প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব-৫৬

0
1020

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____৫৬

শান্ত নদীর বয়ে যাওয়ার মতো সময়ও যায় বয়ে, একটুও থমকায় না কারো ডাকে। থামার সাধ্য নেই তার,আর না মানবজাতির আছে তাকে থামানোর সাধ্যতা। তবুও তনুজার মনে হচ্ছে তার সময়টা থমকে গেছে, আটকে গেছে সে এই প্রাণহীন যান্ত্রিক শহরটায়। সহস্রবার চেয়ে চেয়েও আমেরিকা ফিরে যাবার সময়টা কোনোক্রমেই ধরা দিচ্ছে না তার মুঠোয়। নিজেকে আজকাল বড্ড অসহায় লাগে তার, মনে হয় কোনো এক রাজ্যের রাজপুত্রকে ভালোবাসার মহা অপ-রাধে রাজা তাকে শা-স্তিস্বরূপ কোনো এক নির্জন দ্বীপে জনমভরের জন্য নির্বাসন দিয়েছে। যন্ত্রণায় কাতর সে থেকে থেকে ছটফট করছে সেই দ্বীপ থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে, কিন্তু পারছে না। কি এক নিদারুণ,নি*ষ্ঠুর যাতনা! হৃদয়ে গেঁথে থাকা ভালোবাসাটা ছু””রি হয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। ক্লেশে,ব্যথায় চোখের কোল থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে তার,তবুও সেই বি**ষাক্ত ছু-রিটাকে বের করে ছুঁড়ে ফেলতে পারছে না।

ভালোবাসা,প্রেম এত সুন্দর একটা অনুভূতি, অথচ ধোঁয়া হয়ে ধরা দিল তনুজার জীবনে। যেই ধোঁয়াকে ছোঁয়া যায় না, আলিঙ্গন করা যায় না। শুধুমাত্র শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে ভিতরে টেনে নেওয়া যায়, ক্ষতিগ্রস্ত করা যায় ফুসফুস নামের অঙ্গটিকে। তনুজার শ্বাস নিতে ও নিঃশ্বাস ফেলতেও যন্ত্রণা হয়। ওর মনে হয়, এই শহরের বাতাসে, গাছে, আকাশে, রাস্তায়, অলিগলিতে মিশে আছে প্রহরের শরীরের ঘ্রাণ, ভালোবাসার ঘ্রাণ। শ্বাস নিলেই পরতে পরতে বৃদ্ধি পায় ভালোবাসাটা। যে ভালোবাসা ওর নয়,যে মানুষ ওর নয়,সেই ভালোবাসার কিশোরীর মতো দুরন্তপনা করে, লাফঝাপ করে বেড়ে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই। সে অধিকার ও দেয় নি। যতটুকু ভালোবেসেছে সেটা হৃদয়ের সংগোপনে অতি যতনে লুকিয়ে এই ধুলোমাখা, ভালোবাসার মানুষটার বসবাসের শহরটা ছাড়তে চায় ও চিরতরে।

তনুজা ভাবে,তার ভাগ্যটাই বোধহয় খারাপ। নতুবা ভালোবাসা সঠিক সময়ে কেন এলো না তার জীবনে? সঠিক মানুষের জন্য কেন জাগ্রত হলো না এই বুকে চিনচিনে ব্যথা সৃষ্ট করা এই ভালোবাসাটা? ভাগ্য নিষ্ঠুর খেল খেলে গেল ওর সাথে। ভালোবাসা জাগাল, হৃদয়ে অন্য কারো দখলে যেতে বাধা দিল না,আবার সেই হৃদয়ের অধিপতিকে পাওয়ার কোনো পথ খোলা রাখল না তার জন্য। এত এত ব্যথার মাঝে একটা অনুভূতি এটা ভাবিয়ে তাকে ভালো রাখে যে তার ভালোবাসার মানুষটা নিজের ভালোবাসাকে পেয়েছে। মেহরিন মজুমদার নিশাত গড়পড়তা এক বাঙালি মেয়ে, দেখতে অসাধারণ নয় বরং খুবই সাধারণ ও ছোট বয়সের একটা মেয়ে। কিন্তু এমপি প্রহর এজাযের চোখে সে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর মেয়ে, অসাধারণ ও তার হৃদয়েশ্বরী। তনুজার মতে,ওই অতি সাধারণ মেয়েটাই তার থেকে ভাগ্যবতী। সে তার জন্য সর্বদা বিছিয়ে রাখা ভালোবাসাটা বিনা পরিশ্রমে পেয়ে গিয়েছে, আর তনুজা? ভালোবেসেও পায় নি ভালোবাসা। ব্যাপারটা সাধারণ, অসাধারণ এর নয়। আসল কথা হলো,মনুষ্য হৃদয়ে রোপণ কারী বীজের চারায় ফোটা ফুলটাই সেই মানুষের কাছে বিশেষ ফুল মনে হয়, হাজারো ফুলের সৌন্দর্যও মুগ্ধ করতে পারে না তখন। প্রহরকে যেমন আধুনিকতা দিয়েও মুগ্ধ করতে পারে নি তনুজা,তেমনি তনুজাকেও আমেরিকার সুদর্শন কোনো পুরুষেরা বিমোহিত করতে পারে নি। তার মন জমিনে প্রেমের বীজ বপন করেছিল স্রেফ তুখোড় রাজনীতিবিদ, ত্যাড়া,বুদ্ধিমান , শ্যামবর্ণ চেহারার লম্বাটে পুরুষ প্রহর এজায। ভালোবাসা এমনই, সাধারণ-অসাধারণ কিচ্ছু চেনে না,কখন কার জন্য মনের অলিন্দে ঝলমলে রোদ্দুর নিয়ে হাজির হয় কেউ জানে না, যখন উষ্ণতায় হৃদয় পুড়তে শুরু করে তখুনি টনক নড়ে হৃদয়ের বন্দরে ভালোবাসার জাহাজটা হাজির হয়ে গেছে, চড়তে হবে এটায়,এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ভোরের স্নিগ্ধকর পরিবেশে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তনুজা যখন ভালোবাসার হিসেব-নিকাশ,মিল-মিলান্তি নিয়ে ব্যস্ত তখুনি তার মৃদু জলে ভেজা চোখ দুটি গিয়ে পড়ে গেটের দিকে। পৃথিবীতে এখনও আঁধারের অস্তিত্ব রয়েছে আবছা। এত ভোরে সমীরণের গাড়ি ঢুকতে দেখে ভাবনায় পড়ল সে। বিগত দিনগুলোতে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে ও সমীরণের মাঝে। সারাক্ষণ ঘরকুনো হয়ে থাকে, প্রায় বাজে স্বভাব ছেড়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক ব্যাপার, খাওয়া-দাওয়া কোনোকিছুর ঠিক নেই। ক্ষমতার দাপটে জ্বলজ্বল করা সেই উজ্জীবিত রূপটাও ধপ করে নিভে গেছে। মেয়েদের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার বিষয়টাও ময়লার মতো ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলেছে। কতকগুলো বিজ্ঞাপনের মডেল হবার জন্য প্রস্তাব নিয়ে ঘুরে গেছে অনেক ব্র্যান্ডের মালিক,কিন্তু সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছে আর কখনো মডেলিং করবে না বলে। এমনকি মডেলিং করবে না বলে ঘোষণাও দিয়ে ফেলেছে। সুন্দর,সুদর্শন চেহারা,দেহটাও চাপা ক্লেশে শুকিয়ে গেছে, মুখটা ফ্যাকাশে, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। এত,এত পরিবর্তন! ক্ষমতা, অহংকার, সফলতা, এক কথায় সর্ব সুখ বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে সে। ভালোবাসার অসুখ যে মানুষকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয় তনুজার কাছে তার অন্যতম উদাহরণ সমীরণ। ঊষাকে ভালোবাসার খবর কানে এসেছে তার। সবকিছু যে ঊষার জন্য জানে ও। প্রহর যেদিন বলেছিল দেশের ক্ষতি করতে ভীনদেশের কিছু সন্ত্রা–সের সাথে সমীরণের হাত আছে,সেদিন ঘৃ**ণায় আরও অত্যধিক বি**ষিয়ে উঠেছিল তনুজার মনটা। দেশদ্রোহী, ভাইয়ের খু–নীকে কিছুতেই আর সহ্য করতে পারছিল না। অথচ সময়ের কি দারুণ পরিবর্তন! আজ মায়া হচ্ছে ওই অসহায় লোকটার জন্য। তার হৃদয় অতটা পাথর নয়, শত হোক ওই লোকটাও তার আপন ভাই, তাই বলে যে ক্ষমা করে দেবে,সহানুভূতি দেখাবে তা নয়। শুধুই মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি মায়া জেগেছে তার মনে। ছোটবেলায় সমীরণ ও অন্তিম দুজনেই মাথায় করে রাখত ওকে, বোনই যেন ছিল ওদের চোখের মণি। অথচ বড়ো হয়ে মানুষ কত পরিবর্তন হয়ে যায়। বড়ো না হলে মন অবুঝ থেকে যেত, সমীরণ খারাপ হতো না,কারো মনে ভালোবাসা আসত না। বড়ো হওয়াটাই যেন অপ–রাধ মনে হলো তার।

সমীরণ গাড়ি থেকে নেমে বসে পড়ল ঘাসের বুকে হাঁটু ভেঙে। সে নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না। ক্ষমতা ও বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু লুটপাট করে নেওয়া সমীরণ আজ নির্বোধ, অসহায়। ভালোবাসা না পাবার যন্ত্রণায় তার দুই চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। শক্তিশালী পুরুষ হৃদয় না-কি কাঁদে না, সেই পুরুষ হৃদয়ও ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে লুটিয়ে পড়ছে কান্নায়। ভালোবাসার অনেক ক্ষমতা। ভালোবাসা অতি দুঃখ জর্জরিত হৃদয়ে খুশির জোয়ার নিয়ে আসতে পারে আবার সকল বিষয়ে ধৈর্যশীল ও শক্ত থাকা মানুষের চোখে এনে দিতে পারে জল। কেউ লড়াই করে জিততে পারে না ভালোবাসার সাথে, সবসময় পরাজিতই হতে হয়।
হয় সুখ পেয়ে নয় দুঃখ পেয়ে, এটাই ভালোবাসার নিয়ম।

সমীরণ ঘাসের বুকে ঢলে পড়ল। চোখ বুজতেই চোখের কোণা দিয়ে নামল জল। তার শরীরটা আর চলছে না। তনুজা দৌড়ে আসল নিচে। উদ্বিগ্ন হয়ে ডাকল,’ ভাইয়া!’

সমীরণ ঘাসের ওপর হাতের ভর দিয়ে উঠে বসল। চোখ দুটি টকটকে লাল হয়ে আছে। সেগুলো মেলল তনুজার পানে। সমীরণের অবস্থা দেখে তনুজার হৃদয় কাঁপলেও নিজের শক্ত খোলস ছেড়ে বের হলো না। কণ্ঠে কাঠিন্য রেখে প্রশ্ন করল,

‘ কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ? বাবা দেখলে কষ্ট পাবেন। তুমি যেমনই হও বাবা তো আর জানে না তোমার কুকীর্তি। ঘরে চলো। ‘
সমীরণ কাতর স্বরে বলল,’ তনু!’
‘ বলো,শুনছি। ‘
‘ তোর অভিশাপ লেগে গেছে তনু, আমি আমার শাস্তি পাচ্ছি। ‘
গাড়িতে মাথা ঠেকিয়ে কথাটা বলল সে। তনুজা বলল,
‘ এটা তোমার পাওয়ারই ছিল। আমি মুখে বললেও, এই অভিশাপ এক ভালোবাসার মানুষের অন্তর থেকে দেওয়া যার ভালোবাসা তুমি কেঁড়ে নিয়েছ। সেও ভালো নেই ভাইয়া, তুমি কী করে ভালো থাকবে? কারো সাথে অন্যায় করলে সেটার শাস্তি সেই মানুষটা না দিলেও, আল্লাহ একদিন ঠিকি বিচার করে। ‘
সমীরণ মাথা তুলে বসল। তার সাদা পাঞ্জাবির জায়গায় জায়গায় কাঁদা মাখা। চেহারা পাণ্ডুর। ভিতরকার ব্যথার ছাপ ভেসে ওঠেছে চেহারায় বিশদ। সে তার বুকটা খামচে ধরে বলল,
‘ আমার ভীষণ কষ্ট হয় তনু,খুব কষ্ট হয়। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়,খেতে কষ্ট হয়,ঘুম আসে না আমার। আমার পুরোটা শরীরে যন্ত্রণা হয়,বুকটা ব্যথা করে অনেক। ভালোবাসা কেন অসময়ে আসল রে তনু?’
‘ ঊষা তোমার নিয়তিতে নেই বলেই অসময়ে এসেছে। যে ভালোবাসা তোমার, ভালোবাসার মানুষটা তোমার তারা সঠিক সময়ে আসে,ভাগ্য তাদের মিলিয়ে দেয়। ‘

সমীরণ তনুর হাতটা নিয়ে বুকে চেপে ধরে বলে, ‘ দেখ তনু, এই…এই স্পন্দনগুলো ঊষার নাম জপে। এগুলো আর আমার রইল না তনু। আমি কিছু চাই না,এমপি,মডেল,সম্পত্তির মালিক কিছু হতে চাই না। আমি শুধু ঊষাকে চাই তনু,শুধু ঊষাকে চাই। আমার কষ্টগুলো ও বুঝে না কেন তনু?’
‘ ও বুঝবে না ভাইয়া। কারণ তুমি ওর ভালোবাসা নও। তুমি কি ওকে কষ্ট দিয়ে নিজের করে চাও?’
সমীরণ তনুজার হাতটা ছেড়ে দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ আমি ওর কোনো ক্ষতি চাই না। ওর কিছু হলে তো আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না। ও কষ্ট পাবে বলেই ওকে আমি ছিনিয়ে আনতে পারি না। পারি না ঊষাকে আমার করতে। আমার ঊষা আমাকে ঘৃণা করে। ওর চোখে আর আমি নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে চাই না। ‘
‘ ও তোমার ঊষা নয়,প্রত্যয়ের ঊষা। ‘
সমীরণ অস্থির হয়ে বলল,
‘ না,না ও আমার ঊষা৷ তুই এভাবে বলিস না। আমি তাকে না ছুঁতে পারি,তার ভালোবাসা না পাই,বাস্তবে সে আমার না হোক, তবুও সে আমার মনে আমার ঊষা হয়ে থাকবে সবসময়। কল্পনার জগতে ও শুধুই আমার, একান্তই আমার। ‘
পা–গলের মতো প্রলাপ করতে লাগল সমীরণ। তনুজার খারাপ লাগা শুরু হয়ে গেল,শক্ত হয়ে কথা বলতে পারল না আর এমন করুনদশা দেখে। চোখে শ্রাবণের বৃষ্টি নামে ওর। এর থেকে বড়ো শা-স্তি, সেকেন্ডে সেকেন্ডে যন্ত্রণায় কাতরানোর চেয়ে কঠিন শা-স্তি আর কী হতে পারে! এই তো অন্তিম ও মৃন্ময়ীর ভালোবাসাকে বিচ্ছেদ করার শা-স্তি পেয়ে কাতরাচ্ছে সমীরণ। কিন্তু ভাইয়ের এই মরণদশা মানতেও কষ্ট হচ্ছে তার। আসলেই মানব মন বড়ো বিচিত্র।
_______________________

প্রহর আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মাথা বাঁকিয়ে বার বার নিজের পিঠ দেখার চেষ্টা করছে। হাত পেছনে নিয়ে উন্মুক্ত পিঠে হাত বুলিয়ে জ্বলনের তীব্রতা টের পেয়ে চোখ মুখ খিঁচে দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে। চোয়াল কঠিন। নিশাত ওয়াশরুমের দরজার আড়াল থেকে মাথা বের করে এহেন দৃশ্য দেখে অস্থির ও ভীত হয়ে পড়ল। আজ ওর রক্ষে নেই নিশ্চয়। বুকের ভেতরটাও আকুলিবিকুলি করছে লজ্জায়। প্রহর চট করে ঘুরে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। স্পষ্ট-স্বচ্ছ দৃষ্টি। রাগ নেই চোখে। কিন্তু কণ্ঠ মাধ্যমে তাকে তেজের হল্কায় পুড়িয়ে আদেশ করল,
‘ উঁকিঝুঁকি মারছিস কেন? লুকিয়ে লুকিয়ে আমার খালি শরীর দেখছিস? আয়,সামনে এসে দেখ। দেখে যা জঙলির মতো আমার পিঠের কি হাল করেছিস। ‘
নিশাত শুকনো ঢোক গিলল। বলতে চাইল,
‘ এতে আমার কি দোষ? আমার তো নখগুলো জঙলির মতোন,আর আপনার যে দাঁতগুলো কোদালের থেকে কম না। ‘
মুখে বলতে পারল না,যদি এসে থাপ্পড় টাপ্পড় মে-রে দেয়? বিয়ে করলে কেউ পাল্টে যায় না। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা প্রহর,যে তাকে ছোটবেলা থেকে শাসন করে,মে-রে, ধমকে এতদূর এসেছে, এই লোকটাও একটুও পরিবর্তন হলো না। দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে বাচ্চাদের মতো গুটি গুটি পায়ে সামনে এসে দাঁড়ায় ও। প্রহর ওর দিকে পিঠ করে একটা এন্টিসেপটিক ঘাড়ের ওপর দিয়ে ধরে গুমোট স্বরে বলল,
‘ দেখ কী করেছিস তুই? এখন,মলম লাগিয়ে দে। ‘
নিশাত মিনমিন করে বলে, ‘ আমি!’
‘ তো কে? তুই কি ভাবছিস এসব তুই করিস নি? জিনে করেছে? ভাবতেই পারিস,তোদের আবার এসব ভাবার অভ্যাস আছে। একবার তোর বমির খবর শুনে মিষ্টি পাঠালাম, আর তোর চৌদ্দ গুষ্টি বানিয়ে দিল জিনে মিষ্টি পাঠিয়েছে। আরে গর্দভ জিনে কি চিরকুট লিখতে পারে? মিষ্টিগুলো কী করেছিলি?’
আয়নায় তীক্ষ্ণ নজর নিবদ্ধ করে জবাবের অপেক্ষায় রইল প্রহর। নিশাত ঈষৎ নত বদনে ভয় ভয় কণ্ঠে প্রতুত্তর করে,
‘ আব্বা ফেলে দিয়েছিলেন ওইগুলো। ‘
প্রহর আলোকের গতিতে পেছন ফিরল। লাল সিল্কের শাড়ির ওপরে হলুদ সূর্যমুখী ফুলের কাজ করা আবারও একটা হ্যান্ড পেইন্টেড শাড়ি পরেছে ও। ভেজা চুল লেপ্টে আছে গ্রীবাদেশে। জানালা দিয়ে ভোরের সোনালি আভা এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে হলদেটে বর্ণের বদনটায়। প্রহরের মনে হলো, এই ধরণীর সব মায়া হুটোপুটি করে এসে বসত গড়েছে এই মায়াবিনীর চেহারায়। সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে কোমরে আলতো করে জড়িয়ে ধরে টেনে নিল নিজের কাছে। গ্রীবাদেশে নাক ঘষতে ঘষতে ফিসফিস করে বলল,
‘ জানতাম, শ্বশুরজান এমন কিছুই করবে। আমার টাকার মায়া নেই তোদের কাছে। র–ক্ত পানি করে রাজনীতি করে এক এক পয়সা কামাই। সে টাকায় মিষ্টি কিনে পাঠালাম, আর তোর বাপ ফেলে দিল! তোর বাপের নাতি-নাতনী আসলে আমি এক টাকারও মিষ্টি পাঠাব না তোদের বাড়িতে। তোর বাপ আসবে মিষ্টি নিয়ে। ‘
গলায় গাঢ়ভাবে ঠোঁট ছুয়ে প্রহর কাঁধের চুল সরিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
‘ তোরও তো এখানে দাগ পড়ে আছে, দে মলমটা দে, লাগিয়ে দিই। ‘
এটা বলতেই নিশাত অপ্রতিভ হয়ে গেল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উলটো ঘুরে চলে যেতে নিলে তাড়াহুড়ায় শাড়িতে পা পেঁচিয়ে ধপাস করে পড়ল ফ্লোরে। আরক্তিম হয়ে উঠল গাল দুটো তীব্র লজ্জায়। জীবনে বার বার কেন ও এই লোকের সামনেই আছাড় খায়?
প্রহর হাঁটু ভেঙে ওর সামনে বসল। নত চিবুকে তর্জনী রেখে উপরে তুলল। তিরস্কার করে বলল,
‘ বরের কথা না শুনলে এমনই হবে। ছোটবেলা থেকে আমার কথার খেলাপি করিস বলেই বার বার আছাড় খাস। প্রমাণ পেয়েছিস তো?’
নিশাত চুপটি মেরে রইল। প্রহর বলিষ্ঠ হাতে ওর কোমল দেহটা তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে পায়ে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করে নরম গলায়,
‘ ব্যথা পেয়েছিস আমার তিলবতী? ‘
নিশাত মাথা নাড়ায়। ওষ্ঠযুগল আলগা করে উত্তর দেয়,
‘ একটুখানি। ‘

বউভাতের অনুষ্ঠান গ্রামে হবে না,হবে শহরে। সেকারণে আজকেই শহরে চলে যাবে স্মরণিকা নিবাসের সবাই। তার আগে নিশাত প্রহরের সাথে মজুমদার বাড়িতে এলো। সাথে শিমুলও এসেছে। আসার পরেই শিমুল ও নিশাত মিলেঝুলে একান্তে পেয়ে জেঁকে ধরল পিংকিকে। পিংকি ওদের দুজনের রাগান্বিত হাল দেখে ছাদের সিঁড়িঘরের দেয়ালের এক কোণে সেঁটে গেল। আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল,
‘ কী…কী হয়েছে? ‘
নিশাত কঠিন গলায় বলল,
‘ তুই আমায় ঔষধ দিয়েছিস ভালো কথা। কিন্তু ওইসব ব্যাপার অত কঠিনভাবে, ভয় দেখিয়ে কেন বললি? তোর জন্য আমার বাসর রাতটাই বাদ যাচ্ছিল। ‘
শিমুল নিশাতের কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে মিটিমিটি হাসছে। পিংকি হতভম্ব স্বরে বলল,
‘ আমি আসলে তোর ভালোর জন্য বলছিলাম। বুঝতে পারি নি,তুই অত ভয় পেয়ে যাবি। প্রহর ভাই, কারিমকে ধমকেছে আমার জন্য। এতে কারিম এসে আমায় ধমকেছে। আমাদের সম্পর্ক ভালো না হলেও আমি সত্যিই তোর ভালো চেয়ে বলছিলাম। ‘
নিশাত পিংকিকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বলল,
‘ আচ্ছা, শান্ত হো। তোর পেটে বাবু আছে, উত্তেজিত হোস না। যা,বাবুর জন্য মাফ করে দিলাম তোকে। ‘
শিমুল নিশাতকে টেনে এনে বলল,
‘ হয়েছে, ওকে আর জড়িয়ে ধরবি না৷ ‘
পিংকি অকস্মাৎ দুজনকে অবাক করে দিয়ে শিমুলকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ কারিম আমাকে বুঝিয়েছে,আমি নিজের কাজের জন্য দুঃখিত। সৌরভ ভাইয়ের সাথে ভুল করেছি আমি, তুই উনার সঠিক ভালোবাসা। ভালো থাকুক উনি তোর সাথে। ‘

নিশাতের ব্যাপক ভালো লাগল পিংকির এই পরিবর্তনে। হয়তো শীগ্রই মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করবে বলে বুঝ আসছে মেয়েটার মাঝে। পিংকির হাত দুজনে ধরে শাসনের সুরে বলে,
‘ এই শরীর নিয়ে একা একা ছাদে আসবি না। চল। ‘

নিশাত নিজের জরুরি কিছু নিতে ঘরে এলো। মেয়ের ঘরের দরজা থেকে গম্ভীর স্বরে ডাকলেন রফিক আজম,
‘ আম্মা!’
নিশাত পেছন ফিরে আব্বাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে গেল। প্রহরের সাথে বিয়ের পর আব্বা কথা বলে নি ওর সঙ্গে ভালো করে। তরতর করে বলল,
‘ আসেন আব্বা। ‘
‘ আজকেই চলে যাবে?’
‘ বিকালে রওনা দেব সবাই। আপনারা কি পরশু যাবেন?’
‘ হু, বউভাতের দিনই যামু। আপনি ভালা আছেন আম্মা?’
‘ আছি,আব্বা। আপনি এখনো আমার সাথে রাগ করে আছেন?’
‘ না। ছেলেটা একটু ত্যাড়া স্বভাবের হইলেও মানুষটা ভালো। আজ মনে হয় আপনে ভালোবাসছিলেন বলেই আমি আমার ভুলগুলো বুঝতে পারছি। প্রহরকে আপনি ভালো না বাসলে আমার ভুলগুলো কখনও বুঝতাম না। ওই ছেলেটা খাঁটি হীরা আম্মা। ‘
নিশাতের ওষ্ঠকোণে হাসির দেখা মিলল,তৃপ্তির হাসি। বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল পরম আদর মিশিয়ে। এক জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই নিশাতের। বাবা ও ফুপি,সে,ভাই সবাই এখন ভালো আছে, দুঃখগুলো পালিয়েছে লেজ গুটিয়ে, আর কোনো সুখ চাই না তার। এই সুখগুলো জীবনে থাকলেই চলবে।

তারপরের সময়টা কেটে গেল ঝড়ের বেগে। ঢাকাতে বউভাত হলো নিশাতের। বউভাতের পর আলতা ও উজ্জ্বল সাহেব চলে গেলেন গ্রামে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা কিছুটা দেরিতে হওয়াই রেজাল্টও বেরিয়েছে দেরিতে। শিমুল ও নিশাত দুজনেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। রেজাল্ট শুনে প্রহর দুপুরেই বাড়ি ফিরে এসে নিশাতকে বলল,
‘ শুনলাম তুই গোল্ডেনে প্লাস পেয়েছিস?’
নিশাত গ্লাস ভরতি পানি টেবিলে রেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, ‘ হুম। ‘
সে ভেবেছিল প্রহর খুশিমনে তার প্রশংসা করবে কিন্তু আশায় জল ঢেলে দিয়ে তার মনের আকাশের শুভ্র মেঘকে নিমিষেই কালো মেঘে রূপান্তর করে ফেলল। সোফায় ঘাড় হেলিয়ে বলল,
‘ তোর প্লাসটা কি স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা? এজন্য গোল্ডেনে প্লাস? আমি নিশ্চিত তুই এটা চু–রি করে পেয়েছিস। তোর পাশে, পেছনে, সামনে কার সিট ছিল? ওরা প্লাস পেয়েছে? ‘
নিশাত তখন বিরস মুখে জবাব দিল,’ পায় নি। ‘
‘ দেখলি, ওরা পেল না, ওদের খাতা থেকে লিখে তুই স্বর্ণে বাঁধাই করা প্লাসটা পেয়ে গেলি। মামুজানের র–ক্ত বলে কথা।’
বিয়ের মাস পেরিয়ে গেল,অথচ একটুও বদলাল না লোকটা। নিশাত একটুখানি সাহস সঞ্চয় করল,
‘ আমি নিজে সব লিখেছি। কারো থেকে দেখে লিখি নি। আপনি স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখেন, ভালো ছাত্রী ছিলাম আমি। ‘
প্রহর মাথা তুলে সোজা হয়ে বসল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে সামনে ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিশাতের দিকে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ মন্দ নয়, আমার সাথে থাকতে থাকতে একটুখানি সাহসী হয়েছিস জান। ‘

ঊষা ও প্রত্যয়ের ভালোবাসার প্রদীপটা আরও দ্বিগুণ তেজে জ্বলছে। দুজনে মিলে গড়ে ফেলেছে ভালোবাসার একটা রাজ্য। প্রত্যয় প্রতিদিন মেডিক্যাল কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় ওকে। সেও রাজনীতিতে বেশ মনোযোগ দিয়েছে। ঊষার সেমিস্টার প্রায় শেষের দিকে। হররোজ ক্লাস করতে হয়। একদিন মিস দিলেই বিরাট লস হয়ে যায়। সেজন্য ক্লাস মিস করে না। কিন্ত গত কয়েকটা মাস ধরে প্রতিদিন ক্লাস শেষে গেটের বাহিরে অদূরে সমীরণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও। লোকটার পরিবর্তন চোখে বিঁধেছে ওর। সেই সুদর্শন চেহারাটা ও সৌষ্ঠবপূর্ণ দেহটা আর নেই। রোগা হয়ে গেছে শরীর, চেহারায় সবসময় মলিন ভাব বিরাজ করে। দেখে মায়া হয় ওর, যেমনটা হয়ে থাকে মানবতার খাতিরে। এভাবে রোজ দাঁড়িয়ে ওর দিকে নিষ্পলক মিনিটের পর মিনিট চেয়ে থাকা ভালো লাগে না ঊষার। ফলপ্রসূ আজ সে বারণ করতে এগিয়ে গেলে বেশ খানিকটা দূরত্বে তাকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয় সমীরণ। গাড়ির সাথে হেলে দাঁড়িয়ে ছিল সে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ কাছে এসো না আর। ওখানেই থাকো। ‘
ঊষা অগ্নি চোখে তাকায়। প্রশ্ন করে,
‘ আপনি কেন আসেন প্রতিদিন? ‘
শ্লেষের হাসি হাসে সমীরণ৷ কণ্ঠে তার চাপা আর্তনাদ,
‘ তোমার কাছাকাছি যাবার সাধ্য নেই আমার, তাই তোমায় দূর থেকে দেখেই চোখের তৃষ্ণা মিটাই। ‘

#চলবে!