প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0
972

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____৪২

অব্যক্ত প্রেমে অপ্রকাশিত অভিমানে ধুকে ধুকে ম–রছে দুইজন অঘোষিত প্রেমিক-প্রেমিকা। আজ পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা। গতরাত থেকে শিমুলের মনটা বড় অপদার্থ হয়ে আছে। কোনো কাজের না এটা। নয়তো শিমুলের কথার বিরুদ্ধে কেন যাবে? কেন? বার বার করে যে বলছে মন তুই সৌরভ ভাইকে স্মরণ করবি না,পড়া গুলো চর্চা কর তবুও কেন ওই ব**দ পুরুষের প্রতিচ্ছবি ভাসিয়ে তুলছে চোখের তারায়?

এক সপ্তাহ যাবত সৌরভের সাথে কোনো কথা হচ্ছে না শিমুলের। কলহ বেঁধেছে নিশাত ও প্রহরের বিয়ে নিয়ে। এগুলো দিন হয়ে গেল,মাস পেরিয়ে গেল কিন্তু সৌরভ বিয়েটা মানতে নারাজ। তিন দফা ঝগড়া করেও শিমুল বুঝাতে ব্যর্থ হলো যে তার ভাই নিশাতকে ভালো রাখবে, মা–রবে না,শা–সাবে না। অথচ সৌরভের একটাই বুলি,

‘ তোর ভাই মা**রবে,শা**সাবে। ছোট বেলায় কম মা*রত? আমার সামনেই আমার বোনকে মা**রত। আত্মীয়তার খাতিরে টু শব্দটুকু করি নি। বিয়ে করে নিয়ে মার–বে না তার কি গ্যারান্টি আছে? তোর ভাই একদিন আমাকেও মে**রেছিল বাজারে। আমার মনে হয় আব্বা তোদের পছন্দ করেন না বলে, কখনো বাড়িতে আসতে দেয় নি বলে প্রহর প্রতিশোধ নিতে আমার পিচ্চি বোনকে ফুসলিয়ে ফাসিয়ে বিয়ে করেছে। না হলে কোমল মনের মেয়ে হয়ে সে তোর পাষাণ হৃদয়ের অভদ্র ভাইকে ভালোবাসতে যাবে কোন দুঃখে?’

শেষোক্ত বাক্যে শিমুলের মাথায় রাগ চেপে যায়। কি করে এমন খারাপ মনোভাব পোষণ করতে পারে সৌরভ? প্রতিশোধ! সেটা আবার কী! প্রতিশোধ নিতে হলে কি এতদিনে চাইলেই পুরো মজুমদার বাড়িকে জেলে পঁচিয়ে মার**তে পারত না? নিরু ফুপি করুক না নিজে আত্ম**হত্যা। মহানন্দ গ্রামের মানুষ, সমাজ,মজুমদার বাড়ির মানুষ কি দায়ী নয় মৃ**ত্যুর পেছনে? উনাদের খারাপ কটুক্তি কি নিরু ফুপিকে মৃ**ত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয় নি? তবুও স্মরণিকা নিবাসের প্রতিটি মানুষ ক্ষমা করে দিয়েছে তাদের। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি খাটিয়ে উচ্ছেদ করার সকল সুযোগ-সুবিধে থাকলেও আত্মীয়তার সম্পর্ক যেন ছিন্ন না হয় তাই নিশ্চুপ ছিলেন শিমুলের দাদা ভাই।

আর প্রেম! জেনে-বুঝে কেউ প্রেমে পড়ে? যাচাই-বাছাই করে প্রেমে পড়লে পৃথিবীর সবথেকে পারফেক্ট মানুষটাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যেত মানুষের। প্রেমে পড়তে মোক্ষম লগ্নের প্রয়োজন হয় না,মানুষ বাছাই করতে হয় না। কখন কে কার প্রেমে ডুবে যাবে এটা কেউ জানে না,টের পায় না। হুট করে যখন কাউকে ছাড়া হৃদয়টা শূন্য শূন্য লাগে সেই অনুভূতিই জানিয়ে দেয়, ‘প্রেম এসেছে তোমার দুয়ারে, দরজা খুলে সাদরে গ্রহণ করো তাহারে।’

প্রহর কখনোই নিশাতকে ভালোবাসতে চায় নি। সর্বদা চেষ্টা করেছে ঘৃণা করার। নয়ত কারণে-অকারণে কেন মা””রত নিশাতকে? নিশাতের কুষ্ঠি-ঠিকুজি, নাড়িভুড়ি জানলেও ছোট থেকেই ভালোবাসে তেমনটা নয়। নিশাত তার কাছে অন্যসব কাজিনের মতোই ছিল। কিন্তু এক খ্যাপা এসে লন্ডভন্ড করে দিল তাকে, বুকের বা পাশে গেঁথে দিল প্রেম নামক বিষ। এই বিষে শিমুলকে নিঃশেষ করে চলেছে দিনকে দিন। ভালোবাসা না পেলে হৃদয় অশান্ত থাকে,পৃথিবীর সবকিছু তিক্ত লাগে,মুখের স্বাদ অব্দি পানসে হয়ে যায়। ভালোবাসার আবার অনেক জাদু। একটুতেই সুস্থ করে তুলতে পারে মনপ্রাণ, অসুন্দর জিনিসটাও সুন্দর লাগে তখন। শিমুল রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে প্রায় অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলেছিল,

‘ শুনেন সৌরভ ভাই,আপনার মন কুৎসিত। আমার লজ্জা হইতেছে আপনাকে ভালোবেসে। যারা ভালোবাসার সম্মান করতে পারে না, তাদের ভালোবাসতে নেই। তিতা লাগলেও কথা সত্য। আমি নাদান মানুষ,বুঝি নাই আপনি যে ভেতর থেকে কালো। আপনার ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা নাই,এ কারণেই পিংকিরে হারাইছেন। আপনি,,’

কথা শেষ করার আগেই সৌরভ কলটা কেটে দেয়,ব্লকলিস্টে ফেলে দেয় শিমুলের নাম্বারটা। তারপর থেকেই নিরব দ্বন্দ্বের শুরু। পরীক্ষার হলে বারংবার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল শিমুলের। প্রশ্ন মোটামুটি কঠিন হয়েছে। সে ও নিশাত একই রুমে পড়ে নি। হল থেকে বেরিয়ে দেখল নিশাত হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই হাত ধরে বলল,
” আম্মু বলেছে পরীক্ষা শেষে তোকে বাড়িতে নিয়ে যেতে, চল।”
শিমুল কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে দুর্বল কণ্ঠে জবাব দিল,” যাব না, বাড়িতে যাব সোজা। কাকা অপেক্ষা করছেন, তোকে নামিয়ে দেবো বাড়ির সামনে। ‘

” কাকা কে ফিরিয়ে দেবো। ভাইয়া আসবে। তুই আমি মেলায় যাব ভাইয়ার সাথে। পরীক্ষা শেষ, উপজেলায় আর আসা হবে না। সেকারণে ভাইয়াকে অনুরোধ করেছি আমাকে মেলায় ঘুরতে নিয়ে যেতে। ”

ম্যাট্রিক পরীক্ষার কেন্দ্র পড়েছে উপজেলায়। হররোজ এখানেই পরীক্ষা দিতে আসতে হয় শিক্ষার্থীদের। উজ্জ্বল সাহেব জোরদার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গ্রামের প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুলে বোর্ড পরীক্ষার ব্যবস্থা করার। মেলায় যাবে তা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই শিমুলের। কিন্তু সৌরভকে চোখের সম্মুখে দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে কি-না এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। নিম্ন স্বরে ঘোর আপত্তি জানাল,
” আমি যামু না,বাড়িতে যামু। তোর ইচ্ছে হলে তুই যা। আর ভাইয়া জানে তুই মেলায় যাচ্ছিস?”
নিশাত চুপসে গিয়ে বলল,” না৷ আচ্ছা তুই কি বলে দিবি শিমুল?”
” তুই আমার ভাইকে না জানিয়ে অঘটন করছিস,বলব না?”
” মেলায় ঘুর ঘুর মোটেও খারাপ কিছু না৷ আমার খারাপে তুই শামিল হ। তাহলে প্রহর ভাই জানবে তুই ছিলি আমার সাথে, সুতরাং তুইও দোষী। তাছাড়া বিয়ের পর স্বামী নিয়ে মেলায় ঘুরার সৌভাগ্য কি আমার আছে? তিনি এখন প্রভাবশালী নেতা,এমপি সাহেব৷ আগেপিছে পুলিশ,বডিগার্ড থাকে। আমার মতো আমজনতার কাছে যাবার সাধ্য আছে নাকি?”

” তুই নিছক অভিমান করতেছিস নিশু। জানিসই তো কত ঝামেলা গেল ভাইয়ার ওপর দিয়ে। তোদের বিয়ের পরের সকালে যে গেল একটাবার আসার সুযোগ পাচ্ছে না। নতুন নেতার হবার দরুন আগের সব কাজ বুঝে নিতেছে, সমাবেশে যোগদান কত কি৷ খাওয়ার জন্য ফুরসত মিলে কি-না কে জানে। ভাইয়া নিজের অবস্থার কথা কখনো জানায় না। বুদ্ধি করে মা বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কল দিয়েছিল বুয়ার থেকে জেনে নিতে ভাইয়া কখন ফিরে,খায় কিনা ঠিমতো। বুয়া জানাল প্রায় না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, আর না হয় মধ্য রাতে খায়। ”

নিশাত হতভম্ব, নিশ্চুপ। সে কখনোই জানতে চায় নি প্রহর ভাই কেমন আছে। পরীক্ষার চক্করে কথা-ই হয় না ঠিকঠাক। অথচ কাজের প্রেশারে থেকে লোকটা এক বেলাও তাকে খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতে ভোলে নি৷ তিন বেলা নিয়ম করে রোকেয়ার কাছে জানতে চেয়েছে নিশাতের হালচাল। রোকেয়া গর্ব করে বলেন, নিশাত কপাল করে এমন স্বামী পেয়েছে। খারাপ লাগছে তার। বউ হিসেবে একদিন ভুল করেও জানতে চাওয়া দরকার ছিল না? কিন্তু তার মাথায় ব্যাপারগুলো আসতই না।

গেইট থেকে বের হয়ে দেখে সামনেই ড্রাইভার কাকা। হাতে উনার বাটন ফোন। নিশাতকে দেখে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
” ধরো মা,কথা কইবো। ”
নিশাত ইতস্তত করে মোবাইল হাত নেয়। শিমুলের অবাক কণ্ঠস্বর,” কে কথা বলবে কাকা?”
” প্রহর বাবাজান। ”
শিমুল নিশাতের কানে ফিসফিস করে বলল তৎক্ষনাৎ,
” অভিমান ভুল যান। দূরে গিয়ে এখন প্রেমালাপ করুন ভাবী।”

নিশাত লজ্জাবনত হয়ে সামান্য দূরে সরে আসল। কানে ধরে আস্তে করে হ্যালো বলল। আজ এটাও জিজ্ঞেস করল, ” কেমন আছেন? ”

” সকালে ওঠে সূর্য দেখেছিলি? কোনদিকে ওঠেছিল? ”

তাচ্ছিল্য করে বলল প্রহর৷ নিশাত লজ্জিত ভঙ্গিতে তড়তড় করে বলল,

” আমার ভুল হয়েছে। আমি আপনার খবর নিই নি। আপনার যোগ্য বউ হতে পারি নি৷ ”

” তোকে যোগ্য হতে কে বলেছে? আর খবর কেন নিতে হবে? রোগ হলে ঔষধ খেলে যেমন সেড়ে যায়,তোর কণ্ঠ শুনলেই আমি ভালো হয়ে যাই। তুই আমার বউ, আমার চিরকালের সঙ্গী এটাই আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। তোর আমার যত্ন নিতে হবে না,আমি তোর যত্ন নেবো। তুই শুধু আমার হয়ে থাক তাতেই চলবে। ”

নিশাত অল্প করে হাসল। নিঃশব্দ হাসি। প্রহর ভাইকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করে। আজকাল হৃদয় ভূমিতে খরা দেখা দিয়েছে তাকে না দেখতে পেয়ে। নিজেকে একলা পথিক মনে হয় মাঝে মাঝে। একবার কি বলবে আপনি আসুন প্লিজ? অনুরোধ করবে? পরক্ষণেই চিন্তাভাবনা দমিয়ে ফেলল সে প্রহরের কাজের কথা চিন্তা করে। শুধু বলল,

” আপনি কোথায় যাচ্ছেন? গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ”
” যাচ্ছি কোথাও। পরীক্ষা কেমন হলো? উল্টাপাল্টা কিছু লিখে আসিস নি তো? নিউটন অনেক কষ্ট করে গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়া নিয়ে গবেষণা করে সূত্র বানিয়েছিল। উনার কষ্টকে সম্মান করে সবকিছু সঠিক লিখে এসেছিস তো?”

” আপনার কি মনে হয় আমি ফিজিক্সে গাধী?”

” আলবাত। যে মাথামোটা সে সবকিছুতেই মাথামোটা। সম্মান বাঁচিয়ে রাখিস। মানুষ যেন আমার কাছে এসে না বলে নেতার বউ ম্যাট্রিক ফেইল। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রটা বল। তাইলে বুঝব তুই পদার্থে প্লাস পাবি। ”

নিশাত অল্পক্ষণ ভেবে বিনা নোটিশে কল কেটে দিল। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র মনে আসছে না তার এ মুহূর্তে। পারে সে। কিন্তু মনে আসছে না৷ সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রহর আবার কল দিল। ধরে নি ও। ড্রাইভার কাকার হাতে মোবাইল দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,

” আপনি চলে যান। উনাকে বলে দিয়েন,ভাইয়া এসেছে তার সাথে চলে গিয়েছি। ”

” শিমুল মা?”

” সে-ও যাবে। ”

” না,আমি,,”

নিশাত শিমুলের হাত চেপে ধরে বলল,” ভাইয়া অপেক্ষা করছে, চল। ”

সত্যি সত্যিই সৌরভ টমটম নিয়ে অপেক্ষা করছে। শিমুল তার দিকে পল-অনুপল চেয়ে তড়িৎ গতিতে দৃষ্টি সরিয়ে টমটমে ওঠে বসল। সৌরভও এক পল চেয়ে সামনে বসে পড়ে ড্রাইভারের সাথে।

বাণিজ্য মেলা। বছরে একবার বসে উপজেলায়। সারি সারি চুড়ি,মালা-দুল, কসমেটিকসের জমজমাট দোকান দেখে নিশাত মহাখুশি। এসবের প্রতি ঝোঁক তার প্রবল। প্রথমেই দৌড়ে দৌড়ে চুড়ি দেখতে চলে গেল সে। শিমুল পেছনেই হাঁটছিল মন্থরগতিতে। পুরুষালি কণ্ঠটা অনায়সে তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল,

” আমি ব্লক খুলে কত বার কল দিলাম তোকে,পাল্টা ব্লক কেন দিয়েছিস?”

শিমুল নির্বাক। বোবা সেজে চুপ করে হাঁটতে লাগল। সৌরভ আরেকটু কাছে এসে অধৈর্য গলায় বলল,

” সেদিনের জন্য সরি। আর অমন বলব না। তোর ভাই ভালো, আমিই খারাপ। তবুও চুপ করে থাকিস না। তোর শুদ্ধ -গ্রাম্য ভাষায় মিশ্রিত কথাগুলো আমাকে ভীষণ পোড়ায় শিমুল, না শুনতে পেয়ে দম আটকে আসছে। ”

নিশাত একটা দোকানে গিয়ে মহা আনন্দে রঙ বেরঙের চুড়ি দেখতে ব্যস্ত। আগে-পিছে কে ছিল তার খেয়াল নেই। শিমুল সেদিকে পা বাড়াল। শিমুলের নির্বিকার ভাব দেখে মেজাজ সপ্তম পর্যায়ে পৌঁছে গেল সৌরভের। হাত টেনে ধরে রাগান্বিত সুরে বলে উঠল,

” কথা আছে চল। নিশু ঘুরেফিরে দেখুক। ”

শিমুলের কণ্ঠে চাপা রাগ,অভিমান,” যাব না। ”

” তুই যাবি,তোর ঘাড়,নাক,কান সব যাবে। ”

বলেই টেনে হিচড়ে ভিড়ের মাঝে দিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যেতে লাগল সৌরভ। কাউকে তোয়াক্কা করার সময় নেই এখন। আগে শিমুলের সাথে অদৃশ্য সম্পর্ককে আবার জোরা লাগাবে, তারপর বাকি সব। শিমুল জোরাজুরি করেও ছাড়াতে পারল না নিজেকে।

নিশাত ভ্যালবেটের চুড়ি হাতে পড়ে দেখছিল। চুড়ির রং কালো। একটা নিয়ে ফরসা হাতে পড়তেই বেশ সুন্দর দেখাল হাতটা। আরেকটা পড়তে নিয়ে ভড়কে গেল সে। অকস্মাৎ একটা বলিষ্ঠ হাত তার বাম বাহু চেপে ধরল। কাপন ধরিয়ে দিল হৃদয়ে। চুড়িগুলো একেক করে পড়ে গেল নরম ঘাসের বুকে। বয়স্ক দোকানদার চেঁচিয়ে উঠলো,
” এই মাইয়্যা চুড়িগুলো ভেঙে ফেললি,জরিমানা না দিয়ে যাইতে পারবি না। ”

#চলবে~
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____৪৩

নধরকান্তি সবুজ ঘাসের বুকে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে ভ্যালবেটের কৃষ্ণাভ চুড়িগুলো। ভাঙে নি একটাও। পা টা মাড়িয়ে জুতার তলানিতে ঠাঁই দিল তাদের লম্বাটে এক পুরুষ। পকেট থেকে পাঁচশ টাকার চকচকে একটি নোট বের করে বাড়িয়ে দেয় প্রবীণ দোকানির দিক। টাকাটা হাতে নিতে ধানাইপানাই করল বৃদ্ধ, নিতে তাঁর ভীষণ দ্বিধা। নিশাতের রোগাটে দেহ নিজের বক্ষস্থলে বেঁধে রেখে বলল সেই পুরুষ,
” আপনার কর্কশ কণ্ঠে মিথ্যা শুনে ভয় পেয়েছে আমার বউ। চুড়ি একটাও ভাঙে নি,সবে নষ্ট করলাম আমি৷ ক্ষতি না করে জরিমানা দেওয়া যায় না,তাই করেই ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি,নিয়ে নিন। ”
সামনের মানুষকে দেখে মুখের রং উড়ে গেল দোকানীর,কুঁচকানো চামড়া হয়ে যায় বিবর্ণ। চিনতে পেরে আমতা আমতা করে,”ঘাসের ওপর পড়লে কি ভাঙে নাকি? কথার কথা কইয়া লাইছি। টেহা দিওন লাগব না স্যার। আপনের আব্বার বদৌলতেই প্রতি বৎসর মেলায় দোকান দিতে পারি। এই মাইয়্যা যে আপনের বউ এইডা জানতাম না। ”

নিশাত ঘাড় ঘুরিয়ে প্রহরকে দেখল। মানুষটা শুকিয়ে গেছে খুব। চোখ দুটি কোটরাগত। ঠোঁট কালচে,চোয়াল শক্ত। উজ্জ্বল শ্যামলা রংটা প্রায় মলিন হয়ে গিয়েছে। নির্বাচনের সময় থেকে এমপি হবার সময়টুকু পর্যন্ত নিজের প্রতি চরম অবহেলার দরুন এমনতর দশা বুঝতে বাকি থাকল না ওর। পুতুলের ন্যায় মিশে রইল বুকে। মেলার উৎসুক জনতা ওদেরই দেখছে। সবার উত্তেজনাপূর্ন দৃষ্টি জুড়ে এখন পুলিশ,বডিগার্ড, আর নেতা প্রহর এজায। নিশাত তার বউ এটা নিয়ে কানাঘুঁষা চলছে রীতিমতো। বুঝা গেল গ্রামের খবর উপজেলা অবধি আসে নি। মন্ত্রী বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে হলো অথচ কেউই জানে না। অস্পষ্ট কানে আসছে কথাগুলো প্রহরের। নিশাতের মলিন মুখের দিকে চেয়ে দোকানিকে প্রশ্ন করে, ” ঝুড়ি আছে আপনাদের? থাকলে বিশ ডজন চুড়ি প্যাক করে দিন। তোর কোনগুলি পছন্দ নিশু? হাত দিয়ে দেখিয়ে দে। ”
নিশাত কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এত চুড়ি দিয়ে কী করবে সে? শখের বশে ধরেই কেমন ফ্যাসাদে জড়িয়ে গেল।
” চুড়ি লাগবে না আমার। ”
ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলল সে। প্রহর বক্ষবাঁধন থেকে মুক্ত করে দিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল,” কেন লাগবে না? মেলায় এসেছিস কেন তাহলে? অবশ্যই নিতে হবে তোর। শিমুল আর তোর ভাই কই? ড্রাইভার কাকা বলল তারা সহ আসছে। ”
নিশাত অবিন্যস্ত চোখে আশেপাশে তাকায়। কোথাও নেই দুজনে। গেল কোথায়! সে ভেবেছিল ওর সাথেই বোধহয় আছে,চুড়ি দেখায় এতই মত্ত ছিল যে ওদের ভুলেই বসেছিল। মিনমিন করে বলে,” আছে হয়ত এদিকেই। ”
প্রহর বাঁকা হেসে বলে,” চুড়ি দেখ তুই। শ্রদ্ধেয় মামুজানের আরেকটা হা**র্ট অ্যাটা**কের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ”
নিশাতের চমকিত কণ্ঠস্বর,” আব্বা হা**র্ট অ্যা**টাক করবে কেন?”
” তোর ভাইয়ের জন্য। ”
” ভাইয়া কী করেছে?”
” সময় এলে বুঝবি। চুড়ি চয়েজ কর।”
নিশাত লাল, সবুজ,সোনালি রঙের তিন ডজন চুড়ি দেখিয়ে বলল, ” এগুলোই নেবো। ”
প্রহর চোখ জোড়া সংকুচিত করে চাইল। তেজী গলা,” তোর জামাই কি কিপ্টে না-কি? কয়টা বাচ্চা আছে তোর যে তাদের ভরনপোষণর কথা ভেবে কিপ্টামি করছিস? সদ্য ম্যাট্রিক দেওয়া মেয়েদের এত হিসেবি হতে হয় না। মামুজানের অভ্যাস ছাড়। একমাত্র মেয়েকে অনুষ্ঠান করে তুলে দিতে পারবে না, সেকারণে ইন্টারের পর শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর অজুহাত দেখায়। ততদিনে মানুষজন অনুষ্ঠানের কথা ভুলে যাবে সেটা ভালো করে জানেন উনি। কেন রে? আমি কি বাঘ? খেয়ে ফেলব তোকে? মামুজান এমন বিহেভ করছে যেন তুই তুলতুলে কেক আর আমি রা””ক্ষস। ঠিকি আমার শ***ত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছিল। তখন কই ছিল এমন অজুহাত? যত কিপ্টেমি,শয়**তানি বুদ্ধি আমার বেলায়।

নিশাত কথার দাপটে বাধ্য হয়ে বলে,” সব চুড়ি নেবো,সব নিয়ে দিন। ”
প্রহর ওর হাত টেনে নেয় মুখের সামনে। ফর্সা হাতে সোনালি রঙা কয়েকটা চুড়ি পরিয়ে বলে,” এখন একদম প্রহরের বউয়ের মতো কথা বলেছিস সুইটহার্ট। ”

শিমুল দিশেহারা হয়ে খপ করে কা**মড় বসিয়ে দিল সৌরভের হাতে। সৌরভ হতভম্ব। ক্যাটকেটে স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ” কা**মড় কেন দিলি পাগলের জাত? ”
মাথায় রক্ত চাপল শিমুলের। ক্রোধান্বিত গলায় বলল,” আমি পাগ**লের জাত? আপনার সাহস কেমনে হয় আমারে টাইনা আনার?”
মেলার মাঠের শেষ প্রান্তে একটা ঝিল আছে। তাতে অসংখ্য কচুরিপানার রাজত্ব। ঝিলের কোল ঘেঁষে চার-পাঁচটে ফুচকা,চটপটির দোকান বসেছে। দোকানগুলোতে মানুষের দুর্দান্ত হট্টগোল। সৌরভ অল্প দূরত্ব বজায় রেখে প্রচন্ড নরম কণ্ঠে শুধায়,” পা**গল হবি কেন? তুই হলি শরতের সকালের সুরভিত শিমুল ফুল। ”
শিমুল ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। বলল,” ঢং কইরা শিমুল ফুল ডাকা লাগবে না। কী বলতে আনছেন, সেটা বলেন সৌরভ ভাই।”
” ব্লক খুলে দে,কলে কথা বলব তোর সাথে। ”
” আমার সাথে কেন কথা বলবেন?”
” সবসময় যে কারণে বলি। ”
” কোন কারণে বলেন?”
সৌরভ এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিম্নস্বরে বলে,” কোন কারণে বলি জানিস না?”
শিমুল অভিমান ভরপুর গলায় জবাব দিল,” না। আপনের সাথে আমার কোনো কথা নেই। ”
সৌরভ অসহায় চোখে চেয়ে বলে,” অনেক কথা আছে। একটু শোন।”
মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখল শিমুল। হৃদয় সমুদ্রে উথালপাতাল ঢেউ উঠছে। কত আর অনুভূতি বুঝে চলবে মন? অব্যক্ত অনুভূতি প্রকাশ না হলে কীভাবে এক হবে দুজনের পথ? ভবিতব্য পরিকল্পনা করার পূর্বে সম্পর্ক স্পষ্ট করা খুবই প্রয়োজন।
” জলদি বলেন। নিশুরে ফেলে আসছি,ফিরে যেতে হইব। ”
সৌরভের পুরুষালী কণ্ঠটা সমস্তা জড়তা,আশঙ্কাকে ঝেরে ফেলে দিয়ে পুরো শক্ত হয়ে বলল,
” তোকে গ্রহণ করলে আব্বা আমাকে নিঃসন্দেহে ত্যাজ্য করবেন। ভয় পাই না আর। তোকে চাইলে ফুপা-ফুপু, তোর দুই ভাই কি আমায় ফিরিয়ে দেবে?”
শিমুলের ভেতর কেবল ‘ভালোবাসি’ শব্দখানা শোনার আশায় শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গিয়েছে। অথচ সৌরভের মুখ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে অন্যকিছু।
” আপনি কেন চাইবেন আমাকে?”
” ভালোবাসি বলে। ভালোবাসার মানুষকে চাইতে হয়,আগলে রাখতে হয়,নিজের সম্পত্তি বলে দাবি করার বন্দোবস্ত করতে হয়। ”

সৌরভের সরল সোজা স্বীকারোক্তি শিমুলের মনের বাঁধ প্রবল জোয়ারে হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অতল গহ্বরে, যেমন করে ভয়ংকর জোয়ার এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সমুদ্রের বালির বাঁধ। ধ্বক করে উঠল বুকটা। সময় থমকে গেল,আশাপাশ অচেনা রূপ ধারণ করল,অদ্ভুত অজানা অনুভূতিতে মুখরিত হয়ে গেল হৃদয় ভূমি। অভিমান, জেদের সমাপ্তি ঘটিয়ে একরাশ লজ্জারা হামলা চালায় শিমুলের অভ্যন্তরে। সৌরভ স্মিত হেসে বলল,
” আইডিয়া দে। কীভাবে বললে তোর পরিবার রাজি হবে? আপাতত শুধু রাজি করিয়ে রাখব,বিয়ে তুই আরেকটু বড় হলেই করব। ”
শিমুল একটু বুদ্ধি করে বলল,” নিশুকে বেঁধে রাখলে ভাইয়া রাজি হয়ে যাবে। ”

চোখ বড়সড় করে তাকাল সৌরভ। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,” তখন এগারো কি বারো বছরের ছিলাম। ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি চলছে। তোর ভাই ক্রিকেট প্র্যাকটিস করছিল একদিকে,আর আমরা হ্যান্ডবল। ক্রিকেট বল এসে আমাদের সাথের একজনের বুকে পড়ল। সেজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বল ফেরত দেবো না,স্যার বিচার করবেন,তারপর দেবো। কারণ স্যার বার বার করে বলেছে আগে হ্যান্ডবল চর্চা হবে তারপর ক্রিকেট। কিন্তু তোর ভাই সবসময় নিজেকে ওস্তাদ মনে করত। বল দেবো না বলে অসম্মতি জানালে সে সবার সামনে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে আমার পায়ে আঘা**ত করে বসে। ব্যথায় টানা সাত দিন কাতরেছি আমি। সামান্য বলের জন্য এমন করেছে,বউ না দিলে আমাকে মাটির নিচে পুঁতে ফেলবে শিউর থাক। গু**ন্ডা ছেলেরা কারো পরোয়া করে না। ”

” আপনি আবার আমার ভাইকে নিয়ে নিন্দা করছেন। ”
সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে উঠল শিমুল। সৌরভ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,” প্রশংসা করছি। অনেক সাহসী তোর ভাই। নইলে এমপি হওয়া এত সোজা? সাহসের অভাবে আমরা হতে পারলাম না। সে সাহসী পুরুষ বলেই হতে পেরেছে। ”

সৌরভ,শিমুলের অপেক্ষায় গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকল নিশাত। আগ্রহী দৃষ্টি ওদের খুঁজে চলেছে। অকস্মাৎ দুজনের লাপাত্তার ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না ও। পাশ থেকে ভরাট কণ্ঠের প্রশ্ন এলো,” তোর ভাই প্রেম করে?”
হতবাক সে। বিস্ফোরিত নয়নে প্রহরের দিক তাকায়। প্রেম! পিংকির সাথে করত। কিন্তু এখন এমন প্রশ্ন কেন করছে প্রহর! মিনমিন করে উত্তর দেয়,” না। ”
ওইসময় সৌরভ, শিমুল হাজির হলো। পেছনে বডিগার্ড। প্রহর খুঁজে আনতে পাঠিয়েছিল। ভাইকে দেখে বুক ধড়ফড় করে উঠল শিমুলের। চোরা নজরে চেয়ে নিশাতের দিকে এগিয়ে গেল। সৌরভ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে বোন জামাইকে জিজ্ঞেস করল,” কেমন আছিস?”
প্রহর ঠোঁটের কোণে সুপ্ত হাসি এঁকে জবাব দেয়, ” ভালো। কোথায় গিয়েছিলি তোরা?”
শিমুলের মুখশ্রী ফ্যাকাসে হয়ে গেল ভয়ের তোপে। ভাইয়ের গভীর চাহনিতে ধরা না পড়ে যায়! সৌরভ সামলে নিল।
নির্বিকার অভিব্যক্তিতে জানান দিল,” শিমুল ওয়াশরুমে যাবে বলল, নিয়ে গেলাম। ”

চারটে গাড়ি রাস্তার ধুলোবালি উড়িয়ে উপজেলা ছেড়ে গ্রামের পথে নামল। মজুমদার বাড়ির সামনে ব্রেক কষে থেমে যায় সবকটা ইঞ্জিন। রোকেয়া গেইট খুলে বেরিয়ে এলেন গাড়ির শব্দ পেয়ে। বিয়ের পর মেয়ের জামাই একমুহূর্তের জন্য আসে নি। সৌরভ গাড়িতে ফোন দিয়ে বলেছিল প্রহর এসেছে, সেই অনুযায়ী হরেক পদের রান্না শুরু করলেন। গাড়ি থেকে নেমে রোকেয়াকে সালাম দেয় প্রহর। আসার সময় প্ল্যান করেই এসেছিল আজ প্রথমে শ্বশুর বাড়িতে যাবে। শ্বশুরের সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া আছে তার। সেই মোতাবেক মিষ্টি, ফলফলাদি নিয়ে হাজির বাড়িতে। প্রহর রোকেয়ার সাথে বাড়িতে প্রবেশ করে। নিশাত, শিমুল গুটি গুটি পায়ে আগায় পেছন পেছন। পিংকির মা শরবতের গ্লাস এনে হাসিমুখে বলে,” শরবত খা বাবা। ”
প্রহর হাতে তুলে নেয়,” ধন্যবাদ মেজো মামী। পিংকি আসে না?”
” না। ও পোয়াতি। জার্নি করলে সমস্যা হই যদি এইজন্য কারিম আসতে দেয় না। ”
” বাহ! এটুকু বয়সে কি সুন্দর ঘর-সংসার করছে,স্বামীর বাধ্য হয়ে চলছে। অনেক মেয়েরা এ বয়সে বিয়ে বসলে সংসারের প্রতি অনীহা করে,অবুঝ সেজে থাকে। পিংকিকে আমার বেস্ট ঘরণী এওয়ার্ড দিতে ইচ্ছে করছে মামী। ”

পিংকির মা হেসে পা বাড়ালেন রান্না ঘরের দিকে। নিশাত বুঝল খোঁচার তীর তার দিকেই নিক্ষেপ করা হয়েছে। সে সংসার করতে অনীহা করে নি৷ আব্বার কথারও নাকচ করতে পারছে না। তাঁর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছে। তবুও বিয়েটা মেনে নিয়েছেন উনি। শেষে একটা আবদার করেছে ইন্টার শেষ করলে প্রহরের হাতে তুলে দেবে,এতে কীভাবে না করা যায়?

রোকেয়া এসে ওকে স্কুল ড্রেস পাল্টে নিতে বলল। প্রহর তাঁর কাছে জানতে চায়,” মামুজান কোথায়? কিছু কথা আছে উনার সাথে। ”
রোকেয়া চিন্তিত হয়ে প্রতুত্তর করে,” ঘরে আছে। কী বলবি?”
” কথা বলে এসে জানাচ্ছি তোমাকে। ”

ঘরে বসে বাজার থেকে আনা পত্রিকা পড়ছিলেন রফিক আজম। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকিয়ে মেজাজ সপ্তমে পৌঁছে গেল। থমথমে কণ্ঠে বলে উঠলেন,” কীজন্য এসেছ?”
” শ্বশুর বাড়িতে আসব না? নানার বাড়িতে আসা নিষিদ্ধ ছিল,শ্বশুর বাড়িতে আসাও কি নিষিদ্ধ? ”
প্রহর চেয়ার টেনে বসল। গুরুতর ভঙ্গিতে বলল, ” ইম্পরট্যান্ট কথা আছে বলে আপনার ঘরে এসেছি মামুজান, বিয়ের দিন নির্বাচনের চিন্তায় বলা হয় নি। ”
রফিক আজমের কপালে কুঞ্চিত রেখার দেখা মিলল। জলদগম্ভীর স্বরে বললেন,” কী কথা?”
প্রহর বেকায়দায় হেসে সাফ সাফ বলল,” যৌতুকের কথা। আপনার একমাত্র মেয়ে,মেয়ের জামাইকে যৌতুক দেবেন না? যৌতুক হিসেবে আমার এটা চাই। ”

প্রহরের বাড়ানো কাগজটা নিয়ে পড়ে দেখলেন তিনি। তেতে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে, ” এই উদ্দেশ্যে নিশাতকে বিয়ে করেছ তুমি তাই না? আমি আগেই জানতাম এমন কিছুই হবে। এজন্যই বাড়িতে আসতে দিতাম না তোমাদের। বেয়াদ**বদের পা এই বাড়িতে পড়ুক কখনোই চাই নি। ”

” আমি চাইলে আপনাকে নিঃশেষ করে দিতে পারি। রবিন মামা রাজি। আপনাকে বদনাম করার উদ্দেশ্য আমার নেই। আপনি পা**প করেছেন,মিথ্যা বদনাম রটিয়েছেন,আপনাদের ধ্বংস করা আমার জন্য মশা মা””রার মতো। কিন্তু সম্মান রক্ষার্থে আমি এমন কিছুই করি নি। গ্রামে লোকজন ডাকিয়ে সুন্দর করে ব্যাপারটা আগামীকাল মিমাংসা করবেন। আমি নিজের মতো করে আমার চাওয়া হাসিল করতে গেলে আপনার সম্মান দাফন হয়ে যাবে চিরতরে। আর নিশুকে বিয়ে করার আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল এবং আছে তা হলো,ভালোবাসা। ”

” তুমি যা চাইছো এরকম করব না। যুগ যুগ আগের ভেজাল কেন টেনে আনব আমি?”

” দম্ভ,হিংসা এসব বহন করে ধ্বংস ব্যতীত কিছুই পাবেন না। আপনি আমাদের অপছন্দ করেন বলেই হয়ত সৃষ্টিকর্তা আমাকে আপনার মেয়ের সাথে বেঁধে দিয়েছে, নতুন সম্পর্কও বাঁধতে চলেছে। আগামীকাল আপনার, আমাদের সম্মানের নতুন পথ তৈরি হবে আর নয়তো অধঃপতন হবে আপনার অহংকারের। গেট রেডি ডিয়ার মামুজান। ”

কথাটা বলে বেরিয়ে গেল প্রহর। রফিক আজম কাগজটা নিয়ে বসে রইলেন দুশ্চিন্তায়। আগে আঁচ করতে পেরেছিলেন প্রহর গর্ত খুঁড়ে কেঁচো বের করার ছেলে। নিজের ফুপুর বিষয়টা দামাচাপা দিয়ে বিনা দোষে অন্যায় মাথায় নিয়ে থাকার পাত্র না সে।

শীতের আমেজ প্রায় শেষ। গ্রীষ্ম সদ্য জন্মেছে, খেলা করছে প্রকৃতির কোল জুড়ে। ঊষা বুনোফুলগুলো ছুঁয়ে দেখছে। প্রত্যয় হলদেটে একটা ফুল ছিড়ে নিয়ে তার কানের পাশে গুঁজে দেয়,তাকায় প্রগাঢ় দৃষ্টিতে। এই মুখ সে প্রতিদিন দেখতে পায় না,দেখার সৌভাগ্য হয় না। দূরত্ব আজও শেষ করে নি ঊষা। গ্রাম থেকে ফিরে এসে পুনরায় চলে যায় সে মেডিক্যাল হলে। গুঞ্জন কি-না জানে না তবে শুনেছে লন্ডনে চলে যাবে ঊষা। আজ নিজেই ফোন করে ঢাকা থেকে বাইরে নির্জন পরিবেশে ডাক পাঠিয়েছে তাকে।

” তোমাকে কেন ডেকেছি জানো,ভাইয়া?”
” জানব কীভাবে? বলিস নি। শাড়ি পরেছিস কেন? অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে। ”
” তোমার জন্যই পরেছি। তুমি আমার বর না? বউ মানুষ আমি,বরের জন্যই তো শাড়ি পরব। ”

প্রত্যয় ঊষার নরম গালে শক্ত হাত রাখে পরম আদর মাখিয়ে। টলমলে ভাসা ভাসা চোখে চোখ ডুবিয়ে বলে,” তোর মধুময় কথা আমার হজম হচ্ছে না ভোরের পাখি। দূরত্ব আরও বাড়াবি বলেই কি প্রেম দেখাচ্ছিস,মায়া দেখিয়ে দেহের মৃ**ত্যু ঘটাতে চাইছিস? আমার পা**পের শাস্তি হয়ে গেছে, তোকে ছাড়া পল-অনুপল ধুঁকে ধুঁকে ম–রে আমার মন। দেহটুকু বেঁচে আছে তোর পথ চেয়ে। হররোজ স্বপ্ন দেখি আমাদের ঘরে নতুন আরেক ভোরের পাখি জন্ম নিয়েছে। আমার স্বপ্নটা বাস্তব করে দে ঊষা। আমি মৃন্ময়ীর কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম,পাই নি তাকে। ”

ভালোবাসাকে অবজ্ঞা করার মতো কঠিন কাজ আর কিছু নেই। যারা অবহেলা করে নির্ঘাৎ মূর্খ সে। ঊষা অবোধ, মূর্খ হতে চেয়েছে। ভাগ্যের ওপর অভিমান করেছে। মৃন্ময়ীর বিদায়কালীন দুটো বাক্য খান খান করে ভেঙে দিয়েছে তার রাগ,অভিমান, কষ্টের মজবুত প্রাচীর। এতদিন যাবত প্রত্যয়কে দূরে ঠেলে দেওয়া তার অন্যায় ছিল? মোটেও না। বরং দূরত্বের দেয়াল না তৈরি করলে সে নিজের করা অন্যায়,পাপ উপলব্ধি করতে পারত না, মনে অনুশোচনা জন্মানোর বদলে সেগুলো চাপা পড়ে থাকত। কৈশোর থেকে যৌবনে আসার সময়টাতে সঠিক পথে থাকাটা চাঁদ ছুঁতে পারার মতো দুরূহ বিষয়। প্রত্যয়ের জেদ, অবাধ্য চাওয়া মৃন্ময়ী, ঊষাকে নিপতিত করেছিল অন্ধকারে। কষ্ট পেয়ে যতই দূরে থাকুক ঊষা, প্রত্যয়ের জন্য ভালোবাসা কমে নি এক চিমটি। বরঞ্চ ভয়াবহভাবে বেড়েই চলছিল। প্রত্যয়ের খরখরে গালে হাত রাখে ও। চাউনি স্থির, গভীর। অস্ফুটস্বরে বলে,

” তুমি কি তোমার ভোরের পাখিকে আর কষ্ট দেবে ভাইয়া?”

হ্যাঁচকা টানে ঊষাকে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে নেয় প্রত্যয়। গালে গাল ছুঁয়ে কর্ণকুহরে বাতাসে মতো ফিসফিস করে বলল,” যতবেশি ভালোবাসলে তুই হাসিখুশি থাকবি,তার থেকে দ্বিগুণ ভালোবাসব তোকে ঊষা। তুই শুধু রাতের সমাপ্তিতে ভোরের পাখি হয়ে নেমে আসিস আমার বুকে,মিশে থাকিস প্রয়াণকালেও আমার সাথে। ”

” মৃন্ময়ী চলে গেছে, হারিয়ে গেছে বহুদূরে। ক্ষমা করে দিয়েছে সে তোমাকে। শূন্য হাতে এ শহরে এসেছিল, শূন্য হাতেই ফিরে গিয়েছে। ভাগ্য চরম বেই–মানী করেছে তার সাথে। ”

#চলবে~

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_____৪৪

ঊষা ব্যাগ থেকে একটা চিঠির খাম বের করে প্রত্যয়ের হাতে ধরিয়ে দিল। চোখ জোড়া সংকুচিত করে তার দিকে তাকাল প্রত্যয়। বিস্ময়াহত হয়ে ছোট করে উচ্চারণ করে,” চিঠি!”
” হুম,তোমার জন্য। ”
” আমাকে চিঠি কে দিল?”
” মৃন্ময়ী। ”
প্রত্যয় দ্বিগুণ চমৎকৃত চেহারা নিয়ে প্রশ্ন করল,” কখন দিল?”
” এক সপ্তাহ আগে,যাওয়ার আগের দিন। ”
” তোর সাথে দেখা করে গিয়েছিল? ”
” হ্যাঁ, চিঠিটা তোমাকে দিতে বলল। ”
চিঠির খাম খুলতে খুলতে প্রত্যয় জিজ্ঞাসু গলায় বলে ওঠে,” তুই খুলিস নি?”
” তোমার নামে চিঠি দিয়েছে তুমি পড়বে বলে। আমি পড়লে অন্যায় হয়ে যাবে না?”
” তোর অধিকার আছে পড়ার। ”
” অধিকার আছে,তবে আমি চাই না পড়তে। মৃন্ময়ীর চিঠির ভাষাগুলো একান্তই তোমার মাঝে থাকুক। ”
প্রত্যয় অতি যত্নে খাম খুলে চিঠিটা বের করল। মেলে ধরল মুখের সামনে।

❝ কাঠের পুতুল যেভাবে নাচে এক হিংস্র জানোয়ারের ভয়ে আমি সেভাবেই নেচেছিলাম। নিজের জীবনের তিক্ত সত্যটা গোপনে রেখেছিলাম ভীষণ যত্নসহকারে। প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে দ্বিতীয় ভালোবাসা আঁকড়ে ধরতে আমার ছিল অগাধ ভয়। নিজেকে যতটা শক্ত খোলসে লুকিয়ে রেখেছিলাম ভিতর থেকে আমি তার চেয়েও নরম ছিলাম। আমার প্রথম ভালোবাসা আপনার মতোই ছন্নছাড়া এক যুবক ছিলেন, কিশোরগঞ্জে অতিথি হয়ে এসে কেড়ে নিয়েছিল আমার মন। আমি তখন সদ্য ম্যাট্রিক দিয়ে কলেজে পদার্পণের দিন গুণছি। হুট করে ঝড়ো হাওয়া হয়ে জীবনে এলো সেই যুবক। আমাদের বাড়ির পাশে এক বড়ো ভাইয়ার বন্ধু হবার খাতিরে বেড়াতে সেখানে এসেছিল সে। সেখান থেকেই পরিচয় এবং পরিচয় থেকেই প্রণয়। প্রণয়ের কয়েক মাসের মাথায় বিবাহ বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়া। আসলে মা ছাড়া বড়ো হয়েছি আমি,বাবা ব্যাংকের চাকরির জন্য আমাকে তেমন সময় দিতে পারত না। কারো হুট করে পাওয়া ভালোবাসায়,ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি নিমিষেই মুগ্ধতার জালে জড়িয়ে যাই। আমার মুগ্ধতা, সেই মানুষটা কিছুই ভুল ছিল না। আমাদের বিপক্ষে ছিল আমাদেরই নিয়তি। একটা মেয়ে যতটা গভীর ভালোবাসা পেলে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবতী বলে দাবি করতে পারে আমি তেমনটাই পেয়েছি। কত সুখময় কপাল আমার,তাই না? এত ভালোবাসা পেলাম, নিঃসন্দেহে আমি সুখী মেয়ে। কিন্তু সুখের ওপর নজর লাগে জানেন তো? আমারই ভাগ্যের কালো নজর লেগেছিল বোধহয়। সারাক্ষণ ভাবতাম আমি কেন এত সুখী! কখনো ভাবন ঘরে আসে নি দুঃখও তো আমায় ছুঁতে পারে, সুখ নিয়ে কেন এত লাফঝাপ আমার! দুঃখ আমার সুখের ওপর হিংসে করে চলেই এলো জীবনে নীলাম্বরে আষাঢ়ের ঘন কালো কাদম্বিনীর মতো। হঠাৎ বাবা স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। লুকোচুরি বিয়ে হওয়ায় দুই পরিবার থেকে অনুষ্ঠান করে ফের বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হয়। আমার স্বামীর সাথে ফোনে আলাপন হতো তখন আমাদের। বাবা হাসপাতালে ভর্তি হবার সময়টায় তাকে আমি কয়েক বার কল করেও পাই নি। তার পরিবারের কারো নাম্বার না রাখায় যোগাযোগ করতে পারি নি আমি। ভাবলাম রাজনীতি করে তাতে হয়তো ব্যস্ত। সুযোগ করে আমাকে কল দেবে। একদিন, দুদিন, তিনদিন, মাসখানেক চলে গেল,যোগাযোগ করল না আর। বাবা সুস্থ হয়ে বার কয়েক চেষ্টা করলেন যোগাযোগ করার সম্ভব হলো না। এর মধ্যে আমার ফোনটাও বাবার জন্য হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করার সময়টায় চুরি হয়ে যায়। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পাঁচ মাস পর আমিই বাবাকে নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসি, এসে জানতে পারি আমি আসার পাঁচ মিনিট আগেই আমার স্বামীকে দাফন করা হয়েছে। তিনি নাকি মাদকাসক্ত হয়ে মারা গেছেন। কথাটা বিশ্বাস হয় নি আমার। সেই বাড়ির কেউ আমার সাথে কথা বলতে রাজি ছিল না। প্রথম থেকেই তার পরিবারে আমাদের বিয়ে নিয়ে অমত ছিল। তাই অন্তিমের মৃত্যুর পর যোগাযোগ না করতে চাওয়াটা স্বাভাবিক। আমার বার বার মনে হচ্ছিল অন্তিমের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। ওহ হ্যাঁ, আমার স্বামীর নাম অন্তিম। যেই মানুষটার জীবনে কোনো কষ্ট ছিল না,বাজে অভ্যাস ছিল না,আমাকে এত ভালোবাসত সে কেমন করে পাল্টে গিয়ে এভাবে নিজেকে শেষ করে দেয়? নামটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে পরিচিত লাগছে? লাগারই কথা,সেও আপনাদের বিপক্ষে রাজনীতি করত একটা সময়। অন্তিম সেই ভয়ংকর পথ মৃত্যুর জন্য বেছে নেয় নি আমি জানি, তাকে মারা হয়েছে এবং খুবই ভয়ংকরভাবে। শুধু মাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা হাসিলের জন্য সমীরণ মেরেছে তাকে। সে জানতেই পারে নি আমার মাঝে সে তার একটা অংশ রেখে গিয়েছে। আমার একটা ছেলে আছে চার বছরের, যাকে আপনি আমার জীবনে আসার আগেও কুদৃষ্টি থেকে আড়ালে রেখেছিলাম সমীরণের কারণে। নিজের এবং ছেলের সুন্দর একটা ভবিষ্যত গড়ব বলে ঢাকাতেই থেকে যাই। এটাই ছিল আমার জীবনের চরম ভুল। অত বছর সমীরণ আমাকে নিয়ে মাথা না ঘামালেও আপনি আমার পেছনে পড়ার পর থেকে তার নজর চলে আসে আমার ওপর। আপনাদের ব্যাপারে সে সকল খোঁজ রাখত, শ–ত্রু বলে কথা। আপনি যেদিন থেকে আমার কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে হাজির হওয়া শুরু করলেন,সেদিন থেকেই অন্ধকারের অন্যতম অধ্যায় শুরু হয় জীবনে। যেই ছেলেকে সবার আড়ালে রেখেছিলাম তার ঠিকানা খুঁজে নেয় সে। কাছের কিছুসংখ্যক মানুষ ছাড়া আমার ছেলের ব্যাপারটা কেউ জানত না, আমার বড়ো বোনের কাছে রেখেছিলাম তাকে। নিজেকেও যথাসম্ভব শক্ত রেখে,আড়ালে থাকার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সমীরণ আমাকে ঠিকি খুঁজে বের করে নেয়। সে হু””মকি দেয় আমি আপনার বুকের ভেতরের যন্ত্রণা হাহাকার না বাড়ালে সে বাবার ক্ষতি করবে। আসলে এসব মানুষ নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে। তাছাড়া সে আমার স্বামীর মৃ–ত্যুর পেছনে দায়ী সেটা জানতাম। তনুজা আপুর মাধ্যমে জানা হয়। আমেরিকা থেকে উনি আমার সাথে যোগাযোগ করেই সত্যটা জানান। প্রথমে আমি কেস লড়তে চাইলে আপু আমাকে দমিয়ে দেন,সমীরণ কতটা ভয়ংকর সে সম্পর্কে অবগত করেন। অন্তিমের বউ আমি এটা সমীরণের জানা ছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে ভেঙে দেওয়া। আপনার প্রতি মুহূর্তের খোঁজ সে রাখত। আমি তনুজা আপুর কথায় নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তার উদ্দেশ্যে রাজি হয়ে যাই। আপনার ভালোবাসার প্রস্তাব প্রথমে আমার কাছে বিরক্ত লাগত, তিক্ত সত্যের মাঝে আবদ্ধ ছিলাম বলে বার বার ফিরিয়ে দিতাম আপনাকে। সমীরণের কথায় সেটার মাত্রা আরও বাড়ল। কিন্তু মানুষ যা ভাবে,যা প্ল্যান করে জীবনে সবসময় এমন হয় না।

আমি চেয়েছিলাম সমীরণের কথা রাখতে আপনাকে ভেঙে দিয়ে এখান থেকে নিরাপদে চলে যেতে,কিন্তু আমিই জীবনে আবার মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লাম, জানেন? ভেবেছিলাম অন্তিমের মতো আবারও কেউ বুঝি আমাকে ভালোবাসার জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আপনার প্রেমের আহ্বান, পাগলামি, চোখের যন্ত্রণায় ডুবে আমিও ক্ষণিকের জন্য পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। বুঝি নি সবই ছিল মোহ,মিথ্যে। এত নিখুঁত অভিনয় কেউ করতে পারে জেদের বশীভূত হয়ে! না,অভিযোগ নেই আপনার প্রতি। পথভোলা পথিক আমি ঠিকি নিজের পথ খুঁজে নেব,আমার অন্তিম আমাকে পথ চলা শিখিয়ে গেছে। আমি অন্যের কথায় নিরুপায় হয়ে আপনাকে ঝলসে দিতে গিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছি। আপনি জেদে সফল হয়েছেন, বুকের ভেতর এই সত্যটা পুষে রাখতে পারি নি আর। আমাদের আর কখনো দেখা হবে না বলে চিঠিতে কথাটা প্রকাশ করার সুযোগটুকু পেলাম। যদি কোনোদিন জেনে ফেলেন আমি কোথায় আছি তবুও দেখা করতে আসবেন না দয়া করে। নিজেকে অপরাধী ভাববেন না, অপরাধী তো আমি। ঊষা আপুকে বিয়ে করে আপনি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন,সমীরণ থেকে মুক্ত হয়ে ছাড়তে পারছি বিষাক্ত এ শহর। নয়ত নিজের মাঝে ভালোবাসা নিয়ে আপনার সাথে যন্ত্রণা দেবার খেলায় আমি ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছিলাম। মোহ ছাপিয়ে আপনি সত্যিকারের ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পেরেছেন,এতে আমি খুশি হয়েছি। আমি কেবলই আপনার জীবনে জেদ,মোহের, অসমাপ্ত অধ্যায় ছিলাম। কখনো যদি আমার না থাকার খবর আপনার কানে আসে আমার ছেলেটাকে একটু আগলে রাখবেন? হারাতে হারাতে নিঃস্ব আমি। এত এত কথা শুধু আপনাকে সত্য বলে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। ক্ষমা করে দেবেন আমায়, আগলে রাখবেন ঊষা আপুকে। অসম্ভব ভালোবাসে আপনাকে, আমার কাছে আপনার প্রেমের দাবি নিয়ে অনেক বার এসেছিল শুধুমাত্র আপনার সুখের জন্য। আমার এক তরফা প্রেমহীন, আপনার জেদের অধ্যায় এটুকুই ছিল। ❞

ইতি,
মৃন্ময়ী।

ইতি টানার পরও চিঠিটার শেষ অংশে আরও কিছু লেখা দেখতে পেল প্রত্যয়। লাল কালি দিয়ে লেখা,
❝ ভালোবাসার নিয়ে মিছে খেল আর খেলবেন না প্রত্যয়। আপনার মিছে ভালোবাসায় আমার হৃদয় জ্বলে পুড়ে অঙ্গার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের আর দেখা না হোক। ❞

চিঠিটা পড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রত্যয়ের বুক চিড়ে। যে মেয়েটাকে সে শক্ত ধাঁচের ভাবত,সে আসলে ভেতরে ভেতরে ছিল ভঙ্গুর। শেষোক্ত যন্ত্রণামিশ্রিত কথাগুলো তার হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে। কী করে পারল সে এত বড়ো অন্যায় করতে! কারো সাথে ভালোবাসার অভিনয় করার আগে কখনো কেন ভাবে নি ওই মানুষটার মনের কথা! কেন সে মৃন্ময়ীর ব্যাপারে ভালো করে খোঁজ নেয় নি! মৃন্ময়ী তাকে ক্ষমা করে দিলেও সে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না।

ঊষা তার গুমোট চেহারা দেখে হাতটা স্পর্শ করল আলতো করে। স্মিত হেসে বলল,“ অনুশোচনা হচ্ছে? ”

প্রত্যয় তড়াক করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওর দিকে। পরক্ষনেই মাথা নত করে ফেলে। ঊষা হাতের পিঠের ওপর হাত ছুঁয়ে বলে,“ এই অনুশোচনা-ই তোমার জন্য শাস্তি ভাইয়া। এর থেকে বড়ো শাস্তি আর হয় না। মেয়েটা জীবনে কত কষ্ট পেল, তোমায় ভালোবেসে অবশিষ্ট সুখটুকুও হারিয়ে ফেলল। ইচ্ছে করে তোমায় ছেড়ে চলে যেতে কিন্তু মৃন্ময়ী আমাকে যাওয়ার সময় কী বলে গিয়েছে জানো? বলল, ভালোবাসার মানুষকে দূরে ঠেলে না দিয়ে কাছে রেখে ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে। সে এসেছিল বলেই হয়ত আমি তোমার থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্য কোথাও বিয়ে বসার চিন্তা করছিলাম। আর আমি অন্য কারো হওয়ার চিন্তা করতেই হয়ত তোমার আমার প্রতি ভালোবাসা উপলব্ধি হলো। কিন্তু সবদিক থেকে ভাগ্যের খেলায় মেয়েটাই ঠকে গেল। জ্বলল প্রেম উত্তাপে।
________________

গ্রামে বহুবছর পর এত বড়ো সালিশ বসল বাজারের কাছের বটগাছের তলায়। সালিশের কেন্দ্রবিন্দু রফিক আজম। রবিন দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পাশে। পুরোনো কাহিনির পৃষ্ঠা খোলা হলো পুনরায়। যেই কাহিনি ছিল অসমাপ্ত, তারই সমাপ্তি পাতা লেখা হবে আজ। প্রহর এসে উপস্থিত হলো সেখানে। রবিন নত মাথায় নিরু ও তার কাবিননামার কাগজটা রাখল সবার সামনে পাতানো টেবিলের ওপর।
চলবে।