#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৩০
সবে গভীর নিদ্রা ভর করেছিল সৌরভের মলিন,কালচে চোখ দুটিতে। বহু রাত্রি ভালো ঘুম আসে না তার। ধরা দিতে চায় না খুব সহজে। তৃপ্তিদায়ক ঘুমের আশায় যুগ যুগ অপেক্ষা করতে হবে যেন। সুখ,ভালোবাসা, শান্তির সহিত ঘুমও পালায় তা সে হাড়েমজ্জায় টের পেয়েছে। সদ্য চোখে আসা ঘুম ফের পলায়ন হলো মোবাইল ফোনের মস্তিষ্কে উত্তাপ তুলে দেওয়া শব্দে। বিরক্তি সামলে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিল সে। নাম্বারটা,নামটা দেখে হতবাক হয় ভীষণভাবে। বিশদভাবে মুখাবয়বে লেপ্টে পড়ল বিস্ময়। কণ্ঠে ক্রোধ,গম্ভীরভাব,
‘ ক’টা বাজে জানিস? ‘
ওপাশ থেকে তড়িৎ করে রিনিঝিনি স্বরের আওয়াজ এলো,
‘ মাত্র ভোর সাড়ে তিনটা। ‘
‘ এটা তোর মাত্র মনে হইল?’– চাপা স্বরে গর্জে ওঠে সৌরভ।
শিমুল তোয়াক্কা করল না। ফোনটা নিয়ে ডান পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। প্রবেল উৎসাহিত গলায় বলে উঠল,
‘ একটা স্বপ্ন দেখছি সৌরভ ভাই। ‘
সৌরভের মেজাজ এবার বোধহয় বিরক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে। চোখ জ্বলছে ঘুমের অভাবে।
‘ তুই স্বপ্নের কথা বলার জন্য আমাকে এই অসময়ে কল দিয়েছিস? মে”রে চাপা ভেঙে দিব,ফাজিল! ‘
‘ বকছেন কেন? বকবেন না প্লিজ। স্বপ্নটা আপনাকে নিয়েই দেখছি। মেলা সুন্দর একটা স্বপ্ন। ‘
মায়া মেশানো মিষ্টি স্বর, যা পুরুষের হৃদয় নিংড়ে দিতে সক্ষম। সৌরভের বক্ষস্থলটা ধ্বক করে উঠল। ধীরে ধীরে বা হাতটা নিয়ে নিজের হৃৎপিন্ড বরাবর রাখল সে স্পন্দন পরখ করতে। বড্ড শীতল হয়ে পড়েছে অভ্যন্তর।
‘ বকছি না। কী বলবি জলদি বল,আমি ঘুমাব। ‘
এত সময় যাবত অবিরত বকবক করলেও এখন শিমুলের কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে লজ্জায়। শরমে মরমে তার মর**ণ দশা। কপোলদ্বয় উষ্ণ হয়ে ওঠেছে। হৃদয়কুহর হতে কিছু কথা বের হলো। মনের,মস্তিষ্কের, স্বপ্নে দেখা সাজানো গোছানো লজ্জামিশ্রিত কথা,
‘ আমি দেখেছি মামা আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। আপনি বাড়িতে বলেছেন আমাকে ছাড়া বাঁচবেন না। আমাকে বিয়ে করবেন। তারপর! তারপর মাঝ দিয়ে মনে নেই। কিন্তু আমাদের বিয়ে হয়েছে। ফুলশয্যার রাতে অনেক চিন্তায় ছিলেন আপনি। আমাকে কাছে ডেকে বললেন তুই কি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবি শিমুল? লজ্জায় আমি আপনার বুকে মাথা রাখলাম। তখনই আপনি কানতে কানতে কইলেন আমি একজনরে ভালোবাসতাম শিমুল। সত্যিই কি আপনি কাউকে ভালোবাসতেন সৌরভ ভাই?’
সৌরভের হৃদয় গহনে স্তব্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল অকস্মাৎ। উঠে বসল সে তাৎক্ষণিক। মৃদু চেঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল। ধমকালো কঠিনরূপে।
‘ এসব কী বলছিস তুই? ফোন রাখ,এখনই রাখবি। ‘
শিমুলের জীর্ণ গলায় সেই একই প্রশ্নাতীত বাক্য,
‘ আপনি কি কাউকে ভালোবাসতেন?’
টনক নড়ল সৌরভের। দ্রুত বেগে মাথায় তিক্ত এক বিষয় হানা দিল। বুঝল স্বপ্ন কেবল শিমুলের মনগড়া কাহিনী। আসলে সে প্রশ্নটার উত্তর চায়। সেই প্রশ্নের উদগত হলো কোথা থেকে! আন্দাজে ঢিল ছুড়ছে নাকি জানে ও! সজাগ দৃষ্টি আধো আধো অন্ধকার কক্ষে মেলে ধরল। নিরাসক্ত সৌরভ, ‘ না। ‘
উদগ্রীব হয়ে গেল শিমুল। গলা ভিজে ওঠেছে মেয়েটার। সুন্দর সুন্দর চোখজোড়া টপাটপ অশ্রু ফেলছে হয়ত। অনায়াসে তা বুঝতে পারছে সৌরভ। কি মধুর,ক্রন্দন মিশেল সুর,
‘ মিথ্যা বলতেছেন আপনি। আমি জানি পিংকিরে আপনি পছন্দ করতেন। এ কারণেই আমারে দেখতে পারতেন না। জানবার পর থেকে আমি এক ফোঁটাও শান্তি পাইতেছি না, না থাকতে পেরে কল দিলাম আপনারে। ‘
সৌরভ খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করল,’ এসব তোকে কে বলল?’
জবাব দেয় নি শিমুল। কণ্ঠ তার বিষাদ,অশ্রুকণায় পরিপূর্ণ। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। এ মর্ত্যলোকের সকল যন্ত্রণা তারই গলা চেপে ধরছে যেন বার বার। ওপাশে সৌরভ নিস্তব্ধ হয়ে শুনছে,অনুভব করছে ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ। মিনিট তিনেক কাটল। এক হাতে চোখ মুছে শিমুল আকুতিভরা কণ্ঠে শুধায়,
‘ আমরা যাকে ভালোবাসি সে আমাদের কেন চায় না? আর আমরা যাকে চায় না সে আমাদের কেন পাগলের মতো চায়? আপনি কি আমাকে একটাবার পাগলের মতোন চেয়ে দেখবেন সৌরভ ভাই? বিশ্বাস করেন,এবার ঠকবেন না আপনি। ‘
টুপ করে কল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মোবাইলটা বন্ধ করে দরদর করে ঘামছে সৌরভ। রাত বাড়লেই বাড়ে ঠান্ডা। শীত অতীব সন্নিকটে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির। অপেক্ষা তার কখন বিদায় ঘন্টা বাজবে হেমন্তের। অথচ হিমশীতল পরিবেশেও সুঠাম দেহ হতে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। গলায় শুষ্কতা। শিমুল আস্তে আস্তে হৃদয় নাড়িয়ে তুলছে দিনকে দিন। এ মেয়ের কথা,কণ্ঠস্বর,কান্না,সান্নিধ্য ঘায়েল করে ফেলছে সৌরভের হৃৎপিণ্ড তারই সম্মতি বিহীন। না, আজ আর ঘুম হবে না। তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে স্মরণিকা নিবাসে বসবাসরত সেই শিমুল ফুল। ইতোমধ্যে অনুরক্তির বীজ বপন করে ফেলেছে ভঙ্গুর হৃদয়স্থে। চারা গজিয়ে ফুল ফোটবার আগেই সতর্ক হতে হবে ওর। আদৌ কি পারবে তা!
————————————-
বিরাট এক অমানিশার রাত ঘুম ছাড়াই কাটালো নিশাত। মস্তিষ্ক, চক্ষু কোনোকিছুকেই বিশ্রাম দেয় নি ও। ঘুমোলে সকালে যদি নির্দিষ্ট সময়ে উঠতে না পারে! তাহলে প্রহর ভাইকে দেখবে না ও। চিন্তায়,বিশৃঙ্খল অনুভূতি, মনের উতালপাতাল ভাবনা কোনো কিছুই ওকে ঘুমোতে দেয় নি। ঘুম আর ওর মাঝে ছিল এসব মিলিয়ে বড়সড় একটা শক্তপোক্ত প্রাচীর। চেয়ারের উপরের দিকে থুতনি ঠেকিয়ে সময় গুণতে লাগল। ঘন্টার কাটা তখন আটটার ঘরে। প্রহর ওকে ঠিক ন’টা ত্রিশে বাস স্ট্যান্ডে থাকতে বলেছে। ওঠে দাঁড়াল চকিতে। সবচেয়ে চমৎকার সিঁদুর লাল রঙা জামাটা রাতেই বের করে রেখেছিল। সেটা নিয়ে ত্রস্ত পায়ে ঢুকল গোসলখানায়। সেড়ে বেরুতেই চোখজোড়া বড় বড় হয়ে যায়,হানা দেয় ভয়। চমকে ওঠে,শিউরে ওঠে। ভয়ের দমকে কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে কায়া।
রোকেয়া বিছানা ঝাড়ছিলেন। নিশাতের ঈষৎ কাঁপুনি নেত্রযুগলে বিঁধতেই সংশয়ের চাহনি নিক্ষেপ করলেন উনি। প্রশ্নও সন্দেহ মেশানো,
‘ এত সকালে অমন রঙিন জামা পইড়া কই যাইতেছিস?’
নিশাত ভড়কালো। সদুত্তর উঁকি দিচ্ছে না ওর মন দুয়ারে। ইনিয়েবিনিয়ে বলল,
‘ স্কুলে অনুষ্ঠান আছে আম্মু। সবাই স্কুল ড্রেস ছাড়াই যাইব।’
‘ কই আমি তো আগে শুনলাম না!’
‘ হঠাৎ বলছে,তোমারে বলা হয় নাই। ‘
‘ শিমুল যাইব তোর লগে?’
‘ হু। ‘
এক বুক সাহস নিয়ে পরিপক্কভাবে গুছিয়ে মিথ্যা জবাব দিল নিশাত। মা’য়ের মনে কী চলছে কে জানে! গত কয়েকদিন যাবত সে খেয়াল রেখেছে রোকেয়ার কথা,আচরণ ওর প্রতি অনেক কঠোর। পূর্বের থেকেও বহুত শক্ত। রোকেয়ার অধরদ্বয় আলগা হলো না। মৌনমুখে বিছানা ঝেড়ে রুম ঝাড়ু দিতে লাগলেন তিনি। নিশাত দোনোমোনো করছে। মা’র ভাবগতি তাঁর অল্পস্বল্প বুঝদার মনে শঙ্কার তীব্রতা বৃদ্ধি করে চলেছে ক্রমাগত। তৈরিও হতে পারছে না সে। রোকেয়া দরজার কাছে গিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে গাম্ভীর্য সমেত আওড়ালেন,
‘ সাইজা নিচে আয়। খাইয়া তারপর যাবি। যাওয়ার আগে মনে কইরা গাড়ি ভাড়া লইয়া যাইস। হাইট্টা যাবার দরকার নাই। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
‘ ঢাকা,ঢাকা। এক্ষুনি একটা বাস যাইব আফা। পরের বাস এক ঘন্টা পর। আফনে কি এহনই যাইবেন। গেলে উইঠা যান জলদি। ছাড়বার সময় হইয়া গেছে। ‘
নিশাত শরীর গুটিয়ে বাসস্ট্যান্ডেের এক কর্ণারে এসে দাঁড়ালো। দুইজন লোক আসা অব্দি থেকে বিরক্ত করে চলেছে তাকে। গুণে গুণে চারবার সে জবাবে বলেছে ঢাকা যাবে না। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ক্রমশ বিরক্তি বাড়ছে,একটা সময় অতিক্রম করে ঘা ঘেঁষে দাড়াচ্ছে ওই দু’জনের মধ্যে একজন। এই একজনকে ও চিনে। উজ্জ্বল সাহেবের বিশ্বাসযোগ্য সহযোগী শামসুল হকের ভাতিজা। মেয়েদের দেখলেই উত্ত্যক্ত করায় ঝাঁপিয়ে পড়া তার নিত্যকার রুটিন। আরেকটু সেঁটে গেল ও। প্রহরের দেওয়া সময়ের বিশ মিনিট আগেই এসে উপস্থিত হয়েছে। পরিণামে এমতাবস্থায় পড়ল। ছেলেটা ওর লম্বা ঘোমটার দিকে ঝুঁকে হাসল। সিগারেটে পোড়া ওষ্ঠে তির্যক হাসি বিচরণ করছে তখন। কণ্ঠনালি হতে মুক্ত হচ্ছে গায়ে আ*গুন লাগানো,দুমড়েমুচড়ে দেওয়া শব্দ,
‘ কিরে নিশু নাগরী ব্যাপার স্যাপার নাকি! এইখানে কী করো সোনাপাখি? অত সুন্দর কইরা নতুন বউয়ের লাহান সাইজা আইছিস ক্যান? নাগর না আসলে আমার সাথে চল। আমি কিন্তু প্রেম দিতে কিপ্টামু করমু না। ‘
‘ সুখ কী বেশি দিবি তুই? আমারে এক ঝলক দেখা তো তুই কেমন প্রেম দিতে পারবি। ‘
করপুটে জামার খানিক অংশ মুষ্টিমেয় করে পল্লব নেতিয়ে কেঁদে যাচ্ছিল নিশাত। চিরচেনা, হাস্যরসাত্মক স্বর কর্ণধারে পৌঁছাতেই ঝটপট চোখ মেলে চাইল। ভরসা খুঁজে পেল সমুখের শ্যামপুরুষের চেহারাতে। ছেলেটাও ফিরে তাকালো পেছনে। নিমিষেই নিশাত থেকে ছিটকে পড়ল। মাথা নুইয়ে সালাম দিল। বলল,
‘ কেমন আছেন ভাই?’
‘ ওরে ততক্ষণ পেটাবি যতক্ষণ না আমার আত্মা তৃপ্ত হয়। সইতে না পেরে ম–রে গেলে মাটিতে ধামাচাপা দিয়ে দিবি। কুলা**ঙ্গার বেঁচে থেকে কী করবে!’
ছেলেটা আঁতকে উঠল তৎক্ষনাৎ। তড়তড়িয়ে বলে,
‘ আমি কি কোনো ভুল করেছি ভাই?’
‘ তোকে উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। ‘
প্রহরের দায়সারা জবাবে নিশাত বিস্ফোরিত নেত্রে চাইল। চাহনি আরো গভীর হলো পর পর তার রোষপূর্ণ কণ্ঠে,
‘ জাস্ট তোকে নিশুর সামনেই খু**ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কু**ত্তার বা**চ্চা তুই জানতি না ও আমার আপন হয়? জানতি না?’
অবস্থা দুর্বিষহ আঁচ করতে পেরে ছেলেটা প্রহরের পায়ের নিকটস্থে হামলে পড়ল। কমবেশি স্ট্যান্ডে উপস্থিত সকল মানুষজন জড়ো হয়ে গেল এখানটায়। বডিগার্ডদের জন্য কাছে এসে ভিড়তে অক্ষম। প্রহর বডিগার্ডদের উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ নিয়ে যা না ভাই। আর হ্যাঁ গ্রামের কোথাও যেন এ কথা না রটে। জায়গাটা ক্লিয়ার করো। ‘
‘ ওকে স্যার। ‘
‘ কখন এসেছিস?’
নিশাত অধোমুখে জবাব দেয়,
‘ এক,,একটু আগে। ‘
প্রহর বক্র চাউনি নিক্ষেপ করল। জানতে চাইল,
‘ গলা কাঁপছে! ভয় পেয়েছিস বেশি?’
নতমুখে মাথা নাড়াল নিশাত। সাথে সাথেই চোখ উপচে নামে নোনতা পানির ঢল। প্রহর মোটেও বিচলিত হলো না। স্বাভাবিকভাবেই বলে উঠল,
‘ শিমুল,প্রত্যয়, ঊষা গাড়ির কাছে অপেক্ষা করছে,চল। চোখ মুছে নে।’
নিশাত মন্থর গতিতে হেঁটে পিছু পিছু আসল। গাড়িতে হেলান দিয়ে প্রত্যয় একমনে সামনে তাকিয়ে ছিল ভাইয়ের অপেক্ষায়। ঊষা ও শিমুল একে অপরের সঙ্গে কথা বিনিময় করছিল। ওকে দেখেই এগিয়ে আসতে চাইলে প্রহর সুপুষ্ট হাতখানা উঠিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে মুহূর্তেই। ঊষা চরম হতাশ। শিমুল মন খারাপ করে বলে,
‘ আমরা কি এখন যেতে পারব না ভাবীর কাছে? ‘
নিশাত কিংকর্তব্যবিমূঢ়,হতভম্ব। বিদ্যুৎপৃষ্ঠের ন্যায় চমকালো সে। মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরন ভজকট পাকিয়ে ফেলল । ভাবী! পরক্ষণেই শুনল প্রহরের শীতল কণ্ঠ,
‘ বক্সটা এনেছিস?’
দ্রুত হাতে বক্সটা ব্যাগ থেকে বের করে বাড়িয়ে দিল ও। প্রহর হাতে নিয়ে শশব্যস্ত হয়ে আদেশ করল,
‘ আঙ্গুল বাড়া। ‘
অপ্রকৃতস্থ চাউনিতে তাকায় নিশাত। বুঝতে ব্যর্থ সে। দমকা হাওয়া এলো। ওর মন, জীবনের সব উল্টে পাল্টে গেল প্রহরের করা কাজে। ওর হাতে ঝলমল করছে একটা আংটি, যা ওর চিকন আঙ্গুলে ঢিল হলো একটুখানি। জলোচ্ছ্বাসের তীব্র ঝাপটা সামলে উঠবার প্রস্তুতি নিতে না নিতেই দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দিল প্রহর,
‘ এটা আমার রাজনীতিতে আয় করা এক পয়সা দিয়েও কিনি নি। ছোট থেকে মিনি ব্যাংকে অল্প অল্প করে জমানো টাকায় কিনেছি নিশু। যার কারণে খুব বেশি বড়,ভারী না এটা। কমদামী একটা স্বর্ণের আংটি কিন্তু আমার হৃদয়ের জমানো সবকিছুর উদাহরণ। তুই আমার এটা বুঝতে কি তোর আর কষ্ট হবে ?’
নিশাত উত্তর দিল না৷ ঠকঠক করে কাঁপছে সে শ্বাসপ্রশ্বাসের বেগতিক,উন্মাতাল ক্রিয়ায়। প্রহর হাঁটুতে ভর দিয়ে কংক্রিটের পথের বুকে বসে পড়ল। হাতটা ধরে রেখেই প্রগাঢ় অনুভবের সহিত বলে,
‘ আমার হবি তিলবতী? শা*সাব,মার*ব,ঠিকঠাক আগলেও রাখব। এগুলো মেনেই কি আমাকে চাইবি আমৃত্যু? ‘
#চলবে,,,!
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৩১
প্রহর বসে আছে হাঁটুগেড়ে। ইটের অতি ক্ষুদ্র এক কণা তার হাঁটুর চামড়া ভেদ করে প্রবেশ করতে চাইছে গহনে। সূক্ষ্ম যন্ত্রণা নাড়াতে চাইছে তাকে৷ কিন্তু সে ভাবলেশহীন, অনড়। জবাবের প্রতিক্ষায় চেয়ে আছে নির্নিমেষ। তার নিগূঢ় দৃষ্টির সবটা জুড়ে কেবলই নিশাতের অলক্তবর্ণ মুখশ্রী। টলছে না কিয়ৎপরিমাণ। সেই সঙ্গে আরও তিনটে মানুষের তিন জোড়া দৃষ্টি ওদের ওপর। গায়ে অজস্র ঝাঁকুনি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিশাতের চিত্তপটের সমস্ত ভাবনা চেহারায় ভেসে উঠেছে যেন। মেয়েটার কি কম্পজ্বর হলো! অধরোষ্ঠ কাঁপছে কিন্তু বিচ্ছেদ ঘটছে না তাহাদের। পৃথিবীতে মুক্ত হতে পারছে না ধ্বনিরূপে মেয়েটার ভয়ংকর অনুভূতিগুলো। চিকন চিকন হাত-পা,শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গে তরঙ্গের ছোঁয়া লেগেছে হয়ত। সরুভাবে আঁকা আইলাইনারে শোভায়িত চোখ দুয়ের চাউনিটাও অস্পষ্ট। প্রহরের খটকা লাগছে। প্রত্যয়ের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
‘ গাড়ির দরজা খোল প্রত্যয়। ‘
প্রত্যয় অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকায়। ঊষা আর শিমুলের দিকে নজর নিবদ্ধ করে। ওরাও বুঝতে পারছে না। উৎসুক দৃষ্টিগুলো এক নিমেষেই চিন্তিত হয়ে পড়ে।
‘ কী হয়েছে ভাই?’
গাড়ির দরজা মেলে দিয়ে শঙ্কিত গলায় জানতে চায় প্রত্যয়। প্রহর ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। পেশিবহুল দু হাতে তুলে নিয়েছে নিশাতের দেহটা। বুকের খুব কাছে আঁকড়ে ধরে নিরাশ কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
‘ গবেটটা এখনই বেহুঁশ হয়ে যাবে। ‘
শিমুলের মুখ হা হয়ে গেল। বিস্ময়ে নিবিষ্ট হয়ে প্রশ্ন করল,
‘ বেহুঁশ কেন হবে ভাইয়া? কী হয়েছে ওর?’
ঊষা ওর কোমরের কাছের কাপড় টেনে ধরল। কানের ধারে ফিসফিস করল,
‘ ডোজ বেশি হয়ে গেছে, তাই সহ্য করতে পারছে না হলুদিয়া পাখি। ‘
শিমুল আরও অবাক হলো। একইভাবে ঊষার কর্ণ দুয়ারে মিহি স্বরে বলে,
‘ ডোজ? কীসের ডোজ আপু?’
ঠোঁটে হাত চেপে লাজুক হাসে ঊষা। কানে কানেই উত্তর দেয়,
‘ প্রেমের ডোজ। এই যে প্রহর ভাই সোজা আংটি পড়িয়ে প্রপোজ করল? এটা নিশু নিতে পারে নি। হয়ত বিশ্বাসই করতে পারছে না। ‘
‘ আমিও তো বিশ্বাস করতে পারছি না আপু। কাল ওইসব হলো। তারপর রাতেই ভাইয়া আমাদের ছাঁদে ডেকে বলল সকালেই তার সাথে বের হতে,নিশুকে আংটি পড়াবে। আমার আগে থেকেই মন বলত বড় ভাইয়া নিশুকে ভালোবাসে তাহলে তনুজা আপুর সাথে বিয়ে কেন বলো তো? কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। এমনকি আজ নিশুকে আংটি পড়ানোর কথা তুমি,আমি,প্রত্যয় ভাইয়া বাদে একটা কাকপক্ষীও জানে না। সবকিছু এমন জটিল কেন? সত্যিটা কী?’
ঊষা মৃদু হেসে প্রতুত্তর করে,
‘ দুনিয়ার সবথেকে বড় সত্যি হলো বড় ভাইয়া নিশাতকেই চায়,নিশাতকেই ভালোবাসে। এর থেকে বেশি বুঝি না আমি রহস্যময় মানুষটাকে। ক’দিন আগেও চোখের সামনে যা ঘটত,কানে যা শুনতাম তাতে আমার মনে হত ভাইয়া নিশুকে চায় না। অথচ গত রাতে ধারণা বদলে গেল,সত্যি হলো আমাদের ভাবনাই। নয়ত তনুজাকে নিজ হাতে আংটি না পড়িয়ে ভাইয়া বেরিয়ে যাবে কেন বল? আর আমাদের স্বাক্ষী রেখে নিশাতকে ভালোবাসা কেন জাহির করবে না বাসলে?’
শিমুলের মস্তিষ্কে প্রশ্ন উদয় হলো। মুখে প্রস্ফুটিত করল,
‘ আচ্ছা ঊষা আপু। তুমি কাউকে ভালোবাসো?’
চোখ রাঙাল ঊষা। রাগত স্বরে আওড়ালো,
‘ তোর দুঃসাহস তো কম না। বড় বোনকে এমন প্রশ্ন করিস!’
শিমুল ঠোঁট উল্টে ফেলল।
‘ তোমার ভালোর জন্যই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি জানো বাবা,বড় কাকা তোমার বিয়ের কথা বলাবলি করছিল? ভালোবাসার মানুষ থাকলে বলে দাও। ‘
ঊষার অবাক কণ্ঠস্বর,’ বাবা বিয়ের কথা বলছিল?’
শিমুল তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয়,’ হ্যাঁ। ছেলে ডাক্তার। অস্ট্রেলিয়া থাকে। প্রস্তাবটা বেশ পছন্দ হয়েছে বাবারও। ‘
ঊষা হতবাক, বাকরুদ্ধ। বাবা সব জানে। ঠিক কতটা ভালোবাসে প্রত্যয়কে সেটা তাঁর জানার বাহিরে নয়। তাহলে! বিয়ে করবে না ও। প্রত্যয়কে ভালোবেসেই দিব্যি এ জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। সব ভালোবাসায় যেমন পূর্ণতা নেই, তেমনি জীবনকে পরিপূর্ণ করতে সঙ্গীর প্রয়োজন নেই। একাকীত্বকে বরণ করে অপ্রকাশিত প্রেমোত্তাপ নিয়েই পুড়ে ছাঁই হতে নিঃসংকোচে রাজি সে। এটা বাবা কেন বুঝতে পারছে না!
প্রত্যয় পানির বোতল নিয়ে ছুটে এলো। জ্ঞান হারায় নি নিশাত। চোখ বুঁজে প্রহরের বুকে পড়ে আছে। শরীরের সকল শক্তি হারিয়ে গিয়েছে ওর। বুকের ভেতরের যন্ত্রটার ক্রিয়া-প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণহীন। মাদল বাজছে অন্তঃকরণে। এসবের ভর সামলাতে পারছে না ও। লজ্জার দাপটে প্রহরের বুক থেকে সরে সোজা হয়েও বসতে পারছে না। প্রহর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘ রক্তের মতো তোর কি ভালোবাসায়ও ফোবিয়া আছে?’
প্রত্যয় গাড়ির ভিতরে বোতলটা রেখে মুখ লুকিয়ে কেটে পড়ে। মনে পড়ল, দু’টো দিন ধরে মৃন্ময়ীকে একদমই জ্বালানো হয় নি। ঢাকা ফিরেই মেয়েটার কাছে ছুটে যেতে হবে। চোখ দুটি যে তুমুল তৃষ্ণার্ত।
‘ কথা বলছিস না কেন? ‘
নিশাত নিরুত্তর। প্রহর রেগেমেগে বলে উঠল,
‘ সর, সর। আমার বুক থেকে সর। আংটি পড়িয়েছি এর মানে এই নয় যে তুই আঠার মতো লেগে থাকবি। ‘
নিশাত আলগা হয়ে বসে। প্রহর পানির বোতল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ মুখ খুলে পুরোটা পানি আমার মাথায় ঢাল। ‘
নিশাত সজাগ দৃষ্টিতে তাকাল চক্ষুদ্বয় বড় বড় করে। কল্পনা ভেবে প্রশ্ন করল,’ হু?’
‘ তাড়াতাড়ি পানি ঢাল মাথায়। আমার প্রপোজালের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিস তুই মৃগী রোগী। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে চ*ড় মারি৷ মাত্র ভালোবাসা দেখিয়েছি,মা*রতে পারব না। তার চেয়ে ভালো আমার মাথাটা ঠান্ডা কর। ‘
বোতলের মুখটা খুলে হাতে মুষ্টিবদ্ধ করল নিশাত। ভয়ে ভয়ে পানিভরা বোতলটা এগিয়ে নিয়ে ধরে প্রহরের মাথার কাছে। এ মানুষের ভরসা নেই। ওকে আবার মে”রে বসে যদি! ঢালতে গিয়ে হাত পিছিয়ে আনে একবার, বাড়িয়ে দেয় পুনশ্চঃ। শেষমেশ চোখ বুঁজে ঢেলে দেয় জল। সহসা শুনতে পায় নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বর,
‘ তোর ওড়না দিয়ে মাথাটা মুছে দে এবার। ‘
নিশাত নিরুপায় হয়ে মিনমিন করে বলে,
‘ তুমি চোখ বন্ধ রাখো ভাইয়া। ‘
বলতেই প্রহর চোখ বন্ধ করতে সময় নষ্ট করে নি। গা থেকে ওড়না অর্ধেক খুলে চুল মুছতে আরম্ভ করে নিশাত। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে ওর। হরমোনের প্রবল সাড়ায়,উত্তেজনায় আবারও শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে গাড়িতে। চুল মুছতে থাকা হাতটা থমকে গেল আকস্মিক।
‘ তোকে আমি তিলবতী কেন ডাকি জানিস?’
ছোট্ট করে উত্তর দিল, ‘না। ‘
‘ ছয় বছর বয়সে একবার মা’কে পেটের,পায়ের গোড়ালির,হাতের,পিঠের গলার কাছের তিল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলি ফুপু এগুলো কী? সেদিনই নামটা আমার মাথায় আসে। কিন্তু তখন আমি তোকে কু*নজরে দেখতাম না। এখন কীভাবে দেখি শুনবি?’
নিশাত ওড়না দিয়ে শরীর ভালো করে ঢেকে নিল। সতর্ক দৃষ্টিতে প্রহরের পানে চাইল। চোখ বুঁজে আছে সে। অস্ফুটস্বরে তাল মিলিয়ে বলল ,
‘ কীভাবে? ‘
ঝট করে চোখ মেলে তাকালো প্রহর। গাঢ় চাহনি৷ একাগ্রচিত্তে চেয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,
‘ নব্বই পারসেন্ট কু**নজর আর দশ পারসেন্ট সুনজরে। ‘
নিশাত তৎক্ষনাৎ আমতা আমতা করে,
‘ আমি বাড়ি যাব। ‘
‘ ভয় পাচ্ছিস? আমার কু নজরের ভয়? তোর ওপর কু নজর দেওয়ার রাইটটা শুধু আমারই। সহ্য করতে হবে তোর। মাথায় ঘোমটাটা দে। ‘
কাঁপা কাঁপা হাতে ঘোমটা টানল ও। কিশোরী হৃদয়ে লহরি খেলে যাচ্ছে। তার অ**সভ্য প্রহর ভাই তাকে ভালোবাসে ভাবলেই মন কাননে উড়ে বেড়াচ্ছে রঙিন প্রজাপতি। ঘোমটা টেনেই নামিয়ে ফেলে নেত্রযুগল।
প্রহর আঙ্গুলে তুলে নেয় নত চিবুক। আলতো হেসে বলে,
‘ তোকে টুকটুকে লাল বউ লাগছে তিলবতী। আমার অধৈর্য্যের যৌবন বয়স পার করে এসেছি ধৈর্য্যশীল হয়ে তোকে পাব বলে। অপেক্ষা করেছি তোর চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখার। ভেবে রেখেছি যেদিন দেখব সেদিনই তোকে নিয়ে ছুটে যাব কাজী অফিসে। গোছালো সব ভাবনা উলোটপালোট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মামুজানের সামনেই তাঁর মেয়েকে চিরতরে হাসিল করব আমি। বর হিসেবে পছন্দ তোর আমাকে? অনেক কষ্ট দিব কিন্তু। ‘
নিশাত নরম হাতে প্রহরের অন্য হাতের পিঠে হাত রাখল। মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না ওর। প্রহর অধৈর্য্য হয়ে বলে উঠল,
‘ তুই যে বোবা ভুলে গেছিলাম। একটা হিন্টস দিয়ে দে। আমাকে আর বুড়ো বানাইস না। ‘
কি নিদারুণ যন্ত্রণা! এতদিন ভালোবাসার জন্য খাঁচায় বন্দি পাখির ন্যায় ছটফট করছিল নিশাত। এখন স্বপ্নের মতো পেয়েও প্রকাশ করতে পারছে না। মনের সাথে যুদ্ধ করে বলল,
‘ আমি আপনাকে ছা,,ছাড়া থাকতে পারব না। ‘
‘ আমি তোকে বাঁচতেও দিব না আমাকে ছাড়া। ‘
বলেই ওর কপালে উষ্ণ ওষ্ঠের ছোঁয়া লেপ্টে দিল প্রহর। জমে গেল নিশাত। মূর্তি হয়ে গেল মুহূর্তেই। ঝমঝম আওয়াজ মস্তিষ্ক জুড়ে।
—————————————————
বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দিয়েছে ঊষা। পরশু ঘরোয়াভাবে আকদ হবে ওর। পাত্রের ছুটি কম। ফলপ্রসূ বিয়েতে তাড়াহুড়ো। পাত্রকে অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে মোশতাক সাহেবের। উনার বন্ধুর ছেলে হয়। ঊষাও আর নাকচ করে নি। ঢাকা ফিরেই মিনিটেই সম্মতি দিয়ে দিল বিয়েতে। পাত্রের পরিবারের সাথে একেবারে আকদের দিনই দেখা হবে। শহরতলীতে আঁধারের খেলা চলছে। বই নিয়ে বসল ঊষা টেবিলে ল্যাম্পশেডের অল্পস্বল্প আলোয়। রুমের দরজা খোলা। গটগট করে প্রবেশ করল কেউ অনুমতি বিহীন। সশব্দে বইটা বন্ধ করে দিয়ে অসংবরণ ক্রোধে ফেটে পড়ল লোকটা,
‘ তুই বিয়েতে অনুমতি দিয়েছিস?’
#চলবে,,,!
#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৩২
‘ দিয়েছি। ‘
দৃঢ়,শান্ত গলার সংকোচহীন উত্তর। প্রত্যয় অল্প সময়ের জন্য কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল। সচেতন দৃষ্টি মেলে তাকালো ঊষার পানে। ঈষৎ কিরণে ঝলমলিয়ে চক্ষুগহ্বরে ধরা দিচ্ছে ঊষার মুখের কাঠিন্য রূপ। কণ্ঠের সমস্ত উত্তাপ কমিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ তুই হঠাৎ করেই বিয়েতে রাজি হলি কেন?’
ঊষা বইটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে স্মিতহাস্যে অনুরোধ করে, ‘ পাশের চেয়ারটায় বসো ভাইয়া। ‘
‘ বসব না। আগে জবাব দে। ‘
আবারও রাগ এসে জড়ো হয়েছে প্রত্যয়ের গ্রীবাদেশে। ঊষা শীতল গলায় বলল,
‘ জবাব দিচ্ছি তো। তুমি আগে বসো না। ‘
গা থেকে জিন্সের কালো জ্যাকেটটা খুলে ঊষার পরিপাটি বিছানার উপর ছুঁড়ে মা”রল প্রত্যয়। পরনে রয়ে গেল পাতলা ছাঁই রঙের টি-শার্টটি। প্রলম্বিত, উষ্ণ নিঃশ্বাস নাসারন্ধ্র গলিয়ে বের হয় বড্ড আওয়াজ করে। ধপ করে চেয়ারে বসে চুলগুলো মুঠোয় পুড়ে নেয়। প্রচন্ড জোরে জোরে টেনে ঠেলে দেয় পেছনে। ঊষার চোখ ছানাবড়া। আঁতকে ওঠে,
‘ জেদ চুলের ওপর দেখাচ্ছ কেন? চুল ঝরে যাবে সব। কী লাভ মাসে দশবার জেন্স পার্লারে গিয়ে শেষে যদি মাথায় চুলই না থাকে!’
রক্তাভ নেত্রে তাকায় প্রত্যয়। বলল,
‘ দশবার না একবার যাই। ‘
‘ ওটাই। গেলেই হলো। এখন মাথাটা ঠান্ডা করো। মালিশ করে দেবো আমি?’
‘ না। লাগবে না। পরে অভ্যাস হয়ে যাবে। অন্য বাড়ি থেকে এসে মালিশ করে দিতে পারবি না। অভ্যস্ত হয়ে গেলে তোর হাতের ছোঁয়ার জন্য তপড়াতে হবে আমার। ‘
কণ্ঠে বেদনা বোধ পরিস্ফুটিত। প্রত্যয়ের অভিমান উপেক্ষা করে ঊষা খোঁচা মা””রে,
‘ তোমার এমন কত অভ্যাসেই আমি আছি ভাইয়া। এই যেমন তোমাকে সকালে কফি করে দেওয়া, তোমার রুম গুছিয়ে দেওয়া, বুয়া যেন তোমার বিয়ার এর বোতলগুলো খাটের তলানি হতে খুঁজে না পায় ঝাড়ু দিতে গিয়ে, তাই ডাস্ট এলার্জি নিয়েই নিজে কোমরে ওড়না বেঁধে ঝাড়ু দেওয়া। এই অভ্যাসগুলো কীভাবে ছাড়বে? এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা, তোমার আন্ডারওয়্যার গুছিয়ে দিবে কে? আমি না থাকলে তোমার গুছাতে মনে থাকবে নাকি সবসময়ের মতো ফ্লোরে একটা,বিছানায় একটা এভাবে ফেলে রাখবে? এমনটা করো না ভুলেও। বুয়া এমনিতেই তোমার জন্য ধারে ধারে ভোট চাইবে বলে ওইদিন এসে বলল, ” আপা সুন্দর দেইখা দুইডা কথা শিখান না আমারে। আমি যেই বাড়িডিত কাম করি,তাদের হুনাইয়া কমু বড় ছ্যার,ছোডো ছ্যারেরে ভোট দিত সামনের ইলেকট্রনে।” হাতের নাগালে পেলে এ বাড়ি,ওই বাড়ি করে পুরো ঢাকা শহরে কুখ্যাত বানিয়ে ফেলবে তোমাকে। প্রচার করবে উনার শুদ্ধতম স্বরে,” মহল্লাবাসী,শহরবাসী দেইখা লন আমার হাতে কিতা৷ প্রত্যয় ভাইয়ের জাইঙ্গা পাইছি আমি কোমর ভাইঙ্গা। এবারের মার্কা সেরা মার্কা,প্রত্যয় মিয়ার জাইঙ্গা মার্কা। ”
ঊষার হাস্যকর কথাগুলো শুনেও দৃষ্টি নড়বড়ে হলো না প্রত্যয়ের। আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে।
‘ আমি কিন্তু সিরিয়াস। তোমার মনে নেই। একবার তোমার ছোট প্যান্ট নিয়ে বুয়া সারা বাড়ি,বডিগার্ড, দারোয়ান সবার কাছে ঢোল পিটাচ্ছিল “ছোডো ছ্যারে আবুইদ্দাদের লাহান ছোডো হাপ্পেন পরে। ”
বাক্যটার সমাপ্তি টেনেই অট্ট হাসিতে লুটিয়ে পড়ল ঊষা।প্রত্যয় বক্র চাউনি নিক্ষেপ করে রেখেছে। চাহনি নিষ্পলক,স্থির। ঊষা চেয়ার ছেড়ে দিয়ে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ কী হয়েছে? এমন করে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘ তোকে দেখছি। তোর হাসি দেখছি। বিয়ের ফুল তোর মনে এত জলদি ফোটে গেল! পাত্র কি দেখতে বেশি সুন্দর? বছর গড়ানোর পথে,আজ তোকে এতটা সুন্দরভাবে হাসতে দেখছি। ‘
শ্লেষাত্মক কণ্ঠস্বর বাজছে ঊষার শ্রবণগ্রন্থিতে। ও হলফ করে বলতে পারবে প্রত্যয়ের চাহনি,কণ্ঠ কিছুই স্বাভাবিকের কাতারে পড়ছে না এই মুহূর্তে। মিশে আছে ঝাঁঝ, পরিহাসের কড়া গন্ধ। হড়বড় করে বলল সে,
‘ এমন কিছুই না ভাইয়া। ‘
প্রত্যয় ওর হাতে স্পর্শ আঁকল। আলতো করে ধরল। চেয়ারে বসিয়ে খানিকটা কাছে গিয়ে অবিচলিত, নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ তাহলে বিয়েতে রাজি কেন হলি?’
ঊষার অভ্যন্তরের যন্ত্রণার জোয়ার থামিয়ে মুখে মৃদু হাসি টানে। হাসিটার জায়গা হয় ঠিক ফ্যাকাশে অধরের কোণে।
সর্বদার ন্যায় আর্দ্র স্বরটা লুকোতে সময় নেয় সামান্য। চেহারায় চনমনে ভাব এনে উত্তর সাজায়,ব্যক্ত করে,
‘ বিয়েতে রাজি হবার অনেক অনেক কারণ আছে। বিয়েতে রাজি হলে জামাইয়ের সাথে আমিও আমার পছন্দের একটা দেশের বাসিন্দা হয়ে যেতে পারব। এটা গেল প্রথম কারণ। তারপর আসি সুন্দর একটা ব্যাপারে। আমি আর বছর দুটো গেলে ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে যাব,জামাইও ডাক্তার। আমাদের ভবিষ্যৎ বাচ্চাকাচ্চাও ডাক্তার হবে। অবশেষে আমরা পরিণত হতে পারব একটা ডাক্তার ফ্যামিলিতে। এটা আমার ড্রিম ছিল। তাছাড়া বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলা উচিত। কারো ভালোবাসা, সঙ্গ,সুখ,শান্তি পেতে হলে, অন্যের জন্য নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হলেও বিয়ে করা প্রয়োজন। এসব ভেবেই আমি রাজি হয়ে গিয়েছি। আকদ হলেই চলে যাচ্ছি না। মেডিক্যাল কমপ্লিট হলে তবেই শ্বশুর বাড়িতে ট্রান্সফার হবো। ততদিনে আমি তোমাকে একটা বিয়ে করিয়ে দেবো যেন আমাকে ঘিরে থাকা তোমার বদঅভ্যেসগুলো দূর হয়ে যায়। ‘
হাতে কঠিন চাপ অনুভূত হওয়া মাত্র ঊষা দুর্দমে প্রত্যয়ের চাহনিতে আবিষ্ট হয়ে পড়ল। শানিত চাহনি। লালচে মণিজোড়া হতে ঠিকরে রক্ত ঝরা বাকি কেবল। ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ডাক দেয়, ‘ ভাই য়া। ‘
প্রত্যয় চৈতন্য ফিরে পায়। চোখ বুঁজে ফের মেলে। রাগান্বিত কণ্ঠে আদেশমূলক বাক্য,
‘ তুই এক্ষুণি গিয়ে বড় আব্বুকে না করে আসবি। ‘
‘ কেন?’
‘ যা বলেছি সেটা করবি। আগে পড়াশোনা তারপর বিয়ে। ‘
‘ আমার সমস্যা নেই। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত। এছাড়া বছর দুয়েক আমি এখানেই থাকব তোমাদের সাথে। অভ্যাস ছাড়ার ভয় পাচ্ছ? কয়েক বছর পর্যন্ত অভ্যাসের মেয়াদ আছে। তারপর চলে যাব। ‘
‘ সাথে আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে যাবি। এমনটা হতে দেবো না আমি। ‘
বিড়বিড় করে উঠে দাঁড়ায় প্রত্যয়। ঊষা শেষোক্ত কথাটা শুনে নি স্পষ্টত। প্রত্যয় দরজার চৌকাঠে গিয়ে ফিরে আসে। জ্যাকেটটা বিছানা থেকে তুলে নেয়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
‘ তুই বিয়ের জন্য প্রস্তুত তাই না? যখন থেকে ত্যানা গায়ে প্যাঁচিয়ে মানুষের কোলে চড়ে বেড়াতি, তখন থেকেই চোখে চোখে বড় করেছি তোকে। আমার একটা দায়িত্ব আছে না আমার ভোরের পাখি ঠিক কতটা প্রস্তুত বিয়ের জন্য সেটা পরখ করে নেওয়ার? কাল সারাদিন তোর প্র্যাক্টিস ডে চলবে। সকালে উঠেই গোসল করে একটা শাড়ি পরে নিবি। ভেজা চুলে আমার রুমে এসে আমাকে ডেকে তুলবি। আমি নাস্তায় কী কী খাব লিস্ট করে রান্না করবি,আমার পাশে বসে আমাকে সার্ভ করবি। বাকিটা দিনেই বলব। আপাতত এগুলোই মাথায় রাখ। নয়ত তোর বিয়েতে আমি ভেজাল বাঁধিয়ে দিব। ‘
গটগট করে বেরিয়ে গেল প্রত্যয়। ঊষা স্তব্ধ,ভাষাহীন। শরীরটা জমে গিয়েছে। বিহ্বলিত অতীব। এ যেন পুরোনো প্রত্যয়কে দেখতে পাচ্ছে ও। মৃন্ময়ীর প্রেমে মজনু হওয়া প্রত্যয় নয় এটা, এই ছেলে ওর প্রত্যয় ভাইয়া। বিয়েতে নাকচ করতে,ঘোর বিরোধিতা করতে বাবার কক্ষে প্রবেশ করেছিল সে। প্রসঙ্গ তুলতেই মোশতাক সাহেব কড়া গলায় বললেন বিয়েটা করতেই হবে। তিনি আর না শুনবেন না। উনি চান না প্রত্যয়ের জন্য ওর জীবন ধ্বংস হয়ে যাক। বাবা হয়ে এটা মানতে অত্যন্ত নারাজ উনি। তবুও ঊষা দমে নি। বাড়ি ছাড়বে বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে চলে আসতে নিলে মোশতাক সাহেব ভরাট কণ্ঠে জানান,
‘ প্রহর,প্রত্যয় কাউকেই আমি এমপি আসনে বসতে দেবো না,তুমি বিয়েটা না করলে। তোমার বাবা কতটা ভালো,খারাপ তা তুমি জানো। নিজের মেয়ের ব্যাপারে আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক স্বার্থপর আমি। প্রত্যয় তোমাকে ভালোবাসে না,ওর জন্য জীবন একা পার করা নিঃসন্দেহে বোকামি। ‘
ঊষা অবাক হয় নি। বাবা এমনই। রাজনীতি, স্বার্থপরতা যেন তাঁর দম্ভ। ওকেও ভালোবাসে এটা নিরন্তর সত্য। ওকে রাজি করানোর জন্য ভাইদের স্বপ্ন বলি দেবে এটাও মিছে নয়। নিস্তেজ কণ্ঠে বলে,
‘ ভাইয়াদের এ পথে এনে তুমি পথহারা কেন করবে বাবা? তুমি বরং আমাকেই ভেঙে দাও। ‘
__________________________________
রোকেয়া গত রাতের ময়লা থালাবাসন নিয়ে পুকুরঘাটে এসে বসলেন। ট্যাংকের পানিতে ধুয়ে স্বস্তি পান না উনি। ফলপ্রসূ থালাবাসন, হাঁড়ি পাতিল এখানেই ধোয়ার কাজটা শেষ করেন। পাড়ে কারো পায়ের শব্দ কর্ণপাত হতেই ঘাড় ঘুরিয়ে উপরের দিকে চাইলেন। টুনির আম্মা এসেছে।
‘ কিছু কইবা টুনির আম্মা? আজ সক্কালে আইলা?’
টুনির আম্মা চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে,
‘ কমু কি-না ভাবতাছি ভাবী। ‘
রোকেয়ার হাত থেমে গেল। ভাবুক হয়ে বললেন,
‘ কী কথা?’
টুনির আম্মা নিম্নকণ্ঠে বলে উঠল,
‘ গত কাইল টুনির আব্বা বাড়ি ফেরবার পথে নিশুরে বাসস্ট্যানে দাঁড়ায় থাকে দেখল। স্কুলের টাইমে মাইয়া ওইখানে কী করতাছিল ভাবী? কইয়া গেছে আপনারে? যুগ ভালা না। এমনে এ বাড়িত একটা কলঙ্ক লাইগা আছে,মাইয়াডা যদি বখে যায়! এইজন্য আপনেরে কইতে আইলাম। ‘
রোকেয়ার চেহারায় বিস্ময়ের ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না। ভাবে এমন যেন তিনি মোটেও অবাক হন নি। উল্টে বললেন,
‘ আমিই পাঠাইছি নিশুরে। কাম আছিল। ‘
অপ্রসন্ন হলেন টুনির আম্মা।
‘ ওহ!’
‘ হ। ‘
গ্রামে কথা বিলি করতে অতিশয় পটু সে। জবাবটা তার ভালো লাগে নি। বাহ্যিকভাবে স্বাভাবিক রইলেও ভিতরে ভিতরে হুতাশনে পুড়ছেন রোকেয়া। দাঁতে দাঁত চেপে থালা বাসন মেজে বাড়ির দিকে ছুটলেন তড়িৎ গতিতে। রান্না ঘরে রেখে দোতলায় উঠে সোজা নিশাতের ঘরে এসে উপস্থিত হলেন।
শুয়ে শুয়ে মোবাইল নিয়ে প্রহরের কলের অপেক্ষায় নিমজ্জিত নিশাত। অনুভূতিগুলো উন্মাদনায় দিশেহারা হয়ে ছুটছে অন্তরের সর্বত্র। মা’কে ধপধপ শব্দে এগিয়ে আসতে দেখে মোবাইল রেখে অতি দ্রুত উঠে বসল। কিছু বলবার জন্য মুখ খুলতে যাবে সবে,বিনা বার্তায় শক্ত হাতের থাবা বসিয়ে দেন রোকেয়া ওর গালে। চিড় চিড় করে জ্বলে ওঠে গালটা। অশ্রুধারা বইতে থাকে বাঁধাহীন। অপ্রকৃতস্থ দৃষ্টি মেলতেই রোকেয়া আবারও চ*ড় বসালেন। চিবুকে আঙুল ধাবিয়ে গর্জে উঠেন,
‘ বাসস্ট্যান্ডে কেন গেছিলি?’
নিশাত হাপুস নয়নে চেয়ে কেঁদে যাচ্ছে অনবরত। ব্যথায় মুখশ্রী সম্পূর্ণ রক্তিম। রোকেয়ার হৃদয় গলছে না।
‘ তুই প্রহররে পছন্দ করিস?’
মায়ের প্রশ্নে রুহু কেঁপে ওঠে ওর। কথা বলতে পারে না। ডুকরে কাঁদতে শুরু করে। চিবুক ছেড়ে বিছানায় বসে পড়লেন রোকেয়া ক্লান্ত দেহে।
‘ আমি তোর আম্মা। তোর হাবভাব চেনা আমার। প্রহরের বিয়া ঠিক। শরম লাগল না তোর ওরে পছন্দ করতে? লজ্জা নাই তোর? তোর আব্বা জানলে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলব তোরে। সময় থাকতে আবেগ শেষ কর। আবেগ দিয়া দুনিয়া চলব না। আজ থিকা প্রহরের লগে কথা কইবি না। তোর আবেগ আমি ধ্বংস কইরা সাড়মু। ‘
নিশাত নিশ্চুপে, মৌনমুখে মা’য়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মা কী করে এসব জানল ঠাহর করতে পারছে না সে। গাল ব্যথায় দুই হাতে বিছানার চাঁদর খামচে ধরে ঠোঁট ঠোঁট চেপে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে নিঃশব্দে। প্রহর ভাইয়ের প্রেমে পড়ার পর থেকে ওর এত এত দুঃখ কেন পেতে হচ্ছে! মোবাইলটা ভাইব্রেট করে জানান দিচ্ছে লাগাতার মালিককে এখন প্রয়োজন ভীষণ। কম্পনরত হাতে নাম্বার না দেখেই কানের কাছে ধরে।
‘ ভিডিও কল দিচ্ছি। ধরতে এক সেকেন্ড লেইট হলে আমি মহানন্দ গ্রামে এসে তোকে শায়ে**স্তা করব। ‘
বলার আগে,বুঝবার আগেই ভিডিও কল এলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষের কল পেয়ে তাড়াতাড়ি চোখের একেকটা অশ্রুকণা এলেমেলো হাতে মুছতে লাগল নিশাত। পাছে প্রহর ওর কান্নার চিহ্ন না বুঝে যায়। কলটা ধরে মাথা নুইয়ে রাখল। প্রহর ধম**কায়,
‘ মিটিংয়ে সবাইকে বসিয়ে রেখে তোকে দেখব বলে বাহিরে এসেছি। তুই মাথা নুইয়ে রাখলে মুখটা দেখব কী করে? মাথা তোল। ‘
নিশাত আঁড়চোখে প্রহরকে দেখে নেয় এক পল। আস্তেধীরে মাথা উঠায়। নিমিষেই প্রহরের সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্নের সূচনা,
‘ গালে কী হয়েছে তোর?’
নিশাত হাসফাস করতে লাগল। মিথ্যা সাজাতেও দম বন্ধ হয়ে আসছে।
‘ তোর গালে আঙ্গুলের দাগ ভেসে আছে। কে মে**রেছে সুইটহার্ট? ‘
নিরুত্তর সে। শ্রবণ হলো রোষপূর্ণ কণ্ঠস্বর,
‘ তোকে বলতে বলেছি। ‘
নিশাত এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করে, ‘আম্মা। ‘
ব্যস কলটা কেটে গেল। পর পর ডায়াল করলে দেখালো ব্যস্ত।
পিংকির মা মোবাইল হাতে নিয়ে রান্নাঘরে আসল,
‘ আপনার ফোন বাজতাছে ভাবী। ‘
রোকেয়া হাতে নিয়ে প্রহরের নাম্বার দেখে চমকালেন। সরে আসলেন রান্নাঘর থেকে। ” হ্যালো” উচ্চারণ করতেই প্রশ্ন শুনল এমন,” আপনি নিশাতকে মে*রেছেন মামী?”
রোকেয়া হতবুদ্ধি, বিহ্বল হয়ে পড়লেন,” কে বলেছে?”
” প্রমাণ দেখেছি। কেন মা*রলেন মামী?”
সংকোচ, জড়তা জিহ্বায় রেখে রোকেয়া বললেন,
” এটা আমি তোরে বলতে পারমু না বাবা। আমার মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাইতেছে। ”
” কী করেছে ও?”
” এ বয়সেই প্রেমে পড়ছে,আমি বুঝি এগুলা ওর বয়সের দোষ। ”
” কার প্রেমে পড়েছে?”
রোকেয়া ভাবলেন প্রহরকে বলে দেওয়া ভালো। এতে সে নিশাতের থেকে দূরে দূরে থাকবে। যেই ভাবনা সেই কাজ,
” ভুল করে ফেলছে। আবেগে তোরে চাইতেছে। তুই ওরে বুঝাইস এসব প্রেম না। ”
” ও আমাকে চাওয়ার আগেই আমি ওকে আল্লাহর কাছে চেয়ে ফেলেছি। বিয়ের প্রস্তাব মজুমদার বাড়িতে যাবে শীগ্রই। আপনারা প্রস্তুত থাকুন। ”
#চলবে,,,!