

বাইকে ওঠে প্রহরের কাঁধে হাত রাখল নিশাত। ভয় পাচ্ছে ও। বেলা ফুরিয়ে গেল,নিশ্চয়ই মজুমদার বাড়িতে হুলস্থূল পড়ে গেছে ওর এখনও বাড়ি না ফেরার। প্রহরের সামনে কিছু বলতেও পারছে না। উজ্জ্বল প্রকৃতি নিভে গিয়ে কমলাটে আবরণে আবৃত হয়েছে। বাইক চলছে দ্রুত গতিতে। হয়ত প্রহরেরও ফেরার ভীষণ তাড়া। সাপোর্টের খাতিরে আরেকটু শক্ত করে প্রশস্ত কাঁধে হাতটা চেপে ধরল ও। তক্ষুনি ভয়ংকর এক দূর্ঘটনা ঘটে গেল। এমন ঘটনার সম্মুখে প্রথমবার পড়েছে ওর তনুমন,চোখ।
___________________________________

রফিক আজম হিসাবের খাতাটা নিয়ে হিসেব কষছিলেন। আর অল্প কিছুক্ষণ। তৎপরে আজান পড়বে মাগরিবের। রোকেয়া পরনের কাপড়ের আঁচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন। মনটা বিষিয়ে আছে তাঁর পিংকির মায়ের কথা শুনে। স্বামীর কাছাকাছি চেয়ার টেনে বসে গলা ঝারলেন।

‘ নিশাতের আব্বা। ‘
‘ হু। ‘
খাতায় নজর নিবিষ্ট রেখেই ডাকে সাড়া দিলেন রফিক আজম। রোকেয়া শুকনো মুখে বললেন,
‘ নিশুরে লইয়া একটা কথা কইতাম। ‘
‘ কী কথা? কী করছে ও?’
স্বামীকে এসব বলা যাবে না বিধায় কথাটা মনে চেপে রেখে, অন্য কথা তুললেন,
‘ মাইয়ার বয়স কম হয় নাই। আপনেরে অনেক আগে আমার এক খালাতো বোনের কথা বলছিলাম না?’
‘ তোমার ওই দূর সম্পর্কের খালাতো বোন?’
‘ হ্যাঁ, রুমানা আফা। আফার পোলার কথা কইছিল গত বছর আমাদের নিশুর জন্য, আপনের মনে আছে?’

গত বছর নিশাতের মামার বাড়িতে ওর মামাতো বোনের বিয়েতে রোকেয়ার দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোন নিশাতকে এক দফা দেখেই পুত্রবধূ রূপে বাছাই করে বসেন। প্রস্তাব রাখেন সরাসরি। তখন রফিক আজম বলে দেন যে বিয়ের কথা ভাবেন নি মেয়ের জন্য। বয়সে এখনও মেয়ে অপরিপক্ক। কিন্তু এখন সেটা বলতে পারবেন না তিনি। কারণ এই অপরিপক্ক বয়সেই পিংকিকে অন্য ঘরে তুলে দিয়েছেন। বছর পেরিয়ে রোকেয়া ফের কেন এ প্রসঙ্গে কথা বলছে ঠাহর করতে পারছেন না। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন,
‘ হঠাৎ এই কথা কিরে সৌরভের আম্মা?’
‘ রুমানা আফা আমাকে গত রাতে কল দিছিল। বলল তার মাইয়ার বিয়া ঠিক। এখন ছেলেরও একটা গতি করতে চায়। নিশাতের ওপর এখনও তার মন পইড়া আছে। ‘

কথাটা বলে জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক অধর ভিজিয়ে নিলেন রোকেয়া। রফিক আজম হিসাবের খাতা বন্ধ করলেন নিঃশব্দে। স্ত্রীর দিক ঘুরে বসলেন। বললেন,

‘ ছেলেরে আমি দেহি নাই। শুনছি রাজনীতি করে। আমার এসব কাম ভাল্লাগে না। জাইনা শুইনা কলিজার টুকরারে এমন ছেলের হাতে আমি দিতে পারমু না। ‘

রোকেয়া দ্বিরুক্তি করলেন তৎক্ষনাৎ,

‘ আপনি যেমন মেয়ের জন্য পরিবার চান,তেমনই তারা। ছেলে রাজনীতি করে ঠিকি কিন্তু খারাপ না। শুনছি স্বভাব চরিত্র অনেক ভালা। আপনি একবার ভাবেন না নিশাতের আব্বা। তারা একবার নিশাতরে দেখবার আসতে চাইতেছে। শহরে গেলে ও ভালো কইরা পড়তেও পারব। বিয়া এহনই করাইব না। মেট্টিক হইয়া গেলে তারপর নাহয়,,,

‘ ছেলের নাম কী?’

রোকেয়া মৃদু সময় নিয়ে মনে করার চেষ্টায় মগ্ন হলেন। কণ্ঠনালি ভেদ করে অস্ফুট উন্মুক্ত হলো নামখানি,

‘ সমীরণ। ‘

#চলবে,,,!

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____২৮

স্কুল ব্যাগটা বুকে ঝাপটে ধরে বাড়ির অভিমুখে হাঁটা ধরল নিশাত। টালমাটাল পায়ে,ধীরে ধীরেই অগ্রসর হচ্ছে ও। ভীতসন্ত্রস্ত মন, নিরীহ হাল নিয়ে গুণে গুণে তিন পা ফেলে থেমে যায় হঠাৎ। তাকায় পশ্চাতে। অচিরেই চোখ গিয়ে আঁটকালো তরল ঈষৎ লাল রক্তে ভিজে ওঠা শার্টের দিক। নিশাতের অনুভূত হলো ওর চোখ ভারী হয়ে উঠেছে, জ্বলছে প্রচন্ড। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে নিমিষেই হয়ে পড়ল ক্ষমতাশূণ্য। ঝুঁকল, নেতিয়ে পড়ল অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিযুগল। অটল হয়ে রইল সেখানেই।

প্রহর বাইকে হেলান দিয়ে থেকে সবটা লক্ষ্য করল। দ্রুত গভীর চাহনি নিক্ষেপ করল ডান বাহুতে। সাদা পট্টির উপর অতি সূক্ষ্মভাবে,নির্বিঘ্নে ভেসে উঠেছে লালচে রঙ। টনক নড়ে ওঠে তার মুহূর্তেই। মস্তিষ্কে উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটতে থাকে একটা বিষয়। ক্ষত পায়ে দ্রুত হতে দ্রুত বেগে এসে আঁকড়ে ধরল নিশাতের দুর্বল শরীর। বন্দিনী বানাল বক্ষস্থলে। শক্ত বন্ধনক্রিয়ায় আবদ্ধ করে ছাড়ে পরম স্বস্তির নিঃশ্বাস। সর্বক্ষণ ক্ষেপাটে থাকা কণ্ঠটা হয় কোমল। শীতল কণ্ঠে বলল,
‘ মুখ তুলবি না। স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস ফেল। র*ক্ত দেখলেই কেন এমন করতে হবে?’

প্রহর নিরব হয়ে গেল এটুকু বলে। পুনরায় চাপা ক্লেশে বলে উঠে, ‘ আমার কাছাকাছি এলেই অনিরাপদ তুই। সেটার ছোটোখাটো প্রমাণ আজ পেলি তো? প্রিয় কোনো জিনিসকে কখনো কেউ নিরাপদহীনতায় ভুগতে দেয় না। তেমন আমিও দেবো না। তুই হলি আমার কাছে শখের পুতুল, যার দেহে আঁচড় লাগলেও আমার জ্বলন নিশ্চিত। ‘

নিশাত দুই হাতে প্রহরের পিঠ আঁকড়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। কথা হলো প্রহরের হাতের র*ক্ত দেখেই ভেঙে পড়েছে সে। ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকালে বোধহয় এমনতর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। তাছাড়া আসার পথে যা ঘটেছে তাতেই দুর্বিষহ অবস্থা। ভ-য় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ঘর বানিয়েছে মানসপটে। এখনও অভ্যন্তর ধড়ফরানোতে ব্যস্ত। চক্ষু গহ্বরে বার বার হানা দিয়ে চলছে সুদূর হতে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসা বু**লেট টার ঠিক তার এবং প্রহরের পাশ দিয়ে যাওয়ার দমবন্ধকর দৃশ্যখানি। ভাগ্য সহায় ছিল বলে এটার কবল থেকে রেহাই পেয়েছে তারা। কিন্তু উল্টো হাতে ওকে সামলাতে গিয়ে বাইক থেকে পড়ে গিয়ে ইটের কণা গেঁথেছে প্রহরের বাহুতে। ওর শরীরে খুব একটা লাগে নি। যা ধকল গিয়েছে সবটা সানন্দে গ্রহণ করেছে প্রহর। পথিমধ্যে ফার্মেসিতে ব্যান্ডেজ সারিয়ে নিয়েছে।

‘ বাড়ির পেছনের হিজল গাছের নিচে নিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। তুই পাঁচ মিনিটে আসবি। ‘

শক্ত, আদেশমূলক কণ্ঠ শুনে নিশাত নড়চড়ে উঠল। সম্বিৎ ফিরে পেল সে। বুক থেকে সরে আসতে নিলে প্রহর কোমর চেপে ধরে। রুষ্ট হয়ে বলল,
‘ পড়ে যাবি তুই। ‘
নিস্তেজ গলায় নত দৃষ্টে বলে উঠল ও,
‘ আমি যেতে পারব। তুমি হাতে আবার ব্যান্ডেজ করিয়ে নিও ভাইয়া। ‘
প্রহর হুকুম করে,
‘ চোখ তুলে আমার দিকে তাকা। দৃষ্টি শুধু আমার মুখের দিকেই রাখবি। ‘
নিশাত কচ্ছপের গতিতে চোখ দু’টোর দৃষ্টি সঁপে দিল মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষটার প্রগাঢ় চাহনিতে। বুকের ভেতর ভয়ংকর যন্ত্রটা বেতাল হয়ে ছুটতে শুরু করে নিমিষেই। পুরুষোচিত দৃষ্টির কবলে থাকতে পারছে না ও। পল্লব জোড়া নুইয়ে পড়ছে বারংবার। প্রহর ঘোর আপত্তি জানাল এতে,
‘ চোখ লুকাচ্ছিস কেন? তাকাতে বলেছি না তোকে? ‘
তন্মধ্যে নিরাবেগ গলায় উত্তর দিল নিশাত,
‘ পারব না। ‘
প্রহর ঘন সন্দেহের চোখে তাকায়। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ কেন পারবি না? আমার চোখের দিকে তাকালে তুই কী ধ্বংস হয়ে যাবি?’
নিশাতের অতিশয় ক্ষীণ কণ্ঠস্বর,
‘ শেষ হয়ে যাব একেবারে। ‘
‘ এটুকু বয়সে শেষ হলে হবে তোর? তোকে শেষ করার জন্য কত কত প্ল্যান করে রেখেছি। চোখে চোখ পড়লে শেষ হবি না তুই। তাকা আমার দিকে। ‘

হৃদয়কুহর বেকাবু,বেসামাল, নিয়ন্ত্রণহীন। জড়োসড়ো হয়ে পড়ল নিশাত। সে অতীব নিচু কণ্ঠে, আনমনেই বলেছিল কথাটুকু। ভাবে নি প্রহরের শ্রবণশক্তি এত তুখোড়। অপ্রকৃতস্থ চাহনি মেলে ধরল প্রহরের সমুখে। মনের অলিন্দে পায়চারি করতে থাকল উচ্ছ্বসিত আবেগ,প্রেম, আকাঙ্ক্ষা। কি সুন্দর মিচমিচে কালো মণির ওই নেত্রযুগল! কত সুন্দর এই শ্যামপুরুষ! কালো মণির আশপাশ অল্পস্বল্প লাল। এ যাত্রায় চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল নিশাত। চেয়ে রইল অনিমেষ, পলকহীন৷ প্রহর কোমরের বাঁধন সামান্য শিথিল করে। বা হাতে ওর চোখের কোণে জমায়িত অশ্রু কণা মুছে দেয় আঙুলের সহায়তায়। আলিঙ্গনে রেখেই বলে,

“চোখ দুইটা লাল তোর
ছিন্ন হইতেছে আমার অন্তর
চরম কষ্টে ছটফট করছে আমার প্রাণ
এর কারণ কী তুই সুইটহার্ট?”

বেগতিক হারে রক্ত ছুটতে থাকে শরীরে। নিশাত জমে গেল,থমকে গেল। বরফ ন্যায় পরিণত হলো সমস্ত কায়া। কিশোরী সে,তবে অতটাও অবুঝ নয় যে প্রেমবাক্য,অনুভূতি বুঝবে না। তবে কী প্রহর ভাই! মুখের কথাগুলো একটুও মিছে লাগছে না ওর কাছে। বরঞ্চ ইচ্ছে করছে সামনের মানুষটাকে ঝাপটে ধরতে। প্রশ্ন করতে, ‘ কবে থেকে আমার জন্য তোমার অন্তর এমন করেই ছটফট করে প্রহর ভাই? ‘ কিন্তু হায় সে পারবে না,যতক্ষণ না গোপনের ভালোবাসা হচ্ছে পরিস্ফুটিত। তবে একটু আধটু উপলব্ধি করতে সফল ও এবার আর তার ভাবনা নিছক নয়। আগে ভালোবাসা শিখে গেলে হয়ত! হয়ত ও শাসন,আদর সবকিছুতে খুঁজে পেত প্রেম।
___________________________

শিমুল বিরক্তির চূড়ান্ত অবস্থায় বিরাজমান। চোখ মুখ কুঁচকে জেদ চেপে যাচ্ছে অতি সন্তপর্ণে। এত এত বিরক্তির কারণ হলো তনুজা। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে সবেমাত্র সদর দরজা ডিঙিয়েছিল ও। এরই মধ্যে তনুজা পিছু ডেকে বসল। শাড়ির আঁচল মাথায় তুলতে তুলতে দু তিনটে প্রশ্ন ছুঁড়ে মা–রল আমুদে গলায়,

‘ কোথায় যাচ্ছো ননদিনী? মাগরিবের আজান দিচ্ছে। এ সময় কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে?’

শিমুলের চিল্লিয়ে বলতে মন চাইল,’ না নিয়ে যাওয়া যাবে না,উড়ে এসে জুড়ে বসে ভাবী হতে চাওয়া নীল বাবরিওয়ালি। ‘

অথচ বলল না। বিষয়টা দৃষ্টিকটু দেখায়। এ বাড়ির একটা নিয়ম আছে। কখনোই কোনো অতিথির সাথে কিঞ্চিৎ বা*জে আচরণ করা যাবে না। নিয়মটা বড় কাকার বানানো। ফলস্বরূপ তনুজার সাথে কখনোই না। শত হোক ভাবী হবে এ বাড়ির যদি প্রহর বিয়ে করে আরকি! বলাবাহুল্য তনুজার ব্যবহার যথেষ্ট অমায়িক। সুতরাং খারাপ কোনো গুণাগুণ না পেয়ে অবহেলা কিংবা ঘৃ**ণা করার মতো কান্ড না করতে পেরে শিমুল বড্ড হতাশ।

‘ এক সখির বাড়িতে যাব। এই যাব এই আসব। ‘
তনুজা উজবুকের ন্যায় তাকালো। মুখটা বিকৃত করে বলল,
‘ সখি?’
শিমুলের মস্তিষ্কে এলো শহুরে,বিদেশীনি মেয়ে এই ওয়ার্ড এ জনমে শুনেছে কিনা সন্দেহাতীত। বুঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
‘ সখি মানে ফ্রেন্ড। ‘
তনুজা উৎকণ্ঠিত, ‘ আমাকে নিয়ে চলো না শিমুল। ওয়েদারটা বেশ সুন্দর। হাঁটতে ইচ্ছে করছে। তোমার ভাইয়াও সেই যে বের হলো খবর নেই। তার জন্য এখানে ছুটে এলাম, নেতাসাহেবই আমাকে ফেলে লাপাত্তা। ‘

শিমুলের অবস্থা বেগতিক। দুনিয়া ভেসে গেলে যাক। তবুও তনুজাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। নিয়ে গেলে আজ ওর সমাপ্তি অধ্যায় চলে আসবে। ভাইয়ের শিষ্য হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে চিরতরে। সেই সাথে সকল সুযোগ সুবিধা হাতছাড়া হয়ে যাবে। ভাইয়ের কথা মোতাবেক চললে সে সর্বপ্রথম যেই বেনিফিটটা পাবে সেটা হলো সৌরভের সাথে বিয়ের ব্যাপারে সমর্থন। এটাই ওর জীবনের চাওয়া,ড্রিম। কী করে হাতছাড়া করবে তিলে তিলে গড়া এ স্বপ্ন! চটপটে গলায়, মুখের ওপর বলে উঠল,
‘ আপনাকে নেওয়া যাবে না এখন। আমার দেরি হচ্ছে, যাই।’
বলেই এক পা ফেলল। তক্ষুনি ভরাট,থমথমে কণ্ঠ এলো কর্ণকুহরে।
‘ কোথায় যাচ্ছিস এ অবেলায়? ওরে কেন নিয়ে যাচ্ছিস না?’
মোশতাক সাহেব ভাইকে নিয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন কেবল। তনুজার কথা খানিকটা শুনেছেন তিনি। খনখনে গলায় বললেন,
‘ তনুজা মামণিকেও নিয়ে যা। আর জলদি ফিরে আসিস। ‘
বড় কাকার সামনে ভিজে বেড়াল শিমুল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়,নিয়ে যাবে। মলিন স্বরে তনুজার উদ্দেশ্যে বলে,’ চলেন আপু। ‘
‘ হেই শিমুল,মাই ননদিনী। আপু ডেকো না। ভাবী ডাকলে খুশি হব। ‘- আনন্দিত কণ্ঠস্বর তনুজার।
শিমুল নিরাসক্ত হয়ে বলল,’ ঠিক আছে। ‘

অমানিশা ধরণীতলে ছেয়ে যাওয়ার সূচনা ঘটিয়েছে। রশ্মিকে আড়াল করে প্রদর্শন করে চলেছে আস্তে আস্তে স্বয়ং রাজত্ব। বিস্তর অম্বরে কালো মেঘেরা খিলখিল করে হাসছে যেন। শাঁই শাঁই করে দক্ষিণ হতে উত্তরে বইছে শীতল বায়ু। মোবাইলের মৃদুমন্দ আলোতে শিমুল ক্ষেত পর্যন্ত এলো। আইল ধরেই মজুমদার বাড়ির পেছনে গিয়ে উঠবে। তার পূর্বে তনুজার একটা ব্যবস্থা করতে হবে ওর। নয়ত যাওয়া যাবে না। পাঁচ মিনিটের স্থলে সেই কবে দশমিনিট অতিক্রান্ত হয়ে এগারো চলছে। মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করল। ভাইকে জমের মতো ভয় পায় সে। এদিক সেদিক আলো ফেলতেই চট করে চমকে উঠল,বুদ্ধি পেল। যদিও রিস্কি, এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। কমছে কম আঁটকে রাখা যাবে গুটি কয়েক মিনিট।

নিচে বসে চিকন, ক্ষুদ্র লাঠিটা হাতে তুলে নেয় শিমুল। অধর কোণে তার সুপ্ত হাসি লুটোপুটি খাচ্ছে। অতি সূক্ষ্মভাবে জোঁকটা লাঠিতে তুলল। তনুজা প্রচন্ড উদ্বিগ্ন,

‘ কী করছো তুমি বসে বসে? অন্ধকার হয়ে গিয়েছে সব। ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না আমি। চলো,চলে যাই শিমুল। ‘
‘ আমি যেতে পারব না। আপনি চলে যান। ‘
‘ না না আমি যাব না৷ গা কেমন ছমছম করছে। তুমি চলো না প্লিজ। ‘
সকরুণ আর্তনাদ তনুজার। শিমুল মন পাল্টে ফেলার উদ্যোগ নেয়। পরক্ষণেই ভাবনা জাগে এছাড়া কোনো উপায়ন্তর নেই। লাঠিটা খুব সাবধানে, অগোচরে তনুজার শাড়ির কুঁচিতে ফেলে দিল। কথার তালে তালে নজরে এলো না তনুজার। শিমুল চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলতে থাকে,

‘ দেখুন আপনার শাড়িতে জোঁক। নড়বেন না ভাবী। নড়লে এটা আপনার সব র**ক্ত খেয়ে ফেলবে। ‘

তনুজা ভরকে গেল। ঠান্ডার মাঝেও তার সাদা ললাটে ঘাম বিন্দু জড়ো হতে লাগল অকস্মাৎ। নড়ল না একটুও। জোঁকের নাম সে শুনেছে,দেখে নি কোনোকালে। শাড়ির পাড়ের দিকে এটা লেপ্টে আছে বিশদ। রীতিমতো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল পা। আর্দ্র গলায় প্রশ্ন করল,
‘ এখন কী হবে? ‘
শিমুল ঠোঁটের হাসিটা আড়াল করে মিষ্টি আওয়াজে বলল,
‘ আপনি দাঁড়ান। বেশি না দুই মিনিট দাঁড়ান। আমি আমার বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে দেখি এটা সরানোর কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা। ‘
‘ কী!’- তনুজা চমকে উঠল। তোতলাতে তোতলাতে বলল আবারও,
‘ আমি এতক্ষণ এটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। প্লিজ সেভ মি। তুমি যেও না ননদিনী। ‘
‘ আমি না গেলে আপনার এটা নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আপনার হাতে মোবাইল আছে না? ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে একটুখানি অপেক্ষা করুন। ‘

শিমুল আর সেকেন্ড সময়টুকুও বিলম্ব করে নি। ভীত তনুজাকে ফেলে পুকুর পাড় দিয়ে দৌড়ে এলো। বড় বড়, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বিমোচন করে দেয় প্রকৃতিতে। ওই তো ভাইকে দেখা যাচ্ছে পেছন দিক থেকে। দ্রুতপদে হেঁটে এলো সেখানটায়। ডাকল,
‘ ভাই। ‘
প্রহরের হাত নিশাতের চিকন কোমর হতে ঢিল হয়ে এলো। আলতো করে সামলে রাখল ওকে। বোনের চেহারায় ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ফেলে কোনো বিড়ম্বনা ছাড়াই।

‘ তোর আসতে এত সময় লাগল কেন? রাত হয়ে গেছে। মামীকে আমি বলেছিলাম নিশু তোর সাথে ছিল। ব্লা**ড দেখে ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ওকে আমি নিয়ে যেতে পারব না। তুই ওকে সামলা। আমি মামীকে কল দিচ্ছি। আর হ্যাঁ বলবি ও গরমে একটু সিক হয়ে গেছে। কল দিয়েই এখান থেকে চলে যাব আমি। ‘

শিমুল হ্যাঁ বলতে গিয়ে আঁতকে উঠল। রুহু কেঁপে উঠল মেয়েটার। তড়তড় করে কণ্ঠনালি গলিয়ে বের হলো,

‘ তোমার হাতে কী হয়েছে ভাইয়া?’

প্রহর প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে ভাবুক কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

‘ তনুজার ভাই সমীরণ বাসায় ছিল সারাটাদিন? ‘

‘ ছিল। রুমেই ছিল সারাদিন। দুপুরে খাওয়ার সময় দেখেছিলাম। তারপর আম্মুর কাছ থেকে জানলাম রুমেই আছে। কেন ভাইয়া?’

‘ কিছু না। তুই নিশুকে ধর। ‘

নিশাত নরম কণ্ঠে বাঁধ সাধল,

‘ আমি যেতে পারব ভাইয়া। ‘

‘ তুই আমার থেকে বেশি বুঝিস?’– ভারিক্কি স্বর প্রহরের।

শিমুল এগিয়ে এসে ওর একটা হাত ধরল। বলল,

‘ তোকে দুর্বল দেখাচ্ছে নিশু। সমস্যা নেই মামী আসা পর্যন্ত আমি থাকি। ‘

প্রহরের মাথায় রা**গ দাপাদাপি করছে। মস্তিষ্ক অতিকায় উত্তপ্ত। রোকেয়াকে কল দিয়ে উল্টো ঘুরল যাওয়ার উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,

‘ ওকে মামীর হাতে তুলে দিয়েই আসবি। প্রত্যয় আছে বাজারের দিকে। ও এসে নিয়ে যাবে তোকে। একা যাস না। ‘

শিমুলের তনুজার কথা মনে পড়তেই নিম্নস্বরে হাঁক ছাড়ল,

‘ তনুজা আপু এসেছে আমার সাথে। উনাকে জোঁকের ভয় দেখিয়ে ক্ষেতের মাঝে রেখে চলে এসেছি ভাইয়া। ‘

প্রহর হাতের জ্বলনে চোখ মুখ খিঁচে বিড়বিড় করল,

‘ এই দুই ভাই বোন আমার জান নিয়েই ঠান্ডা হবে। শুধুমাত্র খেলার গুটি বলে এত এত যত্নআত্তি। ‘

গলায় ঈষৎ ঝাঁঝ এনে বলল,’ আচ্ছা আমি দেখছি। ‘

ব্যাস! বড় বড় পা ফেলে চলে গেল প্রহর। বিছুটির জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে গেল নিশাতের সারা অঙ্গে। মা’কে আসতে দেখে কিছুটা ধাতস্থ হলো ও। রোকেয়া ভ্রুঁকুটি করলেন। জহুরি চক্ষে পরখ করলেন মেয়েকে। শিমুলের পানে চেয়ে বেশ অসন্তুষ্টির সুর তুললেন,

‘ তোরা এত দেরি করছস ক্যান? আলতা কইল আজানের আগে পাঠায় দিব নিশুরে। তোর বড় মামা বাড়িত। আমি উনারে কইছি নিশু স্কুল থাইকা ফিরা ঘুমাইতেছে। এমন করলে নিশুরে চাইলেও আর তোদের বাড়িতে দিতে পারমু না। ‘

মুখ হা হয়ে গেল শিমুলের। তার মানে ভাইয়ার সাথে মা-ও যোগ! মিহি কণ্ঠে প্রতুত্তর করে,

‘ একটু দেরি হয়ে গেল মামী। বাড়িতে মেহমান ছিল। সবাই নিশুরে ছাড়তে চাইছিল না। কাল ওকে পাঠিয়ে দিয়েন প্লিজ। ‘

‘ আর সম্ভব না। তোর মামার থাইকা লুকাইয়া এইসব করতে পারমু না আমি। দোয়া করি প্রহরের আংটি পড়ানোর অনুষ্ঠানটা ঠিকঠাক হইয়া যাক। তুই কেমনে যাবি?’

‘ প্রত্যয় ভাইয়া আছে মোড়ে। নিয়ে যাইবে। ‘

‘ আচ্ছা ভালোমতে যাইস। আর গিয়া আমারে ফোন দিস,নইলে চিন্তা লাইগা থাকব। ‘

‘ আচ্ছা মামী। ‘

রোকেয়া নিশাতকে ধরে ঘরের দিকে রওনা হলেন। কলে প্রহর বলেছে নিশাতের শরীর খারাপ, খুব মাথা ব্যথা নাকি! মেয়েকে আজ জেরার তোপে ফেলবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রহরের প্রতি নিশাতের মনে যে প্রেমলীলা জন্মেছে সেটা উনি দূর করেই ক্ষান্ত হবেন বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন।

‘ তুই ঘুরেফিরে এই বাড়িতে কী করিস?’

গম্ভীর, তীক্ষ্ণ স্বর। শিমুল আতঙ্কিত। শংকিত, বিস্মিত নেত্রে তাকাল পাশ ফিরে। সৌরভ বক্র চাউনি মেলে রেখেছে স্পষ্টত। জামার ওপর দিয়েই ভয়কে ঠেলেঠুলে ভাগাতে ছোট্টবেলার মতোন বুকে কয়েকটা থু থু দিল ফটাফট। স্মিতহাস্যে,লাজুকতা মিশিয়ে শুধালো,

‘ আমার চাঁদ এ বাড়িতে। রাত হইছে, চাঁদ দেখতে আসমু না?’

এলাচির এলোমেলো ঘ্রাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে বাতাসে,বাতাসে। তোড়জোড় রান্না চলছে বোধহয়। সৌরভ ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে সদ্য নেমে আসা নিশীথের আকাশে রাখল দু চোখ। একাগ্রচিত্তে বলে,

‘ শিমুল! চাঁদ তুই। আর আমি হলাম দাগ। মোহনীয় চাঁদের গায়ে কখনো আমি হতে চাই না কলুষ। ‘

#চলবে,,,,
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার অনুরোধ রইল।)