বাঁধনহীন সেই বাঁধন অকারণ পর্ব-১২+১৩

0
614

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|১২|
#শার্লিন_হাসান

(সারপ্রাইজ)

পাত্র পক্ষের সামনে বসে আছে আরোহী। দু’পক্ষেরই সব পছন্দ হয়েছে। ছেলের মেয়ে পছন্দ হয়েছে এই বিয়েটাতে সবাই সন্তুষ্ট। আরিয়া ইসলাম আরোহীকে আংটি পড়িয়ে দেন। রোশান আরোহীর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা দেখতে মাশাল্লাহ। আলিশা তাকে বিয়ে করবে না শোনার পর অনেক রাগ হয় রোশানের। তবে আলিশা বিয়ে করা না করা নিয়ে না। সে কখনো আলিশাকে বিয়ের প্রপোজাল দেয়নি সে জায়গা আলিশা বড় মুখ করে তাকে রিজেক্ট করলো কীভাবে। পরিবারে বিয়ে ভাঙা নিয়ে হায় হুতাশ। অথচ রোশান তাঁদের সবাইকে আচ্ছা মতো বকেছে! সে নিজেও আলিশাকে বিয়ে করবে না। এরই মাঝে আরোহীর খবর আসে। রোশান সবাইকে কাটকাট গলায় উত্তর দিয়েছে,
-আলিশা ছাড়া মেয়ের অভাব নেই পৃথিবীতে। রোশানের জন্যও মেয়ের অভাব পড়বে না। কয়েকদিনের মধ্যে বিয়ে করে দেখিয়ে দেবে।

সেদিনের মতো তারা বিদায় নিয়ে চলে আসে। বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়। আগামী রবিবার বিয়ে। তিনদিন গ্যাপ রেখে বিয়ের আয়োজন।

আরোহী সহ বাকীরা বসে,বসে কথা বলছে। চৌধুরী বাড়ীতে উৎসবের আমেজ এখন থেকেই শুরু। মেহরাব এসেছিলো ঘন্টাখানেক আগে। সুন্দর খবরটায় সবাই খুশি। বিয়ে নামক একটা সুন্দর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে ছেলে মেয়ে দু’টো।

এতো কিছুর মাঝেও ফাইজা চৌধুরীর দীর্ঘ শ্বাস যায় না। রাইহান চৌধুরীকে বুঝতে পারেন না তিনি। সাদিয়া,আয়মানকে নিয়ে এতো জামেলা তো তাঁদেরকে ছেড়ে দেয় না কেন? আর সাদিয়ার সাথেই বা কীভাবে সংসারটা শুরু করলো। অবশ্য তার ছেলেকে যে যেভাবে ঘুরায় সেভাবে। আছে এক ধরনের মানুষ! বেশীভাগ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। ফাইজা চৌধুরীর কাছে রাইহান চৌধুরীকে তাই মনে হচ্ছে। কী জানি আবার কোন জামেলা সামনে অপেক্ষা করছে।

*****

খান বাড়ী কয়েকঘন্টার মাঝে সাজসজ্জিত হয়ে উঠেছো। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। অথচ তাঁদের আংটিবদল কিছুই হয়নি ডিরেক্ট বিয়ে। আলিশা কী করবে বুঝতে পারছে না। তার কাছে ফোন ও নেই যে রুদ্রকে কল করবে। আয়মানের কথা আপাতত মাথায় নেই তার। রুদ্রর সাথে সাড়ে তিনবছর রিলেশনে ছিলো। আয়মানের সাথে ছয়মাস। অথচ তাদের কাউকে সে পাবে না। ভাগ্য! কীভাবে এক নিমিষে সব উলোটপালোট। ফ্লোরে বসে আছে আলিশা। কান্না আসছে না তার। কার জন্য কান্না করবে? কিসের জন্য কান্না করবে? সে তো কোনদিন কাউকে ভালই বাসেনি। আবার আফসোস! মন থেকে আসছে না। তবে মনে পড়ে সেদিনের কথা। যেদিন আয়মান মালদ্বীপ থেকে ট্যুর শেষে বিডিতে আসে। সুমাইয়ার সাথে সে কথা বলছিলো আয়মানকে দেখে। দু’জনের চোখাচোখি হয়। অবশ্য এর আগে সুমাইয়ার মুখে আয়মানের নাম শুনেছে আলিশা। তার কয়েকদিন পর সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের কথা হয়। সেদিন সিঁড়ি বেয়ে যাওয়ার সময় আয়মান যখন আলিশার পাশ কাটিয়ে যায় তখন একটা লেটার আর চকলেটস ছিলো যেটা আলিশার হাতে দেয় সুমাইয়ার আড়ালে। তখন হাসে আলিশা! সুমাইয়া সেটা সন্দেহ করতে গিয়েও করেনি কারণ আলিশা টপিকটা বাদ দিয়ে দেয়। সেই চিরকুটে লেখা ছিলো,

-হেই কিউট বেইব! আই লাইক ইউ! আয়মান আরহাম চৌধুরী তোমায় পছন্দ করে তোমায় চায়। গার্লফ্রেন্ড হবা? ইউ নো, এটা সোশ্যাল মিডিয়ায় বলতে পারতাম কিন্তু হাতে কলমে লিখাটা বেশী শোভনীয়। বাসায় গিয়ে মতামত দিও। অপেক্ষায় রইলাম।

চিঠিটা পড়ে আলিশা। বাড়ীতে গিয়ে অনেক ভেবেচিন্তে রাজী হয় আলিশা। আয়মানের অনেক টাকা পয়সা ছিলো। বাবার একমাত্র ছেলে। ওর মা সাদিয়ার সাথেও বেশ কয়েকবার কথা হয়। তাঁদের ফাস্ট ডেট ছিলো তার কয়েকদিন পরে। মনে পড়ে আলিশার সেদিনের কথা।

সকাল,সকাল নিজেকে তৈরি করে নিলো আলিশা। আজকে তার ফাস্ট ডেট আয়মানের সাথে। তাদের রিলেশনের দশদিন গেছে। ব্যপারটা হাইড করা। আয়মান রুদ্রর ব্যপারে সবটা জানে যে রুদ্রর সাথে আলিশার রিলেশন ছিলো। তবে রুদ্রর পরিচয় জানে না। আলিশা রিলেশন কন্টিনিউস করছে। আয়মান তাকে বেশী প্যারা দেয় না।
আলিশার মনে হয় সে রুদ্রকে হয়ত ভালবাসতে পারেনি নাহলে রুদ্র থাকতে দ্বিতীয় জনের প্রতি তার জোক কীভাবে আসে। হয়ত তার ভালবাসার খামতি নাহয় রুদ্রর ভালবাসায় খামতি আছে।
আলিশা নাস্তা করে বেড়িয়ে পড়লো। আয়মানকে নক দিয়ে রেখেছে সে বেড়িয়েছে। তাঁদের ফাস্ট ডেট আয়মান তাকে আইফোন 14 প্রো মেক্স গিফ্ট করবে। সেজন্য একটু বেশী এক্সাইটেড আলিশা। হোয়াইট এবং ব্লাক কালারের সংমিশ্রণ জাম্প সুট পরিধান করেছে সে। এশ ব্রাউন কালারের চুলগুলো কাঁধ অব্দি ছাড়া। ফেসে হালকা মেকআপ। নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছে আলিশা। আজকে তাকে একটু বেশী সুন্দর লাগছে।

আয়মান ব্লাক শার্ট ব্লাক প্যান্ট পরিধান করেছে। ফর্সা সুঠাম দেহে ব্লাক কালারটা ফুটে উঠেছে তার। রাইহান চৌধুরীর কার্ড নিয়ে এসেছে। এটা থেকে টাকা নিয়ে আলিশাকে আইফোন গিফ্ট করবে। কঠিন বিষয়টাকে সহজ করে দিয়েছে তার মা সাদিয়া। তাকে হেল্প করেছে।

আয়মান বাইরে আসতে তার বোন সাদবি তাকে দেখে প্রশ্ন করলো,

“ডেটে যাচ্ছো নাকী?”

“হুম যাচ্ছি। তোমার রুদ্র ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ডের সাথে।”

“দুনিয়াতে কী মেয়ের অভাব পড়সে ভাইয়া?”

“দুনিয়াতে পড়েনি তবে আমার রুচিতে পড়েছে। আলিশাকে আমার ভালো লাগে। আমার তাকেই চাই। হোক সে রুদ্র রওনাফ চৌধুরীর গার্লফ্রেন্ড নাহয় আশরাফ খানের একমাত্র কন্যা। ও আমার প্রেজেন্ট!

” ফিউচার কী?”

“দেখা যাক প্রেজেন্টকে ফিউচার অব্দি নিতে পারি কী না।”

আয়মান নাস্তা করে বেড়িয়ে পড়লো। তারা দু’জন একটা সুপার শপে গেলো। আলিশাকে গিফ্ট কিনে দিয়ে তার একটা রিসোর্টে গেলো। কোলাহল মুক্তি পরিবেশ। আলিশা তার আর আয়মানের কয়েকটা ক্লোজ পিক তুললো। রুদ্রর সাথে ব্রেক আপের সময় হলে এই পিকগুলো ডে দিবে।

“আলিশা তোমাকে প্রচুর কিউট লাগছে সাথে হ’ট ও। ইচ্ছে করছে খেয়ে ফেলি।”

“আলিশা নূর এমনিতে ও কিউট। তবে তার কিউটনেস সবাই বুঝতে পারে না।…”

আলিশার কথার মাঝে পোড়ন কেটে আয়মান বললো,
“বিশেষ করে রুদ্র। রাইট?”

“ইয়াহ্!”

” ফিফটি ডেইস লেটার সম্পূর্ণ ব্রেকআপ করে নিও। তবে এখন থেকে ইগনোর শুরু করে দাও। বেবি আয়মান আছে মানে তোমার আর কী চাই? সব সুখ আমার মাঝে পাবে তুমি।”

“ওকে বেইবি! এটাকে আমরা রিলেশন বলতে পারি বাট রুদ্রর মতো হাবার সাথে এতোদিন ছিলাম এটা রিলেশনের জাতে পরে কী না জানি না। এই জেনারেশনের ছেলে-মেয়ে হয়ে নব্বই দশকের প্রেম তুলে ধরতে চাইছে।”

“রুদ্র মানে একটা জামেলার নাম। আমাদের সুন্দর মূহুর্তে ওর মতো জামেলার কথা মনে করো না তো।”

-আচ্ছা বাদ দেই ওর কথা। আয়মান আমরা তাহলে বিয়েটা করছি কবে?

-যাক না বছর। আমি নতুন জব নেই বা পাপার বিজন্যাসে যোগ দেই। অবশ্য এখন করলেও করতে পারি বাট এটায় আমি মজা পাবো না। তুমি বরং ব্রেকআপটা করে নিও।

-বাট এখন হুটহাট কীভাবে?

-ওয়েট কয়েকটা দিন যাক। আমি নিজেই তোমার বফকে দেখাবো আমাদের পিকচারগুলো।

-না,না তার দরকার নেই। আমি সময় মতো ব্রেকআপ করে নিবো।

-হ্যাঁ এখন রুদ্রর সাথে অভিনয় টা ভালোভাবে চালিয়ে যেও। মনে রাখবে আয়মান মানে আলিশা আর আলিশা মানে আয়মান। একজনকে ছাড়া আরেকজন অসম্পূর্ণ।

সেদিন তাদের ফাস্ট ডেট ছিলো। এর পর ও বেশ কয়েকবার ডেটে গিয়েছিলো। রুদ্রর সাথে ব্রেকআপ করবে,করবে করা হয়না। কথাটাই তুলতে পারে না আলিশা। কোথাও একটা বাঁধা পায়। রুদ্রর সাথে ব্রেকআপ করার চিন্তা রিলেশনে যাওয়ার পর মাথায় আনেনি কখনো। আয়মান আসার পর রুদ্রকে অনেকটা চিপ মনে হয়েছে আলিশার কাছে। এমন রুদ্র অহরঅহর আছে। কিন্তু আয়মান বলে, রুদ্র একপিস। তার কয়েক মাস পর আয়মান জানায় রুদ্রর সাথে কোন ব্যপার নিয়ে তার জামেলা। এবং সেটা শত্রুতায় রুপ নিয়েছে। কথা বিশ্বাস হয়নি আলিশার কারণ রুদ্র এমন না। আর এমন কিছু হলো আলিশাকে ঠিকই বলতো। অনেক জানা অজানা প্রশ্ন জমা হয়েছে মনে।

উঠে বেলকনিতে যায় আলিশা। মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে বাড়ীতে। তার রিলেটিভস অনেকে এসেছে। তখন আবার দরজায় নক করে কেউ। আলিশা দরজা খুলে। সুমাইয়া আর প্রিতী এসেছে। আলিশা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ। ওদের কাছে কী সব বলে দিবে? ইশশ! কত মিথ্যে বলে এসেছে এতোদিন। আর সুমাইয়া সে তো আয়মানকে লাইক করতো। অথচ আয়মানের সাথে আলিশা গোপনে রিলেশনে ছিলো।

ভেতরে আসে সুমাইয়া,প্রিতী। আলিশাকে প্রশ্ন করে,

-রুদ্র ভাই কিছু জানে আলিশা? বিয়েটা ভেঙে দে আলিশা। তুই রুদ্রকে ভালোবাসিস।

-না আমি কাউকে ভালোবাসি না সুমু। রুদ্রকেও না।

আলিশার কথায় দু’জনে তাকায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাঁদের। যপই আলিশা রুদ্রর কথা বলতে,বলতে ফেনা তুলে ফেলতো মুখে। রুদ্রকে নিয়ে এটা করবে,ওটা করবে। এখানে যাবে, ফিউচারে ওটা হবে। রুদ্র তাকে ভালোবাসে। সে রুদ্রকে ভালোবাসে। অথচ আজ! আসলে সময়ের সাথে মানুষ পাল্টায়,পরিস্থিতি পাল্টায়।

-আসলে আমি পরে বুঝতে পারি রুদ্র আমার ভালোবাসা না আবেগ ছিলো। নাহলে আয়মানের সাথে আমি রিলেশনে যেতে পারতাম না।

থেমে,

-আমি কাউকেই ভালোবাসতে পারিনি। এখন বাবার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করে নিবো। রুদ্রকে কেউ কিছু জানাবি না।

আলিশার কথায় স্তব্ধ দু’জন। রুদ্রর কথা ভাবতে খারাপ লাগছে। রুদ্র তো এসবের কিছুই জানে না। তখন প্রিতী বলে,

-এতো যেহেতু টাইমপাস করবি তাহলে রুদ্রকে আগেই ছেড়ে দিতি। সে এই খবরটা জানলে কী রিয়েক্ট করবে জানিস? আর তুই এটা কীভাবে পারবি আলিশা?

-আমি আলিশা নূর কাউকে ভালোবাসি না।

কথা বাড়ায়না দু’জন। তখন আলিশা বলে,

-বান্ধুবীর বিয়ে বলে কথা। চিল কর দু’জন। আর আমার দেবরটেবর থাকলে ইমপ্রেস কর আয় চলে আয় আমার কাছে।

-না থাক।
জবাব দেয় সুমাইয়া। তখন আফিয়া ইসলাম আসেন রুমে। সুমাইয়া, প্রিতীকে দেখে এক গাল হাসেন।

-হালকা নাস্তা করে নিবে চলো। আলিশাকে নিয়ে আসো৷ একটু পর সব শপিং চলে আসবে তোমরা সহ বুঝে নিও সব ঠিকঠাক আছে কী না।

তখন আলিশা এদেরকে তাড়া দেয়।

-চল নিচে চল। এতো চিন্তা করে কিছু হবে না। আমি আলিশা মানে তোদেরই আলিশা বুঝলি?

মাথা নাড়ায় দুজন। আলিশা সহ নিচে যায়। তখন সার্ভেন্ট ওদের নাস্তা এনে দেয়।

******

-ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবি তিন মাসের মধ্যে। আর তোর পাপ আয়মানের নামে যেই প্রোপার্টি দেওয়ার কথা ছিলো সেসব চিন্তা বাদ দে। আমি ডিএনএ টেস্ট করিয়েছি। আয়মানের সাথে আমার কোন কিছুই মিলে না। আর যার সাথে মিলে এসব করেছিস সেও আসছে খুব তাড়াতাড়ি। এবার বিদায় হ আমার বাড়ী থেকে।

সাদিয়াকে বলে রাইহান চৌধুরী। রাইহান চৌধুরীর এমন ব্যবহার সাদিয়া আশা করতে পারেনি। মনে পড়ে সেদিনের কথা।
সাদিয়া একটা অফিসে জব করতো। রাইহান চৌধুরী যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পর তারই কলিগ আলতাফ পারভেজের সাথে বেশ সখ্যাত গড়ে উঠে। পনেরোদিনে কেউ প্রেগন্যান্ট হয় না। কমপক্ষে দেড়মাস তো লাগে বুঝতে। আলতাফ পারভেজের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যাওয়ার দেড় মাস পর সাদিয়া বুঝতে পারে তার মাঝে নতুন প্রাণ আসছে। এই সুযোগ টা কাজে লাগানোর জন্য রাইহান চৌধুরীকে ক্লাবে নিয়ে যায়। ভুলবাল ড্রিং পান করায় কিন্তু সেদিন তাদের মাঝে কিছুই হয়নি। শুধু এটা বুঝাতে চেয়েছে এই পার্টিতে তারা ঘনিষ্ট সম্পর্কে যায় আর সাদিয়া প্রেগন্যান্ট হয়। আয়মান রাইহান চৌধুরীর সন্তান। একদিক দিয়ে নিজের বল হলো অন্যদিকে সংসারটা কীভাবে নিজের করা যায়! রুদ্র রাখিকে দূরে সরিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু রাইহান চৌধুরী একটু ভীতু টাইপ। বেশীরভাগ সময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। এটাকেই কাজে লাগায় সাদিয়া।

#চলবে

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|১৩|
#শার্লিন_হাসান

-কী হলো এখনো দাঁড়িয়ে থাকবি এখানে? যা তোর ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে যা আমার বাড়ী থেকে।

-রাইহান তুমি বুঝার চেষ্টা করো।

-চুপ একদম চুপ। জিয়াউলকে কী বলবি? আমি তার সাথে বেঈমানী করেছিলাম বিজন্যাসে? যা বল গিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। আর কী থ্রেট দেওয়া বাকী আছে? আমার সন্তানদের মেরে ফেলবি? আয় মারতি আয়! তেকে আমি জেলের ভাত না খাইয়েছি। আমার জাফিয়াকে তুই মেরেছিস।

-আমি মারিনি ও হার্ট অ্যাটাক করেছে এটার জন্য তুমি দায়ী রায়হান।

ঠাস করে চড় বসে যায় সাদিয়ার গালে। রক্তচক্ষু করে রাইহান চৌধুরী বলে,

-চুপ একদম চুপ। আমার দোষ দেওয়ার আগে নিজের দিকে তাকা। তুই তো আমায় ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছিস। আমি তো বললাম আমি তোকে ডিভোর্স দেব। তারপর তো গেলি আরেক লোকের কাছে। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করে আমায় ফাঁসালি।

-ওইসব তো!!

-আর একটা কথা বললে তোর লা’শ যাবে। যা বের হ আমার বাড়ী থেকে।

কথাটা বলে সাদিয়াকে ধাক্কা দেয় রাইহান চৌধুরী যার ফলস্বরূপ দরজার বাইরে চলে যায় সাদিয়া।

-যা বের হয়ে যা তোর ছেলেকে নিয়ে।

সাদিয়া আসে আয়মানের রুমে। সে রুমের লাইট অফ করে মুভি দেখছিলো। হঠাত লাইট জ্বলে উঠাতে বিরক্ত হয়। সাদিয়াকে দেখে বলে,

-কী হয়েছে? ডিস্টার্ব করেছো কেন?

-চলে আসো। তোমার বাবা আমাদের বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছে।

-কিন্তু কেন?

-কারণ তুমি তার আসল সন্তান না। আর অতীতের কিছু ঘটনা সামনে এসেছে। চলে আসো এই বাড়ী এই প্রোপার্টির কোন অংশ তুমি পাবে না। তেমার অধিকার ও নেই।

-বললেই হয়ে গেলো। ওই রুদ্র? রুদ্রই তো? সবকিছুর মূল এই রুদ্র তাই না?

ছেলের আশকারা পেয়ে সাদিয়া এবার কেঁদেই দেয়। আয়মান রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে আছে।

-এই রুদ্র। জাফিয়া মরেছে তো রুদ্রকে আর রাখিকে রেখে গেছে আমার সুন্দর সংসারটায় আগুন জ্বালানোর জন্য।

-তুমি চিন্তা করো না মা। রাখির সংসার আর রুদ্রর জীবন হেল করে দিতে আমার কয়েক ঘন্টার ব্যপার। এখন যাও রিলেক্স করো।

-তোমার বাবা তাড়িয়ে দিয়েছে আমায়। তিনমাস পর ডিভোর্স লেটার দিবে। তুমি তার সন্তান নও। এখন তোমার ও অধিকার নেই এই বাড়ীতে থাকার।

-কোথায় যাবো আমরা?

-আমার বান্ধুবার বাসায়। সেখানে বসে নতুন কিছু পরিকল্পনা করা যাবে। শুনেছি চৌধুরী বাড়ীতে নাকী খুশির আমেজ লেগেছে। এই খুশিকে দুঃখে পরিনত করে দিবো।

হাসে আয়মান। ফোন হাতে বেলকনিতে যায়। তার দলের কয়েকজনকে বলে দেয় রুদ্রকে কিডন্যাপ করে মে’রে শহর থেকে দূরে সরিয়ে দিতে।

নিজেও রেডি হয়ে নেয়। সাদিয়াকে নিয়ে লিভিং রুমে আসতে সাদবি আসে। তার মা ভাইকে চলে যেতে দেখে সাদবি বলে,

-কোথায় যাচ্ছো তোমরা?

-চলে যাচ্ছি। তুমি থাকো তোমার বাবার সাথে। আর কখনো আমার মুখ দেখবে না তুমি।

সাদিয়া বলে। সাদবি কোন রিয়েক্ট করে না। তার কাছে এই অন্দরমহল ভালো লাগে না। আর না এই পরিবার তার ইচ্ছে রুদ্র,রাখি,আরিশ,অর্ণব আরোহীর কাছে যেতে। সেই পরিবারের সাথে সময় কাটাতে থাকতে। দাদীর সাথে গল্প করতে। যৌথ পরিবার তার ভীষণ পছন্দের। অথচ নামগুলোই শুনে এসেছে এখন অব্দি কারোর মুখই দেখলো না সাদবি। মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে সাদিয়া আবারো বলে,

-কিছু বলবে না সাদবি?

-কী বলবো? যাও না যাও। আমার ভালো লাগে না তোমাদেরকে। এই আয়মান ভাইয়াই তো রুদ্র ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড কী জেনো নাম হ্যাঁ আলিশা। আলিশা আপুকে রুদ্র ভাইয়ার থেকে সরিয়ে এনেছে। নিজে সম্পর্কে গেছে। রুদ্র ভাইয়াকে আপু ঠকিয়েছে শুধু মাত্র আয়মান ভাইয়ার জন্য।

-মুখ সামলে রাখো সাদবি।

আয়মান বলে। সাদবি পুনরায় বলে,

-কী সামলাবো? আমি সবই শুনেছি তুমি আমার বাবার সন্তান নও। যাও নিজের পরিবারের কাছে। আমার পরিবারের কারোর দিকে চোখ তুলে তাকাবে না তুমি।

-মা দেখো তোমার মেয়ে কেমন।

-পাপা!

ডাক দেয় সাদবি। রাইহান চৌধুরী আসেন। তখন সাদবি বলে,

– এই ছেলেটা আমায় থ্রেট দিচ্ছে। একে বলো চলে যেতে।

সাদবির কথায় রাইহান চৌধুরী গলে যান। তার মেয়েটা চঞ্চল বৈকি তবে আয়মানকে পছন্দ করে না। মূলত তার চলাফেরা কথাবার্তার জন্য। আর না তাদের ভাই বোন হিসাবে কোন ভালো সম্পর্ক ছিলো তেমন। তখন রাইহান চৌধুরী বলেন,

-বেড়িয়ে যা আমার বাড়ী থেকে।

চলে আসে আয়মান এবং সাদিয়া। সাদবি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটা ওতোটাও অবুঝ না। এবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে। মা ভাইয়ের কীর্তি এতোদিন দেখেছে। সেই সাথে আলিশাকে নিয়ে করা নাটক সবই সাদবির জানা।

-আমি দাদীনের কাছে যাবো। তাঁদের সাথে পরিচিত হবো। প্লিজ আমায় নিয়ে চলো বাবা।

-এখন না মা। আমরা আগামী কালকে যাবো।

-আচ্ছা। প্রমিস করো আগামী কালকে নিয়ে যাইবা?

-প্রমিস করলাম।

*****

পরের দিন সকাল থেকে তোরজোর চলছে খান বাড়ীতে। কিছুক্ষণ পর বরযাত্রী আসবে আর বিয়ে হবে। আলিশাকে রেডি করাচ্ছে পার্লারের মেয়েরা৷

এরই মাঝে খবর আসে বর এসেছে। সবাই বর দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে প্রিতী,সুমাইয়া আলিশার কাছেই বসে থাকে। তারা রুদ্রর কথা ভাবছে। আহারে! কিছুই তো জানে না রুদ্র।

বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু করবে এমন সময় কোথা থেকে আয়মান আসে সাথে আসে তার দলবল। বাক্যব্যায় না করে হবু বর এবং বাকীদের মাথায় রিলভার ঠেকায় তার লোকেরা। আশরাফ খান তাঁদেরকে বাঁধা দিতে যায় তখন আয়মান বলে,

-শ্বশুর মশাই আমি আমার বউকে নিতে এসেছি। বিয়েটা আগেই হয়ে গেছে আমাদের। আমার বউকে অন্য কারোর হাতে তুলে দিবেন আমি চেয়ে, চেয়ে দেখবো নাকী?

বাক্যহারা হয় আশরাফ খান। ইতোমধ্যে শোরগোল, কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। আয়মান সেসব উপেক্ষা করে আলিশার রুমের দিকে অগ্রসর হয়। আলিশাকে বউ সেজে বসে থাকতে দেখে মেজাজ বিগড়ে যায়। আয়মানকে দেখে উঠে দাঁড়ায় আলিশা। এরই মধ্যে আয়মান স্ব জোরে চড় বসিয়ে দেয় আলিশার গালে। গাল চেপে ধরে বলে,

-এতো বাড় বেড়েছিস তুই? আমাকে ধোঁকা দিবি? কী মনে করেছিস আয়মান আরহাম চৌধুরীর কানে কোন খবর যায় না? আমি রুদ্র না যে অন্ধের মতো পড়ে থাকবো। আয় এক্ষুনি তোর বাবা মায়ের সামনে তোকে বিয়ে করবো আর প্রোপার্টি তোর নামে লেখাবো।

আলিশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কান্না থামছে না। প্রিতী সুমাইয়া এগিয়ে আসতে যাবে আয়মান হাতের ইশারায় থামিয়ে দেয়। আলিশাকে টেনে নিচে আনে। বাকীরা চুপচাপ কারণ তাদের অনেকের মাথায় রিলভার ঠেকানো। তখন আলিশা আয়মানের হাত ঝাড়ি মেরে সরিয়ে দেয়।

-ডোন্ট টাচ্ মি! গেট লস্ট।

পুনরায় আয়মান আলিশার হাত ধরে শক্ত করে। বাক্যব্যায় না করে নিচে আসে। আলিশাকে সোফায় বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসে, কাজীকে বলে,

-বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।

কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করে। আয়মান তিনবার কবুল বলে ফেলে আলিশাকে কবুল বলতে বললে আলিশা চুপসে যায়। সে কবুল বলবে না। আয়মান বিশ্রী কয়টা গালি দেয় আলিশাকে। ধমকের স্বরে বলে,

-প্রেম করার সময় মনে ছিলো না জান? এখন বিয়ে করতে কেনো এতো কষ্ট?

-আমি বিয়ে করবো না। রুদ্র কোথায়?

আবারে চড় বসে যায় আলিশার গালে। ধমক দেয় আয়মান।

-কবুল বলবি?

-না।

-তাহলে তোর বাবাকে তোর সামনে গত করে দেই?

-না,না। কবুল বলবো।

-বল তাহলে?

-কবুল,কবুল,কবুল।

আলিশা বলে আয়মান উঠে দাঁড়ায়। আশরাফ খানের সামনে এসে বলে,

-বিয়েটা তো হয়ে গেলে শ্বশুর মশাই এবার থাকার ব্যবস্থা করুন আপনার একমাত্র মেয়ের এবং মেয়ের জামাইয়ের।

উত্তর দেয় না আশরাফ খান। আয়মান অনুমতি দিতে রিলভার নামায় তার লোকেরা। তখন শাহরিয়ার সায়ন্তিক শিকদার উঠে দাঁড়ায়। আশরাফ খানকে বলে,

-ছিঃ আংকেল ছিঃ। মেয়েকে তো শিক্ষা দিতে পারেননি শুধু,শুধু আমাদের সময় আর টাকা নষ্ট করালেন। এর ক্ষতি পূরণ না দিলে আপনার নামে কেস করবো।

সায়ন্তিকের কথায় অনেকে অবাক হয়। এই জেনো নিয়ম উল্টে নিলো। বিয়ে করতে এসে বিয়ে করতে পারেনি বলে সময় আর টাকার ক্ষতিপূরণ চায় হবু বর। আশরাফ খান বললেন,

-আগে মেয়েটাকে শিক্ষা দেই তারপর ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি তোমার। এখন আসতে পারো।

আশরাফ খানের কথায় শিকদার পরিবার চলে যায়। আলিশা দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে কাদছে। আশরাফ খান পুনরায় চড় মারে আলিশাকে। চড়টা একটু বেশী জোরে পরেছে যার দরুন আলিশা নিচে পড়ে যায়। চিৎকার করে উঠে আশরাফ খান।

-এক মাত্র মেয়ে আদরে যত্নে বড় করেছি এতো সুন্দর দিন,সময়,সন্মান উপহার পেতে। ছিঃ!

-প্রোপার্টিটা মেয়ের নামে লিখে দিন শ্বশুর মশাই।

আয়মানের কথায় আশরাফ খান তার গালেও চড় বসিয়ে দেয়। তবে একটা না দুই দু’টো চড়।

-প্রোপার্টির জন্য আমার মেয়েকে ফাসিয়েছো? গুন্ডা কোথাকার। যাও বেড়িয়ে যাও তোমার বউকে নিয়ে খান মহল থেকে। আমার মেয়ে নেই আজকে থেকে আর মেয়ের জামাই তো দূরে থাক।

-আলিশা তোর বাবাকে বল প্রোপার্টি তোর নামে লিখে দিতে।

উঠে দাঁড়ায় আলিশা। নিজেও স্ব জোরে চড় বসিয়ে দেয় আয়মানের গালে। রেগে যায় আয়মান। এরা বাপ মেয়ে দু’জন তার গাল দুটোকে সরকারি পেয়েছে। একটু পর পর শুধু চড় দিচ্ছে।

-জানো’য়া র কোথাকার। এই ছিলো তোর আসল উদ্দেশ্য? আমায় ঠকালি তুই। আমাকে আমার রুদ্রর থেকে কেড়ে নিলি? আসলে ঠিকই বলেছিস রুদ্র একপিস। রুদ্র, রুদ্রই রুদ্রর মতো কেউ হয়না। এমন রুদ্র হতে হলে তোকে হাজার বার জন্মগ্রহণ করতে হবে। দুইদিন না যেতে নিজের আসল রুপটা দেখিয়ে দিলি। আর রুদ্রর সাথে আমার সাড়ে তিনবছর সম্পর্ক ছিলো কোনদিন তুমি থেকে তুই শব্দটা মুখে আনেনি। তোর পারিবারিক শিক্ষার অভাব আছে বুঝলি?

-এই জানো য়া রে র সাথে তোকে বাকীটা জীবন কাটাতে হবে আলিশা।

কথাটা বলে আলিশার হাত টেনে হিচড়ে বাইরে নিয়ে আসে আয়মান। আলিশার কান্না পাচ্ছে। ভীষণ রকমের কান্না পাচ্ছে। রুদ্রকে ঠকালো সে আর আজকে সে বাজে ভাবে ঠকে গেলো। নিজের ভুলের জন্য আফসোস হচ্ছে বড্ড বেশী আফসোস হচ্ছে তার। আয়মান! তাকে কতোই না ভালো ভেবেছে আলিশা। অথচ মানুষ রুপী জানো য়া র একটা। এই জন্য বলে কারোর মিষ্টি কথায় না ভোলা আর কারোর চোহারা দেখে মিষ্টি কথা দেখে বিচার করা ঠিক না। সময় মতো আসল রুপ বেড়িয়ে আসে। এই রুদ্র যাকে আলিশা নব্বই দশকের প্রেম কাহিনী নিয়ে পড়ে থাকে। নব্বই দশকের প্রেমকাহিনী তুলে ধরতে চেয়েছেন আজকে আলিশার সেই নব্বই দশকের প্রেমকাহিনী তুলে ধরতে চাওয়া প্রেমিককে মনে পড়ছে। খুব করে চাইছে তাকে।
তার সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো চোখের সামনে ভাসছে।

#চলবে