প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব-৫৭ এবং শেষ পর্ব

0
1271

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৫৭( সমাপ্তি অংশ-১)

আকাশের বুকে কালো কালো মেঘপুঞ্জদের ছড়াছড়ি। কিছু মেঘ একত্রিত হয়ে শ্রাবণ ধারা নিয়ে জরুরি সভা বসিয়েছে, আবার কিছু দলছুট মেঘ ছন্নছাড়া কিশোরের মতো বেপরোয়া হয়ে উড়ে চলেছে গন্তব্যহীন। নিসর্গে বইছে গা হিম করা শীতল প্রভঞ্জন, তাহার সাথে জীর্ণ ধরাধামে ঝরছে শ্রাবণের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। যান্ত্রিক শহরটায় অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে আজ। কোনো কোলাহল নেই, তাপ নেই, আছে কেবল শ্রাবণের সুখকর অদৃশ্য ছোঁয়া। নিশাত আরেকটু গা ঘেঁষে দাঁড়াল শিমুলের। একই ছাতার তলে জড়োসড়ো হয়ে বৃষ্টির স্পর্শ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলেছে দুজনে। ওদের নিতে ড্রাইভার আসে নি এখনো গাড়ি নিয়ে। অথচ কলেজ ছুটি হয়ে গেল প্রায় মিনিট বিশেক পেরিয়ে গেছে। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবার পর শিমুলকে এখানেই ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামে কলেজ নেই, সবেই না উন্নতির ছোঁয়া লাগল। কলেজ প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথাবার্তা চলছে। বন্ধ পড়লেই ওরা ছুটে যায় গ্রামের বাড়িতে। আবার ফিরে আসে ঢাকায়। এভাবেই চলে যাচ্ছে দিন,মাসগুলো। শিমুল চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠল,

” আমার মনে হয় ড্রাইভার কাকা জ্যামে ফেঁসে গেছেন। রিকশা করে চলে গেলে কেমন হয়?”
” এসে যদি আমাদের খুঁজেন? ”
প্রশ্নাত্মক বাক্য ভেসে এলো নিশাতের শঙ্কিত কণ্ঠ হতে। শিমুল জবাব দিল,
” তা-ও ঠিক। কলেজে মোবাইল এলাউ নয়। নাহলে একটা কল করা যেত। ”
” তোর কী মনে হয় জ্যামে আটকা পড়েছেন? কই এদিকটায় কত শান্ত, একটা রিকশাও নেই। ”
” আজ এই জায়গাটা ঠান্ডা বলে পুরো ঢাকা শহরে কি গরম থাকা নিষেধ আছে গাধী? বৃষ্টি হোক আর না হোক জ্যাম লেগেই থাকে। ”
” এখন অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। ”

” তুমি ভিজে যাচ্ছ নিশাত। এই ছাতাটা নাও। ”
পুরুষালি স্বর কর্ণকুহরে ধাক্কা খেতেই পানির স্পর্শে ভেজা চোখের পাপড়ি নেড়ে সম্মুখে তাকাল নিশাত। তার সামনে ছাতা ধরে আছে হ্যাংলা পাতলা শরীরের একজন মানুষ। ফর্সা মুখে মৃদু হাসি লেগে আছে। পরনে কলেজ ড্রেস। শিমুল অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে চেচিয়ে উঠল ছেলেটার ওপর,
” তোমাকে কতবার বলেছি ও বিবাহিত। কেন বিরক্ত করছ ওকে? ”
ছেলেটার নাম নিনাদ। ওদের সাথে পড়ে। কলেজের প্রথমদিন থেকেই বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে ওদের সাথে। শিমুল না করে দিয়েছে স্পষ্টভাবে। কিন্তু ছেলেটা নাছোড়বান্দা। একটা সময় তো নিশাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েই বসে। ক্লাসের কেউই বিশ্বাস করতে চায় না সে যে বিবাহিত। বললে,বলে মজা করছে। ঠাট্টার সুরে বলে বেড়ায়, প্রেম করবে না ভালো কথা, মিথ্যা মিথ্যা বিবাহিত বলার কি দরকার! তখন আর সত্য প্রমাণ করতে ইচ্ছে করে না নিশাতের। অভিমান হয় প্রহরের ওপর। কি পরিচয় দিয়েছে ওর যে বেশিরভাগ মানুষই জানে না সে এমপি প্রহর এজাযের বউ! বিয়ে করেও ব্যাচেলর সেজে থাকা হচ্ছে। ওদের ক্লাসের মেয়েগুলোও বলাবলি করে এমপি প্রহর এজাযের মতো একটা বর হলে মন্দ হয় না, রাজনীতিবিদ এত সুদর্শন হয়! শ্যামলা বর্ণ হওয়াই লোকটা বেশিই সুন্দর, বয়সের পার্থক্য থাকলেও এমপি প্রহর এজায ওদের প্রপোজ করলে এক্ষুনি রাজি হয়ে যাবে। এসব শুনতে একটুও ভালো লাগে না ওর। কলেজ শুরু হবার বেশিদিন হয় নি, তাই তার ও শিমুলের তেমন কারো সাথে পরিচয় হয়ে ওঠে নি। নিজেদের পরিচয়ও খোলাসা করে দেওয়া হয় নি কাউকে।
নিনাদ শিমুলের দিকে চেয়ে বলল,
” তোমার কী সমস্যা? মিথ্যে কেন বলো বার বার? ”
শিমুল রেগেমেগে বলল,
” মিথ্যা কেন বলব আমি? ও আমার বড়ো ভাইয়ার বউ। ভাইয়াকে তোমার ভালোর জন্যই কিছু বলছি না। ”
নিনাদ মজা পেয়েছে এমন করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বলল,
” তোমার ভাই কি আমার হাড়গোড় ভেঙে দেবে?”
” অবশ্যই দেবে। তুমি আমাদের পরিচয় ভালো করে জানো না। দুইদিনের আবেগে মজনু হয়ে গেছ। তুমি যার পেছনে দুইদিনের মজনু হয়েছ, তার জন্য আমার ভাই বছরখানেক ধরে উম্মাদ। ”
ছেলেটা এবার একটুখানি সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করল,
” তোমার ভাইয়ের নাম কী?”
” প্রহর এজায। ”
” এমপি প্রহর এজায? ”
সন্দিহান গলায় ফের প্রশ্ন করল নিশ্চিত হবার জন্য। তখন শিমুল উত্তর দিল এক শব্দে ভীষণ গর্বিত স্বরে,
” হ্যাঁ। ”
শূন্য, বৃষ্টিস্নাত পথে তড়তড় করে এসে থামল দুইটা গাড়ি। পেছনের কালো গাড়ি থেকে নামল হাতে বন্দুক নিয়ে কয়েকজন গার্ডস। সামনের সাদা গাড়ি থেকে প্রহর নামল। একজন গার্ডস দৌড়ে এসে ছাতা ধরল তার মাথার উপর। তবুও বৃষ্টিতে ভিজে গেছে শরীরের অনেকখানি অংশ। শ্বেতশুভ্র পাঞ্জাবির হাতা গোটানো কনুই অব্দি। হাতের লোমশগুলো বৃষ্টির স্পর্শে হার মেনে লেপ্টে আছে। নিশাত আড়চোখে সবটা লক্ষ্য করল। প্রহর ওদের দিকে এগিয়ে এসে গুমোট স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? ”
শিমুল রাগান্বিত চোখে তাকাল নিনাদের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” তোমার বউ যে নিশাত সেটা এই মজনু সাহেবের বিশ্বাস হচ্ছে না ভাইয়া। তোমার বউকে প্রেম প্রস্তাব দিচ্ছে। ”
প্রহর নিনাদের কাঁধ জড়িয়ে বলল,
” অনেক সাধনার পর বউকে পেয়েছি ভাই। বউয়ের মনে নিজের জন্য প্রেমের ফুল ফোঁটার অপেক্ষা করেছি, মামুজানকে শ্বশুরজান বানিয়েছি, তারপর শ্বশুরজানের মনে নিজের জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করে বউকে আমি পেয়েছি। আমার এত সাধনার ফলাফলে আর চোখ দিও না। সাদা পাঞ্জাবি পরে আছি বলে ভদ্র মনে হতে পারে। আসলে আমি প্রচন্ড অভদ্র, আর নিশুর বেলায় একেবারেই ত্যাড়া। ”
নিনাদ কেঁপে উঠল ঠান্ডা হুম–কিতে। সে ভেবেছিল শিমুল ওর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে নিশাতকে বার বার বিবাহিত বলে পরিচয় দিচ্ছিল। কিন্তু এখন প্রমাণ পেল সব সত্য। আবেগকে ভালোবাসা বলে অভিহিত করে ক্ষণিকের ভালো লাগায় নিশাতের পিছু নিয়ে ফেঁ*সে গেল এখন। আমতা আমতা করে বলে উঠল,
” আর এমন হবে না স্যার। ”
” গুড। সবাইকে বলে দেবে কলেজে, মেহরিন মজুমদার নিশাত তোমাদের ভাবি। ”
” আচ্ছা। ”
ছেলেটাকে ছাড়তেই এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল। প্রহর গার্ড থেকে ছাতা নিজের হাতে নিয়ে নিশাতের সামনে এসে দাঁড়াল। শিমুলকে বলল,
” গাড়িতে গিয়ে বোস। গাড়ি মাঝপথে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ড্রাইভার আসতে পারে নি। ”
” আচ্ছা ভাইয়া। ”
নিশাত তিল পরিমাণ নড়ল না। অভিমানে নিশ্চুপ হয়ে আছে ও। প্রহর হাত শক্ত করে টেনে ধরে নিজের ছাতার নিচে নিয়ে আসল তাকে। রাগ মিশ্রিত সুরে তেতে উঠল,
” তোকে আলাদা করে বলতে হবে?”
নিশাত নরম চোখে একবার চেয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। ততক্ষণে শিমুল গাড়িতে গিয়ে বসেছে। নত বদনে উঁচু কণ্ঠে বলে,
” আমি রিকশা দিয়ে যাব। আপনার সাথে যাব না। ”
” কেন? আমার সাথে যাবি না কেন?”
” আপনার সাথে কেন যাব? আপনি তো আমায় মানুষের কাছে বউ পরিচয় দিতে লজ্জা পান। ”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল প্রহর। ফ্যাকাসে মুখশ্রী পানে চাহনি নিবদ্ধ করে বলে,
” তোকে বউ পরিচয় দেওয়ার জন্য কত কি করলাম, তুই বলিস আমি লজ্জা পাই? আমার লজ্জা নেই। লজ্জা তোকে ভালোবাসার সময়ই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। আমি আমার বিয়ের কথা সবাইকে বলেছি। তোর কলেজের মানুষ না জানলে আমার দোষ? বল,আমার দোষ?”
গলায় ক্রোধ এসে জমল প্রহরের। নিশাত ভয় পেয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,
” না,আপনার দোষ নেই। এখন চলেন। ”
” না। তোর অভিমান না ভাঙিয়ে কোথাও যাব না আমি। প্রয়োজনে হরতাল ডাকব,অনশন করব। ”
নিশাতের মনে হলো সে একটু অভিমান করেও ফ্যাসাদে পড়ে গেল।
” আমার কোনো অভিমান নেই। ”
” তাহলে আমায় চুমু খেয়ে প্রমাণ করে দে। ”
নিশাত বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে গেল। কী বলছে লোকটা এই রাস্তায়! কণ্ঠ খাদে নামিয়ে উচ্চারণ করে,
” এটা রাস্তা। ”
প্রহর একাগ্রচিত্তে চেয়ে বলল,
” সমস্যা নেই। আমি ছাতা দিয়ে আমাদের মুখ ঢেকে ফেলব। তুই টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিবি আমার গালে। কেউ দেখবে না। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে এই জনমানবহীন রাস্তায়,সুন্দর আবহাওয়াই আমার তিলবতী আমায় একটা চুমু খাক। ”
অসহায় চোখে তাকাল নিশাত। এই লোক চাইছে মানে দিতেই হবে। তাই বলে এই রাস্তায় কখনোই পারবে না সে। প্রহর গার্ডসদের গাড়ি নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে বলল। কথামতো দুইটা গাড়িই ধীরে ধীরে অনেকখানিই সামনে এগিয়ে গিয়ে থামল। শিমুল গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে একবার দেখে নিল ভাই ও ভাবিকে। তৎপরে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে সৌরভের কথা ভাবতে লাগল।

” নে, সব দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি। ”
নিশাত আশপাশে চাইল কয়েক বার। বৃষ্টি হওয়াই মানুষ চোখে পড়ছে না তেমন। প্রহর ওর আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল ঢুকিয়ে নিজের গা ঘেঁষে দাঁড় করাল। খানিক সময় ভেবে বলল,
” রিকশা ডাকি নিশু। আমরা বরং রিকশায় যাব আজ। তোর জন্য একটু সুবিধা করে দিলাম। ”
রাস্তার অপর পাশের এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাকে হাত নেড়ে ডাকল প্রহর। মিনিটের মাথায় রিকশা সমেত এপাশে এসে থামলেন। প্রহরকে চিনতে পেরে বিনয়ের সুরে বললেন,
” কই যাইবেন এমপি সাহেব?”
” আপনি যেদিকে নিয়ে যাবেন। এক কাজ করুন রমনা পার্ক নিয়ে চলুন আমাদের। দেশের সেবা করতে করতে বউ নিয়ে ঘুরাঘুরি হয় না। পরিবেশ শীতল হলেও আমার বেগমের মেজাজ গরম। মেজাজ ঠান্ডা করতে হবে। ”

বৃদ্ধ লোক হেসে দিলেন। প্রহরের গুণাগুণ ইতোমধ্যে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। একজন এমপি হিসেবে খুবই পছন্দের হয়ে উঠেছে সবার কাছে। তা নিয়ে বিপরীত দলের লোকেদের হিংসা-ত্মক মনোভাব বেড়েই চলেছে। অগোচরে তার ক্ষতি করার জন্য মুখিয়ে আছে কিছু কিছু ষড়–যন্ত্রকারী। তাই একান্তে বাহিরে কোথাও সময় দিতে পারছে না নিশাতকে। সর্বদা সাথে নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতদিন! তার নিজেরও ইচ্ছে করে মেয়েটাকে নিয়ে কোনো নির্জন জায়গায় একাকী সময় কাটানোর,যেখানে তাদের ওপর কেউ নজর রাখবে না। তাই আজ একটুখানি ঝুঁকি নিয়েই নিচ্ছে।
নিশাত প্রশ্নবিদ্ধ চাউনি মেলে ধরে,” শিমুল?”
” আমি বলে দিচ্ছি। ড্রাইভার আর গার্ডস ওকে নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। তুই ওঠে বোস। ”
নিশাত খুশি হলো বেশ। বিয়ের পর তাদের একদমই কোথাও যাওয়া হয় নি। তারও কিশোরী মনটা প্রিয়তমের হাত ধরে হাঁটতে চায়, সময় কাটাতে চায়,ঘুরতে চায়। কিন্তু লজ্জা ও ভয়ে বলতে পারে না প্রহরকে।
প্রহর গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল গার্ডসদের বলার জন্য। একজন গার্ডস মাথা নুইয়ে বলল,
” ক্ষমা করবেন স্যার। বড়ো স্যার বললেন বাহিরে সবসময় আপনার সাথে থাকতে। ”
” তোমরা আমার রক্ষক না-কি বড়ো স্যারের?”
” আপনার। ”
” আমার এখন তোমাদের প্রয়োজন নেই। শিমুলকে নিরাপত্তা দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাও। ”
রোষপূর্ণ কণ্ঠে বলল প্রহর। তার আদেশ মেনে নিয়ে দুটো গাড়িই স্টার্ট দেওয়া হলো। নিশাত এখনও ওঠে নি রিকশায়। রিকশাওয়ালা বৃদ্ধ লোক রিকশা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। অকস্মাৎ চোখ-মুখ বিকৃত করে বুকে হাত দিয়ে পথে ঢলে পড়লেন তিনি। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো লাল বর্ণের র–ক্ত। নিশাতের সমস্ত কায়া ঝিমঝিম করে উঠল। ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল ও। প্রহর দৌড়ে এসে জড়িয়ে নিল বুকের মাঝে। কিছু বুঝে উঠার আগে একের পর এক মুখে কালো কাপড় বাঁধা লোক বন্দুক হাতে দৌড়ে এসে ঘিরে ফেলল ওদের। লোকগুলোর চোখ ব্যতীত কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রহর বুঝল, তাকে মা**রার জন্য ঘিরে ধরা হয়েছে। মাত্র পাওয়া সুযোগ লুফে নিয়েছে আড়ালে থাকা শত্রু–দের দল। সে অস্থির হয়ে পড়ল নিশাতকে নিয়ে,
” নিশু,চোখ খোল। এসব র**ক্ত ভয় পাওয়ার জিনিস না। ভয় কেন পাস তুই বেক্কল? চোখ খোল। ”
নিশাত বহু কষ্টে চোখ খোলা রেখে বলল,
” আপনাকে মে-রে ফেলবে। আপনি পালিয়ে যান৷ ”
” কিচ্ছু করতে পারবে না আমাকে। ”
প্রহর নির্ভয় কণ্ঠে বলল। রাস্তায় মানুষজন যা ছিল সবাই পালিয়েছে। প্রকাশ্যে হঠাৎ হাম–লায় নিজের জীবনের চিন্তা করে পালিয়েছে সকলে। আকস্মিক একজন লোক প্রহরের মাথায় বন্দু**ক ঠেকিয়ে বলল,
” আপনাকে মা**রার হুকুম করা হয়েছে এমপি সাহেব।”
নিশাত কম্পনরত হাতে জাপটে ধরল প্রহরকে। কথা বলার শক্তি নেই তার। চেয়েও মুখ দিয়ে কিছু বের হচ্ছে না। শিমুল জানালা দিয়ে মাথা বের করে দূরের এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বলে। গার্ডরা দূর থেকেই ব**ন্দুক চালায়। শিমুল দৌড়ে আসে ভাইয়ের কাছে। গোলাগু**লি বেঁধে যায় দুইদলে। একের পর এক লা–শ পড়তে থাকে রাস্তায়। নিশাতের শরীর কাঁপছে অনবরত। প্রহর কোলে তোলে নেয় তাকে। শিমুলকে নিয়ে পা বাড়ায় গাড়ির দিকে। ধমকে ওঠে,
” গাড়ি থেকে নেমেছিস কেন? নিশাতকে নিয়ে গাড়িতে বোস। ”
শিমুল ও নিশাতকে গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভারকে বলল,
” বাড়ি নিয়ে যান ওদের। ”
নিশাত প্রহরের ডান হাতটা দুই হাতে আঁকড়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। অনুরোধ করে বলল,
” আপনাকে ছাড়া যাব না আমি। আপনি চলুন। ”
” গার্ডরা কি মানুষ না? ওদের ফেলে কীভাবে যাব? তুই যা, আমি জলদিই আসব। ”
নিশাতের হাত নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে দুই হাত চোখের সামনে মেলে আঁজলায় ঠোঁট ছুয়ে দিল প্রহর। গাড়ি থেকে লাইসেন্স করা পিস্ত–লটা নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে। এভাবে সব ফেলে পালাতে পারবে না সে। পুলিশে কল দিয়েছে। ট্রিগার চেপে একের পর এক গু-লি চালাতে লাগল সে। সেকেন্ডে শ্বেত পাঞ্জাবিতে এসে পড়তে লাগল র–ক্তের ছোপ ছোপ দাগ।
শিমুলকে ছাড়িয়ে নিশাত চিল্লিয়ে ডাকল প্রহরকে,
” কখন আসবেন আপনি? কথা দিন আমাকে,আপনার এই দেশপ্রেম শেষ হলে ফিরে আসবেন। ”
প্রহর বন্দুক চালানো থামিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে হেসে বলল,
” আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না নিশু। অবশ্যই ফিরে যাব আমি তোর কাছে। ”
শিমুল টেনে নিশাতকে গাড়িতে এনে বসাল। ভাইকে ভয়ংকর এই পরিস্থিতিতে ফেলে তারও যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু ভাই ওর কথা শুনবে না আর নিশাতের কিছু হলে বেঁচে থেকেও জীবন্মৃত হয়ে থাকবে। সে নিশাতকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” ভাইয়া এসব অনেকবার হ্যান্ডেল করেছে। তুই টেনশন করিস না। রাজনীতিতে এসব হট্টগোল হয়। ”
নিশাত ভীতসন্ত্রস্ত স্বরে বলল,
” আমার ভয় লাগছে শিমুল। অনেক ভয় করছে। ”
বলেই জ্ঞান হারাল সে। ড্রাইভার থেকে মোবাইল নিয়ে প্রত্যয়কে কল দিল শিমুল। তারও ভয় লাগছে। হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল!

সমীরণের ঘরে এসে তার গলায় ছু—রি চেপে ধরল তনুজা। ভাইয়ের প্রতি সব মায়া ভুলে গেল সে। সমীরণ ওকে আটকাতে ছু–রি টেনে নিয়ে ফেলল মেঝেতে। রাগে ফুঁসতে থাকা তনুজার হাত ধরে ভড়কে যাওয়া কণ্ঠে জানতে চাইল,

” কী হয়েছে তনু? কী করেছি আমি?”
” কী করো নি তুমি? হা–মলা করিয়েছ নেতাসাহেবের ওপর। কেন এমন করলে তুমি? উনার নিঃশ্বাস বন্ধ হলে আমি তোমাকে শেষ করে দিব। এবার আর ছাড় দিব না তোমাকে। ”
এলোমেলো,ক্ষিপ্র কণ্ঠে বলতে লাগল তনুজা।
সমীরণ হতভম্ব,” আমি প্রহরের ওপর কোনো হা-মলা চালাই নি তনু। একটা সময় ওর খারাপ চাইলেও এখন আর কিছুই চাই না আমি। এসব এমপি হবার ইচ্ছেও আমার ম**রে গেছে। বিশ্বাস কর,আমি করি নি কিছু। ”
” তুমি করাও নি? কে করিয়েছে? ”
” বুঝতে পারছি না। প্রহর ঠিক আছে? ”
” ঠিক নেই, একদম ঠিক নেই। রাজনীতি এত খারাপ কেন? এটার সুফলের চেয়ে ক্ষতিকারক দিক বেশি কেন? দেশের মানুষের জীবন রক্ষা করতে প্রতি পদে নিজের জীবনের বাজি কেন রাখতে হয়? ভালো নেই উনি ভাইয়া। ”
কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ল তনুজা। সমীরণ অগোছালোভাবেই উদভ্রান্তের ন্যায় বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

#চলবে~

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকা: আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৫৭( সমাপ্তি অংশ-২)

সমস্ত শহর ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় বাতাসের বেগে গুঞ্জরন পড়ে যায় এমপি প্রহর এজাযের ওপর হওয়া অকস্মাৎ আক্র**মণের সংবাদ। হাসপাতালের বাহিরে আষাঢ়ের ঢলের মতো হৈ চৈ করে হাজির হয় দলের সদস্যগণ, মিডিয়ার লোকজন। প্রহরের খবরাখবর জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষায় সকলে। সমীরণ হন্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে ছুটে যেতে চায় হাসপাতালের ভিতর। কিন্তু মিডিয়ার লোকজন মৌমাছির মতো ঘিরে ধরে তাকে। সবার একটা প্রশ্ন, ‘ হাম**লার পেছনে আপনার হাত আছে কি সমীরণ? ‘

প্রহরের বুকের একটুখানি উপরে গু**লি লেগেছে। অবস্থা নাজেহাল। নিঃশ্বাস প্রায় চিরতরে ছেড়ে যাবার হাল। ডাক্তার সঠিকভাবে এখনও কিছু জানান নি। হাম-লা চলাকালীন সেখানে মিডিয়া ও পুলিশের লোক হাজির হয়েছিল। ততক্ষণে সফেদ পাঞ্জাবি পরিহিত পুরুষের বুক লেপ্টে গিয়েছিল লালচে তরল র**ক্তে। বৃদ্ধ রিকশাচালক গুলিবিদ্ধ হবার সাথে সাথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ছেড়েছেন এ দুনিয়া। সাথে মৃ–ত্যু হয়েছে হাম**লাকারী ও নিরাপত্তাকারীদের মধ্যে অনেকেরই। গুলিবিদ্ধ প্রহরের বুকে হাত দিয়ে হাঁটু ভেঙে রাস্তায় বসে যাওয়ার দৃশ্যখানি বন্দি হয় ক্যামেরায়,সেটা সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। দৃশ্যটুকু দেখে শান্ত থাকতে পারছে না কেউ। প্রহরের দলের লোক,আত্মীয়-স্বজন সবাই পাগ**লের মতো ছুটে এসেছেন হাসপাতালে। কিন্তু এত লোক প্রবেশের অনুমতি নেই বলে বাহিরেই ভালো সংবাদ শোনার অপেক্ষা করছে সবাই। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে কে ছিল এই হাম””লার পেছনে। ধারণা করা হয় বাহিরের দেশ থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এই হাম–লাকারীদের আনা হয়, সাথে কিছু বাংলাদেশীও আছে। কালো কাপড় উন্মুক্ত করার পর কিছু জনের চেহারা দেখেই ধারণা করা হয় অন্য দেশের তারা।

সমীরণ অবিন্যস্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। এই মুহূর্তে জবাব দেবার অবস্থায় নেই সে। তার দ্বারা অনেক বড়ো অন্যা*য় হয়ে গেছে। সে খবর পেয়েছে আজকের হাম**লাটা তারই দলের কিছু সদস্য করিয়েছে। মূলত এই প্ল্যানটা তারই করা ছিল বহু মাস খানেক পূর্বে। প্রহর এমপি পদে বসার সঙ্গে সঙ্গে রাগে-আক্রোশে তাকে মা*রার প্ল্যানটা সে দলের কিছু সদস্যের সাথে মিলেঝুলে করে। প্ল্যান মোতাবেক সুযোগ পেলেই আক্র-মণ করার অনুমতি ছিল মাসের পর মাস ধরে। সেটার কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল সে। ঊষার প্রতি ভালোবাসা তাকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটাত না,কোনো কর্মে অংশগ্রহণ করত না,দলের লোকের সাথেও যোগাযোগ করত না তেমন। মাথায় ও হৃদয়ে কেবল প্রেম নামক অনুভূতিটা চেপে থাকে সারাক্ষণ। বুকের চিনচিনে ব্যথা নিয়ে কাটে একেকটা সেকেন্ড। অত-শত যন্ত্রণার ভিড়ে সে ভুলে বসেছিল সেই প্ল্যানের কথা,যা তার দেওয়া পূর্বের আদেশ অনুযায়ী কার্যকর করে ফেলে তারই দলের লোকেরা। সে এখন এসব সম্পর্কে অবগত না থাকলেও নিজেকে দোষী মানছে সম্পূর্ণভাবে। প্রহরের কিছু হয়ে গেলে কীভাবে মুখ দেখাবে সে তনুজাকে? আর ঊষা? ঊষা সারাজীবনই ঘৃ-ণা করবে তাকে। ঊষাকে তার পাওয়া না-ই হলো, কিন্তু তার ঘৃ-ণা নিয়ে বাঁচতে পারবে না একটুও।

পুলিশের সহায়তায় সবার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে হাসপাতালের ভিতর ঢুকল। করিডোরে দেখতে পেল নির্জীব হয়ে এক বিষাদিনী তার বিশ্বাসযোগ্য পুরুষের বক্ষঃস্থলে মাথা রেখে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। ব্যথায় আর্তনাদ শুরু করল সমীরণের অভ্যন্তর সেই বিষাদিনীর ভরসার আশ্রয়স্থল হতে না পেরে। বোলতার হূল ফোটানোর যন্ত্রণা তরতর করে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল। তাকে দেখে ঊষা প্রত্যয়ের বুক থেকে মাথা তুলে তেড়েফুঁড়ে এলো। অসহায় চোখে পলকহীন তাকিয়ে রইল সমীরণ ওর পানে। মেয়েটার চোখ থেকে হওয়া জলের বর্ষণ মেনে নিতে পারছে না ও। ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে সেই অবাধ্য অশ্রু বিন্দু মুছে দিতে, কিন্তু এই অধিকার সে পায় নি। প্রত্যয় পাশে দাঁড়িয়ে ক্রুর হতে ক্রুরতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ তুই এখানে কেন এসেছিস? আমার ভাই বেঁচে আছে না-কি ম–রে গেছে দেখতে? হা*মলা করিয়েও শান্তি হোস নি?’
সমীরণ ঊষার মুখশ্রী থেকে চোখ সরিয়ে প্রত্যয়ের দিকে চেয়ে নরম গলায় বলল,
‘ আমি প্রহরের কোনো ক্ষতি করতে চাই নি। যেই রাজনীতির পথই আমি ছেড়ে দিয়েছি, তাকে কেন্দ্র করে তোদের কেন মা–রতে যাব? তবে আমি বলছি না যে আমার দোষ নেই। আমার দোষ আমি অকপটে স্বীকার করতে রাজি। বিশ্বাস কর, প্রহরের ওপর হওয়া আজকের হাম**লা আমি করাই নি। ‘
ঊষা আগ্নেয়গিরির ন্যায় জ্বলে উঠল,
‘ আর কত নিজের পাপ ঢাকবেন আপনি,সমীরণ? আপনি পাপী,হ**হত্যাকারী। নিজের বড়ো ভাইয়ের হ–ত্যা করেছেন আপনি। আমার ভাইকেও মা–রতে চেয়েছেন। নিকৃষ্ট আপনি। ক্ষমতার জন্য কেউ এত অস-ভ্য, জানো**য়ার হতে পারে! মানুষ না আপনি, আপনি অমানুষ,নরপ–শু। আল্লাহকে ভয় করুন এবার, নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুন। মেয়েটার বয়স কত কম, জ্ঞান হারিয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছে হসপিটালের বেডে। ভাইয়ার কিছু হয়ে গেলে কী হবে তার? আর কতগুলো জীবন নষ্ট করবেন? ‘

কথাগুলো বলতে বলতে ঊষা নিজের শরীরের শক্তি হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে তাকে আকড়ে ধরার জন্য এগিয়ে এলো সমীরণ। তার আগেই প্রত্যয় আগলে নিল মেয়েটাকে বুকের মাঝে। সমীরণ গুটিয়ে নিল নিজের হাত দু’টি। পাথরের মতো কঠিন হৃদয়টা যাতনায় আর্তচিৎকার করছে। কত মানুষের সাথে অন্যায় করেছে, তখন কেন এই হৃদয়টা কাঁপে নি তার? কাঁপলে হয়তো অন্যায়গুলো করতে বিবেকে বাধত তার। শেলের মতো বিঁধল ঊষার উচ্চারিত একেকটা শব্দগুচ্ছ তার বুকে। কত-শত বার নিকৃষ্ট, অসভ্য এই শব্দগুলো শুনে এসেছে সে,অবহেলায় তুচ্ছও করেছে। কিন্তু মনের কুঠুরিতে বসবাস করা মেয়েটা, তাকে ওলোটপালোট করে দেওয়া মেয়েটার মুখে আজ এই শব্দগুলো শুনে ভিতরে ভিতরে দমবন্ধ হয়ে আসছে তার। সত্যিই তো সে পাপী। কীভাবে করবে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত? কম কি করছে? এ জীবন তার অপ্রিয় হয়ে গেছে ঊষা নেই বলে জীবনে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে আসে প্রতিক্ষণে। জীবন অপ্রিয় হয়ে গেলে মানুষের দেহটাই বেঁচে থাকে, মন বেঁচে থাকে না। বেহায়া মনটা তো অপরিমেয় যন্ত্রণা সইয়ে সইয়ে একটা সময় ম*রেই যায়। তবুও ঊষার দৃষ্টিতে কী করলে মনে হবে সে তার পাপের শা*স্তি পাচ্ছে? এই এক জীবনে ঊষার জন্য সব করতে পারবে সে, নিজেকে তিলে তিলে ধ্বংসও করতে পারবে। যা করলে এই দুনিয়ার চোখে, তার প্রাণেশ্বরীর চোখে পা-পের শা””স্তি মনে হবে সেটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে। পা চালিয়ে ছুটে হাসপাতালের বাহিরে আসল। মিডিয়ার লোককে ডেকে ঠোঁটের কোণে কপটতাহীন বিষাদের হাসি ফুটিয়ে নিজের পাপের অধ্যায় মেলে ধরল দেশের কাছে,দেশের মানুষের কাছে,

‘ এমপি প্রহর এজাযের ওপর হাম**লায় আমি সরাসরি দোষী না হলেও শামিল রয়েছি। এই প্ল্যানটা আজ থেকে পাঁচ মাস আগে আমি করেছিলাম নিজের দলের কিছু লোক নিয়ে। বাহিরের দেশ এবং নিজের দেশ থেকে টাকার বিনিময়ে হ**ত্যা করতে দক্ষ এমন সন্ত্রা–স ঠিক করে রাখা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল সুযোগ মিললেই প্রহরকে মে**রে এমপি পদ নিজের দখলে নেওয়া। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় একটা সময় আমি রাজনীতি ছেড়ে দিই,তবে নিজের করে রাখা সেই প্ল্যান ভুলে যাই আমি। আমায় আর না জানিয়েই আজ এমপি সাহেবের ওপর হামলা চালায় দলের লোকেরা। আমি তাদের নাম বলে দেব। তাদের জলদি আইনের আওতায় নেওয়ার জন্য অনুরোধ করব, নয়তো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। ক্ষমতার লোভে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আপনজনের মায়া,ভালোবাসা সব শেষ হয়ে গিয়েছিল আমার ভিতর থেকে, দিনকে দিন হিং**স্র হয়ে উঠেছিলাম আমি। কিন্তু আল্লাহর মর্জি বোধহয় অন্য কিছুই ছিল। ক্ষমতার লোভে র–ক্তের ভাইকে খু**ন করা আমি আজ সেই ক্ষমতাকে,রাজনীতিকেই ঘৃ”ণা করি। আমি খু–নি, আমাকে এখুনি গ্রেফতার করার অনুরোধ করব। ‘

সাথে সাথে প্রহরের দলের লোক ইট-পাথর ছুঁড়ে মার**তে শুরু করে সমীরণের ওপর। ক্ষোভ ফেটে পড়ে সবাই। পুলিশ ভিড় ঠেলে সমীরণকে জিপে উঠায়। সমীরণের কপাল চুইয়ে কানের কার্নিশ ছুঁয়ে র**ক্ত গড়িয়ে পড়ল কাঁধে। পুড়ন্ত দুটি ঠোঁটে তখনও হাসি লেগে, নিজের মধ্যকার ভার হালকা করতে পারার শান্তির হাসি। চোখ তুলে এক পলক হাসপাতালের দিকে চেয়ে নিচুস্বরে উচ্চারণ করল,

‘ ঊষা!
তোমায় ভালোবেসেছি বলেই আমি আমার পাপ উপলব্ধি করতে পেরেছি। তোমায় ভালোবেসেছি বলেই আমি ধীরে ধীরে ধ্বংস হচ্ছি। তোমায় ভালোবেসেছি বলেই এই এক জীবনে আমি পা””পের পথ ছেড়ে ভালো হতে চেয়েছি। তুমি আমার ভোরের আলো, যেই আলোতে পথ চলে আমি আমার অন্যায় মাথা পেতে নিয়ে নতুন এক জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। যতদিন বাঁচব তোমাকে অপরিসীম ভালোবাসব। এটাই এখন আমার জীবনের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ঊষা! ভালোবাসি ঊষা। প্রচন্ড ভালোবাসে তোমাকে আমার বোকা হৃদয়টা। ‘

ঊষার শরীরটা কিঞ্চিৎ দুর্বল। প্রহরের এমতাবস্থা বোন হয়ে মেনে নিতে পারছে না। চিন্তায়,রাগে,যন্ত্রণায় শরীর ক্রমশ শক্তি হারিয়ে নিঃশক্তি। প্রত্যয়ের ভিতরও তুফান চলছে। মাকে কী জবাব দেবে? নিশাতের কী হবে? মা তো বলেছিল রাজনৈতিক বিষয়টা ভয়ং-কর। এই ভয়ং-কর পথ যখন দুই ভাই বেছে নিয়েছে, একে অপরের ঢাল হয়ে যেন থাকে। ঊষাকে নিয়ে নিশাতের কেবিনে গেল ও। শিমুল কেবিনে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। নিশাতের হুঁশ নেই। প্রহরের গু**লিবিদ্ধ দেহ দেখে জ্ঞান হারিয়েছে সে। সর্বক্ষণ ভীত হয়ে থাকা মেয়েটার জন্য নিজের স্বামীর এমনতরো হাল সহ্য করার মতো ছিল না।

ঘন্টা দুয়েক পর গ্রাম থেকে দুই বাড়ির লোক আসে হাসপাতালে। আলতা এসে ছোট ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। সবসময় উনার মধ্যে একটা ভয় বিরাজ করত ছেলেদের নিয়ে। কতবার হাম**লার শিকার হলো প্রহর! সর্বদা শক্ত থাকলেও আজ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ছোট ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। রোকেয়া মেয়ের কাছাকাছি বসে ছিলেন। নিশাতের জ্ঞান ফিরতেই সে মাকে দেখে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,
‘ আম্মা, উনি কেমন আছেন? এখনও কি র-ক্ত ঝড়তেছে আম্মা?’
প্রশ্ন করতে করতে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে। তখন হুঁশে আসার পর ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার ঝামেলা স্থানে যেতে বাধ্য করে। প্রহরের বুকে গু**লি লাগতে নিজ চক্ষে দেখে সে। কতক্ষণ থম মে**রে থেকে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে রাস্তায়।

তাকে শান্ত করতে রোকেয়া ও শিমুল জাপটে ধরে থামাতে চাইল তাকে। পারল না। ছোট মেয়েটার মাঝে যেন আজ অশরীরীর শক্তি এসে ভর করেছে। রফিক আজম কেবিনে ঢুকে গম্ভীর স্বরে আদেশ করলেন,’ থামেন আম্মা। ‘
আব্বাকে দেখে নিশাত তাঁর হাতটা ধরে বলল,’ আব্বা, উনি ঠিক আছেন? আপনি উনাকে আর রাজনীতি করতে নিষেধ করবেন আব্বা। উনার বুকে অনেক র**ক্ত ছিল,আমি দেখেছি আব্বা। ‘
রফিক আজম মেয়ের মাথাটা বুকে নিয়ে বললেন, ‘ ঠিক আছে আম্মা। আপনে চিন্তা কইরেন না। শান্ত হোন। ‘
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করলেন তিনি। প্রহরের শরীর থেকে বু–লেট বেরা করা হয়েছে। তবে এখনও আশঙ্কামুক্ত নয়। এ কথাটা ঠিকভাবে নিতে পারবে না মেয়েটা,তাই কথাটা চেপে গেলেন। ছেলেটাকে এক সময় অপছন্দ করলেও এখন তিনিও ভালোবেসে ফেলেছেন। মনপ্রাণে চান,জলদি সুস্থ হয়ে উঠুক।

মৃন্ময়ী কিশোরগঞ্জে তাদের পুরোনো বাসায় ছিল এতদিন। প্রহরের কথা শোনামাত্র ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে আসে। হাসপাতালে ঊষার সাথে দেখা হয় তার। প্রত্যয়ের সাথে হয় এক মিনিটের দৃষ্টি বিনিময়। ওকে দেখেই মাথা নত করে ফেলে প্রত্যয়, তখন মৃন্ময়ীর ওষ্ঠাধারে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে। সে এই লোকটার মুখোমুখি কখনোই হতে চায় নি। মৃ**ত অনুভূতিগুলো ফের প্রাণ পেয়ে গেল যেন। প্রেমের উত্তাপে জ্বলনের ভয়েই মূলত আর কখনো প্রত্যয়ের চেহারা দেখতে চায় নি। কিন্তু প্রহর ওকে বোনের মর্যাদা দিয়েছে। এতগুলো দিন তনুজার কথায় আগলে রেখেছিল বড়ো ভাইয়ের মতোন কড়া নিরাপত্তা দিয়ে। এগুলো ভুলে কী করে অকৃতজ্ঞ হবে ও? ওর ছেলেটা ভীষণ আদুরে। গোলগাল ছাঁচের, ফর্সা চেহারার। ধীরে ধীরে আধো আধো গলায় কথাও বলে। ঊষা পরিচিত একজনের চেহারার মিল খোঁজে পেল। হ্যাঁ, সমীরণের। যেহেতু অন্তিম ও সমীরণ একই চেহারার জমজ ছিল, মিল পাওয়াটা যেন ভুল কিছু নয়। ঊষা ওকে কোলে করে প্রত্যয়ের কাছে এলো। করিডোরের একপাশে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও। ঊষা ধীরকণ্ঠে জানতে চাইল,’ অনুশোচনায় ভুগছ?’
চকিতে মাথা তুলে ওর দিকে তাকাল প্রত্যয়। হাসল, তবে হাসিতে প্রাণ নেই, ভীষণ মলিন। ঊষার কোলে থাকা বাচ্চাটাকে নিজের কোলে নিতেই বাচ্চাটা দুম করে ঘুষি মা*রল ওর নাকে। সে হতবিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করল,
‘ কীরে বাপ,ঘুষি মা**রলি কেন?’
বাচ্চাটা অপরিপক্ক গলায় বলল,’ আমি ব্যথা পেয়েছি। ‘
‘ ব্যথা কীভাবে পাইলি?’
‘ হাত শক্ত। ‘
‘ ওহ, আচ্ছা। তুই তো তুলতুলে। নাম কী তোর?’
ছেলেটা যেন গর্বের সাথে বলল,’ সায়র। ‘
ঊষা হেসে বলল,’ বাহ! কি চমৎকার নাম!’
বাচ্চা সায়রের কথাগুলোতে বেশ মজা পেল ঊষা ও প্রত্যয়। মৃন্ময়ী প্রহরের সুস্থ হবার অপেক্ষা করল। দুইদিন ধরে এক বান্ধবীর বাসায় থেকে গেল সায়রকে নিয়ে। ঊষা ও তনুজা খুব করে অনুরোধ করলেও কারও বাড়িতে যায় নি সে। যে বাড়িতে প্রত্যয় আছে,সেখানে পুরোনো ক্ষত তাজা করতে যাবে না। আর যেই শ্বশুর বাড়িতে কখনো যাওয়ার সৌভাগ্য হয় নি সেথায়ও যাবে না। প্রহর সুস্থ হলে তাকে দেখে কিশোরগঞ্জ ফিরবে আবার। টানা ৩-৪ দিন হাসপাতালে যাতায়াত লেগে থাকল রোকেয়া, ঊষা,আলতা সকলের। এই কয়েকদিনের মাঝে জ্ঞান ফিরলেও প্রহরের সাথে দেখা করার অনুমতি পায় নি কেউ শরীরের অবস্থা তেমন ভালো নয় বিধায়। নিশাত নাওয়াখাওয়া ভুলে হাসপাতালেই পড়ে থাকল। ফুলের মতো দেখতে মেয়েটা মূর্ছা গিয়েছে অযত্নে। প্রতি পল প্রহরকে দেখার জন্য চাতক হয়ে আছে। এক গভীর রাতে ডাক্তার জানাল প্রহরের সাথে এখন সবাই-ই দেখা করতে পারবে। তখন হাসপাতালে সৌরভ, আলতা ও নিশাত ছিল। আলতা নিশাতের মাথায় হাত রেখে বলল,’ তুই যা। তারপর আমি যাব। ‘

নিশাত দরজা ঠেলে কেবিনে ঢুকে দেখল প্রহর বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। ওকে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকাল। পরক্ষণেই টকটকে লাল হয়ে উঠল তার কালো কুচকুচে মণির আশপাশ। ধমকে ওঠে মেঘের নিনাদের ন্যায়,’ তোকে থা**প্পড় মেরে তাজা করব এখন আমি। তোর সাহস কী করে হলো নিজের অযত্ন করার? বলেছিলাম না, আমি ফিরে আসব? বিশ্বাস নেই তোর আমার ওপর? ‘

নিশাত কেঁপে উঠল। স্তব্ধ হয়ে গেল। এই অবস্থায়ও লোকটা ধমকাচ্ছে তাকে! মিনমিন করে চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি অসুস্থ, আস্তে কথা বলুন। ‘
‘ আমি অসুস্থ! অসুস্থ তো তুই। তোর মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখে ধেবে গেছে, ঠোঁট শুকিয়ে খরা লেগে আছে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে বছর ধরে অনাহারে ভুগছিস, এখনই একটা বাতাস আসলে উড়ে যাবি। এদিকে আয়। ‘
ভয় চেপে পা চালিয়ে কাছে এগিয়ে গেল নিশাত। গালে কান্নার শুকিয়ে যাওয়া ছাপ লেগে আছে। চুল আলুথালু। প্রহর হাত বাড়িয়ে গুছিয়ে দিল চুলগুলো। মুখ এগিয়ে নিয়ে শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয়ে ঠোঁটজোড়া রাখল। মৃদু নড়েচেড়ে উঠল নিশাত। প্রহর ঠোঁট সরিয়ে এনে রোষপূর্ণ গলায় বলল,

‘ হাসপাতাল থেকে জলদি রিলিজ দিতে বলতে হবে ডাক্তারকে। তোকে বাড়িতে নিয়ে বেশি খাইয়ে খাইয়ে মোটা বানাতে হবে। কি হাল করেছিস নিজের!’
নিশাত বলিষ্ঠ হাতটা ধরে তার পিঠে কপাল ঠেকিয়ে কেঁদে দিল। ক্রন্দনরত গলায় বলল,’ আমি ইচ্ছে করে এমন করি নি। ‘
হাতের মালিক গলার কাঠিন্য কমিয়ে অত্যন্ত কোমল সুরে বলল,
‘ জানি তো, তোর ভালো থাকা আমার মধ্যে। তোকে ভালো রাখতে এখন থেকে আমি নিজেকে ভালো রাখব তিলবতী। নিজের প্রতি আর অবহেলা করব না। ‘
______________________

প্রহর সুস্থ হবার একমাস পর মৃন্ময়ী ও তনুজার আমেরিকা যাবার সবকিছু কনফার্ম হয়ে যায়। মৃন্ময়ীর বাবা আপাতত বড়ো মেয়ের সাথে থাকছেন। সমীরণের কথা জেনে তার বাবা-মা একবারও যায় নি ছেলের সাথে দেখা করতে ঘৃ**ণায়। তারাও খুব জলদি তনুজার কাছে চলে যাবে। মৃন্ময়ীর কাছে ক্ষমা চেয়েছে খুব। মৃন্ময়ী নিরবে ক্ষমা করে দিয়েছে তাদের। সবটাই তার ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে সে। তনুজা যাওয়ার আগের দিন সকালে সমীরণের সাথে দেখা করতে জেলখানায় এলো। দেশের মানুষের চাপের মুখে ও বড়ো বড়ো নেতাদের নির্দেশে তার মাম–লাটা জলদিই সমাধান করা হয় আদালতে। যাবত জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাকে। সেদিন একটুও কষ্ট হয় নি সমীরণের। কারণ নিজের ধ্বংস সে নিজেই বেছে নিয়েছে। তনুজা ভাইয়ের মলিন চেহারা দেখে করুন গলায় বলল,
‘ আমি তোমার এমন শা**স্তি চাই নি। চেয়েছি যা-ই হোক তোমার সাথে সেটা খোলা আকাশের নিচে হোক,এই বন্দি দশায় নয়। ‘
সমীরণ একপেশে হেসে বলল,’ ঊষা ভালো আছে?’
হতবাক, বিস্মিত তনুজা। এখনও শুধু ঊষার চিন্তা! নিজের কষ্ট নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই! তনুজার মনে হলো,তার ভাইটা সত্যিই খুব ভালো হয়ে গিয়েছে। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল,
‘ ভালো আছে। মা হবে ও। ‘
সমীরণ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘ বাবুর মা হবে? ও নিশ্চয়ই খুব খুশি? প্রত্যয় ওর যত্ন নিচ্ছে তো ঠিকঠাক? ‘
‘ নিচ্ছে। তুমি কেন ওর কথা ভাবছ,ভাইয়া? এসব ভেবে কষ্ট বাড়াচ্ছ কেন নিজের?’
‘ আমার সমস্ত ভাবনাই তো ওকে নিয়ে তনু। ওকে ছোঁয়ার অধিকার আমার নেই, দেখার অধিকারও নেই কিন্তু ভালোবাসার আছে। আমি বেঁচেই আছি ওকে ভালোবেসে। আমি কখনো আর ওর খবরাখবর জানতে পারব না। তুই মাঝে মাঝে বাংলাদেশ আসিস তনু। আমাকে ওর ভালো থাকার খবর দিস। ও ভালো থাকলে এই বন্দি জীবনও আমার কাছে ফুলের বাগান। ‘
তনুজা কাঁদতে কাঁদতে বলল,’ ভালো থেকো, ভাইয়া। আমি আসব বাংলাদেশ মাঝে মাঝে শুধু তোমার জন্য। ‘
সমীরণ স্মিত হেসে বলল,’ তুই তাকে আমার হয়ে বলে দিস,সে যেন নিজের খেয়াল রাখে। ‘

তনুজা, মৃন্ময়ী ও সায়রকে এগিয়ে দিতে এয়ারপোর্টে ঊষা,প্রত্যয়, প্রহর ও নিশাত এলো। প্রত্যয় এক ফাঁকে মৃন্ময়ীকে বলল,’ আমাকে ক্ষমা করে দিও। ‘
মৃন্ময়ী ঘাড় বাঁকিয়ে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,’ কেন?’
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল প্রত্যয়। বলল,’ আমি আমার জেদকে প্রশ্রয় দিয়ে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। তুমি যত আমাকে অবহেলা করছিলে তত আমার জেদ বাড়ছিল তোমাকে পাওয়ার। কখনও নিজের মধ্যে ঊষার জন্য লুকায়িত ভালোবাসাকে বুঝতে পারি নি। শুধু জেদ ধরে তোমাকে ভালোবাসি বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারি। কিন্তু ততদিনে আমার দ্বারা তুমি কষ্ট পেয়ে গেছ। ‘

মৃন্ময়ী চোখ জোড়া ঊষার কোলে খিলখিল করে হেসে যাওয়া সায়রের দিকে নিবদ্ধ করে বলল, ‘ প্রতিটা প্রেমে কেউ একজন পুড়ে যায়। সেই পুড়ে যাওয়া মানুষটা ছিলাম আমি। এতে আমার বিন্দু পরিমাণ কষ্ট নেই। আপনার প্রেমের উষ্ণতায় আমার পুড়তে হবে তা হয়তো নির্ধারিত ছিল এবং আমি তা গ্রহণ করে নিয়েছি। আপনি ঊষা আপুকে সবসময় ভালো রাখবেন প্লিজ। জানি, অনেক ভালোবাসেন তাকে,তবুও আরও বেশি ভালোবাসবেন। আপনার প্রতি আমার একটুও অভিযোগ নেই,একটুও না। ‘

প্রত্যয় তৃপ্তির হাসি হাসল। তার ভিতরটা অনুশোচনায় পুড়ে যাচ্ছিল দিনের পর দিন। ঊষা বলল, সুযোগ বুঝে মৃন্ময়ীর সাথে একটাবার কথা বলতে,ভিতরের সব অশান্তি দূর করে ফেলতে। ঊষা ওদের কাছে এসে বলল,
‘ আমার একটা আবদার আছে মৃন্ময়ী। ‘
মৃন্ময়ী ও প্রত্যয় প্রশ্নাত্মক চাহনি নিক্ষেপ করল ওর দিকে। ঊষা ওদের উত্তর দিতে বেশিক্ষণ বিলম্ব করল না। অকপটে জানাল,’ আমার মেয়ে হলে তোমার ছেলের কাছে বিয়ে দেব। বেশ পছন্দ হয়েছে আমার সায়রকে। ‘
আজকাল ঊষা বেশ বাচ্চামো করে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও। সবটাই প্রেগ্ন্যান্সির প্রভাব। প্রত্যয় নাক গলিয়ে শুধাল,
‘ মেয়ে হলেও সায়র যদি তোর মেয়েকে পছন্দ না করে? ওর যদি গার্লফ্রেন্ড হয়ে যায়?’
মৃন্ময়ী ঠোঁট টিপে হেসে বলল,’ হতে দেব না। ছেলের পেছনে সিসিটিভি ক্যামেরা হয়ে থাকব। বলব, বাংলাদেশ ওর একটা বউ আছে। আমাদের আত্মীয়তা হলে মন্দ হবে না। ‘
একে অপরের বাচ্চামো কথায় হেসে উঠল ওরা সবাই। এক সময় ভিতরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। তনুজা নিশাতকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ নেতাসাহেবকে ভালো রেখো ভাগ্যবতী মেয়ে। ‘
ঊষাকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়ের কথাটা পৌঁছে দিল তার কানে,’ নিজের খেয়াল রেখো। ‘
প্রহরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’ চলে যাচ্ছি নেতাসাহেব। ভালো থাকবেন। ‘
প্রহর নিশাতের কাঁধ জড়িয়ে সবার সামনেই বুকে টেনে নিয়ে তনুজাকে বলল,
‘ পরের বার বাংলাদেশ এভাবেই আসবেন, কারো একজনের হাত ধরে। জীবনে ভালোবাসা আসে, তবে সব ভালোবাসার গন্তব্য হয় না, মাঝে মাঝে জীবনকে সাজাতে হলে পুরোনো ভালোবাসাকে তালাবদ্ধ করে নতুন কাউকে ভালোবাসার সুযোগ দিতে হয়। ‘
কেউ না বুঝলেও তনুজা হাড়ে হাড়ে টের পেল প্রহরের কথাগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকা অর্থ। সে প্রহরকে গভীর ভালোবাসার গল্পটা প্রকাশ না করলেও প্রহরের মতো বিচক্ষণ মানুষ সেটা বুঝে নেওয়া চমৎকৃত কিছু নয়। বরং এটা খুবই স্বাভাবিক। চিকন অধরোষ্ঠ প্রসারিত করে বলল,
‘ অবশ্যই সুযোগ দিব। ‘
তনুজা ও মৃন্ময়ী ভিতরে যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল ওদের। ঊষার চোখে থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ছে, ঠোঁটে হাসি। নিশাত নির্নিমেষ চেয়ে আছে ওদের দিকে প্রহরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। সায়র হাত নেড়ে টাটা দিল ওদের।
_______________________________
‘ আমরা কাল তোকে আংটি পরাতে যাব। তোর কোনো আনন্দ নেই এতে? মেডিক্যালে চান্স পেয়ে সব আনন্দ কি ধুয়ে ফেলেছিস? আমায় ফোনও দিস না। ‘
শিমুল ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে ফিসফিস করে বলল,’ আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে সৌরভ ভাই। এতদিন এমন লাগে নি। সামনে আমাদের বিয়ে ভাবলেই লজ্জা লাগে খুব।’
‘ ঢাকা এসে আমি তোকে একটা থা**প্পড় মে–রে সব লজ্জা দূর করে দেব। আমাকে ভুলেই গেছিস তুই। তুই পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিস। ‘
ঢের অভিমানী গলায় বলল সৌরভ। শিমুল মন খারাপ করে ফেলল। সে মোটেও পরিবর্তন হয় নি। শুধু মেডিক্যালে নতুন ভর্তি হওয়াই পড়াশোনা বুঝে উঠতে মনমেজাজ গরম গরম থাকে।
‘ স্বভাব পরিবর্তন হতে পারে। আপনার জন্য ভালোবাসার পরিবর্তন কখনোই হয় নি,হবে না। আপনার প্রতি আমার যে ভালোবাসা সেটা দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে। ‘
সৌরভ চিন্তিত কণ্ঠে বলল,’ পড়াশোনার চাপ বেশি?’
‘ একটুখানি,সবে ভর্তি হলাম সেজন্য গন্ডগোল লাগছে সব।’

নিশাত ভার্সিটি থেকে ফিরে জলদি করে গোসল সেড়ে শাড়ি পরে নিল। বাড়িতে এসে কাউকে দেখতে পেল না। ঊষা একটা হসপিটালে ইন্টার্ন হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। বুয়া বলল তারিনকে নিয়ে প্রত্যয় ঊষার কাছে গিয়েছে। মোশতাক সাহেব ও শিমুল বাহিরে। তারিন প্রত্যয় ও ঊষার মেয়ে। বাড়িতে ঢুকেই তারিনকে না দেখলে মনটা ছটফট করে ওর। আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়ছিল,এমন সময় ঘরে হনহনিয়ে প্রবেশ করল প্রহর। দ্রুত উল্টো ঘুরে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ আপনার হাতে র–ক্ত কেন?’

প্রহর টেবিলের ওপর থেকে টিস্যু নিয়ে হাত মুছে এককোণে ছুঁড়ে ফেলল। তড়িৎ বেগে ওর কাছে গিয়ে ক্রোধমিশ্রিত স্বরে প্রশ্ন করল,’ তুই আমায় বলিস নি কেন কিছু ছেলে ভার্সিটিতে তোকে বিরক্ত করে?’
নিশাত নিশ্চুপ হয়ে রইল। অবাক হলো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়েছে তার। সে আর শিমুল এখন ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। একাই যেতে হয় ওকে এখন সবসময়। কিছু ছেলে গত ক’দিন ধরে ভার্সিটির গেইটে দাঁড় করিয়ে খুব বিরক্ত করত ওকে। প্রহর ঝামেলা করবে বলে, বলে নি। কিন্তু ও ভুলে গিয়েছিল দূরে থেকেও আগলে রাখে মানুষটা তাকে। ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠস্বর ওর,
‘ আপনি মে**রেছেন ওদের?’
‘ হ্যাঁ। একটার গালে আস্তে করে একটা ঘু-ষি দিলাম মুখ থেকে র-ক্ত ছিটকে আমার হাতে পড়ল। এই শক্তি আর সাহস নিয়ে আমার তিলবতীকে জ্বালাতন করতে আসে!’
নিশাত সাহস সঞ্চয় করে ফের বলল,
‘ আপনি নেতা মানুষ। এভাবে মা–রপিট করলে মানুষ কী বলবে?’
প্রহর তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল নিঃশ্বাসের কাছাকাছি দাঁড়ানো অপরূপার মুখের ওপর। চোখ বুঁজে ফেলল অপরূপা। লজ্জার শামিয়ানায় ঢেকে গেল সমস্ত মুখশ্রী। সে নেশাতুর কণ্ঠে বলল,’ আমি কারো পরোয়া করি না সুইটহার্ট। ‘
বলেই নিশাতকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় ও। নিশাত তার কাঁধে থুতনি রেখে সামনের দেয়ালে তাকায়। দেয়ালে টানানো ফ্রেমের দিকে নজর যায় ওর। বছর আগে স্মরণিকা নিবাসে দেওয়া সেই চিঠিটা সত্যি সত্যি ফ্রেমে বাঁধাই করে রেখেছে প্রহর। ঘাড়ত্যাড়া একটা লোক,যা বলে তা-ই করে। আর এই ঘাড়ত্যাড়া মানুষটাকেই ভালোবেসে গাধী,তিলবতী,বেক্কল, ভীতু,বাথরুমের ঘুমন্তপরী,জান,সুইটহার্ট সব, সব হয়ে থাকবে সে আমৃ*ত্যু।

( সমাপ্ত)