বাঁধনহীন সেই বাঁধন অকারণ পর্ব-১৭+১৮

0
580

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|১৭|
#শার্লিন_হাসান

শপিং শেষ করে রওনা দেয় সবাই। মেহরাব রুদ্রকে সামলানোর চেষ্টা করছে তবে কাউকে কিছু বুঝতে দিচ্ছে না। সাদবি রুদ্রর মুখের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। রুদ্রের মুখটা দেখে তার না চাইতে কেনো জানি কান্না আসছে। চোখেমুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।
মানুষ তো কেবল স্বান্ত্বনা দেয়৷ কিন্তু যার হারায় সেই বুঝে।
সাদবি ফোন হাতে আয়মানের আইডি স্ক্রোল করছে। কয়েক ঘন্টা আগে আয়মান পোস্ট দিয়েছে তার আর আলিশার কিছু পিক। সাথে কয়েকটা ডে ও আছে।

আরিশ,অর্ণব এতোক্ষণে বুঝে গেছে সবকিছু। কিছু বলেনি কেউ। সবাই বাকরুদ্ধ বিশেষ করে আয়মানের ক্যাপশন পড়ে। যেটাতে লেখা আছে,

-আমার ভালোবাসা, আমার বউ। যাকে প্রথম দেখায় আমার ভালো লাগে! অনুভূতি কী বুঝিনি তবে কয়েকদিন যেতে মনে হলো সে আমার ভালোবাসা। কথায় আছে না ভালোবাসার মানুষকে দূরে রাখতে নেই। নিজের করে নিতে হয়! আমিও সেটাই করলাম। ছয়মাসের মাঝেই গতকালকে বিয়ে করে নিলাম। সবাই দো’আ করবেন আমাদের জন্য।

সাথে আলিশার আইডি ট্যাগ দেওয়া। রাখি সে তো চুপচাপ বসে আছে।
চৌধুরী বাড়ীতে আসতে যে যার মতো রুমে চলে যায়। রুদ্রকে কেউ কিছু বলবে না। বলেও লাভ নেই,রুদ্র কারোর কথা শুনবে না। তার মুভ অন করতে,করতে কতমাস যায় আল্লাহ ভালো জানে। এমনিতে চুপচাপ গম্ভীর মানুষ তারউপর যদি হার্ট হয়ে হার্ট অ্যাটাক করে বসে?
রাখির ভাইকে নিয়ে চিন্তা যাচ্ছে না। বাজে ভাবে ঠকে গেলো তার ভাই।

রুমে এসে রুদ্র লাইট অফ করে দেয়। হাত পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। না চাইতে চোখের পানি পড়ছে তার। আলিশা তাকে জঘন্যভাবে ঠকালো। এই ছিলো সাড়ে তিনবছরের ভালোবাসা! যে ব্যক্তি জীবনের একাংশ জুড়ে ছিলো সেই ঠকিয়ে ছেড়ে গেলো।
কান্না করছে রুদ্র। হাউমাউ করে কান্না করছে। ছেলে মানুষ সহজে কান্না করে না। রুদ্রর মনে হলো কতগুলো বছর পর সে এভাবে কান্না করছে। কঠোর হৃদয়ের মানুষটাও কারোর জন্য কান্না করছে চার দেওয়ালের ভেতরে। আসলেই সত্যিকারের ভালোবাসা এমনই! কয়জনের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়? হাজারে দু একজন। এমন হাজারো রুদ্র কাঁদে আড়ালে, হাজারো রুদ্র হেরে যায় ভালোবাসার কাছে, হাজারো রুদ্র হারায় নিজের প্রিয়তমাকে।

****

ফেবু স্ক্রোল করছে মেঘ। আলিশার আইডি সার্চ দিতে আয়মানের দেওয়া পোস্টটা তার সামনে আসে। তাতেই জেনো বাকরুদ্ধ হয়ে যায় মেঘ। ছবিগুলো দেখে চিনতে ভুলহয়নি মেঘের। আলিশার সাথেই ছবিগুলো। কেনো জেনো সব মিছে স্বপ্ন মনে হয় মেঘের কাছে। সে তড়িঘড়ি গ্যালারীতে গিয়ে তাদের পিক গুলো দেখলো। সাথে আলিশা রুদ্রর কয়টা পিক। এই তো কয়েকমাস আগেও আলিশা রুদ্রর ছিলো। তার মানে কক্সবাজারে থাকা কালীন ও আয়মানের সাথে রিলেশন ছিলো আলিশার?

-আচ্ছা তখন কী আলিশা আয়মানের সাথে মেসেজ করছিলো? যখন আমি পেছন থেকে গিয়েছিলাম আর সে কিছু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে? আর আলিশার বলা ধোঁয়াশা জিনিসটা কী? এই রুদ্রর প্রতি ভালোবাসাটা?

এরই মাঝে হৃদের কল আসে। মেঘ তড়িঘড়ি রিসিভ করে। অপরপাশ থেকে হৃদ বলে,

-ঈদ মোবারক বাঙ্গির ছিলকা । তোর ক্রাশ হোয়াইট মুরগির গার্লফ্রেন্ড তো আরেকজনের বউ হয়ে গেলো।

-তুই জানলি কীভাবে?

-তোর ফোনে যে ফাদার আর আলিশা মাদারের পিক দেখলাম এখন ভার্সিটির বড় ভাই আয়মান আরহাম চৌধুরীর পোস্ট দেখলাম। মাদারকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

-শালা ফাদার মাদার বাদ দিয়ে সুন্দর ভাবে কথা বল। আর তুই আয়মান নাকী কী জেনো নাম ওনার আইডি ফেলি কোথায়?

-তুই কী গাধা? কত মানুষের সাথে আমার এড আছে ফেবুতে। আর ছেলে মানুষ শুধু কয়েকজনকে লিস্টে রাখে না…

-পারলে পুরো ফেসবুকের যত নারী আছে, সাদিয়া,সুমাইয়া,মিম আরো কী,কী জানি এদের সবাইকে লিস্টে রাখে। বেডা জাত বলে কথা।

-দেখ বাঙ্গির ছিলকা সন্মান দিয়ে কথা বলবি। বেডা জাত কে? তোর ক্রাশ জাতির ফাদার তোর ও হিসাবে ফাদার উনিও কিন্তু বেডা।

-আমার ক্রাশ ব্রাদার উনি লয়্যাল বুঝলি? মেয়েদেরকে জুলিয়ে রাখে। তোর মতো আলু,পটল,গাজর,ফুলকপি লিস্টে নেয় না।

-অপমান না করলেও পারতি বাঙ্গির ছিলকা। এখন তো তোর ঈদ।

-ধুর কিসের ঈদ? খারাপ লাগছে রে। রুদ্র স্যার আলিশা আপুকে অনেক ভালোবাসতো। তাঁদের লাভ স্টোরি দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।

-গোপনে অন্য বা*তা*** রাখে আবার এনে আসে রিয়েল লাভের অভিনয় করতে। মুগ্ধ হলে তোর মতো আবা*ল ই মুগ্ধ হবে আমার মতো ম্যাচিউর ছেলে না বুঝলি?

-পটলের বাচ্চা পটল আইছে আমার ম্যাচিউর পোলা। যেই না ম্যাচিউর আবার মাইশা পাত্তা দেয়না সেই দুঃখ প্রকাশ করে। শা*লা তুই এতো ম্যাচিউর হলে মেয়েদের পেছনে ঘুরিস কেন?

-দেখ বাঙ্গির ছিলকা তুই আমায় একটু বেশী অপমান করছিস৷ দো’আ দিলাম ওই ফাদারও তোর কপালে জুটবে না।

-পটলের বাচ্চা পটল দো’আ দিলাম কোন বেডি তো তোর কপালে জুটবোই না! দু একটা থার্ড….”

-রাখি ভাই। তুই মুখের ভাষা ঠিক কর। জাতির ফাদারের প্রিন্সেস।

হৃদ কল কেটে দেয়।
-শেষ এটা কী বললো? শা*লা হারামি? রুদ্র আমার ক্রাশ! বেয়াই মানে ব্রাদার ফাদার হয় কীভাবে বুঝি না? ফাদার বলে ইট’স ওকে বাট তাই বলে ফাদারের প্রিন্সেস মানে মেয়ে বানিয়ে দিবে?
বজ্জা*ত জীবনে মাইশা পাত্তা দিলেও তোর নামে এমন কুট কাঁচালি করমু যাতে মাইশা তোর কপালে উষ্ঠা দিয়ে চলে যায়। প্রেম তো দূরে থাক।

-হাই বউমনি?

মিসবাহর কন্ঠ শোনে মেঘ মনে,মনে দো’আ দুরুদ পড়ে। এই বুঝি নিবরাস আসলো তাকে ডেকে নিয়ে গেলো।

-আচ্ছা এর মা কই থাকে? পাকনা বাচ্চা এতো ডাকডাকি কিসের? তাও আবার বউমনি। মনে হয় তার মামার বিয়ে করা বউ আমি।

তখন আবার মিসবাহ ডাক দেয়,

-এই যে মেঘ আন্টি।

তাকায় মেঘ।
-যাক বাচ্চাটা এখন লাইনে এসেছে।

-বলো মিসবাহ?

-কী করো আন্টি?

-দো’আ করছি বাচ্চা।

-কেনো আন্টি কী হলো?

-কিছু হয়নি বাচ্চা। আমি দো’আ করছি তাড়াতাড়ি যাতে আমার বিয়েটা হয়ে যায়। তোমার আংকেলকে পেয়ে যাই।

-আমিও দো’আ করি তাড়াতাড়ি তুমি আমার মামার বউ হয়ে যাও।

-ধুর কী যুগ আসলো বাচ্চা গুলোও দেখি ঠোঁটকাটা তবে এই বাচ্চাটা একটু বেশীই৷ যাও বাচ্চা ঘুমাও!
বিড়বিড় করে মেঘ। মেকি হাসি টেনে বলে,

-তোমার পড়াশোনা নেই বাচ্চা? বয়স তো মনে হয় দশ পেড়িয়ে এতো তাড়াতাড়ি এতো পাকনা হয়ে গেলে?

-আমি পাকিনি গো আমার মামা আমায় ফরমালিন দিয়ে পাকিয়েছে।

মিসবাহ র এমন কথায় মেঘ তাকায়। এই বাচ্চা আসলেই ওভার। কানের নিচে দু’টো দিয়ে পড়তে বসানো দরকার।

– বাচ্চা তোমার মতো থাকতে মা পড়ার টেবিলে বসিয়ে রাখতো। আর মামার সাথে দেখা হলে সালাম দিয়ে খেলতে চলে যেতাম। আর তুমি এখানে মামার ঘটক গিরি করছো?

-আসলে কী আন্টি আমার নানু বুঝে না কেনো জানি। মামু বিয়ে করবে আমার মামনি আসবে কত মজা হবে।

-আচ্ছা মিসবাহ আমি গেলাম। বাবা আর জ্বালাস না। তোমার মামুর বিয়ে ঠিক হলে চার ঠ্যাংয়ে লাফিয়ো।

মেঘ উঠে চলে আসে। মনে হচ্ছে আগামী কালকে সে বাড়ী চলে যাবে। এই বাচ্চা আর বাচ্চার মামা তার পেছনে পড়েছে। উফফ অসহ্য!

রাতে ডিনার করে মায়া,মোহনার সাথে আড্ডা দিচ্ছে মেঘ। রুদ্রর জন্য খারাপ লাগছে তার। ইশশ! লোকটা জানি এখন কী করছে? কান্না করছে? মন খারাপ করে আছে? কীভাবে কী? এই আলিশা?

মেঘের মুড অফ দেখে মোহনা বলে,

-তোর ক্রাশ বিয়ে করে নিলো নাকী?

-না! ক্রাশের গফ তাকে ব্রোকেন বানিয়ে অন্য ছেলেকে বিয়ে করে নিয়েছে।

তখন মায়া বলে,

-তাহলে তোর রাস্তা ক্লিয়ার। লোহা গরম হাতুড়ি মেরে দে। এমনটা জেনো না হয় ও হাত ছাড়া হয়ে গেলো।

-রাখ তো হাতছাড়া। আমার রাস্তা ক্লিয়ার টিলিয়ার না। আর রুদ্র স্যারকে আমি ভালোবাসি ঠিক আছে তবে এখন আর চাই না সে আমার হোক।

-এমাহ্ কেন?

-বারে উনি আলিশা আপুকে ভালোবাসতো এখনো বাসে,ফিউচারের টা জানি না। উনার লাইপে আমি গেলে আদৌ ভালোবাসা পাবো? উঁহু! পাবো না। আর আমি ভালোবাসার কাঙ্গাল বুঝলি? আমি কী করে সহ্য করবো আমার মানুষটা আমি থাকতে এখনো অন্য কাউকে ভালোবাসবে? আর আমি যাকেই ভালোবাসি না কেন আমি চাই আমার মানুষটা শুধু আমায় ভালোবাসুক। একান্ত আমার হোক।

-সর এন্তে আলুর খোসা। নিজে আরেক বেডারে ভালোবাসবি আর নিজের বেডায় তোরে ভালোবাসবে?
লোকটার সাথে বেঈমানী হয়ে যাবে না?

-মোহনা আপু মায়ার বাচ্চার মুখে স্কচটেপ লাগাও। আমি কী বলছি নাকী আমি আমার মানুষকে ভালোবাসবো না?

-তাহলে রুদ্রকে ভুলে যা।

-হ্যাঁ যাবো সময় হলেই।

-হু এখন দো’আ করি তাড়াতাড়ি তোর বিয়েটা হয়ে যাক।

-দো’আ কর বইন। এই শহর ছেড়ে যাতে দূরে কোথাও চলে যেতে পারি।

-না এতো দূরে যাওয়ার দরকার নাই। জাস্ট ইমাজিন এখান থেকে গেলি আর তোর বিয়েটা হয়ে গেলো কারোর সাথে। তখন ফিলিংস?

-শান্তি,শান্তি,শান্তি।

*****

পরের দিন সকালে তোর জোর চলছে চৌধুরী বাড়ীতে। আরোহীর হলুদ সন্ধ্যা। যদিও রুদ্র কারোর সাথে কথা বলেনি। চুপচাপ সোফায় বসে আছে। রাখি নোটিশ করেছে রুদ্র নাস্তাও ঠিক মতো খায়নি। ফাইজা চৌধুরীর কাছে যায় রাখি। তাকে আড়ালে ডেকে আনে।

আলিশার বিয়ের ছবি দেখায় ফাইজা চৌধুরী। সাথে সব খুলে বলে। ফাইজা চৌধুরী সিদ্ধান্ত নেয় রুদ্রকে বিয়ে করিয়ে দিবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যে যেখানে পায় পাত্রি খোঁজার কাজে নেমে পড়তে। তবে রুদ্রকে যাতে না বলে তার জন্য পাত্রি খোঁজা হচ্ছে।

রাখি সোফায় বসে আছে। তার জানা শোনায় তেমন কেউ নেই। কিন্তু ভয় হয় যদি রুদ্র আলিশাকে মনে রাখে সবসময়। তার স্ত্রীকে শুধু রেসপন্সিবিলিটি হওসাবে নেয়। ভালো না বাসে তাহলে? মেয়েটার কী দোষ? কিন্তু রুদ্র!

রোশানদের বাড়ীতে ও অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। রিলেটিভিট সবাই এসেছে। আফিয়া ইসলাম, আরিয়া ইসলামকে সব বললেন। সাথে আলিশার সিদ্ধান্ত। আরিয়া ইসলাম পারছে না এখনি আয়মানকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়।

আলিশাকে সে নিজের মেয়ের মতো দেখে। সেজন্য আলিশাকে নিজের কাছে রেখে দিতে চেয়েছে। কিন্তু রোশান তো এখন মানবে না। আর চৌধুরী বাড়ীতে কথা দিয়েছে, বিয়ে ঠিক সব ঠিক এমনকি ছেলেও রাজী সেখানে তার করার মতো কিছুই নেই।

চৌধুরী বাড়ীতে গান বাজনা উৎসব পূর্ণ আমেজ। আরিশ,অর্ণব তারা বেশ উপভোগ করছে। আরিশের মনে হলো মেঘ থাকলে খারাপ হতো না। কিন্তু এই মেয়ে আস্ত এট্টিটিউড ওয়ালি। চৌধুরী বাড়ীর বিয়েতে আসলে মনে হয় ভাব কমে যাবে। বুঝে না আরিশ। তারা কী তাকে খেয়ে ফেলবে? নাকী মেরে ফেলবে? কোনটাই না। তাহলে আসলে কী হয়?

*******

সাদিয়া,আয়মান বসে আছে। আলিশার খোঁজ নেয়নি আর আয়মান। বর্তমানে তার দরকার প্রোপার্টি সাথে ব্যাংকে কয়েক লাখ টাকা।

-যাও তোমার তো অধিকার আছে রাইহান চৌধুরীর উপর। এখন বসে আছো কেন? সে বললেই হবে নাকী? তুমি তো তার স্ত্রী।

-সে আমায় না রাখলে আমি কী জোর করে যেতে পারি?

-তোহ রুদ্রর মা’কে মারার পর আবার তোমাদের বিয়ে হলো কীভাবে?

-ওকে আমি ব্লাকমেইল করেছি। জাফিয়ার ভাই জিয়াউলকে সে ঠকিয়েছে। কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। যেটা জিয়াউল জানে না। এখনো বিজন্যাস পার্টনার রেখেছে তাকে। আমি বলেছি সব বলে দেবো জিয়াউলকে। আর জিয়াউল যদি পুলিশ কেস করে ওর বিজন্যাস,ইন্ডাস্ট্রি সব ধুলোয় মিশে যেতে সময় লাগবে। বিজন্যাসটা গড়ে উঠানো কঠিন তবে ধুলোয় মেশানো সহজ। ছোট্ট থেকে ছোট্ট ভুলের জন্যও অনেক সময় সব শেষ হয়ে যায়।

#চলবে

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|১৮|
#শার্লিন_হাসান

দেখতে,দেখতে আরোহীর বিয়ের দিন চলে আসে। সকাল থেকে মানুষের আনাগোনা চৌধুরী বাড়ীতে। সবার বেশ ব্যস্ত সময় কাটছে৷ রাখি আরোহীর পায়ে আলতা পড়িয়ে দিচ্ছে।

রুদ্র বাকীদের সাথে কাজে ব্যস্ত। আফরোজা বেগম এবং মহীউদ্দীন তালুকদার এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। তাদেরকে আপ্পায়ন করছে রুদ্র,ফাইজা চৌধুরী। রুদ্র কিছুটা সরে আসতে ফাইজা চৌধুরী বললেন,

-মেঘকে তো আনলেন না। মেয়েটা থাকতো,মজা করতো। কী দরকার ছিলো দূরে পাঠানোর?

ফাইজা চৌধুরীর কথায় আফরোজা বেগম বলেন,

-ও আসবে না। বাড়ীতে থাকলেও আসতো না।

-এতো আসবে না আসবে না করছে যদি একবারে নিয়ে আসি তখন? তখন কোথায় পালাবে?

-তখন পালানোর সুযোগ থাকবে না।

আফরোজা বেগমর কথায় হাসে ফাইজা চৌধুরী। মহীউদ্দীন তালুকদার বসে আছে দেখে ফাইজা চৌধুরী আর দেরী করেনি চটজলদি বলে দিলেন,

-মেঘকে বিয়ে সাদী দিবেন তো?

-সবে মাত্র ইন্টারে পড়ে। কমপক্ষে এইচএসসি দেক।

-আরে সেসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমাদের বাড়ীতে আসলে এখান থেকে কলেজ যাবে। আর তাছাড়া রুদ্র যেই কলেজে জব করে সেই কলেজেই তো ও পড়াশোনা করছে। রুদ্র তো আর না করবে না পড়াশোনা নিয়ে। ইনডিরেক্টলি বলে দিলো ফাইজা চৌধুরী রুদ্রর জন্য মেঘকে আনতে চায়। তখন মহীউদ্দীন তালুকদার বললেন,

-মন্দ নয় ব্যপারটা। দেখি ভেবে দেখি।

-কোন ভাবাভাবি নেই। আমাদের মাঝেই তো! এই বিয়ের ভেজাল গেলেই আমরা মেঘকে দেখতে যাবো। আমি থাকতে,থাকতে আমার নাতি-নাতনি দুটোকে এক কূলে করে দিয়ে যাবো।

-মেহরাবের সাথে কথা বলে দেখি।

-আচ্ছা ঠিক আছে। তবে বলে রাখি আমার রুদ্রকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। ও মেঘের পড়াশোনা কন্টিনিউ করাবে।

-আচ্ছা।

*****

– তোমার নাম কী?

জিজ্ঞেস করলেন মরিয়ম নওয়াজ। মেঘ সোফায় বসে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এখন এখান থেকে উঠে যেতে পারলেই হলো। এই মহিলা যেভাবে ধরেছে মনে হয় তাকে দেখতে এসেছে। বিরক্ত বোধ করে মেঘ। তবুও মুখে হাসি টেনে বলে,

-এই তো আন্টি আমার নাম মারশিয়া জাহান মেঘ।

-বাহ বেশ মিষ্টি নাম তো।

মরিয়ম নওয়াজের কথায় মেঘের আন্টি আজিয়া হেসে বলেন,

-হ্যাঁ ভাবী আমার মেঘ নামের মতোই সুন্দর এবং মিষ্টি।

-এমন একটা মেয়ে আমার নিবরাসের জন্য খুঁজছি। মেঘকে আমার পছন্দ হয়েছে। এখন শুধু দেখাশোনা আর বিয়ের পালা।

মরিয়ম নওয়াজের কথায় আজিয়া হাসে। মেঘ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। এই মহিলা মিসবাহর থেকে কোন অংশে কম না। কী সুন্দর বসে,বসে সামনাসামনি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। ভাবছে না সামনে বসে থাকা মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে কীনা। এরা নানি নাতি দু’টো পড়েছে বিয়ের পেছনে সেই সাথে মেঘের পেছনে।

-আন্টি আমি আসি তাহলে।

কথাটা বলে মেঘ ভেতরে চলে আসে। মেজাজ তার এতো বেশী খারাপ। সেই আরিশ আর রুদ্রর জন্যই তো চৌধুরী বাড়ীতে যায়নি এখানে বেড়াতে এসেছে। লাভটা হলো কী? এখানে এসে নিবরাস অভদ্র লোক। সেই সাথে তার অভদ্র ভাগিনা,মা।

রাগটাগ কমিয়ে মেঘ বসেছে। ভাবছে এখন বিয়েটা হয়ে গেলে মন্দ হয়না। অন্তত রুদ্রর প্রতি সব অনুভূতি, আবেগ মাটি করতে পারবে। কিন্তু নিবরাস? এই নিবরাসের সাথে বিয়ে হলে কী সব শেষ? যাই হোক রুদ্রর প্রতি আর দুর্বল হওয়া যাবে না। আলিশা রুদ্রর জীবনে নেই এটা ভেবেও দুর্বল হওয়া যাবে না তার প্রতি। এই এক তরফা ভালোবাসা এক তরফাই সুন্দর। পূর্ণতা পেলেও অপূর্ণতার মাঝে কাটাতে হবে। রুদ্র কোনদিন তাকে ভালোবাসবে না।

*****

বর এসেছে কথাটা কানে বাজতে উঠে দাঁড়ায় রাখি সেই সাথে সাদবি। কই তাদের পরিবারে তেমন মেয়ে নেই। এই তিনজন ছাড়া। মেঘ আসলে কতই না ভালো হতো ভেবে আফসোস করছে রাখি। তবুও তারা দুজন গেটের সামনে যায়। সেখানে কিছুক্ষণ মজা করে টাকা নিয়ে বরকে ভেতরে আসতে দেয়।

কথাবার্তা, ফটোশুট এসবের মাঝেও কিছু সময় চলে যায়। কাজী এসে বিয়ে পড়ানো আরম্ভ করে দেয়। সুন্দর ভাবে বিয়েটা শেষ হয়। খাওয়াদাওয়া এসবের মাঝে টুকাটাক কেটে যায়।

বিদায়ের সময় আসতেই কান্নার রোল পড়ে যায়। আরিশ,অর্ণব,রুদ্র তারা আরোহীকে বিদায় দিয়ে বাড়ীতে ঢুকে যায়। অগোছালো সব গোছাতে হবে। বাড়ীটা পুরো এলোমেলো হয়ে আছে।

হাতের কয়টা কাজ সেরে রুদ্র রুমে চলে আসে। আলিশা অন্য কারোর সাথে সংসার করছে। অন্য কাউকে নিয়ে ভালো আছে। তাকে শুধু টাইমপাস করলো। মনটা খাঁ খাঁ করছে। কতদিন হয়ে গেলো আলিশাকে দেখে না রুদ্র। আর কোনদিন দেখতে চায় ও না। রুদ্র।

তার পেছন দিয়ে ফাইজা চৌধুরী আসে রুদ্রর রুমে। নিজেকে সামলে নেয় রুদ্র। তখন ফাইজা চৌধুরী বলেন,

-রুদ্র তোমার তো বিয়ের বয়স হয়েছে। আমি চাই তুমি বিয়ে করো এবং সেটা আগামী মাসের মধ্যেই।

-কিন্তু দাদীন।

-কোন কিন্তু না রুদ্র। আমার প্রতি তোমার ভরসা আছে তো?

-আছে।

-তাহলে তুমি নিশ্চিত হও। দাদীন তোমার জন্য যোগ্য কাউকে আনবো। আর আলিশা টালিশা বাদ দাও। বে’য়াদব মেয়ে আমার রুদ্রকে কষ্ট দেয়৷ আর শোনো ওর মতো হাজার আলিশা আসবে যাবে বাট আমার রুদ্র একপিস। হাজার আয়মান আসবে আর যাবে আমার রুদ্র কিন্তু একপিস।

-হু!

ফাইজা চৌধুরী চলে আসেন। নাতিকে এভাবে মরার মতো পড়ে থাকতে দেখতে তার ভালো লাগে না৷ ছোটবেলা থেকে মা ম’রা ছেলে। তবুও তিনি আগলে রেখেছেন নিজের সন্তানের মতোই। কোন কিছু ত্রুটি রাখেননি তবে মায়ের মতো তো আর হওয়া যায় না। মা তো মা-ই। রুদ্রকে অন্য সব নাতিনাতনির থেকে একটু আলাদা রকমের ভালোবাসেন ফাইজা চৌধুরী। তার বড় ছেলের বড় নাতনি সেই সাথে পরিবারের বড় ছেলে রুদ্র। আলাদা টান তো থাকবেই।

এর পেছন দিয়ে সাদবি ফাইজা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে।

-এই দাদীন তুমি আমার সাথে গল্প করবে?

সাদবির আবদারে মুচকি হাসে ফাইজা চৌধুরী। চটজলদি বলে দিলেন,

-হ্যাঁ চলো।

সাদবি খুশি হয়ে যায়। ফাইজা চৌধুরীর রুমে চলে আসে। দুজন মিলে গল্প গুজবে মেতে উঠে। সাদবি তার কলেজ,ফ্রেন্ডস সব কিছু ফাইজা চৌধুরীকে বলছে। ফাইজা চৌধুরী শুনে যাচ্ছে। তার পেছন দিয়ে অর্ণব আসে রুমে। সাদবিকে দেখে ফাইজা চৌধুরীকে বলে,

-শুধু নাতনিকে নিয়েই পড়ে থাকো আমি যে আছি সেটার খোঁজ নিয়েছো তুমি?

হাসে ফাইজা চৌধুরী। অর্ণবকে বসতে বললেন তিনি। অর্ণব বসতে তার মাথায় হাত ভুলিয়ে দেন।

-মনে আছে সব। আগে রুদ্রর বিয়েটা হোক তারপর তোমার বিয়েটা দেবো। আমার সব নাতিনাতনি দের বিয়ে দিয়ে আমার পরিবার আবারো সম্পূর্ণ করবো।

-এখন বউ না হলেও চলবে তুমি আছো না।

-দাদীন আমি আর তুমি গল্প করছি। ভাইয়া মাঝখানে আসলো কেন? তুমি না আমার সাথে গল্প করছো। এই তুমি যাও তো যাও। সারাবছর তো দাদীনের কাছেই থাকো আমি মাত্র আসলাম দুইদিন।

-এই মেয়ে তুমি হিংসে করছো? এতো হিংসুটে তুমি? দাদীন তোমার একার নয় আমারও দাদীন।

-কোথায় হিংসে করলাম আজব? আমি দাদীনের সাথে কথা বলছি তুমি মাঝখানে বা হাত ঢুকালে কেন?

-দেখো দাদীন দেখো তোমার এই নাতনি কী ঝগড়ুটে।
কথাটা বলে মুখে থাকা সুইং গাম সাদবির চুলে লাগিয়ে দেয়। সাদবির পেছনে দাঁড়িয়ে। মুখ বাকিয়ে বলে,

-বড় হই তোমার সন্মান দিবা বুঝলে? আর যদি সন্মান কীভাবে দিতে হয় সেটা না জানো আমার কাছে এসো শিখিয়ে দেবো।

অর্ণব উঠে চলে যায়। সাদবি সেদিকে মুখ বাকায়। ফাইজা চৌধুরীকে বলে,

-এতো ঝগড়ুটে কেন তোমার নাতি? আমার রুদ্র ভাই,আরিশ ভাই তারা কত ভালো,মিশুক।

-ও এমনই। শুধু,শুধু তেমায় ঝগড়ুটে বলে ও তো জানে না ও নিজেই একনাম্বারে ঝগড়ুটে।

-বাদ দাও ওর কথা। ঝগড়ুটে ছেলে।

*****

-হ্যাঁ মাইশা পাশের ফ্লাটে ভাবীর বোনের মেয়েটাকে দেখে আসলাম। ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। নিবরাসের জন্য খারাপ হবে না। আর কতদিন বসিয়ে রাখবো? আমার ও তো মন চায় ছেলের বউ দেখতে, নাতিনাতনি দেখতে।

হসপিটাল থেকে এসেছিলো নিবরাস। লিভিং রুমে প্রবেশ করতে কথাটা কানে যায়। তখন মিসবাহ বলে,

-ওই বউমনিটা?

মিসবাহর কথায় মাইশা নওয়াজ মির্জা এবং মরিয়ম নওয়াজ তাকায়। মাইশা জিজ্ঞেস করে,

-কে আবার বউমনি?

-আচ্ছা নানু ওই মেয়েটার নাম কী পাশের ফ্লাটে যে দেখে আসলে?

-মেঘ।

-ওহো! আমার বউমনি। নানু কিছুতেই বিয়েটা ভাঙবে না কিন্তু।

-কেন নিবরাস কী বিয়েটিয়ে করে নিলো নাকী? এই মাইশা মিসবাহ কী বলছে? আমরা জানি না মিসবাহ জানে নিবরাস যে গোপনে বিয়ে করলো।

-আরে আম্মু তুমি বেশী ভাবছো। ও একটা বাচ্চা ছেলে ও কী বুঝবে?

-বাচ্চারা কখনো মিথ্য বলে না।

-তার মানে ভাইয়া বিয়ে করেছে?

মরিয়ম নওয়াজ তো পারে না বিলাপ জুড়ে কান্না করে দেয়। তার একমাত্র ছেলে এটা কী করলো। গোপনে বিয়েও সেরে নিলো। অথচ তাদেরকে জানালো না। একবার বললে কী হতো? সে কী বারণ করতো নাকী? মেয়েটাকে তো তার ও পছন্দ হয়েছে।

মাইশা বিরক্ত হয়। বেশী বিরক্ত হয় মিসবাহর উপর। তার ছেলে এমনিতে চঞ্চল। মুখে লাঘাম কম। কে জানে সত্যি বললো না মিথ্যে বললো?

-আরে আম্মু টেনশন করো না তো। বিয়ে করেছে অন্যায় তো করেনি? আর যা হওয়ার হয়ে গেছে তুমি তাড়াতাড়ি আমাদের ঘরের বউ আমাদের ঘরে তুলে আনো।

মা,বোন,বোনের ছেলের সব কান্ড দেখলো এতোক্ষণ নিবরাস। মিসবাহ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। নিবরাস পারে না মিসবাহর কানের নিচে চারটা দেয়। এই ছেলে তার পেছনে যেভাবে পড়েছে। কোমড় ভাঙা লাউডস্পিকার মেয়েটাকে তার বউ করেই ছাড়াবে।

-হলে হবে বউ। কিন্তু এতো নাটক করার কী আছে? আমি বারণ করতাম নাকী বিয়ে নিয়ে কিছু বললে?

বিরবির করে নিবরাস। ফ্রেশ হয়ে লিভিং রুমে আসে। তাকে দেখে তার মা বলে,

-ও বাড়ী যাবে কবে?

ব্রু কুঁচকায় নিবরাস।
-কে?
-তোমার বউ! এখন ভুলে গেলে?

-আমি কী করে জানবো ও কবে বাড়ী যাবে না যাবে। আর আমি জেনেই বা কী করবো?

ছেলের ত্যাড়া কথায় রাগ হয় মরিয়ম নওয়াজের। ধমকের স্বরে বললেন,

-তুমি কথা বলো না ওর সাথে? কল দিলে জিজ্ঞেস করবে।

-অপরিচিত কারোর সাথে আমি কথা বলবো? আমাকে এমন মনে হয় তোমার? আর ওই মেয়ের নাম্বার আমি কই পাবো?

-মামু তুমি চাইলে আমি এনে দিতে পারি।

-তুমি চুপ থাকে মিসবাহ্ বেশী পাকনামী করছো।

-তুমি চুপ থাকো নিবরাস এক লাইন কম বুঝছো তুমি।

মরিয়ম নওয়াজের ফিরিত কথায় নিবরাস তাকায়। সবাই তাকে ভুল বুঝছে। তার মা না থাকলে মিসবাহকে কম করে দুটো চড় মারতো নিবরাস। তবুও নিজেকে সামলে নেয়।

-আম্মু ওকে আমি চিনিই না ভালো করে। আর মিসবাহ তোমাদের মিথ্যে বলেছে কোন বিয়েটিয়ে হয়নি।

-তাহলে ও বউমনি বলে কেন?

-আমি কী করে জানব? মিসবাহ এর পর থেকে এই নামে ডাকলে থাপ্পড় খাইবা।

-ডাকবে না এই নামে। এখন বলো মেয়েটাকে নিয়ে তোমরা মামা ভাগিনা এতো ইন্টারেস্ট কেন?

-তুমি আর মিসবাহ ই তো ইন্টারেস্ট। কখন শুনেছো ওর নাম মুখে আনতে? মানে চেনা নাই,জানা নাই অপরিচিত মেয়ে নিয়ে জামেলা। হাউ ফানি?

কথাটা বলে নিবরাস উঠে চলে আসে রুমে। বেলকনিতে যেতে কানে আওয়াজ আসলো,

-আর বলিস না কী অদ্ভুত জায়গায় এসে পড়লাম। কানা লোকটা মনে হয় তার মাকে পাঠিয়েছে। মেয়ে দেখলেই হলো! আবার কী বলে জানিস একটা নার্সের সাথে ধাক্কা লাগলো না। এমন ছেলেদের টাইট না দিতে পারলে আমার মনে হয় নারী তুমি ব্যর্থ।

-হ্যাঁ আমি তো এটাই বুঝানো ট্রাই করছি। চলে আসো, বিয়েটা করে নেই। তারপর যা টাইট দেওয়ার দিও। আর শোনো আমার আশেপাশে অনেক সুন্দরী নার্স ঘুরাঘুরি করে চোখ তো একটুআধটু যাবেই। আমার মতো ছেলেকে টাইট না দিতে পারলে নারী তুমি আসলেই ব্যর্থ।

মেঘ পাশে তাকাতে নিবরাসকে দেখে। নিবরাস তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয় মেঘ। তাড়াতাড়ি লিমার কল কাটে।

#চলবে