#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|২১|
#শার্লিন_হাসান
নিবরাসদের বাড়ীতে এসেছে আফরোজা বেগম, আজিয়া বেগম সাথে মহীউদ্দীন তালুকদার। সময়টা বিকেল হয়ে গেছে। নিবরাস সবে হসপিটাল থেকে এসেছে। তাঁদেরকে দেখে সালাম দেয়। মহীউদ্দীন তালুকদারের বেশ পছন্দ হয় নিবরাসকে। ছেলেটা এতো নম্র,ভদ্র। মরিয়ম নওয়াজ ও বেশ মিশুক। তাঁদের কথাবার্তার পাট চুকে ডেট ফিক্সড করা হয় আগামী কাল। আংটিবদল হলেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হবে।
মিসবাহ নিবরাসের পেছন,পেছন রুমে আসে। নিবরাস তাকে পাত্তা দেয়নি। জানে এখন পাকনা কথা বলবে। মিসবাহ পাত্তা না পেয়ে সোফায় বসে। নিবরাস ফ্রেশ হয়ে আসতো তার বকবক শুরু হয়ে যায়।
-মামু বিয়ে ঠিক হতে না হতে আমায় পাত্তা দিচ্ছো না। মামিকে পেলে তো আমায় চিনবাও না।
-তুমি ওভারপাকনা সোনা সেজন্য মামু তোমায় পাত্তা দিচ্ছে না।
-মামু আমি পাকনা না। আমি ইন্টেলিজেন্ট। বুঝো কী?
-ইশশ মিসবাহ সোনা ইন্টেলিজেন্ট শুনেই গর্বে বুকটা ফুলে উঠলো। তা সোনা এতো ইন্টেলিজেন্ট তো তোমার নানুকে বলো বিয়ে নিয়ে এতো হাইপার না হতে।
-একমাত্র ছেলের বিয়ে। মির্জা বাড়ীর ছেলে মুয়াম্মার নিবরাস মির্জার বিয়ে বলে কথা একটু তো এক্সাইটেড হতেই হবে।
নিনরাস তাকায় মিসবাহর কথায়। ছেলেটা আসলেই বেশ পাকনা। ছটফটে! কথা না বাড়িয়ে বেলকনিতে চলে যায় সে। পাশের বেলকনিতে তাকাতে দেখলো খালি পড়ে আছে। পনেরোদিন আগেও মেঘকে দেখেছিলো বেলকনিতে। আর কয়েকটা দিন তারপর তার চোখের সামনেই থাকবে মেয়েটি। মুচকি হাসে নিবরাস।
মিসবাহ ফোনে গেমস খেলছে। তার পেছন দিয়ে তার নানু আসে নিবরাসের রুমে। নিবরাস বেলকনি থেকে আসতে বলে দেয় ডেইট কবে ফিক্সড করবে?
তখন মিসবাহ বলে,
-নানু আগামী কালকে আকদ হয়ে গেলে, দুইদিন পর ডেট দাও। তাড়াতাড়ি মামুর বিয়েটা শেষ করো।
-তুমি পাকনামী কম করো মিসবাহ।
ধমক দিয়ে বলো নিবরাস। সে কথা কানেও তুলেনি মিসবাহ। আজকাল তার মামু তাকে একটু বেশী শাসন করছে। সব হিসাব করে রেখেছে তার বউমনি আসলে সব শুধে আসলে ফেরত দিবে। একবারে নাকানিচুবানি দিবে।
*****
আনায়া রান্না করেছে। মেয়েটা বেশ গুনবতী। খাবার টেবিলে সাজিয়ে তার বাবাকে ডেকে নিয়েছে। জিয়াউর রহমান আসতে দেখলো রুদ্র নেই। আনায়াকে প্রশ্ন করেন,
-জারিফকে ডেকে আনো?
-তোমার জারিফ আমায় ধমক দিবে।
-ধমক দিবে কেন?
-আমি কী করে বলবো? এমনিতে উনি আমাকে দেখলেই ধমকা ধমকি শুরু করে দেন।
জিয়াউর রহমান ডাকে রুদ্রকে। রুদ্র আসে। আনায়ার দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। টেবিলে সাজিয়ে রাখা খাবার গুলোর দিকে একবার তাকায়। বেশ ভালো স্মেল আসছে। বা হাতে ব্যথা পেয়েছে বেশ ভালো করেই। ডান হাত তার ভরসা! কোনরকম খেয়ে মেডিসিন নিয়ে শুয়ে পড়ে রুদ্র। আগে সুস্থ হতে পারলেই বাকীসব দেখা যাবে।
আনায়া খাবার শেষ করে এদিকটা সামনে আইসক্রিমের বক্স নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। সবে এইচএসসি দিয়েছে সে। এখন চিল আর চিল।মাঝেমাঝে বিয়ে করার ইচ্ছে জাগে কিন্তু বলতে পারেনা। যাই হোক এবার পছন্দের মানুষটাকে পেয়ে গেলেই হলো।
চৌধুরী বাড়ীতে শোকের ছায়া। পুলিশ তদন্ত করছে। কিন্তু কোথা থেকে কোথায় গিয়ে রুদ্র উদাও হলো সেটাই তো কেউ জানে না। তারউপর ঢাকার শহর! প্রত্যেকটা অলিতেগলিতে অসংখ্য মানুষ। কে রাখে কার খোঁজ? মেহরাব এসেছে বিকেলে। রুদ্রকে কোথায় খুঁজবে ভেবে পাচ্ছে না।
****
আয়মান তার দলের লোকদের আচ্ছা মতো মেরেছে গতকাল। না মারারই বা কী গেছে? রুদ্র গায়েব হয়ে গেলো অথচ তারা টেরই পেলো না।
কলেজ থেকে ফেরার পথে রুদ্রকে কিডন্যাপ করে তারা। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে চলে যায়। সেখানেই রুদ্রকে মারে। ভেবেছিলো কোন গ্রামে নিয়ে ফেলে দিবে যেখানে কেউ তাকে চিনবেও না। সবাই ভেবেছিলো রুদ্র মারা গেছে। গ্রামের রাস্তায় ঢুকে সবাই চা খাওয়ার জন্য বেড়িয়েছিলো। এর মাঝে রুদ্র গায়েব হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও কেউ খোঁজ মেলাতে পারেনি। আয়মানের মাথা নষ্ট! কে করলো এমনটা? আলিশা? না,না সে তো আর এসবে জড়াবে না নিজেকে।
সাদিয়া বসে আছে সোফায়। আপাতত তাদের কয়েক লাখ টাকার প্রয়োজন। একটা ফ্লাট দরকার থাকার জন্য। কিন্তু কোথা থেকে জোগাড় করে আনবে?
এরই মাঝে কল আসে তাঁদের দলের একজনকে পুলিশ গ্রেফ্তার করেছে। আয়মান কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বাকীদেরকে পালিয়ে আসতে বলে। সমস্যা হলো কেউ মুখ খোললে জামেলা। তারউপর তার তেমন দাপট নেই যে পুলিশকে পকেটে রাখবে।
তবে কয়েকদিন ধরে রাইহান চৌধুরী কে তারা মা ছেলে থ্রেট দেয় প্রোপার্টি তাদেরকে দেওয়ার জন্য। তেমন রেসপন্স পায় না। এই রাইহান চৌধুরী এতে সহজে গলে যাওয়ার মানুষ না।
রাইহান চৌধুরী থানায় গিয়ে সাদিয়া, আয়মানের নামে মামলা করে। প্রোপার্টি তাদের নামে করে দেওয়ার জন্য হুমকি দেয়। সাথে কিছু কল রেকর্ডিং প্রমাণ দেখিয়েছেন তিনি।
****
আগামী কালকে আংটিবদল করতে আসবে মির্জা পরিবার কথাটা মেঘের কানে আসে। তার এই মূহুর্তে সব ছেড়ে ছুঁড়ে রুদ্রর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। খুব করে চাচ্ছে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে মনের সব অভিমান, অভিযোগ, ভালোবাসা,অনুভূতি,আবেগ তার সামনে ঢেলে দিতে। আফসোস পারছে না। বরং ধুঁকে,ধুঁকে মরছে।
চোখের পানি বাঁধ মানছে না। কিছুতেই নিবরাসকে সে বিয়েটা করতে পারবে না। রুদ্রর থেকে অবহেলা পেলে পাবে তাও তার রুদ্রকে চাই। কিন্তু কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। নিজের আত্নসন্মান সব বিসর্জন দিয়ে দিবে?
লিমাকে কল দেয় মেঘ। সাথে,সাথে রিসিভ হতে মেঘ কান্নাভেজা গলা নিয়ে বলে,
-আমি বিয়েটা করতে পারবো না লিমা। আমি মরে যাবো ধুকে,ধুকে। রুদ্রকে এনে দে না প্লিজ। আমার ওকেই লাগবে। ওর থেকে বেটার কাউকে না,আমার শুধু ওকেই লাগবে।
-প্লিজ শান্ত হ! স্যারের তো খোঁজই নেই। সে থাকলে নাহয় বলতাম আমি তাকে।
-আমি এতে অসহায় কেন? ভালোবাসার বিষ পান করে এখন মৃত্যু সজ্জায় আমি।
-প্লিজ নিজেকে কন্ট্রোল কর? তুই বিয়ে ভেঙে দিবি কী বলে?এটা তো আর নয় যে রুদ্র স্যার তোকে চায়।
-এই জায়গাটাতে আমি দুর্বল। শুধু একবার সে আসুক! বলুক মেঘ আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমি বিয়ে ভাঙতে দু’বার ও ভাববো না।
-সে কোথায়? তার তো খোঁজই মেলেনি।
-আমার ভালোবাসা যদি তার প্রতি সত্যিকারের হয়ে থাকে তাহলে ভালোবাসার টানে হলেও সে আসবে। আমার না হোক তবে বেঁচে ফিরে আসবে।
-সিনেমাটিক হয়ে গেলো না কথাটা? এটা বাস্তবতা বোন।
-অনেক সময় অনেক কথা কবুল হয়ে যায়। বলা মুশকিল আল্লাহ কখন কার ডাক কবুল করে নেয়। বুঝলি?
-তাই জেনো হয়। তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুর দরকার নেই।
-তোরা আমার পাশে থাকবি তো?
-হ্যাঁ আমি আর হৃদ সবসময় তোর সাথে,পাশে আছি।
-ভালোবাসি তোদের।
-ভালোবাসি সই।
****
রুম জুড়ে চোখ ভোলাচ্ছে রুদ্র। খুড়িয়ে,খুড়িয়ে হেটে ডায়েরির খোঁজ করছে। উপায়ান্তর না পেয়ে জিয়াউর রহমানের রুমে যায় ধীরে,ধীরে। তখন জিয়াউর রহমান বই পড়ছিলেন। রুদ্রকে দেখে বসতে বলেন তিনি। রুদ্র কোন রকম ভণিতা ছেড়ে বলে দেয়,
-আমার হাতের ব্যাগটা দেখেছিলেন মামু?
-হ্যাঁ আমার গাড়ীতে এখনো পড়ে আছে।
-গাড়ী কোথায়?
-নিচে রাখা আছে।
রুদ্র বাক্যব্যায় না করে নিচে যায়। যেতে সময় লাগলেও সে যায়। গতকাল তো অবহেলায় রাখলো বিষয়টা। আজকে কেনে জানি নিজেকে অপরাধি মনে হলো। কারোর আমানত সে নষ্ট করে দিলো। তবে মনে পরেছে সে ব্যাগটা হাত থেকে ছাড়েনি।
-কলেজ থেকে ফেরার পথে ছোট্ট ব্যাগটা কাধে ভালো ভাবে আবদ্ধ রেখেছিলো। কিছুটা নির্জন জায়গায় আসতে একদল তাকে মুখে কালো কিছু দিয়ে তার মুখ ঢেকে দেয়। অনেক জোড়াজুড়ি করে গাড়ীতে বসায়। সেখান থেকে কয়েকঘন্টা পর কোন একটা জায়গায় নেয় তাকে। হাতে,পায়ে অনেক মারধর করে। মাথায়ও চোট লাগে। মার খেয়ে নিজস্ত হয়ে পড়ে দেহটা। তবে জ্ঞান ছিলো কিছুটা। মাথায় একটা কথাই ঘুরঘুর করেছিলো পালাতে হবে।
সন্ধ্যায় গ্রামের রাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়ে তারা চা খেতে নামে কিছু দূরের দোকানে। গাড়ীর দরজা লক করেনি কেউ। এই সুযোগটাকে কাজে লাগায় রুদ্র। কোনরকম দৌড়ে,হেঁটে অন্ধকারে পেছনের দিকে ছুটে। ভাগ্যক্রমে জিয়াউর রহমানের গাড়ীর সামনে এসে সেন্সলেস হয়ে পড়ে। তারপর কিছুই মনে নেই। কাঁধের ব্যগাটা কাঁধেই ছিল।
গাড়ীর ভেতর থেকে ব্যাগটা নিয়ে খুঁড়িয়ে, খুঁড়িয়ে হেঁটে ভেতরে আসে রুদ্র। খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে। ডায়েরিটা পরবে। ডায়েরির প্রতি জোক বেড়ে যাচ্ছে তার। পরে দরকার হলে মেঘকে সরি বলবে তবুও লোভ সামলাতে পারছে না সে।
আল্লাহর নাম নিয়ে প্রথম পাতাটা উল্টোতে একটা নাম জ্বলজ্বল করছে সেটা আর কারোর নাম না তার নিজেরই নাম। কালো কলম মোটা কালি দিয়ে লেখা,
❝জারিফ আনান চৌধুরী রুদ্র❞
এখন আমার ভালোবাসার মানুষ! নিচে তারিখ লেখা। হয়ত বা পরে লিখেছিলো এই লেখাটা।
রুদ্র হাসে মুচকি হাসে। সে জানতো মেঘ তার প্রতি দুর্বল তবে এবার হাতেনাতেই সে প্রমাণ পেলো।
তার কয়েক পেজে তাকে নিয়ে মেয়েটার সাজানো অনুভূতি মন দিয়ে পড়লো রুদ্র।
-তারিখ দিয়ে নিচে লেখা,
আজকে একজনের দেখা পেলাম। এই আমার প্রথম ক্রাশ,প্রথম বালো লাগা তাও কোন ছেলের দিকে নজর গেলো। সেটা আর কেউ না আমারই নতুন টিচার জারিফ আনান চৌধুরী রুদ্র স্যার। হ্যাঁ তার টোল পড়া হাসিতে আমি ফেসেছি। তার কথা বলার ধরণটাও আমায় ফিদা করলো তার প্রতি। এই এতো সুন্দর হয়েও সে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই মেশে সবার সাথে। সুন্দর নাহ্ ব্যপারটা? সত্যি সুন্দর! অবশয় সুন্দর হতেই হবে। মেঘের ফাস্ট ক্রাশ বলে কথা। মেঘের মতোই হতে হবে।
পরে আরেলটা তারিখ দিয়ে লেখা,
-তাকে দেখতে আমার ভালো লাগে। প্রেমে পড়ে গেলাম তো! কিন্তু তার সামনে আমার জুতা ছিঁড়ে গেলো। এটা হওয়ারই কী ছিলো? এই টেবিলটাই যত সমস্যা! না,না টেবিলের দোষ দেবো কী? এই লোকটা সেই সময় লাইব্রেরিতে আসার জন্য গেলো? কী লজ্জাজনক ব্যপারস্যাপার।
এই পেজটা পড়ে রুদ্র হাসে। মনে পড়ে সেদিনের কথা। মেয়েটা টেবিলের সাথে উষ্ঠা খেয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলো। জুতা ছিঁড়েছে কী না রুদ্রর ওতো খেয়াল নেই। তবে ডায়েরি পড়ে বুঝলো জুতা ছিঁড়েছে। শব্দ করেই হাসে রুদ্র।
কত দিন পর মন খুলে হাসলো সে। এই চঞ্চল মেয়ের লেখাগুলোই তাকে হাসালো। আচ্ছা কথা গুলো লেখা মেয়েটা যদি সারাজীবনের জন্য তার হাসির কারণ হয় তাহলে কী মন্দ হবে? সে তো একজনকে ভালোবেসে ঠকলো! বিপরীত আরেকজন তাকে ভালোবাসা জানার পর তার কী উচিত সেটায় সাড়া দেওয়া? মেয়েটা তো তাকে চায়? তাহলে হোক প্রণয়! সব বাঁধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সে হয়ে যাক চঞ্চল মেয়েটার। তাকে কেউ ভালোবাসবে মন্দ কী তাতে? সেও নাহয় ভালোবাসবে দ্বিতীয়বারের মতো সুন্দর হবে গল্পটাও। ভালোবাসার বাঁধনহীন সেই বাঁধন অকারণ, প্রণয়ে পরিনত হবে।
#চলবে
#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|২২|
#শার্লিন_হাসান
তার। পরের পেজে যেতে যে লেখাটা চোখ পড়লো রুদ্রর। সেটা হচ্ছে,
-স্যার আমায় চ’ড় মারলো। এই লোক এতো তেতো কেন? ওনার বউয়ের পোড়া কপাল হবে! পান থেকে চুন খসলে চড় দিতে দু’বার ও ভাববে না। আমার গুলো মুলো গালটা শেষ। যত্তসব অঘটন তার সামনেই ঘটে কেন? আমার মুখটাও দেখো! শিস বাজাতে এই ক্রিয়েটিভ তার সামনে প্রকাশ না করলেই ভালো হতো।
হাসে রুদ্র। হ্যাঁ চড়টা জোরেই মেরেছিলো সে। তার পরের পেজে যেতে চোখ পড়লো,
-রুদ্র স্যার আমার বেয়াই হয়ে গেলো। কী সিনেমাটিক ঘটনা। আগে খোঁজখবর নিলে হয়ত বা জানতে পারতাম রাখি আপুর ভাই সম্পর্কে। যাই হোক! উনার গফ আছে শিওর হলাম। আরেহী আর উনার দাদীন বললো যে! ইশ আলিশা আপু কত লাকি উনাকে পাবে। এমন লাকি যদি আমি হতাম। থাক,
❝ পরের জন্মে জন্মানের সুযোগ হলে ঠিক ততোটা ভাগ্যবতী হয়ে জন্মাতে চাই, যতটা ভাগ্যবতী হলে তাকে আমার করে পাবো। একান্ত আমার! শুধুই আমার।❞
~মেঘ
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রুদ্র। আলিশার কথা ভাবলে তাচ্ছিল্য হাসি টানে ঠোঁটে। যাকে সবটা দিয়ে অন্ধর মতো ভালোবাসলো অথচ ভালোবাসা পেলো না। ধোঁকা ছাড়া! সেখানে আরেকজন তাকে আড়ালে ভালোবাসতো। তাকে পাবেনা জেনেও ভালোবাসতে তাকে কী করে হারায় রুদ্র?
কয়েক পেজে তাকে নিয়ে মেঘের অনুভূতি লেখা। তাকে লুকিয়া দেখা,তার কথা বলার ভঙ্গি মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা। সে একদিন অনুপস্থিত থাকলে মেঘ পাগলের মতো তাকে খোঁজা। সেই সাথে কক্সবাজারে কাটানো কিছু মূহুর্তের কথাও লিখা। সে যখন আলিশাকে প্রপোজ করেছিলো তখন মেঘ অনেকটা হার্ট হয়। তবে সহ্য করে নেয়।
ডায়েরির প্রতিটা পাতাই রুদ্রকে নিয়ে সাজানো অনুভূতি থাকলেও কয়েকটা পেজ নিবরাস নামের কাউকে নিয়ে লেখা। রুদ্রর হিংসে হচ্ছে প্রচুর। তাকে নিয়ে সাজানো অনুভূতির মাঝে নিবরাস আসলো কোথা থেকে? ইচ্ছে করছে পেজ গুলো ছিঁড়ে টুকরো, টুকরো করে দিতে। নিজেকে কিছুটা শান্ত রেখে পড়ায় মনোযোগ দেয় রুদ্র।
-রুদ্র স্যার আমার লাভ আর যার সাথে আমার বিয়েটা ঠিক হলো বা হচ্ছে নিবরাস! সে আমাকে বিয়ে করবে ঠিক আছে তবে সবসময় আমার রেসপনসেবলিটিতে থাকবে কখনো ভালোবাসতে পারবো না। আমার কিছু করার ও নেই! না বিয়েটা ভাঙার মতো কোন লজিক নেই আমার কাছে। আর রুদ্র স্যার তো আমায় চায় না যে পরিবারকে বলবো, আমি রুদ্র স্যারকে ভালোবাসি। তাকে বিয়ে করবো এমনকি সেও আমায় বিয়ে করবে। আমি অসহায়! নিজের অনুভূতি, ইচ্ছে,আকাঙ্খা,চাওয়া-পাওয়া সবকিছুতে। আমার শখের পুরুষকে বিসর্জন দিয়ে দিলাম। সেই সাথে নিজের সব চাওয়া-পাওয়া স্বপ্নকেও বিসর্জন দিয়ে দিলাম। ইশ! আমার অনুভূতি পড়ে আপনি আসুন না আমার কাছে? আমার চোখের ভাষা,মনের চাওয়া কিছুই কী আপনি বুঝতে পারেন না? নাকী আমায় অনুভব করতে পারেন না। আমি আপনাকে ভালোবাসি! আপনাকে চাই! একটি বার এসে বলুন মেঘ আমি তোমায় বিয়ে করবো! আমার হবে তুমি? বিশ্বাস করুন আমি কোন বাঁধাই পরোয়া করতাম না আপনার ডাকে সাড়া দিতে। অথচ আমি অসহায়! ত্যাগ করা ছাড়া কোন রাস্তা নেই। রুদ্রকে জীবন থেকে মাইনাস করে নিবরাসকে জীবনে প্লাস করে নেবো। তবে আমার মনে সবসময় রুদ্র স্যার থাকবে।
“ভালোবাসি ছায়া মানব রুদ্র। আমার শখের পুরুষ আপনাকে আমি ভালোবাসি।”
রুদ্র ডায়েরি টা রেখে দেয়। আপাতত একটা চিন্তা মাথায় ঘুরছে। মেঘের বিয়ে ঠিক? কিন্তু কবে বিয়ে? সে যেতে,যেতে কী বেশী লেট হয়ে যাবে? মেঘকে চমকে দিতে চায় রুদ্র কিন্তু কীভাবে? যদি আগামী কালকে মেঘের বিয়ে হয়ে থাকে? না তাহলে তো সব শেষ। রুদ্র সাত পাঁচ না ভেবে আনায়ার রুমের দিকে যায়। আনায়া তখন বই পড়ছিলো। রুদ্র নক করতে ভেতরে আসার অনুমতি দেয়।
রুদ্র ভণিতা ছেড়ে বলে দেয়,
-আপনার ফোনটা একটু দেওয়া যাবে? ইমার্জেন্সি কল করব।
আনায়া ফোনটা রুদ্রকে দেয়। রুদ্র ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে আসে রুম থেকে। ফাইজা চৌধুরীর নাম্বারে কল দেয়। কয়েক সেকন্ডের মাঝে কল রিসিভ হতে রুদ্র বলে,
-দাদীন আমি রুদ্র।
ফাইজা চৌধুরী অস্থির কন্ঠে জবাব দেয়,
-আমার রুদ্র তুমি কোথায়? এভাবে উদাও হলে কেন?
-দাদীন তুমি আগামী কালকে তালুকদার বাড়ীতে যাবে।
-যাওয়ার তো কথা ছিলো। কিন্তু আগামী কালকে কেন?
-গিয়ে সোজা মায়ের বালা জোড়া পড়িয়ে দিবে। বলবে সন্ধ্যায় বিয়ে হবে।
-কিন্তু এতো তাড়াহুড়োর কী আছে?
-তাড়াহুড়ো করবো না তো কী করবো? তুমি চাও মেঘকে অন্য কেউ বিয়ে করুক? আমি বসে,বসে আঙুল চাটবো? তুমি পারলে এক্ষুনি যাও গিয়ে বলে আসো আগামী কালকে বিয়ে হবে।
-এখন তো অনেক রাত হয়ে গেলো। তুমি এতেটা অস্থির হইয়ো না।
-তাহলে কল দাও। কল দিয়ে বলো আগামী কালকে তুমি যাবে, আংটি পড়াবে। সন্ধ্যায় বিয়েটা হবে।
-আচ্ছা আমি নাহয় বলবো। কিন্তু তুমি এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেন?
-দাদীন তুমি বুঝতে পারছো না। বিয়েটা না হওয়া অব্দি আমার শান্তি নেই।
হাসে ফাইজা চৌধুরী। তার নাতি আদৌ তখনো কোন বিষয়ে এতো উত্তেজিত হয়েছে কীনা জানা নেই। এই রু্দ্র জেনো দিনদিন নিজেকে নতুন করে প্রকাশ করছে। খুশি হয় ফাইজা চৌধুরী তার মনে হয়, মেঘই পারবে রুদ্রকে কিছুটা পরিবর্তন করিয়ে আনতে। বাকীটা উপরওয়ালার ইচ্ছে।
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-রাখি আছে তোমার কাছে?
-হ্যাঁ আছে তো।
-ফোনটা দাও তো।
ফাইজা চৌধুরী রাখির কাছে ফোনটা দেয়। রাখি নিজেকে কিছু সামলে, “হ্যালো” বলে। রুদ্র প্রথমে খোঁজখবর জিজ্ঞেস করে রাখির। পরে বলে,
-মেঘের বিয়ে ঠিক হয়েছে?
-না হয়নি শুনেছি আগামী কালকে আংটিবদল হবে।
-কার সাথে?
-নিবরাস, মুয়াম্মার নিবরাস মির্জা। পেশায় ডক্টর। ওনার সাথেই।
-আচ্ছা কল দিয়ে বলে দাও, ‘ নিবরাসের সাথে বিয়েটা হবে না রুদ্র আসছে আগামীকাল। সন্ধ্যায় রুদ্রর সাথেই বিয়েটা হবে।’
-কিন্তু কথাবার্তা তো হয়ে গেলো ওখানে।
-কিছুই হয়নি। দাদীনকে নিয়ে আগামী কালকে যাবে আর আমি যা বলেছি তাই করবে। আমি আগামী কালকে বাড়ী ফিরছি।
-এখন তুমি কোথায় ভাইয়া?
-মামুর বাড়ীতে। আগামী কালকে এসে সব বলবো।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
রুদ্র বায় বলে কল কেটে দেয়। আনায়াকে ফোন ফেরত দিয়ে আসার সময় জিজ্ঞেস করে,
-ডক্টরের নাম জেনো কী?
-মুয়াম্মার নিবরাস মির্জা।
-ওনার বিয়ে ঠিক হয়েছে নাকী?
-শোনলাম হলো। আগামী কালকে আংটিবদল।
-ওহ্! তা বিয়েতে যাবেন না আপনি?
-না আসলে…
-তাকে পছন্দ করেন?
আনায়া চোখ বড়বড় করে তাকায়। তার জানা মতে রুদ্র ইন্ট্রোভার্ট এখন ইন্ট্রোবার্ট এক্সট্রোভার্ট কোন ভার্টই আনায়ার বিশ্বাস হচ্ছে না। আনায়াকে চুপ থাকতে দেখে রুদ্র বলে,
-মামুকে বলতে পারছেন না?
-আরে বিষয়টা এমন না। উনি আমার ব্রো!
-ব্রো র ‘ও’ টা ‘আর’ এর জায়গায় বসালে কিন্তু বর হয়ে যায়। সো…!
-আপনি বেশী ভাবছেন না?
– ইউ নো হুয়াট, ভাইয়া ক্যান বি সাইয়া, সাইয়া। এখন মামুকে বলে আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
-আপনিও তো আমার ভাইয়া। তো এখানে আপনি যেভাবে বলছেন, সেই হিসাবে আপনাকেও আমার সাইয়া বানানো যায়ই।
-পর পুরুষের দিকে নজর দেওয়া ঠিক না। আমি আরেকজনের জন্য ফিক্সড করা।
-নজর দেইনি জাস্ট লজিক দেখালাম।
রুদ্র জবাব দেয়না। প্রস্থান করে নিশব্দে। আপাতত বিয়ে না করা অব্দি তার শান্তি নেই। নিজেকে অন্যরকম ভাবে প্রকাশ করে ফেললো না সবার সামনে?
-এই আবেগীমেয়ের জন্য গম্ভীর ছেলেটা উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। যা এর আগে কখনো হয়নি।
****
ফাইজা চৌধুরী মহীউদ্দীন তালুকদারের সাথে কথা বলে নেয়। অনেক বুঝানোর পর মহীউদ্দীন তালুকদার রাজী হোন। সে তো রুদ্রর জন্য রাজীই ছিলো। কিন্তু মাঝখানে আজিয়া নতুন কাউকে আনলো। শুধু আফরোজা বেগমের জন্য নিবরাসের জন্য মেঘকে দিতে রাজী হয়েছেন। কিন্তু এর আগে যে ফাইজা চৌধুরীকে হ্যাঁ বলেছেন সেটা তার মাথায় থাকলেও আফরোজা বেগম বেমালুম ভুলে গেছেন।
মহীউদ্দীন তালুকদার সময় ব্যয় না করে মরিয়ম নওয়াজের কাছে কল দেন।
খোঁজখবর জিজ্ঞেস করে বলে দেন,
-দেখুন আমাদের মেঘ তো অনেক ছোট। আর ওর বিয়েতে মত নেই। আমরা ওর মতের বিরুদ্ধে বিয়েটা দেবো না।
মরিয়ম নওয়াজ আর কিছু বলেন না। তখন মহীউদ্দীন তালুকদার বলেন,
-বালা জোড়া আগামী কালকে পাঠিয়ে দেবো।
-আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আপনার মেয়েটা আমার পছন্দের ছিলো।
-সমস্যা নেই। মেয়ে মানুষ কত জনই দেখবে, পছন্দ করবে। বললে তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। নিবরাস বাবার জন্য এর থেকে ভালো মেয়ে পাবেন। দোয়া রইলো নিবরাসের জন্য।
-ধন্যবাদ। মেঘের জন্য ও দোয়া রইলো। মেয়েটা সবসময় হাসিখুশি থাকুক।
কল কাটতে মরিয়ম নওয়াজ বিষয়টা মাইশাকে জানায়। মিসবাহ শুনে স্যাড হয়। তার মামুর রুমে গিয়ে মামুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-মামু তোমার কোমড় ভাঙা লাউডস্পিকার অন্যকারোর জীবনে স্পিকার হয়ে গেলো।
-ভালো তো মামু। তুমি নিজে বেশী লাফালাফি করেছো। আমি বলেছিলাম তো অপরিচিত কাউকে বউমনি বলবে না। আর না কোন বিষয় নিয়ে বেশী এক্সপেকটেশন রাখবা।
-স্যরি মামু। আমি স্যাড হয়েছি। মেঘ আন্টি তোমায় ধোঁকা দেয়নি দিয়েছে আমায়। আমার মামুর বউ হবে বলে অন্য জনের মাইন হয়ে গেলো?
-আমি কবে বললাম মেঘ আমার বউ হবে?
-বলোনি তো! আমি বানিয়েছিলাম। মামু তোমার বিয়েটা কী হবে না?
-হবে মামু আল্লাহ যেদিন লিখে রেখেছে।
****
পরের দিন সকালে রাখিকে, অন্তিকে নিয়ে শপিং মলে যান ফাইজা চৌধুরী। মেঘের জন্য শাড়ী,থ্রি-পিস সাথে তার তরফ থেকে গিফ্ট হিসাবে গোল্ডের ব্রেসলেট কিনে নিয়েছে। রাখি,অন্তি মিলে কিছু জুয়েলারি, সাথে টুকটাক কসমেটিকস কিনে সেখান থেকে প্যাক করে নেয়। নয়টায় এসেছিলো শপিংমলে। সব ঠিকঠাক করতে,করতে সাড়ে দশটা বেজে যায়। সেখান থেকে রওনা হয় তালুকদার বাড়ীর উদ্দেশ্য। মেহরাবকে রাখি কল দিয়ে সব বলে দেয়। মেহরাব ছুটি নিয়েছে স্কুল থেকে। আড়ংয়ে এসেছে মহীউদ্দীন তালুকদারের সাথে। সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের জন্য বাজার করে নেয়। যেহেতু সব গরোয়া ভাবে হবে তবুও চাপ কম না। মেঘকে এই বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।
এগারোটা বাজে তালুকদার বাড়ীতে আসেন ফাইজা চৌধুরী। মেঘ তখন সব রুম পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। নতুন চাদর বেছানো সাথে টুকটাক কাজ। পরনে তার গোলাপী রংয়ের থ্রিপিস। ফাইজা চৌধুরী মেঘকে দেখে এক গাল হাসেন। মেঘ কনফিউজড সব কী হচ্ছে? আজকে নিবরাসদের আসার কথা অথচ অন্য সব দিনের মতোই কাটছে। বরং সব আস্তেধীরে গোছ গাছ করা হচ্ছে। তারউপর অসময়ে ফাইজা চৌধুরী, অন্তিকে দেখে সন্দেহ হয় মেঘের। কিন্তু রুদ্র তো নেই। এমনকি তার খোঁজ ও মেলেনি। ড্রাইভার একের পর এক ঢালাগুলো ট্রি-টেবিলের উপর রাখে। ফাইজা চৌধুরী বসে মেঘকে কাছে ডাকে। আফরোজা বেগম নাস্তা নিয়ে এসেছেন তখন। মুচকি হেঁসে বালা জোড়া পড়িয়ে দেন মেঘের হাসে। সেই সাথে ব্রেসলেট টাও। অন্তি একটা রিং পড়িয়ে দেয় মেঘের অনামিকা আঙুলে। মেঘ তাকায়। কী সব হচ্ছে বুঝতে পারছে না। আরিশের আম্মু তাকে রিং পড়ালো তার মানে নিনরাস রুদ্র সব বাদ শেষমেশ আরিশের সাথে তার বিয়েটা হতে যাচ্ছে?
#চলবে