বিয়ে পর্ব-০২

0
1070

#বিয়ে
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

ধ্রুব নিজের ওপর চরম বিরক্ত। কিভাবে ও মায়ের ইমোশনাল কথা শুনে এই বিয়েটা করতে গেলো? নিজের মেয়ে নেই বলে শায়লা চিরকালই ধ্রুবকে বিয়ে দিতে চেয়েছে। যাতে করে পুত্রবধূর মাধ্যমে নিজের মেয়ের শখটা পূরণ করতে পারে। কিন্তু ধ্রুব কখনোই চায় নি তার মায়ের ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিয়ে দিতে। আর কারো কাছে দায়বদ্ধ থাকাও ওর চিরজীবনের অপছন্দ। অদ্রিদের ওখান থেকে বেরিয়ে এসে ধ্রুব’র নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। এতক্ষণ রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে বসেছিলো। যখনই বিয়ের ব্যাপারটা মাথায় আসছে মাথার ভেতর দপদপানিটা বাড়ছে, নিজেকে সামলাতে না পেরে রাগে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে ঘুসি মারতেই ড্রাইভার যতীন আঁৎকে ওঠে বলল,
— ভাইজান গো, পায়ে ধরি। আমার এই সুন্দরীরে আফনে মাইরেন না। এত দামী পেট্রোল ভরি, তিনবেলা যত্ন করি নিজের সন্তানের মতো। আফনে নিজের রাগ দেখাইয়েন না আমার সুন্দরীর ওপর। এতক্ষণ তো আফনে চালাইছেন, এহন দেন আমি চালাই।
ধ্রুব প্রচন্ড বিরক্ত হলো। রেগে বললো,
— যত্তসব জোকারি আচরণ। এই, তোমাকে আমার সাথে আসতে বলেছি আমি? তোমাকে পিছু পিছু মা’ই পাঠিয়েছে তাই না? আমাকে একাও থাকতে দিবেনা কিছুক্ষণ। লাইফটা শেষ হয়ে গেলো আমার।
যতীন হেসে বলল,
— রাগ কইরেন না ভাইজান। জোর কইরা বিয়ে দিলে প্রথম প্রথম অত রাগই লাগে। বাসরঘরে যখন বউয়ের মুখ দেখবেন তহন সব রাগ পানি হইয়া যাইবো।
ধ্রুব দাঁত চেপে বলল,
— যতীন তুমি বিয়ে করেছো?
যতীন শুনে লজ্জা পেলো। মাথাটা নিচু করে মিটিমিটি হেসে বলল,
— না ভাইজান। পরের বছর ট্যাহাপয়সা জমলে করুম।
আমার আবার ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে বউ আনবার শখ। হাতে তলোয়ার থাকবো, নিজেরে রাজা মনে হইবো। ভাবসাবই আলাদা। আফনের অমন রাজকীয় বিয়া না হইলেও কিন্তু আফনে সবদিক দিয়েই জিতছেন ভাইজান।
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে বলল,
— কি রকম?
— আফনের কোনো শালি নাই। শালি থাকলে মহাযন্ত্রণা। আবার ভাবিজানও খুবই সুন্দর মাশাল্লাহ! মুখ দেইখাই কইবার পারি ভাবি কম কথা কয়।
ধ্রুব হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না। বলল,
— মুখ দেখেই বুঝে গেলে? তুমি এইসব এক্সপেরিয়েন্স কিভাবে পেলে?
–জীবনে কত বিয়া খাইসি গো ভাইজান। মাইনষের বিয়া দেখতে দেখতে সব মুখস্ত হইয়া গেসে। আফনে আর রাগ না কইরা দেন আমিই গাড়িটা চালাই। নতুন জামাইয়ের একটা ভাবসাব আছে না?
ধ্রুব যতীনকে চুপ করাতে বলল,
— দিচ্ছি, বাট আর একটা কথাও যাতে না শুনি।
যতীন ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল,
— শেষ আরেকটা কথা কই?
ধ্রুব হতাশ হয়ে বলল,
— কি?
— নতুন ভাবিজানরে ফোন দিয়া একটু প্রেমালাপ শুরু করেন। এহন তো আফনেরা বিবাহিত, কেউ কিছু কইবো না। আফনের রাগও পানি হইয়া যাইবো।

ধ্রুব আর নিজের রাগকে সামলাতে পারলো না। যেখানে ও বিয়েই করতে চায় না, সেখানে ও নাকি প্রেমালাপ করবে। হাউ রিডিকুলাস! এইসব জোকারকে তার মা শায়লা কোথা থেকে যে জোগাড় করে ধ্রুব ভেবে পায় না। যতীনকে জোরেসোরে একটা ধমক দিতেই যতীন চুপ হয়ে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো। গাড়ি চলছে বাড়ির পথে। অন্ধকার আকাশে গোলাকার চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে ধ্রুব মনে মনে ভাবলো, এই মেয়েটার মাঝে কি এমন দেখলো যে মা ওকেই সিলেক্ট করলো? হুহ! কথা কম বা বেশি বলুক ধ্রুব তো কখনোই মেনে নেবে না এই ফালতু মেয়েকে। উহু! কখনোই নয়।

ওদিকে শায়লা আজই অদ্রিকে নিয়ে যেতে চান।
জামিউল সাহেব তাতে রাজি হলেন যদিও তার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। সাথী বেগমের পিড়াপীড়িতেই অবশেষে তিনি বাধ্য হলেন। অদ্রি বিদায়ের সময়ও বাবার দিকে তাকালো না। শায়লা হাসান বিষয়টি লক্ষ্য করলেন কিন্তু কিছু বললেন না। ড্রাইভার যতীন ধ্রুবকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার ওদের নিতে এলো। গাড়িতে বসে অদ্রি চুপচাপ বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে শায়লা ওকে জিজ্ঞেস করল,
— মন খারাপ?
অদ্রি হাসার চেষ্টা করে বলল,
— না তো।
— আমি জানি। তবে মন খারাপ করিস না। তুই করে বললে কি রাগ করবি?
অদ্রি মাথা নেড়ে বলল,
— একদম না।
আশফাক সাহেব সামনের সিট থেকে হেসে বলে ওঠলেন,
— শোন, আমরা ছেলের বউ না মেয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তোর কোনো অযত্ন করবো না। আমাদের মেয়ে নেইতো, মেয়ের শখ পূরণ করবো বুঝলি?
পাশ থেকে যতীন হেসে বলল,
— স্যার আফনে তো শ্বশুর হইয়া গেলেন। এইবার তো মানেন যে আফনার বয়স হইসে? বুড়া হইসেন?
আশফাক সাহেব ধমকে ওঠলেন,
— এত বড় কথা? মাত্র মেয়ের বাবা হলাম আর তুই বলিস আমি বুড়ো? চড়িয়ে তোর দাঁত ফালাবো। শোনে রাখ, এই আশফাক হাসান এভারগ্রিন পুরুষ। এখনো কত মেয়ে এমনকি তোদের ম্যাডামও আমাকে দেখে ক্রাশ খায়, তাকিয়ে থাকে।
শায়লা রেগে স্বামীকে বললেন,
— সব মেয়ের দিকে যে তোমার নজর পড়ে থাকে সেটা দেখি, তোমাকে না।
অদ্রি হেসে ফেললো তাদের ঝগড়া দেখে। আশফাক সাহেব মিইয়ে গেলেন স্ত্রীর কাছ থেকে ঝাড়ি খেয়ে।
এত সহজসরল মানুষ অদ্রির খুব ভালো লাগে। এত অল্প সময়েই অদ্রিকে কীভাবে আপন করে
নিলো তারা!
শায়লা অদ্রির দিকে তাকিয়ে বললেন,
–ছোটবেলায় তোর মাকে কথা দিয়েছিলাম যে নিজেদের ছেলেমেয়ে হলে তাদের একসাথে বিয়ে দেবো। যাতে আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় হয়। কথা তো রাখলাম কিন্তু রুবি আর দেখে যেতে পারলো না!

শায়লা হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আশফাক সাহেব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কেশে ওঠে বললেন,
— ধ্রুব কি বাড়িতে না বাইরে?
যতীন উত্তর দিল,
— বাড়িতেই আছে। অনেক রাইগা আছে গো স্যার। ভাইজানে না জানি কি কান্ড ঘটায়!
আশফাক সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— কি আর ঘটাবে? চেঁচামেচি করবে, করুক। আরে বাবা বিয়ে তো সবাইকেই করতে হয়। আমিও করেছি। একটামাত্র ছেলে আমার। আমাদের কি শখ-আহ্লাদ নেই? আমরা কি নাতি-নাতনির মুখ না দেখেই দুনিয়া ত্যাগ করবো নাকি? বিয়ে করেছিস বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবি তা না ব্যাটা নিরামিষ বাড়িতে বসে রাগে ফুলছে! এই প্রথম নিজ চোখে দেখলাম বউ রেখে বর পলাতক!
শায়লা হাসান বললেন,
— হুহ, আমাদের বিয়ের দিন বাসররাতে তুমিও তো আমার ভয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে পালিয়ে ছিলে, ভুলে গেছ? ছেলে তো তোমারই মতো হবে।

মুহূর্তেই হাসির রোল পড়ে গেল গাড়িতে। আশফাক সাহেব লজ্জা পেলেন। যতীন আর শায়লা বিভিন্ন মজার কথা বলতে লাগলো যাতে অদ্রি একটু সহজ হয় তাদের সাথে। আর অদ্রিও খানিকটা সহজ হয়ে এলো সবার সাথে। ওর মনেই হলো না ও অপরিচিত কারো সাথে কোথাও যাচ্ছে! এভাবেই বাড়ি ফিরতে তাদের প্রায় নয়টা বেজে গেলো। বউ বরণ করবে এই খুশিতে অদ্রিকে দরজায় দাঁড় করিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকতেই আশফাক সাহেব ও শায়লা দেখলেন ধ্রুব অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। মুখচোখ লাল! আশফাক সাহেব আর শায়লা বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে বরণের জিনিসপত্র এনে বরণ করলো অদ্রিকে। ড্রাইভার যতীন হৈ-হুল্লোড় করে স্বাগত জানাচ্ছে নতুন বউকে। ধ্রুব বিষয়টি দেখে রাগে ফুঁসতে লাগলো। আশফাক সাহেব চুপচাপ রইলেন। ছেলেকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে ওরা অদ্রিকে নিয়ে শায়লা উপরতলায় চলে গেলো। ধ্রুব বাবা-মায়ের কান্ড দেখে হতবিহ্বল। নতুন মেয়ে পেয়ে কি মা তাকেই ভুলে গেল? যে আস্ত ধ্রুবকে সে খেয়ালই করলো না? মায়ের এটা আবার কোন চাল? ধ্রুব তবুও অপেক্ষা করতে লাগলো। একসময় ধৈর্যহারা হয়ে সে ওপরে গেলো। মায়ের ঘরে গিয়ে টোকা দিতেই আপনাআপনি দরজা খুলে গেল। অদ্রিকে দেখে হতভম্ব হয়ে নিচুস্বরে বলল,
— আমি কিছু দেখিনি।
অদ্রি চেঞ্জ করছিলো। শাড়ির পিন খুলে খুলে রাখছিলো ঠিক তখনই দরজা খুলে ধ্রুব ঢুকে পড়লো। অবাক হওয়া ভুলে আগুন চোখে তাকালো অদ্রি। দ্রুত শাড়ি আঁচল মেঝে থেকে কুড়াতে কুড়াতে বলল,
— চোখ খোলা রেখে বলছেন কিছু দেখেন নি?
আমাকে বোকা ভাববেন না। সব ধান্ধাবাজি জানি আমি।
ধ্রব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— তুমি কি ভেবেছো তোমার জিনিসপত্র দেখতে এসেছি? ধ্রুব এসব দেখে না।
অদ্রি বলল,
— তাইতো বেহায়ার মতো এখনো দাঁড়িয়ে আছেন। বেরিয়ে যান। নয়তো এক্ষুনি আন্টিকে ডাকবো।
ধ্রুব রেগে গেল,
— আমার বাড়িতে, আমার মায়ের ঘরে দাঁড়িয়ে আমাকেই হুমকি দেওয়া? বেশি সাহস!
অদ্রিও ছাড়ার পাত্র নয়,
— নিজের বাড়ি বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন?
বিদেশে বড় হয়ে লাজলজ্জা সব বিসর্জন দিয়েছেন নাকি? যে একটা মেয়ের চেঞ্জ করা দেখতে এলেন?
ধ্রুব রেগে বলল,
— চেঞ্জ করার সময় দরজা লক করতে হয় এটুকু কমনসেন্স নেই তোমার?
অদ্রি এগিয়ে এসে ধ্রুবের মুখোমুখি দাঁড়ালো। তারপর কঠোর গলায় বলল,
— আছে।

বলেই ওর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো। ধ্রুব বাক্যহারা হয়ে গেলো। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে ধ্রুব’র। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। না চাইতেও সে যে চেঞ্জ করা দেখে ফেলেছে এটা বললে বোধহয় মেয়েটা ওকে খু’নই করে ফেলবে! কিন্তু এই ধ্রুবকে চোখ রাঙানোর সাহস করে কি করে এই মেয়ে? ধ্রুব’র বউ বলে?

[ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি, মন্তব্য জানানোর অনুরোধ রইলো।]

চলবে….